যদি এমন হয়

শাপলা জাকিয়া
অণুগল্প, পডকাস্ট
Bengali
যদি এমন হয়

স্থান: বাংলাদেশ।

সময়: রাত দুইটা।

একুশ বছরের একজন রুপবতী তরুণী পার্কের কোণার দিকে একটা বেঞ্চে বসে আছে। তার খুব ক্লান্তি লাগছে। সে আরেকটু আরামের আশায় বেঞ্চটায় লম্বা হয়ে শুয়ে পড়লো। মেয়েটির নাম ইয়ানা। সে পেশায় ইঞ্জিনিয়ার। সামনের সপ্তাহে বান্ধবীর সাথে ওর পাহাড়ে বেড়াতে যাওয়ার কথা। তাই অফিসের জরুরী কাজটা ওকে আজ শেষ করতেই হলো। কাজ করতে করতে কখন এতো রাত হয়েছে, টেরই পায়নি। কাজ শেষে একটু প্রাকৃতিক হাওয়ায় বসে থাকতে ইচ্ছা করছিল ওর , তাই বাড়ি না ফিরে পার্কে চলে এসেছে ইয়ানা।

গল্পের অডিওপাঠ শুনুন এখানে:

অবশ্য এই সাত হাজার ষোল সালে রুমের মধ্যেই প্রাকৃতিক আবহাওয়া তৈরী করা যায় এসি ছাড়লে। ঠান্ডা বাতাসের সাথে সাথে গাছ অথবা ফুলের মিষ্টি গন্ধে ঘর ভরে যায়। কখনো বিকেলের নরম আলো, কখনো ভোরের স্নিগ্ধতা, কখনো রাতের মায়াবী আলো চুঁইয়ে চুঁইয়ে পড়ে মেশিনটা থাকে। যেটা চাই, সেই অপশনে ক্লিক করলেই হলো। কিন্তু ইয়ানা খুব অরিজিনালিটির ভক্ত। আর্টিফিশিয়াল কোন কিছু ওকে তেমন টানে না।

ওকে টানে প্রাচীন পৃথিবী। যখন মানুষ প্রকৃতির সন্তান হয়ে প্রকৃতির কোলে বেঁচে থাকতো। যখন পুরুষ জাতি বিলুপ্ত হয়নি। নারী ও পুরুষ পরস্পরকে ভালোবেসে ঘর বাঁধতো, জন্ম নিতো তাদের ভবিষ্যৎ বংশধর।

পাঁচ শতাব্দী আগে পুরুষ জাতি পৃথিবী থেকে বিলুপ্ত হয়ে গেছে। এখন ক্লোন করে সৃষ্টি করা হয় ভবিষ্যৎ প্রজন্ম। তাই একজন নারী থেকে শুধু একজন নারী শিশুই জন্মায়।

পাঁচ শতাব্দী আগে বিলুপ্ত হয়ে যাওয়া পুরুষ প্রজাতি সম্পর্কে এখন আর তেমন তথ্যের প্রচার নাই। তাই পুরুষদের সম্পর্কে খুব বেশী কিছু জানে না ইয়ানা। গতকাল কৌতুহলী হয়ে পুরানো একটা নিউজ আপলোড করেছে সে। পুরোটা দেখা হয়নি সময়ের অভাবে। শুধু একজন অতি সুদর্শন পুরুষের স্থিরচিত্র ওকে যারপরনাই মুগ্ধ করেছিল। অপলক নেত্রে সেই মুখের দিকে তাকিয়ে থেকেছে ইয়ানা। পুরুষ মানুষ এতো সুন্দর হতে পারে! আহা কার স্বামী ছিল সে, কার প্রেমিক?

সেই মুখটির কথা মনে হতেই ঝটপট উঠে বসে ইয়ানা। ব্যাগ খুলে টিভি গ্লাসটা চোখে পরে নেয়। নিউজটা অন করতেই সুদর্শন পুরুষটির মুখ ভেসে ওঠে স্ক্রিনে। ইয়ানা দ্বিতীয়বারের মতো আজ আবারও প্রেমে পড়ে। বুকের মধ্যে হু হু করে ওঠে ওর। আহা, কয়েকশ বছর আগে এই পুরুষটির সময়ে যদি জন্ম হতো ওর, তবে ঘর বাঁধতো সে তার সাথে। কোন চাকরি বাকরি করতো না। সারাদিন শুধু এই মানুষটার আশেপাশে ঘুরঘুর করতো।

পুরুষটি সম্পর্কে বিস্তারিত জানার জন্য ছবির নিচে ক্লিক করে ইয়ানা।

পুরুষটি বাংলাদেশী, একটি সম্মানজনক পেশায় জড়িত ছিল। কিন্তু সে এক নারীর কাছে প্রত্যাখ্যাত হয়ে সেই নারীটিকে নৃশংসভাবে খুন করে। এতো জোরে তার চুল টেনে ছেঁড়ে যে মেয়েটির নাক -মুখ দিয়ে রক্ত বেরিয়ে আসে।

ভয়ংকরভাবে শিউরে ওঠে ইয়ানা। এতো মানুষ নয়, পিশাচ! আর সে কি না এই জানোয়ারটার প্রেমে পড়েছিল। তাড়াতাড়ি ছবিটা থেকে সরে আসে ও। একটা সম্ভ্রান্ত চেহারার পুরুষের চেহারায় ক্লিক করে।

তার সম্পর্কে বলা হয়েছে, তিনি একজন শিক্ষক ছিলেন কিন্তু একবার তার সাত বছরের ছাত্রকে যৌন নির্যাতন করে মেরে ফেলার পর ধরা পড়েন।

হতভম্ব হয়ে বসে থাকে ইয়ানা। পুরুষ সম্পর্কে এসব তথ্য এতোদিন তার অজানা ছিল। সাহস করে পরের পাতায় যায় সে। খুব সাধারণ দেখতে একজন পুরুষ সম্পর্কে জানতে চায়।

উত্তর আসে, এই পুরুষ মানুষটি তার সন্তানসম্ভবা স্ত্রীকে পেটে এমনভাবে লাথি মেরেছিলো যে তাতে করে স্ত্রী এবং গর্ভস্থ সন্তান একই সাথে মারা যায়।

এখানে কি একটাও ভালো পুরুষের কথা নাই! আরেকটু খোঁজে ইয়ানা মরিয়া হয়ে। এবার একজন দরিদ্র পুরুষের ছবিতে ক্লিক করে সে, লোকটি পেশায় ভ্যান চালক। তার অপরাধ হলো একটি ধর্ষিত রমণীর লাশ তার ভ্যান গাড়ীতে বহন করার সময় সে লাশটিকে পুনরায় ধর্ষণ করেছিল।

এরপরই একজন পাঞ্জাবী যুবকের ছবি দেয়া আছে, যে সদ্য কবর দেয়া হয়েছে এমন নারীদের কবরে প্রবেশ করতো তারপর লাশটিকে রেপ করতো!

ঘৃণায় গা গুলিয়ে ওঠে ইয়ানার। সে তাড়াতাড়ি একজন কিশোরের ছবিতে ক্লিক করে এই আশায় যে কিশোরটি নিশ্চয় এসব করার সুযোগ পায়নি। কিন্তু সে অবাক হয়ে দেখে কিশোর সম্পর্কে বলা হয়েছে, সে একটি যাত্রীবাহী বাসে আর সবার দেখাদেখি গ্যাং রেপে অংশগ্রহন করেছিল।

আরও একটি গ্রুপ ছবি দেখলো ইয়ানা। ইন্ডিয়ার এক আশি বছরের বৃদ্ধাকে এই পুরুষগুলি গ্যাং রেপ করে মেরে ফেলেছিল।

আরেকজন পুরুষ হাসিমুখে দাঁড়িয়ে আছে। সে এক বয়স্কা রমনীকে তার কিশোর পুত্রের সামনে বিবস্ত্র করে অত্যাচার করে। এক পর্যায়ে মাথা ন্যাড়া করে ছেড়ে দেয়।

নাহ্ ইয়ানা আর নিতে পারছে না। ওর মনে হয় ও কোন বিষাক্ত জগতে ঢুকে পড়েছে। পুরুষগুলির ছবি যেন এখনি আক্রমণ করবে ওকে। অস্থির ইয়ানা আর কোন পুরুষের ছবিতে ক্লিক না করে দ্রুত শেষ পাতায় চলে আসে। সেখানে রিপোর্টার মেয়েটি তার নিজের মতামত লিখেছে –

“পুরুষ জাতি পৃথিবীর সভ্যতায় অনেক অবদান রেখেছিল। পৃথিবীর উন্নতির সিংহভাগ কৃতিত্বই ছিল তাদের। কিন্তু পুরুষেরা প্রকৃতিগতভাবেই বহুগামী এবং ধর্ষকামী। বিলুপ্ত হওয়ার আগে তাদের মধ্যে এই প্রবণতা আশংকাজনক হারে বৃদ্ধি পায়। মানব সভ্যতা হুমকির মুখে পড়ে। কিছু উন্নত মনের পুরুষ ছিলেন কিন্তু তাদের সংখ্যাটা ছিল হাতে গোনা। আমরা জানি প্রকৃতি তার ত্রুটিপূর্ণ সৃষ্টিকে বাঁচিয়ে রাখতে পছন্দ করে না। তাই ডাইনোসারদের মতো পুরুষ জাতিও একদিন বিলুপ্ত হয়ে যায়। একটি বিচিত্র ভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে মাত্র বিশ বছরের মধ্যে পৃথিবী থেকে সমস্ত পুরুষ নিশ্চিহ্ন হয়ে যায়।”

যাক্ বাবা, ভালো হয়েছে! -বলে একটা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে ভিডিও গ্লাসটা চোখ থেকে খোলে ইয়ানা। গ্লাসের একপাশে লেখা রাত তিনটা। চারদিকে তাকায় ও। নিউজের বীভৎস তথ্যগুলি দেখার পর এখন শান্ত পার্কটা ওর চোখকে বড় আরাম দেয়। মৃদু আলোয় চারপাশটা স্বপ্নিল মনে হয় ওর। বাতাসের ঠাণ্ডা পেলব ছোঁয়া আর কামিনী ফুলের সুবাসে নেশা ধরানো ঘুম পায় ইয়ানার। বেঞ্চটায় আবার শুয়ে পড়ে ও। ঘুমানোর আগে নিজেকে বিড়বিড় করে বলে,

“নিশ্চিন্তে ঘুমাও মেয়ে, চারপাশে কোথাও কোন পুরুষ নেই…”

 

(লেখকের নোট: এই গল্পটি কাল্পনিক, তবে গল্পে বর্ণিত পুরুষদের কাণ্ডকারখানাগুলো সত্যি।)

শাপলা জাকিয়া। লেখক ও ফ্রিল্যান্স সাংবাদিক। পৈত্রিক নিবাস কুষ্টিয়া হলেও স্কুল ও কলেজ জীবন কেটেছে নারায়ণগঞ্জ শহরে। নারায়ণগঞ্জ সরকারি তোলারাম কলেজ থেকে রাষ্ট্রবিজ্ঞানে স্নাতকোত্তর করেন। বর্তমান নিবাস ঢাকা। যুক্ত ছিলেন ফ্রিল্যান্স সাংবাদিকতায়। দীর্ঘদিন কাজ করেছেন দৈনিক যুগান্তরে। তাঁর প্রকাশিত গ্রন্থসমূহ- খুন...

এই বিভাগের অন্যান্য লেখাসমূহ

দৌড়

দৌড়

একবার এক দৌড় প্রতিযোগিতায় কেনিয়ার হয়ে দৌড়চ্ছিলেন আবেল মুতাই। খুবই ভালো দৌড়াচ্ছিলেন তিনি। সবাইকে পেছনে…..