রক ইউ কান্ট্রি সিস্টেম

মাসকাওয়াথ আহসান
ছোটগল্প, রম্য রচনা
Bengali
রক ইউ কান্ট্রি সিস্টেম

চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের গজদন্তের মিনারে বসে উন্নয়ন ভাইরাসেরা ডিজিটাল সুখে চোখ বুঁজে জিডিপির গান গাইতে থাকে। মোটিভেশনাল ভাইরাসেরা আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স আর এলগরিদমের গাল ফুলিয়ে বলে, হে তরুণেরা ২০৫০ সালের জব-মার্কেটের জন্য নিজেকে প্রস্তুত করো; মনে রাখবে জগতে টাকাটাই প্রাসঙ্গিক; বাকিসব অপ্রাসঙ্গিক; তাই সিক্স ডিজিট আর সিক্স প্যাক অর্জন করতে আমাকে সাবস্ক্রাইব করো।

করোনা ভাইরাস এসে মোটিভেশন ভাইরাসকে বলে, টাকা থাকলে সবাইকে কেনা যায়; কেবল করোনাকে ছাড়া। এরপর করোনা অবিরাম গাইতে থাকে, রক ইউ কান্ট্রি সিস্টেম।

উন্নয়ন ভাইরাস এতে ভীষণ ক্ষিপ্ত হয়, এতো বড় সাহস তোমার; সিস্টেমকে চ্যালেঞ্জ করছো! কোথাকার কোন নবাবজাদা তুমি হে! সিস্টেমকে রক ইউ বলছো।

করোনা ভাইরাস আরো বেপরোয়া হয়ে যায়, মাস্টার্স করা উন্নয়ন ভাইরাসদের শুইয়ে দিলাম বেজিং-এ, তেহেরানে, রোমে, বার্লিনে, লন্ডনে। আর আপনি গ্র্যাজুয়েশনের পরীক্ষার্থী একজন উন্নয়ন ভাইরাস এতো নবাবি দেখাচ্ছেন কেন!

উন্নয়ন ভাইরাস সমাগত সবাইকে আশ্বস্ত করেন, করোনাকে ভয় পাবার কিছু নেই। ঠিকই পরাস্ত হবে আমাদের অদম্য দেশপ্রেমের কাছে।

দেশপ্রেম শব্দটি শুনেই অনুপ্রাণিত হয়ে সামনে এগিয়ে আসে গণতন্ত্র ভাইরাস। সহাস্যে বলে, আল্লাহর রহমতে করোনা পরাজিত হবে। নগর নির্বাচনের তারিখ পেছানোর প্রয়োজন নেই।

আল্লাহর রহমতের কথা শুনে এগিয়ে আসেন ধর্মান্ধতার ভাইরাস, আমি স্বপ্নে পেয়েছি করোনা উপশমের দুয়া। তিপ্পান্ন বার সুরা এখলাস পড়লেই করোনা লুটিয়ে পড়বে আপনার পদতলে।

মিডিয়া ভাইরাস ভেবে দেখে, যতক্ষণ বেঁচে আছি হ্যান্ড-স্যানিটাইজার বেচে যাই। সে উন্নয়নে মাস্টার্স করা ভাইরাসদের স্বাস্থ্য-ব্যবস্থা ভেঙ্গে পড়ার সচিত্র প্রতিবেদন হাজির করতে থাকে।

ডনাল্ড ট্রাম্প কুস্তির পোশাকে বসে আছে; করোনার সঙ্গে কুস্তি লড়বে সে। করোনা ডোনাল্ড ট্রাম্পকে উপহাস করে বলে, তুমি এক কাজ করো, মেক্সিকো সীমান্তে উঁচু দেয়াল তুলে দাও; দেখো আমাকে ঠেকাতে পারো কীনা।

নানাদেশ থেকে এমেরিকায় ফেরা নাগরিকদের সাহস জোগাতে ট্রাম্প বলে, উই উইল মেইক এমেরিকা গ্রেট এগেইন।

বিমানবন্দরে ভিড়ের চাপে উত্তেজিত এমেরিকানরা আর্তনাদ করে, রক ইউ কান্ট্রি সিস্টেম।

করোনার অট্টহাসিতে প্রকম্পিত হয় চারপাশ। ট্রাম্পের সমর্থক উগ্র জাতীয়তাবাদী ভাইরাসেরা বিক্ষুব্ধ হয়। তার দেশে ফিরে আসা এমেরিকানদের ধমক দিয়ে বলে, সিস্টেমকে ভালোবাসুন। নয়তো রাশিয়া চলে যান।

ক্যানাডার প্রধানমন্ত্রী জাস্টিন ট্রুডো বিভিন্ন দেশে বসবাসকারী ক্যানাডিয়ানদের আহবান জানান, এবার তোমরা দেশে ফিরে এসো; ক্যানাডা তোমাদের করোনা ভাইরাসের হাত থেকে বাঁচাতে সম্ভব সব কিছুই করবে।

ট্রাম্পের সহমত উগ্র জাতীয়তাবাদী ভাইরাসেরা বিরক্ত হয়ে বলে, ট্রুডোর এই সুশীল ভাইরাস আজকাল আরো অসহ্য লাগে।

উগ্র জাতীয়তাবাদীদের প্রশমিত করতে ট্রাম্প বলে, বিশ্বায়ন ভাইরাসের মহৌষধ এই করোনা ভাইরাস। দেখো কী সুন্দর ইউরোপের দেশগুলো তাদের সীমান্ত বন্ধ করে দিচ্ছে করোনার ভয়ে।

নরেন্দ্র মোদি ট্রাম্পের সঙ্গে ভিডিও কনফারেন্সে পরামর্শ করে, আমার ঐ কাশ্মীর লকডাউন মডেলটাকেই করোনাজি অনুসরণ করেছেন। আপনি যদি জার্মানি থেকে করোনার নতুন কোন ওষুধের পেটেন্ট কিনতে ব্যর্থ হন, আমি আপনাকে পতঞ্জলির ওষুধ পাঠাতে পারি। এ ওষুধ ধন্বন্তরী।

মিডিয়া ভাইরাসের নিয়মিত আপডেটে পৃথিবীর মানুষের মনে নভেল করোনা এক জনপ্রিয় উপন্যাস হয়ে উঠতে থাকে যেন। সোশ্যাল মিডিয়ায় আগে যারা দেশভ্রমণের ছবি দিতো; পর্যটন বন্ধ হয়ে যাওয়ায় এখন তারা তারা হ্যান্ড স্যানিটাইজার, টিস্যু, টয়লেট পেপার, খাদ্য সামগ্রী মজুদের সেলফি দিতে থাকে। প্যানিক শপিং হয়ে ওঠে ফ্যাশনেবল।

চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের ঢেউয়ে মাতোয়ারা হয়ে যারা মোবাইল ফোনে ব্যস্ত থাকতো সামনে বসে থাকা মানুষটার সঙ্গে কথা না বলে, সেই খুব ট্রেন্ডি এন্টি সোশ্যালেরাও করোনার কারণে কোয়ারিন্টিন হতে ভয় পেতে থাকে। করোনা টেস্টের সময় হাসপাতাল থেকে পালাতে থাকে অনেকে।

যেসব দেশে গুম খুব জনপ্রিয়,সেখানে গুম ভাইরাসেরা খুব খুশি হয়, যাক গুম করার জন্য তুলে নিতে বাধা নেই। করোনার প্যানিকের মাঝে কেউ টের পাবে না। যদি মিডিয়া ভাইরাস বিরক্ত করে, বলে দেয়া যাবে করোনার কারণে সেফ হাউজে কোয়ারিন্টিন করা হয়েছে।

রকিং কান্ট্রি সিস্টেম মেনে নিয়ে অনেকেই হোম কোয়ারিন্টিনে যায়। ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে করোনার উস্কানিতে তবু স্বৈরাচার বিরোধী গান গাইতে থাকে।

মোটিভেশন ভাইরাস তার আশাবাদ ও দায়িত্ববোধ ভাইরাসের ঝুলি খুলে বলতে থাকে, সব ঠিক হয়ে যাবে; একটু গরম পড়লেই করোনা মারা যাবে। হোম কোয়ারিন্টিনে বসে লাইক বাটন টিপে আমাকে সাবস্ক্রাইব করুন।

মাসকাওয়াথ আহসান। লেখক, শিক্ষক ও সাংবাদিক। 'শিল্পের জন্য শিল্প নয়, সমাজ-রাজনৈতিক উত্তরণের জন্য শিল্প' এই ভাবনাটিই মাসকাওয়াথ আহসানের লেখালেখির প্রণোদনা। নাগরিক বিচ্ছিন্নতার বিচূর্ণীভাবনার গদ্য ‘বিষণ্ণতার শহর’-এর মাঝ দিয়েই লেখকের প্রকাশনার অভিষেক ঘটে। একটি পাঠক সমাজ তৈরি হয় যারা নাগরিক জীবনের...

এই বিভাগের অন্যান্য লেখাসমূহ