মেয়েদের উচ্চশিক্ষায় প্রতিবন্ধকতা

আয়েশা মরিয়ম মাঝারভুইয়া
নারী
Bengali
মেয়েদের উচ্চশিক্ষায় প্রতিবন্ধকতা

জন্মের পর থেকে প্রতিটি শিশুর যেখানে একজন মানুষ হিসেবে সকল অধিকার নিয়ে বড় হয়ে উঠার কথা ছিল, কথা ছিল এ পৃথিবী সকল শিশুর বাসযোগ্য হবার, কথা ছিল সকল শিশু ভবিষ্যতের জন্য যোগ্য মানুষ হিসেবে বড় হবে। কিন্তু সেখানে লিংগভিত্তিক বৈষম্যের ফলে কন্যাসন্তানরা বিভিন্ন অধিকার থেকে বঞ্চিত ত হয়ই,সংগে থাকে বিভিন্ন ধরনের নির্যাতন। একটা কন্যা সন্তান জন্মের পর থেকেই প্রথম বৈষম্যের শিকার হয় তার পরিবারে। অনেক পরিবার আছে যেখানে  সংসারে একটি ছেলে ও একটি মেয়ে থাকলে আন্তরিকতায় তাদেরকে ভিন্ন ভাবে ট্রিট করা হয়। ছেলেকে নামীদামি স্কুলে ভর্তি করা হয় সেখানে কন্যাসন্তান পড়তে যায়  কোনোও অখ্যাত স্কুলে। মা বাবা মনে করেন ছেলেসন্তান হলো বংশের প্রদীপ এবং ভবিষ্যতে তাদের জন্য ভরসার হাত। জন্মের পর থেকেই মেয়েকে ভালো পরিবারে ভালো ছেলের সংগে বিয়ে দেওয়ার স্বপ্ন দেখেন তাই মেয়ের পড়াশোনায় এত অর্থব্যয় করার কারণ খুঁজে পান না,বিয়ের জন্য যতটুক দরকার ততটুক পড়াশোনা হয়ে গেলেই বিয়ের তোড়জোড়ে লেগে যান। আর যৌতুকের মত ভয়াবহ একটা ব্যাবস্থা তো আছে যা তাদেরকে আরো ব্যতিব্যস্ত করে তোলে। আর্থিক সংগতি থাকলেও ধর্মীয় গোঁড়ামি ও কুসংস্কার ,অবরোধ প্রথা ইত্যাদির জন্য মেয়েদেরকে উচ্চশিক্ষায় উৎসাহী করা হয় না।

বিয়ে একটা সামাজিক এবং ধর্মীয় প্রথা তবে বিয়ের চিন্তা প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষে শুধু শুধু মেয়েদের মনে শৈশব থেকেই ঢুকিয়ে দেওয়া হয়। মেয়ে যতই পড়াশোনা করুক ,ভালো চাকুরি করুক সবই বৃথা ভালো  বিয়ে না  হলে। তাই বড় হয়ে অন্য এক পরিবারের হাল ধরার জন্য তাকে সর্বংসহা হতে হবে,হতে হবে সর্বগুণসমন্বিতা। সমাজে আজো মেয়ের পরিচয় হয় স্বামীর পরিচয়ে কিন্তু ছেলেরা পরিচিত হয় নিজের বা বাবার পরিচয়ে। অনেক মা বাবা ইচ্ছে থাকা সত্বেও মেয়েকে দূরে কোথাও পড়তে পাঠান না নিরাপত্তার দোহাই দিয়ে, অবাধ যৌনতা ইত্যাদি বিভিন্ন সামাজিক অবক্ষয় রোধে তাদেরকে হতে হয় গৃহবন্দি অথচ সংগী পুরুষটিকে কোনো প্রশ্নের সম্মুখীন হতে হয় না। কর্মস্থলে ও মেয়েদের সহ্য করতে হয় নানা ধরনের নির্যাতনের। পিতৃতান্ত্রিক সমাজকাঠামোয় অধিকাংশ ছেলেরা নিজেদের থেকে শিক্ষাদীক্ষা এবং উপার্জনে কম যোগ্যতাসম্পন্ন মেয়েদেরকে পছন্দ করে তাই প্রেমিকের মন রক্ষার্থে মেয়েরা আবেগিক হয়ে নিজেদেরকে কম যোগ্যতাসম্পন্ন রেখে আত্মতৃপ্তি অনুভব করে, সেজন্য প্রেম তাদের জন্য প্রেরণাদায়ক তো নয়ই বরং উল্টো।

অনেক মেয়েরা বিয়ে হয়ে যাওয়ার পরও উচ্চশিক্ষা লাভ করতে ইচ্ছুক হন কিন্তু স্বামী পরিবার থেকে সাপোর্ট (?) পাননা তাই একসময় নিজেকে গুটিয়ে আনা ছাড়া উপায় থাকে না। আবার সন্তান লালনপালনে যাতে কোনো ক্রুটি না হয় সেজন্য অনেক পরিবারে চাকুরিজীবি মেয়ের  চাকুরি ছাড়িয়ে আনেন। মাতৃত্বকে কোথাও বা অতিমাত্রায় মহিমান্বিত করেও মেয়েদেরকে উচ্চশিক্ষায় নিরুত্সাহিত করা হয়েছে তাই কোন বাবাকে চাকরি ছাড়তে দেখা যায় না, মাকে ছাড়তে হয় তবেই না পরিবার আত্মীয়স্বজনের স্বস্তি মেলে। আবার বেশি বয়সে বিয়ে করলে মেয়েরা প্রজনন সমস্যায় ভুগে এমন একটা মিথ ও মেয়েদেরকে মানসিক ভাবে দুর্বল করে যা উচ্চশিক্ষা গ্রহণে পরোক্ষভাবে বাধাদান করে তাই তারা পড়াশোনার পাঠ চুকিয়ে দেয় কারণ আজন্ম তাদের শেখানো হয়েছে মাতৃত্বেই নারীজন্মের সার্থকতা।

পিতৃতান্ত্রিক সমাজকাঠামোয় নারী আজো পূর্ণ মানুষ নয় বরং ভোগের বস্তু, গল্পে-কবিতায় সাহিত্যে , ধর্মে কিংবা কর্পোরেটে নারী আলোচিত তার শরীর নিয়ে ,মেধাও মনন দিয়ে নয়। তাই শিক্ষা,কর্মক্ষেত্রে মুষ্টিমেয় কিছু নারী অনেক বাধা পেরিয়ে অনেকটা এগোলেও সিংহভাগই আজো কম সুবিধাপ্রাপ্ত এবং অর্থনৈতিক, সামাজিক ধর্মীয় বাধায় আটকা পড়া, তাদের কাছে উচ্চশিক্ষার স্বপ্ন আজো এক অলীক আকাংকা মাত্রই।

আয়েশা মরিয়ম মাঝারভুইয়া। লেখক। জন্ম ও বাস ভারতের অসম রাজ্যের হাইলাকান্দি জেলায়। বর্তমানে আসাম বিশ্ববিদ্যালয়ে পদার্থবিজ্ঞান নিয়ে Ph.D করছেন, চিত্রকলায় বিশেষ আগ্রহ থাকায় বিশারদ ডিগ্রি অর্জন করেছেন। গবেষণার সুবাদে চষে বেড়িয়েছেন ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলে।

এই বিভাগের অন্যান্য লেখাসমূহ

সাবিনা স্পিয়েলরিন: বাংলা সাহিত্যে জিঘাংসা ও জিজীবিষার নতুন পাঠ

সাবিনা স্পিয়েলরিন: বাংলা সাহিত্যে জিঘাংসা ও জিজীবিষার নতুন পাঠ

বিধবা রতিমন্জরী বুঝেছিল যে স্বামীবিয়োগজনিত দুর্নীতির পরিণাম পুরোটাই তার ওপর বর্তাবে। তার চাইতেও কঠিন হল,…..