যে পথে যেতে হবে

অনিন্দিতা গোস্বামী
নভেলেট
Bengali
যে পথে যেতে হবে

স্কোয়াড সাবধান। এক। বায়ে মুড়। এক। স্কোয়াড আগে বাড়ে গা আগে বাড়। এক দো এক। এক দো এক।

বুটের শব্দ মিলিয়ে যাচ্ছে পশ্চিম ব্যারাকের দিকে। দ্বিপ্রাহরিক প্যারেড সেরে সেনাদল চলে গেল ছাউনির আড়ালে বিশ্রাম নিতে। একটু উঁচু বেদির ওপর দাঁড়িয়ে ছিলেন সেনা নায়ক প্রশান্ত। ওঁর চোখের মনি দুটো ঘোরে সার্চ লাইটের মতই। ওঁর ঘ্রাণ শক্তি শ্বাপদের মতই প্রখর। নিজেই সহযোদ্ধাদের মজা করে বলেন সারমেয় জীবনই নাকি শেষ জীবন, তারপরেই মুক্তি পায় আত্মা।

এদিনও টের পেলেন। ওঁর চোখের তারায় বিচ্চুরিত হলো এক আলোর প্রভা। ওঁর সামনে এসে দাঁড়ালেন মুণ্ডিত মস্তক গেরুয়া বসনধারী দিব্যসুন্দর। প্রশান্ত মুঠি বদ্ধ হাত এগিয়ে দিলেন সামনের দিকে, বললেন, স্বাগত কমরেড। কমরেড মানে বন্ধু। দিব্যসুন্দর হাত পাতলেন। হাত পেতে ধারণ করলেন প্রশান্তর মুঠি, বললেন ধর্ম মানে ধারণ, দিব্যসুন্দরকে বুকে জড়িয়ে ধরে প্রশান্ত বললেন, জানোতো ধর্ম শব্দটায় আমাদের আপত্তি আছে, ও তো একটা নেশা যা মানুষকে সত্য থেকে আড়াল করে রাখে।

হাসলেন দিব্যসুন্দর, তারপর প্রশান্তর পিঠে মৃদু চাপড় মেরে বললেন, তর্কে বহুদূর। বল বন্ধু কাজের কথা বল, হঠাৎ তলব করেছিলে কেন?

প্রশান্ত বললেন, আমি একটা গোপন মেইল পেয়েছি যা তোমার কাজে সাহায্য করবে হয়ত।

দিব্যসুন্দর বললেন আচ্ছা! চল তবে তোমার অফিসে গিয়ে বসা যাক।

প্রশান্ত বললেন, হুম, চল। তবে অফিসে নয় আমার আরো গভীর গোপন ডেরায়। যা এখনো অনেকেই দেখেনি।

দিব্যসুন্দর বললেন, এতটা বিশ্বাস করবে?

প্রশান্ত বললেন, উপায় কি বল, একটা কাউকে তো ধরে থাকতেই হয়, তা আমার মত নাস্তিক সারমেয়র তোমাকে ধরে থাকাই ভালো।

বন পথে হাঁটতে হাঁটতে দিব্য বললেন, তোমার মত ধার্মিক কে আছে বন্ধু! আদর্শের জন্য সব ছেড়ে এসেছে, গৃহ, পরিবার। যে যাকে ধরে রাখে সেই তার ধর্ম। শুধু প্রাণহানির শংকা আমাকে বড়ো  বিষন্ন করে তোলে।

বেয়নেটের ফলায় পথের লতা-গুল্ম সরাতে সরাতে প্রশান্ত বলেন, জঙ্গলে আত্মরক্ষার জন্য একটা ক্ষুদ্র প্রাণীরও কতনা আয়োজন। আমাজনের জঙ্গলে তো এমন ব্যাঙ আছে যার ত্বক থেকে নিঃসৃত বিষের জন্য কোন প্রাণী তার ধারে কাছে ঘেঁষতে সাহস পায় না। অথচ মানুষ দেখো কত অসহায়, ক্ষমতার কাছে  তারা চিরকাল হার মেনেছে, আগ্রাসনের বলি হওয়া তাদের ভবিতব্য। প্রকৃতি যদি তাকে স্বাভাবিক অস্ত্র না দেয় তবে তাকে তার যা অস্ত্র বুদ্ধি তা-ই কাজে লাগাতে হবে।

দিব্যসুন্দর ঘাড় নাড়লেন, ঠিক। কিন্তু বুদ্ধিটা কি আরো সুক্ষ্ম ভাবে প্রয়োগ করা যায় না যাতে বিনা রক্তপাতে অভীষ্ট সিদ্ধ করা যায়।

প্রশান্ত বললেন, যায়ই তো। তাই জন্যই তো তোমার সঙ্গে গাঁটছড়া বাঁধা। তবে বিনা শক্তি প্রয়োগে ক্ষমতা বদল হয় প্রথার বদল হয় না। বড় করে শ্বাস টেনে দিব্য বললেন, প্রথাও একটা ক্ষমতা। মুক্তি কোথাও নেই বন্ধু তা নীল আকাশের মতই। তবে যতক্ষণ কোন কথা তোমার উপলব্ধির স্তরে না পৌঁছয় ততক্ষণ তা জ্ঞান দানের মতই শুষ্ক শোনাবে তোমার কানে। কথা প্রথা এসব তো অনেক বড় বড় ব্যাপার প্রত্যেকটা শব্দেরও আলাদা আলাদা উপলব্ধির  স্তর আছে তা কি তুমি জানো বন্ধু!

একটা বড় পাথর দেখিয়ে প্রশান্ত বললেন, বসো। তারপর কাঠ পাতায় ছাওয়া ছোট্ট কুঠিরের ভেতর থেকে নিয়ে এলেন একটি অত্যাধুনিক ল্যাপটপ।

মেইল ড্রাফট খুললেন অফলাইনেই বললেন দেখো, এখানে আমি কখনো অনলাইন হই না। সেসব জায়গা আছে ভিন্ন। সেসব ভেক্‌ ও আছে ভিন্ন।  তুমি যদি ভেকধারী সন্ন্যাসী হও আমি ভেকধারী ভণ্ড।

প্রশান্তর এই কথাতে কেমন যেন একটু ধাক্কা খেলেন দিব্য। ঠিকই তো, সর্বত্যাগী না হলে কিসের বৈরাগ্য, কিসের সন্ন্যাস। গেরুয়া বসন তো তবে শুধুই প্রদর্শন। কষ্ট জ্বালা যন্ত্রণা কিছুই তো এখনো জুড়ায় নি তার। তবে সেই নিষ্ক্রমণের আশেই তো তিনি আজ ছুটে এসেছেন,  যে ভাবে যৌবনে প্রায় প্রতি রাতে নিজ বুড়ো আঙুলের চাপে ছিটকে ফেলতেন  উচ্ছ্বাস, অভ্যাস করতেন স্থিতির,  শান্তির।  এও এক ধরনের যোগ। তারল্যের পথ বেয়ে আসে অন্তরালের সন্ধান।

ঝুঁকে পড়লেন দিব্য ল্যাপটপের পর্দায়। প্রশান্ত মুখ নামিয়ে আনলেন দিব্যর কানের কাছে। মেইল পড়ে দিব্য খাড়া হয়ে বসলেন। সরাসরি তাকালেন প্রশান্তের চোখের দিকে। তারপর বুঝে নিতে চাইলেন সবকিছু, জলের ওপরে আঁকা আছে যে মানচিত্র।

বললেন আমি তোমাকে যে পরিকল্পনার কথা বলেছিলাম তাতে এসবের কোন প্রয়োজন ছিল না। তার মানে তুমি আমার ওপরে ভরসা রাখতে পারোনি। প্রশান্ত হাত ধরলেন দিব্যর, বললেন নানা সম্পূর্ণ ভরসা আছে, আমি ভাবলাম যদি এই তথ্য তোমার কোন প্রয়োজনে আসে।

ঘাড় নাড়লেন দিব্য, হুম্‌। তথ্য সবসময়ই প্রয়োজনীয়। তুমি যত বেশি তথ্য সমৃদ্ধ হতে পারবে তত সঠিক অবস্থানে পৌঁছাতে পারবে। তবে তুমি যে তথ্য মেইল মারফত জেনেছ সে তথ্য আমার অজানা ছিল না কিন্তু আমি তৃতীয় তথ্য সূত্রের ওপর ভরসা না রেখে নিজের ধ্যান নিজের লক্ষ্য বস্তুর ওপর রাখি। অবশ্য সবার কাজের ধরন এক না-ও হতে পারে। যত মত তত পথ। অভীষ্ট লক্ষ্য কিন্তু আমাদের একই। চল ফেরা যাক।

শিবির পর্যন্ত পৌঁছে প্রশান্ত বললেন, সামান্য আতিথেয়তা গ্রহণ করে যাও বন্ধু।

দিব্য বললেন, ফের কখনো। আসা যাওয়া তো লেগেই রয়েছে। ফিরতে ফিরতে হয়তো আঁধার ঘনাবে, অনেকটা পথ ভাঙতে হবে। সময় লাগবে অনেক। তোমার মতো মার্চে অভ্যস্ত নই আমি। আমার কাছে চলা মানে ভ্রমণ। ধীর, আলস্যের।

সেনা শিবির থেকে বেরিয়ে দ্রুত হাঁটছিলেন দিব্য। তিনি সাধারণত অত দ্রুত হাটেন না। কিন্তু এ জায়গাটায় এলে কেমন যেন একটা অদ্ভুত শ্বাসকষ্ট হয় তার। কোন বুনো ফল বা গাছের গন্ধে কি এমনটা হয়? কে জানে। উৎরাই পথ সহজে উৎরানো যায়। তারপর পাকদণ্ডীর পায়ে চলা পথ ছেড়ে তিনি সরাসরি চড়াইয়ের পথ ধরলেন।

অপরাহ্ণের আলো গড়িয়ে নামছে। চতুঃপার্শ্বের  শ্বেতশুভ্র পর্বত শিখরে সোনালি মুকুট। বৃহৎ একটা চ্যাটালো পর্বত প্রান্তে এসে থমকালেন দিব্য। সামনে সুগভীর পরিখা আর  তার অপর প্রান্তে গিরিশৃঙ্গ। যেন কাচের মত নীল আকাশের গায় কেটে বসিয়েছে কেউ। ক্ষণিক দাঁড়ালেন তিনি। মনে মনে বললেন অরুণ বরণ পারিজাত লয়ে হাতে, সুন্দর তুমি এসেছিলে আজ প্রাতে। তার চোখের কোণে চিকচিক্‌ করে উঠল জল। সন্ধ্যাকালে প্রভাতী সঙ্গীত মনে হয় কেন তার! হয়ত আবর্তনের এই দুই বিন্দু একই সুরে বাঁধা তার কাছে, শুরু এবং শেষ। ঠিক এই দুটো সময়ই তো কুয়াশা সরে যায় পর্বত শিখর থেকে পূর্ণ মহিমাময়ের আরাধনায়।

ফের চলতে শুরু করলেন দিব্য। আরো খানিকটা দ্রুত। সন্ধ্যারতির সময় হয়ে এলো। তাকে পৌঁছাতে হবে তার মঠ ও মন্দিরে। ফের চড়াই ফের উৎরাই। ক্লান্ত লাগে তার আজকাল মাঝে মাঝে। বুকের মধ্যে সেই অসহনীয় কষ্টটায় কে যেন ফু দেয় অবিরত। পুকার লো তুমাহারা ইন্তেজার হ্যা। তিনি অনুচ্চারিত কন্ঠে শুধু বলেন যাচ্ছি! যাচ্ছি! আর সেই শব্দ প্রতিধ্বনি হয়ে পাহাড়ে পাহাড়ে ধাক্কা খেয়ে ফেরে। দিব্য সুন্দর দু হাতে কান চেপে ধরে বসে পড়েন মাটিতে তবু তার মাথা থেকে যায় না সেই নাছোড় সুর, তুমাহারা আ আ আ ইন্তেজার হ্যায়। কে ডাকে কে ডাকে তাকে! কষ্ট হয়, কষ্ট হয় তার বুকের মধ্যেখানে, যা ইসিজি রিপোর্টে ধরা পড়ে না।

দুই

কুশধ্বজ এসেছিল আজ দিব্য সুন্দরের কাছে। সন্ন্যাস জীবনে পূর্বাশ্রমের কথা মনে রাখতে নেই। এই পৃথিবীতে কুশধ্বজ তার একমাত্র বন্ধন যেখানে তিনি দুর্বল হতে পারেন। কুশধ্বজর এই বার বার তার কাছে আসাটা দিব্যসুন্দরের পছন্দ নয়। তার পথ একলার পথ। তিনি চান না সেই পথে তার কোন পরিচিত জন থাকুক। তাছাড়া এপথে বিপদের সম্ভাবনাও অনেক। তবু শোনে না ছেলেটা। অনন্ত গতির পথ যেন টেনে আনে তাকে। যেভাবে একদিন দিব্যসুন্দর চলে এসছিলেন সব ছেড়ে ছুড়ে। সমস্ত বৈভব খ্যাতি, সবকিছু। মিলনাকাংখায় উন্মুখ হলে প্রাণ তোমায় বাঁধবে কে!

তার প্রপিতামহ ছিলেন মহর্ষির ভক্ত। তার পিতাও সঙ্গ করেছিলেন রবীন্দ্রনাথের। তাই রবীন্দ্র শিক্ষায় শিক্ষিত করে তুলতে    ছেলেকে পাঠিয়েছিলেন শান্তিনিকেতনে। উদ্দেশ্য আরো একটা ছিল, রাজনৈতিক ভাব বিনিময়। স্কলার এক্সচেঞ্জ এখন বিশ্বে প্রায় সব বিশ্ববিদ্যালয় গুলোরই আবশ্যিক কর্মসূচী। অথচ তার পিতা তাকে দিয়ে কবেই শুরু করেছিলেন এই কাজ। বুদ্ধিমান ছিলেন তার পিতা। রাজা হিসাবে বিচক্ষণ। রাজ্য পরিচালনার যে আবশ্যিক  শর্ত প্রতিবেশী শক্তিশালী রাষ্ট্রের সঙ্গে সুসম্পর্ক বজায় রাখা একথা বিলক্ষণ বুঝতেন তিনি। স্থিথধী ছোট কুমার কে তিনি তাই বিদেশনীতি নির্ধারক হিসাবে গড়ে তুলতে চেয়েছিলেন। চেয়েছিলেন তার ছেলে শিখুক কৃষিবিদ্যা, শিখুক ভাষাবিদ্যা। মাত্র আট বছর বয়সে বিদ্যালয় শিক্ষা গ্রহণের উদ্দেশ্যে দিব্যসুন্দর পা রেখেছিলেন ভারতবর্ষের মাটিতে।

মুশকিল হলো একই শিক্ষা গ্রহণের তারতম্যে হয়ে ওঠে অনন্য, হয়ে ওঠে বস্তুমুখী, হয়ে ওঠে গতানুগতিক। বেশির ভাগ মানুষই গতানুগতিক প্রেক্ষাপট গ্রহণ করে পরিকল্পনা সাজান ভবিষ্যতের। খুব ব্যতিক্রমী হিসেবে ছোটবেলায় আমরা কাউকেই সেভাবে ভাবতে পারি না। ব্যক্তির  পারিপার্শ্ব তার অনুযায়ী শিশুকে ভাবতে থাকে এবং গড়ে তুলতে চায়। নরম মাটির পুতুল বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই ছাঁচ অনুসারে তৈরি হয়ে ওঠে। গোল বাধে সেখানেই বদ্ধ ঘরে যেখানে চারাগাছটি আলোর সন্ধান পায় এবং আলো অভিমুখে নিদৃর্ষ্ট করে তার গতিপথ।

দিব্যসুন্দর সেই আলোর সন্ধান পেয়েছিলেন। পিতা অনিন্দ্যসুন্দরের সব পরিকল্পনার ছক উল্টে দিয়ে তিনি গুরুদেব রবীন্দ্রনাথের ছবির নীচে মনে মনে নামিয়ে রেখেছিলেন রাজমুকুট। ছেলে যে ক্রমেই কোন এক অজানার সন্ধানে চলছে অনিন্দ্যসুন্দর টের পেলেন  দিব্যসুন্দর চোদ্দ বছর বয়সেই। তড়িঘড়ি তিনি ছেলেকে নিয়ে গিয়ে ভর্তি করালেন বৃটেনের এক খ্যাতনামা শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে। কিন্তু দিব্যর সেখানে মন টিকছিল না। তিনি দেশে ফিরতে চাইছিলেন। শিক্ষা সমাপ্ত হতেই অনিন্দ্যসুন্দর ব্যবস্থা করলেন দিব্যসুন্দরের দেশে ফেরার। এবং পারিবারিক রীতি-রেওয়াজ মেনে দিব্যসুন্দরকে অভিষিক্ত করলেন সেনানায়কের পদে। দায়িত্ব অর্পণ করলেন পররাষ্ট্র নীতির।

প্রাথমিক ভাবে এই দায়িত্ব গ্রহণ করতে অস্বীকার করেছিলেন দিব্যসুন্দর। তারপর কি মনে করে গ্রহণ করলেন পদ। কিন্তু দায়িত্বভার গ্রহণ করে থেকে মনোমালিন্য প্রকট হল তার অগ্রজের সঙ্গে। যদিও তার স্বভাবগত অভিজাত্যে সে বিরোধের বহিঃপ্রকাশ কখনো ঘটালেন না দিব্যসুন্দর।

দিব্যসুন্দরকে সেনাপ্রধানের দায়িত্ব অর্পণ করে অনিন্দ্যসুন্দর প্রজ্ঞাসুন্দরের রাজ্যাভিষেকের ব্যবস্থা করলেন। প্রজ্ঞাসুন্দর তখন চল্লিশ উর্দ্ধ পরিণত বয়স্ক মানুষ। সতেরো বছরের ছোট অনুজের আবেগ মথিত সিদ্ধান্ত গ্রহণের জন্য একেবারেই প্রস্তুত নন। যদিও শিক্ষায়-দীক্ষায় দিব্য ছিলেন প্রজ্ঞাসুন্দরের থেকে অনেক এগিয়ে, হয়ত বিচক্ষণতায়ও। একটি পর্বত সঙ্কুল দেশের দুর্বল অর্থনীতিকে চাঙ্গা করার জন্য সর্বপ্রথম  প্রয়োজন তার বৈদেশিক নীতিতে পরিবর্তন। সীমান্ত সুরক্ষা নীতিতে অর্থ বরাদ্দ কমানো এবং মধ্যযুগীয় অগ্রাসন নীতির পরিবর্তন। বিদেশী শিক্ষায় শিক্ষিত দিব্যর চোখে যা সহজেই ধরা পরেছিল মধ্যযুগীয় ধ্যান-ধারণার আবিষ্ট ধর্মীয় সংস্কারে আবদ্ধ প্রজ্ঞাসুন্দরের কাছে তা ছিল একেবারেই রাষ্ট্রনীতি বিরোধী।

দিব্যসুন্দর বুঝেছিলেন আজকের যুগে দাঁড়িয়ে রাজতন্ত্র টিকিয়ে রাখা কোন দেশের পক্ষে  বিশদৃশ তো বটেই এমন কি অসম্ভবও। তাই নিজের ক্ষমতাকে কায়েম রাখতে গেলেও সমাজতন্ত্রের ধাঁচা অনুসরণ করতে হবে। ক্ষুদ্র প্রতিবেশীকে আক্রমন করলে সবল প্রতিবেশীর সঙ্গে সে হাত মিলাবে। দিব্য বলেছিল দাদা রাজতন্ত্র ব্যাপারটাই অশ্লীল, দেশের আশি শতাংশ মানুষকে দারিদ্র্যসীমার নীচে রেখে নিজেকে সমগ্র ক্ষমতার নিয়ন্ত্রক হিসাবে দেশবাসীর কাছে প্রতিপন্ন করতে তোমার কুন্ঠা বোধ হয় না? আর তা যদি না হয় তাও একথা তো মানবে রাজ ধর্মের প্রধান শর্তই হলো প্রজাপালন। অনুজের ঔদ্ধত্যে থরথর করে কাঁপতেন প্রজ্ঞাসুন্দর। কিন্তু পিতার বিরাগ ভাজন হবার ভয়ে চুপ করে থাকতেন। কারণ ভাতৃ বিরোধ পছন্দ করতেন না অনিন্দ্যসুন্দর। আর তখনো ক্ষমতার সূত্রটি বাঁধা ছিল ওঁরই হাতে।

ধর্মের জিগির তুলে জনমত গড়ে তোলা অনেক সহজ। আর প্রজ্ঞাসুন্দর সেই কাজেই নামলেন। বুঝলেন দেশাত্মবোধের সূত্র ধরেই পৌঁছাতে হবে পিতার কাছে। তাহলেই একমাত্র কোন ঠাসা করা যাবে দিব্যসুন্দর কে। এই কাজে হাত মিলালেন ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানের প্রধানেরা। ধর্ম রক্ষার নামে অধর্মের পথকে বড় করে তুললেন প্রজ্ঞাসুন্দর। নিজের দুই ছেলে ব্রজধ্বজ আর কুশধ্বজ কে বৃটেনে পড়তে পাঠিয়ে দিয়ে দেশের চারদিকে বাজিয়ে দিলেন রনদুন্দুভি। ধর্মযুদ্ধের নামে দুর্বল প্রতিবেশীর ওপর আক্রমন শানানোর প্রস্তুতি নিলেন তিনি।

জনমত এইভাবে গঠন করেছিলেন প্রজ্ঞাসুন্দর যে চুপ করে দেখা ছাড়া দিব্যসুন্দরের কিচ্ছু করার ছিল না। তিনি শুধু অস্থিরভাবে প্রাসাদের বারান্দায় পায়চারী করতেন সারারাত। তিনি যে সেনানায়ক। রাজ নির্দেশে  তারই হাত দিয়ে সংঘটিত হবে যে নির্মম হত্যালীলা! অন্যায় অনাচার। যুদ্ধের বাইরে যে ভয়ানক যুদ্ধের কথা আজ ঘোষণা করছেন প্রজ্ঞাসুন্দর তাতে বিবমিষা হচ্ছে দিব্যসুন্দরের। পৃথিবীর অন্যতম প্রাচীন ধর্মের উপাশক তারা। অথচ তাদেরই পদতলে পিষ্ট হবে আজ মানবতার ধর্ম। তোলপার করে দিবসুন্দরের মন। তিনি রাজপুত্র, রাজভ্রাতা। স্বধর্ম পালনই তার কর্তব্য।

কিন্তু তিনি যে হেরে যাচ্ছেন তার আপন ধর্মের কাছে। নিজের কাছে পরাজিত একজন মানুষ অপর রাজ্য জয় করবেন কেমন করে? আর জয়ের সংজ্ঞা কি? ক্ষমতা কি কখনো প্রকৃত জয় আনতে পারে? বিজিত ব্যক্তি শুধু দম বন্ধ করে মনে মনে অপেক্ষা করে সুযোগের।

তবুও শেষ পর্যন্ত তাঁর দেশ আক্রমণ শানালো পার্শ্ববর্তী ক্ষুদ্র সেই দেশের ওপর। স্থলযুদ্ধের দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি চেয়ে নিলেন দিব্যসুন্দর।সমগ্র কর্মকাণ্ড থেকেই ছুটি চাইতে পারতেন তিনি কিন্তু তিনি বুঝলেন তিনি অব্যাহতি নিলে উন্মত্ত হয়ে উঠবে সেনাবাহিনী। বিশেষ করে যুদ্ধনীতি বলে যুদ্ধ বহির্ভূত যে নীতি নির্ধারণ করেছেন প্রজ্ঞাসুন্দর তা যে কোন উপায়ে ঠেকাতে হবে তাকে। এ ব্যাপারে তিনি সাহায্য চাইতে গিয়েছিলেন পিতা অনিন্দ্যসুন্দরের কাছে কিন্তু ফল হয়নি। তিনি মিন মিন করে বলেছিলেন প্রজ্ঞাকে ঠেকানো কি আমার কাজ! দিব্য এসব চালাকি বোঝেন। অনিন্দ্যসুন্দর নিজেই চান রাজ্যের প্রসার, সেই পুরনো রাজ রোগ। কিন্তু দিব্যর কাছে নিজেকে এমন ভাবে উপস্থাপন করলেন যেন তিনি প্রজ্ঞার শক্তির কাছে পরাস্ত হয়ে মেনে নিতে বাধ্য হচ্ছেন এই সব অসৎ উপায়। আসলে কিন্তু ব্যাপারটা তা নয় চাইলে তিনি এব্যাপারে দিব্যকে অধিক ক্ষমতা প্রয়োগের অধিকার দিয়ে ঘটনা আটকাতেই পারতেন। আসলে অনিন্দ্যসুন্দর নিজের কাছেও বুঝ দিতে চাইছিলেন। ভাবতে চাইছিলেন হয়ত না না আমার নিজের কিছু করার ছিল না, আমাকে বাধ্য হয়েই মেনে নিতে হয়েছে এই সব অক্ষত্রিয়  সুলভ ব্যাপার স্যাপার। দিব্য বুঝে গেলেন যা করতে হবে তা নিজ দায়িত্বেই। এবং তা যদি তার পিতা বা  ভ্রাতা রাজদ্রোহের সামিল মনে করে তাকে বন্দী করেন তার জন্যও তাকে মনে মনে প্রস্তুত থাকতে হবে।

বন্দীত্বে তার কোন সমস্যা ছিল না। রাজতন্ত্রে বন্দী থাকার চেয়ে বেশি বন্দী জীবন তার আর কিছুতেই লাগছিল না। যেন হাঁসফাঁস লাগছিল তার। সেনা বাহিনী ভেঙে গুঁড়িয়ে দিল সীমান্তের বেড়া। প্রতিবেশী  দেশের দূর্গ প্রাসাদের  দখল নিতে এগিয়ে চললো মার্চ করে। এদিকে একদল দিল জনপদ গুলোতে হানা। ছোট্ট দেশ। কতটুকুই বা আর জনসংখ্যা। প্রজ্ঞাসুন্দর নির্দেশ দিয়েছিলেন সদ্যজাত থেকে ঋতুমতী সকল কন্যাজাতিকে বন্দী করে আনতে, আগত দিনগুলিতে যাতে কোনো বিদ্রোহী জন্ম নিতে না পারে। এই ভাবেই সমগ্র জাতিকে বিলুপ্ত করে দেবেন প্রজ্ঞাসুন্দর। বুদ্ধি বলেও যে তিনি ভ্রাতা দিব্যসুন্দরের থেকে অনেক এগিয়ে একথা প্রমান করতে পারবেন তিনি পিতা অনিন্দ্যসুন্দরের কাছে।

ঘটনা সংঘটিত হবার পর দিব্যসুন্দর হাত জোড় করে এসে দাঁড়ালেন পিতার কাছে। পিতৃদেব এবার আমায় অব্যাহতি দিন। রাজধর্ম পালনে আমি অসমর্থ। নিজ আদর্শ চ্যুত হয়ে আমি বেয়নেট তুলে ধরতে পারবো না আর্তের দিকে। নারী সুরক্ষাই যদি নিশ্চিত না করতে পারি, সে নিজ রাষ্ট্রই হোক কি পররাষ্ট্রের তবে ধিক্‌ সে পৌরুষের।

অনিন্দ্যসুন্দর বললেন, সমগ্র নারী জাতি না কোন বিশেষ নারী?

দিব্যসুন্দর বললেন,  সে প্রশ্নের উত্তর আমি আপনাকে দেবো না।

অনিন্দ্যসুন্দর বললেন, উত্তর তোমাকে দিতে হবে না। রাজারা যে প্রশ্ন অন্যকে করেন সে প্রশ্নের উত্তর আগেই তার জানা হয়ে যায়।

দিব্য মেরুদণ্ড সোজা করে দাঁড়িয়ে বললেন, তবে তারা প্রশ্ন করেন কেন?

স্বীকার করানোর জন্য।

দিব্যসুন্দর বললেন, সত্য যা তা সত্যই, স্বীকার করা না করায় কিছু এসে যায় না।

তবুও আমি সরাসরি শুনতে চাই তোমার কাছে।

আমি এর বেশি কিছু বলব না।

প্রয়োজনে তোমাকে বন্দী  করা হতে পারে।

জানি।

কিন্তু আমি তোমাকে বন্দী করতে চাই না।আমি চাই তুমি স্বধর্ম পালনে ব্রতী হও।তোমাকে আরো একটা কথা বলে সতর্ক করতে চাই, আমার শক্তি আর কতদিন, তারপরে কিন্তু পরিস্থিতি পুরো পাল্টে যাবে।

দিব্যসুন্দর বললেন, জানি তাও জানি। তবে এও জানি সত্য পাল্টাবে না।

তোমার ওসব দর্শন দিয়ে কি রাজনীতি চলে?

চলে বলেই আমার বিশ্বাস।

তুমি একদিন ভুল প্রমাণিত হবে।

দেখা যাক। আপাতত আমি অব্যাহতি চাই আপনার রাজতন্ত্র থেকে। শুধু যদি আপনার অনুমতি হয় আমি একটি মঠ মন্দির প্রতিষ্ঠা করতে চাই আপনার রাষ্ট্রের সীমানায়।

চোখে জল আসছিল অনিন্দ্যসুন্দরের। তার সবচেয়ে প্রিয় সন্তানটি গৃহত্যাগী হবে! তথাপি চোখের জল চেপে রেখে তিনি বললেন, এ ব্যাপারে অনুমোতি দিতে পারে একমাত্র প্রজ্ঞাসুন্দর। আমি ওর সঙ্গে কথা বলব।

পিতার সব কথা শুনে ইতিহাসের পাতা অনুসরণ করে গলা ফাটিয়ে হাসলেন প্রজ্ঞাসুন্দর, বললেন সন্ন্যাসী হবে সন্ন্যাসী? দিব্য কোনদিন বিদেশী ব্র্যান্ড ছাড়া ধূমপান করেছে? স্কচ ছাড়া মদ্যপান করেছে? হা হা হা দাও ওকে এক খন্ড জমি দিয়ে দাও। যদি বিশ্বমানের একটা মন্দির তৈরি করতে পারে আমার দেশেই বৈদেশিক মুদ্রার আমদানী হবে। নির্বিজ কথাকার।

তিন

ট্যাল্ক একটা নরম কাদা পাথর। নখ দিয়ে খুঁটলেই ওপর থেকে উঠে আসে পাউডারের মত। ট্যালকম্‌ পাউডার। এদিকের পার্বত্য অঞ্চলটি এই ট্যাল্ক পাথরে গঠিত। ধপ্‌ধপে সাদা নরম সেই পার্বত্য উপত্যকার মধ্যে দিয়ে নেমে এসেছে এক ক্ষীণ জলধারা। ক্ষয়িত প্রস্তর কণার সংমিশ্রণে দুধ সাদা তার রঙ। সেই নদী উপত্যকার পার্শ্ববর্তী অঞ্চলে মঠ তৈরির নিমিত্ত এক খন্ড

জমি পেলেন দিব্যসুন্দর। তিনি ঐ অঞ্চলের নাম দিলেন সুন্দর। ঐ নদীর নাম দিলেন শ্বেতা।

সেনাবাহিনীর ভয়ে ভীত সন্ত্রস্ত হয়ে যে সমস্ত উদ্বাস্তু পরিবার আশ্রয় নিয়েছিল পাহারের কোলে, তাদের জন্য তিনি গড়ে তুললেন কলোনী অঞ্চল। ব্যবস্থা করলেন বাসস্থানের, শিক্ষার। কিন্তু এত সব করলেন কি তিনি শুধু মাত্র ধর্মের টানে? হ্যাঁ তাই। যে যাকে ধরে রাখে সেই তার ধর্ম। দিব্যসুন্দরের সেই ধর্মের নাম শ্বেতা। স্রোতস্বিনী। সে এক মর্মদন্তু কাহিনি। রাজ পরিবারের  অন্দরে কত কাহিনি চাপা পড়ে যায় গোপন কুঠুরির অন্দরে।  সর্ব সমক্ষে তা উচ্চারণেরও অনুমোতি থাকে না। জ্যান্ত কবর দেবার মত ঘটনা আনারকলির ক্ষেত্রে ইতিহাস বিকৃত কল্প কথা বলে চালানোর চেষ্টা হলেও তা ছিল একসময় অতি সাধারণ প্রেক্ষাপট। অনার কিলিং। বংশ গৌরব রক্ষার্থে হত্যা সম্মানীয়, কোন সময়ই অপরাধ নয়। দন্ডদাতাই যেখানে সর্বোচ্চ ক্ষমতার উৎস, স্বঘোষিত ঈশ্বর, তার বিচার করবে কে!

দিব্যও সেদিন কোন প্রতিবাদ করে নি। শুধু শীতল বরফ ঠান্ডা চোখে সামনে দাঁড়িয়ে বলেছিলেন আমায় মুক্তি দিন মহারাজ, রাজ ধর্ম পালনে আমি ব্যর্থ। কি ছিল সেই কাহিনি তা আর দিব্যসুন্দর মনে রাখতে চান না। মনেও নেই হয়ত তার সেভাবে শুধু এক অবিশ্রান্ত ধাক্কা সুর তোলে কোন বাঁশিতে। তুমাহারা আ আ আ আ ইন্তেজার হ্যায়। পুকার লো। সব সময় যেন এক অশান্ত ঝড় আছড়ে পড়তে চায় নদী উপকূলে। বাই দ্যা পিপল, অফ দ্যা পিপল, ফর দ্যা পিপল। পথিক তুমি কি পথ হারাইয়াছ? নিজেকেই নিজে প্রশ্ন করেন দিব্য, তারপর নিজেই উত্তর খুঁজে নেন, না, না, না। প্রতি প্রাতে শ্বেতা নদীর জলে আচমন করে দিন শুরু করেন তিনি, শ্বেতা বন্দনায় করেন দিন অবসান। সারাদিনের ক্লান্তি মুছে যায় যেন কোন শীতল করতল স্পর্শে।

কত কাজ তার। ভোর বেলা দিগন্ত প্রসারিত শুভ্র পর্বতমালার মাঝখান দিয়ে যখন কুয়াশার আবরণ উন্মোচন করে উদিত হন ঊষা, তখন সূর্য বন্দনায় শুরু হয় তার দিন। মাত্র কয়েকটা মানুষ তাদের খাদ্য খাবারের ব্যবস্থা করতেই জেরবার হয়ে যান তিনি। পাহারের ধাপ কেটে ভুট্টার চাষ, রেশম  সুতোর ফোড় তুলে কার্পেটের বুনন, বাঁশ ও বেতের নানা বিধ সামগ্রী তৈরি, সেগুলো বাজার জাত করা। শিশু ও বয়স্ক শিক্ষার বিদ্যালয় চালানো। ছোট্ট এই অঞ্চলের মধ্যে দিয়ে তিনি পূর্ণ করেছেন যৌথ খামারে স্বপ্ন। এই অঞ্চলে দিব্যসুন্দর রাজা নন, ভগবান।

এই অঞ্চল নিয়ে মাথা ব্যথা নেই কারো, না প্রজ্ঞাসুন্দরের না অনিন্দ্যসুন্দরের। দুর্গম, অনুর্বর এক প্রত্যন্ত প্রদেশের কটা মানুষকে নিয়ে ভাবার অবকাশ তাদের নেই। শুধু ঐ অঞ্চল থেকে কোন মানুষের জনপদে প্রবেশ অধিকার নেই একমাত্র দিব্যসুন্দর ছাড়া। তবে কোনো সাধারণ মানুষেরও প্রবেশাধিকার নেই ঐ এলাকায়। শুধুমাত্র বিদেশি পর্যটক ঘন্টা খানেকের জন্য প্রবেশ করতে পারেন ঐ অঞ্চল পরিদর্শনের জন্য। অঞ্চলের প্রবেশ পথে সরকারের তরফ থেকে লাগানো হয়েছে চেক পোস্ট, বসানো হয়েছে পাহারা এবং  সংগ্রহ করা হচ্ছে শুল্ক। তবে ঐ দুর্গম পথ পেরিয়ে খুব একটা পর্যটক এদিকে আসেন না। এখানকার পরিবেশ এত শান্ত যে একমাত্র নদীর কলধ্বনি ছাড়া আর কোন শব্দ কানে আসে না। কেবল সকাল সন্ধ্যে মন্ত্র ঘণ্টাধ্বনি আর মৃদু প্রার্থনা সংগীত। এখানকার বাচ্চাগুলোও ছুটোছুটি করে খেলা করে, ভেড়ার পাল কিংবা পশমিনা ছাগলের দল ম্যা ম্যা করে ডেকে যায় তবে কিনা ঐ বৃহৎ পর্বত গাত্রে, শনশন হাওয়ার মধ্যে তা কেমন হারিয়ে যায়।

প্রায় প্রতি অপরাহ্ণে শ্বেতা নদীর তীরবর্তী কোন পাথরের ওপরে ধ্যানে বসেন দিব্য। বড় শান্তি পান মনে। নির্জন পর্বত গ্রাত্র থেকে ফিসফিস করে কথা বলে কে যেন তার সঙ্গে। বলে, কেন এত অস্থিরতা তোমার? কেন? আমি এক থাকব, এক। কি হবে আমার এই নশ্বর দেহটা বিলুপ্ত হয়ে গেছে তো? আমি কি তোমাকে রোজ আদর করি না বলো? কেউ না জানুক তুমি নিজে তো জানো। তুমি পারবে, ঠিক তুমি নিজের কাজ সম্পন্ন করতে পারবে। তার জন্য তোমার ছুটে বেড়ানোর দরকার নেই। সময় হলে সুযোগ তোমার কাছে আপনি চলে আসবে। আমার বুকে মাথা রাখো, শান্ত কর মন।

– কিন্তু তোমার বুকে মাথা রাখলে আমি যে আরও অশান্ত হয়ে উঠি।

– এই! তুমি না সন্ন্যাসী! পাজি।

– আমি কতদিন পাজিমি করিনি। তবে কি করে শান্ত হব বল? আমি যে তোমার ঢেউয়ের মধ্যে ঝাঁপিয়ে পড়তে চাই, জলকাদা মাখতে চাই সারা শরীরে। আমি না হতে পারলাম সন্ন্যাসী না সংসারী, আমি শুধু অস্থির হয়ে ছুটে বেড়াই। কেন ছুটে বেড়াই তুমি বোঝ না শ্বেতা। এখনো তুমি কেনো টেনে নিচ্ছ না তোমার কোলে, কেন ফেলে রেখেছ আমাকে এই পাথুরে উপকূলে! আমি যে আর পারছি না। আমায় মুক্তি দাও, মুক্তি দাও। যে আত্মা তার চলমান সংসার থেকে বিচ্যুত হয়ে গেছে কবেই তাকে কিসের জন্য ফেলে রেখেছ এই জলকাদায়? উত্তরও দিব্য নিজেই পান। ধ্যানস্ত দিব্য উপলব্ধি করেন তাঁর অনেক কাজ বাকী। মাইলস্‌ টু গো বিফোর আই স্লিপ, মাইলস টু গো বিফোর আই স্লিপ।

প্রজ্ঞাসুন্দর,গুলির বিনিময় হয় গুলিতে। অথচ গুলির বিনিময়ে তুমি পেয়েছিলে পুষ্প স্তবক। অর্ধাংশের বদলে পেয়েছিলে সমগ্র রাজত্ব। তাই নিয়ে কোন ক্ষোভ নেই দিব্যর শুধু কয়েকটা দৃশ্য যদি তাকে এমন তাড়া করে না বেড়াত! তিনি স্বেচ্ছায়ই ছেড়ে দিতেন সব। দিতেনই। বৈভবও তার আঁটো লাগাছিল বেশ কিছু দিন। বৈরাগ্য বহিরঙ্গে আসে অনেক পরে, তাকে তো অনেক  পারিপার্শ্ব  ডিঙ্গোতে হয়। কিন্তু বৈরাগ্য আগে আসে মনে। প্রস্তুতি শুরু হয় ভিতরে ভিতরে। শ্বেতা হয়তো তা নির্দিষ্ট করেছিল, দরজা খুলে দিয়ে বলেছিল তোমার পথ আলোর তোরণ পেরিয়ে। ভালোবাসা মানে নাকি বন্ধন! কিন্তু শ্বেতার ভালোবাসা যেন বৃহতের সন্ধান দিয়েছিল, উত্তোরণের পথ ধরে মুক্তি পথ দেখিয়েছিল দিব্যকে। দিয়েছিল প্রকৃত আনন্দের সন্ধান।

সদ্য ইংল্যান্ড থেকে দেশে ফিরেছেন দিব্য। পররাষ্ট্র নীতি নির্ধারণের দায়িত্ব পেয়ে পরিকল্পনা সাজাচ্ছেন নিজের মতো করে। ক্ষুদ্র প্রতিবেশী রাষ্ট্র প্রধানদের নিয়ে আয়োজন করলেন একটি সম্মেলনের। উদ্দেশ্য এই সমস্ত দেশগুলোর মিলিত শক্তি হিসাবে একটি সংস্থা গঠন করা। যাতে ঐ সংস্থার মাধ্যমে তারা তাদের সমস্যার কথা রাষ্ট্রপুঞ্জের কাছে খুব সহজেই তুলে ধরতে পারেন এবং প্রয়োজনীয় অর্থ সাহায্য চাইতে পারেন বিশ্ব ব্যাঙ্ক থেকে।

পাহাড়ের আনাচে কানাচে উপজাতি অধ্যুষিত ছোট ছোট রাষ্ট্র অনেক। মৈত্রী চুক্তির মাধ্যমে তাদের নিয়ে চলতে পারলে দেশের শক্তি বৃদ্ধি পাবে বলেই  দিব্যর বিশ্বাস। যদিও প্রজ্ঞার এসব একেবারেই না পছন্দ। সে চায় অধিগ্রহণ, অগ্রাসন। তার ধারনা মৈত্রীর পথ খুলে দিলে ঐসব উপজাতি সম্প্রদায় যে কোন সময় আক্রমণ শানাবে তাদেরই উদ্দেশ্যে। উপজাতি সম্প্রদায়ের মানুষ বেশির ভাগই দস্যু শ্রেণীর এবং বিশ্বাসঘাতক।

এই সম্মেলনকে কেন্দ্র করেই দুই ভাইয়ের মত বিরোধ উঠেছিলো  তুঙ্গে। বিশেষ করে ঐ উপজাতি সম্প্রদায় ভুক্ত মানুষ জনের সঙ্গে এক টেবিলে নৈশ ভোজের আয়োজন করার সিদ্ধান্তে প্রজ্ঞার নীল অভিজাত্য  যেন শিউরে উঠেছিল।

দিব্য শোনেন নি। নিজ সিদ্ধান্তে অবিচল থেকেছেন। যেহেতু    দায়িত্বভার অর্পণ করা হয়ে গিয়েছে তাই পুত্রের কাজের ওপর আর হস্তক্ষেপ করতে চান নি অনিন্দ্যসুন্দর। তিনি সমগ্র পরিস্থিতি বিবেচনা করে সময় মত লাগাম টেনে ধরবার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন।

ঐ সম্মেলনে যোগ দিতে এসেছিল তিতি। নিজেকে সে রাজকন্যা হিসেবে পরিচয় দিতে পারত কিন্তু দেয় নি। সে নিজের পরিচয় দিয়েছিল জন প্রতিনিধি হিসাবে। প্রথমটায় দিব্য তাকে অত আমল দেন নি। যদিও গুরুদেব রবীন্দ্রনাথের শিক্ষায় শিক্ষিত দিব্যসুন্দর শৈশব থেকেই শিখেছিল নারী পুরুষ নির্বিশেষে মানুষকে সম্মান করতে তথাপি একটা কিন্তু রয়েই গিয়েছিল। বিশেষ করে রাষ্ট্রনীতি নির্ধারন সংক্রান্ত আলোচনায় অত নরম সরম একটা মেয়ে ঠিক কি বলবে আন্দাজ করতে পারেন নি দিব্য। বরং দেখেই   যেটা মনে হয়েছিল তা হলো এই মাত্র কে যেন মেয়েটিকে কাদামাটি দিয়ে তৈরি করে উঠে গিয়েছে। এখনো শুকায় নি। ছুঁলেই যেন আঙ্গুলে নরম মাটি লেগে যাবে।

কিন্তু সে যখন বলতে উঠল টেবিলের চারপাশের সকল চক্ষুই স্থির হয়ে গিয়েছিল তার ওপরে। যেন স্রোতস্বিনী। নাগারে ঘন্টাখানেক সে পেশ করে গিয়েছিল তাঁর বক্তব্য। জানিয়েছিল তার সুচিন্তিত মতামত।  দিব্য তাকিয়েছিলেন। তাঁর চোখের মধ্যে দিয়ে মাথার মধ্যে দিয়ে ঘুরতে ঘুরতে পার হয়ে যাচ্ছিল কোন এক জ্যোতির্বলয়। তিনি উঠে দাঁড়িয়ে করতালিতে অভিনন্দিত করেছিলেন সেই কলস্বিনী মাটির কন্যাকে। বলেছিলেন আমিও ঠিক এই ভাবেই স্বপ্ন দেখতে চাই। স্বপ্নের মত স্বপ্ন। মেয়েটি জবাবে খুব ধীরে বলেছিল আমি স্বপ্নকে ছুঁয়ে দেখতে চাই। কিন্তু আবার এ ও ভাবি তাকে কি সত্যি ছোঁয়া যায়? ছোঁয়া যাবে? দেখা যাক্‌।

উঠে পড়েছিলেন দিব্য। বলেছিলেন চলুন আপনারা সব। সামান্য কিছু আপ্যায়নের ব্যবস্থা করা হয়েছে আপনাদের জন্য। দয়া করে তা গ্রহণ করে আপনারা আমাদের বাধিত করুন। ভোজ সভায় আমার পিতা অনিন্দ্যসুন্দর এবং ভ্রাতা প্রজ্ঞাসুন্দরও উপস্থিত থাকবেন। আশাকরি আনন্দময় হয়ে উঠবে আমাদের সম্মেলন।

ভোজ সভায় সকলে এলেও ঐ মাটির কন্যাকে কিন্তু দেখা গেল না। দিব্য চোখ দিয়ে ইতি উতি খুঁজে দূত পাঠালেন অতিথিশালায়। দূত খবর আনলেন রাজকন্যা সামান্য ক্লান্ত বোধ করছেন, যদি অতিথিশালায় ওর ভোজনের ব্যবস্থা করা হয় তবে প্রীতি বোধ করবেন। দিব্যর নির্দেশে অতিথিশালায় ভোজনের ব্যবস্থা করা হলো রাজকন্যার। কিন্তু ভোজ সভা জমল না। সুর তাল কাটা সুরসভার মত তা অল্প কিছুক্ষণের মধ্যেই সমাপ্ত হলো। অনিন্দ্যসুন্দর ক্ষণিক সময়ের জন্য এসে অভ্যাগতদের সঙ্গে সামান্য সৌজন্য বিনিময় করে ব্যস্ততার অজুহাতে সভা ত্যাগ করলেন। প্রজ্ঞাসুন্দর ভোজসভায় উপস্থিতই হলেন না, অভ্যাগত অতিথিরা আহার গ্রহণ করে যে যার মত কক্ষ পরিত্যাগ করলেন। সন্ধ্যা চা পানের আসরে ফের মিলিত হবার আশা প্রকাশ করে দিব্যসুন্দরও সভা পরিত্যাগ করলেন। বিশ্রামের উদ্দেশ্যে সকল অভ্যাগতই চলে গেলেন নিদৃষ্ট অতিথিশালায়।

দারু নির্মিত পুরাতন বসন্ত বিহার নির্দিষ্ট করা হয়েছিল অতিথিদের বিশ্রামের জন্য যা আধুনিক রাজপ্রসাদ থেকে বেশ কিছুটা দূরে। দিব্য সামান্য বিশ্রাম সেরে রওনা হলেন অতিথিশালা পরিদর্শনে। স্বচ্ছন্দ বোধ করেছিলেন তো তার আমন্ত্রিত অতিথিরা! কোন ত্রুটি নেই তো ব্যবস্থাপনায়? সমস্ত খোঁজ খবর নেবার পর পায়ে পায়ে তিনি গিয়ে দাঁড়ালেন নিদৃষ্ট কক্ষের সামনে।    দ্বিধাভরে দুবার টোকা দিলেন দরজায়। দরজা খুলে তিতির কন্যা দিব্যকে আমন্ত্রণ জানালেন নিজ কক্ষে, আসুন। তারপর হাত দিয়ে সোফা দেখিয়ে বললেন, বসুন। আসন গ্রহণ করুন রাজকুমার।

দিব্য সোফায় গা এলিয়ে দিতে দিতে প্রশ্ন করলেন এখন কেমন বোধ করছেন  মাদমোলয়েজ?

নিজ হাতে জার থেকে কাঁচের পাত্রে আপেলের নির্যাস ঢেলে দিতে দিতে কন্যা জবাব দিলেন, আপন দেশে কুমারের আপ্যায়নের ত্রুটি হবে না, এ কথা দিতে পারি তবে এখানে তো ঐ কী যেন বলে গঙ্গা জলেই গঙ্গা পুজো কিনা। তাই সামান্য পানীয় গ্রহণ করুন। হ্যাঁ, তিতি, আমার নাম তিথি। তথ্য বিস্মৃতি হয়েছে বোধহয়।

পানপাত্র হাতে তুলে নিয়ে দিব্য বললেন, উঁহু, স্রোতস্বিনী।

হুম! ভুরু উঠিয়ে কন্যা জবাব দিলেন, অধিগ্রহণের আগেই অধিগ্রহণ! তা মন্দ নয়, নামকরণ পছন্দ হয়েছে অধিকৃতের।

দিব্য বললেন, এখন কিছুটা সুস্থ বোধ করছেন তো? স্রোতস্বিনী জবাব দিলেন, খুব একটা কিছু তো হয় নি আমার। আসলে ভোজসভাটা এড়াতে চাইছিলাম আমি। আপনার ভ্রাতা প্রজ্ঞাসুন্দরের সীমান্তরক্ষী বাহিনী বারংবার পর্যুদস্ত করেছে আমাদের রাষ্ট্রকে। আপনাদের মৈত্রী সম্মেলনে যোগ দিতে আসার ব্যাপারে কারোরই মত ছিল না আমাদের রাষ্ট্রে। সকলের মত অমান্য করে তথাপি আমি এসেছি। কেন জানেন? শুধু আপনার জন্য। পাহাড়ের আনাচে কানাচে সমস্ত উপজাতি গোষ্ঠীর মধ্যে আপনার নাম মুখে মুখে ফেরে। আমাদের তো এতদিন কেউ মানুষ বলে মনে করেনি। রাষ্ট্র টাষ্ট্র সেসব তো আমরা মনে করি। আপনারাতো সেইসব অঞ্চলগুলোকে আমাদের জবরদস্তি অধিকৃত শিবির এলাকা বলেই চিহ্নিত করে এসেছেন। আমাদের শিক্ষার আলো বহির্ভূত বর্বর দস্যু মনোভাবাপন্ন জাতি গোষ্ঠী হিসেবে দেখতেই এতদিন অভ্যস্ত ছিল উচ্চবর্ণের রাজন্যবর্গ। অথচ রাজতন্ত্র যে আসলে বর্ববরচিত সেই বোধটিই তাদের ছিল না। আজ যৌথ খামারের স্বপ্ন নিয়ে প্রথম বিশ্ব দ্বিধাভক্ত অথচ যৌথ খামার পদ্ধতি আমাদের জাতিগোষ্ঠীর মধ্যে কবে থেকেই প্রচলিত। আমার বাবা প্রথম আমাকে বিদেশে পাঠান শিক্ষার উদ্দেশ্যে। দেশে ফিরে এসে থেকেই আমি চেষ্টা করেছি উপজাতি সম্প্রদায়গুলোকে ঐক্যবদ্ধ করার। তবে আমাদের সামর্থ তো অতি সামান্য। আগ্রাসনের লোলুপ হাত থেকে নিজেদের বাঁচাতে বারবার আমরা ব্যর্থ হয়েছি, উপঢৌকন, বিশ্বাসঘাতকতা নানাবিধ অসৎ পথ গ্রহণ করেছেন উচ্চবর্ণের রাজন্যবর্গ। তার মধ্যে আপনিই যেন এক উজ্জ্বল আলো। স্বপ্নকে এত কাছ থেকে তো কখনো দেখিনি আমরা।

দিব্য যেন অত কথা সব ঠিকঠাক শুনতেও পাচ্ছিল না, তার মাথার মধ্যে একটা গান শুধু গুনগুন করছিল, তোমার দ্বারে কেন আসি ভুলেই যে যাই, কত কী চাই।

রাজকন্যা বললেন, আজ যেন মনে হচ্ছে স্বপ্ন শুধু দেখার নয় তা সত্যিও  হয়, তাকে ছোঁয়াও যায়। এই কথাতে দিব্যর মনে হলো এক হরকা বানে তার কোমর পর্যন্ত ডুবে গিয়েছে এই মুহূর্তে সন্তরন শুরু না করলে তিনি ভেসে যাবেন। তিনি রাজকন্যার দিকে হাতটা বাড়িয়ে দিয়ে বললেন অপরাহ্ণ আগত। পাহাড়ে পাহাড়ে শুরু হয়েছে আলোর খেলা। যদি মহামান্যের আপত্তি না থাকে তবে নদীর তীর থেকে একটু বেরিয়ে আসা যাক?

দিব্যর হাতের ওপরে নরম শ্বেতশুভ্র হাতখানি রেখে সে বলল, বেশ যাওয়া যাক। তবে সাবধান, কুমার যে নিজ রাজ্যেই কতটা নিরাপদ সে ব্যাপারে আমার যথেষ্ট সন্দেহ আছে।

দিব্য কোন কথা না বলে শুধু তাকালেন, মনে হলো যেন এক অপার ঐশ্বর্য তার হাতের মুঠোয় আর তিনি যেন পৃথিবীর অধীশ্বর।

ওঁরা গিয়ে দাঁড়ালেন এক উন্মুক্ত প্রান্তরে। গভীর খাদের নীচে কলস্বিনী নদী, সামনে প্রসারিত শুভ্র গিরিশৃঙ্গ। কেউ কোন কথা বললেন না। চুপ করে দাঁড়িয়ে রইলেন। শুধু নিভৃতে দুজনের হাতের মুঠির মধ্যে ধরা রইল দুজনের হাত। যেন পানপাতা আর পট্টবস্ত্রের আড়ালে পূর্ণ কলসে প্রতিস্থাপিত হয়েছিল ওদের করযুগল। বাতাসে ধ্বনিত হয়েছিল বেদ মন্ত্র। অনুষ্টুপ ছন্দ। প্রজাপতি ঋষি। যদিদং হৃদয়ং মম, তদস্তু হৃদয়ং তব।

চার

হিস্ট্রি রিপিট ইটসেল্ফ। অদ্ভুত, এই ভাবে সত্যি কথাটা! ঘটনাটা যখন প্রথম শুনেছিলেন, দিব্যসুন্দর কেঁপে উঠেছিলেন। কারন তিনি তার বংশজাতদের চেনেন। চেনেন রাজ রক্তের অহমিকা, চেনেন ধর্মান্ধতা, চেনেন ঔদ্ধত্ত্য। চেনেন নৃশঃসতা। তথাপি তিনি প্রশ্রয় না দিয়ে পারেন নি তার ভাতস্পুত্র কে, ভালোবাসার জন্য সর্বত্যাগী হওয়া, একি কম বড় কথা! পায় কি সবাই অমন নিরাশক্ত ভালবাসার সন্ধান ! কিন্তু দিব্য জানতেন কুশধব্বজ দিব্যর সাহায্য চায়। কিন্তু দিব্য যেকোন বন্ধন থেকে মুক্তি চান। স্নেহের বন্ধনে নতুন করে তিনি জড়াতে চান না। চান না  কুশধব্বজ তার মত ছুটে বেড়াক পথে প্রান্তরে। ছেলেটা যে ঘর বাঁধার স্বপ্ন দেখে। ওকে তার মত সর্বত্যাগী সন্ন্যাসী কি বা সহায়তা করতে পারে?

কুশধব্বজ বোঝে না। বার বার তার কাছে আসে। এই তো কিছুদিন আগেও এসেছিল। বলল, তাত, ধর্ম কি তা না জেনে আমরা কি সারাজীবন কূপমন্ডুপের মত রাজত্ব চালাব? তুমি সংসার ত্যাগ করে সন্ন্যাসী হলে, যে কাজ তুমি শুরু করেছিলে তা তো শেষ হলো না। রাজতন্ত্রের অবসান ঘটানোর সময় এসেছে। দেশের সম্পদ, ক্ষমতা কোন একটি বংশের কুক্ষিগত হয়ে থাকবে এ হতে পারে না। কোন ভাবে কি গণ ভোটের আয়োজন করা যায় না? দিব্য স্বস্নেহে কুশধব্বজ মাথায় হাত রেখে বললেন, এইসব কথা তুমি প্রকাশ্যে বলতে যেও না পুত্র, অনর্থ ঘটবে। কুশধব্বজ উদ্ধত গ্রীবা তুলে বলল, কেন, কেন বলব না তাত?  তাহলে তো কোনদিনই পরিবর্তন আসবে না।

শঙ্কিত হয়ে দিব্য বললেন, তোমার পিতা কোনদিন পরিবর্তন মানতে চান না।

– না চাইলে জোর করে মানাতে হবে। তোমার কবিগুরু বলেন নি? বাধা দিলে বাধবে লড়াই। দিব্য ভুরু কুঁচকে কুশধব্বজর দিকে তাকিয়ে বললেন, সত্যিই লড়াই করতে চাও পুত্র? তবে অসম শক্তি নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ে কোন লাভ নেই। বুদ্ধি মাফিক পরিকল্পনা সাজাতে হবে। সম্মুখ সমরে জিতবার মত শক্তি আমাদের নেই।

ধবক্‌ ধবক্‌ করে জ্বলছিল কুশধব্বজ। তার রাগের কারন অন্য সেকথা জানেন দিব্য।  কুশধব্বজ বলল, যথার্থ। আজ থেকে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠাই আমার একমাত্র লক্ষ্য, তার জন্য যে লড়াই লড়তে হবে লড়ব। বেঁচে আর আমি আছি কই বল? ওরা মরিনাকে মেরে দেবে বলে শাসিয়েছে। একথা মারিনাকে আমি জানতে দিইনি। আমি মারিনাকে ভুলে যাবার ভান করছি। মারিনার একমাত্র দোষ ও অন্য ধর্মে দীক্ষিত। ও একজন সাধারন নৃত্যশিল্পী। ওরা মারিনাকে বেশ্যা বলেছে তাত। এর পরেও আমি বেঁচে আছি?

শান্ত! শান্ত হও পুত্র। দিব্য কুশধব্বজর হাত চেপে ধরেন। তারপর বলেন ক্ষমতায় বদল আনতে গেলে এই মুহূর্তে বন্দুকের নলই কিন্তু একমাত্র পথ। কিন্তু বিনা রক্তপাতে তা ঘটানো সম্ভব কিনা সেটাই একমাত্র চিন্তার বিষয়। ক্ষমতা দখল ছাড়া এই মুহূর্তে গণ ভোট কিছুতেই সম্ভব নয়।

অস্থির হয়ো না পুত্র। যুদ্ধের ময়দানে কাউকেই সম্পূর্ণ বিশ্বাস করো না। যাকে পাওয়ার জন্য লড়াই, লড়াই করতে গিয়ে তাকেই যেন হারিয়ে বসো না। অতি সাবধানে এগোতে হবে পথ। যে ভুল আমি যৌবনে করেছি, সেভুল তুমি আর করো না।

তারপর এক দীর্ঘ আলোচনায় শামিল হলেন কাকা ভাতুষ্পুত্র দুইজনেই।

কুশধব্বজকে পথে খানিক এগিয়ে দিয়ে দিব্য দীর্ঘ ঢাল বেয়ে নেমে এসে বসলেন নদীর পারে একটি পাথরে। পা দুটি জলে ডুবালেন আলগোছে, শীতল জলের স্পর্শে টের পেলেন সে এসেছে। টের পেলেন কাঁধের ওপর পড়ছে তার গরম নিঃশ্বাস। পিছন থেকে দুহাত দিয়ে সে দিব্যর কোমর জড়িয়ে ধরে থতুনি রেখেছে কাঁধের ওপরে। দিব্য ফিসফিস করে বললেন, আর কতদিন কষ্ট দেবে আমাকে? আর কতদিন এমন পালিয়ে পালিয়ে বেড়াবে?

সে এসে বসল দিব্যর কোলের কাছে, কাঁধে মাথা রেখে বলল বেশ আর পালিয়ে যাব না, তবে একটা গান শোনাও।

দিব্য গুনগুন করে গাইছিল সেই গানটা যে গানটা আনমনে একা একা সে রাতের বেলা গায়, এবার আমায় ডাকলে দূরে। সাগর পারের গোপন পুরে। এবার আমায় ডাকলে দূরে। কখন যেন তার চোখের কোন দিয়ে জল গড়িয়ে নামছিল। সে চোখ বুজে গাইছিল। তার কাছে ধ্যান মানে সঙ্গীত। অন্য কোন মন্ত্র উচ্চারণ সে জানে না।

ওহ! প্রায় প্রতি রাতে আর্ত চিৎকারে ঘুম ভেঙে যায় তার। চোখের সামনে বিভৎস দৃশ্য। তিনি যেন প্রানপণ দৌড়াতে শুরু করেন বন জঙ্গল গিরিখাত পেরিয়ে, পালাতে চান, পালাতে চান সেই অসহনীয় সত্যির থেকে।  দৌড়াতে দৌড়াতে কখনো এসে দাঁড়ান কোনো পাহাড়ি গ্রামের পথে। পথ ধরে পার হয়ে যায় ভেড়ার পাল কিম্বা বৃহৎ পশমিনা ছাগল। টুংটাং ঘণ্টা ধ্বনি গীতিময় করে তোলে ঐ নির্জন প্রান্তর। রাখাল বালক উজ্জ্বল এক মুখ হেসে বলে আমার সঙ্গে যাবে? আজ তোমায় একটা দারুণ গান শোনাব। যাবে? চোখের সামনে থেকে মুছে যায় রক্ত। অপূর্ব শান্তি প্রবেশ করে দিব্য সুন্দরের অন্তরে। যেন শান্ত হয়ে আসে চারপাশ। পর্বতমালার কোল ঘেঁষে উদিত হন সূর্যদেব, দিব্য উদাত্ত কণ্ঠে গান, কখন দিলে পরায়ে স্বপনে বরনমালা। ব্যথার মালা। সুর গড়িয়ে গড়িয়ে বয়ে যায় সহস্র ধারায়। আর সেই জলের ধাক্কায় গড়ানো নুড়ি পাথর পলির নিচে চাপা পড়ে যায় সেই সত্য। হ্যাঁ হ্যাঁ  শ্বেতাকে মেরে ফেলেছিল ওরা। আর মেরে ফেলেছিলে দিব্যরই সামনে।

নৈশভোজের টেবিলে পিতা অনিন্দ্যসুন্দরের সামনেই প্রথম কথাটা পেশ  করেছিলেন দিব্যসুন্দর। বলেছিলেন তিতির উপজাতির রাজকন্যা তিতিকে  আমি বিয়ে করতে চাই।

এ কথা শোনা মাত্র বাঘের মত লাফিয়ে উঠেছিলেন বৃদ্ধ রাজা অনিন্দ্যসুন্দর, অসম্ভব।

একটুও না ঘাবড়ে দিব্যসুন্দর বলেছিলেন কিন্তু গন্ধর্ব মতে আমাদের বিবাহ সম্পন্ন হয়েছে।

প্রজ্ঞাসুন্দর কোমরে হাত ঠেকিয়েছিলেন। কোমরে তখন রাত্রিবাসের বন্ধনী ছাড়া যদিও কিছুই ছিল না কিন্তু ওখানে যে আসি না হলেও বারুদ ভর্তি আগ্নেয় অস্ত্র উসখুস করে প্রজ্ঞাসুন্দরের শরীরী ভাষা তার ইঙ্গিত দিয়েছিল। অনিন্দ্যসুন্দর বলেছিলেন এতদিন আমি তোমার সব আব্দার নীরবে সহ্য করেছি, তুমি আমার কনিষ্ঠ সন্তান, শৈশবে মাতৃহারা হয়েছ। কিঞ্চিৎ দুর্বলতা ছিল আমার তোমার প্রতি। বর্বর উপজাতিদের নিয়ে সংগঠন করতে চেয়েছ তাতেই রাজি হয়েছি। কিন্তু তাই বলে রাজরক্ত নষ্ট হতে দিতে পারব না। এ তো ধর্মত্যাগের সামিল। তোমার এ প্রস্তাব মেনে নিলে রাজ্যে প্রজাবিদ্রোহ ঘটবে।

দিব্য বললেন, কোনদিন প্রজাদের মতামত আপনারা কি শুনে দেখেছেন? সব সময় তো নিজের ইচ্ছা অনিচ্ছা প্রজাদের উপর চাপিয়ে দিয়েছেন।

প্রজ্ঞাসুন্দর বললেন, এতদিন পরে তোমার কাছ থেকে আমরা রাজনীতি শিখব না নিশ্চয়ই!

দিব্যসুন্দর বললেন, নিশ্চয়ই নয়। কারণ শিখবার মানসিকতা সকলের থাকে না। তবে রাজকন্যা তিতিকে বিবাহ করতে চাওয়ার সঙ্গে রাজনীতির কোনো সম্পর্ক নেই। তিতির উপজাতির সঙ্গে বন্ধুতা আমাদের স্থাপিত হয়েছে। এবং শুধু তিতির উপজাতিই কেন, মহারাজ চাইলে সমস্ত উপজাতি ঐক্যবদ্ধ শক্তি হিসাবে মহারাজের পাশে দাঁড়াতে পারে এই কাজটুকু আমি করতে পেরেছি।

প্রজ্ঞাসুন্দর বলেছিলেন, উপজাতিদের সাহায্য নিয়ে আমাদের শক্তি বৃদ্ধি করার মতন অবস্থা এখনো আসেনি। বৃহৎ প্রতিবেশী রাষ্ট্রের সঙ্গে আমাদের যে শুধু সুসম্পর্ক তাই নয় তাদের সঙ্গে আমাদের বাণিজ্যিক চুক্তিও স্বাক্ষরিত হয়েছে। আসলে তিতির রাজকন্যাকে বিবাহের অভিসন্ধিতেই তোমার এইসব উপজাতি সম্মেলন, উপজাতি চুক্তি স্বাক্ষরের মত নাটক ছিল তা আর আমাদের জানতে বাকি নেই। আর গান্ধর্ব বিবাহ? ও বিবাহের না আছে কোন স্বীকৃতি না আছে কোন মর্যাদা। জাস্ট  ইগনোর ইট। ভুলে যাও। তুমি কি জানো তিতিররা পলিগ্যামাস? বহুগামী। তোমার আগে ঐ রঙ্গিনী দেখো  গে আরও হাজার জনের সঙ্গ উপভোগ করেছে।

চেয়ার ঠেলে উঠে পড়ে দিব্য বললেন, ইউ জাষ্ট সাট ইয়োর মাউথ।

প্রজ্ঞাসুন্দর বললেন, ইউ জাষ্ট স্টপ ফাকিং উইথ দ্যা বিচ।

দিব্যসুন্দর বললেন, আইউইল। বিকজ বীচ ইজ দ্য লাস্ট আইডেন্টিটি অব এভরি হিউম্যান বিয়িং। তারপর বেসিনে হাত ধুয়ে তোয়ালেতে হাত মুছতে মুছতে বললেন, শাস্ত্রের ধব্জা ধরতে গেলে শাস্ত্রটাও একটু ভালো করে পড়তে হয় দাদা। গ্রীক মাইথেলজিতে মিউজ বলে একজন দেবী আছেন, তিতি আমার সেই প্রেরণার দেবী, মিউজ। তোমাদের মানা না মানার ওপর তো আমার সিদ্ধান্ত বদল হবে না। তোমরা মানলে রাজ সমারোহে বিবাহ সম্পন্ন হতো,  না মানলে আমারা আইনগত সাহায্য নেব।

তাই নাকি! চোখ তুলেছিলেন প্রজ্ঞাসুন্দর।

অনিন্দ্যসুন্দর বলেছিল, এ সিদ্ধান্ত নিলে তোমাকে রাজ্যে থাকার অধিকার হারাতে হবে।

দিব্য বলেছিলেন, তাতে আমার বিন্দুমাত্র আপত্তি নেই।

অনিন্দ্যসুন্দর বলেছিলেন, তুমি কি খুব নিশ্চিত যে ওরা তোমার মৈত্রী চুক্তিকে গুরুত্ব দিয়েছে? এটা কোন  ফাঁদ নয় তো? আমার কাছে কিন্তু খবর আছে ওরা যে কোন সময় সীমান্তে আক্রমণ করতে পারে।

দিব্যসুন্দর বললেন, তথ্যসূত্র নিশ্চয়ই মহারাজের সেনা। আপনি নিশ্চিত থাকুন এ ঘটনা কখনোই সম্পন্ন হবে না। সীমান্ত রক্ষার ভার যখন আপনি আমার ওপর ন্যাস্ত করেছেন তবে এ ব্যাপারে আপনাকে চিন্তা করতে হবে না। কিন্তু দাদা প্রজ্ঞাসুন্দরের সেনাবাহিনী আমার অনুমোতি ভিন্ন এখানো কেন সীমান্তে টহল দিচ্ছে আপনি আগে সে কথা বলুন।

প্রজ্ঞাসুন্দর বললেন, মহারাজ চাইলে রাজ্যের যেখানে খুশি সেনা স্থাপন করতে পারে।

দিব্যসুন্দর বললেন, নিশ্চয়ই। তবে যে দেশের জাতীয় আয়ের অধিকাংশই ব্যায় হয় সীমান্তের সেনা টহলে সে দেশের মাথাপিছু আয় বৃদ্ধি কল্পনা মাত্র তা আর কারো বুঝতে বাকি থাকে না। দুনিয়া না বুঝতে পারলে রাজতন্ত্র আপনি ভেঙে পড়বে। মৈত্রীর পথে গেলে উপজাতি শক্তি এই মুহূর্তে আমাদের বড় হাতিয়ার হতো। রাজ্যের স্বার্থে সমস্ত পরিস্থিতি আমি আর একবার বিবেচনা করতে অনুরোধ জানাই। না হলে যে চূড়ান্ত অপমানিত আজ আমি হয়েছি তার পরেও আমি এখানে দাঁড়িয়ে এতগুলো কথা বলতাম না। বলে দিব্যসুন্দর বেরিয়ে গেলেন ভোজন কক্ষ থেকে। গিয়ে দাঁড়ালেন উদ্যানের অন্ধকারে। সাহস্র মাইল দূরে থাকা তিতিরের জন্য তখন তার মন ছুঁটে চলেছিল হু হু করে।

কী অপূর্ব মেয়ে এই শ্বেতা। নরম তুলতুলে, দিব্য পাঁজা কোলা করে তাকে শুইয়ে দেন একটা সাদা পাহাড়ের ওপরে। পাথরের সঙ্গে মিশে যায় যেন শ্বেতার শ্বেত পাথরের মত শরীর। সেই জন্যই তো তিনি তিতির কন্যার নাম দিয়েছেন শ্বেতা। আর সে যখন কথা বলে, কলকল, তখন দিব্য তাকে ডাকেন স্রোতস্বিনী বলে। তিতিরের সুডোল বুকের ঠিক মাঝখানে মাথা রাখেন তিনি তারপর যেন মাথা মুণ্ডু সব নিয়ে ডুব দেন নদীর ভেতরে। তার শ্বেতা, তার বুকের ভেতর রাখা শ্বেতাকে তিনি টের পান তার প্রতিটি রক্ত, কোষ, কণায়। শরীরের প্রতিটি বিন্দুতে। একেই কি বলে প্রতি অঙ্গ লাগি কাঁদে প্রতি অঙ্গ মোর!

এই শ্বেতাকে অপমান করেছে প্রজ্ঞাসুন্দর। তার ধ্বংস অনিবার্য। দিব্যসুন্দর প্রতি ভোর রাতে একবার করে উচ্চারণ করেন এই বেদ মন্ত্র। আর কোথা থেকে যেন এক তীক্ষ্ণ গুলির শব্দে রক্তাক্ত হয়ে যায় চারপাশ। দিব্যসুন্দর এক ঝটকায়  বিছানা ছেড়ে উঠে পড়েন আর হাঁটতে থাকেন উদভ্রান্তের মত।

নিপুন পরিকল্পনার ছক তার মাথায় এসেছিল অনেক আগেই। জলের উপর দিয়ে আঁকা সে ছক। বাস্তবের মাটিতে তা দেখা যায় না। তখন কোথায় ছিল প্রশান্ত কোথায় ছিল কুশধ্বজ কোথায় ছিল আগ্নেয় অস্ত্র, কোথায় ছিল লোক বল এমন কি ছিল না তৃণকে শর  বানানোর মত কোন দিব্য শক্তিও। তবুও মাথার ভেতরে জাল বিস্তার করেছিল দুর্দমনীয় স্পর্ধা। স্বপ্ন দেখার স্পর্ধা।

তারপর যোগাযোগ গুলো কেমন আপনি আপনি হয়ে গেল। প্রশান্তর সঙ্গে দেখা হলো। কুশধ্বজ এলো। তথাপিও দিব্য মনে করেন তিনি একা। যা চিন্তা করেন তা একার শক্তিতেই চিন্তা করেন। বরং তিনি মাঝে মাঝে মনে করেন তিনি একা থাকলে বুঝি অধিক সুচিন্তিত পথে এগোতে পারেন। কিন্তু এমনটা হওয়া উচিৎ নয়।  সকলের সঙ্গে আলোচনা করেই এগোনো উচিৎ। এ-ও কি তার রক্তের দোষ!

রাজরক্ত মনে করতেই বিবমিষা হয় তার। মনে হয় সব রক্ত রস বদলে ফেলে প্রক্ষালন করতে। সে রাতে প্রজ্ঞাসুন্দরের সীমান্ত রক্ষী বাহিনী তছনছ করেছিল তিতির উপত্যকার সীমান্তবর্তী গ্রাম। কুঠিরের পর কুঠির জ্বালিয়ে দিয়েছিল খড়কুটোর মত। পরদিন সকালে তিতি ছুটে এসেছিল প্রজ্ঞাসুন্দরের রাজপ্রসাদে। মৈত্রী চুক্তি লঙ্ঘন করে এ অনাচার করবার স্পর্ধা প্রজ্ঞাসুন্দরের হলো কি করে? তাচ্ছিল্য ভাবে হেসে  প্রজ্ঞাসুন্দর জবাব দিয়েছিলেন, চুক্তি আমি করিনি করেছে আমার ভাতৃদেব দিব্যসুন্দর। আর সীমান্ত রক্ষী বাহিনীর দায়িত্বে তো আছে ও-ই। ওকেই জিজ্ঞাসা করুন। শুনেছি আমার ভাতৃদেবের সঙ্গে রাজকন্যার সমধুর সম্পর্ক! রাজরক্তকে কখনো বিশ্বাস করতে নেই এটাও জানেন না মহামোতী! তিতি জবাব দিয়েছিলেন, রাজা শব্দের অর্থ একেক জনের কাছে একেক রকম, সম্পদ শব্দের অর্থও। নিজ কৃতকর্মের দোষ আপন ভ্রাতার স্কন্ধে  অর্পণ করে নিজে মুক্ত হতে চাইবেন না রাজন! মানুষ চিনতে আমার ভুল হয় না।

তাই নাকি! প্রজ্ঞাসুন্দর হেসেছিলেন, বলেছিলেন তা কেমন মানুষ বলে মনে হয় আপনার আমাকে!

শ্বেতার আগমন বার্তা পেয়ে একটা কোন অঘটন ঘটতে পারে আন্দাজ করে রাজ সভায় ছুটে এসেছিলেন দিব্যসুন্দর।  সভায় প্রবেশের মুখে থমকে গিয়েছিলেন তিতির রাজকন্যা আর প্রজ্ঞাসুন্দরের তুমুল বিতণ্ডায়।

 তিতির প্রজ্ঞাসুন্দরের দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলেছিলেন, মধ্যযুগীয় বর্বর। শিক্ষার আলো প্রবেশ করেনি আপনার অন্দরে, জ্ঞান তো অতি দূরস্থান। তবে শতাব্দীর আয়রনি এটাই আপনারই নাম প্রজ্ঞাসুন্দর। না আছে আপনার প্রজ্ঞা, না আপনি সুন্দর।

সাট আপ। চিৎকার করে উঠেছিলেন প্রজ্ঞাসুন্দর।

তিনি জবাব দিয়েছিলেন, চিৎকার করলে অসুন্দর মানুষকে আরো অসুন্দর দেখায়। বিভৎস কুৎসিত, নিকৃষ্ট।

ছুটে এসেছিলেন দিব্য, তিতি প্লিজ মাথা ঠান্ডা করুন। বুঝতে পারছি আপনার উতলা হবার কারণ কিন্তু তাই বলে আপনি রাষ্ট্রপ্রধানের সঙ্গে এই ভাবে কথা বলতে পারেন না।

প্রজ্ঞাসুন্দর দুবার তালি দিয়েছিলেন হাতে, দুপাশ থেকে দুজন রক্ষী এসে বন্দুকের নল ঠেকিয়ে ধরেছিলেন তিতিরের কানের পাশে, চুক্‌চুক্‌ শব্দ করে প্রজ্ঞাসুন্দর বললেন,অত নরম শরীরে কি বন্দুক ঠেকাতে হয়! দিব্য যাও ওদের নিরস্ত্র কর। রাজকন্যা এখন থেকে বন্দী থাকবেন আমাদের প্রাসাদে।

দিব্য এগিয়ে গেলেন রক্ষীদের কাছে, বললেন অস্ত্র নামাও। কিন্তু বলার সঙ্গে সঙ্গে সশব্দে গুলি ঢুকে গেল রাজকন্যা খুলি ভেদ করে। দিব্যসুন্দর হতবাক হয়ে বললেন, একি করলে তোমরা? তারা বলল, আপনিই তো ফায়ারের  অর্ডার দিলেন যুবরাজ।

আমি! আমি তো তোমাদের অস্ত্র নামাতে বললাম। সভা শুদ্ধ মন্ত্রী পারিষদ সকলেই এক বাক্যে বললেন, না যুবরাজ, আপনি ফায়ারেরই নির্দেশ দিয়েছেন। হয়ত আপনার মাথার ঠিক ছিল না, কি বলতে কি বলেছেন।

ততক্ষণে তিথিরের দেহ লুটিয়ে পড়েছে মেঝের ওপরে। কানের পাশ দিয়ে গড়িয়ে নামছে রক্তের ধারা। দিব্যসুন্দর ধীরে ধীরে হাঁটু মুড়ে বসে পড়লেন তিতিরের সামনে তারপর দুহাতের আঁজলায় তুলে নিলেন তিথিরের মাথাটা নিজের ঊরুর ওপরে। আর হাঁ করে তাকিয়ে থাকলেন তিতিরের নিথর মুখের দিকে।

প্রজ্ঞাসুন্দর নেমে এলেন সোনার সিংহাসন থেকে। বললেন, দিব্যসুন্দর এইভাবে কি রাজপদ রক্ষা করা সম্ভব?

দিব্য কোন উত্তর দিচ্ছে না দেখে প্রজ্ঞাসুন্দর আবার বললেন তোমার একটা নির্দেশের ওপর নির্ভর করছে একটা দেশের ভাগ্য। আর তুমি উন্মনা বিবস্‌ হয়ে আছ? কখন কি বলছ তার ঠিক নেই! এই ঘটনা সম্পূর্ণ চেপে না দিতে পারলে বিশ্বের কাছে আমাদের মুখ কালিমালিপ্ত হবে। অন্তত এই কাজটিতে আমাদের সহযোগিতা কর, মৃতদেহ সরিয়ে ফেলতে দাও।

দিব্য হাত জোড় করে বললেন, গোপনে মৃতদেহ সৎকারের দায়িত্বটুকু আমাকে দেওয়া হোক মহারাজের কাছে এটুকু আমার আর্ত প্রার্থনা। কথা দিলাম একথা কেউ জানবে না বরং এই ঘটনা ঘটার মধ্যে যে আমাদের রাজ পরিবারের কোন হাত ছিল না তাও কৌশলে আমি প্রচারের ব্যবস্থা করব। শুধু  দাহকার্যের অনুমোতিটুকু যদি আমাকে দেন।

প্রজ্ঞাসুন্দর দিব্যর পিঠ চাপড়ে দিয়ে বললেন, বেশ তো। তোমার কোন আবদারটাই আর আমি না রেখেছি বল। শুধু তুমি যদি একটু আমার নির্দেশ মত চলতে। বেশ বেশ তুমি যেভাবে ইচ্ছে রাজকন্যার দাহকার্য সম্পন্ন কর, রাষ্ট্র এব্যাপারে কোনো হস্তক্ষেপ করবে না। দিব্য ধীরে পাঁজা কোলা করে তুলে নিলেন তিতিরের শ্বেত তনুলতা, তারপর হাঁটতে লাগলেন বনপথ ধরে।

হাঁটতে হাঁটতে পাহাড়ি    উপত্যকার কোলে লুকোনো সেই নদীটির কাছে গিয়ে থামলেন রাজকুমার। আলতো করে একটা পাথরের ওপর শুইয়ে দিলেন রাজকুমারীকে। তন্ত্র মন্ত্র মানেন না কুমার। মৃতদেহের সঙ্গে যৌনচার এক জঘন্য অপরাধ বলে জানেন তবু তিনি তার শরীরের সমস্ত নির্যাসটুকু পুরে দিতে চাইলেন শ্বেতার শরীরে। পাগোলের মত যেন প্রাণ ঢেলে দিচ্ছিলেন তিনি, বলছিলেন জাগো শ্বেতা জাগো। কিন্তু তিনি দেখছিলেন ঘন সাদা আঠালো এক ধোঁয়ায় ঢেকে ফেলেছে তার চারপাশ। তিনি হাতড়ে হাতড়ে ছুঁয়ে দিচ্ছিলেন তিতিরের চোখ মুখ ঠোঁট, বলছিলেন, কোথায় লেগেছে তোমার বল? কোথায় লেগেছে? খুব কষ্ট হচ্ছে? খুব? না না তোমার কোন কষ্ট হবে না। তুমি সব কষ্ট আমাকে দাও, আমাকে। এই যে দেখো, দেখো এই বুকের মধ্যে আমি তোমার সব কষ্ট ধারণ করলাম। যতদিন আমি তোমার স্বপ্ন সফল করতে না পারি, এই ধরাধামে আমি তোমার কষ্ট বহন করব। কাজ শেষ হলে আমায় ডেকে নিও তোমার কাছে। তারপর পাথরের ওপর উঠে হুই হুই করে মুখে চোঙা ফুঁকে ডাক দিলেন কাউকে। দেখতে দেখতে আদিবাসী গ্রাম থেকে জড়ো হয়ে গেল বেশ কিছু লোক। তাদের হাতে রাজকুমারী দাহকার্যের ভার অর্পণ করে তিনি মিলিয়ে গেলেন পাহাড়ের অন্তরালে। ধ্যানে বসলেন, বিশুদ্ধ অগ্নি লকলক করে জ্বলে উঠল  উর্দ্ধপানে।

ফিরে গিয়েছিলেন দিব্যসুন্দর। পুনরায় দায়িত্বভার গ্রহণ করেছিলেন রাষ্ট্রের। প্রজ্ঞাসুন্দর ভায়ের সঙ্গে আলোচনায় শান্তি চুক্তি অনুসরণ করে চলবার শপথ নিয়েছিলেন পুনরায়। কিছুদিন নির্বিঘ্নে কেটেছিল সকলের কিন্তু ফের অতর্কিত আক্রমণ। এইবার রাজপদ থেকে অব্যহতি চেয়ে নিলেন দিব্যসুন্দর। সংসার ত্যাগ করে সন্ন্যাস গ্রহন  করলেন। স্থাপন করলেন মঠ ও মন্দির। প্রজ্ঞাসুন্দরের তাচ্ছিল্যের দান এক খণ্ড জমি গ্রহন করে স্বেচ্ছায় সব ছেড়ে চলে এলেন শ্বেতা নদীর তীরে এই দুর্গম উপত্যকায়। তৈরি করলেন এক ছবির মত অঞ্চল নাম দিলেন সুন্দর। বহির্বিশ্বের সঙ্গে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন এই এলাকাটির চারধারে প্রজ্ঞাসুন্দর নজরদারির ব্যবস্থা করলেন কড়া ভাবে।

কিন্তু যখন সময় হয় প্রভূ আপনি এসে দ্বার খুলে দেন। দেখিয়ে দেন পথ। ঠিক এই ভাবেই প্রশান্ত একদিন এসেছিলেন দিব্যর কাছে। বলেছিলেন বড় আশা নিয়ে আপনার কাছে এসেছি সন্ন্যাসী রাজা। দিব্যসুন্দর বলেছিলেন না আমি সন্ন্যাসী না আমি রাজা। আমি একজন উদ্ভ্রান্ত মানুষ, যে কেবলই শান্তি খুঁজে ফেরে। আমাকে বরং বন্ধু বলে ডাকুন। যদি আপনাকে কোন সাহায্য করতে পারি, হয়ত কিছুটা শান্তি পাব আমি।

প্রশান্ত বলেছিলেন, আমাদের দুজনারই লক্ষ্য কিন্তু এক পথটা হয়ত ভিন্ন।

দিব্যসুন্দর বললেন, আমার তো কোন লক্ষ্য নেই, কাজ আছে। কাজটা আমাকে করে যেতে হবে।

প্রশান্ত বললেন, বাই দ্যা পিপল, অব দ্যা পিপল, ফর দ্যা পিপল। রাইট?

দিব্যসুন্দর হাঁ করে তাকিয়ে রইলেন প্রশান্তর দিকে তারপর বললেন, কিকরে বুঝলেন?

– কাজের ধরন দেখে।

– ঠিক তাই।

– আমারও তাই।

– কিরকম?

– গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা। জনগণের শাসনতন্ত্র প্রতিষ্ঠা। বর্বর রাজতন্ত্রের বিলোপ সাধন।

দিব্য বললেন, আমি আপনার কথা শুনেছি। দীর্ঘদিন ধরে পাহাড়ের আনাচে কানাচে আপনি জঙ্গি সংগঠন চালান।আপনাদের কথা সম্ভবত রাজ পরিবার ও জানেন।কিন্তু আপনাদের কাজ কম্মের ধরন এতোই আধুনিক যে তারা আপনাদের হদিস করে উঠতে পারে না।বেশ কয়েকবার অতর্কিত হামলা চালিয়েছেন আপনারা রাজধানীর পথেঘাটে কিন্তু এখনো পর্যন্ত তেমন বড়ো কিছু নাশতার ছক আপনারা কষে উঠতে পারেন নি।আমার পথ তো শান্তির পথ।আমার সঙ্গে আপনার কিকরে মিলবে মহামান্য? তাছাড়া গনতন্ত্র প্রতিষ্ঠা কি অত সহজ? রাজতন্ত্র একটা  জগদ্দল পাথর! শক্তি কই আমাদের তাকে সরানোর?

– নেই। তাই ছলে বলে-কৌশলে।

– না না অসৎ উপায় আমি অবলম্বন করতে পারব না।

– তিতির রাজকন্যাকে সভামধ্যে গুলি করে হত্যা করাটা সততা ছিল?

– আঃ! দুহাতে কান চেপে চিৎকার করে উঠেছিলেন দিব্য, চুপ করুন পুরনো ইতিহাস ঘাটবেন না।

প্রশান্ত ঠোঁটটা বেঁকিয়ে বলেছিলেন, রাজকাহিনী বলে যুবরাজের অসহনীয় লাগছে। রাজকাহিনীতে দুঃখ বেদনারও একটা গ্র্যাঞ্জার আছে। কয়লার ইঞ্জিনের মত, ধক্‌ ধক্‌ ধক্‌ ধক্‌ সশব্দে ধোঁয়া ছাড়তে ছাড়তে ছুটে চলে। আর সহায় সম্বলহীন জনসাধারণ, যাদের শক্তিশালী রাজার পদপিষ্ট হয়ে মরাই ভবিতব্য তাদের নিয়ে কোন গল্পও তৈরি হয় না। তাদের মৃত্যুটাও এমন গরিমা বিহীন! তাদের ক্ষেত্রে ন্যায় অন্যায় সততা শব্দগুলোও এমন অর্থহীন!

দিব্য উঠে এসেছিলেন নিজের আসন ছেড়ে, প্রশান্তর পিঠে হাত রেখে বলেছিলেন, আমাদের উচিৎ কাজ নিয়ে কথা বলা। যন্ত্রণা আমাদের এক রাস্তায় এনে ফেলেছে। যিনি এনেছেন তিনি উচিৎ মনে করেছেন বলেই এনেছেন, না হলে এমন হঠাৎ করে যোগাযোগ হবে কেন বলুন!

প্রশান্ত বলেছিলেন, হঠাৎ করে নয়, আমি বহুদিন থেকেই আপনার সঙ্গে যোগাযোগ করতে চাইছিলাম। বারংবার আমি দূত পাঠাতে চেয়েছি আপনার মঠে। কিন্তু তারা প্রজ্ঞাসুন্দরের দুর্ভেদ্য পাহারার প্রাচীর সরিয়ে পৌঁছাতে পারে নি। এতদিনে আমি অনেকটা সফল। প্রজ্ঞাসুন্দরের আঞ্চলিক সুরক্ষা বাহিনীর অধিকাংশ সৈনিকই এখন আমার অনুগামী। বন্ধু আপনার সততার পথ অনুসরণ করলে কোনদিনই আমাদের দেখা হতো না। যুদ্ধে এবং প্রেমে কোন কিছুই অসৎ পথ নয়। এই দুই ক্ষেত্রেরই ভিন্ন নীতি আছে। কথা দিন আজ থেকে আমরা একসঙ্গে কাজ করবো। আপনার কৌশল যদি হিংসা ব্যতিরেকে ক্ষমতা দখল করতে সমর্থ হয় তবে আপনার পরামর্শ মেনে চলতে আমার বিন্দুমাত্র আপত্তি নেই।আর আমার সেনাবাহিনী যদি আপনাকে কিছুমাত্র সাহায্য করতে পারে আমি নিজেকে ধন্য মনে করবো।

দিব্য বললেন, নিশ্চয়ই। বন্ধু বলেছি যখন তখন ধন্য মনে করার তো কিছু নেই।একে অপরের সাহায্যে আসবো। সীমান্তে উপজাতিদের উপর হামলা এখনো সমানে চলছে,আপনার সাহায্য পেলে সত্যি তা সামলানো সহজ হবে।আর তারপরেই আসবে মাহেন্দ্রক্ষণ, ক্ষমতাবদলের ছকটা কষে নিতে হবে বুদ্ধি করে।

এব্যাপারে আপনার ভাতুষ্পুত্র কুশধ্বজকেও আমরা কাজে লাগাতে পারি,সেও পিতার উপর ক্ষুব্ধ।

নড়ে চড়ে বসলেন দিব্য,বললেন ওকে অব্যাহতি দিন।ও বড়োই সরল মোতি।ওকে বরং আমি মূল স্রোতে ফিরিয়ে দেবারই চেষ্টা করছি।

সেকথার কোনো উত্তর না দিয়ে শুধু মৃদু হাসলেন প্রশান্ত।

পাঁচ

সুবৃহৎ  ভোজন কক্ষের মাঝ বরাবর দীর্ঘ শ্বেত পাথরের টেবিল। আর সারসার সেগুন কাঠের উপর হাতির দাঁতের কারুকাজ করা চেয়ার।

উপরে ঝুলছে মস্ত বড় ঝাড়বাতি। রুপোর পান পাত্রে সাজানো বহুমূল্য বিদেশী পানীয়। ছোটখাটো অনুষ্ঠানে রাজ অতিথিরা এই কক্ষে মিলিত হন  পান আহারের উদ্দেশ্যে। আজ কুশধ্বজর জন্মদিন। সেই উপলক্ষ্যে প্রজ্ঞাসুন্দর আয়োজন করেছেন ছোট্ট অনুষ্ঠানের। সম্প্রতি কুশধ্বজ বিদেশে বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিগ্রি সম্পন্ন করে দেশে ফিরেছেন পাকাপাকি ভাবে। অতএব একটা ছোটখাট পার্টির ব্যবস্থা করাই দরকার। প্রজ্ঞাসুন্দর অনেকদিন থেকেই একটু হৈ চৈ করতে চাইছিলেন, কুশধ্বজ রাজি হন নি। পিতার ওপর অভিমান হয়েছিল। সম্প্রতি তার মন কিছুটা নরম হয়েছে। শিল্পপতি রায়ানের কন্যা পিয়াকে তার মনে ধরেছে খানিক। তাই রাজি হয়েছেন পিতার প্রস্তাবে। শুধু অনুরোধ জানিয়েছেন কাকা দিব্যসুন্দরকে আমন্ত্রণ জানানোর।

পুত্রের আবদার মেনে প্রজ্ঞাসুন্দর আমন্ত্রণ জানিয়ে পত্র পাঠিয়েছিলেন দিব্যসুন্দরের কাছে। কিন্তু দিব্যসুন্দর সে আমন্ত্রণ ফিরিয়ে দিয়েছেন। রাজপ্রাসাদে তিনি কখনো পা রাখবেন না, এই তার দৃঢ় প্রতিজ্ঞা। তবে তিনি রাজার সম্মানার্থে তারই এক বিশ্বস্ত  শিষ্যকে পাঠাবেন বলে জানিয়েছেন।

পানীয়ের উল্লাসে শুরু হলো জন্মদিনের উৎসব। অনুষ্ঠান কিছুক্ষণ চলার পরেই রাজ পরিবারের সদস্যরা মদিরাশক্ত হয়ে গেলেন। ঝাড়বাতির মায়াবী আলোয় সুরের মূর্চ্ছনায় যখন প্রজ্ঞাসুন্দর ঘোষণা করতে গেলেন কুশধ্বজের বিবাহ প্রস্তাব ঠিক তক্ষুনি পিতার দিকে বন্দুকের নল তাক করে ধরলেন কুশধ্বজ। বললেন, ক্যু, গণঅভ্যুত্থান হয়েছে মহারাজ প্রজ্ঞাসুন্দর। এখন আপনি আমার হাতে বন্দী। রাজতন্ত্রের অবসান হলো এই মুহূর্ত থেকে। বাইরে অপেক্ষা করছেন দিব্যসুন্দর। জনপ্রতিনিধি হিসাবে জনগণের শাসনের ভার আজ থেকে আমি তুলে দেব তার হাতে। হা হা করে হাসলেন প্রজ্ঞাসুন্দর। বললেন আমাদের সামরিক শক্তি সম্পর্কে   কোনো ধারণা আছে তোমার? এই মুহূর্তে ঐ বন্দুকের নলই ভেঙে গুঁড়িয়ে দেবে তোমাদের জনতার ব্যারিকেট।

ঠিক তাই, আর সে কথা জেনেই আমি আজ রাজসভায় উপস্থিত হয়েছি।ভিড়ের মধ্যে থেকে কথা বলে উঠলেন বৃহৎ প্রতিবেশী রাষ্টের রাষ্ট্রদূত প্রজ্ঞাসুন্দরের বন্ধু মিস্টার নারায়ণ। বললেন  আপনার সামরিক শক্তির পুরোটাই এখন আমার হাতের মুঠোয়। তবুও আমি শত্রুর শেষ রাখায় বিশ্বাসী নই। বলতে বলতে প্রশান্ত বাঁহাতে টেনে খুলে ফেললেন নিজের পরচুলো আর মুখোশ।বললেন এম্বাসির পুরোপুরি দখল এখন আমাদের হাতে। মিস্টার নারায়ণ অনেক আগেই বন্দী হয়েছেন আমাদের কাছে। আসলে আপনার ভাই দিব্যসুন্দরের কথা মতো সবটাই ভবিতব্য। নাহলে মিস্টার নারায়ণের চেহারার সঙ্গে আমার চেহারার এমন মিল থাকবে কিকরে বলুন!  কথা শেষ হবার আগেই তার হাতে ঝলসে উঠল  আগ্নেয় অস্ত্র।

কিছু বুঝে উঠবার আগেই এলোপাথাড়ি গুলিতে একে একে লুটিয়ে পড়লেন রাজ পরিবারের সকল সদস্য। এমন কি কুশধ্বজ নিজেও।

গুলির শব্দে রাজপ্রাসাদের অভ্যন্তরের ছুটে এলেন দিব্যসুন্দর। বললেন আমকেও মারুন প্রশান্ত, আমি বাকি থাকি কেন? আমার গায়েও তো আছে রাজরক্ত।

হাতজোড় করলেন প্রশান্ত, বললেন, না না বন্ধু একি বলছ?

দিব্যসুন্দর বললেন, কেন নয়? এমন তো কথা ছিল না। কথা ছিল বিনা রক্ত পাতে গন অভ্যুত্থানের মাধ্যমে  যদি ক্ষমতা দখল করা যায় তাই করা হবে। আমি তো সব ব্যবস্থা সুষ্ঠু ভাবে করে ফেলেছিলাম। তারপরেও কেন এই অকারণ রক্তপাত?

প্রশান্ত বললেন,আমি তো কোনো হত্যা সংঘটিত করিনি। প্রেম ও বিবাহে বাধা প্রাপ্ত হয়ে ক্ষুব্ধ রাজকুমার পিতা সহ রাজপরিবারের অন্যান্য সদস্যদের হত্যা করে নিজে আত্মঘাতী হয়েছেন।একথাই তো জানবে সকলে।তারপর গলা নামিয়ে প্রায় ফিসফিস করে বললেন,  তুমি জানো না বন্ধু, বিনা রক্তপাতে ক্ষমতা দখল কোন অবস্থাতেই সম্ভব হতো না। বরং এই পিশাচদের চক্রান্তে অনেকগুলো নিরিহ মানুষ প্রান হারাতেন। যারা বিশ্বাসযোগ্য নয় তাদের কখনো বিশ্বাস করতে নেই।

দিব্য বললেন, বন্দী রাজার ক্ষমতা কি?

প্রশান্ত বললেন, আছে। ক্ষমতার প্রসারিত হাত ছড়িয়ে থাকে শহরের আনাচে কানাচে।

তাই বলে আমার প্রাণাধিক কুশধ্বজ? যে আমাদের সবচেয়ে বেশি সাহায্য করেছে!

প্রশান্ত হাঁটু মুড়ে বসে বন্দুক নামিয়ে রাখলেন দিব্যসুন্দের পায়ের কাছে, বললেন ক্ষমা কর বন্ধু, কিন্তু ঐ যে তোমাকে বলেছিলাম যুদ্ধ আর প্রেমে কোন সামাজিক নিয়ম খাটে না। তাদের ক্ষেত্র আলাদা। আমি রাজতন্ত্রের শেষ রাখতে চাই নি। তুমি তো জানো রাজতন্ত্র বিনাশের জন্য আমি সারাজীবন বিসর্জন দিয়েছি।তুমি বলেছিলে কুশধ্বজ গান পয়েন্টে প্রজ্ঞাসুন্দরকে বন্ধী করবে তখন আমার সেনাবাহিনী রাজপ্রাসাদের দখল নেবে কিন্তু আমার মনে হয়েছিলো তাতে জনসাধারণ কুশধ্বজকেই রাজা হিসাবে অভিষিক্ত করবে আর নতুন রূপে সেই একই রাজতন্ত্র আবার ফিরে আসবে।দীর্ঘদিন রাজতন্ত্রের অধীনে থাকতে থাকতে এখানকার বেশিরভাগ মানুষ রাজপরিবারের দাসত্ব করতেই অভ্যস্ত হয়ে গিয়েছে।

দিব্যসুন্দর বললেন, তবে আমাকেও মুক্তি দাও বন্ধু। নিজে না পারো লোক দিয়ে হত্যা করাও। প্রশান্ত দিব্যসুন্দরের দুহাত চেপে ধরে বললেন, না না, গন ভোট হবার আগে পর্যন্ত এ রাজ্য পাটের দায়িত্ব তোমাকেই নিতে হবে। তুমি নিজ হাতে ক্ষমতা আমাকে তুলে না দিলে জনগণ সরাসরি আমাকে গ্রহণ করবে না।

দিব্যসুন্দর বললেন, বেশ, এখনো তবে কিছু বিনিময় যোগ্য বার্তা রয়ে গেছে আমাদের মধ্যে। কুশধ্বজকে আমি নিজ হাতে দাহ করতে চাই আমার মঠ ও মন্দির প্রাঙ্গনে, আশা করি তাতে তোমার আপত্তি হবে না।

প্রশান্ত বললেন, না না নিশ্চয়ই নয়। তুমি চাইলে আমি তোমাদের পৌঁছে দেওয়ার ব্যবস্থাও করতে পারি।

দিব্যসুন্দর বললেন, আমার শক্তির এখনো অত কিছু অভাব হয় নি। বলে তিনি নীচু হয়ে বসলেন কুশধ্বজের নিথর দেহের সামনে তারপর তাকে পাঁজা কোলা করে তুলে নিয়ে হেঁটে চললেন এক নির্জন নদী উপত্যকার উদ্দেশ্যে, সেই বহু বছর আগে যে পথ ধরে হেঁটে গিয়েছিলেন তিতির রাজকন্যাকে কোলে করে ঠিক সেই পথ ধরে।

গভীর জঙ্গলের মধ্যে প্রবেশ করে কুশধ্বজকে কোল থেকে নামিয়ে দিলেন দিব্যসুন্দর। বললেন, ঠিক আছো তো পুত্র?

কুশধ্বজ বললেন, আমি ঠিক আছি তাত, কিন্তু আপনি সুস্থ বোধ করছেন তো? এই বয়সেও আপনার শক্তি দেখে আমি আশ্চর্য হচ্ছি। আমার মত একজন যুবাপুরুষকে কোলে করে হেঁটে আপনি এত পথ অতিক্রম করলেন তার ওপর বুলেট প্রুফ জ্যাকেটের ভার!

দিব্য বললেন, সে হয়ত ঐ রাজ রক্তের জোর কিম্বা যোগ সাধনার। তবে জন্মদিন উপলক্ষে মাথায় বিশেষ ঝালর দেওয়া টুপি পরার বুদ্ধিটা তোমার মাথায় না এলে কিন্তু প্রশান্ত তোমার কপালই লক্ষ্য করত। মনবল সংগ্রহ করেছ তো? এখন কিন্তু তোমাকে অনেক দুর্গম পথ অতিক্রম করতে হবে। যিনি তোমাকে নিতে আসবেন তিনি রাজকুমারী তিতির অনুজ। বড় ভালো ছেলেটি। দক্ষ অভিযাত্রী। বিশ্বাস যোগ্য এবং আন্তরিক। বুদ্ধিমান এবং সপ্রতিভ। ও তোমাকে গোপনে বিদেশে পাঠানোর সব ব্যবস্থা করে রেখেছে। একবার এই দেশের সীমানা পরিত্যাগ করতে পারলে আর ভয় নেই। ওখানে গিয়ে তুমি মারিনাকে বিবাহ করো, সুখী হয়ো। তবে হ্যাঁ আসক্তিতে জড়িয়ে পড়ো না। দেশের দিকে লক্ষ্য রেখো, যদি কোনদিন দেশের পরিস্থিতি অনুকূল হয় তবে দেশে ফিরে এসে দেশীয় গণতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থায় অংশ গ্রহণ করো। আর এই মঠ ও মন্দিরের ও দায়িত্ব নিও। আপাতত আদিবাসী পরিষদের হাতে এই মঠ ও মন্দিরের দায়িত্ব দিয়ে আমি আরো নির্জনে অন্তর্হিত হতে চাই।

– সে কি তাত, আপনি কোথায় যাবেন?

– দেখি পথ আমাকে কোথায় নিয়ে যায়।

সামনে এসে দাঁড়াল পিঙ্গল বর্ণের এক আদিবাসী যুবা। বলল কুমার প্রস্তুত তো? মাথা নাড়ল কুশধ্বজ। হ্যাঁ। যুবা বললেন,আচার্যের কাছে অনুমতি নিয়ে তবে যাত্রা শুরু করি? আমি আহার্য কিছু গুছিয়ে এনেছি চামরির পিঠে। আপাতত আমাদের তেমন কোন সমস্যা হবে না।

দিব্যসুন্দর বললেন, এসো। তোমাদের যাত্রা শুভ হোক। প্রশান্তর হাত থেকে যে তোমাকে আমি ফিরিয়ে আনতে পেরেছি এ আমার বড় শান্তি কুশধ্বজ।  যেদিন মারিনা আর তোমার প্রেমের খবর প্রশান্ত আমাকে জানিয়ে ছিলেন,দেখিয়েছিলেন তোমার আর মারিনার পত্র চালাচালি কিভাবে হ্যাক করে তিনি তা সংগ্রহ করেছেন,যেখানে তুমি উগরে দিয়েছো তোমার পিতার বিরুদ্ধে ক্ষোভ, সেই দিন থেকে আমি বুঝেছিলাম প্রশান্ত তোমাকে ঘুটি করতে চায়। আর যারা রক্তের পথ ধরে অস্ত্রের পথ ধরে তারা নিজেদের বিপরীত পৃথিবীকে শত্রু হিসাবে মানে, কাজকে যুদ্ধ হিসাবে মানে। ন্যায়, নীতি, বিশ্বাস সব হারিয়ে যায় তাদের পথ থেকে। যদিও আমার কোন হত্যাই কাম্য ছিল না। তবে আমি চাইলেই তা আটকাতে পারতাম না। ধর্ম তার আপন পথেই চলে। প্রশান্তও তার আপন ধর্ম পথেই চলেছেন। তার ধর্ম তাকে ঐ টুকুই চিনিয়েছেন। এর পরের চাকাটিও আপনি ঘুরবে তার আপন গতিতে। যাও, তোমরা এগিয়ে যাও। আমার কাজ আরো কয়েকটা দিন বাকি। গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় নির্বাচনের মাধ্যমে সরকার প্রতিষ্ঠা করে তবে আমার ছুটি। বাই দ্যা পিপল, অফ দ্য পিপল, ফর দ্য পিপল, মানুষের দ্বারা, মানুষের নিমিত্ত, মানুষের সরকার।

কটাদিন গেল নির্বাচন প্রস্তুতির উদ্দিপনায়। নির্বাচন প্রক্রিয়াও মিটল সুষ্ঠুভাবেই। স্বভাবতই বিপুল ভোটে দিব্যসুন্দর নির্বাচিত হলেন জন প্রতিনিধি হিসেবে এবং প্রকাশ্য জনসভায় স্বেচ্ছায় তিনি সেই দায়ভার অর্পণ করলেন আদিবাসী প্রতিনিধি প্রশান্তর হাতে। মন্ত্রীসভার প্রধান হিসাবেও ঘোষণা করলেন প্রশান্তের নাম। তারপর যাত্রা শুরু করলে নিরুদ্দেশের পথে।

শ্বেতা নদীর তীর ধরে তিনি হাঁটতে লাগলেন নদীর উৎসাভিমুখে। হাঁটতে হাঁটতে তিনি বেছে নিলেন আরো গভীর নির্জন এক উপল তটভূমি। পা ফেলে ফেলে গিয়ে বসলেন নদীগর্ভের এক বৃহৎ পাথরে। তখন একটু একটু করে বরফ গলছে চারদিকে। প্রতি দিন লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ছে নদীর জলস্তর। পাথরের ধাক্কায় ছিটকে উঠছে দুগ্ধ সফেন। তীব্র স্রোতে উত্তাল হয়ে উঠছে যেন তার কলধ্বনি। ঠিক এই ভাবে কথা বলত তার তিতি, তার স্রোতস্বিনী। চোখ বুজলেন তিনি। ঢেউ এসে আছড়ে পড়ছে তার উরুতে, পিঠে। বহুদিন বাদে নতুন করে যৌবন প্রাপ্তি ঘটছে দিব্যসুন্দরের।

দিনাবসানের ক্লান্তিটুকু নিয়ে নতুন করে উঠছে চন্দ্রিমা। ওলট পালট উদ্দামের শেষে আজ যেন সেই চূড়ান্ত তৃপ্তির ক্ষণ। ডুবে যাচ্ছেন দিব্যসুন্দর, ভেসে যাচ্ছেন দিব্যসুন্দর শ্বেতা নদীর গভীরে।

মৃত্যুরেও তবে তারা হয়তো ফেলিবে বেসে ভালো
সব সাধ জেনেছে যে সেও চায় এই নিশ্চয়তা!
সব ভালোবাসা যার বোঝা হল –
দেখুক সে মৃত্যু ভালোবেসে!

 

অনিন্দিতা গোস্বামী। গল্পকার ও ঔপন্যাসিক। জন্ম নদিয়ার কৃষ্ণনগরে। বর্তমানে থাকেন কল্যাণীতে। বিদ্যালয় জীবনে কবিতা লেখার শুরু। বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াকালীন ১৯৯৫ সালে প্রথম কবিতার বই প্রকাশ। দেশ, সানন্দা, কৃত্তিবাস, কবিতাপাক্ষিক, কবি সম্মেলন ইত্যাদি নানা পত্র-পত্রিকায় কবিতা প্রকাশ। ২০০৬ সালে আনন্দবাজার পত্রিকার নবান্ন'তে...

এই বিভাগের অন্যান্য লেখাসমূহ