গৌর (মালদা) – বাংলার চিত্তাকর্ষক ইতিহাস
বাংলার চিত্তাকর্ষক ইতিহাস সম্পর্কে জানার সময়, গৌরের মতো আর কিছু গন্তব্য হতে পারে না।…..
স্মৃতি খুব বিশ্বস্ত সঙ্গী। দূরে সরে গেলেও চলে যায় না পুরোপুরি। কোনো মানুষই তাই কখনো একা নয়। একলা সময়গুলোতে অবিরত কথা চলে মনের নানা কুঠুরিতে জমানো লক্ষ কোটি স্মৃতির সাথে। প্রয়োজন হলেই খুঁড়ে বের করা যায়। তার জন্য দরকার পড়ে কখনো ছেনি, হাতুড়ি, গাইতি, কুড়াল। জমা রাখবার জন্য টুকরি। হঠাৎই মনে হয়েছিল দেখিই না টুকরি ভরে আনা যায় কিনা। উপচে পড়া ঝুড়ির ভারে কুঁজো আমি তবু টানটান হতে চাই।
কেউ বয়স জানতে চাইলে বা জানানোর প্রয়োজনে বলি বাংলাদেশ আর আমি সমান। সমবয়সীকে রেখে দূরে যেতে কখনো ইচ্ছে হয়নি। ট্রাভেল টক নামে একটা মাসিক পত্রিকায় লিখি। মার্চ সংখ্যার বিষয় মুক্তিযুদ্ধ। কী লিখব ভাবতে ভাবতে বাংলাদেশ আর আমার জন্মের উত্তাল সময়টাকে তুলে ধরার ইচ্ছে হলো। কাছের কয়েকজন মানুষের যুদ্ধ সময়ের কথা জানতে চাইলাম। প্রত্যেকের অভিজ্ঞতা ভিন্ন, আবার সবার মূল এক। পালিয়ে বাঁচা। দূরে। অথবা মুখোমুখি হওয়া। ঠেকিয়ে দেওয়া। মুক্তিযুদ্ধ এভাবেই জনযুদ্ধ হয়ে উঠেছিল। জনযুদ্ধ হয়েছিল বলেই নিরন্ন মানুষ মুখের আহার তুলে দিতে পারত মুক্তিযোদ্ধাদের কিংবা বাড়িতে আশ্রয় নিতে আসা মানুষদের। গাছের মগডালে উঠে বাঁশের কঞ্চি আলগি দিয়ে এরোপ্লেন নামিয়ে ফেলার স্বপ্ন দেখত। মুক্তিযুদ্ধের অতি গুরুত্বপূর্ণ জন মুক্তিযোদ্ধারা। তারা আশ্রয় নিয়েছেন এক বাড়িতে। খাওয়া দাওয়ার পর অ্যাকশনে যান। ফিরে এসে দেখেন বাড়ির কিশোরীকে তুলে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। ভাত বেড়ে দেওয়ার সময় যার হাতের সামান্য ছোঁয়ায় শিহরণ জেগেছিল তরুণ মুক্তিযোদ্ধার প্রাণে, পরাধীনতার আগল ছিঁড়ে ফেলার ইচ্ছেটুকু আরো জেকে বসেছিল। অল্প চেষ্টাতেই খুঁজে পাওয়া গেল তথ্য সরবরাহকারীর। ধরে আনার পর কমান্ডার নির্দেশ দিলেন চাকু দিয়ে হত্যা করতে। পারলেন না। কমান্ডার নিজেই কাজটা সম্পন্ন করার সময় ফিনকি দিয়ে আসা গরম রক্তের ছিটা পড়েছিল গালে। আজও গালের সেখানটায় গরম অনুভূত হয়। প্রবল পোড়ে। নরম হাতের পুলক জাগানো ছোঁয়া বিরহী করে তোলে। অন্য বাড়িতে সন্তান জন্মদানকারী মা আজও সেই কষ্ট আর যন্ত্রণা ভোলেননি। মনে হলো টুকরিতে এসব জমা করা খুব জরুরী।
শুরু হলো অনুসন্ধান। ঘটনার, অভিজ্ঞতার। স্মৃতিতে ধুলো জমে। ধুলো সরানোর কাজ করতে গিয়ে নানা রকম অভিজ্ঞতার মুখোমুখি। কেন বলব, কী লাভ, কখনো বলিনি তো, বলতে ইচ্ছে হয় না এমন নানা কথা। কাউকে কাউকে রীতিমতো লেগে থেকে রাজি করাতে হয়েছে। অভিমান। তিনিই আবার বলা শুরু করে থামতে চাইতেন না। কেউ কেউ চোখে জল নিয়ে অবিরাম বলে গেছেন দুঃখস্মৃতি। দিয়েছেন যন্ত্রণার দীর্ঘ প্রহরের বর্ণনা। জ¦লজ¦লে চোখে শুনিয়েছেন শত কষ্ট শোয়ে জয়ের ইতিহাস। কারো কারো সামান্য ব্রাশেই কাজ হয়েছে, কারো কারো প্রয়োজন হয়েছে শাবল গাঁইতির। আমি মন্ত্রমুগ্ধ শ্রোতা। একটা সময় নেশার মতো হয়ে গেল। নানা প্রশ্ন খোঁজার তাড়া জাগল। একদিন বন্ধুর বাসায় তিনজনের সাক্ষাৎকার নিয়ে দিলখুশ আমি ফিরছি। হঠাৎ রিকশাওয়ালার ‘শালা পাকিস্তানি’ গালিতে অবাক। কাকতাল! নামার আগে গালির মাজেজা জানতে চাই। ‘এরা কত খারাপ ছিল জানেন না তো।’ মেঘ না চাইতেই জল! বলি, ‘কন, শুনি।’ খুশি মনেই ১৫ মিনিট ধরে শোনালেন মুক্তিযুদ্ধের সময় দাদার কষ্টের গল্প। ‘পাকিস্তানিরা পানিতে পা দেবে না। ৫/৭ জন দামড়াকে পিঠে বহন করা কেমন কষ্ট কন।’ ভাড়া ১০ টাকা বেশি চাওয়ায় রাজি হচ্ছিলাম না। গল্প শেষে ১৫ মিনিট পোষানোর ইচ্ছায় টাকা দিতে চাইলে রাজি হন না। ‘আপনে ভালো কাম করতেসেন।’এভাবেই আমার যুদ্ধ স্মৃতির বাকসগুলো নানা রঙে ভরতে থাকে।
ফেইসবুকের ওয়ালে রুহি আপার লেখায় নারী কমান্ডার ফরিদা আক্তার এর কথা জেনেছিলাম। এত বড় শৌর্যের কথা জানি না! সেই আমার শুরু। রুহি আপার ইনবক্সে লিখলাম আপার সাথে যোগাযোগের ব্যবস্থা করে দিতে। হলো। নারায়ণগঞ্জবাসী ফরিদা আপা ঢাকায় ধানমন্ডিতে কদিন থাকবেন। ঠিক হলো ২০ এপ্রিল, ২০২০ সকাল ১১টায় সামনাসামনি বসে কথা হবে। আধা ঘণ্টা পৌঁছে গিয়েছিলাম। দুপুরের আজানের শব্দে ঘোর কাটল। প্রায় তিন ঘণ্টা সেদিন কীভাবে যে কেটেছিল! আমি মুগ্ধ শ্রোতা আর আপা প্রকাশের আনন্দে বিভোর। রাজনীতি করা মানুষ। খুব গুছিয়ে শুরু থেকে ইতি টানলেন। তবু যেন শেষ হয়নি। তখন করোনা তুঙ্গে। বাইরে থেকে যাওয়া আমি কোনো অঘটনের কারণ হই কিনা শঙ্কা ছিল। উনি সাহসী, কিচ্ছু হবে না। পাশে বসিয়ে নিজেই ছবি তোলালেন ভাগ্নি দীপা খন্দকারকে দিয়ে। পরের কটা দিন সাক্ষাৎকারটা ট্রান্সক্রিপ্ট করতে গিয়ে বার বার শুনেও একঘেয়ে লাগেনি। যেন সিনেমার কোনো প্লট। একটা সম্পূর্ণ জীবন আখ্যান।
গত বছরই ফেব্রুয়ারি শুরুতে জাহাঙ্গীর কবির ভাই এর সাথে তাঁর বইয়ের সূত্র ধরে পরিচয় হয়েছিল। তাঁর একাত্তরের স্মৃতি জানতে চাইলে মন খুলে বললেন। অপার বিস্ময়। মুক্তিযুদ্ধের ভিন্ন পাঠ শুরু হলো আমার। যুদ্ধের রাজনীতির দিকটা বোঝা জরুরী মনে হলো। একই পরিবারের এতগুলো ভাইবোন রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত থেকে দেশ বদলের স্বপ্ন দেখেন, অন্যদের সংগঠিত করতে কাজ করেন, ৭ মার্চের পর রাজনৈতিক বিভক্তি ভুলে প্রশিক্ষণে অংশগ্রহণ করেও সেই লাইনে অগ্রসর হওয়া হলো না। একদিন ধরে নিয়ে গেল। তুমুল অত্যাচারের শিকার হলেন। মাসুদ রানাপ্রেমী মানুষটি কৌশলে পালালেন। বাঁচার আশায় হলেন শহরছাড়া। অক্টোবরের ৫ তারিখ বড় বোন লুৎফুন্নাহার হেলেনকে নৃশংসভাবে হত্যা করা হলো। এক দরজায় কড়া নাড়ার পর আমার জন্য খুলে গেল আরো দরজা। এত আগ্রহ জন্মালো যে মাগুরা গেলাম দুদিনের জন্য। যে কলেজে পড়তেন, সেখানেও চিহ্ন নেই কোনো। যুদ্ধে শুধু নয়, সাংগঠনিক পর্যায়ে এমন নারীর বীরত্মগাথা যতটা প্রচার হওয়ার কথা ছিল, তার কিছচ্ছু প্রায় নেই। ব্যর্থতার কিছুটা দায় কাঁধে বয়ে ফিরে এলাম আমার শহরে।
কলিগ সঞ্চিতার বাবা মুক্তিযোদ্ধা জি, এম, এম, শাহাবউদ্দিন খালুকে ধরলাম যুদ্ধস্মৃতি জানতে চাই। সমস্যা সেই করোনা। ফোনে বলতে চাইলেন না, লিখে দেবেন। আমি তাতেই রাজি। আমার মতো করে গুছিয়ে প্রশ্ন সমেত আবার পাঠালাম তাঁর কাছে। জিজ্ঞাসার উত্তর মিলল। তাঁর ছেলেমেয়েরা প্রবল খুশি। ৫০ বছরে বাবাকে দিয়ে লেখাতে পারেননি। অসাধ্য সাধন হলো। গোয়েন্দা দলের কার্যক্রম জানার সুযোগ পেলাম। আমার ভাণ্ডার অল্প অল্প করে ভরে উঠতে থাকল। মনে নানা প্রশ্ন। এর তার কাছে, এখানে সেখানে খোঁজার চেষ্টা।
শিল্পী শাহাবুদ্দিন আহমেদ এর তুলির টান খুব পছন্দের। তাঁর ছোট ভাই কফিলউদ্দিন ভাই এর স্ত্রী হোসনে আরা আপার কাছেই একদিন গল্প শুনেছিলাম তাঁরা ৪ ভাই মুক্তিযোদ্ধা। ক্লাসে ছাত্রছাত্রীদের বলেছি এই পরিবারের কথা। খুব ইচ্ছে ছিল একবার কফিলউদ্দিন ভাই এর মতো মুক্তিযোদ্ধাকে আমন্ত্রণ জানাব স্কুলে। বাচ্চারা তাঁর পায়ের কাছে বসে মুক্তিযুদ্ধের কথা শুনবে। দেশ কীভাবে আমাদের হয়েছিল, পতাকাটা কীভাবে নিজেদের করতে পেরেছিলাম- তা জানবে। হয়ে উঠেনি। ওদের বদলে আমি শুনলাম একদিন তাঁর যুদ্ধস্মৃতি। এতদিন যুদ্ধের যে ছবি দেখে এসেছি, তার বাইরের অন্য কিছু ছবি দৃষ্টিগোচর হয়। মুক্তিযোদ্ধাদের নানা ভাগের সাথে পরিচিত হই।
মুক্তিযোদ্ধা দুলাভাই জালালউদ্দীন আখন্দ এর সাথে কথা বলতে গিয়ে অনেক অজানা তথ্য জানা হয়। কুড়িয়ে পাওয়া চৌদ্দ আনার মতো পেয়ে যাই বোনের ম্মৃতিকথা। ১৩ বছরের মানুষের স্মৃতিতে উঠে আসে সামাজিক বাস্তবতা, একটা পরিবারের ভেঙে টুকরো হওয়ার বেদনা। তারপর একে একে অনেকের সাথে কথা হয়। বিস্ময়কর ব্যাপার হলো এমন অনেকের স্মৃতি ধারণ করেছি, যাদের বয়স তখন ৩/৬/৭/৮ বছর। তাঁরা বলেছেন মা বাবার কাছে শোনা গল্প বা নিজেদের স্মৃতি খুঁড়ে বের করেছেন। অনেকে ইনবক্সে এসে নিজের কথা বা পরিবারের কথা বলতে চেয়েছেন। আবার অনেকে বলব বলে সময় দিতে পারেননি। সাক্ষাৎকার থেকে লেখা তৈরির পর কেউ কেউ পালটাতে চাইলে আবার চলে এডিট।
তখন সমাজের অনেক প্রভাবশালী বা প্রতাপশালী মানুষেরা শান্তিবাহিনীতে যোগ দিয়েছিলেন যুদ্ধের কৌশল হিসাবেই। তাঁদের দ্বারা মুক্তিযোদ্ধাদের তো সাহায্য হয়েছেই, পুরো গ্রাম বেঁচেছিল শত্রুর আক্রমণ থেকে। কিন্তু মৃত্যুর পর রাজাকার আখ্যা দিয়ে জানাজায় বাধা দেওয়ার ঘটনা ঘটেছে। যুদ্ধের সময় যে পাক আর্মি ধরে নিয়ে অত্যাচার করেছিল, সেই আবার ছেড়ে দিয়েছেÑ এমন ঘটনাও আছে। আমরা মোটা দাগে রাজাকার মুক্তিযোদ্ধা ভাগ করি। সাদা কালোর মাঝে ধূসর রঙের অস্তিত্ব আমলে নিই না। সব মিলিয়ে মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে আমার ভাবনা পরিষ্কার না হয়ে প্রায়ই জটিল হয়ে উঠে। জট পাকিয়ে যায়। এত বিশাল একটা বিষয়কে ধরবার জন্য পাত্র যেমন হওয়া প্রয়োজন, সেখানে হয়তো এখনো ঘাটতি রয়ে গেছে।
কাজ শুরু করার পর পরিচয় হয় বেশ কজন মুক্তিযোদ্ধার সাথে। তাদের সাথে নানা সময়ের আলোচনা ঋদ্ধ করছে ক্রমশ। মাঠ পর্যায়ে কাজ করা তেমনই একজন সাইফুল ইসলাম ভাই, কৃতজ্ঞতার শেষ নাই। একজন জাহাঙ্গীর কবির ভাই, একজন লিনু আপা, একজন মজিবর রহমান খোকা ভাই এর সাথে টুকরো টুকরো আলাপ আমাকে ক্রমাগত সমৃদ্ধ করে। কাজটা অবিরাম চলার মতো। জানি কোথাও না কোথাও চলবেই…
বাংলার চিত্তাকর্ষক ইতিহাস সম্পর্কে জানার সময়, গৌরের মতো আর কিছু গন্তব্য হতে পারে না।…..
সবার হৃদয়ে রবীন্দ্রনাথ চেতনাতে নজরুল যতই আসুক বিঘ্ন-বিপদ হাওয়া হোক প্রতিকূল এক হাতে বাজে অগ্নিবীণা,…..
৭১ এর মুক্তিযোদ্ধের গল্প বাঙালি প্রত্যেক পরিবারের মধ্যে কিছুনাকিছু জানার ইতিহাস রয়েছে।তখনকার বাংলাদেশের সাড়ে সাত…..
‘নারী হয়ে কেউ জন্মায় না, কেউ কেউ নারী হয়ে ওঠে’ -একথা বলেছিলেন সিমোন দ্য বোভোয়া…..