মেটাহিউম্যান

ফিরোজ আখতার
গল্প
Bengali
মেটাহিউম্যান

এটা তীব্র শিষের শব্দ কানের পর্দায় বেশ জোরে এসে লাগতে ঘুমটা ভেঙে গেল শমীকের। ঘুমের ঘোরে অবশ্য শিষের শব্দটা বেশ কিছুক্ষণ ধরে শ্রবণপর্দায় দোলা তুলছিল তার আবছা ঘুমের ঘোরের মধ্যে। পাশ ফিরে চেয়ে দেখলো বিছানা ফাঁকা। মেয়ে ইভাঙ্কা ও বৌ অতসী কেউ-ই নেই বিছানায়।

মেয়েকে টয়লেটে নিয়ে গেছে নিশ্চয়ই অতসী। ভাবলো শমীক। চোখ বন্ধ করে পাশ ফিরে শুলো।

আবার শিষের শব্দ। এবারে আরো তীক্ষ্ণ। উঠে পড়লো সে একটা ভয়মিশ্রিত কৌতুহল নিয়ে। আওয়াজটা আসছে দক্ষিণের ঝোলা বারান্দা থেকে। বারান্দাটা খোলা, তিনতলায় ফ্ল্যাটটা বলে ইচ্ছা করেই গ্রিল দিয়ে ঘেরেনি সে। মাঝের ড্রয়িং রুমটা পেরিয়ে যাবার সময় ড্রয়িং রুমের আলোটা জ্বালালো আর টয়লেটের দিকে একবার দেখেও নিলো সে। নাহ্, টয়লেটের  দরজা বাইরে থেকেই বন্ধ।

ঝুলবারান্দার দিকে চোখ পড়তেই শিরদাঁড়া দিয়ে একটা শীতল স্রোত বয়ে গেলো শমীকের। দরজাটা পুরোটা খোলা। আর শিষের আওয়াজটা বাইরে ওদিক থেকেই আসছে।  দ্রুতবেগে বারান্দায় গিয়ে এদিক-ওদিক দেখতে লাগলো সে। কিন্তু কিছুই দেখতে পেলো না।

তাহলে কি চোর ঢুকলো ঘরে। অতসী আর ইভাঙ্কা কোথায় গেলো? তিনতলা থেকে নিচের দিকে উঁকি মারলো, দেখতে লাগলো ইতি-উতি। পূর্ণচাঁদের জোৎস্নায় সবকিছু স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। কিন্তু না! কিছুই দেখা যাচ্ছে না। হঠাৎ, আবার শিষের আওয়াজ! সামনের কৃষ্ণচূড়া গাছটা বেশ জোরে নড়ে উঠলো। চোখদুটো সেদিকে ফেরাতেই যে দৃশ্য তার চোখে পড়লো তাতে হাড় হিম হয়ে গেলো শমীকের। কৃষ্ণচূড়া গাছের মগডাল থেকে বাতাসে শরীর ভাসিয়ে উড়ে আসছে দুটি প্রাণি; তারই দিকে। ব্যালকনির রেলিং টপকে তারা একদম তার সামনে এসে দাঁড়ালো।  অতসী আর ইভাঙ্কা।

বুকের মধ্যে তীব্র হাতুড়ির দমাদ্দম আওয়াজের সঙ্গে সঙ্গে লক্ষ সূঁচ বেঁধানোর ব্যথাটা অনুভব করলো সে। ডানাগুলি ধীরে ধীরে সেঁধিয়ে গেলো ওদের মেরুদণ্ডের দুইপাশে। জ্ঞান হারানোর সময় টের পেলো অতসী এসে তাকে ধরে ফেললো।

দুই.

কতক্ষণ অজ্ঞান হয়ে ছিলো কে জানে। জ্ঞান ফিরতে দেখলো সামনে অতসী বসে আছে। পাশে ইভাঙ্কা অঘোরে ঘুমাচ্ছে। ধড়ফড় করে উঠে বসলো সে। সবকিছু স্পষ্ট ভেসে উঠলো তার চোখের সামনে।

– “তুমি, তোমরা কারা”? কোনক্রমে জড়িয়ে জড়িয়ে বললো শমীক।

অতসীকে চুপ করে বসে থাকতে দেখে সে আবার জিগ্যেস করলো, “তোমরা কি পরী”? জিভটা ঠিকমতো কাজ করছে না অনুভব করলো সে। মন্থরগতিতে নড়াচড়া করছে। জলের বোতলটা খোঁজার জন্য এদিক ওদিক চাইলো। অতসী উঠে এসে এগিয়ে দিলো বোতলটা তার দিকে। ঢকঢক করে একবারে আধবোতল জল খেয়ে নিলো শমীক। কিছুটা জল জামায় পড়ে জামাটাও খানিকটা ভিজে গেলো।

-“আমি মেটাহিউম্যান। ইভাঙ্কাও তাই “। এবার কথা বললো অতসী।

-“মানে “? হতভম্ব হয়ে প্রশ্ন করলো শমীক।

-“মানে খুব সহজ। আমরা মানুষ কিন্তু শুধু মানুষ না। মানুষের থেকেও আরো বেশি কিছু”।

-“কি বলছো তুমি যাতা “? আবার ঘামতে লাগলো শমীক।

-“ভালো করে শোন শমীক। আমরা মেটাহিউম্যান, কারণ আমাদের শরীরে মেটাজিন আছে। মেটাজিন আসলে সেই সব জিন যা থাকার ফলে আমরা সাধারণ মানুষের থেকে অনেক বেশি ক্ষমতা ধরি। পৃথিবীতে অনেক মেটাহিউম্যান আছে। কিন্তু সাধারণ মানুষ সেটা জানে না। তুমিও জানতে না। হঠাৎ করে ধরা পড়ে গেলাম বলেই জানতে পারলে “।

– “আর ইভাঙ্কা”?

-” হ্যাঁ, ইভাঙ্কাও মেটাহিউম্যান। গতমাস থেকেই ওর মধ্যে মেটাহিউম্যানের কিছু কিছু বৈশিষ্ট্য প্রকাশ পাচ্ছিল। গতমাসেই ও চারবছরে পড়েছে। তারপর থেকেই আমি ধীরে ধীরে ওর মধ্যেকার বৈশিষ্ট্যগুলোকে প্রকাশ করতে সাহায্য করতে থাকি আমি “।

-“সে তো হবেই। তুমি মেটাহিউম্যান, ইভাঙ্কাও তাই হবে “। প্রচন্ড হতাশায় মাথা নাড়লো শমীক।

-” তা অবশ্য বেশিরভাগ সময়ই হয় না “। মৃদু হাসলো অতসী।

-“কতদিন ধরে তুমি ওকে এমন প্রশিক্ষণ দিচ্ছ “?

-“গত একমাস ধরে। গতমাসে ওর জন্মদিনের পরের দিনই আমি জানতে পারি ওর মধ্যে মেটাজিন আছে। সে দিন রাতে হঠাৎ একটা আওয়াজে আমার ঘুম ভেঙে যায়। পাশ ফিরে দেখি ইভাঙ্কা নেই বিছানায়। ভীষণ ভয় পেয়ে যাই। তারপর তোমার মতই ব্যালকনি বারান্দায় উঠে এসে দেখি ওর পিঠের দু’পাশ থেকে বেরিয়ে এসেছে ছোট্ট দুটি ডানা। ধীরে ধীরে নাড়াচ্ছে সে দুটো। সবকিছুই পরিষ্কার হয়ে যায়। সেদিন থেকেই শুরু করে দেই ওর ট্রেনিং “।

-“তোমরা কি এলিয়েন”? বিস্ময়ে মূঢ় হয়ে বলে ওঠে শমীক।

-“আমাদের পূর্বপুরুষরা অন্যগ্রহ থেকেই এসেছিলেন। মানুষের সাথে মিলনের ফলে মেটাহিউম্যানের সৃষ্টি হয়েছিল আজ থেকে বহু যুগ আগে। তবে বর্তমানে আমরা পৃথিবীরই বাসিন্দা। সাধারণ মানুষের সঙ্গেই আমরা থাকি। তাদের সঙ্গে আমাদের বিয়েও হয়। ঠিক যেমন আমাদের মধ্যে হয়েছিল। “

-” তোমার মা-বাবা? কিন্তু, তুমি তো ছোট থেকে অনাথ আশ্রমে মানুষ…”

-“সেটাই তো। ঐ অনাথ আশ্রমে থেকেই বড়ো হওয়া, পড়াশুনা, চাকরি আর তারপর তোমার সাথে অফিসে পরিচয় আর বিয়ে। কিন্তু, কিছুদিন থেকেই কয়েকজন মেটাহিউম্যান আমার সঙ্গে যোগাযোগ করছে। তাই আমাকে যেতে হবে তোমাদের ছেড়ে আমার বাবা-মায়ের প্রকৃত পরিচয়ের সন্ধানে। ততদিন ইভাঙ্কার সব দায়িত্ব তোমার। কিছুদিন পর আমি আবার ফিরে আসবো। মাঝের সময়টা তোমার অগ্নিপরীক্ষা। শুধু প্রতিরাতে তুমি ওকে খোলা আকাশে উঠতে দিও “।

তিন.

ব্যালকনির রেলিং এর ধারে দাঁড়িয়ে আছে শমীক ও অতসী। অতসীর ঠোঁটে গাঢ় চুম্বন এঁকে দিতে ব্যস্ত শমীক। হিউম্যান ও মেটাহিউম্যানের শরীরদুটি এক হয়ে গেছে। অতসীর বিশাল ডানাদুটি বেরিয়ে এলো মেরুদণ্ডের দুপাশ থেকে। ডানার আঁচলে ঢাকা পড়ে গেলো শমীকের পুরো শরীর। তারপর ধীরে ধীরে ডানা মেললো অতসী দূর জোৎস্নার দিকে। ভিতরে অঘোরে ঘুমাচ্ছে তখন আর একটি মেটাহিউম্যান।

এই বিভাগের অন্যান্য লেখাসমূহ

বালির বেহালা

বালির বেহালা

বুড়িমাসি বলেন,জীবনটা বালির ঘর গো।ঢেউ এলে ধুয়ে যায় জীবনের মায়া।তবু বড় ভালবাসা ওদের দাম্পত্যে।রোদের চাদরের…..

তদন্ত

তদন্ত

  এক ড্রইং রুমে বসে রয়েছে সদ্য কিশোর উত্তীর্ণ তরুণ গোয়েন্দা সজীব। সামনের টেবিলে ছড়িয়ে…..