মেঘে ঢাকা গল্প

নাঈম খান
অণুগল্প
Bengali
মেঘে ঢাকা গল্প

মানুষের জীবনটা খুবই অদ্ভুত । সাধারন মানুষ এবং একজন সেলিব্রেটির জীবনটা যে কতটা অদ্ভুত সেটা কেবলমাত্র সেলিব্রেটিরাই বলতে পারবে । একজন মানুষ যেভাবে তার জীবন-যাপন করতে পারে, একজন সেলিব্রেটি সেভাবে পারেনা ।তাদেরকে অনেক কিছু মাথায় রেখে চলতে হয় । বলতে পারেন তারা দুটি জীবন-যাপন করে, একটি মিডিয়া জীবন আরেকটি নিজের জীবন । আসলে তাদের নিজের জীবন বলতে কিছু নেই । তাদের যা আছে সেটা হচ্ছে অভিনয়, একটা সকলের সামনে এবং আরেকটা আড়ালে নিজের জীবনের সাথে ।  আমিও সেইভাবে ছিলাম । কিন্তু ঘটনা যেহেতু অনাকাঙ্খিত, তাই আমার জীবনের একটি অনাকাঙ্খিত ঘটনা বদলে দিয়েছিলো আমার জীবন । আমি তখন কক্সবাজারে শুটিং এর কাজে ছিলাম । শুটিং শেষে রুমে বিশ্রাম নিচ্ছি, হঠাৎ দরজায় জোরে জোরে কড়াঘাত পরলো । আমি বিরক্ত হলাম এই ভেবে, কলিং বেল থাকতে দরজায় জোরে আঘাত করাটা কোন ধরনের ভদ্রতা । কিন্তু দরজা খুলে আমি হতভম্ব হয়ে দাঁড়িয়ে রইলাম ।একটা মেয়ে আমার কাছে অটোগ্রাফ নিতে এসেছে । এইজন্য আমি হতভম্ব নই যে মেয়েটি আমার কাছে অটোগ্রাফ নিতে এসেছে । হতভম্ব এজন্য যে জীবনে অনেক অটোগ্রাফ দিয়েছি, কিন্তু এই মেয়েটি যেভাবে অটোগ্রাফ চাচ্ছে তা আমি জীবনেও কল্পনা করতে পারিনি । মেয়েটা একটি কাগজ হাতে দাঁড়িয়ে, আর তাতে বড় করে লেখা “আমাকে অটোগ্রাফ দিন”, আমি আপনার একজন বড় ফ্যান । কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকার পর মেয়েটিকে রুমে এসে বসতে বললাম । নাম জিজ্ঞাসা করায় মেয়েটি আবারো কাগজে লিখতে শুরু করলো । কাগজটি আমার হাতে দিলো, আর তাতে লেখা অনন্যা । মানে মেয়েটির নাম অনন্যা । মেয়েটির নাম তার রুপের সাথে মানিয়ে নিয়েছে, মেয়েটি দেখতে সত্যিই অনন্যা । মেয়েটি আমার দিকে ঢ্যাপঢ্যাপ করে তাকিয়ে আছে । আমি বললাম- কিছু বলবেন? মেয়েটি আবারো কাগজে লেখা শুরু করলো, আর তাতে লেখা- অনেক কিছু বলার ছিলো, কিন্তু কিছুই বলতে পারলাম না । অযথা আপনাকে বিরক্ত করলাম, আজ আসি তাহলে । মেয়েটি মুচকি হেসে চলে গেলো । আমি কতক্ষণ বসে রইলাম, আর ভাবতে লাগলাম মেয়েটি আমাকে বোকা বানাতে এসেছিলো নাকি । একটি কথাওতো মেয়েটি বললো না । পরেরদিন শুটিং স্পট এ দেখলাম মেয়েটি দাঁড়িয়ে আমার শটগুলো খুব মনোযোগ দিয়ে দেখছে । আমি ঠিকমতো শট দিতে পারলাম না, বার বার মেয়েটির দিকে তাকাচ্ছিলাম । ভালো লেগেছিলো বলে নয়, গতকালের ঘটনার কথা ভেবে তাকাচ্ছিলাম । শট শেষ করে গতকালের ঘটনার বিষয়টা স্পষ্ট করতে আমি মেয়েটির কাছে যেয়ে বললাম- কেমন আছেন? মেয়েটি আজও কথা না বলে হেসে দিয়ে চলে গেলো । পাশে থাকা মেয়েটি আমাকে বলল- ভাইয়া কিছু মনে করবেন না । ও আমার বন্ধু, জন্ম থেকেই বোবা, কথা বলতে পারেনা । আপনার সাথে কথা বলতে পারবেনা বলেই লজ্জা পেয়ে এমনভাবে চলে গেলো । মেয়েটিকে সেদিনের প্রথম দেখাতেই ভালো লেগেছিলো । আর আজকের এই কথা শুনে মেয়েটির প্রতি এক অদ্ভুত ধরনের মায়া জন্মেগেলো । সেই মেয়েটির কাছ থেকে জানতে পারলাম,আমি যে রিসোটে আছি ওরাও নাকি একই রিসোটে উঠেছে । সন্ধ্যাবেলায় হঠাৎ দেখতে পেলাম মেয়েটি রিসোটের ওয়েটিং রুমে একা বসে আছে আর এদিক ঐদিক তাকাচ্ছে । আমি ভাবলাম মেয়েটিকে একটা সারপ্রাইজ দেওয়া যাক । আমি রিসিপশন থকে কাগজ-কলম নিয়ে মেয়েটির সামনে কাগজ হাতে দাঁড়ালাম । আর তাতে লেখা- আমি কি আপনার পাশে বসতে পারি? মেয়েটি মাথা নেড়ে সন্মতি জানালো, আর আমিও দেরি না করে বসে পরলাম মেয়েটির পাশে । আপনি কি আমায় খুজছিলেন? মেয়েটি আমার প্রশ্নে খানিকটা ইতস্তবোধ করলো । আমি বললাম- খুশি হননি আমি বসাতে । মেয়েটি আমার হাতে থেকে কাগজ নিয়ে লিখলো- খুশি হয়েছি, আর আমি আমার বান্ধবীকে খুজছিলাম। আমি বললাম- কেন? আমাকে ভয় পাচ্ছেন। মেয়েটি আবার লিখলো- খানিকটা । আমি বললাম- আমি কি আপনার কিছু হতে পারি? মেয়েটি চোখ বড় বড় করে আমার দিকে তাকিয়ে রইলো । তখন বললাম- আমি কি আপনার বন্ধু হতে পারি? মেয়েটি তখন লিখলো- সেলিব্রেটিরা কি কখনো কারো বন্ধু হতে পারে, তাদেরতো ওতো সময় নেই । আমিতো মানুষ, আমার সময় আছে । আমি জিজ্ঞাসা করলাম আর কতদিন থাকবেন এখানে? মেয়েটি আমার হাতে কাগজটা দিয়ে উঠে চলে গেলো । আর কাগজটায় লেখা- আগামীকাল সকালে । দুদিন পর আমারো শুটিং শেষ হলো । আমি ঢাকাতে ফিরে আসলাম । ঢাকায় এসেই আমি অনন্যাদের বাসায় চলে যাই ওকে সারপ্রাইজ দিবো বলে । কক্সবাজার থেকে আসার সময় রিসোটের রিসেপশন থেকে আমি অনন্যার বাসার ঠিকানাটা নিয়ে আসি ।সেদিন অনন্যা আমাকে যেভাবে হতভম্ব করে দিয়েছিলো, আমিও অনন্যাকে তেমনভাবে হতভম্ব করে দিয়েছিলাম । সেদিন অনন্যা এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে ছিলো আমার দিকে । এরপর থেকে আমি আর অনন্যা বিভিন্ন জায়গায় ঘুরাঘুরি, একসাথে অনেক সময় কাটানো, কিছুটা অভিমান এভাবেই চলতে থাকলো কিছুদিন । সারাক্ষণ একে অপরকে  sms পাঠানো একটা অভ্যাসে পরিণত হয়ে দাঁড়ালো । এক সময় এমন হলো,  অনন্যাকে ছাড়া আমার সময়টা কাটতো না । অনন্যা আস্তে আস্তে আমার জীবনের একটা বড় অংশ হয়ে উঠলো । তখন বুঝতে পারলাম আমার মায়াটা অজান্তেই একটি গন্তব্যে পৌছেছে । আমি অনন্যাকে ভালোবেসে ফেলেছি । আর আমি তখন অনন্যাকে বিয়ে করার সিদ্ধান্ত নিলাম । আমার জীবনের অতিস্ত করবো বলে ভাবলাম । কিন্তু ভাবাটা যত সহজ, বাস্তবতা ততটাই কঠিন । আমার পরিবার কিছুতেই অনন্যাকে মেনে নিবেনা, বলে- সবেমাত্র তোমার ক্যারিয়ার শুরু, আর তুমি সেটা ধ্বংস করতে চাচ্ছো । সেটাও একটি বোবা মেয়ের জন্য । শুধু আমার পরিবার নয়, অনন্যার পরিবারও এই বিয়েতে রাজি নন । তারা বলে- বাবা তুমি একজন সেলিব্রেটি আর আমরা সাধারণ মানুষ । আর সবচেয়ে বড় কথা হলো আমার মেয়েটি বোবা, তোমাদের সংসার টিকবে না । আমি সবাইকে বোঝাতে ব্যর্থ হলাম। পরিশেষে ছুটে গেলাম অনন্যার কাছে, ভাবলাম ওতো আমাকে ভালোবাসে, ও নিশ্চয়ই রাজি হবে । অনন্যা কিছুতেই রাজি হলোনা, শেষবারের মতো একটি কাগজ আমাকে দিলো । আর তাতে লেখা ছিলো- “আমি বোবা, আমি তোমার একজন ভালো বন্ধু হতে পারি কিন্তু জীবনসঙ্গিনী নয় । ভালোবাসা মানে কি শুধুই প্রাপ্যতা, ত্যাগটা কি ভালোবাসা নয় । আমিও তোমাকে ভালোবেসে ছিলাম । নাই বা পেলাম তোমায়, না হয় দূর থেকেই ভালোবেসে যাবো । আমি চাইনা আমার কারনে কেউ কারো সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করুক । আমি কারো সুখের কারন হতে যেয়ে কারো দুঃখের কারন হতে চাইনা । যদি পারো আমাকে মাফ করে দিয়ো । মনে করো অনন্যা নামের কারো সাথে তোমার কোনদিন দেখা হয়নি । অনন্যা নামের কোনো মেয়েকে তুমি চেনোনা । সুখে থেকো ।”

আমি অনন্যাকে কিছুতেই রাজি করাতে পারলাম না । বোঝাতে পারলাম না ভালোবাসা মানে কি শুধুই কথা বলা, আমার কাছে ভালোবাসা হচ্ছে একে অপরের অনুভূতিগুলোকে বুঝতে পারা, যেটা আমাদের মাঝে ছিলো । এরপর থেকে অনন্যাকে আমি আর খুজে পাইনি । অনেক খুজেছি, কিন্তু আমাকে ভালো রাখতে যেয়ে ওরা কোথায় চলে গেছে তা কেউ জানেনা । সব নাম্বারগুলোও বদলে ফেলেছে । আমাদের গল্পটাও মেঘের মতো, যা আকাশে কিছুক্ষণের জন্য আসে এবং বৃষ্টি হয়ে ঝরে যায়।  আজও অনন্যার দেওয়া শেষ কাগজটা নিয়ে ঘুরি । যতবারই লেখাগুলো পড়ি ততবারই ভাবি আজ যদি তুমি আমাকে দেখতে তাহলে বুঝতে তুমি দূরে সরে যাওয়াতে আজ আমি কতটা সুখে আছি । আজও অপেক্ষায় থাকি দরজায় কড়াঘাত পরবার । দরজায় অবশ্য কড়াঘাত পরে কিন্তু সেই অনন্যার কড়াঘাত আর পড়েনা । কেউ কাগজ হাতে দাঁড়িয়ে থাকেনা, যাতে লেখা থাকবে- “আমাকে অটোগ্রাফ দিন”, ।

নাঈম খান। টাংগাইল জেলার কালিহাতিতে জন্ম।

এই বিভাগের অন্যান্য লেখাসমূহ

দৌড়

দৌড়

একবার এক দৌড় প্রতিযোগিতায় কেনিয়ার হয়ে দৌড়চ্ছিলেন আবেল মুতাই। খুবই ভালো দৌড়াচ্ছিলেন তিনি। সবাইকে পেছনে…..