ঝরা শিউলি
এক মেয়েটা মুঠো মুঠো জ্যোৎস্না কুড়িয়ে অপরের মুখমন্ডলে চাঁদ দেখত। মানুষের উপকার করার ক্ষেত্রে,…..
-দেখুন, এটা এখনো পরীক্ষাগত কোন রোগ নয়। একে উদ্বেগজনক আচরণগত একটি সমস্যা বলে ধরা হয়, যা পার্সোনালিটি ডিসঅর্ডারের সাথে যেতে পারে। তবে ভালো হবে যদি আপনি ওকে কগনিটিভ বিহেভিয়্যারল থেরাপিস্টের কাছে নিয়ে যান।
-ওখানে কেন? ওর কি মানসিক কোন সমস্যা মনে হচ্ছে?
-ঠিক তা না। অন্যান্য মানসিক সমস্যাগুলোর মতো এটি সাইকিয়াট্রিক গাইডবুকে (DSM-V) অফিসিয়াল ডায়াগনসিস হিসাবে এখনো তালিকাভুক্ত নয়। তবে এটি অবশ্যই একটি অন্তর্নিহিত মানসিক স্বাস্থ্য অবস্থার লক্ষণ। সে কারণেই এই থেরাপির কথা বলছি। এই ধরনের থেরাপিস্টরা ব্যক্তির মৌলিক চিন্তাভাবনা এবং জ্ঞানীয় ক্ষমতাকে যাচাই করে, বিশেষ করে যে বিষয়গুলো এমন আচরণ ও কাজের জন্য দায়ী বলে মনে হয়। এর ফলে ব্যক্তির আচরণের ধরণে একটি ইতিবাচক পরিবর্তন টানতে পারেন তারা।
সালমা বেগমের জন্য এ কথাগুলো শোনা সহজ ছিল না। গত মাস খানেক যাবত তিনি প্রাইমারি ফিজিশিয়ান মি. রেজা নুর এরকাছে যাওয়া আসা করছেন। বাঙালি বলেই তিনি নির্ভর করেছিলেন হয়তো সঠিক পরামর্শ বা সেবা পাবেন। কিন্তু উনার কথাশুনে সালমা বেগমের মন খারাপ হয়ে গেল।
-মি. নুর। আপনি অনেকটাই জানেন। কোন কারণ ছাড়াই এমন বানোয়াট কথাবার্তা, এই অভ্যাস কোথা থেকে এলো? আমাদের কোন দোষ আছে কি?
মি. রেজা নুর ডেস্ক থেকে চেয়ারটা ঘুরিয়ে, সালমা বেগমের দিকে তাকালেন। বললেন, দেখুন, মিথ্যা বলা মানুষের একটি সাধারণ আচরণ। যখন কেউ মিথ্যা বলে, তখন প্রায়ই তাদের কাছে মিথ্যা বলার একটি স্পষ্ট কারণ থাকে। মিথ্যা একটি হাতিয়ার যা মানুষ একটি লক্ষ্য অর্জনের জন্য ব্যবহার করে। তবে পৃথিবীতে এমন কিছু মানুষও রয়েছে, যারা কোন কারণ বা উদ্দেশ্য ছাড়াই মিথ্যা বলেন। তাদের মিথ্যা বলায় কোন পূর্ব-পরিকল্পনাও থাকে না। তাদের মিথ্যাচার ব্যাপক এবং বিস্তৃত। তাদের মিথ্যা বলার তাগিদ বাধ্যতামূলক-না চাইলেও তারা মিথ্যা না বলে থাকতে পারেন না। মনোরোগ বিশেষজ্ঞরা একে ‘প্যাথলজিক্যাল লাই’ অর্থাৎ এক ধরনের আচরণগত সমস্যা হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছেন। একে ‘সুডোলোজিয়া ফ্যান্টাস্টিকা’ বা ‘মিথোম্যানিয়া’ ও বলা হয়।
সালমা বেগম চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ালেন। এতো কঠিন সব শব্দ উচ্চারণেও সমস্যা হয় তার। হাতের ব্যাগটি কাঁধে ঝুলিয়ে মি. রেজা নুরকে ধন্যবাদ জানালেন।
মেডিক্যাল ক্লিনিকের সামনেই চারটা গাড়ি রাখার জায়গা। একটাতে মি. রেজা নুরের গাড়ি থাকে। আরেকটাতে সহকর্মীর গাড়ি। বাকি দুটো পড়ে থাকে রোগীদের জন্য, যিনি আগে আসেন, তিনিই পার্কিং পান। যেদিন পার্কিং স্পেসটা গাড়িতে ভরাট থাকে, সেদিন খুব ঝামেলা পোহাতে হয় রোগীদের। সানফোর্ড আর মেইন স্ট্রিটের মাঝামাঝি জায়গাটা মূলত ব্যবসায়ীদের জন্য। এখানে রাস্তায় মিটার পার্কিং আছে, পয়সা দিতে হয়। তবে যথেষ্ট ফ্রি পার্কিং নেই।
গাড়ির সিটে বসতেই তার মনটা বিষাদে ভরে গেলো। গাড়ি স্টার্ট দিতে গিয়েও দিলো না।
একটাই মেয়ে তার। মারিয়া। পড়াশোনায় ভীষণ ভালো। সবার সাথে খুব সহজেই মিশতে জানে। সারাক্ষণ হাসতে থাকা মেয়েটা প্রায়ই বানোয়াট সব কথাবার্তা বলে মা’কে কেন হতাশ করে ঠিক বুঝে উঠতে পারেন না তিনি। শুধু বাড়িতেই না, অন্যদের সাথেও মিথ্যা গল্প করে। এবং খুব সাবলীলভাবেই করে, যেন যা বলছে সব সত্য। সেদিন বিকালে বিনা দাওয়াতে পাশের ফ্ল্যাটের আপা এসে হাজির। চা-পানির সাথে সংসারের নানা বিষয় নিয়ে কথা বলছিলেন। একপর্যায়ে বললেন, কোথায় বাড়ি কিনছেন? সালমা যেন হঠাৎ ভিমরি খেলো!
-বাড়ি কিনছি?
-হ্যাঁ। মারিয়া বলল আমার মেয়ের কাছে কাল।
-ওহ! আচ্ছা।
-আপা, এটা কিন্তু একটা কাজের কাজ করেছেন। বিদেশে থেকে দেশের সম্পদ জমা রেখে কী লাভ? কে ভোগ করবে? আমাদের বাচ্চারা কি যাবে দেশে এই সম্পদের ভাগ নিতে? তাও তো আপনি দুই কোটি টাকার সম্পদ বিক্রি করে এখানে বাড়ি কিনতে পারছেন, আমার পোড়া কপাল! ভাইরা আমার সম্পদ কিনবেও না, বেচতেও দিবে না।
সালমা বেগম বেড়ে উঠেছেন মামার বাড়ি। বাবাকে দেখেননি, জন্মের আগেই বাবা বিদায় নেন। মাও ছিলেন সাথে জীবনের নটাবছর মাত্র। মামারাই তাকে বিয়ে দিলেন কলাপাতার গেট সাজিয়ে। একদিন ভাগ্যের চাকা ঘুরলো। ডিবি লটারি পেয়ে গেলেন দম্পতি। যুক্তরাষ্ট্রে চলে এলেন। এ দেশে এসেই জন্মালো মারিয়া, ষোলো বছর আগে। সম্পদ বলতে তার মেয়েটা-ই। আর বারো বছর পুরানো মডেলের একটা গাড়ি-টয়োটা করোলা। থাকেন তিনি ব্রোঙ্কে। অনেক বছর যাবত একই এপার্টমেন্টে থাকায় ভাড়াওখুব বেশি বাড়েনি। চাকরি করছেন লোকাল একটি ব্যাংকে। স্বামীও একই ব্যাংকে কর্মরত। আর্থিক ভাবে মোটামোটি, ভালোই চলছে সংসার। তবে, দুই কোটি টাকার সম্পদ বেচে বাড়ি কেনা! কল্পানাই করা যায় না। দেশে তার কিছু নেই মামাদের আদর স্নেহ ছাড়া।
বছর দুয়েক ধরেই মারিয়ার আচরণে এই পরিবর্তন এসেছে। ছোট বাচ্চাদের মতো খেলার ছলে বানোয়াট সব কথা কাহিনি বলে যায়। সালমা বেগমের ছোট ভাই, অর্থাৎ মারিয়া তার ছোট মামার সাথে বেশ সখ্য। ভিডিও কলে তাদের প্রায় প্রতিদিনই কথা হয়।মারিয়া তাকে ডাকে ‘বেস্টবাডি মামা’ বলে। সেই বেস্টবাডি মামার কানও ঝালাপালা হয় তার সব মিথ্যা কল্পকাহিনীতে। সালমা বেগম চিন্তিত হোন। কিন্তু তার ছোট ভাই বলেন, ‘বাচ্চা মানুষ বলে মজা পায়, এত ভেবো না তো বুবু।’
তবু সালমা বেগমের মন সায় দেয় না। পুরোনো টয়োটায় চড়ে খুশি মনে অন্যদের বলে, তাদের বিএমডব্লিউ গাড়ি আছে! যে নানাকে সে কখনো দেখেইনি, বন্ধুদের সাথে বলে বেড়ায় তার নানা দেশের মস্ত বড় বিত্তশালীদের একজন। সালমা বেগম আজকাল খুব বিচলিত হোন মেয়েকে নিয়ে। বেশি ভয় তার, মেয়ের স্বাভাবিক সাবলীল ভঙ্গিতে একের পর এর বানোয়াট সব কথা বলে যাওয়া নিয়ে।
ডিনার সেরে গতরাতে মেয়েকে নিজ কক্ষে ডেকেছিলেন তিনি। প্রতিবেশীর কাছে এত বড় বানোয়াট কথা লজ্জা ও হতাশায় ফেলেছিল তাকে। সেদিন প্রতিবেশীকে বলতে পারেননি তিনি, কোথায় বাড়ি কেনা হচ্ছে। মেয়ের মাথায় নারকেল তেল ডলে দিতে দিতে আলাপ শুরু করেছিলেন।
-মারিয়া!
-কী মা।
-আমাদের নিজের বাড়ি নেই বলে তোমার কি মন খারাপ হয়?
-নট রিয়্যালি!
-তুমি যখন পড়াশোনা করে চাকরি করবে, তখন একটা দামি গাড়ি কিনবে। তুমি ড্রাইভ করবে আর আমি, তোমার বাবা পাশেবসে দেখবো।
-ওকে মা।
-নানা-নানু কে খুব মিস করো?
-আই ডোন্ট নো!
মারিয়ার সাথে আলোচনা এমনই দায়সারা হয় তার। কোন কিছুই যেন তার কাছে সিরিয়াস না। মনে হয় যেন সব ঠিকঠাক আছে। কিন্তু সালমা বেগম টের পান, সব ঠিকঠাক নেই। কোথাও কিছু একটার গড়মিল হচ্ছে, তিনি সেটা বুঝতে পারছেন কিন্তু ধরতে পারছেন না।
ক্রিং ক্রিং ক্রিং! ফোনটা বেজে চলছে। ফোনের স্ক্রিনে তাকাতেই দেখলেন, মারিয়ার ফোন। কেটে দিলেন। আবারো ফোনটা বাজতে শুরু করলো, ক্রিং ক্রিং।
সালমা বেগমের আজ একদম ভালো লাগছে না। ফোনটা সাইলেন্ট মুড করে সরিয়ে রাখলেন ব্যাগের ভিতর। ক্লান্ত লাগছে শরীর, কিছুক্ষণ গাড়িতে ন্যাপ নেয়া যায়। মন খারাপের সাথে শরীরও কী খারাপ হয়? কে জানে! চোখ দুটো বন্ধ হতে শুরুকরেছে।
হঠাৎ তীব্র শব্দে গাড়ির হর্ন বাজতেই চোখ খুললেন সালমা বেগম। বুকের ধুকপুক টের পাচ্ছেন। এমন করে কেউ হর্ন দেয়!
কাচ জানালার বাইরে তাকাতেই দেখলেন, অন্য এক গাড়ি পার্কিং এর অপেক্ষায়। মি. রেজা নুরের ভিজিটর হবেন নিশ্চয়ই। গাড়িতে কাউকে ঘুমাতে দেখে হর্ন দিয়েছেন, ঠিকই তো আছে। এটা ঘুমানোর জায়গা নয়।
চোখ ডলে গাড়িটা সরালেন তিনি। ব্যাগ থেকে ফোনটা বের করলেন। সময় ততক্ষণে প্রায় বারোটার কাছাকাছি। তার মানে চল্লিশ মিনিটের মতো ন্যাপ হয়েছে, মন্দ না। মেয়ে ইতোমধ্যেই দশ-বারোটা টেক্সট ম্যাসেজ পাঠিয়েছে। কথা বলার চাইতে আজকালকার ছেলেমেয়েরা টেক্স করতে এতো পছন্দ করে কেন, কে জানে!
মেসেজগুলোর নটিফিকেশন ফোন স্ক্রিনের উপর উঠা-নামা করছে। পড়তে যে-ই ক্লিক করলেন, সালমা বেগম চিৎকার করে উঠলেন। “ইয়া আল্লাহ! ইয়া আল্লাহ! ও মারিয়া…. ও মারিয়া……..!”
গাড়ির স্পিড লিমিট বাড়িয়ে দ্রুতবেগে ছুটলেন বাড়ির দিকে। কিছুক্ষণের মধ্যেই পৌঁছালেন ব্রঙ্কস-এর ইস্ট ১৮১ স্ট্রিটের ভবনটির সামনে। একি! শতেকের উপর দমকল বাহিনীর সদস্যরা ঘিরে আছেন বিল্ডিংটি। গাড়ির শব্দ, চারিদিক থেকে ভেসে আসছে আর্তনাদ, বাঁচার শেষ আকুতি…. চিৎকার! জানালা দিয়ে কালো ধোঁয়ার সাথে পোড়া, ক্ষত, ঝুলন্ত শরীর…!
আগুন জ্বলছে। পোড়া গন্ধ বাতাস-নিঃশ্বাস ভারি করে দিচ্ছে।
সালমা বেগম হাতের ফোনটি বুকে চেপে ধরে ধপাস করে বসে পড়লেন রাস্তায়। ১৯ তলা উঁচু ভবনটির ৭ম ফ্লোরে তার এক বেডরুমের এপার্টমেন্ট। সেখানে আগুন-তাপে পুড়ছে তার একমাত্র মেয়ে-মারিয়া।
সালমা বেগম চিৎকার করছেন…. ক্যান সামওয়ান সেইভ মাই ডটার? মাই ডটার ইজ বার্নিং… প্লিজ মেয়েটাকে বাঁচাও! সে পুড়ে যাচ্ছে…!
কেউ তার কথা শুনছে না। চারদিকে কালো ধোঁয়া, পোড়া গন্ধ! তাপ আর অসহায় মানুষের চিৎকার! সে চিৎকারে সালমা বেগমের আর্তনাদ-কারো কানে পৌঁছুতে পারছে না।
তিনি চিৎকার করেই যাচ্ছেন! ক্যান সামওয়ান সেইভ মাই ডটার? মাই ডটার ইজ বার্নিং… প্লিজ মেয়েটাকে বাঁচাও! সে পুড়ে যাচ্ছে…!
এক মেয়েটা মুঠো মুঠো জ্যোৎস্না কুড়িয়ে অপরের মুখমন্ডলে চাঁদ দেখত। মানুষের উপকার করার ক্ষেত্রে,…..
শেষ থেকে শুরু। আমি রজকিনী রামী,ধোপার বংশে জন্ম আমার।ঘাটে সখিদের সঙ্গে কাপড় কাচি। একাজটা আমি…..
মালঞ্চার পথে ভোরবেলা। সূর্য সবে উঠছিল। বৈশালী দূর থেকে দেখতে পেল,বুনিয়াদপুর বাসস্ট্যান্ডে বালুরঘাটের দিকে মুখ…..
আমার বাবা ছিলেন অত্যন্ত সাহসী একজন লড়াকু মনের মানুষ।শত অভাব অভিযোগেও তাকে কোনোদিন ভেঙ্গে…..