প্রক্সি
তারপর ইলেকট্রিক বিল জমা দিতে যাবো। আমার দেরি হবে আসতে। স্বামী অমর বলে, ঠিক আছে।…..
পঞ্চদশ বর্ষে পদার্পন করিতে আরো ৬ মাস বাকি। কন্যার পিতা হয়ত অপেক্ষা করিতে পারিতেন কিন্তু ঘটককুল এবং দূর অদুরের উপযুক্ত পুত্রের পিতাগণ অপেক্ষা করিতে চাহিলেন না। কারন তাহার রূপের সুখ্যাতি এবং পিতার বৈভবের সুরভি।
রূপের সুখ্যাতির কারনে কন্যার পিতা, পিতৃব্যগণ কেউই আর ভরসা করিতে পারিলেন না। বহু যাচাই বাছাই করিয়া মঙ্গল হইতে পারে এমন পাত্রের হাতে যথোপযুক্ত পণ প্রদান করিয়া কন্যাকে সম্প্রদান করা হইল।
যাহার অগ্নিরূপি রূপ হেতু পিতাগণ দ্রুত পাত্রস্থ করিতে বাধ্য হইয়াছিলেন, পাত্রকুল এমন ঐশ্বর্য্যকেও খুটিয়া খুঁটিয়া দেখিলেন যেমন ক্রয়যোগ্য পশুকে নিরীক্ষণ করিয়া থাকে কোন ধূর্ত বণিক। অথচ তাহাদেরকে দেখিয়া মনে হয়না তাহারা নিজেরা কখনও দর্পনের সম্মুখে দন্ডায়মান হইয়াছেন!
রাজকীয় মঞ্চ, আলোর রোশনাই, পুষ্পগন্ধে চতুর্দিক আমোদিত হইয়া আছে এরই মধ্যে দিয়ে সুলক্ষণা সুদর্শনা কন্যা চলিয়া গেলেন তাহার জন্য নির্ধারিত নূতন তপোবনে।
স্বাভাবিক ভাবেই বয়সজনীত তিস্তা নদীর প্রবল স্রোতে ভাসিয়া গেল দুইজন। ফলাফল কন্যার গর্ভসঞ্চার। যথাযথ কাল অতিক্রম শেষে কন্যা প্রসব করিলেন একটি অমিয় সন্তান। হইলেন নবমাতা। যেন তাহার নতুন জন্ম হইল। আহা! জগতে এত আনন্দ! অতিকায় ক্ষুদ্র একতাল মনুষ্য অবয়বের প্রতি এত প্রবল মায়া! একেই তাহা হইলে মাতৃত্ব বলিয়া থাকে! সন্তান সুখে কন্যা নিমগ্ন রহিলেন।
শুভ্র চুনসুরকি নির্মিত প্রাচীন দালানটি নদীতীরে এক বনের মধ্যে, যেটি আর নিজস্ব বর্ণে নেই। কোথাও কোথাও প্রাচীর ভাঙ্গিয়া পড়িয়াছে, লতা গুল্ম শ্যাওলা বাড়িয়া উঠিয়াছে অবারিত ভাবে। দালানের কেবল সম্মুখ অংশের কিঞ্চিত অংশ ব্যবহার উপযুক্ত রহিয়াছে। সেইটাই তাহাদের তপোবন। নাম জানা না জানা তরু গুল্ম লতা বৃক্ষে চতুর্দিক ঢাকা। জায়গায় জায়গায় ঝোপজঙ্গলে পরিপূর্ণ, নিবিড় ঘন বন। চারিদিকে পাখপাখালির কূজন। গাছে গাছে শত রকমের হাজার হাজার পক্ষীকুলের অভয়ারণ্য। সর্প, বেজি, শজারু, ইঁদুর এইখানে নির্ভয়ে চলাচল করিয়া থাকে। আর এদের সহিত এরই মাঝে অভিমন্যু নামে এক দেবশিশু খেলিয়া বেড়ায়। জঙ্গলের সকল প্রাণী তাহার সঙ্গী বন্ধু। খিদে পাইলে সে নিজেই কোন গাছ হইতে ফল আহরণ করিয়া মায়ের অগোচরেই গলাধঃকরণ করিয়া ফেলে। বিস্ময়কর ব্যাপার যে কখনও সে মনুষ্যদেহের অনুপযুক্ত কোন ফল ফলাদি গ্রহন করেনা। প্রকৃতির মাঝে প্রকৃতিরই অংশ হইয়া সে বড় হইতে লাগিল। এইজন্য বোধকরি প্রকৃতি নিজেই তাহাকে রক্ষা করিবার দায়িত্ব পালন করিতে লাগিল।
পিতার নির্দেশ এবং পণের লোভেই কেবল এই অনিচ্ছাকৃত বিবাহে অংশ নিয়াছিল অভিমন্যুর জন্মদাতা, অভিনব এই পুরুষটি। সে পঞ্চপান্ডবের একজন না হইলেও সেই গোত্রেরই একজন বলা যায়। তাহার একজন মদ্যপ দুশ্চরিত্র কনিষ্ঠ ভ্রাতা আছে এবং সেই ভ্রাতৃবধূ একজন দ্রৌপদি। দুই ভ্রাতার এক বধূ এবং তাহাদের একাধিক সন্তান। সেখানেই তাহাদের সুখের সংসার। অভিনব পুরুষটি এই সংসারের প্রেমময় ভাসুর এবং অতি স্নেহময় পিতা। নিজের সমস্তকিছু উজাড় করিয়া দিয়া সে তাহাদের পরিচর্যা করিয়া থাকে এদেরকে প্রান দিয়া ভালোবাসিয়া থাকে। সেই ভালোবাসা এতটাই তীব্র যে বিবাহিতা বধূ বা ঔরসজাত সন্তানের প্রতি তাহার কোন ভ্রূক্ষেপ নাই। সে দিবস রজনী ভ্রাতার বাটিতেই অবস্থান করিলেও কনিষ্ঠ ভ্রাতা ভুলিয়াও কখনও প্রশ্ন তোলে না যে হে জ্যেষ্ঠ ভ্রাতা আপনার এইসব কার্যকলাপের হেতু কি? বরং সূক্ষ্মকুট কৌশলে সে তাহার ঘরের মেনকাকে বিনয়ের সহিত ভ্রাতৃ সেবায় উতসর্গ করিয়া থাকে। ছলনাময়ী ললনা দেখিল সংসার রক্ষা করিতে হইলে ধনবান মহাত্মন এর মনোরঞ্জন ছাড়া গতি নাই। এমনি করিয়া দিবস মাস বৎসর চলিতে লাগিল।
পঞ্চদশ বর্ষ পার করিয়া পুত্র অভিমন্যু ষষ্ঠদশ বৎসরে পদার্পণ করিল। মাতা তাহাকে আর তেমন কাছে পায়না। কেবল একবেলা খাওয়ার সময় সে গৃহে উপস্থিত হয় এবং মাতার সহিত বসিয়া আহার্য গ্রহন আর জঙ্গলের নানা গল্প করিতে থাকে। মাতাকে সে অসম্ভব ভালোবাসে। সে এখন অবগত কে তাহার জন্মদাতা সেই জন্মদাতা কোথায় থাকেন, কি করেন। নিজস্ব জ্ঞান, সহজাত বুদ্ধি বিবেচনা দিয়া সে পুরা বিষয়টাই রিদয়াঙ্গম করিতে পারে। পিতা কি? পিতার আদর কি সে জানেনা। কিন্তু তাহার পিতা যে তাহারই মত অন্য কাউকে প্রাণাধিক ভালো বাসিয়া থাকে ইহা সে বুঝিতে পারে। সে সেই বাড়ি চেনে, মাঝে মধ্যেই গোপনস্থানে দাঁড়াইয়া লোভাতুর দৃষ্টিতে তাহাদেরকে অবলোকন করিয়া থাকে। তাহাদের আদর ভালোবাসার সুন্দর দৃশ্য দেখিয়া এক ধরনের ক্রোধ তাহার ভিতরে সঞ্চারিত হইতে থাকে।
সারাদিন সে জঙ্গলে বিচরণ করিয়া থাকে। এই বন তাহার বিচরণ ভূমি। এখানে সেই একচ্ছত্র অধিপতি। এর প্রতিটি ইঞ্চি স্থান তাহার নখদর্পনে। কোন বৃক্ষে খাবার উপযুক্ত ফল পাকিয়া আছে, কোথায় কদলী পাকিয়া হরিদ্রাভ হইয়াছে, কোন বৃক্ষে সবুজ ডাব আর ঝুনা নারিকেল আছে সবই তাহার মুখস্ত। কোথায় পক্ষীশাবক কিংবা কোন প্রাণী বিপদগ্রস্থ সেই রক্ষাকর্তা। তবে সে কখনই পাখি শিকার করেনা কারন বনের বিহঙ্গ তাহার বন্ধু তবে মায়ের কাছে শুনিয়াছে যে মোরগ খাওয়া যায়। তাই সে মাঝে মাঝে বনমোরগ শিকার করিয়া আনে, মাতা রান্না করিলে সে অতি তৃপ্তিসহকারে ভক্ষণ করিয়া থাকে। মোরগ ধরিবার জন্য বা কোন কিছুকে নির্দিষ্ট করিয়া বিদ্ধ করিবার জন্য, মারিবার জন্য তাহার নিজের উদ্ভাবিত গাছের শাখা শিকলে তৈরী নানাধরনের কিছু হাতিয়ার তাহার আছে।
বেলা দ্বিপ্রহর পুত্র গিয়াছে বনে। বাটিস্থ কর্ম সম্পাদন শেষে বিমর্ষ কন্যা সেই ছোট্ট স্রোতস্বিনী নদী তীরে একটি প্রস্তরখন্ডে উপবেশন করিয়া দূর বহুদূরে দৃষ্টি নিক্ষেপ করিয়া নিয়তির কথা ভাবিতে লাগিল। এ কেমন ভাগ্য! এ কেমনতর স্বামীপ্রবর! জীবন কি এইভাবেই কাটিয়া যাইবে! সমস্ত দিবস তাহার তেমন কিছুই করিবার থাকেনা। পুত্রের সামান্য কিছু কর্ম করা ছাড়া আর কোনকিছু করিবার মত উদ্যম তাহার আসেনা। এই দরদালানের একটি কক্ষে কিছু কীট দংশিত অতি প্রাচীন পুঁথি আছে, সেইগুলি সে মাঝে মাঝে পাঠ করিবার চেষ্টা করে। সেখান হইতে সে অভিকে কিছু বিদ্যা শিখাইবার চেষ্টা করিয়াছে। চেষ্টার নিমিত্তে সে পড়িতে পারে বটে কিন্তু তাহার মনোযোগ কেবল জঙ্গল, আর জঙ্গলের পশু প্রাণীদের প্রতি। পুঁথি তাহাকে আকর্ষণ করেনা। তবে সে ভালোমতই পড়িতে শিখিয়াছে।
অভিমন্যুর মাতার দিবস রজনী কাটিতে চাহে না। সেও বনে বনে ঘুরিয়া বেড়ায়। অবশ্য বেড়াইতে তাহার খুবই ভালো লাগে। বনের অপরূপ সৌন্দর্যে সে মুগ্ধ হইয়া যায়। কত রকমের ফুল, কিযে তাহাদের রঙ বিন্যাস! সেকি সবার নাম জানে! ভাট বা ঘেটু ফুল, আকন্দ ফুল, মান্দার, পলাশ, বেগুনী বর্ণের লুটকি, চোরকাঁটার ফুল, ঢোলকলমী, সর্বজায়া বা কলাবতী, কাটাবেগুন, দলকলস, তিতবেগুন, বাসকফুল, কেশরাজ, নাকফুলের মত মহাভৃঙ্গরাজ এমন আরো কত রকম ফুল। পুকুরের ঢাল বাহিয়া বিস্তীর্ণ জমিনে ফুটিয়া থাকে বেগুনী বর্ণের লজ্জাবতীর ফুল। সেখানে বসিয়াই সে অতিক্রান্ত করিয়া দেয় একটা বেলা বা একটা দিন। তাহার কোন তাড়া নাই। একটা চিকন বৃক্ষশাখা হাতে লইয়া সে একপ্রান্ত হইতে লজ্জাবতীর পাতা স্পর্শ করিতে থাকে আর পাতা বন্ধ হইতে থাকে এমনি করিয়া সে অনেকটা স্থান জুড়িয়া স্পর্শের খেলা খেলিয়া থাকে। অপরপ্রান্তে পৌঁছাইতে পৌঁছাইতে শুরুর পাতা আবার চোখ খুলিতে থাকে …সে আবার শুরু হইতে শুরু করে… বড় আনন্দ!
এইস্থান জুড়িয়া জঙ্গলের ঘনত্ব অনেক কম। ধীরে ধীরে ভিতরের দিকে বন আরো নিবিড় হইয়াছে। সেইখানে নাম জানা না জানা হাজার রকমের বৃক্ষ যাহারা কেউ কেউ আকাশের নীলিমা স্পর্শ করিতে চাহিতেছে। এই বনে কতযে ফলজ বৃক্ষ রহিয়াছে, আম্র, কাঁঠাল, জাম, লটকন, কুল, আতাফল, ডেউয়া, জলপাই, চালতা, ডুমুর, পানিয়াল, বিলম্বি, কামরাঙ্গা প্রভৃতি। বনের পশু পাখি এগুলো ভক্ষণ শেষে অষ্টি ফেলিয়া থাকে এবং সেইখান হইতে আবারও বৃক্ষ জন্মাইয়া থাকে। আছে হাজার রকমের বনজ বৃক্ষ সে কয়টির নাম জানে! বেশকিছুটা দূরে একটি জায়গা আছে সে তাহার নাম দিয়াছে কদম কুঞ্জ। আশ্চর্য সেখানে বিশাল এক এলাকাজুড়ে অসংখ্য কদম গাছ। কি বিশাল তাহাদের আকার আকৃতি। যখন সেগুলো ফুলে ফুলে ভরিয়া থাকে সেখানে গিয়াই সময় কাটিয়া যায় তাহার। কেমন একটা মৃদু সুঘ্রাণে সমীরণ ভারি হইয়া থাকে। কেউকি জানে পাকা কদম খাইতে খুব সুস্বাদু! এমন আরো একটি জায়গা আছে যেখানে অনেক গুলি শিমুল বৃক্ষ বন আলোকিত করিয়া দাঁড়াইয়া আছে। শিরদাঁড়া সোজা করিয়া আকাশে মাথা ঠেকাইতে চাহিতেছে। ফুল ফোটার মৌসুমে ঐ এলাকায় যেনবা আগুন ধরিয়া যায়। বনের সাথে মনের সখ্য হইলে বন হইয়া ওঠে যেন স্বর্গধাম। কন্যার কাছে এই বন এখন স্বর্গধাম, তবু কি জানি কিসের লাগি তাহার প্রাণ করে হায় হায়।
নার্সিসাসের উপাখ্যান এই কন্যা জানেনা। “তরুণ নার্সিসাস প্রতিদিন একটি সরোবরের পাশে উবু হয়ে বসে নিজের সৌন্দর্য গভীরভাবে অবলোকন করত। সে নিজের রূপে এতই মুগ্ধ হয়ে গেল যে, সেই নিজেরই প্রতিবিম্বের দিকে অর্থাৎ সরবরে ঝাপ দিল এবং সেখানেই তার সলিলসমাধি হল। ঠিক যেখানে সে ঝাপ দিয়েছিল, সেখানে একটা ফুল ফুটল নাম নার্সিসাস” ।
নার্সিসাসের মত এই নিঃসঙ্গ রূপবতী রমণীও প্রায়ই সরোবরের জলে ধির বসিয়া নিজেকেই অবলোকন করিত। নিজ সৌন্দর্যে সে বিমোহিত হইলেও উপলব্ধি করিত সৌন্দর্য কি কেবল একা একা মোহিত হইবার জন্য! ফুল কি নিজের জন্য ফোটে! এহাসি কারো হাসির সহিত মিশিবার জন্য…
সে নিয়ম করিয়া প্রতিদিন সরোবরের জলে সাঁতার কাটিয়া থাকে। সরোবরের চারিপাশে মান্দার কাঁটার ঘন ঝোপ প্রাচীরের মত বেষ্টন করিয়া রহিয়াছে। তাহা ছাড়া এই নির্জন মনুষ্যবিহীন এলাকায় তাহার লজ্জা পাইবার কোন হেতু নাই। সাঁতার, জলকেলি তাহার ভালোলাগার একটি কাজ এবং তাহার নিত্যদিনের স্নানও বটে। পুর্বে পূত্রও তাহার সহিত জলে অবগাহন করিত কিন্তু আজকাল তাহার দেখা পাওয়া যায়না। সে বিশাল পুস্কুরিনীর এপার ওপার মৎস্যের ন্যায় সাঁতরায়। শ্রান্তিতে দেহ নাজুক না হওয়া পর্যন্ত সে আপনমনে জলকেলি করিয়া যায়। বৎসরের পর বৎসর ধরিয়া বনের ফলমূল ভক্ষন, হাঁটাহাঁটি ও সাঁতার কাটিবার ফলে তাহার শরীর নিরোগ এবং অতি চমৎকার নিটোল তাহার দেহসৌষ্ঠব। তাহার দেহের গড়ন আর রূপের তুলনা নাই।
তাহাদের বাসস্থানের এলাকা হইতে ক্রোশ দূরে সে একটা ছোট্ট ঝর্নার অস্তিত্ব আবিষ্কার করিয়াছিল। করিয়া সে যারপর নাই আমোদিত হইয়াছিল। প্রায় সময় সে সেইখানে বসিয়া বুনোফুলের মিষ্টি মাতাল গন্ধ, আকাশ, জঙ্গল ও নির্জনতা উপভোগ করিয়া থাকে। সেযে কি এক অপার্থিব অনুভূতি তাহা কাউকে বুঝাইয়া বলিবার নহে। এমনিভাবেই কাল কাটিয়া যায় কিন্তু মন যেন বড় উচাটন বড় …
সন্ধ্যা আগত অভিমন্যুর মাতা নদীতীরে এক প্রস্তরখণ্ডের উপর উপবেশন করিয়া আছে যেন বিশাল ক্যানভাসে আঁকা এক চিত্র। তিরতির করিয়া বহিয়া চলিয়াছে ময়ূরাক্ষী নদী। কন্যার পদতলে ছোট ছোট ঢেঊ পায়ের পাতায় জলছাপ আলপনা আঁকিয়া দিতেছে। মৃদু সমীরণে কন্যার কুন্তল উড়িতেছে। পিছনে সারি সারি তরু বৃক্ষ যেন সবুজের এক বিস্তীর্ণ প্রাচীর। তারই মাঝে ছিপছিপে দেহবল্লরির এই রূপবতী কন্যা বিষণ্ন চিত্তে বসিয়া আছে। তাহার পরনে একটি বস্ত্রখন্ড যাহার জমিন কচিকলাপাতা রঙের, গাঢ় রক্তিম পাড় জঙ্ঘা হইতে বেষ্টন করিয়া বক্ষের মাঝ দিয়া পশ্চাতে গিয়াছে। বক্ষে গাঢ় রঙের কাঁচুলি কৃষ্ণ কুন্তল মস্তকের উপরে চুড়ো করিয়া বাঁধা। সেখানে বন্যপুষ্প শোভিত। কেবল খোপাতেই নয় সে আপাদমস্তক পুষ্পগহনায় সজ্জিত। মাথায় টায়রা, গলার হার, হাতের বাজুবন্ধ, কঙ্গন, কোমরে বিছা, পায়ে মল সবই পুস্প পল্লবে নিজহস্তে নির্মিত। কোনরকম কজ্জল, চন্দন, অগুরু, লোধ্ররেণু বা প্রসাধণ সামগ্রী বর্জিত, বা কোনো জড়োয়ার গহনাগাঁটি নাই কিন্তু কী অপরূপ সতেজ সৌন্দর্য্য!
আপণ ভাবনায় কন্যা চৈতন্যহারা। আচমকা চিন্তাসূত্র ছিন্ন হইল- জলকেলির শব্দে। চকিতে হরিণদৃষ্টি। দেখা গেল একটি ছোট্ট ডিঙ্গি নৌকা এইদিকেই আসিতেছে। আরো কিছু নিকটবর্তী হইলে চোখে ভাসিল এক সৌম্যদর্শন বলিষ্ঠ যুবাপুরুষ বৈঠা হাতে জল ঠেলিতেছে। প্রতি বৈঠায় তার হাতের পেশী যেন সর্পের ন্যায় খেলিতেছে দুলিতেছে। কন্যার চিত্তে চাঞ্চল্য দেখা দিল। সে সকল মনোযোগ চক্ষুমাঝে আনত দৃষ্টির প্রখরতা বাড়াইয়া চাহিয়া রহিল। একি! এতো এক অভাবিত ঘটনা। কতকাল অতিবাহিত হইয়াছে সে কোন মনুষ্যমুখ দর্শন করে নাই। প্রথমত সে কিছুটা ভীত, বিচলিত হইয়া পড়িল কিয়তক্ষণ নিরীক্ষণ করিয়া তাহার প্রতীয়মান হইল যে এই যুবা পুরুষ শঠ বা প্রবঞ্চক হইতে পারেনা। অনতিবিলম্বে সে রমণীর নিকটবর্তী হইল এবং তাহাদের মধ্যে এক স্বর্গীয় সখ্য গড়িয়া উঠিল।
এরপরে বনরমণীর এতদিনের কালাতিপাতের সূচিতে এক অজানা ঘুর্ণন উঠিল। তাহার দিবারাত্রি লন্ডভন্ড হইয়া গেল। অনতিক্রম্য জলোচ্ছ্বাসের মতো প্রণয়ক্রীড়ায় সে ভাসিয়া যাইতে লাগিল। মাঝে মধ্যেই অভিমন্যুর মাতার মনে হয় যাহা ঘটিতেছে তাহা সমীচীন নহে। কিন্তু তাহা ঐ ভাবনা পর্যন্তই। নিশ্চিত নিয়তির মতো কাল বহিয়া চলিতে লাগিল… নিয়তির কোলে আগেও সে সমর্পিত ছিল আবারও সে নিয়তির মাঝেই নিজেকে সমর্পন করিল। এতদকালের এক নিসঙ্গ জংলিলতা যেন এক বটবৃক্ষের ছায়ায় আশ্রয় পাইল। সে প্রতিদিন চিন্তা করে এই নব মানুষটির কথা পুত্র অভিকে জানাইতে হইবে… আজই ফিরিয়া সে জানাইবে… কিন্তু আজকাল অভির সাক্ষাৎ পাওয়াই যেন দুর্লভ হইয়া উঠিয়াছে।
অভিমন্যু এখন একজন সুঠাম দেহের পরিপূর্ণ যুবা পূরুষ। জঙ্গল তাহার চারণভূমি। মনে হয় এখানকার পশুকুল তাহার ভাষা বুঝিতে পারে এবং সেও তাহাদের। এক এক দিন সে এই জঙ্গলের আরো আরো গভীরে প্রবেশ করিয়া ঘুরিয়া ঘুরিয়া দেখে। সেই ছোটবেলার সঙ্গী বানর দিবারাত্রি তাহার সঙ্গেই থাকে আর সেই টিয়া পাখিটিও। এরা তিনজনই পরস্পরের পরম বন্ধু। তিনজনই পরস্পরকে ভালোভাবেই বুঝিতে পারে। অভিমন্যুর হাতে আজকাল তির ধনুক থাকে। এবং তির ছুঁড়িতে সে ভীষণ পারদর্শী হইয়া উঠিয়াছে।
কিছুদিন যাবত তাহার মন বিষণ্ন। কখনও কখনও দুশ্চিন্তার সহিত যোগ হয় এক অবদমিত ক্রোধ। তখন সে যারপরনাই বিক্ষিপ্ত ও অস্থির হইয়া কোন এক বৃক্ষের দিকে তাক করিয়া একের পর এক তির ছুঁড়িতে থাকে। তীব্র গতিতে এক লহমায় তিরটি বৃক্ষের কান্ড ভেদ করিয়া অনেকখানি ভেতরে প্রোথিত হইয়া থিরথির করিয়া কাঁপিতে থাকে। একটির কাঁপন না থামিতেই আরেকটি ঠিক উহার পার্শ্বেই প্রোথিত হয়। সেটির পার্শে আরেকটি… আরেকটি… এইভাবে চলিতে থাকে তির বর্ষন…
একসময় তাহার অস্থিরতা কমিয়া ধিশান্ত হইলে সে মাতার কাছে ফিরিয়া আসে।
সাময়িকভাবে তাহার মন স্থির হইলেও তাহার ভিতরে চলে এক কালো ঘুর্ণন, এক দুঃসহ অনির্বান যন্ত্রণা। যন্ত্রণার হাত হইতে রেহাই পাইবার বাসনায় সে দিবারাত্রি বনে বনে গাছে গাছে ঘুরিয়া বেড়ায়। নিজের অজান্তেই সে কখন যেন চলিয়া যায় সেই পিতৃব্যের বাটি সংলগ্ন বৃক্ষের মগডালে। চাহিয়া রহে তাহাদের সুখের পানে আর তাহার ভিতরে এক জ্বলন্ত অগ্নি যেন দাউ দাউ করিয়া জ্বলিতে থাকে। অতঃপর একসময় সে এক সিদ্ধান্তে উপনীত হয়, ইহাই তাহাদের মাতাপুত্রের জন্য শান্তির হইবে।
অবিরল ধারায় আকাশ ঝরিতেছে। বিরামহীন এই জলের তোড়ে যেনবা জগত জঙ্গল ভাসিয়া যাইবে।
অভিমন্যু আজ শান্ত, লক্ষ্যে স্থির, সিদ্ধান্তে অনড়। বহুদিনের পরিকল্পনা আজ সে সম্পাদন করিবে। সে তির ধনুক লইয়া নির্দিষ্ট বাটী সংলগ্ন বৃক্ষ চুড়ায় উঠিয়া তাহার প্রথম কর্ম সম্পাদন শেষে নদীর তীরে যায়। তাহার কাছে আছে তীব্র বিষ মাখানো দুইটি তীর। একটির কাজ শেষ, বাকিটা…
সেই স্রোতস্বিনী নদীবক্ষে ডিঙ্গিতে দাঁড়াইয়া আছে সুঠাম প্রেমিক পুরুষ। তাহার চওড়া বুক যেন চিতিয়ে আছে কোনকিছুর তরে, কাউকে পরম মমতায় ধারন করিতে। এতই চওড়া যে তীর চালনায় অতিদক্ষ অভিমন্যুর জন্য ইহা কোন ব্যাপারই নহে। বৃক্ষের আড়ালে দাঁড়াইয়া অভি লক্ষ্য স্থির করে, তাহার নিপুণ দৃষ্টি বক্ষমাঝে তাক করা। অতঃপর, তাহার জ্যা হইতে মুক্ত হয় তীর, বিচ্ছিন্ন হয় অঙ্গুলি, বাতাসের বুক বিদীর্ন করিয়া বায়ুর অগ্রে ছুটিয়া যায় লক্ষ্যভেদে… আর ঠিক সেই মুহুর্তে, ঠিক সেই পলকে ডিঙ্গিতে বসিয়া থাকা একজন সেই চেতানো বুকে ঝাপাইয়া পড়ে…
মুহুর্তে প্রলয়কাণ্ড ঘটিয়া যায়… আকাশ, বাতাস, ত্রিভুবন, বৃহৎ জঙ্গলের সমস্ত পাখ পাখালি, বৃক্ষরাজি যেন চিৎকার করিয়া ওঠে- না- আ- না- আ- না- আ- না- না – না – না আ- আ- আ-আ
যেন, হাজার হাজার শঙ্খবাদ্য ও ঘণ্টাধ্বনি বাজিয়া উঠিল চতুর্দিকে, বিভিন্ন নিনাদে যেন কম্পিত হইতে লাগিল জল স্থল অন্তরীক্ষ, কোন এক অজানা উৎস হইতে পুঞ্জ পুঞ্জ ধোয়া উদ্গরিত হইয়া চারিপাশ হইয়া উঠিল ধূপময়।
ইকো নিজে কথা কহিতে পারিতোনা, কেবল কাহারো কথার প্রতিধ্বনি করিত। সেই ইকোর কাছ হইতে প্রতিধ্বনিত হইতে লাগিল – আ- আ- আ- আ- আ- আ-
তারপর ইলেকট্রিক বিল জমা দিতে যাবো। আমার দেরি হবে আসতে। স্বামী অমর বলে, ঠিক আছে।…..
নভেম্বর চলছে। অনির সাথে আজ দেখা হবে তা জানাই ছিল। এই তো ক’দিন আগেই দেখা…..
বুড়িমাসি বলেন,জীবনটা বালির ঘর গো।ঢেউ এলে ধুয়ে যায় জীবনের মায়া।তবু বড় ভালবাসা ওদের দাম্পত্যে।রোদের চাদরের…..
এক ড্রইং রুমে বসে রয়েছে সদ্য কিশোর উত্তীর্ণ তরুণ গোয়েন্দা সজীব। সামনের টেবিলে ছড়িয়ে…..