রজকিনী রামি

সুদীপ ঘোষাল
ছোটগল্প
Bengali
রজকিনী রামি

শেষ থেকে শুরু।

আমি রজকিনী রামী,ধোপার বংশে জন্ম আমার।ঘাটে সখিদের সঙ্গে কাপড় কাচি। একাজটা আমি ছোটো থেকেই করি।সখিরা একদিন বলল,ওপাড়ে এক বামুনের ছেলে নাকি আমার জন্য মাছ ধরতে আসে।আমার মত ছোটোজাতের মেয়ের জন্য ও ঘন্টার পর ঘন্টা বসে থাকে । আমি ভাবি,ওর কি জাতকুলমান নাই।বঁড়শিতে খাবার গেঁথে মাছ মারে, ও কেমন বামুন।নিষ্ঠুর কেন এমন। রোজ মাছ ধরে মারে আর আনন্দ পায়।এ মানুষ ভালো হয় কি করে। আমি বিধবা অজাত,কুপয়া শবদেহের মত সাদা শাড়ি ঢাকা দেহ আমার,আমি বাল্যবিধবা, আমাদের কি ভালোবাসতে আছে।আমরা তো মানুষ নই সমাজের চোখে,স্বামীকে খেয়েছি। আমাকে সে ভালোবাসে কি করে।সখিরা বলে আমি নাকি নারী তো আমার নারীত্ব ঢাকা থাকে সাদা রঙে।ও রঙ কি আমার জীবন থেকে মুছবে কোনোদিন।
তারপর একদিন হৃদয় দুমড়ে সে আমার কাছে এলো,প্রেম নিবেদন করল হাঁটুগেড়ে।সে বলল,আমি মাছ ধরি না, খাইও না।তোমাকে একবার দেখার জন্য ছল করে বসে থাকি।আমি কয়েকদিন অচেতন মনে বাড়িতে ছিলাম।কোনো কাজে মন আসত না।দেওয়ালে, ভাতের থালায় শুধু তার ছবি।এ কি হলো আমার। আমি বিধবা। লোকে ছি ছি করবে জানলে।আর আমার মত অভাগীর ওসব চিন্তা না করাই ভালো।তবু গলে যাচ্ছে উপোসী মন। খুব ভালোবাসতে ইচ্ছে করছে পৃথিবীকে।জীবন বড় সুন্দর।
তারপর সমাজের সেনাপতিরা উঠেপড়ে বিরুদ্ধাচারণ করতে লাগল অসম প্রেমের।তারা তাদের প্রাণে মেরে পুঁতে দিতে চায় ভিটেমাটির তলায়।আর আমরা বেপরোয়াভাবে চালাতে থাকি আমাদের প্রেমের কুসুম জীবন।
আমি রামী লেখাপড়া বিশেষ জানি না।তবু মনে আমার জানার ইচ্ছে, বোঝার ইচ্ছে খুব বেশি পরিমাণে আছি।ছোটোবেলা থেকে ধোপার ঘরের মেয়েরা কতটুকু সুযোগ পায় আপনারা তো জানেন।বাবা মা অসীম পরিশ্রম করে আমাদের মানুষ করেন।কোনোরকমে খেয়ে পরে মাটির ঘরে মানুষ আমরা।আমাদের স্বপ্ন দেখতে নেই,শখ থাকতে নেই।শুধু পরিশ্রম করা আর লোকের ফাই ফরমাশি খেটেখুটে আমাদের দিন গুজরান হয়।
তবু আমার ভাগ্য ভালো।আমি এমন একজনকে মনপ্রাণ সঁপেছি তাকে নিয়ে নিশ্চিন্তে একশ জনম পার হওয়া যায়।তিনি কবি, তিনি প্রেমিক,তিনি আমার সাত রাজার ধন এক মাণিক।
চন্ডীদাসকে ঘিরে ধরে সমাজের লোক, তোমার এত সাহস ব্রাহ্মণ হয়ে ধোপার মেয়ের সঙ্গে লটঘট করো।তুমি সমাজের কলঙ্ক। তোমাকে এখানে বাস করতে দেওয়া হবে না।কবি চন্ডীদাস শান্তস্বরে বলে ওঠেন,শোন রে মানুষভাই,সবার উপরে মানুষ সত্য তাহার উপরে নাই।
এক
চন্ডীদাসের ছেলেবেলা আর সকল শিশুদের মত সরলভাবে কেটেছে। গুরুর পাঠশালা পার হয়ে উচ্চ শিক্ষা হয়েছে। চোদ্দ পুরুষের ভিটে আগলে রেখেছে শৈশব আর কৈশোর।যৌবনে কবিতা লেখার পাশাপাশি ছিল মাছ ধরার নেশা।কেতুগ্রামের একটা বড় পুকুরের পাড়ে মাছ ধরতেন ছিপ নিয়ে।একদিন দৃষ্টি পড়ল বিধবা বউটার উপর।কবি ভাবেন,আগে তো এতজনকে দেখেছি,কই এমন করে তো মন বাঁধা পড়েনি চরণে।তার হাঁটা,চলা কবির মাছ ধরার ইচ্ছেকে ছাপিয়ে ঢেউ তোলে মনসায়রে।কেতুগ্রামে যেখানে চন্ডীদাস বাস করতেন সেইস্থানটি চন্ডীভিটে নামে লোকমুখে প্রচারিত।চোদ্দপুরুষের ভিটে বাঙালির মনে অমলিন এক বিষয়।এর সঙ্গে জড়িয়ে থাকে মায়ার চাদরের নকশিকাঁথা, জনম জনমের মরমী ভালোবাসা।কেতুগ্রামের বাহুলক্ষী সতীপীঠের পুরোহিত কালক্রমে নানুরে চলে যান কয়েক বৎসরের জন্য। তারপর আবার ফিরে আসেন কেতুগ্রামে।
ছেলেবেলা থেকেই চন্ডীদাস একা থাকতে ভালোবাসতেন।ফাঁকা মাঠে বসে ভাবতেন,শৈশবের সঙ্গে চাঁদ হাঁটত যখন,সরল বকের সারিও সঙ্গ দিত তালে তালে।সেইসব সাদা মেঘের দিনগুলো এগিয়ে গিয়েছে সময়ের চাকায়।তারা এখন অর্থের তুলাদণ্ড নিয়ে আনন্দ বিচার করে।ছেঁটে ফেলে দেয় আল রাস্তার সবুজপথ,গঙ্গাফড়িং আর ছেলেবেলার আঁকিবুঁকি। কত প্রাচুর্যের সমাহারে তুচ্ছ করে দূরে সরায় স্বপ্নদেখার অভ্যাস কিংবা এখনও সাদা মেঘে লেপ্টে থাকা, অর্থহীন ভাবুক বন্ধুকে।
রামি ভাবে,ওরা কার পিছনে ছুটছে।লক্ষজীবনের তো প্রতিদিন সকাল দেখার সৌভাগ্য হয় না।ঝরাপাতার দলে নাম লেখায় দৈনিক খাতায়।তবু ওরা মানদন্ডে ধনের তালিকা বাড়ায়।ভীষণ গর্জনে মেঘের সাবধান বাণী।শুনেও শোনে না অবুঝ। এক রক্তপাতহীন সকালের অপেক্ষায় শৈশবের স্মৃতি বুকে দীর্ঘশ্বাসের ধ্বনি।
কবি চন্ডীদাসের ছেলেবেলা কেটেছে বর্ধমান জেলার কেতুগ্রামে। বর্ধমান জেলার পূর্ব অংশে কেতুগ্রাম থানা। হিন্দু ও মুসলমানের মিলিত মেলায় গড়ে উঠেছে এই জীবন মাঠ।
এই থানার অন্তর্গত অনেকগুলি গ্রামের এই ইতিহাস। এখানে সতীপীঠ আছে দুটি। একটি নিরোলের কাছে অট্টহাস আর দ্বিতীয়টি কেতুগ্রামের বহুলা মায়ের মন্দির। কতকগুলি বর্ধিষ্ণু গ্রাম এখানে আছে। নিরোল, পাঁচুন্দি। গোমাই, কেতুগ্রাম, পুরুলিয়া, কোপা, কোমডাঙ্গা, ভুলকুড়ি, চরখী, শিবলুন, বেলুন, অম্বলগ্রাম প্রভৃতি আরও অনেক গ্রাম নিয়ে এই বিশাল এলাকা।কেতুগ্রামের মসজিদের আজানের সুর ছড়িয়ে পড়ে এলাকার গ্রামে গ্রামে। সকলের মঙ্গলের স্বার্থে এই ব্যবস্থা। গঙ্গাটিকুরি গ্রামে আর পুরুলিয়া গ্রামে এখনও গেলে অনেক পুরোনো রাজবাড়ি দেখা যাবে। প্রতিটি গ্রামের আনাচে কানাচে মোগল সাম্রাজ্যের ইতিহাস ফিস ফাস করে কথা বলে। একটু অনুসন্ধানী মন নিয়ে এইসব অঞ্চলে এলে ইতিহাসবিদের মনস্কামনা পূর্ণ হবে বলে মনে হয়। এখানে আঞ্চলিক নদী আছে যার নাম ঈশানী। আর এক প্রিয় নদ আছে অজয়। এই অজয়ের তীরে কবি কুমুদরঞ্জন মল্লিকের বাড়ি ছিল। নদীগর্ভে তলিয়ে গেছে অনেক গ্রাম অনেক বাড়ি। আর এতদ্ অঞ্চলের কয়েকজন মানুষের জীবন নিয়ে গড়ে উঠেছে এই কাহিনীর শরীরবাঁশি।

এখানকার বিখ্যাত পাঠশালায় পড়ত চার বন্ধু। ক্রমে পাঠশালা জীবন পেরিয়ে গিয়ে তাদের বন্ধুসংখ্যা বাড়ে। কিন্তু এই চার বন্ধু একই সঙ্গে পড়ে। আসা যাওয়া সব একসাথে। চারজনের মধ্যে চন্ডীদাস বুদ্ধিমান ও কবি।চন্ডীদাসকে আদর করে ওরা বিশু বলেই ডাকে। শাহিন, বিরাজুল, বিশুর, ফতেমা ও অনিতা নতুন বান্ধবী। তারা প্রয়োজনে সঙ্গে থাকে। ছোটোবেলা থেকে একসঙ্গে বড় হওয়া এই ব্যাচ,সকলের বিপদে আপদে ঝাঁপিয়ে পড়ত। বিশুকে দলের ক্যাপটেন বলে মেনে নিয়েছি আমরা । ক্যাপটেন তো এমনি এমনি হয় না। বিশুর চরিত্রের দৃঢ়তা তাকে নেতা বানিয়েছে। স্কুল লাইফে ফুটবল খেলে ও কত পুরষ্কার এনে দিয়েছে তার হিসেব নেই। ছোট থেকেই বিশু সাহসী আর একরোখা ছেলে। বিশুর গুরুদেব তার মামাত ভাই দিলীপ। বিশুকে লাঠিখেলা, সাঁতার, ফুটবল, কুস্তি সমস্ত বিষয়ে পরামর্শ দিত ভাল। কার কাছে কোথায় গেলে শেখা যাবে, নিজেকে ুউন্নত করা যাবে এ সমস্ত বিষয়ে দিলীপ সুপরামর্শ দিত। আমি জানতাম না কি করে বিশু এতবড় একটা মন পেল। তার মনে সবসময় ভারতবর্ষীয় এক সেবাবোধ কাজ করত। প্রাচীন মুনিঋষি থেকে শুরু করে ত্যাগের দেশ আমাদের। ভোগবিলাসের জীবন বিশু পছন্দ করে না। স্কুল লাইফে সেই ছোটবেলার স্মৃতি বিশু ভুলতে পারে না। তখন কত বন্ধু ছিল। কালের প্রবাহে কে কোথায় ছিটকে পড়েছে কে জানে? রমেন বলে,ছোটবলায়, রমেন, বিরাজুল, বিশু আর আমি, যেখানেই যেতাম একসাথে থাকতাম। রমেন বলত চ্ডী ওরফে বিশু ছিলো আমাদের দলের অলিখিত নেতা। নেতা তো এমনি এমনি হয় না। তার কাজ,দল চালানোর কৌশল তাকে নেতা বানিয়েছিলো। একদিন দুপুর বেলায় সে আমাদের ডাক দিলো তার বাঁশি বাজিয়ে। বাঁশির ডাক শুনেই মন চঞ্চল হয়ে উঠতো। ঠিক যেনো রাধার পোড়া বাঁশির ডাক। চুপি চুপি বাড়ি থেকে বেড়িয়ে বটতলায়। রমেন বলত, আমাদের মিলন অফিস ছিলো এই বটতলা। চারজন ছুটে চলে যেতাম মাঠে। সেখানে বিশুবলতো, দাড়া কয়েকটা তাল কাঁকড়া ধরি । ভেজে খাওয়া যাবে। বিরাজুল বন্ধুদের মধ্যে অন্যতম প্রিয় ছিল। তার মধ্যেও জাতপাত নিয়ে কোন গোঁড়ামি ছিল না। বিভিন্নতার মধ্যেও ঐক্য ছিল হৃদয়জুড়ে তার।
রমেন বলে,মাছ মনে করে, হাত ভরে দিলো সোজা ধানের জমির গর্তে বিশু। একটা মাগুর ধরেছি, বলেই মাথা টিপে হাত বের করতেই দেখা গেলো মাছ নয়একটা বড় কালো কেউটে সাপ। বিশু সাপটাকে সাঁ সাঁ করে ঘুরিয়ে সহজেই ছুঁড়ে দিলো দূরে। তারপর তাল কাঁকড়া ধরে ভেজে খাওয়া হলো মাঠে। ভাজার সমস্ত সরঞ্জাম বিশু লুকিয়ে রাখতো একটা পোড়ো বাড়িতে। সাঁতার কাটতে যেতাম নতুন পুকুরে। একবার ডুবে যাওয়ার হাত থেকে রেহাই পেয়েছিলাম তার প্রখর বুদ্ধির জোরে। মাথার চুল ধরে টেনে তুলেছিলো ডাঙায়।রমেন বলত,গ্রীষ্ম অবকাশে বট গাছের ডালে পা ভাঁজ করে বাদুড়ঝোলা খেলতাম বিরাজুল হাজির হত চন্ডীর নেতৃত্বে। আমরা তার কথায় হয়ে যেতাম হুজুরেে হাজির।

তারপর ঝোল ঝাপটি। উঁচু ডাল থেকে লাফিয়ে পড়তাম খড়ের গাদায়। এসব খেলা বিশুর আবিষ্কার। তারপর সন্ধ্যা হলেই গ্রামের বদমাশ লোকটিকে ভয় দেখাত বিশু। সুদখোর সুরেশ মহাজন বটগাছের ডাল থেকে শুনলো, কি রে বেটা খুব তো চলেছিস হনহনিয়ে। আয় তোকে গাছে ঝোলাই। সুদখোর অজ্ঞান হয়ে গিয়েছিলো। তারপর থেকে ও পথে যেত না মহাজন। সাদা চুলো গান্ধিবুড়িকে রোজ সন্ধ্যাবেলা নিজের মুড়ি খাইয়ে আসতো অতি আদরে। বিশু বলতো, আমি তো রাতে খাবো। বুড়ির কেউ নেই, আমি আছি তো। শ্রদ্ধায় মাথা নত হত নেতার হাসিতে। একবার বন্যার সময় স্কুল যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিলেন দলের নেতা। কোথাও সাঁতার জল কোথাও বুক অবধি জল। একটা সাপ বিশুর হাতে জড়িয়ে ধরেছে। বিশু এক ঝটকায় ঝেরে ফেলে দিলো সাপটা। স্কুল আমাদের যেতেই হবে। সাঁতার কাটতে কাটতে আমাদের সে কি উল্লাস। যে কোনো কঠিন কাজের সামনাসামনি বুক চিতিয়ে সমাধান করার মতো মানসিকতা বিশুর ছিলো। সে সামনে আর আমরা চলেছি তার পিছুপিছু। শেষ অবধি পৌঁছে গেলাম স্কুল। হেড মাষ্টারমশাই খুব বাহবা দিলেন স্কুলে আসার জন্য। তিনি বললেন, ইচ্ছা থাকলে কোনো কিছুই অসম্ভব নয়। ছুটি হয়ে গেলে,ফিরে আসার সময় একটা নৌকো পাওয়া গেলো। মাঝি বললেন, আমার বয়স হয়েছে আমি একা অতদূর নৌকা বাইতে পারবো নি বাবু। তাছাড়া আমার এখনও খাওয়া হয় নি।বিশু সঙ্গে সঙ্গে নিজের টিফিন বের করে দিলো। আমরাও মন্ত্রমুগ্ধের মতো টিফিন বের করে দিলাম। মাঝি ভাই বললেন, এসো সবাই এক হয়ে খেয়ে লি। তারপর নৌকার কান্ডারি হলো বিশু। আর আমরা সবাই মুড়ি মাখিয়ে খেতে শুরু করলাম। মাঝি ভাই ও চন্ডী খেলো। ধীরে ধীরে পৌঁছে গেলাম গ্রামে। মাঝি ভাইকে পারিশ্রমিক দিয়ে বিদায় জানালাম।

দুই
আমি রামি রজকিনী। ধোপার মেয়ে।কাজটা আমি ভালোবেসেই করি।গতরের জোর খাটিয়ে কালোকে সাদা করি।ওপাড় থেকে একজন খালি গায়ে রোজ মাছ ধরতে বসে ছিপ নিয়ে।তার দেহে পৈতে আছে।সে নিশ্চয় ব্রাহ্মণ সন্তান।তবে সে কেন এমন করে আমি একা থাকলে নয়নের তির ছোঁড়ে।আমার বুক উথাল পাথাল করে ওঠে।আবার ভয় হয়।আমি যে বিধবা,তাও আবার ধোপা।তারপর বাড়ি যাই স্খলিত পদে।কোনোরকমে শুয়ে পড়ে ভাবি,আমি কি পাগল হলাম।এখন ব্রাহ্মণ ছেলেরা আমাদের পায়ে মাড়ায় আর আমি কি না তার প্রেমে হাবুডুবু খাই।এতবড় সাহস আমার।নিজেকে নিজে সাহস দিই।
সূর্য উদয় হয় আবার ডুবে যায় কিন্তু আমার মনের ভালোবাসা ডোবে না।এযে কাম পিরীতি নয়, এ যুগ যুগান্তরের কামনার ধন।
চন্ডীদাস মাছ ধরেন আর ভাবেন, রজকিনী রাই আমার মন কেড়েছে কিন্তু সমাজ কি মানবে আমার প্রেম, বিরহ, জ্বালা।এ আমাকে একাই ভোগ করতে হবে।
নিঃসঙ্গ অবস্থায় চণ্ডীদাসও ঘর ছেড়ে বেরিয়ে পড়েন৷ ঘুরে বেড়িয়ে নিজে কবিতা লিখে সেগুলো বিদ্বজনদের শুনিয়ে বেড়াতে থাকেন৷ সারা দিনে যেটুকু হাতে আসে সেইটুকু দিয়ে রাতেরবেলায় একটি মাটির হাঁড়িতে অন্ন ফুটিয়ে আধাপেটা খেয়ে দিন কাটাতে থাকলেন৷ এ ভাবে ঘুরতে ঘুরতে তিনি একদিন চললেন রাজদরবারের পথে৷ রাজা তখন সভায় বসে মন্ত্রীদের সঙ্গে আলোচনায় ব্যাস্ত৷ তাঁর কানে এল সুন্দর কণ্ঠে ঝুমুর গানের আওয়াজ৷ রাজা আলোচনায় আর মন লাগাতে পারলেন না৷ কোথা দিয়ে আসছে এত সুরেলা কণ্ঠ, এত সুন্দর ঝুমুরগান কেই-বা গাইছে৷ ভাবতে ভাবতে এক ভিখারিকে তাঁর দরবারের দিকে এগিয়ে আসতে দেখলেন৷ রাজদরবার পাহারায় নিয়োজিত সৈন্যরা সেই ভিখারীকে ভেতরে ঢুকতে বাধা দিলে স্বয়ং রাজা সৈন্যদের থামিয়ে ভিখারি চণ্ডীদাসকে ভেতরে আসার অনুমতি দিলেন এবং সেই সঙ্গে আবদার করলেন, আরও ঝুমুরগান শুনিয়ে তাঁর মন তৃপ্ত করতে হবে৷ এমন অবস্থায় চণ্ডীদাস ঝোলা থেকে তাঁর লেখা পদ্য ও ঝুমুরগানের একখানি সংকলন বার করে বেশ ক’টি গান রাজামশাইকে শোনালেন৷ রাজামশাই যারপরনাই তৃপ্ত চণ্ডীদাসের গানে৷ তাঁর অবস্থার খবর নিয়ে পুরস্কারস্বরূপ রাজা তাঁকে বাসুলীদেবীর মন্দিরের পুরোহিতপদে নিযুক্ত করলেন এবং মন্দিরসংলগ্ন একটি ঘরে থাকার অধিকার দিলেন৷ চণ্ডীদাস জীবনধারণের ব্যাপারে নিশ্চিত হয়ে শ্রীকৃষ্ণর পদ রচনায় ব্রতী হলেন এবং বাসুলীদেবীর পূজা করতে লাগলেন৷
চন্ডীদাস একের পর এক পদ রচনা করেন।চারদিকে বিদ্রুপের ঝড়।একজন ব্রাহ্মণের ছেলে বড়ু চন্ডীদাস কিনা ভালোবাসে এক রজকিনীকে।তার পা ধুয়ে জল খায় আবার বাসুলীদেবীর পুজো করে।সমাজের সেনাপতিরা বলেন,দূর করে দাও এই হতভাগাকে।এ গ্রামে থাকলে বদনাম হবে সকলের।কেতুগ্রাম থেকে বিতাড়িত হয়ে রজকিনী ও বাসুলী দেবীকে সঙ্গে করে চলে আসেন নানুর।কিন্তু কবির মন মানে না।ঈশানী নদীর ধারে কাশফুলের প্রেমে মাতোয়ারা কবি আজ ঘরছাড়া।আবার তার সঙ্গী হলো ময়ূরাক্ষী নদী।
দেবী বাসুলী বীণারঞ্জিত সরস্বতীদেবী, যদিও তাঁকে দুর্গাদেবী মনে করে শাক্ত রূপে পূজা করা হয়৷ এই দেবীর পূজা করতে করতে চণ্ডীদাস দেবীর ভক্তিপ্রেমে বাঁধা পড়লেন৷ বাসুলীদেবীর উপাসনাই তাঁর জীবনের মুল অঙ্গ হয়ে উঠল৷ দেবীর পূজা করার পাশাপাশি শ্রীকৃষ্ণের ভক্তিরস মাঝেমধ্যে সৃষ্টি করে মুখে আওড়াতে লাগলেন, সঙ্গে সঙ্গে সেই পদগুলি লিখে ফেলতে থাকলেন৷
কবি ভাবেন, আমার অপরাধ কি।আমি মানুষকে ভালোবাসি।জাতপাত মানি না।সবার উপরে মানুষ সত্য, তাহার উপরে নাই।এসব পদ রচনা করে সকলের অপ্রিয় হয়েছি আমি।তবু চলব নিজের পথে।নিজেকে ভালোবাসাই হল আসল কাজ।আমি রজকিনী রাই কে ছাড়া বাঁচব না।সমাজ আমাকে মেরে ফেললেও আমি রাইকে ছাড়ব না।

এমন চলতে চলতে একদিন তাঁর মনে এক দোটানার উদ্ভব হল – যে অঙ্গ দিয়ে শাক্তের উপাসনা করে চলেছেন সেই অঙ্গ দিয়ে কী করে শ্রীকৃষ্ণের পদ রচনা করবেন৷ দিশেহারা তিনি৷ এমন অবস্থায় এক অমাবস্যার রাতে বাসুলীদেবী তাঁকে স্বপ্নে দেখা দিয়ে পদ রচনার আদেশ দিলেন৷ দেবীর আদেশ পেয়ে চণ্ডীদাস প্রদীপের টিমটিমে আলোয় বসে মহানন্দে শ্রীকৃষ্ণকীর্তনের পদ রচনা করতে লাগলেন৷
বিদ্যাপতির সমসাময়িক একজন শ্রেষ্ঠ কবি চণ্ডীদাস। চৈতন্যপূর্বযুগে বিদ্যাপতির সমসাময়িক একজন শ্রেষ্ঠ রাধাকৃষ্ণ-পদাবলি রচয়িতা কবি চণ্ডীদাস । যিনি বাংলা ভাষায় প্রথম পদাবলি সাহিত্য রচনা করেন । এবং চণ্ডীদাস জাতিতে ব্রাহ্মণ ছিলেন । চণ্ডীদাসকে নিয়ে বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে জটিল সমস্যার সৃষ্টি হয়েছে কারন, চণ্ডীদাস নামধারী অন্তত চারজন কবি ছিলেন বলে সাহিত্যের ঐতিহাসিকগণ সমস্যায় পড়েছেন যার প্রকৃত সমাধান এখনও হয়নি ।নানুরে যে এক চণ্ডীদাস বাস করতেন তা তিনি নিজেই লিখে গেছেন – নানুরের মাঠে
গ্রামের পাশে বাসুলী আছ’য়ে যথা।
তাহার আদেশে কহে চণ্ডীদাস
সুখ যে পাইবে কোথা।।

স্বরূপ রামানন্দ সনে মহাপ্রভু রাত্রিদিনে, গায় শুনে পরমানন্দ ।।” চণ্ডীদাসের ভাবশিষ্য হলেন জ্ঞানদাস।চণ্ডীদাস সম্পর্কে সর্বপ্রথম বিস্তৃত আলোচনা করেন — রামগতি ন্যায়রত্ন।

তিন
চণ্ডীদাসের সঙ্গে বিদ্যাপতির পার্থক্য চণ্ডীদাস গ্রামবাংলার কবি। পাণ্ডিত্যবর্জিত সহজসরল ভাষায় তিনি রাধাকৃষ্ণ-বিষয়ক পদ রচনা করেন। অন্যদিকে বিদ্যাপতি নাগরিক কবি পণ্ডিত। তাই তাঁর রচনায় বাকবৈদগ্ধ ও মণ্ডলকলার বৈচিত্র্য আছে। রবীন্দ্রনাথের মতে বিদ্যাপতি সুখের কবি, চণ্ডীদাস দুঃখের কবি’ । চণ্ডীদাস গভীর এবং ব্যাকুল, বিদ্যাপতি নবীন এবং মধুর।কেউ কেউ দাবি করেছেন যে কেতুগ্রাম হল খ্যাত ১৪ দশকের গীতিকার কবি চণ্ডীদাসের জন্মস্থান। কথিত আছে যে,চন্ডীদাস নিম্ন বর্ণের বিধবাকে বিবাহ করায় কেতুগ্রামের লোকেরা ক্ষুদ্ধ হয়েছিল। তিনি বীরভূম জেলার নানুরে চলে গিয়েছিলেন। এ সময় তিনি উপাসনাকৃত বিশালক্ষীর প্রতিমা সাথে করে নিয়ে যান। পরবর্তীকালে উত্তেজনা কমে গেলে চণ্ডীদাসকে আবার কেতুগ্রামের বহুলাক্ষী মন্দিরের পুরোহিত হিসাবে গ্রহণ করা হয়েছিল। কেতুগ্রামের উত্তর অংশে যে স্থানটি চণ্ডীদাসের জন্মস্থান বলে মনে করা হচ্ছে, স্থানীয়রা আজও ঐ এলাকাটিকে “চণ্ডীভিটা” বলে উল্লেখ করে থাকেন। রামী নামের একজন রজকিনী, যিনি ছিলেন বাল্য বিধবা তাঁর সংগে প্রেম হয় চন্ডীদাসের। জমিদারের নির্দেশে গ্রামদেবী বিশালাক্ষীর মন্দিরে পরিচারিকার কাজ করতেন রামী, ওই সময় মন্দিরের পুজারির দায়িত্বে ছিলেন চণ্ডীদাস, যিনি আদতে ছিলেন একজন বৈষ্ণব কবি। তাঁরই প্রচেষ্টায় এবং দেবীর স্বপ্নাদেশ পেয়ে মন্দিরে ঢোকার অধিকার পান তথাকথিত ‘অছুত’ধোপানি রামী। ক্রমে ক্রমে দু’জনের মধ্যে জন্ম নেয় গভীর প্রেম। কথিত আছে, রামী যখন ঘাটে কাপড় কাচতেন, তখন ছিপ হাতে পুকুর পাড়ে বসে থাকতেন চণ্ডীদাস। প্রেম যে মানুষের তৈরী জাত-পাতের ধার ধারেনা এটি তার একটি জলন্ত প্রমান।বৃন্দাবনে যেমন কানু ছাড়া গীত নাই, চণ্ডীদাস ছাড়া কথা নাই নানুরে আর কেতুগ্রাম। এ নেহাত মিল খোঁজা নয়, নানুর নামের সঙ্গেই জড়িয়ে রয়েছে বৈষ্ণব কবি চণ্ডীদাসের নাম। এখনও মানুষ একই শব্দে বলে থাকে চণ্ডীদাস-নানুর। সঙ্গে জড়িয়ে রয়েছে রজকিনী-রামীর নামও,যিনি তাঁর সাধনের সঙ্গিনী ছিলেন।

শুন রজকিনী রামি
ও দুটি চরণ শীতল জানিয়া
শরণ লইনু আমি ।।
ক্রমে রামির প্রেম এবং বাসলীদেবীর আশীর্বাদ দুই মিলে যে শ্রীকৃষ্ণকীর্তন কাব্যগ্রন্থ তিনি রচনা করে গেছেন তা আজো বাংলাসাহিত্যের এক অমূল্য সম্পদ ।ণ্ডীদাস একান্ত সহজ সরল গ্রাম্য জনগণের প্রচলিত আটপৌরে ভাষায় তিনি পদাবলি রচনা করেছেন। সাধারণ বাঙালির দৈনন্দিন জীবনে ব্যবহৃত ভাষাতেই তার পদ রচনা । কিন্তু সেই সর্বজনপরিচিত লৌকিক ভাষা চণ্ডীদাসের সহজাত প্রতিভার স্পর্শে অলৌকিক ভাবব্যঞ্জনায় শিল্পমূল্য পেয়েছে। তাঁর ভাষা শব্দের বন্ধন ছাড়িয়ে ভাবের স্বাধীন লোকে ঊর্ধ্বগামী হয়েছে। ভাষার অলংকরণে সচেতনভাবে প্রয়াসী না হলেও কল্পনায় স্বতঃস্ফূর্তভাবে আবেগে যা সৃষ্টি করেছেন তা গভীর ভাবব্যঞ্জনায় শ্রেষ্ঠ শিল্পরূপ লাভ করেছে

চার
চণ্ডীদাস পূর্বরাগের শ্রেষ্ঠ কবি। তার পূর্বরাগের পদগুলিতে শ্রীরাধার হৃদয়গ্রাহী ব্যাকুলতা যে বেদনাঘন ভাষায় প্রকাশিত হয়েছে সমগ্র বৈষ্ণব পদসাহিত্যে তার তুলনা নেই। মানবহৃদয়ের চিরন্তন প্রেমাকূলতা যেন এসকল পদে রূপ লাভ করেছে। মানবিক আবেদনে সর্বজনস্বীকৃত একটি পূর্বরাগের পদ—“সই কেবা শুনাইল শ্যাম নাম।

কানের ভিতর দিয়া মরমে পশিল গো
আকুল করিল মোর প্রাণ।”
চণ্ডীদাসের কাব্য মানবতা, মর্ত্যপ্রীতি ও বাস্তবতার ত্রিবেণী সঙ্গম। রাধাকৃষ্ণের প্রেমকথা বলতে গিয়ে তার পক্ষে এই মানবতা থেকে বিস্মৃত হওয়া সম্ভব হয়নি। পল্লিকবি আসলে সহজিয়া দৃষ্টিভঙ্গিতে দেখেছিলেন—‘সবার উপরে মানুষ সত্য তাহার উপরে নাই। মানবজীবন ধন্য, কেননা মানবের সাধনা নির্মল নয়ন, রাধাকৃষ্ণের অপ্রাকৃত প্রেমলীলা দেখতে পারে। কবির চেতনায় ও উপলদ্ধিতে আধুনিকতার সুর ধ্বনিত। জগৎ ও জীবনের লীলাই হল তার দর্শন ।চণ্ডীদাসের কবিপ্রতিভার একটি প্রধান বৈশিষ্ট্য তাঁর গীতিপ্রাণতা। তিনি যেন সৃষ্ট রাধার মধ্যে আপনাকে মিশিয়ে ফেলেছেন। রাধার বিরহ ক্রন্দনে যেন চণ্ডীদাসের ব্যক্তি অনুভূতি আর্ত। চণ্ডীদাসের কবিতায় ভাবাবেগের প্রাধান্য লক্ষিত। রাধার প্রেমানুভূতিতে এক ইন্দ্রিয়ে অনির্বচনীয় আত্মহারা ভাব আছে। নিখিলের রূপ থেকে অরূপের দিকে চিরন্তন সৌন্দর্য ও প্রেমকামনার এবং বিরহের সুতীব্র আর্তি চণ্ডীদাসের কবিতার শ্রেষ্ঠ সম্পদ।বাংলা ভাষায় রাধা ও কৃষ্ণের প্রেম সম্পর্কিত প্রায় ১২৫০ টির অধিক পদের সন্ধান পাওয়া গেছে যেখানে রচয়িতা হিসেবে বড়ু চণ্ডীদাস, দীন চণ্ডীদাস ও দ্বিজ চণ্ডীদাস তিনটি ভিন্ন নামের উল্লেখ রয়েছে আবার কোনোটিতে রচয়িতার নামের কোনো উল্লেখ পাওয়া যায় নি। এ কাব্যগুলো ভণিতা নামে পরিচিত। ভণিতা একই ব্যক্তি কর্তৃক রচিত কিনা তা পরিষ্কার করে জানা যায় না। আধুনিক পণ্ডিতরা ধারনা করে থাকেন, বর্তমান যে সকল কবিতা চণ্ডীদাসের নামে রয়েছে তা অন্তত চারজন ভিন্ন চণ্ডীদাস কর্তৃক রচিত হয়েছে। ভণিতা কাব্যের রচনাশৈলী অনুযায়ী তাদের পৃথক করা যায়।

পাঁচ
প্রথম চণ্ডীদাস হিসেবে পদাবলীর চণ্ডীদাসকে ধারণা করা হয় যিনি আনুমানিক ১৪ শতকে বীরভূম জেলায় (বর্তমানে পশ্চিমবঙ্গ) জন্ম নেন; তিনি চৈতন্য-পূর্ব বাংলা সাহিত্যে বৈষ্ণব পদাবলী রচয়িতা হিসেবে বিশিষ্ট স্থান অধিকার করে আছেন। কারও কারও মতে, তিনিই মধ্যযুগীয় বাংলা কবিতার অন্যতম নিদর্শন শ্রীকৃষ্ণকীর্তন রচনা করেন। তবে ড. মিহির চৌধুরী কামিল্যা ভাষাতাত্ত্বিক তথ্যপ্রমাণের সাহায্যে প্রমাণ করেছেন, ‘শ্রীকৃষ্ণকীর্তন’ রচয়িতা বড়ুচণ্ডীদাস বাঁকুড়া জেলার সদর মহকুমাস্থ ছাতনার অধিবাসী ছিলেন। এই কাব্যে কবি নিজেকে অনন্ত বড়ু চন্ডীদাস হিসাবে ভণিতা দিয়েছেন। তাঁর আসল নাম অনন্ত, কৌলিক উপাধি বড়ু, এবং গুরুপ্রদত্ত নাম চণ্ডীদাস। তিনি বাসলী/বাশুলী দেবীর উপাসক ছিলেন (বীরভূমের নানুরে এই দেবীর মন্দির আছে)। “বড়ু” শব্দটি “বটু” বা “বাড়ুজ্যে” (বন্দ্যোপাধ্যায়) শব্দের অপভ্রংশ বলে মনে করা হয়।
এই অসম প্রেম অবশ্য জমিদার এবং সেই সময়ের সমাজপতিরা কেউই ভাল চোখে দেখেন নি। কবি রামীকে ত্যাগ না করলে চণ্ডীদাসের মৃত বাবার সৎকার করতে পর্যন্ত অস্বীকার করে সে সময়ের সমাজ। কিন্তু রামীকে ত্যাগ করেননি চণ্ডীদাস। দু’জনের এই ভালবাসা দেখে শেষে রামীকে চণ্ডীদাসের সাধনসঙ্গিনী হিসাবে মেনে নিতে বাধ্য হয় সবাই।
চণ্ডীদাসের মৃত্যু সম্বন্ধে শ্রীকৃষ্ণকীর্তন কাব্যের আবিষ্কর্তা বসন্তরঞ্জন রায় বিদ্বদ্বল্লভ স্থানীয় প্রবাদের উল্লেখ করেছেন — বীরভূমের নানুরে বাশুলীদেবীর মন্দিরের কাছে চণ্ডীদাসের কীর্তন দলের একটি নাট্যশালা ছিল। চণ্ডীদাস একবার গৌড়ের নবাবের রাজসভায় গান গাওয়ার অনুরোধ রক্ষা করতে সেখানে যান। তাঁর কণ্ঠে ভক্তি-প্রেমের গান শুনে নবাবের বেগম মুগ্ধ হয়ে যান এবং তিনি চণ্ডীদাসের গুণের অনুরাগিণী হয়ে পড়েন। বেগম একথা নবাবের কাছে স্বীকার করলে নবাব ক্রোধের বশে চণ্ডীদাসকে মৃত্যুর দণ্ডাদেশ দেন। আত্মীয় বন্ধুবর্গের সামনে চণ্ডীদাস হস্তিপৃষ্ঠে আবদ্ধ হয়ে নিদারুণ কশাঘাত সহ্য করে প্রাণবিসর্জন দেন; বেগম সেই দৃশ্য দেখে শোকে মুর্চ্ছিতা হয়ে প্রাণবিয়োগ করেন। কথিত আছে, শূদ্র কন্যা রামীর সঙ্গে তার প্রেম ছিল বলে স্থানীয় লোকজন তাকে মেরে তার বাড়িতে চাপা দিয়ে দেয়। আবার কারও মতে তিনি সেই সময়ের বৈষ্ণব পীঠস্থান ইলামবাজারে পালিয়ে গিয়েছিলেন।
বীরভূমের নানুরের কাছে ময়ূরাক্ষী নদীর পাড়ে কতস্মৃতি জড়িয়ে আছে কবির। তিনি ভাবতেন কিশোরবেলার কথা।আমরা চার বন্ধু। রমেন, জীবন, বিশু আর আমি। ময়ূরাক্ষী নদীর পাড়ের মানুষ আমরা। মথুরাপুর,সাঁকিরের পাড়,সাঁইথিয়ার বিস্তীর্ণ লাল মাটির আদরে আমরা বড় হয়েছি।ময়ূরাক্ষী নদীর বাঁধের পাশে গ্রীষ্মকালে আমরা ফুটবল খেলতাম। সোনা,অপু,রণু,ভূমা,নিরু,হিরু,চিন্তা,পরেশ আমার ভাই,কেয়া আর পুটু আমার দিদি।কেয়ার বৈদ্যবাটীতে বিয়ে হয়েছে আর পুটু আছে কুন্ডলা গ্রামে। সাঁইথিয়া শহরে একটা সতীপীঠ আছে। মায়ের কেশ পতিত হয়েছিলো এখানে। তাই সতীপীঠের নাম কেশেশ্বরী।
যেখানেই যেতাম একসাথে থাকতাম। বিশু ছিলো আমাদের দলের অলিখিত নেতা। নেতা তো এমনি এমনি হয় না। তার কাজ,দল চালানোর কৌশল তাকে নেতা বানিয়েছিলো। একদিন দুপুর বেলায় সে আমাদের ডাক দিলো তার বাঁশি বাজিয়ে। বাঁশির ডাক শুনেই মন চঞ্চল হয়ে উঠতো। ঠিক যেন, রাধার পোড়া বাঁশির ডাক। চুপি চুপি বাড়ি থেকে বেড়িয়ে বটতলায়। আমাদের মিলন অফিস ছিলো এই বটতলা। চারজন ছুটে চলে যেতাম মাঠে। সেখানে বিশুবলতো, দাঁড়া কয়েকটো তাল কাঁকড়া ধরে নি আগে । ভেজে খাওয়া যাবে রেঁ,কি বলিস পরেশ?
পরেশকে কথাটো বলেই হাত ভরে দিলো সোজা ধানের জমির গর্তে। একটা মাগুর ধরেছি, বলেই মাথা টিপে হাত বের করতেই দেখা গেলো মাছ নয়একটা বড় কালো কেউটে সাপ। বিশু সাপটাকে সাঁ সাঁ করে ঘুরিয়ে সহজেই ছুঁড়ে দিলো দূরে। তারপর তাল কাঁকড়া ধরে ভেজে খাওয়া হলো মাঠে। ভাজার সমস্ত সরঞ্জাম বিশু লুকিয়ে রাখতো একটা পোড়ো বাড়িতে। সাঁতার কাটতে যেতাম নতুন পুকুরে। একবার ডুবে যাওয়ার হাত থেকে রেহাই পেয়েছিলাম তার প্রখর বুদ্ধির জোরে। মাথার চুল ধরে টেনে তুলেছিলো ডাঙায়।
গ্রীষ্ম অবকাশে বট গাছের ডালে পা ভাঁজ করে বাদুড়ঝোলা খেলতাম বিশুর নেতৃত্বে।তারপর ঝোল ঝাপটি। উঁচু ডাল থেকে লাফিয়ে পড়তাম খড়ের গাদায়। এসব খেলা বিশুর আবিষ্কার। তারপর সন্ধ্যা হলেই গ্রামের বদমাশ লোকটিকে ভয় দেখাত বিশু। সুদখোর সুরেশ মহাজন বটগাছের ডাল থেকে শুনলো, কি রে বেটা খুব তো চলেছিস হনহনিয়ে। আয় তোকে গাছে ঝোলাই। সুদখোর অজ্ঞান হয়ে গিয়েছিলো। তারপর থেকে ও পথে যেত না মহাজন। সাদা চুলো গান্ধিবুড়িকে রোজ সন্ধ্যাবেলা নিজের মুড়ি খাইয়ে আসতো অতি আদরে। বিশু বলতো, আমি তো রাতে খাবো। বুড়ির কেউ নেই, আমি আছি তো। শ্রদ্ধায় মাথা নত হত নেতার হাসিতে।

একবার ময়ূরাক্ষী নদীর বন্যার সময় স্কুল যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিলেন আমাদের নেতা। কোথাও সাঁতার জল কোথাও বুক অবধি জল। একটা সাপ বিশুর হাতে জড়িয়ে ধরেছে।
বিশু এক ঝটকায় ঝেরে ফেলে দিলো সাপটা। স্কুল আমাদের যেতেই হবে। সাঁতার কাটতে কাটতে আমাদের সে কি উল্লাস। যে কোনো কঠিন কাজের সামনাসামনি বুক চিতিয়ে সমাধান করার মতো মানসিকতা বিশুর ছিলো। সে সামনে আর আমরা চলেছি তার পিছুপিছু। শেষ অবধি পৌঁছে গেলাম স্কুল। হেড মাষ্টারমশাই খুব বাহবা দিলেন স্কুলে আসার জন্য। তিনি বললেন, ইচ্ছা থাকলে কোনো কিছুই অসম্ভব নয়।টিফিনের সময় ছুটি হয়ে গেলো। আসার সময় একটা নৌকো পাওয়া গেলো। মাঝি বললেন, আমার বয়স হয়েছে আমি একা অতদূর নৌকা বাইতে পারবো নি বাবু। তাছাড়া আমার এখনও খাওয়া হয় নি।

বিশু সঙ্গে সঙ্গে নিজের টিফিন বের করে দিলো। আমরাও মন্ত্রমুগ্ধের মতো টিফিন বের করে দিলাম। মাঝি ভাই বললেন, এসো সবাই এক হয়ে খেয়ে লি। তারপর নৌকার কান্ডারি হলো বিশু। আর আমরা সবাই মুড়ি মাখিয়ে খেতে শুরু করলাম। মাঝি ভাই ও বিশু খেলো। ধীরে ধীরে পৌঁছে গেলাম গ্রামে। মাঝি ভাইকে পারিশ্রমিক দিয়ে বিদায় জানালাম।পরেশ বলছে আমাদের সকলকে,ঝাড়খন্ডে ব্যাপক বৃষ্টির পাতের জের ঝাড়খন্ডের ম্যাসানজোj থেকে ময়ূরাক্ষী নদীতে জল ছাড়া হয়েছে ১৭ হাজার কিউসেক অন্য দিকে তিলপাড়া ব্যারেজ থেকে ময়ূরাক্ষী নদীতে ১৫৮১০ কিউসেক জল ছাড়া হয়েছে ময়ূরাক্ষী নদীতে। জানা গিয়েছে তিলপাড়ার জল ছাড়ার পরিমাণ আরো বাড়বে। প্রশাসন নজর রাখছে নদীতে জলস্তরের দিকে। ঝাড়খণ্ডের ত্রিকুট পাহাড় থেকে এই ময়ূরাক্ষী নদীর উৎপত্তি। সেখান থেকে প্রবাহিত হয়ে ম্যাসানজোর জলাধার। ম্যাসানজোর জলাধার থেকে তিলপাড়া হয়ে মুর্শিদাবাদের দিকে গিয়েছে ময়ূরাক্ষী নদী। ম্যাসাঞ্জোর জলাধার থেকে তিলপাড়া জলাধার পর্যন্ত আসার পথে ময়ূরাক্ষী নদীতে মিশেছে ঝাড়খণ্ডের সিদ্ধেশ্বরী নদীর জল। এত জলের চাপে ফুসছে ময়ূরাক্ষী নদী।
ছয়
তখন ভারতীয় সমাজে নারীদের অবস্থার আরও অবনতি ঘটে এবং বাল্যবিবাহের প্রচলন এবং বিধবাদের পুনর্বিবাহের নিষেধাজ্ঞা ভারতে কিছু সম্প্রদায়ের সামাজিক জীবনের অংশ হয়ে ওঠে। ভারতীয় উপমহাদেশে মুসলমান শাসকদের আধিপত্য বিস্তারের সঙ্গেই ভারতীয় সমাজে পর্দা প্রথার প্রচলন ঘটে। রাজস্থানের রাজপুতদের মধ্যে জওহর প্রথার প্রচলন ছিল। ভারতে কিছু অংশে, দেবদাসীরা কখনো কখনো যৌন নির্যাতনের শিকার হন। রাজনৈতিক কারণে হিন্দু ক্ষত্রিয় শাসকদের মধ্যে বহুবিবাহ প্রথা প্রচলিত ছিল। অনেক মুসলিম পরিবারে, নারীর গতিবিধি বাড়ির অন্দরমহলেই সীমাবদ্ধ ছিল।
খুব অল্প সংখ্যক গ্রন্থেই স্ত্রী আচার ও মহিলাদের ক্রিয়াকলাপ মূল উপজীব্য বিষয়, তবে, ১৭৩০ সালে তাঞ্জৌরের জনৈক রাজকর্মচারী ত্রম্বকোয়জ্যন রচিত স্ত্রী ধর্ম পদ্ধতি একটি গুরুত্বপূর্ণ ব্যতিক্রম। প্রথম শ্লোকটি হল:

এই পরিস্থিতিতেও, রাজনীতি, সাহিত্য, শিক্ষা ও ধর্ম সহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে বহু বিশিষ্ট নারীর সন্ধান পাওয়া যায়। রাজিয়া (১২০৫-১২২০) একমাত্র মহিলা সুলতান যিনি দিল্লি শাসন করেছেন। ১৫৬৪ খ্রিষ্টাব্দে মুগল সম্রাট আকবরের সেনাপতি আসাফ খানের বিরুদ্ধে যুদ্ধে প্রাণ হারানোর আগে গোন্দ রানী দুর্গাবতী ১৫ বছর(১৫২৪-১৫৬৪) রাজ্যশাসন করেছিলেন। চাঁদ বিবি ১৫৯০ খ্রিষ্টাব্দে আকবরের শক্তিশালী মুগল বাহিনীর বিরুদ্ধে আহমদনগরকে রক্ষা করেছিলেন। জাহাঙ্গীরের স্ত্রী নূরজাহানের রাজ্যশাসনে কার্যকরী ভূমিকা ছিল এবং তিনি মুঘল সিংহাসনের পিছনে প্রকৃত ক্ষমতা হিসেবে পরিগণিত হতেন। মুঘল রাজকুমারী জাহানারা ও জিবন্নুসিসা ছিলেন বিখ্যাত কবি এবং তারা ক্ষমতাসীন শাসকদেরও প্রভাবিত করেছিলেন। যোদ্ধা এবং প্রশাসক হিসেবে তার দক্ষতার শিবাজীর মা জিজাবাইকে শাসক বা রাজপ্রতিনিধির মর্যাদা দিয়েছিল। তারাবাই ছিলেন আরেকজন মহিলা মারাঠা শাসক। দক্ষিণ ভারতে অনেক নারী গ্রাম, শহর ও বিভাগ পরিচালনা করেন এবং নতুন সামাজিক ও ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান প্রতিষ্ঠা করেন।

ভক্তি আন্দোলন নারীর অবস্থা পুনরুদ্ধারের চেষ্টা করে এবং তাদের উপর হওয়া বিভিন্ন নিপীড়নের বিষয়ে প্রশ্ন তোলে।

 

কিছু সম্প্রদায়ের মধ্যে প্রচলিত থাকা সতী, জওহর এবং দেবদাসীর মতো প্রথা সম্পূর্ণরূপে নিষিদ্ধ করা হয়েছে এবং আধুনিক ভারতে এই প্রথাগুলি প্রায় অবলুপ্ত। যদিও ভারতেবর্ষের কিছু প্রত্যন্ত অঞ্চলে এখনও এইসব প্রথা মাঝেমাঝে পালিত হয়। কিছু সম্প্রদায়ের মহিলারা আজও পর্দা প্রথা মেনে চলেন। বাল্যবিবাহ গ্রামাঞ্চলে আজও সম্পূর্ণ বন্ধ হয়নি, যদিও এটি বর্তমান ভারতীয় আইন অনুযায়ী অবৈধ।

 

সতী বা সতীদাহ কিছু সম্প্রদায়ের মধ্যে প্রচলিত থাকা একটি পুরানো, প্রায় পুরোপুরি নিশ্চিহ্ণ হয়ে যাওয়া প্রথা, যেখানে বিধবা মহিলারা স্বামীর অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ার সময় স্বামীর চিতায় ঝাঁপ দিয়ে আত্মাহুতি দিতেন। যদিও বিধবাদের এই প্রথায় অংশগ্রহণ স্বেচ্ছায় বলে ধরা হত, তবে হিন্দু ধর্মগ্রন্থ অনুযায়ী বর্তমান যুগে অর্থাত্ কলি যুগে এটি নিষিদ্ধ। ভারতীয় উপমহাদেশের বৈদেশিক আগ্রাসনের পর থেকেই, এই প্রথাটি তার উপস্থিতি জানান দিতে শুরু করে, কারণ, নারীরা প্রায়ই বৈদেশিক বাহিনীর দ্বারা ধর্ষিত বা অপহৃত হত। ১৮২৯ সালে ব্রিটিশ সরকার কর্তৃক এই প্রথাটির বিলোপ ঘটানো হয়। স্বাধীনতার পর থেকে প্রায় ৪০টি সতীদাহর ঘটনা ঘটেছে বলে খবরে প্রকাশ। ১৯৮৭ সালে রাজস্থানের রূপ কানোয়ার মামলায় সতীদাহ(প্রতিরোধ) আইন বলবত্ হয়

 

কোনো যুদ্ধে পরাজিত বাহিনীর স্ত্রী ও কন্যারা শত্রুপক্ষের হাতে বন্দী হওয়া বা যৌন নিপীড়ন এড়াতে স্বেচ্ছয় অগ্নিকুন্ডে ঝাঁপ দিয়ে আত্মাহুতি দিতেন। এই প্রথাটি জওহর প্রথা নামে পরিচিত এবং এটি মূলত রাজপুত সমাজে প্রচলিত ছিল, যেখানে জওহর ব্রতে শহীদ রমণীরা সম্মানের উচ্চাসনে অধিষ্ঠিত হন। এই প্রথার চর্চা মূলত ভারতে ইসলামী আক্রমনের সময় ঘটেছিল।

সাত
চন্ডীদাস ছিপ ফেলে মাছ ধরছে ফাতনার কথা ভুলে। ডাগর দুপুর জলে নেমেছে।বাউরি বৌ গুগুলি আর ঝিনুক ধরছ জলের তলা থেকে। তার সুডৌল স্তন ঝুঁকে পরেছে জল ছুঁয়ে। জল কখনও সখনও রসে ডুবিয়ে দিচ্ছে বিধবা যুবতী হৃদয়। সে দেখছে ভিজে নিতম্বে খাজুরাহের ছবি।চন্ডীদাস ভাবছে ঝিনুক, গুগুলির সোহাগ, রজকিনী রামিকে সোহাগী প্রেমিকা রূপে গড়ে তুলেছে । কালো জঙ্গুলে মোহময়ী পুকুরের পাড়ে গাছ গাছালির স্নেহচ্ছায়া। দুপুরে মিথুনছায়ায় হাঁস হয়ে উঠেছে বসন্তমায়া। কোন এক অদৃশ্য টানে বাউরিবৌ মাঝে মাঝে তাকায় চন্ডীদাসের দিকে। কেউ কোথাও নেই। দুপুরের অবসর ধোপা বউ ধরছে, শামুক, ঝিনুক, কাপড়,জামা ধোওয়ার পরে । জীবনে তার লড়াই প্রকট হয়ে উঠেছে। চন্ডীদাস কবি।রামিকে দেখার লোভে তাই ছিপ নিয়ে বসে এই সময়ে রামিকে দেখার লোভে। সুন্দরী রামি ভোলে না এই বসন্তসময়। কি বর্ষা, কি শীত বা গ্রীষ্ম দুজনের বসন্তসময় কেড়ে নিতে পারে না।
আজ নির্ভিক পৌরুষ জলে নেমেছে। ধোপার বৌ কাপড় ঝেড়ে জলে ধুয়ে নিচ্ছে। দুজনেই ডুবে আছে আকন্ঠ শীতল জলীয় আবরণে। জলের নিচে চলেছে জলকেলি। একটা পানকৌড়ি ডুবে ডুবে মাছ ধরার কৌশল দেখায় প্রেমিক প্রেমিকাকে। ছিপ ডাঙায় তুলে দেখে বিপিন, একটা বড় রুই ধরা পড়েছে বড়শিতে। বাউরিবৌ সোহাগী আঁচলে তুলে নেয় চন্ডীদাসের প্রেম।
তাদের মিলিত দৃশ্য দেখে ফেলে গ্রামের সুদখোর লোকটা।সে রামি চন্ডীদাসের প্রেমের কথা ছড়িয়ে দেয় কেতুগ্রামের দোরে দোরে।
সকলে সিদ্ধান্ত নেয়, ওদের দুজনের এখানে ঠাঁই হবে না।অগত্যা তারা চলে যান নানুর।সেখানে তারা নতুন ঘর বাঁধেন।চন্ডীদাস লিখতে শুরু করেন শান্তিতে।
রামী বলেন,আমি ছিলাম নানুরের বিশালাক্ষী মন্দিরের এক বাল্য বিধবা পরিচারিকা। রাজকিনীর ঘাটে আসতেন কাপড় কাচতে। আর চন্ডীদাস হাতে ছিপ নিয়ে বসতেন তাঁরই অপেক্ষায়। ওই সময় মন্দিরের প্রধান‌ পূজারী ছিলেন স্বয়ং কবি চন্ডীদাস। দেবীর স্বপ্নাদেশেই ধোপানী রামীকে মন্দির চত্বরে আসার অনুমতিও দিলেন কবি। ধীরে ধীরে আমরা একে অপরের সান্নিধ্যে আসি। শুরু হয় প্রণয়‌। কিন্তু এক বিধবা অচ্ছুৎ জাতের মেয়ের সঙ্গে মন্দিরের পুরোহিতের এই সম্পর্ক মেনে নেয়নি আমাদের সমাজ। আমাকে ত্যাগ না দিলে কবিকে একঘরে করারও হুমকি আসে সমাজপতিদের থেকে। কিন্তু না, কোনো অবস্থাতেই আমার হাত ছাড়েননি কবি।শেষমেশ সমাজ রামীকে তাঁর সাধন সঙ্গিনী হিসেবেই স্বীকার করে নেয় কিন্তু রাগ থেকে যায় সমাজপতির । কবির গানের সুরে ও ভাষায় আমার কথাও এসেছে বহুবার। আজও কবির নামের সাথেই তাই উচ্চারিত হবে আমাদের প্রেম।

উপসংহার
এমন ভাবে দিন কাটতে কাটতে চণ্ডীদাসের জীবনে আবার পরিবর্তন এল৷ বাসুলীদেবীর মন্দিরে একদিন আগমণ ঘটল এক পরমা সুন্দরী যুবতীর৷ অপূর্ব মুখশ্রী তাঁর৷ তিনি রজকিনি রামী৷ পিতৃমাতৃহারা রামী মন্দিরে দেবদাসীর কাজ করতে এলেন৷ মন্দিরের কাজ গুছিয়ে করেন রামী৷ ঠাকুরের কাপড় ধোয়া থেকে ঝাঁট দেওয়া, সবেতেই নিখুঁত৷ একদিন ভোগ বিতরণের সময় রামীর সঙ্গে চণ্ডীদাসের মুখোমুখি সাক্ষাৎ ঘটে৷ প্রথম দর্শনেই রামীর রূপে মুগ্ধ হয়ে যান চণ্ডীদাস, তাঁর মনের প্রেমসাগর যেন উত্তাল হয়ে ওঠে৷

স্ত্রী পদ্মজাকে হারিয়ে একাকী জীবন৷ পদ্মজাকে সে ভাবে সুখ দিতে পারেননি৷ অনেক দিন নারীর শরীরসুখ থেকেও বঞ্চিত৷ এমন অবস্থায় রামীর মুখ চণ্ডীদাসকে মাতোয়ারা করে তোলে৷কবি বলেন, আহা কী সৌন্দর্য্য রামীর! হিরের দ্যুতির মতো মুখের ঔজ্জ্বল্য৷ বিদ্যুতের ঝলকানির মতো বাহুযুগল, তন্বী শরীর – সব মিলিয়ে চণ্ডীদাসের দু’ নয়নে শুধুই রামীর উপস্থিতি৷ কখনও বা বাসুলীদেবীর সঙ্গে রামীকে গুলিয়ে ফেলছেন আবার কখনও শ্রীরাধিকার সঙ্গে৷ “ইস্ একবার এসে যদি রামী তাঁর কাছে বসে বুকে তাঁর সুন্দর হাতখানি ছোঁয়াতেন”, “যদি কখনও রামীর শরীর স্পর্শ করার মতো সুখ কপালে জুটত”৷ রাতের একাকী বিছানায় শুধুই এমন ভাবনা তাঁর৷ওদিকে রামীও ভাবেন সেই একই কথা।কবির সঙ্গে দেখা হলে রামী বলেন,আমি তোমার জীবনসঙ্গিনী হয়ে বেঁচে থাকব চিরকাল।আমাকে তুমি গ্রহণ করো প্রিয়।
কবি বলেন,তোমার সঙ্গ পেলে আমি ভুবন ভুলে যেতে পারি।তুমি আমার স্বর্গ, তুমি আমার নরক।আমি তোমাকে ভালোবাসি রামী।

“ব্রহ্মাণ্ড ব্যাপিয়া আছয়ে যে জন, কেহ না জানয়ে তারে।
প্রেমের আরতি যে জন জানয়ে সেই সে চিনিতে পারে।।”

রামি আর চন্ডীদাস একই জায়গার মানুষ। বিধবা রামিকে সাধনসঙ্গিনী করায় পাড়ার সকলে নিন্দা করতেন তাদের।কিন্তু কবি এ ব্যাপারে একদম উদাসীন থাকতেন।রামিকে তিনি অন্তর থেকে ভালোবাসতেন।তিনি জানতেন,এ ভালোবাসা একদিনে হয় না।জন্ম জন্মান্তরের সাধনায় এ প্রেম হৃদয় মাতিয়ে দেয় রাধাভাবের বিরহে।এখানে শরীর নয় আত্মার উন্নতি হয়। এ প্রেম বাইরে থেকে বোঝা যায় না,এ প্রেম ফল্গুধারার মত দুজনের অন্তরে প্রবাহিত হয়।
রামি তার প্রিয় কবিকে বলতেন মনের কথা।রামি বলতেন তার মায়ের কথা,ছেলেবেলার কথা।তিনি বলতেন,চোদ্দ বছর বয়সে মায়ের বিয়ে হয়েছিল। তখন থেকেই মায়ের স্বাধীনতা ডোবাপুকুরের শানবাঁধানো সিঁড়িতে থমকে গিয়েছিল। তবু ছোট পিসির প্রশ্রয়ে দরজাঘাটে তাল কুড়োনোর বেলা, ঘেটো রুই ধরার পালা, মাকে কিছুটা স্বস্তি দিয়েছিল। কিছুটা ডানা মেলে ওড়া,কিছুটা বাবার বাড়ির স্বাদ। দুধের স্বাদ ঘোলে মেটাবার মত মা নতুন পুকুর সাঁতরে এপাড় ওপাড় হত। শাড়ি পরে মায়ের সাঁতারকাটা দেখে কাকা আর পিসি অবাক হত। তারাও মায়ের পিঠে চেপে সাঁতার শিখত। কাকা আর পিসির মাতৃস্নেহের অভাব মা অনেকটা পূরণ করে দিয়েছিল। আমার মা তাদের মানুষ করে তুলেছেন সন্তানের আদরে। অভাবের ঘরে নুন আনতে পান্তা ফুরোয়। তবু ঠাকুরদা হাসিমুখে মায়ের হাতের রান্না তৃপ্তি করে খেতেন। সকলকে খাওয়ানোর সময় মায়ের খেয়াল থাকত না নিজের খাওয়ার কথা। ঠাকুরদা বলতেন,তোমার ভাত কই? মা হাসিমুখে জল খেয়ে দুপুরে মাটির দোতলা ঘরে বিশ্রাম নিত। এরকম কত রাত দিন যে কেটেছে তার ইয়ত্তা নেই। তবু হাসিমুখে মা আমার সংসারের সমস্ত কাজ সেরে বর্ষার উদ্দামতায় সাঁতরে পেরোতেন সংসার নদীর এপাড়, ওপাড়।
তারপর একদিন ঘোর অমাবস্যায় ঢেকে গেল মায়ের অন্তর কাকার মৃত্যুতে। পিসিও চলে গেলেন। বাবা চলে গেলেন। মা আর সাঁতার কাটেন না। তালপুকুরে তাল পচে যায়। ঘেটো রুই ঘাটে আসতে ভুলে যায়। না হেঁটে মায়ের পায়ের জোর কমে যায়। এখন ছেলেদের আশ্রয়ে তাঁর সংসার নদী পারাপারের একান্ত সাধনায় স্মৃতিগুলোই হাতিয়ার।
কবি রামিকে বুকে জড়িয়ে সান্ত্বনা দিতেন,সকলের মা বাবা চিরদিন বেঁচে থাকেন না।আসা যাওয়াই তো কালের নিয়ম। ও নিয়ে তুমি দুঃখ কোরো না।এসো আমরা শ্রীকৃষ্ণের চরণে নিজেদের সমর্পণ করি।রামি হৃদয় দিয়ে কবিকে মুগ্ধ নয়নে দেখতেন।কোনো মতেই তার দেখা শেষ হত না।মনে হত যুগযুগান্তর ধরে তাকিয়ে থাকলেও এই মনোবাসনা পূর্ণ হবে না।
রামি ভাবত,আমি ছোটোজাতের রজকিনী বংশের মেয়ে আর কবি ব্রাহ্মণ সন্তান। তবু তিনি আবেগ এলে আমার চরণ ধরে চুমু খান।আমার কি পাপ হবে না।আমি যে ওনার মধ্যে শ্রীকৃষ্ণকে দেখতে পাই।তখন রামিও কবির চরণযুগল কোলে নিয়ে চোখের জলে ধৌত করতেন মনের মলিনতা। রাধাভাবে বিভোর রামি অবশেষে কবির নয়নে রাধা হয়ে ধরা দেন।কবি চন্ডীদাস বলতেন, তুমি যে আমার প্রাণ সখি,তুমি যে আমার প্রাণ।
রামি বলে,আজ আমরা দুজনে এক হয়েছি মনে,দেহে,স্বপ্নে, জাগরণে।আজ কোনো শক্তি আমাদের আলাদা করতে পারবে না।এখন আমার আকাশে ভেসে বেড়ায় তুলোর মত সাদা প্রেমের মেঘ আর গভীর এক পরিতৃপ্তি। তবে কি আমি তাকে পুরোপুরি পেয়ে গেছি।বোধহয় না।
চন্ডীদাস বলতেন রামিকে,তোমাকে পেলে আমি জীবনের সবকিছু তোমার পায়ে সমর্পণ করব।রামি বলত,আমি তোমারই কবি।আমাকে এত সম্মান দিলে তুমি,এতবড় মন কোথা পেলে সাঁই।কেউ কেউ দাবি করেছেন যে কেতুগ্রাম হল বৈষ্ণব পদাবলি খ্যাত ১৪ দশকের গীতিকার কবি চণ্ডীদাসের জন্মস্থান। কথিত আছে যে, চণ্ডীদাস নিম্ন বর্ণের বিধবাকে বিবাহ করায় কেতুগ্রামের লোকেরা ক্ষুদ্ধ হয়েছিল। তিনি বীরভূম জেলার নানুরে চলে গিয়েছিলেন। এ সময় তিনি উপাসনাকৃত বিশালক্ষীর প্রতিমা সাথে করে নিয়ে যান। পরবর্তীকালে উত্তেজনা কমে গেলে চণ্ডীদাসকে আবার কেতুগ্রামের বহুলাক্ষী মন্দিরের পুরোহিত হিসাবে গ্রহণ করা হয়েছিল। কেতুগ্রামের উত্তর অংশে যে স্থানটি চণ্ডীদাসের জন্মস্থান বলে মনে করা হচ্ছে, স্থানীয়রা আজও ঐ এলাকাটিকে “চণ্ডীভিটা” বলে উল্লেখ করে থাকেন।কেতুগ্রাম আর নানুরের চন্ডীভিটের ধুলো মাথায় নিলে এখনও রাধা নামের বাঁশীর সুর শুনতে পায় প্রেমিকরা।
আজ ময়ূরাক্ষী নদীর ধারে বসে কবি চন্ডীদাস রামীকে নিয়ে বসেন।
রামী কবিকে বলেন,অতি সুক্ষ্ম তরঙ্গের স্পন্দন শোনার অপেক্ষায় মৌন হয়ে অপরূপ প্রকৃতির, কোলে আশ্রয় নিতে চাই।চাওয়া,পাওয়ার উর্ধ্ব জগতে ভাসতে ভাসতে ছাই হোক নশ্বর দেহের অহংকার।

স্থূল পদার্থ নিয়ে পরমাণু বিজ্ঞানীরা অপেক্ষায় থাকেন না।অণু পরমাণু নিয়েই তাঁরা ব্যস্ত।তা না হলে হিমালয়ের চূড়া কিংবা জমি জায়গা নিয়েই তারা টানাটানি করতেন বেশি।
আকাশকে আমরা পৃথিবীর মানুষ, স্বার্থপরের মত খন্ড খন্ড করেছি।এটা কাটোয়ার আকাশ, ওটা দিল্লীর, ওটা রাশিয়ার আকাশ। অখন্ডতার বাণী আমরা ভুলে যাই।আকাশ চিরদিন অখন্ডই থাকে।তাকে খন্ডিত করার অকারণ অপচেষ্টা না করাই ভালো।তবু কাঁটাতার হয়,সীমানা ভাগ হয়। অদ্ভূত মূর্খতার অন্ধকারে ডুবে আছে প্রাণীকুল।

আলোর অন্তরে বাদ্য বাজে, ‘অনন্ত নাদ’ এর ভেরী।সূক্ষ্ম তরঙ্গে মিশে যায় তার অস্তিত্ব,ভুলে যায় তার অবস্থান। এ অনুভূতি ঝর্ণার মত,কবিতার মত,ভালোবাসার মত, নদীর প্রবাহের মত। জোর করে সে গতি পাল্টায় না।

সৃষ্টির সবাই ভয়ে কাজ করি। অস্তিত্ব বিনাশের ভয়ে।পৃথিবী ঘোরে ভয়ে,তা না হলে সে ধ্বংস হবে। সূর্য তাপ দেয় ভয়ে, তা না হলে তার অস্তিত্ব বিপন্ন হবে।
সৃষ্টি মানুষের প্রশ্বাস,স্থিতি মানুষের ক্ষণিক ধারণ ,প্রলয় মানুষের নিশ্বাস।

আলোর অনুসন্ধানীর ভয় নেই, তাই অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার লড়াই নেই। লোভ নেই, তাই অতিরিক্ত দুশ্চিন্তা নেই।অকাল বার্ধক্য নেই।
আছে শুধু আনন্দ,ছেলেমানুষি,বোকামি,সরলতা,সোজা পথে হাঁটার সোজা রাস্তা…

বন্ধু, জাতপাত নির্বিশেষে অখন্ডতার অসীম ভালোলাগায় মনসায়রে আপনি ডুব দিতেই পারেন কবি।
কবি বলেন,তুমি খুব সুন্দর কথা বলো রামী,আরও বলো।
ময়ূরাক্ষী নদীর ধারে, মুহূর্তে নেমে আসে কালোর করাল থাবা দুজনের উপর।আঘাতের পর আঘাত চলতে থাকে। আর চলে টানা হ্যাঁচড়া।রামী শোনে ওরা বলছে,সমাজটাকে উচ্ছনে পাঠিয়ে এখানে প্রেম হচ্ছে। মার বেটাকে কবি হওয়ার শখ মিটিয়ে দে বেটার।রামী ভাবে,চিরকাল প্রেমিকরা,কবিরা মার খায় আর মরে যাওয়ার পরে শুরু হয় আদিখ্যেতা।
রামী শোনে, ওরা বলছে ওদের ভিটের মাটি খুঁড়ে পুঁতে দে দুজনকে।ওখানে প্রেম করুক অভাগীর বেটা, বেটি।
রামীর জীবনদীপ নিভে আসছে।সে ভাবে,প্রাণনাথের কি অবস্থা, নিশ্চয় আমার মত।সে খুঁজতে থাকে অন্ধকারে,কই আমার প্রাণনাথ কই।প্রাণনাথ আমার কবি একবার সাড়া দাও।
ময়ূরাক্ষীর জল শান্ত, স্তব্ধ অথচ গভীর হয়ে বয়ে চলে নিশিদিন।

সুদীপ ঘোষাল। গল্পকার। জন্ম ভারতের পশ্চিমব্ঙ্গরাজ্যের কেতুগ্রামের পুরুলিয়া গ্রামে। প্রকাশিত বই: 'মিলনের পথে' (উপন্যাস)। এছাড়াও কয়েকটি গল্প ও কবিতার বই আছে।

এই বিভাগের অন্যান্য লেখাসমূহ