রক্তে একাত্তর

স্বর্ণাভা হাসান
ছোটগল্প
Bengali
রক্তে একাত্তর

‘জল পড়ে পাতা নড়ে
তাহার কথা মনে পড়ে’

কাহার কথা? কার কথা মনে পড়ে? সারা বাড়ি ম ম করছে ঘ্রাণে। বিরিয়ানী রান্না হচ্ছে। বেলি। না ফুল না। একজন রমনী। বয়স অনুযায়ী পৌঢ়া। কিন্তু আজ যে মেহমান এসেছে তারা যেন তার শৈশব-কৈশোর আর যৌবনের দিন তার সামনে নিয়ে এসেছে। স্মৃতির পর্দা তুলে যেন সেই ধুলোমাখা শহরে ফিরে যাচ্ছে সে। অথবা সে শহরই যেন তার সামনে হাজির হয়। ধুলোভর্তি একটা শহর। কেমন যে ধুলোমাখা একটা গন্ধ। গরু মহিষের গাড়ি ভোর হতেই ক্যাচ ক্যাচ শব্দে নানান পণ্য নিয়ে আসতো। হেই হেই। হ্যাট হ্যাট।

বাওকুমটা বাতাস যেমন ঘুরে ঘুরে ফাগুনের আগমনী বার্তা শোনায় তেমনি ফাগুনের আকাশে সূর্য তাপের সাথে পলাশে রঙ লেগেছিলো। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে যারা পড়তো তেসরা মার্চের গোলাগুলির পর তাদের কেউ কেউ ফিরে এসেছিলো। কেউ রাজশাহীতেই আত্মীয়-স্বজনের বাসায় চলে যায় গোলাগুলির পর।

‘কতবারও ভেবেছিনু আপনা ভুলিয়া
তোমারও চরণে দেবো হৃদয় খুলিয়া।‘

সমীর কুমার কুন্ডু। গান করতো। রবীন্দ্র সঙ্গীত। গায়কীতে একদম যেন সাগর সেন। আরো ছিলো বেলি, লিলি, ডলি। তিন বোন। অপূর্ব সুন্দরী। বেলির গানের গলা খুব মিষ্টি। লিলি বেলি স্কুলের উঁচু ক্লাসে পড়ে। ডলি সিক্সে পড়ে। শহর উত্তাল করে তোলে এরা গানে কবিতায়। ছোট এক শহর। ট্রাকে মঞ্চ বানিয়ে এখানে ওখানে গান করতো ওরা সকলে। মাইক ছাড়াই গলায় জোড় তুলতো। হারমোনিয়াম গলায় বেধে ঢোলের সাথে। কেমন এক মায়ার বাধনে বাধা সবাই। ভাওয়াইয়া গানের সুরে মন মাতোয়ারা।

‘মৃত্যুর উত্তাল সমুদ্র পেরিয়ে
জীবনের তীর খুঁজে পেয়েছি’

‘তীরহারা এই ঢেউয়ের সাগর পাড়ি দেবো রে।
আমরা কজন নবীন মাঝি -হাল ধরেছি।‘

ডাক্তার আজিজ সাহেবের বাসায় গানের আসর বসতো ছুটির দিন বিকালে। সমীর কুন্ডু যখন গান করতো সবাই বলতো ‘সাগর সেন’। একই পাড়ায় আসিফ নামের এক যুবকের বাসা। ফুড কন্ট্রোলারের ছেলে। কলেজে পড়তো।

আজাদ সাহেবের বাসার আশেপাশে যুবকদের আনা গোনা বেশী। তবে আসিফকে দেখলে আর কেউ এদিকটা মাড়ায় না। দুই দুইজন উঠতি তরুণী সুন্দরী কন্যা আজাদ সাহেবের। শহরের আরেক যুবক কিবরিয়া। কলেজে পড়ে। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের সাত মার্চের ভাষণ শুনে সব প্রেমিক যুবকরা কোথায় যে চলে গেলো কেউ কিছু আঁচ করার আগেই। ১৯৭০/৭১ এ একদল তরুণ-তরুণী নীলফামারী শহরে গান গেয়ে মিছিল করে উত্তপ্ত করে রাখতো। একাত্তরের সাত মার্চের ভাষণ রেডিওতে প্রচারের পর সমীর কুন্ডু গিয়ে এসডিও অফিসে উড়ানো পাকিস্তানের চাঁদ-তারা পতাকায় আগুন ধরিয়ে দিলো। এমনই দুর্ধর্ষ দুঃসাহসী ছেলে। যুদ্ধের ডামাডোল বাজতে না বাজতেই এই যুবকরা ঝাঁপিয়ে পড়লো যুদ্ধে। আজাদ সাহেবের দুই ছেলে ছাত্র ইউনিয়ন করতো। ওরাও যুদ্ধে চলে গেলো। তিনি যক্ষা রোগী। শয্যাশায়ী। তিন মেয়ে আর স্ত্রীসহ বাসায় থেকে গেলেন। তার ছেলেরা মুক্তিবাহিনীতে যোগ দিয়েছে। এই অপরাধে বিহারিদের নজরদারিতে পড়ে গেলেন। ইতোমধ্যে শহরে পাকসেনারা এসে গেছে। তাদের আর পালানোর উপায় নাই।

পাকআর্মির মেজর একদিন আজাদ সাহেবের বাড়ি আসবে। খবরটা কীভাবে যেন পৌঁছে গেলো আজাদ সাহেবের বাসায়। বেলি লিলিরা বাড়ি থেকে পালালো। পাশেই ছিলো খাদ্য নিয়ন্ত্রকের বাসা। মাঠের উল্টোদিকে। ছোট শহর। সবাই জানতো ওই বাড়ির ছেলে আসিফের সাথে বেলির প্রেম। আসিফ বেলিকে মাতৃমঙ্গলের কাঠের আলমারির ভেতর লুকিয়ে রাখলো। বিহারীরা মেজর সাহেবকে আসিফদের বাসায় নিয়ে আসে। কে যেন দেখিয়ে দেয় পাশেই মাতৃমঙ্গল। পিল পিল করে বুট পরা আর্মিরা মাতৃমঙ্গলে ঢুকে ওদের খুঁজতে থাকে। আলমারির ভেতর নিশ্বাস বন্ধ করে বসে আছে বেলি। শেষমেষ কাঠের আলমারির পাল্লা খুলে পাক সেনারা বের করে আনে বেলীকে। ধরে নিয়ে যায় ক্যাম্পে। পরে আর্মির জীপ বাসায় নামিয়ে দিয়ে যায়। শোনা যায় ওই মেজর নাকি দয়ালু ছিলো। ওদের ছেড়ে দিয়েছিলো। তবে ওদের নজরবন্দি রাখা হয়। বলে দেয়া হয় ওরা যেন কোনভাবেই বাসা ছেড়ে কোথাও না যায়।

একদিন মধ্যরাতে ওরা তিন বোন আজিজ ডাক্তার সাহেবের বাসায় উঠোনের দিকে দরজা ধাক্কা দিতে থাকে। হাসিনা বেগম দরজা খুলে ওদের আশ্রয় দেন। উনি আজিজ ডাক্তার এর স্ত্রী। ওদেরকে ধানের ডুলীর ভেতর লুকিয়ে রাখলেন। সরকারি ডাক্তার হওয়ার কারণে তখনো শহরের বাসায় ছিলেন।

-ডাক্তার ছাহাবজী দরওজা খুলিয়ে।

জোরে জোরে করাঘাত করে ডাকতে থাকে। ডাক্তার সাহেব দরজা খুলে দেখেন বিহারীরা। তাদের মধ্যে কয়েক জন রিকশাওয়ালা। ওদের হাতে লাঠিসোটা।

-ছালাম ছাবজী।

-কী ব্যাপার?

স্যার আজাদ ছাবকো তিন লাড়কি আপকা ঘর মে আয়া?

-আরেহ না। না না। আমার বাসায় সবাই ঘুমে। পিছনের দরোজা বন্ধ। আসো ভিতরে, দেখো।

-ছালাম ছাব এই চল্ চল্।  হাম বোলা না গোপাল বাবুকা ঘর মে চেক করো।

ওরা হুর মুর করে চলে গেলো পাশের হিন্দু বাড়িতে খুঁজে দেখতে। গোপালদের বাড়ি খালি পড়ে আছে। মার্চের প্রথম দিকে গোপালবাবু ওর বাবা মাসহ ভারতে চলে গিয়েছিলো। আর তার দিদিকে পাঠিয়ে দিয়ে ছিলো আরো আগে। আজিজ ডাক্তার সাহেব দরজা বন্ধ করে চুপচাপ ইজি চেয়ারে শুয়ে সিগারেট টানতে লাগলেন। তার ছেলে মেয়েরা ঘুমাচ্ছে। বড় ছেলে ক্লাস ফোরে পড়ে। তারপরের ছেলে থ্রিতে। মেয়ে একজন টুয়ে। আর ছোটটি ওয়ানে। শ্বাশুরী মা আছেন সাথে। উনার স্ত্রী এসে বসে আছেন পাশে। তার ভয়ার্ত দৃষ্টি।

-আবার আসবে নাকি? ফিসফিসিয়ে জানতে চান।

-না ওরা আসবে না। ওরা আমার কাছে ওষুধ চিকিৎসা পায়। আমাকে মানে।

রাতে আর ঘুমালেন না। হাসিনা বেগম বেলি, লিলি, ডলি মেয়ে তিনটাকে নিজেদের বিছানায় শুয়ে থাকতে বললেন।

ঘন ঘন বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে। আকাশ ভেঙ্গে বৃষ্টি নামলো। আসিফ নামের ছেলেটা সাথে আরো কয়েকজনসহ এসে তিনবোনকে নিয়ে গেলো। বর্ডার ক্রস করে হলদিবাড়ি রেখে আসলো। আমজাদ সাহেব আর উনার স্ত্রী ওই বাসায় থাকলেন। সেদিন বিহারিদের ওই বাসায় ঢুকে ভাংচুর করতে দেখলো সবাই।

‘জয় বাংলা বাংলার জয়
হবে হবে হবে হবে নিশ্চয়’

বাংলার জয় এসেছিলো। নূতন ভোর এসেছিলো ঠিকই। বাংলাদেশ নামের দেশটি তখনো শিশু। ওই শহরের এসডিও অফিসে একদিন বাংলাদেশের সবুজের মাঝে লাল বৃত্ত আঁকা পতাকা উড়লো। কিন্তু সমীর কুন্ডুও আর ফিরেনি। এই পরিবারটিও আর নীলফামারী ফিরে আসেনি। আজাদ সাহেবের বাড়িটি অন্য একজন কিনে নেন। আর বাংলাদেশ এর অন্য এক মহকুমায় আজাদ সাহেব তার স্ত্রী ও পরিবার নিয়ে চলে গেলেন। বেলি লিলিরাও আর ফিরেনি এই শহরে। ফিরেনি আসিফও। শুধু কিবরিয়া অস্ত্রহাতে ফিরেছিলো।

দুইহাজার বারো সাল।

নিউজার্সির এক বাসায় বেড়াতে যাই। ঘরময় বিরিয়ানী খুশবু ছড়িয়েছে। বেশ স্বাস্থ্যোজ্জ্বল বিড়াল পেয়ে কন্যা আমার খুব খুশী। বিড়ালটির সাথে তার ভাব হয়েছে। জলপাইগুড়ির বিলু খালার ভাই তারামামার সাথে বিয়ে হয়েছিলো বেলি খালার। তার মামাদের ডুয়ার্সে চা বাগান ছিলো একসময়। এখানে সুখের সংসার। চল্লিশবছরের কাছাকাছি যুক্তরাষ্ট্রে থাকেন। তাদের এক মেয়ে ডাক্তার। দুই ছেলে এমবিএ করেছে। ছেলেরাও সব কর্পোরেট জব করেন।

স্বাধীনতার পঞ্চাশবছর পূর্তিতে এখনো কী তাদের মনে পড়ে সেই বেদনা বিধুর দিনগুলি? বেলিখালা ডাক্তার আজিজ সাহেবের ছেলেকে

‘তীর হারা ঐ ঢেউ এর সাগর পাড়ি দেবো রে’

গানটি গাইতে বললেন। নিশ্চয়ই স্মৃতির কপাট খুলে মনে পড়েছে আগুনের হল্কা লাগা দিনগুলো।

স্বর্ণাভা হাসান (ছদ্মনাম)। লেখক। জন্ম বাংলাদেশে। পেশাগতসূত্রে বসবাস করেন উত্তর আমেরিকায়।

এই বিভাগের অন্যান্য লেখাসমূহ