ঝরা শিউলি
এক মেয়েটা মুঠো মুঠো জ্যোৎস্না কুড়িয়ে অপরের মুখমন্ডলে চাঁদ দেখত। মানুষের উপকার করার ক্ষেত্রে,…..
শীতের বেলা, একটু একটু ঠাণ্ডা হাওয়া দিচ্ছে। জবর আলীর মা উঠোনে মাদুর পেতে রোদ পোহাচ্ছে। দুপুরে খাওয়াদাওয়া করেই বসে আছে। শীত গ্রীষ্ম সবসময় এখানেই বসে থাকে। শুধু বর্ষার সময় বারান্দায় বসে। এখানে বসে বসে মনের সুখে কাক পক্ষী, গাছগাছালিকে গালাগাল করে।
এখানে বসে বসে প্রতিদিন অপেক্ষা করে। অপেক্ষা করে ডাক পিয়নের। একটা চিঠির জন্য তার অপেক্ষা অনেক দিনের। জবর আলীর মা’র বয়সের কোন গাছ পাথর নেই, কেউ কেউ বলে আশি পেরিয়ে গেছে কবেই! পরিবারে একমাত্র নাতনী ছাড়া আর কেউ নেই। এক ছেলে ছিলো জবর আলী, সে মারা গেছে অনেক দিন আগে। তার কিছুদিন পর জবর আলীর স্ত্রীও স্বামীর পথ ধরলো। তবে তারা পৃথিবী ছেড়ে যাওয়ার আগে একমাত্র মেয়ের বিয়ে দিয়ে গেছেন। কিন্তু মেয়েটার আর স্বামীর ঘর করা হলো না। কারণ পরিবারের একমাত্র সন্তান হওয়ার ফলে মেজাজ ছিলো তিরিক্ষি আর মুখের ভাষা সম্পূর্ণ দাদির মতো। খুব ঝগড়াটে, কেউকে না পেলে বাতাসের গলায় পা রেখে ঝগড়ার আয়োজন করে। তার কুচুটে স্বভাব, গলা ছেড়ে গালাগালির জন্য স্বামী এক কথায় তিন তালাক দিয়ে দেয়। সেও কম যায় না, সাথে সাথে বাড়ির বাইরে এসে পেছনের কাপড় তুলে বাড়ির লোকদের বিশাল নিতম্ব দেখিয়ে দিয়ে বাবার বাড়ির পথ ধরে। এমনকী খোরপোষের দাবীও ছেড়ে এসেছে। কেউ সে কথা তুললে সেদিন সারা দিনমান চলে গালি বর্ষণ। এখন আর কেউ সে কথা তোলা দূরে থাক ওর সামনেও পড়ে না।
সেই থেকে সুন্দরী বেগম দাদির সাথেই থাকে। মন চাইলে দাদিকে গালি দিয়ে তুলাধুনা করে। তাতে রজব আলীর মায়ের কিছু যায় আসে না। কখনো কানে ঢোকায় না, ঢোকালেও বেশিক্ষণ ধরে রাখে না। আবার যখন মন চায় রজব আলীর মাও নাতনীকে মনের সুখে গালি দিয়ে ধুয়ে দেয়। যখন নাতনী আর দাদির ঝগড়া লাগে তখন বাড়ির আশে পাশে কাকপক্ষীও বসে না।
দাদি নাতনীর ভাবভালোবাসাও কম না, হয়তো ওদের আর কেউ নেই বলেই। রজব আলীর মা সারাদিন গজ গজ করে, কখনো গল্প করে আবার কখনো গালি দেয়। বুড়ির গল্প আর গালির সিংহভাগ অনুপস্থিত স্বামীর উদ্দেশ্যে। সেই কবে যুদ্ধে গেছে, এখনো কেন ফেরে না, আর নিয়মিত চিঠি কেন দেয় না এইসব অভিযোগ নিয়ে কল্পনায় সামনে দাঁড় করিয়ে গালিগালাজ করতে থাকে।
এলাকার ডাকপিয়ন হিরণ মিয়া সাইকেলের ঘণ্টি বাজিয়ে এই পথ দিয়ে যাওয়া আসা করে। ঘন্টির শব্দ শুনলেই বুঝতে পারে ‘চিঠিঅলা’ যাচ্ছে। তখন গলা ছেড়ে ডাকাডাকি করে। প্রতিদিনই জিজ্ঞেস করে যুদ্ধের ময়দান থেকে কোন চিঠি এসেছে কিনা। প্রতিদিনই সে বলে আসে নি। শুনে কিছুক্ষণ ঝিম মেরে থাকে, তারপর অনুপস্থিত একজনকে উদ্দেশ্য করে অশ্লীল ভাষায় গালিগালাজ শুরু করে। হিরণ মিয়া তখন পালিয়ে বাঁচে।
কখনো এমন হয়েছে, গলা ছেড়ে উথালপাথাল কান্না জুড়ে দেয়। সে কান্না এমন ভয়াবহ তা বেশ কয়েকঘণ্টা চলে, কখনো তা রাত পর্যন্ত গড়ায়। দাদির কান্না যখন খুব অসহ্য মনে হয় তখন সুন্দরী বেগম তার নিজস্ব গালির ভান্ডার খুলে বসে। তখন মনে হয় ষোলকলা পূর্ণ হয়। রজব আলীর মা কান্না ভুলে কান পেতে গালি শোনে আর মাঝে মাঝে মাথা ঝাঁকায়। একসময় ক্লান্ত হয়ে সুন্দরী বেগম থেমে যায়। যা কিছু জোটে মরিচ পোড়া অথবা কারো ক্ষেত থেকে নিয়ে আসা আনাজপাতি দিয়ে ভাত খেয়ে নাতনী আর দাদি জড়াজড়ি করে শুয়ে থাকে।
নাতনী আর দাদির সুখ দুঃখের সাথে তাল মিলিয়ে বর্ষা চলে এলো। একদিন বেশ বৃষ্টি পড়ছিলো। হিরন মিয়া সাইকেল বের করতে পারেনি। হাঁটু পর্যন্ত গামবুট পরে চিঠি বিলি করতে বের হয়েছে। রজব আলীর বাড়ির কাছে কাছে আসতেই ঝুম বৃষ্টি নামলো। বৃষ্টির জন্য দুই হাত দূরের রাস্তাও দেখা যাচ্ছে না। বাধ্য হয়ে রজব আলীর বারান্দায় উঠে দাঁড়ালো। অন্য সময় বৃষ্টি হলে বুড়ি বারান্দাতে বসে থাকে। আজকের বৃষ্টির তোড় এতো বেশি যে সারাটা বারান্দা ভিজে কাদা কাদা হয়ে গেছে। সুন্দরী বেগম দাদিকে ঘরের ভেতর এনে বসালো।
হিরন মিয়া বারান্দায় উঠতেই রজব আলীর মা চেঁচিয়ে উঠলো,
: কেডারে, আমার দাওয়াত কেডা উডলো রে?
অবস্থা বেগতিক দেখে হিরন মিয়া বলে উঠলো,
: আমি, আমি ‘চিডিঅলা, আপনাগো চিডিঅলা।
রজব আলীর মা খুশিতে আটখানা হয়ে গেলো।
: অ, আইজ বুঝি আমার চিডি আইছে, গরের ভেতরে আইসা বও, অ সুন্দরীরে, চিডি আইছে, তর দাদায় চিডি দিছে।
সুন্দরী বেগম মুখ ঝামটা দিলো,
: অ, চিডি আইছে না বাল, বুড়িমাগী খালি হারাদিন চিডি চিডি করে। কেডাদিবোচিডি?
গজ গজ করতে করতে ঘরে কোণে গিয়ে বসলো। এসবে বুড়ির খেয়াল নেই। ফোকলা দাঁতে হেসে প্রায় হামাগুড়ি দিয়ে হিরন মিয়ার কাছে এসে বসলো,
: আমারে পইড়া শোনাইবা রজব আলীর বাপে কি লিকছে? কতদিন দেহি না তারে!
বলেই বুক কাঁপানো দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো। হিরন মিয়া বিপদেই পড়লো। অবস্থা দেখে সুন্দরীবেগম তার জায়গা থেকে চেঁচালো,
: আইজ যদি চিডি পড়ইরা না হোনাও তুমার খবর আছে। আমি সুন্দরীবেগম, মনে রাইখো আমাকে সবাই চেনে, আইজ তুমিও চিনবা।
ভয়েভয়ে একবার সুন্দরীবেগমের দিকে তাকায় আর একবার রজব আলীর মা’র দিকে। বুড়ি ফোঁকলা একগাল হাসি দিয়ে বললো,
: হোনাও বাজান,হোনাও কি লেখছে রজবআলীর বাপে।
হিরন মিয়া ভাবছে, আজ কোন কুক্ষণে যে বের হয়েছিলো। পোস্টমাস্টার বলেছিলো বৃষ্টির মধ্যে বের নাহয়ে কাল চিঠি বিলি করতে। কিন্তু ওর যে কী হয়ে গেলো, প্রবাসী পরিজনের চিঠি হাতে পাওয়া মানুষগুলোর রঙ্গীন মুখটা দেখতে ওর খুব ভালো লাগে। তাই ভাবলো ব্যাগের মধ্যে তিনটা চিঠি আছে, দিয়েই বাড়ি ফিরে যাবে। মাঝপথে ঘোর বৃষ্টি, বাধ্য হয়ে এখানে এসে বসা। শ্যান নজরে ওর দিকে তাকিয়ে আছে সুন্দরী বেগম। এবার হিরন মিয়া ঝোলা হাতড়াতে শুরু করলো। খামের মধ্য থেকে একটা কাগজ বের করে নিজের দিকে ধরে পড়া শুরু করলো,
‘হে আমার প্রিয়তমা, কেমন আছো তুমি? কতদিন দেখি না তোমায়, খুব ইচ্ছে করছে তোমাকে দেখতে। মনে পড়ে ফেলে আসা দিনগুলো। আমাদের সংসার ছিলো ভালোবাসায় ভরপুর। দিন শুরু হতো তোমার চাঁদমুখ দেকে আর ঘুমাতাম আমার মাথায় তোমার চাঁপাকলির মতো আঙ্গুলের বিলি কাটার সুখ নিয়ে। মনে হয় এখনো তুমি আমার বুকের ভেতর ছোট্ট পাখিটি হয়ে চুপটি করে শুয়ে আছো। আমার হলুদ পাখি, আমাকে কি মনে পড়ে তোমার? ভালো থেকো সোনা। আমার অনেক আদর তোমার জন্য’।
চিঠি শেষ হওয়ার আগেই রজব আলীর মা হাপুস নয়নে কেঁদে ফেললো। চোখের উপর আঁচল চাপা দিয়ে নিঃশব্দে কাঁদছে। একটু দূরে সুন্দরী বেগম স্তন্ধ হয়ে বসে আছে। শূন্য দৃষ্টিতে বাইরে তাকিয়ে আছে, বৃষ্টি কমে গেছে। কিন্তু সামনে বসা দুই নারীর ভেতর তুমুল ঝড় উঠেছে। হিরন মিয়া দু’জনের দিকে তাকিয়ে চুপচাপ বের হয়ে এলো।
বৃষ্টি কমলেও বাইরে বেশ ঠান্ডা হাওয়া বইছে, শরীর কামড় বসাতে চাইছে। হঠাৎ করে এক একটা হাওয়ার বেগ এসে হিরন মিয়ার বুকের পাঁজর কাঁপিয়ে দিচ্ছে। তারপরও কেমন যেন একটা শান্তি শান্তি ভাব। ভাটি অঞ্চল থেকে এসে বিভিন্ন জেলায় এত দিন চাকরি করেছে, সব সময় একই রকম মনে হয়েছে। কিন্তু আজ মনে হলো এ শুধু তার চাকরি নয় পরম আনন্দও। যতদিন এ এলাকায় চিঠি বিলি করেছে কখনো রজব আলীর মাকে কাঁদতে দেখেনি, দেখেছে একনাগাড়ে গালিগালাজ করতে। আজ বাইরের কান্নার সাথে তার ভেতরের কান্না মিলেমিশে একাকার হয়ে গেছে। এমন নিঃশব্দ কান্না দিয়ে বুড়ি কত কী বলে গেলো।
মুখরা সুন্দরী বেগমও নিস্তব্ধ হয়ে গেছে। ওর ভেতর কত যে ভাংচুর চলছে। সেদিনের পর থেকে ও বাড়িতে আর চেঁচামেচি শোনা যাচ্ছে না। রজব আলীর মা চুপচাপ বসে থাকে উঠোনে পাতা মাদুরে আর কি যেন ভাবে, সুন্দরী বেগম উদাস হয়ে আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকে। খিদে পেলে দু’মুঠো রান্না করে দাদি-নাতনি খেয়ে নেয়। প্রতিবেশি মহিলারা পুকুর পারে দাঁড়িয়ে অথবা ঝোঁপঝাড়ের আড়াল থেকে দেখছে আর ভাবছে ‘এ বাড়ি এতো নিরব কেন, কোন সমস্যা হয় নি তো?’
দু’দিন পর হিরন মিয়া রজব আলীর বাড়ির পাশ দিয়ে যাচ্ছিলো। যেতে যেতে থমকে গেলো, সুন্দরী বেগম বেশ উদাস হয়ে পুকুর পারে বসে আছে। পাশ কাটিয়ে যাওয়ার সময় চোখ তুলে তাকালো। অবাক হয়ে গেলো, কালো দু’চোখে একী হাহাকার! সব হারানোর বেদনায় ম্লান হয়ে গেছে চোখের তারা। দ্রুত চলে যাচ্ছিলো হিরন মিয়া। পেছন থেকে ডেকে উঠলো সুন্দরী বেগম,
: যাইও না চিডিঅলা, একটুক খাড়াও।
হিরন মিয়া দাঁড়িয়ে গেলো। মাথা চুলকে বললো,
: চিডি বিলি করন লাগবো তো।
: আমগো কোন চিডি আহে নাই?
: আইলে তো দিতামই।
: কাইল যদি চিডি আহে দাদিরে হুনাইয়া যাইবেন।
এ বলার মধ্যে কি যে কাকুতি ছিলো, হিরন মিয়া পা আর এগোচ্ছে না। মনে হচ্ছে এখনই পুকুর পারে বসে একটা চিঠি পড়ে শোনায়। সাইকেলে প্যাডেল মেরে চলে গেলো। শুধু কানে বাজছে
‘আমগো কোন চিডি আহে নাই?’
পরদিন সব চিঠি বিলি করাশেষ করে হিরন মিয়া রজব আলীর বারান্দায় বসে চিঠি শোনাচ্ছে,
‘প্রিয়তমা আমার, কেমন আছো? আজ তোমাকে খুব মনে পড়ছে। খুব দেখতে ইচ্ছে করছে। তুমি আগের মতো আছো তো? আগের মতো নেই, তাতে কী! আমি তোমাকে এখনও অনেক ভালোবাসি। ভালোবাসার জন্য রুপ নয়, সুন্দর একটা মন লাগে, তোমার মনটা অনেক সুন্দর। কেউ না বুঝুক, আমি বুঝি। আমি চাই তুমি সবসময় এমন থাকো। দিঘির জলে ভেসে থাকা পদ্মফুলের মতো তোমার শান্ত রুপ আমি সবসময় দেখতে চাই। ভালো থেকো’।
এখন প্রতিদিন হিরন মিয়া চালভাজা খেতে খেতে রজব আলীর মা আর মেয়েকে চিঠি পড়ে শোনায়। রজব আলীর মা হাসি হাসি মুখে পান চিবোয়। আর সুন্দরী বেগমের গন্ডে ফুটে থাকে লালের আভা।
প্রতিবেশীরা অবাক হয়, এখন রজব আলীর টিনের চালে পাখপাখালির কলকাকলি শোনা যায়।
এক মেয়েটা মুঠো মুঠো জ্যোৎস্না কুড়িয়ে অপরের মুখমন্ডলে চাঁদ দেখত। মানুষের উপকার করার ক্ষেত্রে,…..
শেষ থেকে শুরু। আমি রজকিনী রামী,ধোপার বংশে জন্ম আমার।ঘাটে সখিদের সঙ্গে কাপড় কাচি। একাজটা আমি…..
মালঞ্চার পথে ভোরবেলা। সূর্য সবে উঠছিল। বৈশালী দূর থেকে দেখতে পেল,বুনিয়াদপুর বাসস্ট্যান্ডে বালুরঘাটের দিকে মুখ…..
আমার বাবা ছিলেন অত্যন্ত সাহসী একজন লড়াকু মনের মানুষ।শত অভাব অভিযোগেও তাকে কোনোদিন ভেঙ্গে…..