মেঘ মল্লারের দেশে

মৌ ভট্টাচার্য
ভ্রমণ
Bengali
মেঘ মল্লারের দেশে

 

ইউরোপ মাতামাতি করে আল্পস্ নিয়ে আমরাও কম যাই কীসে। একটা হিমালয়ের অঙ্গুলী হেলনই যথেষ্ট সারাবিশ্বের জন্য। পৃথিবীর আনাচ -কানাচ থেকে কত লোক আসে মেঘের আড়ালে আবডালে লুকিয়ে থাকা সেই হিমালয়কে একটি বারের জন্য দেখতে। দেশে থেকে আমাদেরই তা দেখা হয় না। সদ্য গ্রীস আর ইস্তানবুল দেখে ফেরা আমার এবারের গন্তব্য হিমাচল প্রদেশ। না দেখা হিমালয়কে দেখতে আর পরতে পরতে লুকিয়ে থাকা না জানাকে আবিষ্কার করতে।

প্রায় ছ মাস আগে কয়েকজন বন্ধু মিলে ঠিক করেছিলাম মানালি হয়ে কুনজুম লা পেরিয়ে বহু প্রতিক্ষীত চন্দ্রতাল লেক দেখতে যাব, যেখান থেকে চন্দ্র নদীর উৎস। আমরা আমাদের মত প্ল্যান এগোচ্ছি আর প্রকৃতি ও তার মত করে আ্যন্টি প্ল্যান তৈরি করছে। অক্টোবর মাসের শুরুতে খবর এল প্রবল বৃষ্টি শুরু আর তুষারপাত শুরু হয়েছে সারা হিমাচল জুড়েই। আমরা দোটানায় যেতে পারব কি না তা নিয়ে। অবশেষে সব বাধা বিপত্তি পেরিয়ে যাওয়া স্থির হল তবে গন্তব্য পাল্টে হল কিন্নর, কল্পা, ছিটকুল, ধঙ্কর , কাজা হয়ে সারাহান। কুনজুম লা বন্ধ অসম্ভব তুষারপাতের ফলে।

ছিটকুল গ্রাম

হিমাচলকে সেইভাবে আগে কখনো দেখি নি। এইবার প্রথম, ভেতরে একটা চাপা উত্তেজনা। গত বছর লাদাখ থেকে ফেরার পথে মানালি হয়ে ফিরেছিলাম, এটুকুই। তবে এত সুন্দর সে না গেলে বুঝতে পারতাম না। আমরা যতোই সাজাই না কেন নিজেদেরকে প্রকৃতি হল শ্রেষ্ট মেকাপ আর্টিস্ট। যেখানে যতটুকু দরকার সে সেভাবেই সাজিয়েছে। বহতা নদীর সাথে পাইনের কম্বিনেশন কোথাও তো অন্যদিকে হয়েছে গভীর খাদ যে কোনো সময়েই মৃত্যু অনিবায। সৌন্দয আর ভয়বহতা মিলেমিশে একাকার। আমার প্রথম গন্তব্য সিমলা, ব্রিটিশদের তৈরি করা সামার ক্যাপিটাল। হোটেলে পৌঁছেই ছুটলাম ম্যাল দেখতে। কসমপলিটন সেই ম্যাল চত্বর। মানুষের ভিড। কেউ কারোর সাথে দেখা করতে এসেছে তো কেউ কারোর অপেক্ষায়, অনেক বিদেশী ঘুরে বেড়াচ্ছে আর বাঙালী টুরিস্ট তার স্বভাবসিদ্ধ ভঙ্গীমায় পরিবারের জন্য জিনিস কিনে চলেছে যা কলকাতাতে সহজেই পাওয়া যায়। কোনার একটা বেন্চে বসে এইসব যখন দেখছি তখন আমার সঙ্গী সাথীরা সিমলা কালিবাডিতে দুগ্গা ঠাকুরকে দেখতে গেছে, কলকাতার পুজো মিস করছে বলে। শেষ বিকেলের মন খারাপ করা সোনালি রোদ আমার চারপাশে , এমন নরম আলোর হাতছানি বিষন্ন বিকেলে যতটুকু নিয়ে নেওয়া যায়। হলুদ গমের মত রঙ ছডিয়ে পড়া সিমলা ম্যালেএকা চুপচাপ বসে ভেবেছি কোথায় তুমি, কেন এই অন্তরাল, একবার তো আসতেই পার আমার পাশে বসে সেই মূহুতের সাক্ষী হতে। সময় থেমে থাকে না সে তো বহতা তাই মন খারাপের রঙ মুছে যেতে না যেতেই জোনাকির মত টুপটাপ আলো জ্বলে ওঠে পাহাড়ের শরীর চুঁয়ে। হঠাৎ সম্বিত ফেরে এক বাঙালি পরিবারের সেলফি বিলাসি চিৎকারে। আকাশে অগুন্তি তারা আর শীতের হাওয়ার দাপটে কান্নারা জডিয়ে থাক তোমার নিস্তবদ্ধতা জুড়ে।

সিমলা ম্যাল

চাঁদের হাসির বাঁধ ভেঙ্গেছে

গন্তব্য দুই সাঙ্গলা। সা ঙ হল ঔজ্জ্বল্য আর লা হল পাস মানে উজ্জ্বল গিরিবত।

প্রকৃতিকে যতই দেখি ততই অবাক হয়ে যাই। মনের মধ্য বেজে ওঠে স্যাক্সফোনের সুর। আঁকাবাঁকা পথ পেরিয়ে চলে আমাদের গাড়ি। কোন বাকেঁ যে কোন অজানা সৌন্দয অপেক্ষা করে আছে আমরা কেউ জানি না। শুধু বাঁক ঘোরার অপেক্ষা। সিমলা ছাডিয়ে ঝকঝকে রোদের সাথে ওঠা নামা পথের নিশানা বেয়ে এগিয়ে চলা। রামপুর হয়ে সাঙ্গলার পথে। লম্বা সে দিন। যত লম্বা ই সে পথ হোক না কেন আমার বেশ ভালোই লাগে। পথ বেধে দিল বন্ধনহীন গ্রন্থী , আর আমরা চলতি হাওয়ার পন্থী। ক্লান্তি শেষে এক অশেষ পাওয়া সে, যখন বয়ে যাওয়া বস্পা নদীর ধারে চাঁদের আলো ছুঁয়ে যাওয়া বরফের পাহাডের মাথায় আলো ফুটে থাকা তারাদের ইশারা আমার সাথে। চাদের হাসির বাধ ভেঙ্গে পড়া সে রূপ। যে তারা টা স্থির হয়েছিল সে তো তুমি। আমাকে দেখছিলে আডাল থেকে। কানে কানে বলে গেছিলে হংসধ্বনির মূছনায় মাতিয়ে দিতে। আসন্ন কোজাগরী পূর্ণিমায় তোমার মিলন রঞ্জনের সাথে, সে কি তুমি জানো না???

শতদ্রু আর স্পিতি নদীর সঙ্গমস্থল

সাঙ্গলা থেকে ছিটকুল মাত্র ১১ কিমি কিন্তু পথ বড বন্ধুর। গাড়ির পেছনের সিটে যারা বসে তারা আরো ভালো টের পায়। রাস্তা নেই এমন রাস্তাকে সঙ্গী করে আমাদের বাহন ও তার চালক পিযুষ বাঙময় চোখ নিয়ে গন্তব্যে পৌঁছেই দেয়। ভারতের শেষ গ্রাম এই ছিটকুল। তারপরেই নো ম্যানস ল্যান্ড আর তিব্বত। ফ্রি টিবেট মুভমেন্ট এর কোনো নিশানা নেই চারপাশে। হিমালয়ের কোলে শুয়ে থাকা ছোট্ট এক গ্রাম। টুরিস্টদের জন্য সে গ্রামের মানুষের আয়োজন জিন্জার লেমন হানি টি অথবা ধোঁয়া ওঠা কালো কফির আস্বাদ। কোথায় তখন আলো ঝলমলে কলকাতার থিম পূজোর হাতছানি। তোমার নরম গাল জুড়ে যে শেষ সূযের আলো পড়েছিলো সে তো ছডিয়ে পড়েছে ওই উপত্যকা জুড়ে। পাইন বনের ফাঁক দিয়ে ঢুকে পড়া রোদ তখন আমাদের শরীরি উপস্থিতি জানান দিচ্ছে। ফ্ল্যাশব্যাকে ফিরে যাচ্ছি আমি।

ঝরণার জল জমে বরফ

বিজয়া দশমী

একরাশ রঙ নিয়ে আমাদের ফিরে আসা ছিটকুল থেকে কল্পার পথে। এ পথের কোনো শেষ নেই। রিকং পি ও হয়ে ঠান্ডায় কাঁপতে কাঁপতে সারি সারি আপেল বাগান পেরিয়ে পৌঁছালাম কল্পায়। ঘরের পদা সরিয়ে দেখলাম রাতের আকাশ জুড়েই ছডিয়ে আছে কৈলাস। যে ও না যে ও না নবমী নিশি। ঝিরিঝিরি বরফ পড়তে থাকে। আপেল গাছের গায়ে লেগে থাকা সাদা বরফের আস্তরণ সরাতে মালিকদের হাঁকডাক। পরের দিন সকাল হতে না হতেই উঠে পড়ি। আজ বিজয়া মা ফিরবেন কৈলাসে। আমাদের কাছে। আগের দিনের খারাপ আবহাওয়ার সমস্ত আশঙ্কা তুচ্ছ করে কৈলাসে প্রথম সূযের আলোর ছটা।পথের সমস্ত ক্লান্তি দূর হয়ে যায়। বিস্তারিত হিমালয় আগলে রেখেছে মানব সভ্যতাকে যুগ যুগ ধরে। তার কাছে আমরা কত তুচ্ছ। আমাদের হানাহানি সমস্ত মেকি মনে হয়।

আবার শুরু পরের গন্তব্য ধঙ্কর। আমাদের চালক পিয়ুশ জানালো “ইয়ে আজুবা জগা হ্যায়”। এইবার আমরা কিন্নর ছেড়ে চলেছি স্পিতির পথে। বিভিন্ন দিকে বিচিত্র তার রূপ। স্পিতি উপত্যকা কে বলা হয় মিনিয়েচার ফম অফ লাদাখ। সবুজ হলুদে মেশা কিন্নর ছেড়ে রুক্ষ শুষ্ক মরুভূমি র পাহাড়ে ঢুকে পড়লাম আমরা। সমস্ত কিন্নর জুড়েই সারা রাস্তায় আমাদের সঙ্গী ছিল শতদ্রু। একেঁ বেঁকে আপন মনে কখনো গান গাইতে গাইতে কখনো নাচতে নাচতে সে এগিয়ে চলেছে। স্পিতি তে ঢোকার আগেই খাব বলে একটা জায়গা আসে, সেখানে শতদ্রু ও স্পিতি নদীর সঙ্গমস্থল। শতদ্রুর জল ঘোলাটে আর সিপতির রঙ সবুজ। সঙ্গমস্থলে দুটো নদীর দুটো রঙ আলাদা বোঝা যায়। দুটো নদী তাদের কি সুন্দর সংসার। কোথাও কোনো বিরোধ নেই সহাবস্থানে। মিলিত হয়ে আবার তারা যে যার মত আপন মনে এগিয়ে চলল। মানুষই পারে না এমন ঝগডাহীন সহাবস্থান করতে। আমরা এগিয়ে চললাম স্পিতি নদীর সাথে খাব থেকে ব্রিজ পেরিয়ে ঢুকে পড়লাম স্পিতি উপত্যকা তরঙ্গে। হিমাচল প্রদেশে এই অন্চলে বলা হয় রাস্তা সবচেয়ে কঠিন। মাঝে কোনো রাস্তাই নেই, খুব সরু, উল্টোদিকে কোনো গাড়ি এসে গেলে আরেক বিপত্তি। কিছুদিন আগে যে বন্যা হয়েছিল তাতেই রাস্তা আরও খারাপ হয়ে গেছে। তাও সমস্ত ভয় আর ক্লেদ দূর হয়ে যায় অপরূপ প্রকৃতিকে দেখে, তার রঙরূপের খেলা, তার গহীন গভীর মায়াময় পাতা ঝরার কাল। ঝরে পড়া পাতাদের সাথে স্মৃতির বুনন।

হেমন্তের অরণ্যে আমি পোস্টম্যান

হেমন্ত যে বিষাদের কাল, পাতা ঝরার সময়। হলুদ উইলো গাছের সারিতে হাওয়া দোল দেয়। শীতের হাওয়ার কাঁপনে ঝিরিঝিরি পাতারা ঢলে পডে রুক্ষ পাহাড়ের কোল বেয়ে। পথে বিছানো রয়েছে মেপেলের কাপেট। হলুদ আর লালের প্যালেট, একটা তুলি হলেই এঁকে দিই তোমার শরীরে রঙের পরত। পথ এগিয়ে চলে, গাড়িতে কখনো ছোটো ন্যাপ নিয়ে নিই কখনো বাইরে তাকিয়ে থাকতে থাকতে দুপুর গডিয়ে বিকেল। ঠাণ্ডা বাড়তেই থাকে। নাকোতে পৌছৌই সেখানে খুব কিছু দেখার নেই, যে লেকটি ছিল এখন তা নষ্ট হয়ে গেছে। অতএব পিয়ুষের মত সেখানে সময় নষ্ট না করে টাবো চলে যাওয়াই ভালো, আলো কমে আসছে, রাস্তা ভালো নয়। ধঙ্কর প্রায় তের হাজার ফিট ওপরে। রাস্তায় পড়ল টাবো মনাস্ট্রি সেটি দেখে আমরা এগিয়ে চললাম। নাকো, টাবো এগুলো ছোটো সব গ্রাম। ভারি সুন্দর। উইলে আর মেপল দিয়ে এমনভাবে সাজানো যেন মনে হচ্ছে কোনো প্রফেশনাল ইন্টিরিয়র ডিজাইনার সাজিয়ে দিয়েছে।

কল্পা, সূর্যের প্রথম রশ্মি কিন্নর কৈলাসে মাথায়

কিন্নর অঞ্চল কিন্তু হিন্দু সম্প্রদায়ের আধিক্য বেশী ছিল, স্পিতিতে ঢুকেই বেডে গেল বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের আধিক্য। এদিক ওদিক ছোটো ছোটো স্তুপ আর মনাস্ট্রি। সমস্ত জায়গাগুলোতেই মানুষজন অতিথি বৎসল আর সহজ সরল, দু বাহু মেলে থাকা প্রকৃতির মত। শেষ বেলার সূযের রেশ কাটতে না কাটতেই ঘন অন্ধকার, ঠাণ্ডা আর বুঝতে পারছিলাম অক্সিজেন কম পড়ছে।

অবশেষে আমরা পৌঁছালাম ধঙ্কর। রাতে বিশেষ কিছুই বোঝা গেল না, ঠাণ্ডা ছাডা। শুধু আকাশে দেখলাম অজস্র তারারা চুপিসারে উঁকি মারছে। ওখানে আমরা একটা হোম স্টে তে ছিলাম। ছোট্ট পরিবার, বৌ বর আর বাচ্চা। বাচ্চা যাতে অতিথি সেবায় বাঁধা না হয়ে দাঁড়ায় তাই তাকে পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছে নীচে শ্বশুর শাশুড়ির কাছে। আগুন পোহাতে পোহাতে আমাদের গল্প জমে ওঠে পরিবারটির সাথে। শোনা যায় গ্রামটিতে মাত্র পাঁচশো লোকের বসবাস। চাষবাস মূল উপার্জন। তাছাড়া সিসনে অনেকেই হোম স্টে করে থাকে। অক্টোবরের পরের থেকেই বরফ পড়তে শুরু করে। তাই হোম স্টে বন্ধ হয়ে যায়। সেইসময়ে মেয়েরা রঙিন সুতোয় ফুল তুলে গালিচা তৈরি করে। আমাদের এই পরিবারটির মটরশুটির ক্ষেত আছে। এরা ঠান্ডা পড়ার আগে অবধি সেই ব্যবসা করে। রাতে মেয়েটির হাতে তৈরি তিব্বতী খাবার খেয়ে আমরা সবাই বিশ্রামের পথে। পরেরদিন সকালে যাব পিন ভ্যালি তারপর কাজা হয়ে আবার ফিরে আসা।

টাবো মনাস্ট্রি

অন্ধকারের মধ্যে যে সৌন্দযকে আঁচ করতে পারিনি, পরেরদিন সকালেই বুঝতে পারলাম তার রূপ মাধুয। আগেই বলেছি যে ধঙ্কর প্রায় তের হাজার ফিট ওপরে। গ্রামটির অবস্থানটি ও বেশ অন্যরকমের। পাথর ক্ষয়ে গিয়ে বিভিন্ন রকমের ফর্মেশন তৈরি হয়েছে, গ্রামের বাডিগুলো সেইসব পাথরের ওপরে বা ভেতরে গুহার মধ্য তৈরি। রুক্ষ ওইরকম পাথরের পাহারকে চারপাশ দিয়ে ঘিরে রেখেছে হিমালয়। মাথার ওপরে ঝকঝকে নীল আকাশ। ওপর থেকে দেখা যাচ্ছে প্রাইমার স্কুল, ডাক্তারখানা, নীচের বাডিগুলো। শোনা গেল আজকে নাকি নীচের কোনো একটা বাড়িতে বাচ্চার জন্মদিনে সারা গ্রামের নেমন্তন্ন, আমাদের ও। অন্য গ্রাম থেকেও লোকজন আসবে। ধঙ্করে দুটো মনাস্ট্রি, একটা পুরোনো আরেকটা নতুন। বন্ধু সৌমেন যখন মনেস্ট্রি তে গেছে আমরা সেইসময়ে পিন ভ্যালির পথে। সৌমেনের কাছেই শুনলাম যে নতুন মনেস্ট্রিটি যতটা জৌলুস নিয়ে বিরাজমান পুরোনো মনেস্ট্রিটি ততটাই জৌলুসহীন এমনকি তাদের কোনো ফান্ড ও আসে না তাই নিজেদের ফান্ড নিজেরা তুলতে তারা প্রবেশ মূল্য ধার্য করেছে পঁচিশ টাকা। অন্যদিকে আমরা মুদ এর পথে পিন ভ্যালি তে। পাহাড়ের কোলে ছোট্ট গ্রাম আর সামনে অনন্ত পরিসর জুড়ে সেই উপত্যকা, সাদা বরফে মোড়ান মাথা আর চারপাশে কালো রঙ যেন ব্ল্যাক ফরেস্ট পেস্ট্রি র মাথায় আইসিং সুগার ছড়ানো। পিয়ুষ জানালো বরফ না থাকলে ওই পাহাড়ের রঙ হয় একদিক সবুজ অন্যদিকে নীল আর গোলাপি। এইজন্যই বোধহয় একই পাহাড়ে বার বার আসতে হয় তার নানা সময়ে নানারূপ দেখতে। রাস্তায় মাঝে মাঝে দেখতে পেলাম পাহাডি ঝরণার জল বরফ হয়ে বিভিন্ন আকার ধারণ করেছে। ফেরার পথে গেলাম কাজা। বেশ জমজমাট পাহাডি শহর। অনেকদিন বাদে হঠাৎ মোবাইল ফোনে টুংটাং আওয়াজ হল। বুঝলাম ওয়াইফাই কাজ করছে, গত দুদিন বিচ্ছিন্ন হয়ে থাকা সমস্ত দরকারি অদরকারি বাতা আসতে শুরু করেছে। কাজাতে বেশ কসমোপলিটন ব্যাপার আছে। খানিকটা দাজিলিং এর মত। ধঙ্কর কিন্তু আনকোরা। এখনও অনাঘ্রাতা। যাতে জবুথবু হয়ে সন্ধে ফিরলাম ধঙ্করে। তখন দেখলাম আমাদের হোম স্টে তে তাদের অনেক আত্মীয়রা এসেছে। ওই জন্মদিন উপলক্ষে। তাদের সাথে গল্প গুজব করে খাওয়া দাওয়া সেরে আমরা প্রস্তুত পরেরদিন প্রায় বারের ঘন্টা জানি, নীচে নামব যাব সারাহান। সেখানে রাত্রিবাস করে পরেরদিন সিমলা হয়ে দিল্লি যাব।

ধঙ্কর

ভোর ছটায় উঠে দেখি সেই মেয়েটি অতি যত্নে আমাদের জন্য প্রাতরাশ আলুর পরোটা তৈরি করে ফেলেছে। এই আতিথেয়তা তুলনাহীন।

এইবার নীচে নামার পালা। রোদ বাডছে আর আমরা খোলসের মত একটা একটা করে শীত পোশাক খুলে ফেলছি। এক পাহাড় থেকে অন্য পাহাড় থেকে আরও অন্য পাহাড় পেরিয়ে, হাত পা যখন জানান দিচ্ছে ব্যাথা বেদনার তখন আমরা পৌঁছালাম সারাহান। ঠাণ্ডা অনেকটাই কম। নিজেদেরকে তখন মনে হচ্ছিল কি একটা জয় করে ফিরলাম যেন।

গিউ মমি গ্রাম

মমি গ্রাম

ধঙ্কর থেকে টাবো হয়ে নামার পথে আমরা থেমেছিলাম গিউ গ্রামে যা কি না মমি গ্রাম নামে বিখ্যাত। গিউ খুব ছোট্ট একটি গ্রাম, পঞ্চাশ  থেকে পঁচাত্তর ঘর আছে সেখানে। প্রায় দশ হাজার ফিট ওপরে সামডো আর টাবোর মাঝখানে হাজার বছরের পুরোনো টাবো মনাস্ট্রি থেকে প্রায় চল্লিশ কিলোমিটার দূরে। গিউ গ্রাম পেরিয়ে একটু ওপরে উঠলেই এক মনাস্ট্রি যার পাশে ছোট্ট একটি হলুদ রঙের ঘরে রাখা আছে ওই মমি। গ্রামের মানুষের বিশ্বাস মমিটি লামা তেনজিনের। সরকারিভাবে মমিটিকে আবিষ্কার করে ইন্দো টিবেটিয়ান বর্ডার পুলিশ রাস্তার কাজ করতে গিয়ে। যদিও গ্রামবাসীরা এই কৃতিত্ব তাদের দিতে নারাজ। প্রায় পাঁচশোরও বছরের পুরোনো এই মমি প্রাকৃতিক উপায় হয়েছে, মিশরীয়দের মত এখানে কোনো কেমিকাল মেশানো হয় নি। লামা পঁয়তাল্লিশ বছর বয়সে যখন উপলব্ধি করলেন যে এইবার তিনি নিবান লাভ করতে চান তখন তিনি আস্তে আস্তে খাওয়া দাওয়া ছেড়ে দেন। তিব্বতী লামাদের মধ্যে কীভাবে নিজেদের মমিতে পরিণত করার রীতি প্রাচীনকালে ছিল। কিন্তু তিব্বতে এই ধরনের মমির অস্তিত্ব আর নেই চীন আগ্রাসনের সময় যে সাংস্কৃতিক বিপ্লব হয়েছিল তারপর সমস্ত মমিকে লুপ্ত করে দেওয়া হয়। গ্রামবাসীরা মনে করেন লামা মমিরূপ ধারন করে তাদের গ্রামের রক্ষা করছে। এই রকম সব গল্প শুনে গা ছমছম করছিল। অদ্ভুত এক ইতিহাসের সাক্ষী রইলাম আমরা। কত টাকা পয়সা খরচ করে বাঙালি মিশর যায়, তার গুরুত্ব অস্বীকার না করেও এটুকু বলাই যায় পরিত্যক্ত এই গিউ গ্রামেও আসা যেতে পারে।

গিউ গ্রাম

ভীমাকালি মন্দির

সারাহান এ দ্রষ্টব্য এই মন্দির। বৌদ্ধ আর তিব্বতী সংস্কৃতির মেল বন্ধন এই কাঠের মন্দির। বাইরে থেকে দেখতে প্যাগোডার মত। বুসাহার রাজারা এই মন্দির তৈরি করেছিলেন। এক ভয়াবহ ভূমিকম্প পুরোনো মন্দিরটি ধ্বংস করে দিলে নতুনভাবে পরে মন্দিরটি আবার তৈরি করা হয়। ভীমাকালী হল অসুরনাশিনী দূগা। দুশো বছরের প্রাচীন এই মন্দির তিনতলার। একতলায় দারুর ডলি, দোতলায় ব্যাঘ্রবাহিনী ভগবতী আর তিনতলায় অষ্টধাতুর অষ্টভূজা ভীমাকালি।

ভীমাকালী মন্দির

সারা হিমাচল জুড়েই যেখানেই গেছি সেখানেই দেখেছি বাঙালি টুরিস্ট। ভারতবর্ষের টুরিজিমকে বাচিয়ে রেখেছে এই বাঙালি। তারা যতই চেচামিচি করুক, অযথা বাজে বকুক এই প্রশংসার অধিকারী তাঁরাই এ বলতে দ্বিধা নেই।

আমি গাই ঘরে ফেরার গান

সারাহান থেকে সিমলা ফিরলাম, পরের দিন দিল্লি আর সেখান থেকে কলকাতা। ন দিনের যাত্রা শেষ হচ্ছে। কানে বাজছে বিদায়ের সুর। ফিরে তো আসতেই হবে। পাহাড়ি রঙ, ঝরণার জল, তিরতির করে বয়ে যাওয়া নদী আর ব্যপ্ত হিমালয়। এইসবই মনের মধে্য গুন্জন তুলছে। তুমি আমি আমরা মিলে মিশে একাকার। ওই ব্যপ্তির মাঝে নিজেকে হারিয়ে ফেলা। নিজেকে খুঁজে পাওয়া। আবার আরেকটা জানির অপেক্ষায়, আরেকটা নতুন জায়গা। জীবন ও তো বহতা নদীর মত। সে থেমে থাকে না। নুড়ি পাথর সরাতে সরাতে এগিয়ে চলে। সেই এগিয়ে চলার সাক্ষী রইলাম আমি, শুধুই আমি, আমার একান্ত নিজস্ব সত্তা।

সিমলা লেখক নিজে

 

প্রকাশকের নোট:  এই লেখার সাথে যুক্ত সকল আলোকচিত্রের কপিরাইট লেখকের। 

মৌ ভট্টাচার্য। নারী অধিকার কর্মী ও পরিব্রাজক। আন্তর্জাতিক নারী ও শিশু পাচার নিয়ে দীর্ঘ দু'দশক ধরে কাজ করছেন। সেই সূত্রে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে গেছেন। ঘুরে বেড়ানো নেশা। যে কোনো সময় কাঁধে ঝোলা নিয়ে বেরিয়ে পড়তে প্রস্তুত তিনি। শখ বেড়ানো নিয়ে...

এই বিভাগের অন্যান্য লেখাসমূহ

রে এলাম সিঙ্গিগ্রাম, কবি কাশীরামদাসের জন্মস্থান।

রে এলাম সিঙ্গিগ্রাম, কবি কাশীরামদাসের জন্মস্থান।

কবি কাশীরামদাসের জন্মস্থান পূর্ববর্ধমান জেলার সিঙ্গিগ্রামে বেড়াতে গেলাম।তাঁর জন্মভিটের ভগ্নাবশেষ দেখলাম।আমি,মিহির,রিমি,সোমা,রজত সকলে গ্রাম ঘুুুুরলাম। চারদিকে…..

শিশিরবিন্দু

শিশিরবিন্দু

ভ্রমণবিলাসী চারজন বেরিয়ে পরলাম ভ্রমণে। আমিও গেলাম।প্রথমে ওরা গেল মুকুটমণিপুর। সপ্তাহান্তে পিকনিক বা একদিনে ছুটিতে…..