মোরা একটি সেকেন্ড হোমকে বাঁচাবো বলে

মাসকাওয়াথ আহসান
রম্য রচনা, রাজনীতি
মোরা একটি সেকেন্ড হোমকে বাঁচাবো বলে
নতুন দিল্লিতে প্রণব মুখার্জি নেই। কোয়ালিশন ইয়ারস-এর সেই প্রাজ্ঞ চাণক্যের কলমটি ধুলোমাখা ডেস্কের কলমদানিতে আকুল হয় এই ভেবে ভেবে, কে আর লিখবে “কোয়ালিশন ইয়ারস টু পয়েন্ট ও”।
কলমটি যেন চেয়ার বসে সামনে টেবিলের ওপর শ্বশুরবাড়ি থেকে পাওয়া সুগন্ধী ডায়েরির পাতায় গোলাপের সুঘ্রাণে লিখতে শুরু করে আচম্বিতে।
ওয়াশিংটন থেকে ডোনাল্ড লু এসেছেন; সঙ্গে বিহারের সেই দীঘল চুলের হাসিখুশি মেয়েটি; মহারাণীর মতো নিটোল পায়ে রিনিক ঝিনিক মাদল বাজে ঢঙ্গে। সাউথ ব্লকের সুরম্য করিডোরে যেন, জিয়ারে জিয়ারে গানের সুরে আকুল হয় পুরুষ চোখগুলো। ডোনাল্ড লু’র পাশে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে; অমিত শাহ’র আক্ষেপে ভোজপুরি বিরহ গানের কলি উড়তে থাকে কার্নিশে, আমারি বধুয়া আনবাড়ি যায়; আমারি আঙ্গিনা দিয়া।
–লাদাখে একদিনের হামলায় চীনেরা হালাক করেছে অনেক ভারতীয় সেনা; জিয়া তোমার মন খারাপ লাগেনা! বিহারের রমেশ ঝাঁর ইউনিফর্ম পরা নিথর মৃতদেহের ছবি দেখে।
ডোনাল্ড লু বলেন, মিয়ানমারে জবাব দিতে হবে, রঙ মিং ঝাং-এর স্থির চিত্র দিয়ে। বেজিং-কে থামাতে হবে।
কলমটা সুগন্ধি ডায়েরিতে লিখতে থাকে, জাহাজ ভাঙ্গার যে কুরুক্ষেত্র; ঐখানে অর্জুনের ধনুক; শ্রীকৃষ্ণের রথসজ্জা যেন তাক করে থাকে বিষ গোলক; ছুঁড়ে দিতে হবে মায়ানমারে; মিং ঝাং -এর শরীর শরবিদ্ধ হলে দেখবে; চীন আর কোনদিন লাদাখের দিকে পা বাড়াবে না!
পতঞ্জলির রামদেব নাচতে নাচতে এসে লু আর জিয়ার কপালে লাল তিলক এঁকে দেয়; ইয়োগার ভঙ্গিতে টেবিলের ওপরে উঠে কোমর সরু করে দেখায় কলাকৈবল্য।
কলমটা লেখে, যা-ও এবার আমার শ্বশুরবাড়িতে যাও; জলপান যে করতে দেবে শালি ধানের চিড়ে।
শাহজালাল মাজারে পৌঁছাতেই খাদেমেরা এসে গোলাপ বৃষ্টিতে আকর্ণ হাসিতে গেয়ে ওঠে, মোরা একটি সেকেন্ড হোমকে বাঁচাবো বলে ধর্না ধরি।
হোটেল রুমে জিয়া তখন হেয়ার ড্রায়ারে চুল শুকাতে শুকাতে ভাবছিলো, অমন চুল খুলে আর নাইতে নেমো না; তোমার চুলে জড়িয়ে যাবে নদী; ওঘাটে আর আসবে না কেউ; অমন করো যদি!
দরজা ঠক ঠক করে মার্কিন মেরিন পিটার আসে; এফবি আই-এর তরুণ, জিয়া তোমার নাম নিয়ে গোলমাল হয়েছে। নামটা খালেদা জিয়ার সঙ্গে মিলে যাওয়ায় সহমত ভাইয়েরা ফেসবুকে উচ্চারণ শিক্ষার আসর বসিয়েছে। মিডিয়াকে শেখাচ্ছে; জিয়া না জিয়া না; জেয়া বলো!
জিয়া হাসে; সেই হাসির ফাঁসিতে একটা প্রজাপতি আত্মহত্যা করে ফুলদানিতে, জিয়া শব্দের ভ্যারিয়েন্ট জেয়া; অর্থ একই; যে যেভাবে ডাকে আরকী! এই শব্দের অর্থ সাকসেস।
কিন্তু এইখানে ভোট চোর ও ভোট ডাকাতদের উভয় পক্ষকে খুশি রাখতে ৪৮ ঘন্টার জন্য তোমার নামটা শেখ উজরা জিয়া করতে হবে যে!
–ওরে বাবা শেখ! বেশ তবে তাই হোক।
ডোনাল্ড লু আদালতে সাতক্ষীরা স্কুল অফ ল’র দলীয় আইনের স্ট্রিপটিজ দেখতে গেলে; কোত্থেকে একটা আইনের ওড়না; কাঁচুলি উড়ে এসে জড়িয়ে যায়; একদলীয় আইনের পরচুলা এসে লু’র ঠিক মাথায় বসে যায়। এফ বি আই এর ড্যানিয়েল, ওটা নিয়ে নিজে পরে নেয়।
ভোট চোরেরা ইংরেজিতে শ্লোগান দিচ্ছে, গো হাসিনা গো; উই উয়ান্ট পেয়ার এলেকশন!
লু মনে মনে ভাবেন, এখানে কী স্পোকেন ইংলিশ কোর্স হয় না! ওরে বাবা উয়ান্ট না ওয়ান্ট; আর পেয়ার কী! ফেয়ার বলো। এলেকশান কী! ইলেকশান!
শ্লোগান ভেসে আসে, হোয়াই ঠু এল ইন ইওর নেম; ভোট ডাকাট লীগ অলসো এল।
লু বলেন, কী সেন্টেন্স রে বাবা! বুঝেছি বুঝেছি! ঠিক আছে আমার নাম থেকে একটা এল কমিয়ে ভোট চোর বিএনপির পি নিয়ে নিচ্ছি; আমায় ডোনাল্ড পু বলে ডেকো খোকারা! এবার হলো তো!
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় জুড়ে; মেরে পিয়া গেছে মেরিল্যান্ড হিয়াসে আয়া হে টেলিফুন গান যেন বাজছে করিডোর এফোঁড় ওফোঁড় করে। একটা বাচ্চা এমেরিকায় না পড়লে কী ফরেন সার্ভিসের কোন মান ইজ্জত থাকে!
সবার চোখেই আকুতি, স্যার ভিসাডা বাড়াইয়া দিয়েন! আমার পোলাডা; আমার মাইয়াডা; হার এক্সসেলেন্সি বিবিডা!
শেখ আজরা জিয়া টুকে নেন একে একে সবার নাম। তদবিরে এগিয়ে শাড়ি পরা চশমা পরা আপারা। তাদেরকে অবশ্যই “স্যার” বলে ডাকবেন সাইনবোর্ড মুখে ঝোলানো আর ডিপ্লোম্যাটিক আকুল হাসি!
প্রধানমন্ত্রীর দপ্তর থেকে তাড়িয়ে দেয়া হয়েছে তেলাঞ্জলির আসর গুলোকে; যাদের দেখলেই ভোট ডাকাত বলে সন্দেহ হবে; এমন হারেরেরে অফিসার; গোমস্তা, চাকর, সহমত ভাই, সহব্রত দাদাকে নোটিফিকেশান দেয়া হয়েছে; যেন ত্রি সীমানায় তোদের না দেখি!
প্রধানমন্ত্রীকে একা দেখে ভালো লাগে শেখ উজরা জিয়ার। যখন এই ভদ্রমহিলাকে সেকেন্ড হোমের গোলাপ বাগানের দুর্জয় শাখার শিখরে দুর্নীতির ধারাপাতগুলোর কানকথা ঘিরে রাখে না; তখন মুশতাক বিহীন বঙ্গবন্ধুর দ্যুতি যেন থাকে হাসিখুশি ভদ্রমহিলার চোখে মুখে।
গোপালগঞ্জের নলেন গুড়ের পায়েস খেয়ে উজরা যেন বিহারে প্রপিতামহীর পায়েসের ধোয়া ওঠা সুঘ্রাণ পায়।
ডোনাল্ড পু নক্সী পিঠায় কামড় দিয়ে খ্রিসমাসে খালার হাতের পিঠা-পুলির স্মৃতিতে চলে যায়।
কিন্তু ছবি তোলার সময় তারা হাসিটাকে ভাগ করে নেয় অতিথিরা। উজরা আর ডোনাল্ড প্রাণ খুলে হাসে; আর দুজন এমেরিকান সাহেব গম্ভীর মুখে সুষ্ঠু ইলেকশানের বাজিটা ধরে! ফখরুলের সঙ্গে অন ক্যামেরা দেখা না হওয়ার হোয়াটস এপ দেখার সখা কী এই দুই গাম্ভীর্য।
অবশেষে বাংলাদেশের ব্যবসা জগতের ঋষি দরবেশদের সঙ্গে দেখা হয়। কিছুদিন আগে এমেরিকার বিমানবন্দরে সামান্য অপেক্ষা করতে হয়েছে কী হয়নি নাকি সেটা ভুল বোঝাবুঝি ছিলো; এখন নলেন গুড়ের পায়েস আর নক্সী পিঠায়; বঙ্গবন্ধুর অদৃশ্য উপস্থিতির উষ্ণতায় দূরত্ব কী কমে এলো; কিংবা অনুশীলিত নির্লিপ্ততায়;ভারতীয় ধনুক ব্যবসায় মার্কিন হাতুড়িতে জাহাজ ভাঙ্গার শব্দ পৌঁছে গেলো মেরে পিয়া গেছে রেঙ্গুনে!
প্রেসের সামনে দূরত্ব কমার রুটিন স্টেটমেন্ট; অথচ চোখে বিষাদের বুড়িগঙ্গা; মুখে দূরত্ব কমার ঠিক আছে সব ঠিক আছে; অথচ মুখমণ্ডলের স্পর্শকে দূরত্ব আরো দূরত্বের বিষাদ যমুনা! কী হবেরে কী হবেরে এখন; লর্ড কর্নওয়ালিশ নিজেই এসে কী চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত রদ করলেন!
বিমানের সিঁড়িতে দাঁড়ালে, উজরার আনমনে রোহিঙ্গা ক্যাম্পের সেই উপায়হীন শরণার্থী শিশুটির কান্নাভেজা মুখচ্ছবি একবার মনে পড়লো; তারপর আচম্বিতে যেন শুনতে পায় সেই বিরহ গীতি আকাশে বাতাসে, মোরা একটি সেকেন্ড হোম বাঁচাবো বলে ধর্না ধরি।
নতুন দিল্লির প্রণবের কলমটা সুগন্ধী প্যাডে লিখতে থাকে, ইউরোপীয় ইউনিয়ন মোদীর মানবাধিকার লংঘনের বিষয়টি অগ্রাধিকার হিসেবে নিয়েছে। হায় রাম, যদি এই গেরুয়ার সৌরভ না থাকে; আবারো যদি রাহুল-মমতা-প্রিয়াংকারা হতচ্ছাড়া অসাম্প্রদায়িকতার নেহেরু পতাকা উড়িয়ে চলো ছাইয়া ছাইয়া নেচে ওঠে গণতন্ত্রের রেলগাড়ির ছাদে; কী হবে রে কী হবে রে এখন!
কলমটা কলমদানিতে ফিরে গিয়ে যেন দীর্ঘশ্বাস ফেলে, আমি নেই, ভাবতেই ব্যথায় ব্যথায়; যেই ভাবি আমি নেই!
কলমটা যেন ঢাকায় ভারতীয় দূতাবাসে চেয়ার বাগিয়ে বসে সুপোরি গালে পুরে, বাকিরা সব দাঁড়িয়ে থাকো; যতক্ষণ না তোমাদের চিরস্থায়ী বন্দোবস্তটা আবার ফিরিয়ে আনছি!

মাসকাওয়াথ আহসান। লেখক, শিক্ষক ও সাংবাদিক। 'শিল্পের জন্য শিল্প নয়, সমাজ-রাজনৈতিক উত্তরণের জন্য শিল্প' এই ভাবনাটিই মাসকাওয়াথ আহসানের লেখালেখির প্রণোদনা। নাগরিক বিচ্ছিন্নতার বিচূর্ণীভাবনার গদ্য ‘বিষণ্ণতার শহর’-এর মাঝ দিয়েই লেখকের প্রকাশনার অভিষেক ঘটে। একটি পাঠক সমাজ তৈরি হয় যারা নাগরিক জীবনের...

এই বিভাগের অন্যান্য লেখাসমূহ