রইদে পোড়া বরিক ঘেরান   

হিমাদ্রী চৌধুরী
ছোটগল্প
Bengali
রইদে পোড়া বরিক ঘেরান   

রইদে পোড়া বরিক ঘেরান   

উঠান লাগোয়া লম্বা মতো চিকন গাব গাছটা দ্যাখলেই আমেনার মনটা হুহু কইরা উঠে।প্রত্যেক দিন সকালে ঘুম থেকে উইঠা কয়লার গুঁড়া দিয়া দাঁত মাজতে মাজতে নিয়ম কইরা সে কিছুক্ষণ দাঁড়ায় এই গাছটার নিচে, হয়তো তখনো তার শরীর ভর্তি লাইগা থাকে নুরু মিয়ার ঘাম অথবা রাতের জঙ্গল হইতে উইড়া আসা আদীমকলের শিরশিরানি।
নুরু মিয়া লোকটা সুবিধার না।সারাদিন ক্যারাম বোর্ডের ক্লাবে পইড়া থাকে।নাওয়া খাওয়া বাদ দিয়া একটার পর একটা বাজি লাগায়,কোনদিন হারতে হারতে শামুক হইয়া যায়,আবার কোনদিন বৃহস্পতি চাঙ্গা হইলে মুখে বিড়ি লাইয়া বাসায় ফিরে।
নুরু মিয়ার অন্য একটা আসক্তিও আছে।আজাগায় কুজাগায় যায়, খারাপ মাইয়া মানুষের লগে ঢলাঢলি করে।বিয়ার প্রথম প্রথম স্বাস্থ্য চেহারা বেশ নাদুস নুদুস ছিলো,কিন্তু দিনকেদিন নদীর ভাটার মতোন টান লাইগা আছে। তারে নিয়া আমেনার বহু অভিযোগ, কিন্তু নুরু কথা শোনেনা।রাত বাড়লেই বিড়ালের স্বভাব চর্চা করে, গায়ে গা লাগায়া বসে, মিষ্টি মিষ্টি কথা কয়
আমেনার বিয়ার আগে মতির সাথে সম্পর্ক আছিলো,মানে লোকে যারে পিরিত বলে তেমন সম্পর্ক।পূর্ণিমার চাঁদ পানির লগে মিলন করা সময় অপূর্ব সেই রুপ ছুঁইয়া কসম কাটছিলো দুইজন “পরজন্মেও চুম্বকের মতো লাইগ্যা থাকবো ছায়ায় ছায়ায়”।
তখনো আমেনা ঠিকঠাক যুবতী হয় নাই, ঠোঁট জোরা কুয়াশার ভিতর আশ্চর্য বাত্তির মতো জ্বলজ্বল করতো।মতি খুউব সুন্দর বাঁশি বাজাইতো, কালো পেটা শরীর তার, হাতের বাঁশিটাও কৃষ্ণ রঙের।পিরিত গাঢ় হইতে হইতে আমেনাও যুবতী হইয়া উঠলো,আর মতি গান বাঁধলো আমেনার পায়ের নুপুর ছুঁইয়া —
        (আসমানের তুন কন্যা আমার বাঁশিতে ভর
        করে, শরীর আমার বাঁশি হইয়া আসমানেতে
        উড়ে।কন্যা আমার বাশিরে সুরে, আন্ধারো
        ফাঁক করে…)
হঠাৎ একদিন মতির লাশ পাওয়া গেলো রথখোলা খালের পাশে এক লম্বা মতো গাব গাছের নিচে,মইরাও ড্যাব ড্যাব কইরা তাকায়া ছিলো গাছের দিকে।তারপর এই নিয়া বহু তদন্ত হইছে কিন্তু কিনার হয়নাই মোটেও।
তেইশ বছর বয়সে এক সন্ধ্যায় আমেনার বিয়া হইয়া যায় নুরু মিয়ার সাথে।প্রথম যেদিন নুরু তার বুকে হাত দেয়, আমেনা দেখে নুরুর চোখে উথালপাতাল ঢেউ।আমেনা ভয় পাইয়া নিজেরে গুটায়ে লয় আর আর নুরু ঘনঘন শ্বাস ফালায় আর কয় “কড়া আতরের লাহান মিডা তোর বুকের গন্ধ রে বউ।আমারে জোছনা দেহাবি?” ছলাৎ কইরা উঠে আমেনার বুক, আমেনা আর প্রতিরোধ করেনা, সব ছাইড়া দেয়,য্যানো বাঁধ ভাইঙা পঞ্চাশ বছর পর বান নামছে।আমেনা ভাবে মতির কথা, তার নিশপিশে কালো হাতের কথা।চারধারের বাতাসে ভাসতে থাকে মতির কন্ঠ ” তোর বুকে মিডা আতরের গন্ধ রে, আমু”। হ্যাঁ, মতি আমেনারে আমু ডাকতো, তার মুখেই বুকের আতরগন্ধের কথা প্রথম শুনছিলো আমেনা।মতি মিয়া শিরার বান খুইল্যা খুইল্যা সাঁতার কাটে, আমেনা মতির ভিতর ডুব দিয়া স্মৃতির রইদ পোহায়।তার মনে হয় রথখোলার খালের পাশের গাবগাছটার নিচে শুইয়া শুইয়া মতি তারে ডাকে।আমেনা ঝাড়া দিয়া সরায়া দিতে চায় নুর মিয়ার আশটে শরীর,গোঙায়।আন্ধারের মধ্যে একটা হাত তার মুখ চেপে ধরে, হাতের মধ্যে বরিকের ঘেরান…
তারপর থেকে প্রত্যেকদিন সকালে ঘুম থেইকা জাইগা দাত মাজতে মাজতে আমেনা বাড়ির গাব গাছের নিচে খাড়ায়। সকালের মিডা রইদ,  বাদলা বা শৈত্যের হা, — আমেনা খাড়াইবোই কোনকিছুর তোয়াক্কা না কইরা।এখানে আসলেই আমেনা দেখে ক্যামন কইরা চক্ষু দিয়া রইদ নামে,রইদের মধ্যে বরিক পোড়া ঘেরান।
নুরু মিয়া হাঁক ছাড়ে, — কইরে বউ? সক্কাল সক্কাল তোরে কি পেত্নী কিলায়?
আমেনা হাসে,তয় হিহি কইরা না।সেই হাসির লগে মিইশ্যা যায় লুকাইন্যা চিক্কুরিয়া গান, স্মৃতির সৌধে রঙবাত্তির চিলিক…

হিমাদ্রী চৌধুরী। কবি ও শিক্ষার্থী। জন্ম ও বাস বাংলাদেশের ঢাকায়। লেখাপড়া করছেন ইংরেজি সাহিত্যে। তিনি স্বপ্ন দেখেন পৃথিবী হবে ক্ষুধা ও বৈষম্যমুক্ত। তিনি বিশ্বাস করেন, ভুল বোধের প্রাচীর ভেঙে একদিন আলো আসবেই।

এই বিভাগের অন্যান্য লেখাসমূহ