স্থির করে দাও কম্পমান জল : গালিবের প্রজ্ঞার সুরাপাত্র হাতে কবি কাকন রেজা
রুমী, খৈয়াম, হাফিজের কয়েক শতাব্দী পর এলেন গালিব। মির্জা গালিব। এত দিতে সুরাপাত্র ও…..
কাব্যগ্রন্থ: যে দেশে সবাই অন্ধ
প্রথম প্রকাশ: জুন, ১৯৮৪
প্রচ্ছদ: পূর্ণেন্দু পত্রী
প্রকাশক: নওরোজ সাহিত্য সংসদ, ঢাকা।
আমাদেরই পাপের প্রায়শ্চিত্তে
মৃত্যুর কালো হিমছায়া
সারাদেশব্যাপী পড়েছে স্তব্ধ মিনার।
তুমি জানো, ভষ্মলীন আঁধার আর মন্বন্তরের বিবর্ণ সুপুর
প্রতিটা প্রাঙ্গণ ছেয়ে আছে, যেন বাংলার মাটিতে আবার
পাক সৈন্য নেমেছে সদর্পে, স্বয়ংক্রিয় অস্ত্র সম্ভারে।
তোমার মানস বলাকায় আমি তাই
বিশ্বভ্রমণে যেতে চাই—
কোন্ দেশ, কোন্ রাজ্যে এমন হাহাকার, আর
কে আমার প্রেমের বাক্যের এবং মৃত্যুর, দিনযাপনের
স্বাধীনতা কেড়ে নিতে চায়
আমি শুধু একবার দেখে নিতে চাই।
জানি, আমার একার পক্ষে এই প্রতিরোধ সম্ভব নয়,
সম্ভব নয় মারণাস্ত্রের বিরুদ্ধাচরণ; তবু
আমাকেই যেতে হবে; কেননা
আমার ভবিষ্যৎসন্তান যদি বলে :
“অতীতে তোমার কার্যকলাপ ছিল খুবই দুঃখজনক; যখন
সারাদেশব্যাপী হাহাকার, আর স্বাধীনতা হরণের পালা
তুমি তখন জীবনের প্রেমে স্বার্থপর, অথচ
এদেশ তোমার। বলো, তবে কি ক্রুর রাবণের ভয়ে
জটায়ু বিস্তার করবে না বাহু?”
তখন, কোন্ যুক্তির আশ্রয়ে বলবো :
‘হে আমার সন্তান-সন্ততি
তোমাদের পিতা ছিল অন্ধ, বধির’।
–আমি তাই, তাই আমি একবার বিশ্বভ্রমণে যেতে চাই; যদি
আমার দেখার চোখ দু’টো বন্ধ করে দাও, জেনে রেখো
কালো মৃত্যুর ভিতরেই আমি অক্ষয় গাণ্ডীব।
২/৮/৮৩
মাঝে মাঝে মনে হয়
গোটা সমাজটার খোলনালচে পাল্টে দিই;
শুধু চুনকাম করে নয়,
ভিত সুদ্ধ উপড়ে ফেলা প্রয়োজন।
কিন্তু কিভাবে?
–এই প্রশ্নে আমিও বিব্রত; তবে,
উপায় যে নেই, তাও নয়।
সমস্যা থাকলে সমাধানও আছে; অতএব
শাসক ও সংবিধান পাল্টাও।
গণভোটে নির্বাচিত হোক
কে যথার্থ শাসক, কে এবং কারা
রচনা করবেন সংবিধান।
জনতার প্রতি যদি আস্থা না থাকে
গণ-সংবিধান যদি অমান্য মনে হয়,
তথাপি একনায়কতন্ত্রের হাতে রাজত্ব নয়—
যদি মনে হয় শস্যের ভিতরেই ভূত;
তবে গোটা শস্যটাই পুড়িয়ে দাও
অপেক্ষা করো নতুন প্রজন্মের জন্যে।
৩/৬/৮৩
দেখুন মশায়, সময়ে অসময়ে আমার সঙ্গে
ইয়ার্কি মস্করা করবেন আ।
আপনি যা ভালো বোঝেন, করুণ
তাতে আমার কিসসু যায় আসে না।
আপনারও বয়স হচ্ছে, আমিও ছেলেপুলের বাপ; তাছাড়া
ইয়ার্কি-ফাজলামোরও তো একটা সীমা আছে; দেখুন
বেশি বাড়াবাড়ি করলে বিপদে পড়বেন; বলে দিচ্ছি।
যেদিকে যাচ্ছিলেন, যান;
যদি না যেতে চান; টু শব্দ করবেন না,
আমার সঙ্গে আসুন। আমি যা করি
শুধু দেখবেন। কোনো বাদ-প্রতবাদ কিংবা
জানতে চাইবেন না, কোনটি ভালো, কোনটি মন্দ : না,
সে হিসেব আপনার নয়।
এখন, আপনাকে একটি গোপন আস্তানায় নিয়ে যাচ্ছি—
এখানে বন্দুক কিংবা বুলেট
কিসসু তৈরী হয় না।
এখানে বোমা-টোমার কোনো কারখানা নেই
এখানে পোস্টার কিংবা ইস্তাহার বিলি হয় না,
এখানে নারী ও মদের কোনো ব্যবসা নেই;
এখানে আপনাকে দু’দণ্ড দাঁড়াতে হবে; এই যা।
আমাদের এই গোপন আস্তানা বুভুক্ষা ভূগোল নামে পরিচিত—
এখানকার জনগণ কিংবা বাসিন্দা, যাই বলুন
গনগনে আগুনের মধ্যে
রক্তকরবীর বীজ বুনে
নিশ্চিন্ত বসে আছে।
মশায়, আপনি দেখুন; দেখে
যেখানে যা খুশি বলবার বলুন :
“বুভুক্ষা ভূগোলের মানুষেরা
আমাদের সুরক্ষিত রাজভবনের দিকে
বিধ্বংসী ঝড়ের মতো সংঘবদ্ধ,
ক্রমশ ধাবমান”।
১৭/৩/৮৩
এদেশ এখন সৈন্য কবলিত
এমাটি এখন রক্তকিংশুক
এই আমার দেশ। আমার স্বদেশে
নেমেছে সান্ত্রী। সান্ত্রীর বুটের আওয়াজে
তীক্ষ্ণ যাত্রী।
এই আমার দেশ। আমার স্বদেশ
মিছিলে-মৃত্যুতে উজ্জ্বল।
এই আমার আকাশ। আকাশ
বজ্রগর্ভে আলোকিত। বাতাস
বারুদগন্ধে ভরপুর।
এই আমার দেশ। আমার স্বদেশ
মিছিলে-মৃত্যুতে উজ্জ্বল।
২৮/৯/৭১
আমার কবিতা দেশের জন্যে
আমার কবিতা দশের জন্যে
আমার কবিতা তোমার জন্যে
আমার কবিতা চৈত্র-দাওয়ায়
খররৌদ্রের কঠিন হাওয়ায়
ঝড়ঝঞ্চার মত্ত-খেলায়
যুদ্ধক্ষেত্রে, গোধূলি বেলায়
আমার কবিতা জলে-স্থলে
আমার কবিতা শীতে-অনলে
আমার কবিতা লাঙলে-ফসলে
আমার কবিতা তোমার জন্যে
আমার কবিতা দশের জন্যে
আমার কবিতা দেশের জন্যে
১৮/১২/৮৩
এই শূণ্যতা অন্ধকারে ভরে দাও। সারাদেশময়
কেবলি অশ্রুকণা, অথচ কোথাও ক্রন্দন নেই। পরাজয়
শুধু মানুষের। জায়মান দিনের গভীরে, আর
রাত্রির নিস্তব্ধতায় যে তরঙ্গ প্রবাহিত; আমার
স্ফুলিঙ্গ গর্ভে তারই প্রত্যাভিষেক; চেতনায়।
তোমাকে বলিনি, জীবনের গাঢ় অঙ্গীকারে-দিক্ষায়
আমার জীবন নির্ভার নয়। আকণ্ঠ তৃষ্ণায় যখন
পাথরও চৌচির, আমার দিগন্তে তখন
উদ্ধত বরাভয়। তোমাকে বলিনি, আমার সঞ্চয়ে শুধুই ব্যর্থতা
আর বিদায়ের হাতছানি;–এই আমার জীবন, এই আমার শিল্প, কবিতা।
২১/৮/৮৩
যত দিন যাচ্ছে, কেবলি
মুখোশ পাল্টে নিচ্ছি, ক্রমাগত
পাল্টে যাচ্ছে নামগুলো—
মনে হয়, আমি আর সেই আগের আমি নেই;
দ্রুত যাচ্ছি ধসে,
কোথায় যাচ্ছি; তাও অজানা।
জাহিদ, শুধু তোমার কিংবা আমার কথা নয়; আমি
গোটা দেশের কথাই বলতে চাই।
দেশের প্রসঙ্গেই আমার বারবার মনে হয়
কী করে একটি জাতি
মেরুদণ্ডহীন হয়ে গেল।
২
যারা গনতন্ত্রের কথা বলছেন,
আমি কিছুতেই বুঝতে পারি না
দেশকে ধ্বংসের পথে ঠেলে দিয়ে,
মানুষের বাঁচবার অধিকার ও স্বাধীনতা কেড়ে নিয়ে
একনায়কতন্ত্রের মাধ্যমে
কী করে গণতন্ত্র সম্ভব?
–অবশ্য, প্লেটোর কথাটাও আমি ভুলছি না :
“মিথ্যা বলার অধিকার কেবল শাসকের, আর
সবই রাজকীয় মিথ্যা।”
জাহিদ, নিশ্চয় তোমার রিপাবলিকের
কথাগুলো মনে আছে :
“শাসিতের পক্ষে শাসকের মান্য করা কি ধর্ম”?
ভেবে দ্যাখো : “টেকোমাথা আর সচুল মাথার কাজ
সত্যিই কি ভিন্ন, কখনো হয়েছে?
তোমার দক্ষতার সাথে, আমার
বিনিময় চলে না বন্ধু; কিন্তু,
অভিভাবকদের বিবাহ উৎসবে আজ
পুত্রকন্যাই অতিথি!”
৩
জাহিদ, তোমার চারপাশে লক্ষ মানুষের
ভিড়; দ্যাখো
প্রত্যেকে তোমার দেশভাই, প্রত্যেকে
প্রতিকার চায়, প্রত্যেকে তোমার
মুখের দিকে চেয়ে আছে,–
কেননা, এদেশের মুক্তিযুদ্ধে তুমিই
অংশ নিয়েছিলে;–মনে পড়ে,
সেই একাত্তরে তোমাকে
‘অর্জুন’ বলে ডাকতুম।
জাহিদ, আমি তো ভাবতেই পারি না
সেই দৃশ্য :
ষাট হাজার যাদবরমণীকে
লুঠ করে নিচ্ছে দস্যুদল,
ধর্ষণ করছে উথালপাতাল; অথচ
অর্জুন চেয়ে দেখছেন,
হাতে তাঁর গাণ্ডীব;
তিনি অসহায়!
–তবে কি গোটা দেশ ক্লীবে পরিণত?
৪
–জাহিদ, আমি কিন্তু প্রশ্নগুলোর উত্তর চাইছি—
যে মুক্তিযোদ্ধার দল, রণাঙ্গনে রক্তকরবী ফুটিয়ে
দেশের স্বাধীনতা এনেছিল
তারা আজ কী করে দর্শক, বৃহন্নলা; বলো তো!
৩/১০/৮৩
যে দেশে আমার মৃত্যুর অধিকার ছিল
সেই দেশে আমি,
পরবাসী আজ।
অথচ এই দেশে, বিদেশ-বিভূঁইয়ে
অভুক্ত দেহমনে
বেঁচে আছি, ক্ষুধার্ত প্রাণ : কি আশ্চর্য বাঁচা।
২
আমার মৃত্যুর পরে, আমার এপিটাফে লিখে দিও :
জননীজন্মভূমি ছেড়ে, এই অচেনা নগরে তার
মৃত্যু হয়েছিল।
মূলত সে কবি : তারও আকাঙ্খা ছিল
স্বাধীনতা, গণতন্ত্র, সাম্য;–আর,
শুভ্র স্বপ্ন ছিল, বিজয়ী যোদ্ধারই মতো।
২৮/৯/১৯৮৩
কোথায়ও কোনো নিশ্চয়তা নেই, এখন সর্বত্রই অনিশ্চিত
আর, সন্দেহের ছায়াগুলো দীর্ঘ থেকে গাঢ় হয়ে উঠছে।
জলপ্রপাতের শব্দে একদিন বুঝতাম, ধস আসন্ন। দেয়ালে
সারি সারি পিঁপড়ের দাগ দেখে বলতাম : ঝড়ের তাণ্ডবে
সংসার, ঘরবাড়ি, সবকিছু তছনছ হয়ে যাবে।
–এখন বুঝতে পারি না, বন্ধুর মুখোশ কোনদিকে ফেরানো।
বুঝতে পারি না, কে শত্রু কে মিত্র, এই দেশে।
২২/১০/৮৩
চৈত্রে ফেটেছে মাঠ; জৈষ্ঠ-আষাঢ়ও খরতাপে উজ্জ্বল,
দগ্ধ করেছে দেশ; এদিকে, শ্রাবণও নির্জলা; কোলাহল
শুনি মানুষের ‘জল দাও’।–শস্যের ভূমি আজ
কবরের মত উন্মুক্ত; যেন সবই মাটির কারুকাজ।
কে-বা দেবে জল; যতটুকু ছিল চোখের কোণায়
তাও যেন ধুয়ে গেছে বিগত বর্ষায়।
–ঘরে ঘরে তাই হাহাকার; পিপাসিত বিশ্বে আমি
ছুটি দিনান্তে-ঊষায়; ক্লান্তিহীন চলা শুধু পথে, পথে-পথে—
সূর্যের প্রচণ্ড দাবদাহে নদীও চৌচির; নামি
অবগাহনে, অতল হেডিসে। বেগার্ত জীবনের রথে
দগ্ধ জীবনের গান, শুনি প্রহরে প্রহরে;
অথচ দেখা নেই বৃষ্টির। এদিকে আকাশ,
হানে বাণ অগ্নির। আমাদের ধনধান্যেপুষ্পেভরা বাংলার ঘরে ঘরে
রোদনের ধ্বনি আর মাঠে মাঠে শ্বাপদের নিশ্বাস!
জল চাই, জল দাও আমাদের প্রত্যাহিক জীবনে, দীর্ঘযাত্রায়
জল দাও আমাদের ঘরে ঘরে, তৃষিত বাংলায়।
১৪/৩/৮৩
দ্যাখো জাহিদ, ঠিক এইভাবে আর চলতে পারে না—
নয়কে ছয় করে, ছয়কে তিনের ঘরে দাঁড় করিয়ে
যেমন ইচ্ছে তুমি ভাঙবে
সেই বয়স, সেই হঠাৎ ভুলে যাওয়ার দিনগুলো
না, এখন আর নেই।
তোমার চোখ-টোখ দেখে মনে হচ্ছে
গতরাত্রে তুমি
ভয়ংকর স্বপ্নের মধ্যে ডুবে গিয়েছিলে।
ঘুমের ভিতরে তুমি
সপ্তদ্বীপ পেরিয়ে, রবীন্দ্রনাথের সেই পদ্মার তীরে
এখন যেখানে অশ্বমেধ আর যজ্ঞের তুমুল হৈ চৈ; সেখানে
সত্যিই তোমাকে অসহায়,
বিপদগ্রস্ত মনে হচ্ছিল।
হা, যে কথা বলছিলাম—
তোমার জন্যে আমার শিরস্ত্রাণ
চেঙ্গিস যুগের বল্লম, আর
টিপু সুলতান আমলের অশ্ব, সব
সাজিয়ে রেখেছি। তুমি,
যুদ্ধে যাবার আগে
শেষবারের মত পরীক্ষা ক’রে নাও।
–মনে রেখো
তোমার প্রতিপক্ষ সারারাত
ঘুমিয়ে নেই। তুমি,
আসমুদ্রহিমালয় জয় করবার আগে
আমাদের চৈতন্যে হানো
বজ্রের আঘাত।
–মনে রেখো
তোমার পুত্র অর্জুন আর
আমার কন্যা জয়শ্রী
ঘরে ঘুরে উড়িয়েছে
অন্তঃশীল রৌদ্রের পতাকা।
১৮/১০/৮২
দর্পনে ও-কার মুখ, তোমার আমার নাকি প্রত্যেকের
নাকি, মানব নামধারী কংসের?
হয়তোবা তাই। হয়তোবা সবাই শাসকের
ভূমিকায় অবতীর্ণ; ধরবে দণ্ড রাজবংশের।
দ্যাখো, কী অবস্থা দেশের, দশের ভাগ্যে আজ
মৃত্যু ছাড়া কিছু নেই। প্রতিবাদী কেউ নয়; অথচ সবাই
ভুলেছি বাহান্ন, একাত্তর;–বিস্মৃত জাতির সাজ
সত্যিই পিপীকিকা-তুল্য; বোঝাবে কে, তেমন বুদ্ধিজীবী
রাজনীতিবিদ কই! “শুধু চাই
সিংহাসব;” ব’লে আমি-তুমি প্রত্যেকে নেমেছি পথে,
কেউবা ভিখিরীর সাজে, কেউবা সৈনিক বস্ত্রে—
যে যেমন সাজে, সজ্জিত হতে চাও মারণ-অস্ত্রে।
–আমরা সবাই নেতা, আমাদের এই নেতার রাজত্বে।
১৩/৩/৮৩
যে কথা যে-ভাবে বলতে চাই,
আগের মতো আর কিছুতেই
ইনিয়ে বিনিয়ে বলতে পারি না।
চুল এখন ক্রমশ শাদা হয়ে আসছে।
সামনের পাটির দু’টি দাঁত, এই দিনকয়েক হলো
নড়ে চড়ে বুঝিয়ে দিচ্ছে
বয়স বসে নেই। মেঘে মেঘে অনেক বেলা হলো।
আমাদের আগামী শতকের দিকে এগুচ্ছি,
পৃথিবী ক্রমশ বুড়ো হয়ে আসছে।
কবিতা এখন আর আগের মতো সংঘবদ্ধ হচ্ছে না—
শব্দকে ভেঙে যে ভাবে তছনছ করছি,
পয়ারকে ভেঙে ফেলে অক্ষরে, অক্ষর ছিঁড়ে ফেলে
মাত্রায় ঢুকে পড়ছি; জাহিদ
তুমি দেখে নিও
আগামী শতকের মানুষেরা
কালবৈশাখীর ঝঞ্জার মতো সর্বত্র ঢুকে পড়ে
চুরমার করে দিচ্চে
আমাদের সুরক্ষিত লিরিক।
তুমি, নিরাপত্তার অভাবে এখনি মোহ্যমান?
ক্ষুধা তৃষ্ণার সংগ্রামে যারা
মৃত্যুকে তুচ্ছ করে
পথে-প্রান্তরে ছড়িয়ে পড়ছে; দ্যাখো
সূর্যকে হাতের মুঠোর এনে
ছড়িয়ে দিচ্ছে রাত্রির গভীরে।
-দ্যাখো, গত এক শতাব্দী ধরে
আমাদের বাংলা কবিতা অভূক্ত, মৃতপ্রায়।
১৮/১০/৮২
আমি যে দেশের কথা বলি
সেই দেশ বিশ্ব স্বদেশ
আমি যে মানুষের কথা বলি
সেই মানুষ অমৃতস্যপুত্রাঃ
আমি যে ঘরের কথা বলি
সেই ঘর আসমুদ্রহিমাচল
আমি যে প্রেমের কথা বলি
সেই প্রেম বিশ্বপ্রকৃতি
আমি যে নারীর কথা বলি
সেই নারী বীরভোগ্যা বসুন্ধরা
আমি যে আমার কথা বলি
সেই আমি বিশ্ববাংলার।
৯/১২/৮৩
তোমার মুখের উপরে, এই শতাব্দীর
কালো ছায়া,
লেপ্টে আছে।
স্ফুলিঙ্গ ও ভষ্মে, যতবার
দেখেছি নিজেকে,
প্রজ্বলনে উন্মোচিত
আমি
নগ্ন-পাখসাটে।
আমার সমস্ত অহংকার, তুমি
নত করে দাও, তোমার
বীজে ও মন্ত্রে।
দিনের প্রখর রোদ্দুরে
যতবার আড়াল করেছি নিজেকে
তোমার শমীবৃক্ষ ঘিরেছে আমার
সমস্ত অঙ্কুর।
আমার চরাচরে তাই, ক্ষিপ্ত খাণ্ডবদাহন।
২১/৮/৮৩
দিগন্তে জাগুক তোমার প্রণয়
আশ্চর্য শরতে যে হাওয়া বয়
চতুর্দিকে, মনে হয় :
সর্ব দুঃখ জয় ক’রে নেব কার্তিকে।
জীবনের সকল ঐক্যে থেকে, মাতিকে
পুরুষ যদি ফিরে যায় রনে
দিও তাকে তিলক, মধুর সম্ভাষণে।
এই মহাকাশ তলে, আমার প্রণতি-প্রণয়
তোমাকে দিলাম; নারী, তুমি দাও যুগ্ম অভয় :
আমার ধমনী হোক চিরশস্যময়
আর, শান্তিসুধারসে ভরুক সকল আলয়।
৯/১২/৮৩
আমার সমস্ত রক্তে, ধমনীতে
আর্ত হাহাকার;
তাই নিয়ে
হে হৃদয়
বাঁচি
ক্ষুধার্ত শহরে, ধোঁয়ায়।
মাঝে মাঝে হঠাৎ শিহরণ জাগে
সমস্ত রসনায়
বিশ্বতৃষ্ণা, আর
তিমিরবিদারী দংশন।
হে হৃদয়, খোলা আকাশের নিচে
তোমাকে নিয়ে আমার
দিনরাত্রি,
একাকার।
২
দিনের পরে দিন যে গেল
ভাবি
বিগত দিনগুলোর কথা;
ভাবি
হে জীবন, এখনো সময় আছে
তোমাকে একবার
গড়ের মাঠে, অন্ধকারে
জনতারাণীর সাথে
অমর্ত্য গানে,
ভাসিয়ে দেব।
হে জীবন, তুমি জানো
যুদ্ধ হিংসা আর বিপ্লবই
আমাদের জীবন, ইতিহাস।
আজকের জীবন আমার কাম্য ছিল না,–
সীমান্তের ওপারে আমার ঘর, গেরস্থালি;–
অথচ দ্যাখো,
যৌবনের অর্ধেককাল এই প্রবাসে, বিভুঁইয়ে কাটিয়ে
আমি আজ অনাথ, গৃহহীন।
হে জীবন, তোমাকে সুখের মুখ দ্যাখাবো ব’লে
সেই কথে থেকে প্রতীক্ষমান;–
এক যুগ কেটে গেল, এই কলকাতায়
এখনো আশায় বসে আছি;
যদি কেউ ফেরায় সস্নেহে, পিতৃদেশে।
১৮/১১/৮৩
রাধা নাচবে ঘি পুড়বে
বর্গী আসবে দেশে
রাজার সেনা ধান গিলিবে
খাজনা দেব কিসে।
খাজনা না হয় রক্তে দিলুম
প্রাণটা দেব কিসে—
প্রাণটা দেব কামান-গোলায়,
জন্মেছি এই দেশে।
২
কালোবজ্র স্টেশনে
তোমায় দেখি আপন মনে
হাঁটছো।
কী এক গভীর সংগোপনে
দেশের দশের আন্দোলনে
যাচ্ছো।
নগ্ন-নরক উন্মোচনে
পারবে?
ক্ষুধার তীব্র আক্রমণে
হারবে?
হারার চেয়ে বড়ো কথা, ঐক্যবদ্ধ আন্দোলন
আন্দোলনে দেখবে তুমি, উল্টে গেছে রাজভবন।
১৯৮৩
রাজার পাপে রাজ্য নষ্ট, তাই সমস্ত থিবি আজ
আক্রান্ত দুর্ভিক্ষে, মহামারী আর বন্যায়—
যে কোনো মুহুর্তে সবকিছু, এমন কী রাজ
-বাড়ি ধ্বংস হয়ে যেতে পারে। ন্যায় অন্যায়
মানুষের করতলে। থিবির অধিবাসী যারা,
মৃত্যু-ভয়ে লীণ নয়, জানি; কিন্তু, সৈন্য-
-সামন্ত রাজার আজ্ঞাবহ; সজ্জিত তারা
বর্মে ও অস্ত্রে; উপরন্তু, স্বভাবে বণ্য।
কার বিরুদ্ধে এই অস্ত্র ও বর্ম?—নাকি,
স্বদেশেই ব্যবহৃত?—হয়তোবা।
মূলত জারজ এরা : তাই, লজ্জায় নাক ঢাকি,
ঘৃণা করি; কারণ, খচ্চরের অধিক রাত্রির শিবা।
২
একদিন সবই ছিল এইদেশে, ধনধান্যেপুষ্পেভরা;
অথচ উধাও আজ। আমাদের সুন্দরী বসুন্ধরা
ভিক্ষা মাগে : ‘কোথায় তাইরেসিয়াস, কে শোনায়
আশার বাণী, দুর্দিনে; তবে কি থিবি আজ, সত্যিই অসহায়’।
৭/১০/৮৩
মাঝে মাঝে তোমার কথা ভাবি
আকাশে জমেছে মেঘ, বাতাসে বৃষ্টির গান
রাত্তির বড়ো দীর্ঘ; কিছুতেই
ঘুম আর আসছে না। একবার এপাশ, একবার ওপাশ, আর
বিশ্বচরাচর জুড়ে নিথর স্তব্ধতা।
মাঝে মাঝে মনে হয়
অসীম শূন্যের ভিতরে উড়ে যাই।
মেঘের মতন ভেসে ভেসে, একবার
বাংলাদেশ ঘুরে আসি।
মনে হয়, মনুমেণ্টের চূড়োয় উঠে
চিৎকার করে
আকাশ ফাটিয়ে বলি :
দ্যাখো, সীমান্তের ওইপারে আমার ঘর
এইখানে আমি একা, ভিনদেশী।
২৫/১০/৮৩
বুঝলে হায়দার, আজকালকার পদ্য আর পড়া যায় না;
কী যে ছাইভস্ম লেখো
আগা নেই মাথা নেই, যা খুশি তাই লিখছো
কী যে বলতে চাও, কাকেইবা বলতে চাও
একমাত্র তোমরাই বোঝো।
অথচ আমাদের কবিতায় কী-না থাকতে পারতো, বলো—
এত বড়ো মুক্তিযুদ্ধ গেল সারাদেশে
রক্তের স্রোত বইলো;
ভারতে এক কোটি উদ্বাস্তু
দশ লক্ষ গৃহহীন
মা বোন ধর্ষিতা
বুদ্ধিজীবী নিখোঁজ, হত্যা
ত্রিশ লক্ষ লোকের বিনিময়ে স্বাধীনতা
এবং ১৯৭৫-এ জাতির জনক
সপরিবারে নিহত
নিহত
নিহত
নিহত
নিহত
এবং নিহত—
–বলো, কোথায় লেখা হলো সেই কাহিনী
কোথায়ইবা সেই মহাকাব্য, বিষাদসিন্ধু?
হায়দার, তোমাদের কবিতা পড়লে মনে হয়
বিগত তিন দশক ধরে
আমরা বেশ সুখেই আছি;
মনে হয় :
বাংলাদেশে প্রেম ভালোবাসা ছাড়া আর কিচ্ছু নেই।
আমি কিন্তু দেখতে পাই
হাসান হোসেনের মুণ্ডের জন্যে
এজিদ আর সীমারের বংশধর, আজো
পথে পথে ঘুরছে।
দেখতে পাই
পেট্রোডলারের কাধে কাধ মিলিয়ে
সাম্রাজ্যবাদের তীব্র নখ
ছিন্নভিন্ন করছে
আমাদের প্রিয় জন্মভূমি, বাংলাদেশ।
২
আমি অবশ্য আদার ব্যাপারী, তাই
জাহাজের খবর রাখিনি কোনোদিন; কিন্তু,
স্পষ্টতই দেখতে পাচ্ছি
ধোঁয়ার ধোঁয়াকার হয়ে আসছে
আকাশ;–
শুনতে পাচ্ছি
বুটের আওয়াজ আর ট্যাঙ্কের গর্জন ছাপিয়ে
গণমানুষের ক্ষিপ্র পদধ্বনি—
আমার বিশ্বাস;
অচিরেই পৃথিবীর ভিত্তিভূমি নাড়িয়ে দেবে।
৩
না, এমন আর কথাটি ঘুরিয়ে ফিরিয়ে নয়;–
প্রতিদিনের মৃত্যুর চেয়ে
একদিনের মৃত্যু অনেক শ্রেয়, তাই
একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ, স্বাধীনতা টিকিয়ে রাখতে হলে
আরো একটি মুক্তিযুদ্ধের প্রয়োজন।
–হায়দার, তুমি তোমার কবিতায়
সেই দিনের কথা লেখো।
২৪/১২/৮৩
কে জানে, নদীর উৎসে
বিশ্বপটের ছায়া
পিঙ্গল আকাশে, পাখির
ওড়াউড়ি, হয়তোবা
মুক্তির পুণর আশা।
প্রকরণে, এও কি সম্ভব?
–প্রকৃতির দুয়ারে দুয়ারে, চেতনায়
তোমার ফিরে চাওয়া।
উত্তরণে, অমর তৃষ্ণায়
হয়তোবা, দগ্ধদিনে
গোধূলিতে, আমাদের মান্যজীবনে
দীর্ঘায়ু; কপিলগুহায়
১২/৭/৮৩
[অত্যাচারের অমোঘ নিয়মে সুখী অসুখীর বিচ্ছেদ ভেঙে কবে যে সবাই বাঁচবে।
হেমন্ত/বিষ্ণুদে
–আমিও ভাবি তাই; দিনান্তে দিগন্তে বাজে
নরবলী মড়ক-সঙ্গীক। নিরন্ন মানুষের দেশে মাঝে মাঝে
তাই মৃত্যুঞ্জয়ী হতে চাই। যদিও, পিতৃকালের শানিত তরবারী নাই
তবুও পথে পথে ঘুরি; যদিও প্রাণের সীমানায় পাই
ঐশীর সীমা, অকাল বোধনে।
আমিও ভাই তাই, নিরন্ন মানুষের দেশে
অত্যাচারের অমোঘ নিয়মে সুখী, আমি-তুমি, নানা পরিবেশে
রাজণ্য অত্যাচারে, নানা ধর্মঘটে, কখনোবা
মারী ও বন্যাতে। দিনে দিনে শুধু জনসভা
এদেশের আনাচে কানাচে; অথচ অসুখী বিচ্ছেদ ভেঙে মনে-
প্রাণে বাঁচা যে কঠিন দায়; আমাদের নবজীবনের উজ্জীবনে।
৭/২/৮৩
আমাদের সমস্যা নির্মাণ ধ্বংসের দিকে
আমাদের সমস্ত প্রেম মৃত্যুর দিকে
আমাদের জীবনের উজ্জীবনে, যতবার
মাধূর্য-বাসর গড়েছি, দেখেছি
রাজন্য অত্যাচারে
ভেঙে গেছে শ্রমের সংসার।
আমাদের ভাষা আছে বধিরের
আমাদের চোখ আছে অন্ধের
আমাদের পৌরুষ বৃদ্ধ যযাতির।
২
আমাদের জীবনের উজ্জীবনে আশা নেই ভাষা নেই, তাই
জীবনে-মরনে ব্রতী
ইতিহাসে-উল্লাসে, নাকি
এক জীবনেই নানা জীবনের জীবন যাপনে
অসুস্থ প্রবাসী?
আমাদের কালের অসুখে
নানা জীবনের দ্বন্দ্ব
প্রহরে-প্রহরে, নাকি
অসুস্থ মারী ও মড়কে, অন্ধ?
আমাদের কালের সভ্যতা, ইতিহাসে
চতুর্দিকে, ঘরে ঘরে সন্দেহ, ভয়
কী ভাবে বাঁচি মরি; কোথায়!
৩
মৃত্যুর দেশে মর্তের অধিবাসী যারা
জীবনের স্কেড়নাট্যে রচেছিল সংহতি
মানবিক-বোধে নাগরিক তারা
বাসুকীর সাথে বন্ধুতা সম্প্রতি?
৪
আমাদের জীবনের কাল যুদ্ধে
মহামারী আর মন্বন্তর, জানি
জীবনে জীবন বেঁধে, জীবনের বিরুদ্ধে
রচি জীবনেরই গ্লানি।
–বিহঙ্গ তাই এনেছে সন্ধ্যা দুরন্ত ঘুর্ণিতে
বন্ধ পাখায় অন্ধ আঁধার নেমেছে কালের চুর্ণিতে।
৫
আমাদের ভাষা আজ বধিরের
আমাদের চোখ আজ অন্ধের
আমাদের পৌরুষ বৃদ্ধ যযাতির
আমাদের চলা শুধু খঞ্জের
আমাদের গান শুধু মৃত্যুর,
আমাদের নির্মান ধ্বংসের।
৬
যেদিকে তাকাই শুধু অন্ধ, পঙ্গুর সমাহার—
যেদিকে তাকাই দেখি, কালো-ছায়া আবিশ্ব পাষানে
যেদিকে ফেরাই কান, শুনি
পদধ্বনি; কার পদধ্বনি?
১/১০/৮৩
মনে করো
একদল ক্ষুধার্ত মানুষ
ঝড় বৃষ্টি মাথায় নিয়ে,
বহু পথ অতিক্রম ক’রে
শুধুমাত্র ভাতের গন্ধে
তোমার দোরগোড়ায় ছুটে এসেছেন।
মনে করো
তাদের শরীর থেকে যে ক্ষুধা-তৃষ্ণার ঘ্রাণ,
বারুদের গন্ধের চাইতেও তীব্র আর ঝাঁঝালো;
বাতাসকে মথিত ক’রে
হাওয়ায় আসছে ভেসে।
মনে করো
ক্ষুধার্ত মানুষের দলে
আমিই সবচেয়ে বুভুক্ষু, আর
পুরোভাগে দণ্ডায়মান।
মনে করো
এক টুকরো ছেঁড়া কাপড়ে
লজ্জাকে ঢাকবার ব্যর্থ প্রয়াসে যখন অতিশয় ক্লান্ত,
হাওয়ায় কিছুতেই অবরুটুকু মানছে না;
তুমি তখন অনায়াসে দেখে নিচ্ছ
আমার পাঁজরে ফুটে উঠছে বিশাল মানচিত্র, আর
সেই মানচিত্রের ভিতরে
অসহায় আর্তনাদে আমি
একমুঠো ভাতের জন্যে
মাটিতে মুখ থুবরে পড়ে যাচ্ছি।
–ঠিক তখনি, তখনি তোমার উনুনের গনগনে আগুনের আঁচে
আমাদের হাড়-মাংস টগবগ, টগবগ করছে।
১১/৩/৮৩
সব শালার চরিত্রই আমার জানা আছে, এবং
সব শালাই খাঁটি হারামজাদা; বললেন
আক্কেল আলী এবং বললেন : যতদিন যাচ্ছে
সব শালাই বাঞ্চোতে পরিনত হচ্ছে এবং খুবই দুঃখের বিষয়
সব শালাই আমার পরিচিত এবং আত্মীয়-বন্ধু-স্বজন।
কথাটি আরেকটি বিস্তৃত করে আক্কেল আলী বললেন :
প্রগতির ধ্বজাধারী বুদ্ধিজীবীর দল বিপদের গন্ধ পেলেই
ভাঁজা মাছ উল্টে খেতে জানে না, বরং
ত্রিকালের ফুলবাবু সেজে দিব্যি বধির, ভালোমানুষ।
এবং আক্কেল আলী ঠিক তক্ষুনি সব শালাদের চেহারায়
কতগুলো মুখোশ দিনে রাতে কী রকম যুৎসই তার বর্ণনা করে
বললেন : এইসব শালা ও বাঞ্চোতদের জন্যেই
দেশটাও আজ রসাতলে গেল।
৫/১১/৮২
আমার আসমুদ্রহিমাচলে
মানুষের যে স্বাধীনতা,
যে বিশ্বাসে উদ্দীপ্ত আমার ভাই
তাকে
ঠুলি পরিয়ে বলা হচ্ছে
‘সূর্য এখন পশ্চিমে উদিত’।
আমার জন্মভূমি নিয়ে
যে তুলকালামা কাণ্ড চলছে,
আমি
সেই খেলা বন্ধ করতে চাই।
রাজার পাপে রাজ্য নষ্ট, তাই
প্রজাগণ
স্বহস্তে বিচারের ভার নেবে অচিরেই।
১৫/১২/৮২
দীর্ঘায়ু-যে, পরতে পরতে তোমার
হিংস্রতা।
শিকড়ে জলের ভিক্ষা, হয়তোবা
চেতনাতেও।
চৈতন্যের দীক্ষায়
ব্যাকুল আকুলতা, হয়তোবা
জীবনে-ইতিহাসে।
কে যাবে সঙ্গে, কিশোর
ক্লিন্ন নরকে
মানবিকতাও দেখি
ট্রাজিকে-উল্লাসে।
অগণন কুণ্ডলী, পাকিয়া
উঠেছে আগুন
হিংস্রতা, পরতে পরতে তোমার
হিরণ্যকশিপু।
২০/৭/৮৩
একাত্তুরে তুমি ছিলে আমার ঈশ্বর
তোমার পদযুগলে তখন
ক্ষিপ্ত গতিবেগ, আর
বাহুতে,
তীব্র বিক্রম;
তুমি ছিলে আমার ঈশ্বর।
২
স্বাধীন স্বদেশে, হে আমার
নিভৃত প্রাণের দেবতা
তুমি আজ বন্দী এক
অক্ষম ধাতব-নির্ভরে।
বাঙ্কারে, যে হাতে গ্রেনেড ছুঁড়েছ
যে পায়ে, দুর্গমগিরিমরুকান্তার পেরিয়ে,
জয় করো স্বাধীনতা
সেই হা, সেই পা এখন
অচল,
নিঃসাড়।
তুমি প্রতিবন্দ্বী স্বাধীন স্বদেশে।
৩
একবার, শুধু একবারই
প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হও। জ্বলে ওঠো,
সার্বভৌম
মাটির গন্ধে,
তৃণজলে।
যে বেদনা ঝরেছে ভূগোলে,
স্বদেশে;
তুমি জানো :
আমাদের স্বাধীনতা, তোমারই
রক্তে, আহুইতে।
৪
মরজীবনের ভিতরে, গোটা
তোমারই মতো প্রতিবন্দ্বী;
হে ঈশ্বর, ঐশ্বরিক
অস্থি ও চামড়ায়, আমাদের
রাজসূয় অট্টালিকা,
সিংহাসন—
–ক্রাচে ভর দিয়ে কোথায় চলেছ, মুক্তিযোদ্ধা?
৩১/১০/৮৩
তুমিও কি বাঁচবে, বাঁচাতে পারবে নিজেকে?
যে আগুন জ্বলেছে চিতায়, সারাদেশে; এঁকেবেঁকে
কুণ্ডলী পাকিয়ে আসছে ধেয়ে; পুড়িয়ে দেশ-ঘর
বনরাজি, খামার, প্রান্তর—
তুমিও কি বাঁচবে, একাই বাঁচবে, এই ভেবে
উঠেছো চূড়োয়?—তোমাকে, কে দেবে
আশ্রয়!—শূন্যেরও সীমা আছে! মারী ও মড়কে
হাহাকার, দেশব্যাপী; নরকে-সড়কে
দেখি দ্বিধাহীন শব, ছড়াছড়ি।
কে দেবে আশ্রয়, ভাবো : সময়ের ঘড়ি
দ্রুত গলে যায়! আছে পারিষদ, আছে সিংহাসন—
জানি; কিন্তু বলো, সব মন
যদি একাকার হয়, দ্রোণাচার্যও অক্ষম
বাঁচাতে তোমাকে। তোমার অনুপম
সার্কাস দেখে কিছুতেই ভুলি না, বাঘ
তুমি জনতায় মিশে ভুলে গেছ রক্তের স্বাদ!—আপাতত মাঘে
উত্তীর্ণ; আসন্ন ফাল্গুনে তাই, দর্শকই ভক্ষক।
কি করে বাঁচবে, বাঁচাতে পারবে কি; শুনি, কে তোমার রক্ষক!
২৬/২/৮৪
সজল বৃষ্টিতে একবার, প্রকৃতির
নিয়মে স্বেচ্ছাবন্দী; তাই
দেশজ সমাজে, অনুষঙ্গে
তোমাকে আমার চাই।
মন জানে, প্রাণের পললে
আমিই মুক্তি, আশা
উত্তরণে।
অনুরক্তে, শিল্পে, দীক্ষায়
যে-জীবন পরাজিত
মানুষের;
সেখানে কী, বার বার ফিরে যাওয়া,
চেতনায়?
চেতনা কি, অকালবৈশাখ
ক্ষুধার্ত বাংলায়?
৮/১০/৮৩
যে বিশ্বাস নিয়ে একদিন
বৈজয়ন্তী উড়িয়েছে, সেই
একাগ্রতায়
এখনো আমি প্রতীক্ষমান।
আমাদের অবয়বে এখন, আপাতত
কোন দৃশ্য নেই; ভিতরে
বহ্নিমান শিখা, আর
রক্তফেন আক্রোশ
জেগে আছে।
২
তোমার দেখার চোখ দু’টোয়
আরো একটি চোখ
বসিয়ে দিতে চাই;
শিবনেত্র নয়, তৃতীয় চক্ষু দিয়ে
দেখে নাও, তোমার স্বদেশে
সহস্র রাবণ ও দুর্যোধন; এখনো
ছদ্মবেশে,
স্থির।
তোমার পায়ের তলা থেকে, মাটি
ধীরে ধীরে
সরে যাচ্ছে; তুমি
দিগন্তে তাকিয়ে
তারা-ছাওয়া সৌর-আকাশ
দেখছ।
যে অরিত্র নিয়ে, ঝঞ্চসাগর
পাড়ি দেবে, বলেছিলে; দ্যাখো
মাস্তুল ভেঙে আছে ডাঙায়।
দ্যাখো, দিকচত্রে আজ
ঊর্মির জোয়ার; অথচ তুমি
ক্ষিপ্ত ঈগলের মতো
আকাশ, শুন্যতা ঠোকরাও।
তবে কি সব আহুতি
বৃথা গেল, তোমাদের?
তোমার ভিতরে এক
শুদ্ধির সন্তান জেগে আছে, শুধু
একবার প্রজ্বলনে
উন্মোচিত হও।
আমি, মাটির মানুষ; তাই
আশাবাদী;–
স্ফুলিঙ্গ ও ভস্মে
অনাদি প্রেমিক্ল আমার স্বদেশের।
এসো, আমাদের বৈজয়ন্তী ওড়াও
ত্রিলোকে, আসমুদ্রহিমাচলে, আর
বিশ্ববাংলায়।
১৮/১০/৮৩
যে দেশে সবাই অন্ধ,
সূর্যের প্রচণ্ড আলোকেও
চক্ষুষ্মান নয়; সেই দেশে
পিতৃলোকের ছায়া
পড়েছে মাটিতে, দর্পণে।
দর্পণে, তোমারই মুখের রেখা
চেনা কী অচেনা
দ্বিখণ্ডিত, স্বরূপে
আলোয়।
আমাদের দেশজ সমাজে, তাই
দিবানিশি অন্ধকার। যেদিকে তাকাই
দৃশ্যত কিছু নেই; আগমন শ্মশান-নরক
আমাদেরই দেশজ সমাজে, ঘরে ঘরে বাংলায়।
১/১০/৮৩
আমাদের ভূগোলে এখন, রাজসূয়
ষড় যন্ত্রের
ঐক্যতান।
পুড়ছে বাংলাদেশ।
সহমরনে, পতিও যাত্রী; শুধু
কীতনে বাতাস
নির্বেদ।
চিতারজনী ঘিরেছে
দিকচক্রবাল। রাজকীয় পুরোহিত
বহ্নির সৌন্দর্যে
মুগ্ধ; তাই
ললাটও প্রসারিত
আনন্দে।
নিয়ত বিপন্ন মানুষ, রক্তসিঞ্চন ক’রে
জরাগ্রস্থ,
স্বদেশে।
পুরোহিত, ষড়যন্ত্রের ঐক্যতানে
দিশেহারা।
পুড়ছে বাংলাদেশ
তীব্র ক্ষুধায়, চিতায়।
২
আমি বলি : এই পাপাচার থেকে
মুক্তি পাবে, যদি
অসুরবিরোধী সহযোগিতায়
বুভূক্ষুর মিছিলে দুঃসাহসী
তরুণিক হও।
আমরা সকলেই
আগ্নেয়গহ্বরে জন্ম নিয়েছি, তাই
লাভাস্রোতের উৎসে
রক্তগোলাপ ফোটাতে
উদ্গ্রীব। তুমি শুধু, একবার
পুষ্পবীজ নিয়ে
দাঁড়াও। তোমার সহযোদ্ধারা
তোমারই চতুর্পাশে, সমবেত
প্রতীক্ষমান। অচিরেই,
রাজসূয় যজ্ঞ, আর
পুরোহিত
ধুলিস্মাৎ হবে,
স্ফুলিঙ্গে ও চিতায়।
২৭/১০/৮৩
বুঝলে জাহিদ, দিনকাল যা পড়েছে
এখন বেঁচে থাকাটাই দায়।
প্রত্যেকদিন সকালে উঠে দেখি
ঘাড়ে মাথা আছে কী নেই
চোখ দু’টো দেখছে, না অন্ধ
কানে শুনছি, না বধির
চুলগুলো কালো, না শাদা
কিছুই বুঝতে পারি না।
ডাইনে বললে বামে
বামে বললে ডাইনে
চলবো; এমন সাহসও আর নেই।
অথচ দ্যাখো
এই আমরাই একদিন
ভাষার আন্দোলনে, ঊনসত্তরের গণুভ্যুত্থানে
একাত্তরের স্বাধীনতা যুদ্ধে
শত্রুর উপর ঝাঁপিয়ে পড়েছি। তখন,
আমাদের কাছে
মৃত্যুই ছিল জীবনের স্বাধীনতা।
স্বাধীনতা ছিল মৃত্যুর চেয়ে বড়ো।
আর সেই স্বাধীনতা পাবার জন্যে
কী কাণ্ডই না করেছি।
অথচ দ্যাখো
একটি দশক যেতে না যেতেই
স্বাধীনতার কি হাল
দেশের কী অবস্থা
খাদ্য বাসস্থান এমন কী জীবন ধারণের নিরাপত্তাও
আজ অনিশ্চিত।
–আজ, শত্রু মানে পাকিস্তান চীন আমেরিকা নয়
শত্রু মানে আমরাই দেশবাসী, আর
স্বাধীনতা মানে
কতিপয় মানুষের হাতে
অর্থ ও শাসন ক্ষমতা।
২/৯/৮৩
রুমী, খৈয়াম, হাফিজের কয়েক শতাব্দী পর এলেন গালিব। মির্জা গালিব। এত দিতে সুরাপাত্র ও…..
দাউদ হায়দার একজন বাংলাদেশী বাঙালি কবি, লেখক ও সাংবাদিক। তিননি ১৯৭৪ খ্রিস্টাব্দে বাংলাদেশ থেকে নির্বাসনের…..