মৃত মেয়ের গল্প (পর্ব- এক)

সৌহার্দ্য ইকবাল
উপন্যাস, ধারাবাহিক
Bengali
মৃত মেয়ের গল্প (পর্ব- এক)

শীতের বিকেল

এই গল্পটা একটা খুব সাধারণ মেয়ের গল্প। চার বছর আগের এক শীতের বিকেলে, আমার সাথে আলাপচারিতায় মেয়েটা তার এই গল্প বলে। আজ অনেকদিন পরে কাকতালীয়ভাবে তার সাথে দেখা হবার পর সে এই গল্পের ইতি টানে। কোন দ্বিধা ছাড়া। আমার কাছে এটা ছিল একটা পেইন্টিং সম্পূর্ণ করার মত, আর্টিস্ট আজ ক্যানভাসে শেষ পোঁচ ধারালোভাবে দিয়ে গল্প’টা শেষ করে। চার বছর আগের গল্প’টাও আজকের পর সম্পূর্ণ লাগছিল। টানা চার বছর পর তার সাথে দেখা হয়েছে, ব্যাপারটা এমন না। বছর দুয়েক আগে হয়েছিল শেষ দেখা, মেয়েটার সাথে তখন এই গল্প নিয়ে কথা হয় নি।

গল্পের শুরুতেই আমি বলেছি মেয়েটা’কে সাধারণ, এতে কি গল্পের কোন সূত্র দেয়া হয়ে গেল ? এটা কি মেয়েটার জীবনের গল্প ? এটা মেয়েটার জীবনের গল্প নাকি তার সাথে ঘটে যাওয়া গল্প কিংবা এই ‘ঘটে যাওয়া’ আর সম্পূর্ণ ‘জীবনের গল্প’র মাঝে অন্তরঙ্গ সম্পর্ক কতটুকু, আমি আসলে খুব নিখুঁতভাবে বলতে অপারগ। এই গল্প বলতে গিয়ে মেয়েটা কিছু কিছু জায়গায় বেশ বর্ণনা দিয়ে যাচ্ছিল চারপাশের, একসময় বুঝতে পারি যে সে ঘটে যাওয়া ব্যাপারগুলোর কিছু সে নিজ চোখে দেখছে। যেমন, সপ্তম পরিচ্ছেদে আপনি পড়বেন যে সে বাংলাদেশের একটা গ্রামের রান্নাঘরের বর্ণনা দিচ্ছে। এই বর্ণনা এত সুন্দরভাবে দেয়া যে, সেখানে আমি নিজেই উপস্থিত হয়েছিলাম বলে মনে হয় এখনও। এছাড়া তার অনুমতি নিয়েই এই গল্পের স্কেচ আঁকছিলাম নোটবুকে, সেই স্কেচে ডিটেইলস তো আছেই, তবে আমি চেয়েছি তার অবস্থানে দাঁড়িয়ে সবকিছু দেখতে। যাকগে, এখানে ব্যক্তিগত একটা তথ্য দেই, খানিকটা শখের লেখালেখি থেকে সিরিয়াস লেখায় ঝোঁক চাপে সেই সময়, মেয়েটার গল্প দারুণ একটা প্লটও দেয় আমাকে কিন্ত সময়ের অভাবে কখনও এই গল্প বলতে পারি নি। এছাড়া প্রথমেই বলেছি, গল্পটা আমার কাছে সম্পূর্ণ মনে হয়েছে এতদিন পরে।

চিত্র: রিয়া দাস

মেয়েটা, মানে তানিয়া’র সাথে পরিচয় করিয়ে দেই আপনাদের। পাসপোর্ট ছবিতে আমি যখন তানিয়া’কে প্রথম দেখি, আমি নিশ্চিতভাবেই তাকে অনেক পরিচিত মুখ বলে মনে করেছিলাম। হারিয়ে যাওয়া পাসপোর্ট ফেরত দিতে গিয়ে তার সাথে আমার পরিচয়, প্রথমদিন তার সাথে আমার দেখা হয় ঢাকার আজিমপুরে। এই গল্পটায় ঘটে যাওয়া অনেক কিছুই ঘটে সেখানে। প্রথমদিন আমার সাথে তার এই গল্প নিয়ে কোন কথা হয় নি, সত্যিটা হল যে তার সাথে আমার আর দেখা হবার কথাই না। কিন্ত হয়েছে। যাই হোক, তানিয়ার পরিচয় দেই এবার ভূমিকা বাদ দিয়ে। তানিয়ার সাথে যখন পরিচয় হয়, সে বাংলাদেশের মোটামুটি স্বনামধন্য এক বিশ্ববিদ্যালয় থেকে মাস্টার্স শেষ করেছে বায়োলজিক্যাল সায়েন্স ফ্যাকাল্টি থেকে, এখন বায়োকেমিস্ট হিসেবে ফার্মাসিউটিক্যাল কোম্পানি’তে চাকরি করছে। বাঙালি মেয়েরা ছেলেদের মুখ দেখেই অনেক কিছু ভাবতে পছন্দ করে, এতদিন পরে মনে হচ্ছে যে তানিয়াও ঠিক এর ব্যতিক্রম ছিল না। সে রিক্সা থেকে নেমে সোজা আমার দিকে খুব পরিচিত ভঙ্গিতে এগিয়ে আসে, যেন পাসপোর্ট হারানো না, সে বাসায় ফেলে এসেছে এবং আমি নিয়ে এসেছি অফিসিয়াল কাজে। সে এগিয়ে এসে বলল আমি চা খেতে চাই কিনা। আমি তাই তার সাথে চা খেতে গেলাম, মেয়েটা শ্যামলা মুখ’টা বড্ড মসৃণ, চুল ছেড়ে দেয়া – মনে হয় বাঁধতে অপছন্দ করে সে। চোখের পাপড়ি খানিকটা সলজ্জ ভাব এনে দিয়েছে তবে সেটা চোখে পড়ে না আচরণে সাবলীলতার কারণে। তার খোলা চুল মসৃণ গলার দুপাশে গভীর ঝরনা হয়ে ছিল। সে ছিল সাদা একটা ফতুয়া আর নীল জিন্সের প্যান্টে, অন্য কোনভাবে তাকে মানাতো না সম্ভবত, এই চায়ের দোকানের সামনে। এই রাস্তার মোড়ে।

প্রথমদিন তানিয়া’র সাথে চা খাবার পর যখন বিদায় নিব, আমাদের আলোচনা কেন যেন ক্যারিয়ারের দিকে ঘুরে গেল। আমি তাকে বললাম যে আমি প্রায় বেকার, অন্যদিকে লেখার চেষ্টাও করছি একটা গল্প কিছুদিন থেকে। তানিয়া’র ঠোঁটের কোণে হাসি দেখা যায়। সে ছুটির একদিন বিকেলে একটা গল্প শোনার আমন্ত্রণ জানায়, আমার ‘না’ বলার কোন কারণ ছিল না। তাই এক শীতের বিকেলে, চার বছর আগে, আমি তার বাসায় নোটবুক নিয়ে চলে আসি এবং গল্প নোট করতে করতে চরিত্রদের স্কেচ করতে শুরু করি।

দুই.

এক মৃত সন্ধ্যে

একটা করে মাথার খুলি সে ফাটায় বিশাল আকৃতির দা দিয়ে আর থরথরিয়ে কেঁপে কেঁপে ওঠে সে। সারা দেহ রক্তে ভিজে আছে, কালচে রক্তে ভেসে গেছে সারা ঘর। ভয়াবহ মাত্রার একটা নোংরা তোষক পড়ে আছে আর সেখানে সে তার দেহ এলিয়ে দিল। ক্লান্তি ভর করেছে তার সারা শরীরে। এই ঘরে প্রবেশ করে না মানুষরা, এটা জল্লাদ কিংবা মানুষখেকো’দের ঘর। সারা ঘরে একটা মাত্র জানালা, তাও বন্ধ আর রুমে টিমটিম করে জ্বলছে ষাট ওয়াটের একটা বাল্ব। সেই বাল্বের চারপাশে এত ময়লা আচ্ছাদিত যে সেটা’কে ছোটখাট ঝুলন্ত হারিকেন ভেবে ভুল হয়। একটা আরাম কেদারা আছে যা মনে হয় বসতে গেলেই পুরোপুরি ভেঙে পড়বে; পুরো রুম ঘোলাটে নীল কিন্ত পচে-গলে যাওয়া গন্ধে তা ঘোলাটে….।

রুমে কি নেই, প্রায় গোটা দশেক মাথার খুলি, খুব বেশি পুরনো হয় নি, আবার এর মাঝে দুটো ঠিক খুলি না – চুলসহ আস্ত দুই মাথা। এই দুটো মাথা পাশে থাকা দুইটা মানুষের শরীরেরই অংশ, যদিও তা যে মানুষের দেহ, তা চিনতে ভুল হয়; কোনটারেই মাথা নেই আর দুই পা একেবারে রেস্টুরেন্টে ওয়েটার’দের দেয়া ফালি ফালি করা চিকেন রোলের মত… একটা শরীর থেকে মনে হয় মাংস খুবলে খুবলে নেয়া হয়েছে – বুকের ডান পাশে আদতে কোন মাংসই নেই – দেখে মনে হতে পারে যে কেউ নিখুঁত খাবলা দিয়ে পেস্ট্রি কেকের মত নরম মাংস তুলে নিয়েছে। সেই ক্ষত যেন কালো একটা জলাধার, সেখানে নিশ্চয়ই আণুবীক্ষণিক প্রাণীরা কলোনী স্থাপন করেছে যেভাবে আমরা মাটি খুবলে নেই পৃথিবী থেকে। আরেকটা মৃতদেহ এখনও মসৃণ, খানিকটা আঁচ করা যায় যে এই দেহের যে অধিকারী – সে সুন্দরী কোন তরুণী ছিল।পা নেই এই লাশটির’ও। খুব বেশি হলে ৪৮ ঘন্টা এই মৃতদেহের “মৃত” অবস্থার সময়কাল,এখনও তেমন পচে নি। লাশটি’র দিকে তাকালে প্রথমেই যে জিনিসটা চোখে পড়ে তা হল নাভির চারপাশে অনেক কালশিটে দাগ। যাকগে আমরা পোস্টমরটেম লিখতে চাই না। তাই অন্যকিছু বলার চেষ্টা করি…এই সময় আটকে যাওয়া একটা মাঝারী সাইজের রুমে, যদিও এক কোণে একটা বুকসেলফ আছে, তাতে কোন বই নেই। আরেক কোণে পড়ে আছে সেই তোষক, যেখানে “সে” ক্লান্ত ভঙ্গিতে মাথায় হাত দিয়ে শুয়ে আছে। আমরা তার নাম জানি না, তাই তাকে এভাবেই, “সে” বলেই সম্বোধন করছি।

সে এবার উঠে দাঁড়ায়, এবার একটা খুব ধারালো ছুরি হাতে নেয় ( যা বুকসেলফে ছিল কিন্ত আমাদের চোখ এড়িয়ে গ্যাছে) এবং তরুণীটির দেহে আশ্চর্য নিখুঁত ভাবে কাটতে থাকে – প্রতিটা হাড়ের জয়েন্ট যেন সে চিনে। সে আত্মমগ্ন হয়েই কাটছে। পুরো রুমের আলো হুট করে কমে আসছে, মনে হয় ভোল্টেজ কমে গেল… যাহ, কারেন্ট চলে গ্যাছে। বাইরে এখনও দিনের আলো, যদিও প্রায় সন্ধ্যা, কিন্ত এই রুমে আলো প্রবেশের কোন সম্ভাবনা নেই। “সে” কি করছে আমাদের তা বোঝার উপায় নেই এখন আর… এই তো সে খুঁজেপেতে একটা মোম জ্বালিয়ে ফেলেছে, কিন্ত এটাও কি আমাদের চোখ এড়িয়ে গ্যাছে ? মোম আমরা দেখি নি এই রুমে একটু আগে, এটা কোথা থেকে আসলো নাকি আমরা কিছু জিনিস দেখতে পাই নি ? মোম’টা সে মেঝে’তে রাখে, উবু হয়ে নগ্ন নারীদেহের পিছনের চামড়া ছিলতে থাকে মসৃণ চাকু দিয়ে, ফলের রসের মত রক্ত ঝরবে মনে করেছিলাম, সেরকম কিছু হল না কিংবা এত অল্প আলো’তে আমরা দেখতে পাচ্ছি না ভাল করে। সে আবার হতশ্রী তোষকে ফেরত যায় আর তোষকের নিচ থেকে একটা সিগারেট বের করে তা জ্বালায় মোমবাতি’র আলো দিয়ে। দুই টান দিয়েই সে কাশতে শুরু করলো, সে যেন এতে বিরক্ত হল – তীব্র দৃষ্টি দিল সিগারেটের জ্বলে থাকা অংশ’টার দিকে তাকিয়ে। এবার সে নিশ্চিন্ত হল কিভাবে যেন, খানিকটা সচেতন ভঙ্গি করে টান দেয়। আমরা মোমের আলো’তে তাকে দেখি খানিকটা কিংবা বলা যায় অনুমানের চেষ্টা করি; ভদ্রলোক বলতে ইচ্ছে হচ্ছে তাকে কারণ তার চোখে তীব্র বুদ্ধির আর অভিজ্ঞতার একটা ছাপ; কোথায় যেন পড়েছিলাম যে একটা বয়সের পরে মানুষের চেহেরায় তার কর্মজীবনের ছাপ পড়তে থাকে। এই ভদ্রলোক’কে দেখে মনে হচ্ছে সে ক্রিয়েটিভ কোন কাজে যুক্ত, সম্ভবত কোন ফার্মে। অবশ্যই তার মুখে খোঁচা খোঁচা দাঁড়ি ছিল এবং তা মনে হয় যত্ন করেই কাটা – দুই পাশের চিপ সমান এবং মনে হয় বেশ পরিচর্যা হয় সেখানে। তার বিশাল বুদ্ধিদীপ্ত চোখের মাঝে জায়গা করে নিয়েছে নিখুঁত লম্বা নাক, প্রশস্ত ফর্সা কপালে আঁচড়ে পড়েছে কাল চুল; সুগঠিত কাঁধ।

সে এবার উঠে দাঁড়ায়, সিগারেট ফেলে দেয় ছড়িয়ে থাকা রক্তে।এবার খানিকটা মমতা নিয়েই যেন তরুণী মেয়েটার শরীর ফালি ফালি করতে থাকে। মসৃণ একটা মৃতদেহের ভেতরটা তরমুজের মত লালচে লাগছে মোমের আলোয়। আসলে এটা আমাদের কল্পনা’ই বলব – মোমের আলো’তে আমরা খুব বেশি ভালভাবে পর্যবেক্ষণ করতে সমর্থ হচ্ছি না, তাই এইরকম খানিকটা বাস্তবতার ফানুস উড়িয়ে দেবার মত কথা বলি হয়তো আমরা।অনুমান নির্ভর।

লাল মাংস দেখে যেন সে মায়া বোধ করে মেয়েটার প্রতি কিন্ত সেটাকে সে আসলে প্রশ্রয় দিতে আগ্রহী নয়, ব্যাপারটা অনেক’টা এমন যেন সে একটা স্রেফ পেশাদারী কশাই – মাংসের হাঁটে ভাল মাংস বিক্রি করার জন্যে কষ্ট করে মাংস কাটছে।

তিন.

আনিতা

আনিতা লোকাল বাসে একজন অপরিচিত পুরুষের সাথে প্রায় গা লেপ্টে দাঁড়িয়ে আছে। কিছু করার নেই – সব বাস’ই এইরকম অবস্থা অফিস আওয়ারের পর। শান্তিনগর থেকে আজিমপুরে আসতে তার সময় লেগে যাবে কম করে হলেও আজকে দুই ঘন্টা। কিছু করার নেই। তনু’র পরীক্ষা শেষ, আজকে বাসায় ফিরেই ওকে নিয়ে বাইরে খেতে যাবার কথা, কোন অজুহাতের সুযোগ নেই। মা হিসেবে প্রমিজ রাখাটা ওর কর্তব্য। বাসে দাঁড়িয়েই সে ফোন করলো বাসায়। হ্যাঁ – তনু’র গলায় উচ্ছাস – আজকে বাইরে না খেলে এই মেয়ে কষ্ট পাবে এবং যদিও আনিতা’র মাস শেষে হাত প্রায় খালি – তার কিছু করার নেই। তনু’র অনেক শখ’ই সে রাখতে পারে না, এইটুকু বাচ্চা হলেও সে মোটামুটি বুঝে নিয়েছে যে তাদের মা-মেয়ের সংসার কতটা টানাপোড়েনের।

এখন শীতের সন্ধ্যা প্রায়, কিন্তু সে ঘেমে উঠছে। মানুষগুলো আস্তে করে শ্বাস ফেলছে জ্যামে। সে ক্লান্তভাবে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল; মানুষের দীর্ঘশ্বাসের নাক যেন লম্বা, আর সেই নাক যেন ঘেমে উঠছে – আনিতা’র হাসি পায়। গাড়ির চোয়াল ধরে থাকা হেল্পার হাঁক দেয় বাঁয়ে টানার, লাভ হয় না। কিছু মানুষ এমনি এমনিই গালি দেয় কথা বলার অজুহাতে। তনু বেশ বলতে পারে অনুকরণ করে ডায়লগগুলি। একদিন বাসভর্তি মানুষের সামনে ছয় বছরের একটা খুকী যদি গম্ভীরভাবে সমালোচনা করে কেমন হয় ?! মনে হয় না খুব খারাপ হবে, সবার জন্যেই বিনোদন হবে। মানুষজন ওকে তাৎক্ষণিকভাবে ভালবাসবে। যে ছেলেটা সারা রাস্তায় চিন্তায় মগ্ন থাকবে অন্য কোন জগত নিয়ে, সে কিছু না বললেও শুনে আরাম পাবে। মানুষের তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়া পাওয়া সহজ কিন্তু তাৎক্ষণিক ভালবাসা পাওয়া কঠিন! অবশ্য ক্ষেত্রবিশেষের ব্যাপার আছে। আনিতা’র মনে হল তার সাথে দাঁড়ানো এই দুই-তিনটা মানুষ’কে সে যদি বলে বাসের সিটে জায়গা দিতে, তারা মনে হয় জায়গা দিবে স্রেফ মহিলা বলে।

আনিতা এবার একটা মহিলা সিট পেল। আরেকটা মহিলা দাঁড়ায় ছিল, সে সুযোগ না দিয়ে সোজা বসে পড়লো। গায়ে লেপ্টে থাকা পুরুষের হাত থেকে রেহাই আপাতত জরুরী। বড্ড জরুরী দরকার! আনিতা এবার আরাম করে বসে, আরও ঘন্টা দেড়েক লাগবে। চোখ বন্ধ করতে কি মনে করে মোবাইল দিয়ে ফেইসবুকে ঢুকলো। ঢুকেই দমে গেল। অনেকগুলো নটিফিকেশনে বোঝাই। মেইলও আছে কয়েকটা। ভাল লাগল না – নিশ্চয়ই ট্যাগে ভর্তি ! যা ভেবেছিল তাই, ছবি থেকে শুরু করে তরুণ উঠতি কবি’র কবিতা – সবখানেই লাইকের’ উদ্যত আহ্বান। না পড়েই সে একের পর এক লাইক দিতে থাকে। ছবি না দেখে হোমপেজে সে লাইক দেয়, এটাও আজকাল অফিসের না বলা ইস্যু। পঞ্চাশ পেরোনো বৃদ্ধ’ও ‘লাইক’ চায়। দুই-তিনদিন পর পর সে ঢুকে লাইক দেয় আচ্ছামত। যেন কেউ মনে না করে সে অসামাজিক ! চাকরি’তে তার পজিশন এমন সাবমিসিভ হয়ে থাকা না, কিন্তু মানুষের জটিল কথাবার্তা ভেঙে সে সহজে বুঝে নিয়েছে একই কমিউনিটি’তে থাকলে “লাইক” মাস্ট ! বসের ছবি’তে লাইক সবচেয়ে বেশি। এই লোক’টাকে সবাই নিশ্চয়ই ঘেন্না করে, দাঁতে দাঁত চেপে লাইক দেয় ! তার সবচেয়ে ছোটভাই আরিফ বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র। সে একদিন বলেছিল যে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের ছবি’তে কোন গ্ল্যামার বা পোস্টে কিছু না থাকলেও লাইক দেয় সে। এটা নাকি কার্টেসী। ভাল, খুব খুব ভাল। সময় নষ্টের কারখানা’তে বসে থাকলে এমন’টা তো মনে হবেই ! কি প্রজন্ম রে বাবা !

হুট করে আনিতা’র চোখে পড়ে জরুরী লেখা একটা পোস্টে।

“জরুরী –

আমি আমার এক পা হারিয়েছি সড়ক দুর্ঘটনায়। কোন সাহায্য বা করুণা চাইছি না আপনাদের কাছে। দয়া করে আমাকে কেউ ম্যাসেজ করে দুঃখ দিবেন না।“

আনিতা’র মনে পড়ল একজন ফেইসবুক সেলিব্রেটি। এটাও স্ট্যাটাস ! সে অফ করে ফেলে ফোনের ব্রাউজার। কোন মানে হয় না। আনিতা এবার ঘুমিয়ে পড়ে, গাড়ি তখন শাহবাগের জ্যামে আটকা। চোখ খুলে নিজেকে ঢাকা কলেজের সামনে স্থির অবস্থায় সে দেখতে পেল। সব অস্বাভাবিক চুপচাপ মনে হয় তার এত মানুষের মাঝে। জ্যামে গাড়িটা দাঁড়িয়েই আছে। হাতঘড়ি’তে সাড়ে সাত – আড়াই ঘন্টা লেগে গেল প্রায়। নির্বিকারভাবে সে দেড় ঘণ্টা ঘুমিয়েছে। এটা কি স্রেফ আজকের অফিসের ক্লান্তি নাকি টেনে নিয়ে যাওয়া জীবনটার ? টাকা-পয়সার কষ্ট’টা বড্ড লাগে তার আজকাল। আর সহ্য হয় না। ফ্ল্যাট বদল করে আরও কম ভাড়ার ফ্ল্যাটে, পুরান ঢাকার দিকে যাবে সে ? না, থাক। তনু’র স্কুলের এত কাছের ফ্ল্যাট ছাড়ার মানে হয় না… আর তনুর বাবার একটা স্মৃতিও…। ছোট দুই ভাই-বোন পড়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে, ওরা নিজের’টা চালিয়ে নেয়। বড় ভাই তার সংসার নিয়ে এত ব্যস্ত যে মা’কেই ভুলে গিয়েছে। মাঝে মাঝে আমেরিকা থেকে কিছু ডলার আর রঙিন ছবি পাঠায়। তিন-চার মাসে একবার। তার ধারণা নেই যে এই টাকায় এখন আর কিছুই হয় না তিনচার মাসে। এই টাকা দেখে লজ্জায় লাগে আনিতা’র। কিন্তু ছেলেপাগল মা ওই টাকা দেখেই জল ফেলে আর আনিতা তার জন্যে ফার্মেসী থেকে ঔষধ কেনে নিজের পার্স থেকে। অবশ্য ফ্ল্যাটের ভাড়াটা কাভার হয়ে যায়। আনিতা’র খুব ইচ্ছে মা’কে নিজের এই ছোট্র ফ্ল্যাটেই আনতে, আরিফ আর আরশি তো হলে থাকলেই পারে ! কিন্তু মেয়ের বাসায় থাকতে তার গায়ে লাগে, ছেলের ভাড়া দেয়া ফ্ল্যাটেই আছে সে। আর আনিতা আবার বিয়ে করবে না আর এটা জানার পর যে মা তার সাথে কথা বলছে এটাই বা কম কি… হায় বাঙালি নারী!

আনিতা বাস থেকে নামে। সংসারের এসব অক্টোপাশের ব্যাপার ছেড়ে সে হেঁটে যায় গলি ধরে। ঝুপ করে শীত নেমেছে, গলি দিয়ে হাঁটতে গিয়ে তার মনে হয় শেষপর্যন্ত নিজেকে সুখী। বেঁচে থাকার মাঝে আনন্দ আছে। তনু’কে জাপটে ধরার মাঝে আনন্দ আছে। তনু’কে স্কুলে দিয়ে অফিসে যাবার মাঝে আনন্দ আছে। অফিসে চুপচাপ বসে তনু’র বাবার কথা মনে করাতে আনন্দ আছে। লোকাল বাসে উঠে তর্ক করে আসলে দুই টাকা কম দিতে পারার মাঝেও আনন্দ আছে। চারপাশে আনন্দ কম নেই। স্বার্থপরের মত একটু খুঁজে নিতে হয় অন্যদিকে অতো না ভেবে। যদি কিছু করার থাকে আরেকটু ভালভাবে বাঁচার, সে চেষ্টা করবে, এই তো !

 ( চলবে…)

ক্যানাডার ডালহৌসি বিশ্ববিদ্যালয়য়ে এক্সপেরিমেন্টাল বায়োফিজিক্‌স-এর গ্রাজুয়েট স্টুডেন্ট।  দেশে স্নাতক পর্যন্ত পড়াশুনা করেছেন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থবিদ্যা বিভাগে। ২০১৬ সালের এপ্রিলে উচ্চশিক্ষার কারণে দেশের বাইরে যাওয়া। ব্লগার হিসেবে পরিচয় খুবই সামান্য, ২০১২-২০১৪ সাল পর্যন্ত মাঝে মাঝে মুক্তমনা, নবযুগ, আমার ব্লগ ও সামহোয়ার ইন ব্লগে লিখেছেন। একাডেমিক...

এই বিভাগের অন্যান্য লেখাসমূহ