যে প্রশ্ন খোঁজার  কথা নয়

রাজিয়া নাজমী
গল্প
Bengali
যে প্রশ্ন খোঁজার  কথা নয়

নার্সের দেখিয়ে দেওয়া ভেজানো দরজা ঠেলে ঢুকতেই অল্প বয়সী ডাক্তার বেশ কোমল কণ্ঠে, ‘ ভিতরে আসুন’ বলেই মোটা ফ্রেমের চশমা নাকের উপরে সামান্য একটু তুলে আরেকবার তাকিয়ে বলল, ‘এই চেয়ারটিতে বসুন’।

টেবিলের সাথে লেগে থাকা চেয়ার টানতে তাঁর অসুবিধা হচ্ছে দেখে এবার ডাক্তার  উঠে এসে বলল, ‘ আমি টেনে দিচ্ছি’।

বেশ মমতা মাখা গলা ছেলেটির। সালমা বেগম বসতে বসতে ভাবলো।

নিজের চেয়ারে ফিরে গিয়ে সালমা বেগমের  স্বাস্থ্য সম্পর্কিত লেখা ফাইলের উপরে হাত রেখে ডাক্তার বলল, ‘আমার নাম মৃণাল সেন’।

সালমা মাথা ঝুঁকিয়ে বলল, হ্যাঁ, মনোবিজ্ঞানী, মনের ডাক্তার।

মৃণাল সেন মুখে হাসি টেনে বলল, কেমন আছেন? কেউ এসেছে আপনার সাথে?’

-‘যেটুকু প্রয়োজনে এসেছি তাঁর বাইরে আমি ভালো আছি ডাক্তার। তবে ডান হাতে বেশ ব্যথা। চেয়ারটা টানতে তাই একটু কষ্ট হচ্ছিল। জানি এটা আপনার বিষয় না। আর হ্যাঁ,আমার সাথে যে এসেছে সে বাইরে আছে। ওকে দরকার হবে?’

– ‘না না, এমনি জানতে চাইলাম।আপনি ঠিক বলেছেন, হাতের ব্যথার চিকিৎসা আমি করব না তবে একটু আধটু পরামর্শ দিতে পারব’।

সালমা বেগম আরও একটু ভালো করে দেখলো মৃণাল সেনকে।

অল্প বয়সী -বেশি দিন হয়নি রোগী দেখার তাই হয়ত এখন কমার্শিয়াল হয়ে যায়নি। কি জানি জন্মগত দয়ালু হলে এমন স্বভাব ওর থেকে যেতেই পারে। তবে বদলে যাওয়াই যে স্বাভাবিক। সবাই বদলে যায়। সালমা বেগমের ভাবনার ছাপ হয়ত তাঁর চেহারায়  পড়েছিল। মৃণাল সেন তাই দেখেই বোধ হয় বলল,  আপনি কিছু ভাবছেন? জল দেব?

-নাহ; তেমন কিছু না। পিপাসাও পায়নি।

মৃণাল সেন ফাইল টেবিলে রেখে সালমা বেগমের পাশে এসে বলল, আপনার হাতের ব্যথা ছাড়া অন্য জটিল রোগ নেই লিখেছেন। আপনি কি নিয়মিত পরীক্ষা করান?  এটা খুব জরুরী এই বয়সে।

সালমা বেগম কোন জবাব না দিয়ে ডাক্তারের টেবিলের পিছনে দেয়ালের ছবি দেখে বললেন, ছবিটি শিল্পী শাহাবুদ্দিন’র আঁকা? এখান থেকে সইটা ঠিক দেখতে পারছি না।

মৃণাল সেন কিছুটা অবাক হয়ে বলল, হ্যাঁ,ওনারই আঁকা। আপনি পেইন্টিং ভালোবাসেন? ছবি আঁকেন?

– ‘একটু আধটু আঁকতাম একসময়। ওর আঁকার ধরণ অন্যরকম তাই বুঝতে কষ্ট হয় না’।

 সালমা বেগমের চেয়ার একটু হেলিয়ে দিয়ে মৃণাল সেন বলল ‘হাতের ব্যথা কমে গেলে আবার শুরু করতে পারেন। এবার আপনি এবার একটু হেলান দিয়ে মাথা রেখে আরাম করে বসেন। আমি আপনার পাশেই বসছি।অসুবিধা হলে আমাকে বলবেন’।

– ‘আচ্ছা’, বলেই সালমা বেগম গায়ের পাতলা চাদর একটু   জড়িয়ে নিয়ে ডাক্তারের কথা মত চেয়ারের গায়ে হেলান দিলেন।

-এবার তাহলে আমরা শুরু করতে পারি? আমি নিয়ম অনুযায়ী আমাদের কথা রেকর্ড করব।

-হ্যাঁ। ঠিক আছে।

-আপনি লিখেছেন ঘুম কম হয়।সেটা কতদিন ধরে? একবারে ঘুম হয় না? না মাঝে মাঝে?

-মাঝে মাঝে সারা রাত জেগে থাকি, আবার কখন হয়ত ঘুম হয় কিন্তু অনেকবার ঘুম ভেঙে যায়।

ডাক্তার, আমি কবে সারা রাত ঘুমিয়েছি মনে নেই। আমার দিনে ঘুমাবার অভ্যাস  নেই। দিন আমার কেটে যায় কোন না কোন ভাবে। রাতটাই আমার জন্য কষ্টকর। এত দীর্ঘ রাত আমার কাটতে চায় না। কখন ব্যালকনিতে বসে থেকেই ভোর হয়ে যায়।  নিঝুম রাতগুলোতে পায়ের কাছে গোরা বসে থাকে।

গোরা; আমাদের বাড়ীর কুকুর। বড় মায়া ওর আমার জন্য। এত বলি যা তুই তোর বিছানায় যা, লেজ নাড়তে নাড়তে সে আমার পায়ের কাছেই বসে থাকবে। মাঝে মাঝে আমার মুখের দিকে তাকায়, যেন জানতে চায় আমি ঘুমাই না কেন। কে জানে হয়ত অন্য কিছু বলতে চায়। তখন ভাবি আহা; ও যদি কথা বলতে পারতো। কখন কখন ওকে আস্তে করে ডাকি ‘বাবুই’।ও তখন  গু গু শব্দ করে লেজ নাড়িয়ে গা ঘেঁসে আমার পায়ে মুখ ডুবিয়ে বসে থাকে। বুঝি, বাবুই হতে চায় না গোঁড়া।

-আপনাকে অন্য ডাক্তার ঘুমের ওষুধ দিয়েছিল লিখেছেন। সেসবে কাজ হয়েছে?

ডাক্তারের বয়স কম বলেই সালমা বেগম নিজের অজান্তেই ডাক্তারের হাতে হাত রেখে বলল, আমি একটা প্রশ্ন খুঁজছি। সেটা খুঁজতেই আমি এখানে এসেছি।

-প্রশ্ন? উত্তর নয়?

-ডাক্তার, প্রশ্ন না জানা থাকলে উত্তর কি করে আশা করব!

– কি প্রশ্ন খুঁজছেন?

-নাহ; তা কোন এক লাইনে বলা সম্ভব নয় । আমার সারাক্ষণের ভাবনার ভিতর সেই প্রশ্ন লুকিয়ে আছে যা আমি আলাদা করে বের করে আনতে পারছি না।

যারা নিজেদের মনের কথা বোঝে না তাঁদের মনের কথার অর্থ, যুক্তি বোঝাবার জন্যই মনোবিজ্ঞানীরা। তাই নয় ডাক্তার? তাই তো মনোবিজ্ঞানীর কাছে এসেছি আজ সেই প্রশ্ন খুঁজতে।

-মৃণাল সেন হাতের কলম রেখে দিয়ে বলল, ঠিক আছে বলুন। তাছাড়া আজ কেন আপনি আবার আসবেন কথা বলতে।

-না ডাক্তার আজকের পর আর কিছু বলার নেই আমার। আজও খুব বেশি কিছু বলার নেই। খুব সময় লাগবে না শুনতে।

মৃণাল সেন একটু চুপ থেকে বলল, ঠিক আছে।আমাদের এখন অনেকটা সময় আছে। না থাকলেও অসুবিধা নেই।আপনার পরে আমার আজ আর কোন এপয়েন্টমেন্ট নেই। আপনি ধীরে ধীরে বলুন আপনার কথা। আমি শুনছি।

সালমা বেগম মৃণাল সেনের দিকে তাকিয়ে চেয়ারের হাতলে ডান হাতটাকে আলতো করে রেখে যেন কোথা থেকে শুরু করবে বুঝতে না পেরেই  বলল, আমি গোরার জন্য তেমন কিছু করি না। কাজের মেয়েটাই ওকে খাবার দেয়, গা ধুয়ে দেয়। তবু আমার জন্য এত মায়া। কি করে বোঝে যেন আমার রাত জাগার কারণ। অথচ যার বোঝার কথা সে কখন বলে না ‘রাত হয়েছে ঘুমাও এখন’।

ডাক্তার , পৃথিবীর আরেক প্রান্তে যখন ভোঁর হয় তখন আমার রাত হলেও পৃথিবীর সেই প্রান্তের সাথে আমার রাত যে দিন হয়ে গেছে কয়েক বছর আগেই। আমার ঘড়ির কাঁটা ঘুরে গেছে সেই দেশের সময় ধরে।

সন্ধ্যে হতেই, না ভুল বললাম; ভোর হতেই ফোন করতাম। ঘুম ঘুম চোখে বলতো, উঠছি মা, থ্যাংকইউ মা। আধা ঘণ্টা পরের ফোনে বলত ‘এখন কলেজে যাওয়ার জন্য তৈরি হচ্ছি। মা রাখছি এখন’।

আমি তাড়াহুড়ো করে বলতাম ,নাস্তা পুরোটা খেয়েছিস বাবুই, আর শোন এখন তো একটু হিম পড়েছে, স্কার্ফ, টুপি নিতে ভুলিস না‘।

‘মা এই মাথায় টুপি দিলাম, গলায় স্কার্ফ পেঁচালাম। হেসে হেসে বলত, মাগো, মা এবার রাখছি, ফিরে এসে কথা বলব’।

দুপুরে বাবুইর কোন ক্লাস থাকতো না। রুমে ফিরেই ফোনে কথা বলতে বলতে খাবার গরম করতো, ক্লাসের গল্প করতে করতে খাবার খেত।আমি জানতাম ছেলে ক্লাস শেষ করে কখন আসবে, তাই বসে থাকতাম ফোন করার জন্য।

আমার ফোন না পেলে নিজেই ফোন করে কি যে রাগ করতো। বলত, মা আমি তো রাতে তোমার সাথে কথা বলার সময় পাই না। আর তুমি অন্য কাজে ব্যস্ত হয়ে যাও?

রাগ হবারই কথা। বিদেশে নিজের খরচ মেটাতে বিকেল থেকে রাত বারোটা পর্যন্ত ক্যাম্পাসেই কী একটি চাকরি করত। আবার সহপাঠীদেরও পড়াত। বলত মা তুমি এক সময় আমাকে পড়াতে এখন আমি তাই করি।

রাগ ভাঙ্গাবার জন্য বলতাম,বাবুই ভুল হয়ে গেছে শোনা। কাজে ব্যস্ত ছিলাম না। একটু চোখ লেগে গিয়েছিল তাই ফোন করতে দেরী হয়ে গেছে বাবুই। এখন বল আজ কোন রান্নার রেসিপি নিবি। রাগ ভুলে হেসে বলত, মা আস্তে আস্তে বল, লিখে রাখি ।কাল বন্ধুদের জন্য রান্না করব ।

এসব অবশ্য কয়েক বছর আগের কথা, এখন সে চাকরি করছে। বেশ বড় চাকরি পেয়েছে বাবুই। বিয়েও করেছে বছর তিনেক আগে।।একই কলেজে পড়তো ওরা। বৌমার বাবা মা ঢাকাতেই থাকে।

তাই বিয়েটা এখানেই হয়েছিল। তখন একমাসের মত ছিল ওরা। আমার কাছেও ছিল তবে আমাদের বাড়িতে এয়ারকন্ডিসন নেই তাই বৌমার কষ্ট হত। বাবুইরও এসি’র অভ্যাস হয়ে গেছে । তাও কষ্ট করে বাবুই বউ নিয়ে নিজের বাড়িতে এক সপ্তাহ ছিল।

তারপরে বাবুই আর আসেনি।

সালমা বেগমের ঠোঁটের কোণায় যেন একটু হাসি। মৃণালের দিকে তাকিয়ে বলল, ওদের একটি মেয়ে হয়েছে। দুই বছর বয়স। এখন দেখিনি আমি। ছবি পাঠিয়েছিল। ওহ, ভাবছেন যোগাযোগ হয় কিনা?  হ্যাঁ হয়। তবে রোজ হয় না। কবে হবে জানতে পারি না তাই জেগে থাকার অভ্যাস থেকে বের হয় আসতে পারি নাই। আগে যখন জিজ্ঞাসা করতাম কবে আবার ফোন করবি?  বলতো মা, এত হিসাব করে তো বলতে পারব না।সময় করে করব আবার। তাই এখন সে কথা জিজ্ঞাসা করি না। আজকাল আমিও আর তেমন কিছু বলার খুঁজে পাই না বাবুইকে। অনেক কিছু বলার ইচ্ছে হলেও মনে হয় কি হবে বলে। তাই ঠিক এক দুই মিনিটের বেশি ফোনের লাইনে থাকা হয় না।

বাচ্চাটার আওয়াজ শুনতে পাই। বাবুই বলে ‘এই যে তোমার গ্র্যামি, হাই বল’। ব্যস ওটুকুই। আমিও বুঝে উঠতে পারি না কি বলব। আমি তো দাদু শোনা বলতে চাই। গ্র্যামি শুনলে কেমন নিজেকে চিনতে পারি না। তখন মনে হয় বাবুইটার সাথে কত দূরত্ব হয়ে গেলো। রাতের আকাশে তাকিয়ে সেই দূরত্ব মাপার চেষ্টা করি। বাবুইর সাথে দূরত্ব মাপা যায় না। এর যেন শেষ নেই।

ডাক্তার, আমার মন চাইলে আমি ফোন করতে পারি। কিন্তু একদিন কেমন বিরক্ত হয়েছিলো। অসময়ে করে ফেলেছিলাম। বুঝতে পারিনি। আসলে দিন রাতের ঘড়ির কাটা এখন আর মেলে না। যদিও আমি ঘড়ির কাটা তেমনই রেখে দিয়েছি।  তবে ওদের তো ঘড়ির কাটা ধরেই চলতে হয়।  দিনের বেলায় অফিস, বিকেলে ঘরে ফিরে কত কাজ। রাতে সময় মত না ঘুমলে যে অফিস করতে অসুবিধা হয়। এত সব কাজের পরে কি আর কতটুকু সময় থাকে আমাকে ফোন করার।

সপ্তাহে শেষে ছুটির রাতে কখন পার্টি থাকে, নয়ত কোথায় বেড়াতে চলে যায়। এইতো সময় আনন্দ করার। বাচ্চার পিছেও যে খাটনি থাকে। বাবুই যখন এসব ব্যস্ততার কথা বলে, আমি বলি, ‘বুঝি বাবা’।

বাবুই আজকাল ফোন ধরেই বলে, হ্যাঁ বল। ‘মা বল মা ‘ডাকটা শেষ কবে শুনেছি মনে পড়ে না।

ডাক্তার, ছেলেকে আমি অভাবে রাখিনি তবে খুব বেশী সচ্ছলতা দিতে পারিনি।  ওকে আমি দেশে টাকা দিয়ে পড়িয়েছি ঠিকই কিন্তু ও নিজের যোগ্যতায় বিদেশে পড়ার স্কলারশিপ পেয়েছে। বিদেশে যাওয়ার প্লেনের টিকিটটাই শুধু দিয়েছি ।এর বাইরে আমি আর কোন সাহায্য করতে পারি নাই।

না, বাবুই আমাকে বলেনি এসব কিছু।

ওর শাশুড়ি ওদের ওখান থেকে ঘুরে এসে আমাকে বলছিল, ‘আমার জামাইকে দেখলে গর্ব হয়। সবাই নাকি ওকে ‘সেলফ মেইড পারসন’ বলে। এত বড় কলেজে নিজের যোগ্যতায় স্কলারশিপ নিয়ে পড়ালেখা করেছ। আহা বেচারা ক্লাস করে আবার রাতে চাকরি করতো। নিজে রান্না করে খেত। আমার রান্না জামাইর এত পছন্দ।। বলেছে এর পরে গেলে বছর থেকে যেতে -এত ভাল ব্যবহার ছেলের। মনে হয় ওর বাবার স্বভাব পেয়েছে। আমার মেয়ে তো রোজ একবার করে আমাদের ফোন করে। প্রায় সময় জামাই ফোন কেড়ে নিয়ে কথা বলে একদম ছেলের মত করে। কি যে ভালো লাগে। বেয়ান আমার ছেলে না থাকার অভাব একদম মিটিয়ে দিয়েছে আপনার ছেলে’।

-না ডাক্তার, বাবুইর শাশুড়ির এসব কথায় আমার দুঃখ নেই। তবু উনি যান বলে বাবুই পছন্দের খাবার যে খেতে পারে।

মৃণালের চোখের দিকে তাকিয়ে সালমা বেগম বলল, আমি জানি বাবুই আমাকে ভালোবাসে। নিয়ম করে টাকা পাঠায়। মাসে একবার এখন ফোন করে। তবে কি জান ডাক্তার, তিন বছর আগে যখন এলো আমি আর আগের বাবুইকে খুঁজে পেলাম না। না আমার কাছে সেই আগের মত করে বসলো, না আমার হাত একবারের জন্য ধরল। অথচ ছেলের অভ্যাস ছিল আমার আঙুল টেনে নিজের মাথায় দিয়ে বলত এক মাত্র ছেলের মাথাটা একটু টিপে দেও না মা ।

কত রাত আমার পাসে শুয়ে সারাদিনের কত কথা বলতো। বাবাকে তো হারিয়েছে সেই স্কুলে থাকতে।আমার সাথেই ছিল সব কথা। যখন ছোট ছিল তখন বলতো, মা আমি একটা বড় বাড়ী বানাবো। তুমি আমি থাকবো সেখানে। বিদেশে যাবার আগে আমার কোলে মাথা রেখে বলেছিল মা, আর কটা বছর পর তোমাকে আর এত কষ্ট করতে হবে না। আমি তোমাকে আমার কাছে নিয়ে যাব।

-আমি বললাম ‘আর তোমার বাবার রেখে যাওয়া এই বাড়ি’?

বলল, ‘সে তখন ভেবে দেখব’। আমিও জানতাম বাবুই সময়মত ভেবেই ঠিক করবে। এ নিয়ে আমাকে ভাবতে হবে না। বাবুইর এখন সময় হয়েছে ভাবার।

বাবুই ওখানে অনেক বড় বাড়ি বানিয়েছে। আমি ছবি দেখেছি । বউমার বোন আমাকে বাবুইর বাড়ীর ভিডিও দেখিয়েছে। সুইমিং পুল, বাগান, বাড়ীর ভিতরে, বাহিরে সব কিছু এত বড়।

বাবুই ছোটবেলা থেকে সব কিছুই ‘বড়’ ভালোবাসতো। নিজের পরিশ্রমে ছেলে আমার তার স্বপ্ন পূরণ করেছে।

ভিডিও দেখে খুশিতে আমার চোখ জলে ভিজে গেলো। আমি তো তাও ছবিতে দেখলাম ওর বাবা এইটুকুও দেখতে পেলো না। আমাদের আদরের বাবুইকে নিয়ে কত স্বপ্ন যে ছিল তাঁর। কি করে যে কি হয়ে গেলো। কোন চিকিৎসার সুযোগ না দিয়ে একদিনের শরীর খারাপে বাবুইর বাবা চলে গেলো আমাদের জীবন থেকে।

ভিডিও দেখা শেষ হতেই বৌমার বোন বলল,‘আনটি, ভাইয়ার চিন্তা ভাবনা বেশ গুছানো। আপনাদের এই বাড়ি বিল্ডারের কাছে দেবার জন্য আপু আমরা তাঁকে বোঝাতেই বলল, মা মারা না যাওয়া পর্যন্ত হাত দেওয়া যাবে না। মায়ের বয়স হয়েছে। কতদিনই বাঁচাবে। একটু অপেক্ষা কর’।

বৌমা হয়ত জানে না বাবুইকে জন্ম দিতে গিয়ে আমি মরেই যাচ্ছিলাম । আমি ডাক্তারের হাত ধরে কেঁদে বলেছিলাম, আমার সন্তান যেন বেঁচে থাকে। ডাক্তার তাঁর আপ্রাণ চেষ্টায় আমাদের দুইজনকে বাঁচিয়ে ছিল। তবে আমার আবার সন্তান ধারণ  সম্ভব হয়নি ।ওই বাবুই ছিল আমাদের সব।

ডাক্তার, জানি ছেলেমেয়ের কাছে একসময় বাবা মায়ের প্রয়োজন ফুরিয়ে যাওয়াই স্বাভাবিক।

তাই আমি অনেক ভেবে দেখলাম,আমার এই বসে থাকা, রাত জাগা ছাড়া আর তো কিছু করার নেই। স্কুলের চাকরি থেকে অবসর নিলেও বাড়িতে বাচ্চাদের পড়াতাম এখন আর সেই বাবুইগুলোকেও পড়াতে পারি না। কী পড়াবো, কী শেখাবো নিজেই জানি না। যদি কোন ভুল হয়ে যায়, সেই ভয়ও হয়। অফুরন্ত সময়ে দিনের আলো রাতের আঁধারে কোন তফাৎ নেই আমার কাছে ।মনে হয় কোন এক চড়ায় আঁটকে পরে থাকা জীবন।

বাবুইর জীবনে আমি যেন একটা অহেতুক কমা’র মত হয়ে আছি।

সালমা বেগম তাঁর সাদা শাড়ির কালো আঁচলের কোনা দিয়ে চোখ থেকে একফোঁটা জল গড়িয়ে পড়ার আগেই তুলে নিয়ে বললেন, ডাক্তার আমার জীবন অনেক অপেক্ষায় কেটে গেছে। এখন একটি দিনের অপেক্ষা বাকি আছে। অপ্রয়োজনীয় মানুষের জীবন অর্থহীন ভাবে লম্বা হওয়াটা বড় অন্যায়।

মৃণাল সেনের বাড়িয়ে দেওয়া হাত ধরে সোজা হয়ে বসে বললেন,  ঘুমের ওষুধ আমি এখন খাইনি। কিন্তু আমি এখন ঘুমাতে চাই। জীবনের বাকি রাত আমি ঘুমাতে চাই।

মৃণাল সেনের ধরে থাকা হাত না ছাড়িয়ে দীর্ঘ নিঃশ্বাস নিয়ে বললেন,আমি ওর মা যেমন ছিলাম তেমনই যে আছি । আমার ছেলেও আছে। কিন্তু কেমন থাকার কথা , কি বদল হবার বা না হবার কথা সেই সবের প্রশ্ন কি হতে পারে বুঝতে পারছি না । আমি আর রাত জেগে এই প্রশ্ন খুঁজতে চাইছি না।

আমার প্রশ্নটা কী বলতে পারবে?

মৃণাল সেন ঘোলা হয়ে যাওয়া চশমার কাঁচ মুছতে মুছতে বলল, আমি কি আপনার ছেলের সাথে কথা বলতে পারি?

সালমা বেগম যেন ভীষণ আহত হলেন। বললেন ডাক্তার আমি তো নিজের ছেলের মনোযোগ, দয়ার জন্য ডাক্তারের সাহায্য পেতে আসি নাই। পৃথিবীর কোন ডাক্তার কী সন্তানকে মায়ের কথা ভাবার জন্য চিকিৎসা করতে পারে ? এর জন্য কী আজ কোন ওষুধ আবিষ্কার হয়েছে?

মৃণাল সেনের কোন উত্তরের অপেক্ষা না করে সালমা বেগম ধীরে ধীরে বের হয়ে গেলেন।

রাজিয়া নাজমী। গল্পকার। জন্ম ৪ সেপ্টেম্বর, বরিশাল; বাংলাদেশ। তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সমাজবিজ্ঞান নিয়ে মাস্টার্স এবং আইন বিষয়ে ডিগ্রি নিয়ে বাংলাদেশ বার কাউন্সিলের সনদ নেন। পেশাগত সূত্রে বর্তমানে তিনি তথ্য প্রযুক্তিবিদ হিসাবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে বসবাস করছেন।

এই বিভাগের অন্যান্য লেখাসমূহ

বালির বেহালা

বালির বেহালা

বুড়িমাসি বলেন,জীবনটা বালির ঘর গো।ঢেউ এলে ধুয়ে যায় জীবনের মায়া।তবু বড় ভালবাসা ওদের দাম্পত্যে।রোদের চাদরের…..

তদন্ত

তদন্ত

  এক ড্রইং রুমে বসে রয়েছে সদ্য কিশোর উত্তীর্ণ তরুণ গোয়েন্দা সজীব। সামনের টেবিলে ছড়িয়ে…..