যিশুর চোখের জল

সৌরভ দাস
গল্প
Bengali
যিশুর চোখের জল

দেয়ালের ছবিটায় যিশুর চোখ বেয়ে নেমে আসা জলের ফোঁটাটা আজ যেন বেশি বড় লাগছে। ওদিকে বেশিক্ষণ তাকিয়ে থাকলে নিজেকে ওনার খুনি বলে মনে হয়। কিন্তু ওপাশ ঘুরে শোয়ার শক্তিও পাচ্ছি না। আলস্য, শরীরকে অবশ করে ফেলেছে। চিৎ হয়ে পড়ে থাকা নিজের হাত দুটোকে একটা মৃত মানুষের হাত বলে মনে হচ্ছে। সেই তখন থেকে বাঁ-পা এর বুড়ো আঙুল দিয়ে, ডান-পায়ের আঙ্গুল গুলো গুনেই চলেছি… এক -দুই-তিন-চার-পাঁচ! এক-দুই-তিন-চার-পাঁচ! এক-দুই- …!

খুব ক্ষিদে পেয়েছে। তবে অন্য কোনো খাবার নয়, কেবলমাত্র যাদবপুর ২ নং প্লাটফর্ম এর নিচের পাল বাজারের লোকনাথ হোটেল এর মিক্স ভেজ আর গরম গরম রুমালি রুটি, সঙ্গে কাঁচা লঙ্কা, পেঁয়াজ। শুধু ঐ খাবার পেলেই এ ক্ষিদে মিটবে বলে মনে হচ্ছে।

ঐটিই আমার দেখা সবথেকে সুন্দর হোটেল। কে মালিক আর কে কর্মচারি তা বোঝবার উপায় নেই। রেডিও বাজে সারাক্ষণ। কর্মচারীরা নাচতে-নাচতে, গাইতে-গাইতে খাবার পরিবেশন করে। ওদের নিজেদের মধ্যে রসিকতায় বিরাম তো নেই ই, খেতে আসা লোক গুলোর সাথেও ওদের রসিকতা চলে সারাক্ষণ। এ যেন এক নাটকের রঙ্গমঞ্চ।

ওদের এই অনাবিল আনন্দের পেছনে কিছু একটা রহস্য আছে নিশ্চই। কিন্তু কি?

আমার বারবার ই মনে হোতো রোজ গভীর রাতে কোনো হিমু আসে ওখানে। সামনের কোল্ডড্রিংক্স এর দোকান থেকে কর্মচারিদের জন্য কাঁচের বোতলে কোল্ডড্রিংক্স আনে হিমু। তারপর হিমুকে সঙ্গে নিয়ে বেঁচে যাওয়া খাবার ওরা এক টেবিলে বোসে ভাগ করে খায়। খাওয়া শেষে টেবিল চেয়ার সরিয়ে মেঝেতে বিছানা পাতে। হিমু ওদের ঘুম পাড়ানি গল্প শোনায়। ওরা ঘুম থেকে উঠে হিমুকে আর খুঁজে পায় না। ওরা আবার একটা রাতের অপেক্ষায় থাকে ….

কেন জানি মনে হচ্ছে, এই এক্ষুণি পল্লব দুহাতে দুটো পলিথিন এর প্যাকেট নিয়ে ঘরে ঢুকবে। একটিতে থাকবে লোকনাথ হোটেল এর রুমালি রুটি, মিক্স ভেজ। অন্যটিতে চিট বাদাম, পাটালি, আমসত্ত্ব আর জয়নগর এর মোয়া।

– এই ফটিক দাস, ওঠো

এই আশিক, থালা ধুয়ে নিয়ে আয়।

লোকনাথ বলে, আগে একটা চিট বাদাম দাও। খাওয়া দাওয়ার শক্তি সঞ্চয় করি।

প্রজেশ উত্তর দেয়, ভাই আমায় একটুখানি আমসত্ত্ব দে আগে।

আশিক চোখে গামছা বাঁধতে বাঁধতে বলে, ভাই এত খাবার? এমনি এমনি খাওয়া যাবে না। আয় আগে বসি আমরা।

এখানে একজনের সিদ্ধান্তই সকলের সিদ্ধান্ত। অতএব…

– এই বুয়া পাল?

– আমি নেই।

– আমাদের ছেড়ে যাস না বুয়া পাল। ভয় লাগে।

দরজায় ঠক ঠক শব্দ হচ্ছে!

পল্লব এলো নাকি?

কোথায় আছি আমি এখন? ওর মেসের দেওয়াল এর রং তো আকা‌‌শের মতো। এই দেওয়ালের রং সবুজ। তবে তো এ পল্লবের মেস না। তবে কে দরজা ঠক ঠক করে?

খুব রাগ হচ্ছে। এই মৃত দশা ভঙ্গ করার কোনো মানেই হয় না। আমি দরজা খুলব না। ঘুমিয়ে থাকার ভান করি। যে এসেছে, সাড়া না পেয়ে চলে যাক।

আবার ঠক: ঠক:!

আবার! আবার!

আশ্চর্যের ব্যাপার হোলো শুধু ঠক: ঠক: ই করছে। কথা বলছে না। এবং চারবারই একইরকম, দুটো সমান মাপের ঠোকা।

চতুর্থ বার ঠক: ঠক: এর পর জিজ্ঞেস করেই ফেললাম, কে?

কোনো উত্তর এলো না।

আবার ঠক: ঠক:

এতক্ষণে আমার শরীরের মৃত দশা, রাগ এর উষ্ণতা কাটতে শুরু করেছে। সুতরাং আমার এই আরাম ভঙ্গকারী কে দেখাই যাক।

দরজা খুলতেই মাথার সব রাগ মুহূর্তেই নেমে গেলো। অভিমানি চোখে মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে আছে মেয়েটি।

কি রে অনন্যা? তুই? আয় আয় ভেতরে আয়।

কোনো কথা না বলেই , ঘরে ঢুকে খাটে পা ঝুলিয়ে বসলো অনন্যা। নিজেই নিজের পা দোলানো দেখছে সে। মনে হচ্ছে খুব আনন্দ পাচ্ছে এটা দেখে। কিন্তু হাসছে না। ওর নুপুরের ঝংকারে চমৎকার একটা সঙ্গীত এর সৃষ্টি হোয়ে চলেছে। মনে হোলো ঘরের আলো অনেকখানি বেড়ে গেছে।

বড়ো দিনের ছুটির আগে শেষ যেদিন অনন্যাদের দোকানে চা খেতে গেয়েছিলাম, সেদিন ও আমায় বলেছিল কয়েকদিন পরেই এখানে বাউল মেলা। সেখানে নাকি কলকাতা থেকে দোকান আসে প্রতিবছর। অনেক কিছু পাওয়া যায়। ও একটা  লাল আর সাদা সোয়েটার কিনবে। তাতে গোলাপ ফুল আঁকা থাকবে।

সেই সোয়েটারটাই পড়ে এসেছে অনন্যা। এতই সুন্দর লাগছে যে শুধু তাকিয়েই থাকতে ইচ্ছে করে। আমার দিকে কিন্তু একবারও তাকাচ্ছে না অনন্যা। আমার উপর অভিমান করেছে বোধ হয়।

আমার উপর রাগ করেছিস ?

– কই না তো।

না তুই রাগ করেছিস। কেনো রাগ হয়েছে?

– তুমি এতো দিন কোথায় গেছিলে? আমায় বোলে গেলে না কেনো?

ওরে বাবা সরি। বাড়ি গেছিলাম। এর পরেরবার তোকে বলে যাবো। ঠিক আছে?

– আমি তোমার বাড়ি এসে দেখতাম তালা মারা। সকালে যোগ্গু দাদা বললো তুমি এসেছো।

আমার মতো মানুষের জন্য এইটুকু একটা বাচ্চার এত মায়া দেখে খুব কষ্ট হচ্ছ। আমারও কি ওর প্রতি সমপরিমাণ মায়া আছে? নিজের কাছে জিজ্ঞেস করে উত্তর কিছুই পেলাম না।

বুঝতে পারলাম চোখ জ্বলছে। এটি চোখে জল আসার আগের অবস্থা।

আসল এ মেয়ে জাতিটাই হলো মায়ার। মায়ার বাঁধনে একবার আটকে পড়লেই হোলো…, বেরোনো সম্ভব নয়। মায়া বাড়তেই থাকবে, বাড়তেই থাকবে….!

আমায় একটা বট গাছ আঁকা শিখিয়ে দিবি?

– তুমি আবার ভুলে গেছো?

হ্যাঁ রে মা, ভুলে গেছি। দিবি শিখিয়ে?

এই নে তোর জন্য নতুন মার্কার পেন নিয়ে এসেছি। একটা  লাল বট গাছ আঁক তো।

– আঁকার পরে কিন্তু ওই জিন এর গল্পটা বলবা। শেষ হয় নি সেদিন।

আচ্ছা বলব।

অনন্যা এখন সাদা বোর্ড এর উপর লাল বট গাছ আঁকছে। এই বট গাছটায় নাকি ভূত থাকে। তাই কোনো পাখি বসে না গাছে। শুধু রাতেরবেলা বাদুড় পাখি উড়ে বেড়ায় গাছের উপর দিয়ে।

হাত নেড়ে নেড়ে আমায় বোঝানোর চেষ্টা করছে ওর নিজের জগৎ এর কথা। আমি মাঝে মাঝে মাথা নাড়ছি। অনন্যার  কথাগুলোকে ছবির মত লাগছে।

দেয়ালের ছবিটার দিকে তাকিয়ে মনে হোলো যিশুর চোখের জলের ফোঁটাটা ছোটো হয়ে যাচ্ছে আবার।

এই বিভাগের অন্যান্য লেখাসমূহ

বালির বেহালা

বালির বেহালা

বুড়িমাসি বলেন,জীবনটা বালির ঘর গো।ঢেউ এলে ধুয়ে যায় জীবনের মায়া।তবু বড় ভালবাসা ওদের দাম্পত্যে।রোদের চাদরের…..

তদন্ত

তদন্ত

  এক ড্রইং রুমে বসে রয়েছে সদ্য কিশোর উত্তীর্ণ তরুণ গোয়েন্দা সজীব। সামনের টেবিলে ছড়িয়ে…..