মৌ কথা 

শ্বেতা সরকার
ছোটগল্প
Bengali
মৌ কথা 

গুছাইতদের বাড়ির গলিটা পার হতেই মৌকে দেখা গেল। টিয়া রঙা কুর্তিতে দারুণ লাগছে তাকে। অতসীদের পাশ দিয়ে স্কুটি নিয়ে হুস করে বেরিয়ে গেল মৌ।

“দেখলে কেমন ভোঁ করে চলে গেল, তাকালোনা পর্যন্ত “।

বলে উঠলো পিউ।

“কি গাঢ় গাঢ় রঙ পরছে আজকাল, উঁচু করে চুল বাঁধে, স্টাইল বেড়েছে কেমন দেখেছো “।

এই শুরু হল। মনে মনে বিরক্ত হয় অতসী। আজ মাস খানেক ধরে এই সব চলছে। বেশ কিছুদিন সে এদের সাথে হাঁটা বন্ধ রেখেছিল। পায়ে ব্যাথার বাহানা দিয়ে ছাদে হাঁটাহাঁটি করতো। ভেবেছিলো কিছুদিন পর আলোচনাটা ঠিক আস্তে আস্তে বন্ধ হয়ে যাবে। গত সপ্তাহে আবার হাঁটার দলে যোগ দেওয়ার পর সে বুঝেছে আলোচনা থামেনি। উল্টে দিন দিন বেশ মশলাদার হয়ে উঠেছে।

মাসখানেক আগে মৌয়ের বর বিনয়কৃষ্ণ ছাদ থেকে পড়ে মারা যান। আকস্মিক মর্মান্তিক ঘটনা। তবে নামের মত বিনয়কৃষ্ণ বিনয়ের অবতার হলেও অন্য দিক থেকে তিনি কৃষ্ণের গুণ সম্পন্ন না হয়ে ভোলেবাবার গুণসম্পন্ন ছিলেন। সারাদিনই তার মুখে অ্যালকোহলের সুবাস ম ম করতো। সন্ধ্যার পর বন্ধু জুটিয়ে তাদের ভরপেট খাবার ও মদ দুইই সরবরাহ করতেন। তবে অনেক সুযোগ সন্ধানীই সুকৌশলে মদের গ্লাস সরিয়ে রেখে সুখাদ্য উদরস্থ করার পর আকণ্ঠ গিলে ফুল লোড হওয়া বিনয়কৃষ্ণকে গাড়িতে তুলে বাড়ী পৌঁছে দিতেন। পাড়া বেপাড়ার হেন কোন ছেলে ছোকরা, আধবুড়ো, বুড়োর দল নেই যারা তার পয়সায় ফুর্তি করে খাওয়া দাওয়া করেনি। পিতৃপুরুষের বিষয় সম্পত্তি আর বড় সরকারী চাকরীর দৌলতে ভাঁড়ারে টান পড়েনি কখনো।

বিনয়কৃষ্ণর বাবা বটকৃষ্ণের জমিতে মজুর খাটতেন মৌয়ের বাবা। তার মদিরা মোহন ছেলেটিকে যে কোন সম্পন্ন বাড়ির লোক জামাই করতে রাজী হবে না  দূরদর্শী বটকৃষ্ণ তা বুঝেছিলেন। তাই গরীব ঘরের সুন্দরী মৌকে রাজরানী করে রাখবেন এই কথা দিয়ে বিনা পণে ছেলের বৌ করে এনেছিলেন। রাজরানীই হয়েছিল মৌ। খাওয়া পরা থেকে শুরু করে ঝি চাকর আমোদ আহ্লাদ কোন কিছুতেই কমতি ছিলোনা তার। একমাত্র ছেলেটিও নামী স্কুলে পড়াশোনা করে। রসেবশে থাকা বিনয়কৃষ্ণ স্ত্রী পুত্রের সুখ সাচ্ছন্দ্যের কোন ত্রুটি রাখেননি। হঠাৎ এই দুর্ঘটনা। বেচারী ত্রিশ বত্রিশের মৌ ক্লাস এইটের ছেলেকে নিয়ে সম্পূর্ণ একা। সে ছাড়া ছেলের স্কুল টিউশন ড্রইং সুইমিং এসব সামলাবে কে? অগত্যা তাকেই ছুটতে হচ্ছে দিনরাত। বাইরে বেরোতে হলে নিজেকে একটু পরিপাটি রাখতেই হয়। তাই নিয়েই যত সমস্যা। মৌ কি পরছে, কি খাচ্ছে, কখন কাজে বেরোচ্ছে, কখন অকাজে বেরোচ্ছে এই সবের নিউজ আপডেট সব সময় সাপ্লাই হতে থাকে।দিনদিন এই সব আপডেটে মশলার ভ্যারাইটি মিশছে। আসলে পাড়া প্রতিবেশীদের বড় সাধ ছিলো, অকাল বিধবা মৌ আলুথালু বিরহিণী হয়ে শোকসাগরে নিমগ্ন থাকবে, আর তারা সময় করে যে যার মত নাকি কান্না কেঁদে আসবে। এই মধুর সাধে ছাই পড়তেই মৌয়ের এপাশ ওপাশ সামনে পিছনে ডাইনে বাঁয়ের মুখরোচক নিউজ আপডেট শুরু হয়েছে।

“স্কুটি নিয়ে খুব উড়ছে আজকাল। আমার বর তাই বলছে, জানে না তো একটা উইডোর জীবন যে কি, টের পাবে মজা”।

মুখ বাঁকিয়ে বলে রুবি।

“আসলে খেতে না পাওয়া লোকেরা হাতে সব পেলে যা হয়, ধরাকে সরা দেখছে বুঝলে “।

কথা জোড়ে পিউ।

“যা বলেছো “

তাল দেয় তনিমা।

“ওই তো পাশের বাড়ী বলছে, ওসব পড়ে টড়ে  যায়নি গো, মদে তো হুঁশ থাকতো না, সুযোগ বুঝে ঠেলে দিয়েছে বুঝলে, বাঁধানো ছাদ থেকে পড়ে যায় নাকি অমনি আমনি “।

এইবারে সত্যি সত্যিই অতসীর মাথা ধরছে। মনে মনে গজগজ করে সে, বলিহারি যাই, পাশের বাড়ির দাদা কি মাঝরাতে ছাদে বিড়ি ফুঁকতে এসেছিলো , নাকি অম্বলের ঢেঁকুর তুলে হেঁটে গ্যাস কমাতে এসেছিলো। মনের গজগজানি মনেই রেখে ভালো মুখে বলে ওঠে অতসী,

“বিনয়বাবু মানুষ ভালো ছিলো কি বলো, কত লোককে যে খাইয়েছে “

” সে আর বলতে”।

বলে ওঠে তনিমা।

শুধু কি খাওয়া, পুজো পোগ্রাম বলো বা বিপদে সাহায্য বলো মানুষটার না ছিলোনা কোন সময়ে। টাকা থাকলেই তো আর দেওয়ার মানসিকতা থাকেনা গো। কোনদিন কাউকে খালি হাতে ফেরায়নি “।

“তা তো বটেই, ওই নেশাটাই যা সমস্যা ছিলো “।

বলে ওঠে অতসী।

“টাকার তো অভাব ছিলোনা”।

রুবি বলে ওঠে।

“তা বাপু বড়লোকদের ওরম নেশাটেশা একটু আধটু থাকে, তবে চরিত্রের দোষ ছিলোনা কিন্তু, কতবার তো ছেলেকে টিউশন থেকে আনতে গিয়ে দেখা হয়েছে, রীতিমত টলছে গো, দেখে ভয় লাগতো, কিন্তু আমাদের দেখেই রাস্তার পাশে চুপ করে মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে যেত , আমরা পার হলে তখন আবার চলতে শুরু করতো গো “।

“হ্যাঁ গো, আমার সাথে দেখা হলেও তাই করতো, লোড হলে কি হবে সম্মান করতো খুব “।

বললো তনিমা।

” তবে যা গন্ধ ছাড়তো গো, কোনরকমে পাশ কাটিয়ে পালাতাম, নাকে চাপা দিলে আবার কি না কি ভাববে, তাই দমবন্ধ করে পা চালাতাম গো “।

হেসে বলে পিউ।

অতসী মনে মনে হাসে। তারপর বলে,

“শুধু পাশ দিয়ে যেতে গিয়েই বমি চলে আসতো? তাহলে ভাবো, ওই রকম সুগন্ধ নিয়ে বিনয়বাবু যখন মৌয়ের ওপর পড়তেন তখন সে বেচারীর কি অবস্থা হতো গো। অমন সুগন্ধি চুমু আদর বেচারীকে তেরো চোদ্দ বছর ধরে হজম করতে হয়েছে। আহারে কি গা গোলানো কষ্টটাই না পেয়েছে।না খেতে পাওয়া ঘরের মেয়ে হলেও বমিকে তো বমিই আর হাগাকে তো হাগাই মনে হবে। বিয়ের সাতপাক ঘুরে নিলে মদের গন্ধ তো আর আতরের সুবাস হয়ে যাবেনা। তা সে যদি সুযোগ পেয়ে এই গা ঘিনঘিনে অবস্থা থেকে বেরোতে চায়… “

ভেবলে গিয়ে বোবা হয়ে যাওয়া মাল গুলোর দিকে প্যাটপেটিয়ে তাকালো অতসী। তারপর বললো,

” না না আইনের চোখে অন্যায় কাজ অবশ্যই, কিন্তু কি জানতো, বেঁচে থাকার ও তো কিছু আইন আছে। ওই যে কথায় বলেনা, ঘাড়ে এসে পড়লে হয় দমবন্ধ করে মরতে হয় নয়তো ধাক্কা দিয়ে সরাতে হয়। তা এত বছর দমবন্ধ করে মরার পর যদি কেউ সুযোগ পেয়ে ধাক্কা মারে… “

তিনজনের দিকে তাকিয়ে হাসলো অতসী।

“ওই দেখো, সাড়ে ছটা বেজে গেলো গো। মেয়ে টিউশন যাবে। কাল থেকে তোমরা আর আমার জন্য ওয়েট কোরোনা বুঝলে, ভাবছি মেয়েকে নিয়ে কাল থেকে কলেজ পাড়ার দিকে হাঁটতে যাবো, আসি গো “।

তিনজনের উত্তরের অপেক্ষা না করে হনহনিয়ে পা চালালো অতসী। বড় রাস্তায় আসতেই দেখলো মৌ ছেলেকে নিয়ে সুইমিং থেকে ফিরছে। অতসীকে একা দেখে ঘাড় কাত করে এক গাল হাসলো মৌ। তারপর বাড়ির দিকে স্কুটি ঘোরালো।

শ্বেতা সরকার। জন্ম ১৯৭৮ সালের ফেব্রুয়ারি। স্থান, বাবার কর্মস্থল টিকিয়াপাড়া রেল কোয়াটার, হাওড়া,বাংলা, ভারত। পাড়ার প্রাথমিক বিদ্যালয়ের পাঠ শেষ করে হাওড়া নরসিংহ কলেজ থেকে বায়ো-সায়েন্সে স্নাতক। ছোট বেলা থেকেই নাচ,গান, আবৃত্তি, ছবি আঁকা, ফটোগ্রাফিতে ছিল শখ। বিবাহসূত্রে খড়্গপুরের বাসিন্দা। আঞ্চলিক...

এই বিভাগের অন্যান্য লেখাসমূহ