ফিরে এসো
আমার বাবা ছিলেন অত্যন্ত সাহসী একজন লড়াকু মনের মানুষ।শত অভাব অভিযোগেও তাকে কোনোদিন ভেঙ্গে…..
পরীবাগের প্রথম গলিটা বেশ নির্জন এখন। দু’চারটে রিক্সা আর পায়ে হাঁটা মানুষ দেখা যাচ্ছে। রঞ্জনের ফ্ল্যাট তৃতীয় তলায়। ওর জানালার নীচেই কৃষ্ণচূড়া গাছটার শীর্ষদেশপৌঁছে গেছে। ফুল ফোটার সময়টাতে প্রতিদিন ঘুম থেকে উঠেই উপর থেকে রঞ্জন তাকিয়ে থাকে। ভর সন্ধ্যায় সেই গাছটার দিকে তাকিয়ে অনিন্দ্য কিছুভাবনায় ডুবে থাকা যায় এমন চেষ্টেইকরছিল সে। অবচেতন মনে কৃষ্ণচূড়ার সৌন্দর্য দেখার ইচ্ছেও জেগেছিল হয়তবা। এখন কৃষ্ণচূড়া নেই।বাতাসে রাঙ্গা ফুলের সম্মোহনী নৃত্য দেখতে না পেলেও গাছের ঠিক চূড়ায় প্রেমের দেবীআফ্রোদিতির নগ্ন ভাস্কর্য গুলো স্বয়ংক্রিয়ভাবে একটার পর একটা কী করে এমন ভেসে উঠছে তা বিস্ময়ের ব্যাপার হলেও রঞ্জন অবাক না হয়ে বরং মুগ্ধ হয়ে দেবীর সৌন্দর্য দেখছে আর ভাবছে একজন সুস্থ মস্তিস্কের মানুষ কীভাবে একজন নারীকে ধর্ষণ করতে পারে!
গতকালের ধর্ষণের ঘটনাটা ভুলতে পাচ্ছে না রঞ্জন। মেয়েটাকে ওরা মেরেই ফেলেছে, মানুষ কী করে এত নির্মম হয়! কিছুতেই স্বস্তি পাচ্ছিল না সে, চারুকলার সান্ধ্য আড্ডায় যেতে ইচ্ছে করেনি তার। শাহবাগ থেকে এলোমেলো হেঁটে শুধুই এক কাপ চা পান করে চলে এসেছে, তার পর থেকেই জানালায়। নিজেকে ধর্ষকের জাত বলে মনে হচ্ছে। মধুরিমার সামনে দাঁড়াতে তার খুব কষ্ট হয়, শুধু মধুরিমাই বা কেন, মেয়েদের সামনে নিজেকে সংকুচিত করে রাখছে সে। কিছুই কি করার নেই! কিছু কিছু প্রতিবাদ-বিক্ষোভ হচ্ছে। কিন্তু প্রতিকার কোথায়! দিনে দিনে এমন ঘটনা ঘটেই যাচ্ছে, ক’জন শাস্তি পায়! শুধু শাস্তি দিয়েই কি অবস্থার পরিবর্তন করা যাবে! মনোজগতের পরিবর্তনটা যে জরুরী, সেটি তো হচ্ছে না। অবশ্য এই মুহুর্তে প্রতিবাদ নিশ্চয়ই প্রয়োজন আছে। যার যার অবস্থান থেকে ঘুরে দাঁড়াতে হবে।” যার যার অবস্থান”এই তিনটে শব্দ মনে আসতেই রঞ্জনের তুলির কথা মনে পড়ে যায়। তার প্রতিবাদের জায়গা তো ক্যানভাস, প্রতিবাদ হবে ক্যানভাসে, তুলির আঁচড়ে। ভেতরের ক্ষরণটাকে নিবৃত্ত করতে তার কিছু একটা করা চাই। কিন্তু কী আঁকবে সে!
একবার ভাবলো, ধর্ষিতা নারীর কষ্টের চিত্র নিয়ে একটা সিরিজ করবে। কিন্তু আফ্রোদিতি এসে তার ভাবনাটাকে এলোমেলো করে ভিন্ন দিকে প্রবাহিত করে দিচ্ছে। তবে কি তার সাবজেক্ট হবে সৌন্দর্য! দেবী কি তা-ই বলে দিচ্ছে! ক্যানভাসে ভেসে ওঠা সৌন্দর্য বিকৃত মস্তিস্কগুলোকে তিরস্কার করবে! হয়ত তাই, তবে তার জন্য চাই ছবির জীবন্ত উপস্থাপনা, যেন মস্তিস্কের নিউরনে গিয়ে আঘাত হানতে পারে। ইজেলে ক্যানভাস সেঁটে রঞ্জন তৎপর হয়ে ওঠে, মনে মনে আওড়ায় -নৃশংসতার বিরুদ্ধে প্রেমের জাগরণ চাই। এবার কিছুটা স্বস্তির বাতাসেঅবগাহন করতে থাকে সে। ধীরে ধীরে জীবন্ত হয়ে ওঠে ক্যানভাস। চোখ-মুখ-নাক-অধর-গ্রীবা, তার পর পুরোটা শরীর জুড়ে জীবন্ত এক নগ্ন নারী স্বীয় সৌন্দর্যে বিস্ফোরিত হয়ে আছে। এযেন নর-পিশাচের বিরুদ্ধে তীব্র এক ভৎর্সনা। রঞ্জন বিস্ময় নিয়েদেখে ছবিটা মধুরিমার ছবি হয়ে উঠেছে। মুখের আদলটা তো স্পষ্টতই মধুরিমার, দাঁড়ানোর ভঙ্গিমাটা মধুরিমার, ঢেউ খেলানো শরীর বেয়ে নেমে যাচ্ছে মধুরিমারঅপরূপলাবণ্যের তরঙ্গ। তবে মুখেরঅভিব্যক্তি ঠিক সে যা চায়, তা এলো না।
তুলিতে রং নিয়ে রঞ্জন চেষ্টা করে যাচ্ছেএক্সপ্রেশনটাতার ভাবনার মতো করে ফুটিয়ে তুলতে, কিন্তু সে কিছুতেই পরিতৃপ্ত হতে পারছে না।অবশেষে না পারার কষ্ট রঞ্জনকে আহত করে, বুকের ভেতরে চিনচিনে ব্যাথা অনুভব করতে থাকে। বেশ কিছুক্ষণ চুপচাপ বসে থাকার পর সহসা একটা মিষ্টি কন্ঠস্বর তার কানে বেজে ওঠে,” কিরে, কি করছিলি?” শীতের এক টুকরো মিষ্টি রোদের মত মধুরিমার কন্ঠ তাকে যাতনা থেকে ফিরিয়ে আনে।
তিন রুমের এই ফ্ল্যাটটাতে একটা রুম নিয়ে রঞ্জন একাই থাকে, ব্যাচেলর মেস। অন্য কারো সাথে রুম শেয়ার করতে তার ভাল লাগে না। মেন ডোর বন্ধ থাকলে নিজের ঘরের দরজা বন্ধ না করলেও চলে। মধুরিমাকে অন্য দু’রুমের সবাই চেনে। তাই হঠাৎ ওর আগমনে অবাক হয়নি রঞ্জন, তবে রাতটা একটু বেশী হয়েছে বলেই চমকে গেছে সে।এসময়মধুরিমারআসার কথা নয়, তাই প্রশ্নটা মুখ থেকে বেরিয়ে যায়, মধুরিমা তুই, এতরাতে!”
আমার জন্য দিন কিংবা রাত আবার কি? আজ রাতটা তোর সাথে কাটাবো বলেই এসেছি। কি করছিলি তাই বল, হাতে তুলি কেন, ছবি আঁকছিলি?
হ্যা, ছবি আঁকছিলাম, ধর্ষণের বিরুদ্ধে একটা প্রতিবাদী সিরিজ করতে চাই, একটু ভিন্ন ভাবে।
মধুরিমা বেশ উৎসুক, যেমন!
আমি সৌন্দর্যকেই উপজীব্য করতে চাই, কষ্টের চিত্র নয়। সৌন্দর্যই ব্যঙ্গ করবে ইতরদের, বুঝিয়ে দেবে পশুত্ব নয়, প্রেম এবং সৌন্দর্যই শ্রেষ্ঠ।
মধুরিমা উৎফুল্ল, দারুণ আইডিয়া তোর, তা কিছু এঁকেছিস?
শুরু করেছি, কিন্তু প্রথমটা শেষ করতে পারছিলাম না, কষ্ট হচ্ছিল- না পারার কষ্ট।
মধুরিমা রঞ্জনের পাশে নিবিড় হয়ে বসে বলে, গত কালের ঘটনাটায় তুই যে ভীষণ আপসেট হয়ে আছিস তা তোকে দেখেই বোঝা যায়। শোন, তুই অনেক সেনসেটিভ তা আমি জানি, কষ্টটা তোর-আমার সবার, এটাকে নিজের করে নিস না। এটা একটা ব্যাধি-সেটা সমাজের, আমরা সমাজের ক্ষুদ্র একটা অংশ মাত্র।
তাই বলে আমাদের কি কিছুই করার নেই, যার যার অবস্থান থেকে আমরা কি কিছু করবো না?
সে তো করবোই আমরা, ইতোমধ্যে শুরুকরেছি, তুইও করছিস। কিন্তু তুই নিজেকে অপরাধী ভেবে যদি আমার কাছে বা সমগ্রনারী সমাজের কাছে নিজেকে ছোট ভাবিস কিংবা আত্মগ্লানিতে ভুগতে থাকিস তাহলে?
কি করবো বল! আমার ভীষণ খারাপ লাগছিল। তাইতো ছবি আঁকার বিষয়টা বেছে নিলাম, কিন্তু দেখ শেষ করতে পারছি না!
” দেখি তো কি আঁকলি” বলে মধুরিমা ক্যানভাসের সামনে গিয়ে দাঁড়িয়ে ছবিটা দেখে তারপর দু’চোখে মহাবিস্ময় নিয়ে রঞ্জনের দিকে ফিরে বলে,” কী চমৎকার! আমাকে মডেল না বানিয়েও তুই এমনটা আঁকতে পারলি!”
রঞ্জন লজ্জায় আনত হয়ে আছে দেখে মধুরিমা এগিয়ে এসে চুমু দিয়ে রঞ্জনের লজ্জা নিবারণ করে।রঞ্জন আবেগে মধুরিমাকে জড়িয়ে ধরলে মধুরিমাওওর মাথার পেছনে হাত রেখে মুখটা দু’হাতে বুকে চেপে ধরে রাখে। রঞ্জন সম্মোহিতের মত নিরবে চোখ বুঁজে ফেলে।
দরজায় বার কয়েক ঠক ঠক আওয়াজ হয়। রঞ্জন ধীরে ধীরে চোখ মেলে তাকায়। জানালা ভেদ করে প্রখর সূর্যের আলো ঘরে প্রবেশ করেছে, তার চোখ জ্বালা করছে। আবারো নক করছে কেউ। বিছানা না ছেড়েই “দরজা খোলা আছে” বলে সে। দরজা ঠেলে প্রবেশ করে মধুরিমা,” শুভ জন্মদিন রঞ্জন!” মধুরিমার হাতে এক গুচ্ছ ফুল আর একটা শপিং ব্যাগ।
রঞ্জন লাফিয়ে বিছানা ছেড়ে মেঝেতে নামে এবং অবাক বিস্ময়ে প্রশ্ন করে, তুই! কখন গেলি?
গেলাম মানে, কি বলছিস রঞ্জন! তুই ঠিক আছিস তো?
রঞ্জন একবার ক্যানভাসের দিকে তাকায়, নিজের হাতে ধরা তুলির দিকে তাকায় আবার মধুরিমার দিকে তাকায়, “তুই রাতে এসেছিলি না, তাই বলছি, কখন গেলি!
মধুরিমাওবেশ অবাক হয়ে রঞ্জনকে দেখে। ক্যানভাসে তাকিয়ে দেখে সমাপ্ত প্রায় মধুরিমার ছবি, রঞ্জনের হাতে তুলি। ওর বুঝতে বাকী রইল না যে ছবি আঁকতে গিয়ে রঞ্জনের অবসেশন হয়েছিল রাতে এবং ভাল ঘুম হয়নি, তাই এত বেলাতেও বিছানায়।মধুরিমা রঞ্জনকে স্বাভাবিত থাকতে সাহায্য করে, সে দ্রুত বলে ওঠে, “তুই তাড়াতাড়ি শাওয়ার নিয়ে এই পাঞ্জাবিটা পরে আয়, এলিফেন্ট রোডে মালঞ্চে গিয়ে নাশতা করবো, অনেক দিন ভুনা মাংস দিয়ে পরোটা খাইনা। ওখান থেকে যাবো বকুল তলায়, আড্ডা শেষেহাঁটতে হাঁটতে যাব নান্না মিয়ার দোকানে-দুপুর বেলা মোরগ পোলাও খাওয়াবো তোকে, ফিরে এসে বিশ্রাম।
রঞ্জন এক নাগাড়ে বলে যাওয়া কথা গুলো শুনছিল, তখনো ওর ঘোর কাটেনি। সে বলে,” এত এত পরিকল্পনা! তোর অফিস নেই আজ?”
জ্বী না মশাই, আজ পুরোটা দিন তোর সাথে আছি, ছুটি নিয়েছি, তোর জন্মদিন বলে কথা! তাড়াতাড়ি যা শাওয়ার নিয়ে আয়, সময় নষ্ট করা যাবে না।
রঞ্জন শাওয়ার নিতে গেলে, মধুরিমা ক্যানভাসের সামনে দাঁড়িয়ে ছবিটা স্পর্শ করে। তার ভিতরে ভিন্ন রকম এক ভাললাগা অনুরণন তোলে। বার বার সে তার নিজের ছবিটা ছুঁয়ে দেখতে থাকে আর শিহরিত হয়। রঞ্জনের প্রতি তার গাঢ় প্রণয়ের মাত্রা বেড়ে যায় বহুগুণ। সেই সাথে বিস্ময় লাগে রঞ্জন কী করে এমন হুবহু তার শরীর চিত্রিত করে ফেললো! তার ভীষণ ইচ্ছে করে নিজের শরীরের পুরোটাই ছবির সাথে মিলিয়ে দেখতে।কিন্তু লজ্জা পায়, যদি হঠাৎ রঞ্জন বেরিয়ে আসে! তখাপি তার ভেতরের দুর্দমনীয়কামনা তাকে নিবৃত্ত করতে ব্যর্থ হয়। উত্তেজনায় সে তার বুকের আবরণ সরিয়ে ক্যানভাসের ছবিরে সাথে মিলিয়ে দেখতে থাকে,যেন এক রোমাঞ্চকর খেলায় মত্ত হয় সে। তার সমস্ত শরীর বেয়ে একটা শিরশিরে বিদ্যুৎ তরঙ্গ খেলে যায়। সহসা রঞ্জনের কথা মনে হতেই নিজেকে আবার সামলে নেয় মধুরিমাএবংরঞ্জনের বেরিয়ে আসার শব্দে সচকিত হয়।
রঞ্জনের গায়ে মধুরিমার দেয়া পাঞ্জাবিটা বেশ মানিয়েছে। শাওয়ার নিয়ে বেরুনোর পর ওকে খুব সুন্দর পরিপাটি দেখাচ্ছে। মাধুরিমার ইচ্ছে হলো রঞ্জনকে জড়িয়ে ধরে ওর প্রশস্ত বুকে মাথা রাখে। কিন্তু কি ভেবে নিজেকে সামলে নিলো।মধুরিমা শাড়ি পরেছে হালকা গোলাপী রংয়ের, শাড়িতে হ্যান্ড পেইন্ট, কপালে ম্যাচিং টিপ। রঞ্জন মুগ্ধ হয়ে বার কয়েক তাকালেওখুব বেশীক্ষণ সেই আকর্ষণটা থাকছে না।
এলিফেন্ট রোডের মালঞ্চে বসে সকালের নাশতা সেরে ওরা রিক্সায় শাহবাগে চারুকলা ইনস্টিটিউটেচলে আসে।মধ্যাহ্নের আগে জায়গাটা বেশ নির্জন হয়ে আছে। শিক্ষার্থীরা নিজ নিজ সেশনে ব্যস্ত, মধুরিমা এমনটাই চেয়েছিল। বকুল গাছের নীচে বসে রঞ্জনের একটা হাত নিজের কোলের মধ্যে ধরে রাখে সে। বকুল ফুলের তীব্র মাতাল করা ঘ্রাণে পুরো চত্বর ম ম করছে। রঞ্জনকে নানা কথায় ধর্ষণের ঘটনা থেকে বের করে নিয়ে আসতে সচেষ্ট হয় মধুরিমা। সেই সাথে নিজের ছবিটার সাথে তার ছেলেমানুষী আচরণের কথা ভেবে পুলক অনুভব করে সে। ছবিটা নিয়ে রঞ্জনের সাথে কথা বলতে চাইছে কিন্তু বার বার চেষ্টা করেও সে লজ্জাকে অতিক্রম করে প্রসঙ্গ উত্থাপন করতে পাচ্ছে না। আবার এমনটাও ভাবছে যদি ছবির প্রসঙ্গ এলে রঞ্জন ধর্ষণের ঘটনাটা নিয়ে আরও বেশী ভাবতে থাকে, তাহলে রঞ্জনকে সেই ভাবনা থেকে বের করে আনার যে চেষ্টা, তা ব্যর্থ হয়ে যাবে। তাই মধুরিমা আর সে পথে এগুলো না, নিজের ভিতরেআন্দোলিত হতে থাকাতীব্র পুলক মনের ভেতরেই চেপে রাখল সে। বিশেষ করে এটা দেখে যে, মধুরিমার সঙ্গ পেলে রঞ্জন যতটা উৎফুল্ল থাকে, আজকের এই বিশেষ দিনে মধুরিমাকে একান্তে পেয়েও সে তেমনটা উৎফুল্ল নেই।
দুপুর গড়াতে শুরু করলে ওরা হেঁটে চানখাাঁর পুলের দিকে এগিয়ে যায় এবং নান্না মিয়ার দোকানে দুপুরের খাবার সেরে রিক্সা করে রঞ্জনের রুমে আসে। পুরো সময় ধরে রঞ্জন বেশআনমনাই থাকলো। মধুরিমার বুঝতে সমস্যা হচ্ছে না যেরঞ্জন ধর্ষণের ঘটনাটা থেকে কিছুতেই বেরিয়ে আসতে পারছে না। নিশ্চয়ই এখনো সে ছবিটা নিয়েই তার পরিকল্পনার কথা ভাবছে, রাতেও অনেক কিছু ভেবেছে এবং নির্ঘুম কাটিয়ে সকাল বেলা ঘুমিয়েছিল। রাতের সেই ঘটনাটা নিয়ে রঞ্জনকে বিব্রত করতে চায়নি মধুরিমা, বরং সারাদিন সঙ্গ দিয়ে ওকে স্বাভাবিক করতে চেয়েছিল। কিন্তু কিছুমাত্র পেরেছে বলে তার মনে হচ্ছে না। তাই সে প্রসঙ্গটা উত্থাপন করেই বসে-
আমাকে ছাড়াই ছবিটা এত চমৎকার ফুটিয়ে তুলতে পারলি কি করে, বলতো?
পারলাম আর কোথায়, যা চাইছিলাম, তা এখনো হয়ে উঠলো না। অমি চেয়েছি এমন একটা এক্সপ্রেশন ফুটিয়ে তুলতে, যা ব্যঙ্গ করবে ধর্ষকামীদের।
মধুরিমা নিশ্চিত হলো তার ধারণাই ঠিক, রঞ্জন যদিও তাকে সঙ্গ দিচ্ছে কিন্তু তার মন পরে আছে ক্যানভাসে। সে রঞ্জনকে জড়িয়ে ধরে বলে,” আমি আছি তোর সাথে, তোর সব কষ্ট শুষে নেব আজ। কিন্তু সেই এক্সপ্রেশনটা কি আমার মাঝে পাবি!”
রঞ্জনের কানের কাছেরমধুরিমার মুখ,সে শুনতে পায় মধুরিমার ক্ষীণ অথচ স্পষ্ট কন্ঠস্বর,” চল, আজ আমরা সব দূরত্ব অতিক্রম করে হারিয়ে যাই।”
অতঃপর ভরা নদীতে বান ডেকে যায়, সাগর হয়ে ওঠে উত্তাল, উঁচু উঁচু ফেনিল ঢেউ দিগন্ত ছুঁতে ছুটে চলে অবিরাম।
ওরা একান্তে মিলিত হবার পর মধুরিমার চোখে মুখেআশ্চর্য এক আলোর আভা দেখে রঞ্জন।মন্ত্রমুগ্ধ হয়েঅনড় দৃষ্টিতেতাকিয়ে থাকে সে, যেন স্বর্গ থেকে এইমাত্র নেমে এলো দেবী আফ্রোদিতি! রতিক্লান্ত-পরিতৃপ্ত-অবসাদগ্রস্থ এবং একই সাথে তীব্র কামাতুর, যার মুখাবয়ব সকালের সোনালী রোদের ঔজ্জ্বল্যে চক চক করছে আর তার দ্যূতিছড়িয়ে পড়েছে সর্বত্র। যা দেখে রঞ্জন নেশাগ্রস্থের মত তাকিয়ে রইল।
মধুরিমা রঞ্জনের চোখে চোখ রেখে বলে,” পাগলের মত অমন করে কি দেখছিস?
তা পরে বলছি, তার আগে বল তোর এই মুহূর্তের অনুভূতি কি?
তুই আজ আমাকে যা দিলি তার কোন তুলনা হয়না রঞ্জন, আমি তোর কাছে আজীবনের জন্যবাঁধা পড়ে রইলাম। আমাদের উপ-মহাদেশের অধিকাংশনারীএই আস্বাদ সারা জীবনেও একবার পায়না, অজান্তেই বার বার ধর্ষিত হয় শুধু। আদর কি,কেমন তার অনুভব- তা ওদের কাছে অজানাই থেকে যায়।
রঞ্জন বলে, তুইও আমাকে যা দিয়েছিস তার মূল্য অপরিসীম, আমি যা পেয়েছি তা কি একজন ধর্ষকামী বা ধর্ষক কখনো পায়!
নিশ্চয়ই পায়না। বিকৃত মানসিকতার পশুরাই শুধু নারীকে ধর্ষণ করার কথা ভাবতে পারে। এবার বল কি দেখছিলি?
রঞ্জন আবেগাপ্লুত হয়ে বলে,” মধুরিমা, কাল রাত থেকে যা খুঁজে ফিরছি সেই এক্সপ্রেশনটা এখন তোর চোখে-মুখে দেখছি আমি। ধর্ষকেরা কী করে বুঝবে এই অভিব্যক্তিকখন-কীভাবেনারীর মুখে ফুটে ওঠে! ছবিতে তোর মুখটা তোর এই মুহূর্তের যে সৌন্দর্য ঠিক এভাবেই ফুটিয়ে তুলতে চেয়েছি।তোর মাঝে স্বর্গীয় অরোরা বোরিয়ালিসের সৌন্দর্য দেখছি আর ভাবছি পাষন্ডের দল আমার চোখ দিয়ে কেন নারীকে দেখে না! ওদের চোখ নির্যাতিতারবেদনার্ত নীলমুখ সহ্য করে কী করে!”
মধুরিমা আপ্লুত হয়, রঞ্জনকে প্রগাঢ় এক চুমু দিয়ে বলে, তবে আর দেরী কেন, ছবিটা শেষ করএখনই। আমি এভাবেই তোর মডেল হয়ে আছি।
মধুরিমার শরীরবেষ্টনী থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে রঞ্জন তুলিতে রং লাগায়।তার ক্যানভাসে ধীরে ধীরে মূর্ত হয়ে ওঠে মধুরিমার সেই দ্যুতিমাখা মুখাবয়ব,যা দেখে দুজনেই বিস্ময়ে হতবাক,একে অপরকে দৃঢ়ভাবে আলিঙ্গন করে। এরপরমধুরিমা তার আপন শরীরের সমস্ত সৌন্দর্য রঞ্জনের ক্যানভাসে ফুটিয়ে তুলতে নিরাভরণ হয়ে অপরাহ্নথেকে সন্ধ্যে অব্দি কাটিয়ে দেয়, তবুও আঁকা শেষ হয় না। প্রথম ছবিটা মনঃপুত হলে রঞ্জন নেশাগ্রস্থের মত সিরিজ ছবি আঁকতে থাকে। রং আর তুলির সমন্বয়ে তার ক্যানভাসে একের পর একআঁকা হতে থাকে মধুরিমা নামক এক নারীরকাব্যিক সৌন্দর্য।রঞ্জনের কানে ক্রমাগতবেজে চলে প্রেমের দেবী আফ্রোদিতির খিলখিল হাসির শব্দ আর তার সাথে খোলা জানালা দিয়ে মৃদু লয়ে ধেয়ে আসা সাঁঝোত্তীর্ণহিম হিম নির্মল বাতাস তার চিত্তকে করে তোলেতীব্র মোহাচ্ছন্ন।
আমার বাবা ছিলেন অত্যন্ত সাহসী একজন লড়াকু মনের মানুষ।শত অভাব অভিযোগেও তাকে কোনোদিন ভেঙ্গে…..
ভার্সিটির বাস ধরতে হয় আমাকে খুব সকালে। বাড়ি থেকে একটু হেঁটেই রিকসা। তারপর বাস। হাঁটা…..
আজকের সন্ধ্যাটা থমকে যাওয়া মেঘেদের। ঝিরিঝির বৃষ্টি ছিল দিনভর। ঢাকা শহরের পথঘাট জল কাদায় মাখামাখি।…..
জোছনা করেছে আড়ি আসে না আমার বাড়ি গলি দিয়ে চলে যায়, গলি দিয়ে চলে যায়…..