মেঘেদের নীল মেখে ভিজি সোঁদা ঘ্রাণে

ইসরাত জাহান
ছোটগল্প
Bengali
মেঘেদের নীল মেখে ভিজি সোঁদা ঘ্রাণে

আজকের সন্ধ্যাটা থমকে যাওয়া মেঘেদের। ঝিরিঝির বৃষ্টি ছিল দিনভর। ঢাকা শহরের পথঘাট জল কাদায় মাখামাখি। প্রচন্ড গরমে নাভিশ্বাস। এরই মধ্যে যেতে হবে বসের ছেলের বিয়ে পরবর্তী অনুষ্ঠানে। বরযাত্রীতে যেতে পারিনি কারণ অফিসের কাজে সে সময় আমাকে নেপাল থাকতে হয়েছিল। তাই আজকের অনুষ্ঠানে যেতেই হবে। বস বারবার করে বলে দিয়েছেন।

বিয়ের অনুষ্ঠানে যাব বলে সারাদিন ধরে প্রস্তুতি নিলাম। ছুটির দিন বলে ঝিরিঝিরি বৃষ্টি উপেক্ষা করে বিউটি পার্লারে গিয়ে হেয়ার স্পা ও ফেসিয়াল করালাম।
সন্ধ্যায় আয়নার সামনে সাজতে এসে ভাবলাম, শাড়ি পরব আজ। অথচ আলমারি খুলে একটিও মনের মত শাড়ি খুঁজে পেলাম না।
ভীষণ রাগ হচ্ছিল নিজের উপর। আলমারি বন্ধ করে দিয়েছি প্রায়……. হঠাৎই চোখের কোনে আকাশ নীল রঙ খেলে গেল ঢেউ। আলমারির আধ বন্ধ করা পাল্লা আবার খুলি পুরোপুরি। অনেক নতুন শাড়ির ভিড়ে উঁকি দিচ্ছে সাদা পাড়ের কলকি তোলা আকাশ নীল জামদানি শাড়ি। বের করে নাকের কাছে নিই। কি আশ্চর্য! এখনও সেই গন্ধ! পুরোনো গন্ধ! প্রথম প্রেমের স্পর্শের মাদকতা এখনও নাকে লাগছে দিব্যি।

এই শাড়িটি মেহুল আমাকে দিয়েছিল কোন এক শ্রাবণের বৃষ্টিতে ভিজে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের পিচ ঢালা পথ ঘিরে দাঁড়ানো গাছেদের আড়ালে। মোটা কাগজের প্যাকেট ভেদ করে শাড়িটিও সেদিন ভিজে গিয়েছিল।
মেহুল বলেছিল, ওর স্কলারশিপের টাকায় কেনা এই শাড়ি। কত আবেগ, কত প্রেম, কত উচ্ছ্বাস, কত পাগলামি ছিল সেদিন মেহুলের কন্ঠে।
মেহুল আর আমি সেদিন সেই শ্রাবণের বৃষ্টিতে ভিজেছিলাম খুব শুধু মনে নয় শরীরেও। আমরা দুজনেই বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তাম সি,এস,ই তে (CSE= Computer Science and Engineering) ।

তারপর……….
মেহুল চলে গেল ইংল্যান্ডে হায়ার স্ট্যাডি করবে বলে। প্রথম বছর যোগাযোগ করত নিয়মিত চিঠি লিখে। পরের বছর কমতে থাকে চিঠির সংখ্যা, কমতে থাকে অক্ষরের আনাগোনা। বছর দুই পরে আর চিঠি নেই ………নেই যোগাযোগ।

এসব কেন ভাবছি? দেরি হয়ে যাবে তো! তাড়াতাড়ি আয়নার সামনে এসে সাজ শেষ করি। মিতসিবিসি ল্যান্সার এভ্যুলেশন টেন অপেক্ষা করছিল আমি ওর স্টিয়ারিং ছোঁব বলেই। ঝিরিঝির বৃষ্টি, জল কাদার শহরের বিরক্তি, চরমে ওঠা যানজটে যুদ্ধ করে পৌঁছলাম ঢাকা সেনানিবাসের সেনা মালঞ্চের দোতলায়।
ভীষণ সুন্দর করে সাজিয়েছেন জায়গাটা আমার বস। স্বীকার করলাম মনে মনে। একমাত্র ছেলের বিয়ে পরবর্তী অভ্যর্থনা অনুষ্ঠান বলে কথা!
কত মানুষ! কত রঙ! কত ফুলের গন্ধ! লাউড স্পিকারে মৃদু মৃদু আওয়াজে গান! সত্যিই দারুণ আবহ।

হঠাৎই সোরগোল। ঐ যে বর-বৌ এসে গেছে! চারিদিক থেকে ক্যামেরাম্যানরা ছুটে এলেন। লাইট-ক্যামেরা- অ্যাকশন। ডানে তাকান—বামে সরে আসুন—-ভাইয়া ভাবিকে একটু জড়িয়ে ধরুন—–ভাবি একটু হাসুন—-কত কত শব্দ-বাক্যের ফুলঝুরিতে আমি যেন একটু আড়াল খুঁজি। কিন্তু চাইলেই কি সব পাওয়া যায়?
সব আলো একটু একটু করে আমার দিকেই আসছে। ভাবছি এখানেই থাকি তবে। বর-বৌ কে দেখাও হয়ে যাবে।
বর-বৌ আসছেন দৃপ্ত পায়ে পা ফেলে। দুজনের হাত দুজনকে ছুঁয়ে। দুজনের মুখে ভুবন ভোলানো হাসি। সেই হাসির ঝলকে আলোকিত সেনা মালঞ্চের সব আলো ম্রিয়মান হতে হতে নিভে যাচ্ছে যেন।

মেহুল! হৃদস্পন্দন অনিয়মিত হল কি আমার কয়েক সেকেন্ডের জন্য?
এভাবেও মেহুলকে দেখব আমি?
লাল-সোনালি জারদৌসি কাজের শেরোয়ানি চুড়িদার পরিহিত মেহুল বর বেশে নতুন বৌ এর হাত ধরে এগিয়ে আসছে আমার দাঁড়িয়ে থাকা পথের রেখা ধরে।
মেহুলের চোখ জুড়ে এত এত খুশি উপচে পড়ছে যেন। সেই খুশির আলোতে নিজেকে বড্ড ম্লান মনে হল আমার। দৌঁড়াতে দৌঁড়াতে ফিরে আসি গাড়ির কাছে। তাড়াতাড়ি গাড়ি স্টার্ট দিয়ে বেরিয়ে আসি সেনা মালঞ্চ থেকে।

কিভাবে কোন পথ দিয়ে এসেছি জানি না। তবে নিজেকে আবিষ্কার করি বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের সবুজ পাতাদের গাছেদের ভিড়ে পিচঢালা পথে। নেমে আসি গাড়ি থেকে। ঝিরিঝিরি বৃষ্টি বাড়ছে ক্রমশ…………।
সাদা পাড়ের নীল জামদানি শাড়িটা আগেও ভিজেছিল এই পথে হেঁটে শ্রাবণের বৃষ্টিতে। তবে তা অল্পই। আজও ভিজবে প্রগাঢ় প্রেমের উপচে পড়া মেঘেদের নীল কষ্ট হয়ে একবারে জবজবে হয়ে।

ইসরাত জাহান। কবি। জন্ম বাংলাদেশের পাবনা জেলার ঈশ্বরদী। বর্তমান নিবাস ঢাকায়। তেরোবছর বয়স থেকে লেখালিখি শুরু। লেখা শুরু করেছিলেন দৈনিক বাংলার বাণীর মাধ্যমে। তারপর দৈনিক আজকের কাগজে নিয়মিত লেখালিখিতে ছিলেন। এরপর হঠাৎ করে বারোবছর লেখালিখি থেকে স্বেচ্ছা নির্বাসন। প্রকাশিত বই: 'তোমার...

এই বিভাগের অন্যান্য লেখাসমূহ