ইমন কল্যাণ
পরিচ্ছেদ ৬ অনেক রাতে ফিরেছিল কল্যাণ ওরফে শহীদুল।গাড়িটা শেডে রাখার পর দু’বার হালকা করে মা…..
এই উড্ডয়নের সময় বেশ লাগে। তুমি মাটি থেকে বিচ্ছিন্ন হচ্ছ, সেটা প্রতিটা মুহূর্ত টের পাচ্ছো। ধীরে খুব ধীরে হালকা করে মাটির শেষ বিন্দু থেকে বিচ্ছিন্ন হচ্ছ। এরপর শূন্যে। ভাসমান। তোমার পায়ের নিচে মাটি নেই। ভাবতেই শিহরণ জাগে। দোলা দিয়ে তুমি শূন্যে ভাসতে থাকো। অনেকটা উড়তে থাকো, পাখা ছাড়া এবং বসে বসে।
ব্যাপারটা নিরুপমার ভাল লাগে। সেই ছোটবেলায় প্রথম প্লেনে চড়ে ছিল। প্রথমবারও তাঁর এতটুকু ভয় লাগে নি। অদ্ভুত বিচিত্র ভালোলাগায় ভরে গিয়েছিল মন। সেই ভালোলাগা এখনো কাজ করে, এই মাঝ বয়সেও যতবার প্লেনে চড়ে। প্রথমবার মা তাঁর হাত খুব শক্ত করে ধরেছিল। মেয়ে তাঁর ভয় পেলে? জিজ্ঞেসও করেছিল “ভয় পাচ্ছিস? ভয় নেই, মা আছি”
“না তো, ভয় পাচ্ছি না মা”
মা একটু মুচকি হাঁসি দিয়ে ছোট নিরুপমার ছোট হাত মুঠো করে ধরেছিল।
প্লেন এখন স্থির অনেকটাই। আলো জ্বলে উঠেছে, সিট বেল্ট সাইন অফ। অধিকাংশই বাঙালি। কিছু সাদা ভোতা নাকের চেহারা বাদে।
নিরুপমার পাশের সীটে এক বাঙালি ভদ্রমহিলা, কোলে শিশু। কোণা চোখে লক্ষ করে মহিলাটিকে। এ তাঁর এক বদভ্যাস। কোন অপরিচিত তাঁর পাশে বসলে তাঁকে লক্ষ্য করা। সে ছেলে হলে ব্যাপারটা মোটেও সুবিধাজনক হত না। মহিলার হাতে দুই বালা স্বর্ণের চুরি, হাতে স্বর্ণের আংটি, গলায় স্বর্ণের মোটা চেইন। থাইল্যান্ডে যাওয়ার সময় হাতে গলায় এত গয়না পরার কি আছে!
শিশুটির বয়স কত হবে? এক বা তাঁর একটু বেশি বোধহয়। কিছুক্ষণ বাদেই কেঁদে উঠবে। এরা কি বুঝে না, প্লেনে বা যেকোনো পাবলিক ট্রান্সপোর্টে শিশুদের কান্না অন্যদের কতটা বিরক্ত করে?
করে না বোধহয়। একবার অফিসের কলিগ সহ কলকাতা যাওয়ার প্লেনে এক শিশু আধা ঘণ্টা ধরে কেঁদেই যাচ্ছিলো। প্লেন ল্যান্ড করা পর্যন্ত কোঁকা। নিরুপমার বিরক্তি দেখে পাশে বসা কলিগ অবাক হয়ে প্রশ্ন করলো “এত বিরক্ত হচ্ছেন কেন? বাচ্চাই তো”। ব্যাপারটা এমন যেন শিশুটির কান্না নয় তাঁর বিরক্ত হওয়াই কলিগটির কাছে বেশি বিরক্তিকর। সেদিন নিরুপমার মনে হয়েছিল বাচ্চার কান্না শুধু মনে হয় তারই বিরক্ত লাগে বাকি সবার আছে উচ্চাঙ্গ সঙ্গীত মনে হয়।
বিমানবালা জুস দিয়ে গেলো। নিরুপমা জুস খাচ্ছে আর মনে মনে প্রার্থনা করছে যেন শিশুটি কেঁদে না উঠে। এটা কলকাতা যাওয়ার ৩০ মিনিটের জার্নি নয়, থাইল্যান্ড যেতে ২ ঘণ্টা লাগবে। এমনিতে জীবনে অনেক বিরক্তিকর পথে হেঁটে যাচ্ছে সে আর বাড়তি খুচরা বিরক্তি চায় না।
“কোথায় যাচ্ছেন” পাশের ভদ্রমহিলা বলে উঠলেন।
একটা ভাব ধরে নিরুপমা উত্তর দিলো “থাইল্যান্ড যাচ্ছি”
যদিও তাঁর কোন এক হিন্দি সিনেমার মত ডায়লগ দিতে ইচ্ছে করছিল যে এই প্লেন থাইল্যান্ড যাচ্ছে। তাই আমি তো আর মাঝ পথে নামতে পারবো না, থাইল্যান্ডই যাবো।
“আমরাও, আমি আর আমার হাসবেন্ড। পিছনে। খুব তাড়াহুড়া করে এসেছি তো তাই একসাথে সিট পাই নি।
যেন নিরুপমা তাঁকে জিজ্ঞেস করেছি কেন সে তাঁর স্বামীর সাথে বসে নি।
“কি করেন আপনি”
“চাকরি”
“অহ, অফিসের কাজে যাচ্ছেন, একা?”
“না অফিসের কাজে না, বেড়াতে যাচ্ছি, হ্যাঁ একা”
“একা বেড়াতে যাচ্ছেন?” ভুবন ভোলান অবাক হওয়া বোধহয় একে বলে যেটা এই মহিলা হয়েছে এখন।
“হ্যাঁ একা” একটা হাসি দিয়ে বলে নিরুপমা।
“অহ আচ্ছা, আপনার স্বামী? মানে একা একা ভাল লাগবে বেড়াতে?”
হাসিটা বিস্তৃত করে নিরুপমা উত্তর দেয় “আমার স্বামী নেই, বিয়ে করি নি”
“অহ আচ্ছা” মহিলা আর কিছু বলতে চাচ্ছে না, বা চাচ্ছে কিন্তু বলতে পারছে না। বোধহয় ভাবছে ৩০ পার করা এক মেয়ে এখনও বিয়ে করেনি কেন। আর একা একা একটা মেয়ে থাইল্যান্ড যাচ্ছে? কীভাবে?
“আমি মাঝে মাঝেই একা একা বেড়াতে যাই এদিক সেদিক, আমার একা বেড়াতে ভাল লাগে” মহিলাটিকে চমকে দেওয়ার জন্যই নিজ থেকেই বলল নিরুপমা।
“হ্যাঁ? অহ, হ্যাঁ অনেকেই যায়”
“আপনি? মানে আপনারা?”
“আমরাও বেড়াতে। ক্রাবি যাবো। এর আগে পাতায়া ফুকেট গিয়েছিলাম, প্রতিবছরই যাই”
“প্রতিবছর থাইল্যান্ডে?”
“না না বিভিন্ন দেশে, ও হওয়ার পর মাঝে দুই বছর যাই নি” কোলের শিশুটিকে দেখিয়ে বলল।
“ওর বাবা ব্যাংকে আছে, প্রায় যাই আমরা বেড়াতে”
“আপনি কিছু করেন?”
“না ঘর সংসার আর এখন ও হয়ে যাওয়ার পর সময় কই কিছু করার” একটু মনে হয় লজ্জা পেয়েছে মহিলাটি।
“নাম কি ওর?” নিরুপমার একদমই জানার কোনও ইচ্ছে নেই এই শিশুর নাম কি, তারা প্রতিবছর যায় না প্রতি মাসে যায়, তবু মাঝে মাঝে নিরুপমা সামাজিক হয়ে উঠে কোনও কারণ ছাড়া। তাঁর পরিচিত মহলে প্রচলিত আছে সে অসামাজিক, অনেকটা বেয়াড়া। এবং আজকে যে সে এত কথা বলছে এই অজানা মহিলাটির সাথে তাতে নিরুপমা নিজের সম্পর্কে একটি ধারনা পেলো “সে প্রয়োজনে অসামাজিক, অপ্রয়োজনে সামাজিক”
“সিয়াম” মহিলাটির মুখে সুখের একটি বিস্তৃত হাসি। নিরুপমা তাকিয়ে দেখল সেই হাসি। মানুষের যা নিয়ে সুখে থাকার কথা তা নিয়ে এই মহিলাটি সুখে আছে মনে হয়। তাঁর হয়ত একটি সুখি পরিবার আছে, একটি ভালবাসার স্বামী আছে, একটি আদুরে সন্তান আছে এবং বছর বছর বাইরে বেড়ানও আছে। সহজ সরল স্বাভাবিক জীবন। কোন কিন্তু নেই জীবনে। এভাবেই কেটে যাবে বাকি সময়গুলো। তাঁর হয়ত আরেকটি সন্তান হবে। তাদের বড় করতে করতে মহিলার সময় সব খরচ হবে। এক সময় সন্তানরা বড় হবে, তাদের বিয়ে দিবে, নাতি নাতনি হবে। সুখে শান্তিতে থেকে একদিন শান্তিতে মরবে। মৃত্যুকালে তিনি একজন সুখি মানুষ হয়ে থাকবেন।
কি নির্ভেজাল জীবন! এমন নির্ভেজাল জীবন সবার হয় না কেন? হয়, যারা নির্ভেজাল চিন্তা করে তারাই নির্ভেজাল জীবন পায়। চিন্তার শাখা প্রশাখা গজালে শান্তিরা ছড়িয়ে ছিটিয়ে যায়।
শিশুটি জেগে উঠেছে কিন্তু কাঁদছে না। মা তাঁকে খাওয়াতে ব্যস্ত। নিরুপমা তাঁকে দেখছে আড়চোখে। কী দেখছে সে জানে না। সে কি এমন জীবন চায়? এমন নির্ভাবনার জীবন? কখনও চেয়েছিল?
না সে এমন জীবন চায় নি কখনও। তবু মাঝে মাঝে মনে হয় সে আসলে এটাই চেয়েছিল।
নিরুপমা চোখ বুজে। একটু ঘুম ঘুম লাগে।
“নিরু তুমি কিসে সুখ পাও তুমি কি জানো? এই মহিলা, কোলে শিশু দেখে তোমার কি কোথাও ব্যথা হচ্ছে?
না ব্যথা হচ্ছে না, হিংসাও হচ্ছে না, আমি কখনই এমন সংসারী জীবন চাই নি। চাইনি বাইরে কোন কাজ না করে শুধু স্বামী সন্তান সংসার নিয়ে পড়ে থাকতে। আমি মা আর বউ হওয়া ছাড়াও অন্য কিছু হতে চেয়েছি”
“তা হয়েছো ঠিকই তবু কি তুমি এখন সুখি? এত অস্থিরতা কেন তোমার ভেতর”
“জানি না, জানি না সেই উত্তর”
নিরুপমার তন্দ্রা ভাঙ্গে ক্যাপ্টেনের যান্ত্রিক আওয়াজে।
লরাকে এসএমএস করে দিয়ে নিরুপমা হোটেলে উঠে। লরার কাছাকাছি একটা হোটেলে। ক্ষেপে যাবে লরা, তবু নিরুপমা একটু একা থাকতে চায়। চেনা জানা সকল কিছু থেকে দুরে। বিশেষত যেখানে কেউ তাঁকে চিনবে না এমন দুরে।
হোটেলে আগে থেকে বুকিং ছিল না। তবু এর আগেও এখানে থেকেছে বার কয়েকবার। সেই পরিচয়ে রুম পেয়ে গেল। বিশাল রুম। বিশাল বিছানা। অনেকটা রাজা বাদশা আমলের পালঙ্কের মত। এবং বিশাল কাঁচের জানালা। শহরের বিশাল দালান আর সুবিশাল আকাশ দেখা যায় যেখান থেকে।
এখনও দুপুর, ক্ষুধা লেগেছে, স্নানটা সেরে খেতে যেতে হবে। তাঁর আগে জানালার পাশে রাখা সোফায় হেলান দিয়ে একটা সিগারেট ধরায় নিরুপমা। দেখছে দালান গুলোকে, যারা সারি সারি লাইন ধরে দাঁড়িয়ে আছে। কোনও আওয়াজ নেই তাদের, কোনও চাওয়া নেই তাদের, কোনও অভিমান নেই তাদের। তারা আছে কারণ মানুষ তাদের বানিয়েছে। আশ্চর্য! মানুষের বানানো জিনিসে মানুষের কোনও আবেগ নেই। আবেগ অনুভব করার ক্ষমতা মানুষ কাউকে দিলো না। বা দিতে পারলো না। পারল না কেন? এত এত অকল্পনীয় আবিষ্কার, সেসব কিছুর মধ্যে কোথাও এক ফোঁটা আবেগ নেই। আবেগ আছে বলেই মানুষ বোধসম্পন্ন প্রাণী। এই গুন যেন আর কেউ না পায় সেই জন্যই কি না দেওয়া?
হিংসা? যা মানুষকে মানুষ করেছে তা আর কারো হবে না?
তাচ্ছিল্যের একটা বাঁকা হাসি হাসে নিরুপমা। মনে মনে বলে, হায় মানুষ, তোমার আবেগ অনুভূতি তোমাকে মানুষ তো করেছে তবে এগুলো যদি একটু আধটু জড় পদার্থদের দিতে জানতে তবে হয়ত তোমার আবেগের মাত্রা একটু কমত। সিগারেট শেষ হলো, বাথরুমে ঢুকে মেজাজ খারাপ হলো নিরুপমার। এসব কী আবোল তাবোল ভাবছে সে। পাগল হয়ে গেলো নাকি?
ফোন বাজছে। নির্ঘাত লরা।
“হ্যালো লরা?”
“আজব মানুষ তুই, আমার এখানে না উঠে তুই হোটেলে উঠলি কোন সাহসে? এটা কি তোর অফিস ট্যুর?”
“আসবো তোর বাসায়, কিন্তু এখন একটু একা থাকতে চাই রে”। ক্লান্ত শোনালো নিরুপমার গলা।
“হয়েছে কী তোর?”
“কিছু না”
“কিছু তো অবশ্যই হয়েছে। বাসায় আয়”
একটু চুপ থেকে নিরুপমা বলে, “ টিকিট কাটবো তোর জন্যও। ফুকেট যাবো দুজন”
“মানে কি? বললেই হলো?”
“হ্যাঁ বললেই হলো। তুই শেষ কবে বেড়াতে গিয়েছিলি। শুধু তুই আর আমি? দেশ ছাড়ার আগে তো জানিয়েও আসলি না। এখন বললেই হলো না কেন?” একটু তেঁতো স্বরে বলে নিরুপমা।
অপরপাশ চুপ।
নিরুপমা আরো বলে, “আমি সহ বাদ দেই, তুই নিজে কবে কোথায় গিয়েছিস লাস্ট ৪ বছরে? বাসা টু দোকান, দোকান টু বাসা ছাড়া আর কোথায় গিয়েছিস?”
“সময় হয় না দোস্ত” করুণ শোনালো লরার গলা।
“সময় কারো হয় না। করে নিতে হয়। রাত দিন তো খেটেই যাচ্ছিস। কীসের জন্য? একটু ভাল থাকার জন্য। তিন বেলা খাওয়া আর মাথার উপর ছাঁদ। ব্যস এই ভাল থাকা? নিজের জন্য সময় না দিলে কীসের ভাল থাকা? “
কথা গুলো যেন নিজেকে নিজেই বলল নিরুপমা। একটু যেন থতমত খেলো। তবে তাঁর বলতে ভাল লাগছে।
“তুই যাবি আমার সাথে ব্যস কথা শেষ। যখন বলব তখন”
“আচ্ছা একটু সময় দে। কাজ গুলো বুঝিয়ে দেই হেলালকে”
“বুঝানোর কী আছে। ও জানে না কী কী করতে হবে?”
“জানে, তাও ডেইলি তো বসে না দোকানে। তাই …
“লরা, ডেইলি তুই বসিস, তুই সামলাস সব, তাই তুই এবার ছুটি নিবি। যেহেতু আয় দুইজনের নামেই হয় তাই শুধু তুই একা সব সামলাবি না। ওকেও ওর দায়িত্ব নিতে হবে”
চুপ থাকে দুজনেই খানিক।
“ক্ষুধা লেগেছে বের হবো এখন খেতে। তুই রেডি থাক। টিকিট কনফার্ম করে জানাচ্ছি”
বলেই ফোন কেটে দিলো নিরুপমা।
একটা জেদ একটা রাগ একটা আক্রোশ থেকেই ফোনটা বেশ জোরে টেবিলে রাখল নিরুপমা। রাগটা কি নিজের উপর? না ফেলে আসা সেই মানুষটার উপর?
*
এখানে বারের অভাব নেই। হোটেল থেকে বেরিয়েই লাইন ধরে বার। আড্ডা দিতে দিতে মদ্যপান করতে চাইলে বারই উত্তম। সাথে হালকা মিউজিক। এখানে ডিস্কো আর নাইটক্লাব যা আছে তাতে যেতে হয় মাতাল হতে চাইলে। মাতাল উদ্যম নৃত্য, এক কথায় নিজেকে বেমালুম হারিয়ে ফেলতে হলে নাইটক্লাব। নিজেকে নিয়ে কিছু ভাবতে হলে অথবা ভাবতে না চাইলে, বার অথবা পাভ।
নিরুপমা এক বোতল বিয়ার নিয়ে বসেছে রাস্তার ধারে একটি চেয়ারে। ডিসেম্বর মাসে আবহাওয়া ভাল, না গরম না ঠাণ্ডা। শিরশিরে হাওয়া দিয়ে যাচ্ছে মাঝে মাঝে। ভাল লাগছে নিরুপমার। বহুদিন পর কিছু ভাল লাগছে তার। বহুদিন পর নিজেকে হালকা লাগছে। কীসের যেন একটা ভার বয়ে চলছে সে। কীসের এতো ভার, এতো অশান্তি, এতো এলোমেলো ভেতরে সে জানে না বুঝেও না। প্রায় সবই তো আছে, তবু কেন এই একাকীত্ব, হাহাকার। কোন কিছু ভাল না লাগার যন্ত্রণা।
আসলেই কি সব পেয়েছে সে? ভাবে নিরুপমা। সিগারেট পুড়ে শেষ হয়ে যায়, মৃদু বাতাস তার কপালের চুল উড়িয়ে নিয়ে যায়। পড়ন্ত বিকেলে অলস সময়ে ভাবে নিজেকে নিয়ে।
এই হাহাকার কি অসীমকে নিয়ে? যে তাঁকে ছেড়ে গিয়েছে অন্য নারীর জন্য। না, অসীম তো ছাড়ে নি, সেই বদ্ধ উন্মাদ হয়ে প্লেট ভাঙার মত সম্পর্ক ভেঙে দিয়ে এসেছে। যেদিন সে অসীমকে দেখেছে অন্য নারীর ঠোঁটে চুমু দিতে। এতক্ষণের অলস অলস ভাল লাগার ভাব হুট করেই কেটে যায়। চোখের সামনে ফুটে উঠে সেই অসহ্য দৃশ্য।
অসীম বসে আছে সোফায়, পাশে তার বন্ধু বলে পরিচয় করে দেওয়া এক হাড্ডিসার লিকলিকে মেয়ে। মেয়েটি অসীমের চুলে হাত বুলচ্ছে। বন্ধুর চুলে হাত বুলাতে হবে কেন? উত্তর খুঁজে পেল না আড়ালে দাঁড়িয়ে থাকা নিরুপমা। বুক ধুক ধুক করে কাঁপছে। শ্বাস বড় হচ্ছে। তবু নিজেকে বুঝাতে লাগলো, হবে হয়ত বন্ধুরা এমন করে। আমি মনে হয় গেঁয়ো ভুতের মত হিংসে করছি। আসলে হিংসের কিছু নেই। কিচ্ছু নেই।
পর্দা খামছে দাঁড়িয়ে নিরুপমা দেখল, মেয়েটি অসীমের কাঁধে মাথা রাখছে, অসীম তাঁকে ঝাপটে ধরে চুমু খেলো। যেভাবে ঝাপটে ধরে সে নিরুপমাকেও চুমু খায়। যেভাবে গ্রোগ্রাসে গিলে নিরুপমার ঠোঁটের প্রতিটি উষ্ণতা। এক বিন্দুও এদিক ওদিক হচ্ছে না। হবুহু যেন সিনেমার কোন দৃশ্যের রিপ্লে হচ্ছে। নিরুপমা কাঁপছে। শরীর জুড়ে যেন ভূমিকম্প হচ্ছে। প্রচণ্ড শীতে কাঁপুনি যেমন বন্ধ হয় না, তেমনি থর থর করে নিরুপমা কাঁপছে। সে কী দেখছে এসব? কেন দেখছে? এমন ভয়ংকর দৃশ্য সে কীভাবে সহ্য করছে? সে সরে যাচ্ছে না কেন? বা এখনই ওদের সামনে দাঁড়িয়ে চিৎকার করছে না কেন? কেন অসীমের গালে চড় বসাচ্ছে না?
কেন সে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে এই দৃশ্য পলকহীন চোখে দেখে যাচ্ছে?
অসীমের চুমু খাওয়া শেষ হলে নিরুপমার বিস্ফোরিত চোখ থেকে টুপ করে জল নেমে যায়। চুমুর কামে বিভোর অসীম জানতে পারে নি তাদের লীলাখেলা পিছনে কারও চোখের জলের কারণ হচ্ছে।
পেছন ফিরে বেরিয়ে যায় নিরুপমা। এরপর আর অসীমের সাথে নিরুপমার কোনও যোগাযোগ হয় নি, যোগাযোগ হতে দেয় নি নিরুপমা। অসীম অফিসে, ফেসবুকে, যত রকম চ্যাটিং এপ আছে সব জায়গায় নিরুপমাকে নক করেছে। কিন্তু কোথাও কোনভাবে যোগাযোগ হতে দেয় নি নিরুপমা।
সে কি ঘৃণা করে অসীমকে এখন? বহুবার এই প্রশ্ন নিজেকে নিজেই করেছে। প্রতিবার জবাব হ্যাঁ দিয়েছে। কিন্তু পরক্ষনেই আবার আরেকটি প্রশ্নের উত্তরে বিরক্ত হয়েছে।
“ঘৃণাই যদি করি তবে এতো অস্থিরতা কেন? এত বিষণ্ণতা কেন? এত কান্না পায় কেন? এত হাহাকার কেন চারিদিকে? ঘৃণাই যদি হবে তবে এত কষ্ট কেন ঘৃণায়?”
কিছুক্ষণ আগে যে ভাল লাগা কাজ করছিল নিরুপমার তা উড়ে গেলো। এখন সব কিছুই বিরক্ত লাগছে। অসহ্য লাগছে। সকল কিছু অর্থহীন লাগছে অসীমকে ছাড়া। আরও বেশি বিরক্ত লাগছে এই চিন্তায় যে কেন অসীম নেই বলে সব কিছু মূল্যহীন মনে হবে। কেন?
বার ছেড়ে বেরিয়ে পড়ল রাস্তায়। সন্ধ্যা নেমে গেছে শহরে। নিরুপমা হাঁটছে। উদ্দেশ্যহীন হাঁটা। গন্তব্যহীন হাঁটা।
পরনে টিশার্ট তার উপর সুতির শার্ট, আর শর্ট জিন্স। পায়ে দু ফিতার স্যান্ডেল, চোখে চশমা, হাতে সিগারেট। বাংলাদেশে যা অসম্ভব এখানে সেটা দুধভাত। রাত হতে হতে বাতাস বাড়ছে হালকা হালকা। একটু শীতও করছে। হেঁটে হেঁটে অনেক দূর চলে আসে নিরুপমা। ক্লান্তিতে যখন আর হাঁটতে পারে না, একটা শপিংমলের সামনে থামে। এলোমেলো ভাবে বসে থাকে সিঁড়িতে। চুল বাতাসে উড়ে। সামনে দিয়ে কত মানুষ যাওয়া আসা করছে। কেউ ফিরেও তাকাচ্ছে না তার দিকে। তুমি বসে আছ কি দাঁড়িয়ে আছো না শুয়ে আছো, কেউ ফিরেও তাকাবে না তোমার দিকে। এখানে সবাই ব্যস্ত। অথবা সবাই জানে অন্যের জীবনে বা অন্যের দিকে অহেতুক তাকাতে নেই। তুমি তোমাকে নিয়ে বাঁচো। অন্যরা অন্যদের নিয়ে। এই কি ভাল না?
নিজেকে নিয়ে ব্যস্ত থাকলেই তো ভাল নাকি। যে যেভাবে খুশি বাঁচতে পারবে কারও কোনও আপত্তি নেই, এই তো স্বাধীনতা। যদি না তা অন্যের ক্ষতি করে।
নিরুপমা ফোনের দিকে তাকায়। দেশে থাকলে এতক্ষণে মা’র ফোন আসতে শুরু করত অনেকবার। বিদেশ বলে মায়ের ফোন পাচ্ছে না।
“হ্যালো মা, কী করো?”
“নিরু, কী অবস্থা তোর? কোথায় এখন? ঠিকঠাক আছে সব?”
“হ্যাঁ মা, সব ঠিক। তুমি কী করছিলে?”
“এই তো টিভি দেখছিলাম”
“সিরিয়াল?”
“আর কী দেখবো, ওই সিরিয়াল দেখে দেখেই তো সময় কাটে আমার”
“মা’র গলা কি নরম শুনালো? একটু হতাশ? নাকি শোনার ভুল?”
নিরুপমা কথা পাল্টায়। “কি রেঁধেছ আজকে?”
“রুই মাছ দিয়ে ফুলকপি। দাঁড়া চ্যানেল ঘুরাই, নাগিন শুরু হবে”
“আচ্ছা মা, রাখি সিরিয়াল দেখো। ফোন দিবো পরে”
“আচ্ছা শোন শোন, এখন কোথায়, কী করছিলি?”
“কিছু না, এই শপিং এ ঘুরছিলাম”
“একটা ব্যাগ দেখিস তো আমার জন্য, মাঝারি সাইজের”
“আচ্ছা নিবো। আর কিছু লাগবে?”
“ব্যাগই নিস শুধু”
ফোনের ভেতর থেকেই শুনতে পাচ্ছে নিরুপমা নাগিন সিরিয়ালের আওয়াজ। “ওকে মা রাখি এখন”
নাগিন শুরু হয়। নাজমা আক্তার, নিরুপমার মা গভীর মনোযোগে নাগিন দেখতে থাকেন। হিন্দি বাঙলা মিলিয়ে প্রায় সব সিরিয়ালই দেখেন। সারাদিনে রুটিনে বিশেষ কিছু থাকে না করার। সকালে উঠেনও নিরুপমা অফিস যাওয়ার পর। ঘরের কাজ করার জন্য গ্রাম থেকে একজনকে নিয়ে এসেছেন নাজমা আক্তার। রান্নাটা শুধু নিজে করেন। রান্না করতে ভালবাসেন। দুপুরে রান্নাবান্নার পাঠ সেরে আবার ক্ষণিক বিছানায় গড়ান। বিকেলে নীচে হাঁটতে যান। ডায়াবেটিস থাকার কারণে নিয়ম মত হাঁটতে হয়। যদিও শরীরে তেমন মেদ জমতে দেন নি নাজমা আক্তার। বরাবরই হালকা পাতলা শরীর তার।
সন্ধ্যা থেকে শুরু হয় সিরিয়াল দেখার পালা। এই একঘেয়ে দিন যাপনে নাজমা আক্তারের কোনও আক্ষেপ নেই। স্বামীর সাথে ডিভোর্স হয়েছে নিরুপমার বয়স যখন ১০বা ১১। সে যে কী কারণে ডিভোর্স হলো ঠিকঠাক জানেও না নিরুপমা।
সেই থেকে নিরুপমাকে নিয়ে একা সংসার তার। একাই গড়েছেন নিরুপমাকে, একাই লড়েছেন সমাজ পরিবার এবং একাকীত্বের সাথে। কিন্তু বড় আশ্চর্যের বিষয় নাজমা আক্তারকে দেখে কোনদিন মনে হয়নি তিনি একজন কঠোর পরিশ্রমী মহিলা। এমন একজন মহিলার সিরিয়াল ছাড়া চলবে না তা কেউ ভাবতেও পারে না।
বেসরকারি চাকরি করতো, নিরুপমার চাকরিতে উন্নতি হওয়ার পর ছেড়ে দিয়ে সারাদিন বাসায় থাকে। এটাও আরেক অদ্ভুত দিক। যারা সাধারণত সারাজীবন চাকরি করে আসে তারা হুট করে চাকরি ছেড়ে দিয়ে ঘরে বসে থাকতে চায় না। নাজমা আক্তার তাই করেছেন। এখন দিব্বি শুয়ে বসে হেসে খেলে সিরিয়াল দেখে দিন কাটাচ্ছেন। কিন্তু কেন তার কোন আফসোস নেই? কেন সংসার না হওয়ার দুঃখ নেই? কেন সঙ্গী না থাকার দীর্ঘশ্বাস নেই? এসবই বিস্ময়ের সৃষ্টি করে নিরুপমার মনে। সে তার মাকে বুঝে না। বুঝে পায় না যার জীবন দুঃখে ভরা থাকার কথা সে কীভাবে এমন হেসে খেলে জীবন কাটিয়ে দিতে পারে কোন রকম অভিযোগ ছাড়া।
আর কেন নিরুপমার অভিযোগ করার কিছু না থাকা সত্ত্বেও জীবনে অভিযোগের লিস্টের সংখ্যা ক্রমেই লম্বা হচ্ছে?
রাত বাড়ে। হাই উঠে নাজমা আক্তারের। ভাত খেয়ে উঠে আবার টিভি দেখে, এবার দেখে সারেগামা। শোয়ার আগে তিনি কিছুক্ষণ বারান্দায় বসে থাকেন। সামনে একটা বিশাল আম গাছ বারান্দার সাথে লাগোয়া। শহরের ফ্ল্যাট বাড়িতে আম গাছের অস্তিত্ব থাকার কথা না, কিন্তু এই গাছটি রয়ে গেছে। প্রতিদিন সকালে আর রাতে তিনি বারান্দায় বসেন। মনে মনে গাছটিকে আদর করেন। গাছটি কে লাগিয়েছে জানে না কেউ। আম হলে বিল্ডিং এর সবাই মিলে খায়।
নাজমা আক্তারের মনে হয় গাছটিও তাকে দেখে। যদিও ব্যাপারটি সম্পূর্ণ অবাস্তব তবুও তার এখানে বসে গাছটির দিকে তাকিয়ে থাকতে ভাল লাগে, শান্তি লাগে। চারিদিক নিঝুম, মাঝে মাঝে পাখির নড়াচড়ার আওয়াজ পাওয়া যায়। সকালে যখন বারান্দায় আসেন তখন সবুজ সবুজ পাতাগুলো কেমন যেন নেচে নেচে নাজমা আক্তারকে স্বাগত জানায়। কেউ না বুঝুক কিন্তু নাজমা আক্তার ঠিকই বুঝেন পাতাগুলো তাকে দেখে উচ্ছল হয়ে উঠে, ঝিলিক দিয়ে উঠে। সকালের সোনালি আলো পাতাগুলোর উপর হেলে পড়ে আরও ঝলমলে করে তুলে। দুপুরে গোসল সেরে যখন কাপড় মেলতে আসেন তখন এই গাছই বারান্দাটাকে ছায়ায় ঢেকে রাখে। রোদে যেন তার সমস্যা না হয়। তিনিও কৃতজ্ঞতায় মুচকি হেসে ধন্যবাদ দেন। সন্ধ্যায় আরেক দফা এসে পাতার ফাঁক দিয়ে দিনের শেষ দেখেন। পাতাগুলো হালকা হালকা উড়ে। গোধূলির আলো আস্তে আস্তে নিভতে থাকে। এই দৃশ্য নাজমা আক্তার প্রতিদিন দেখেন। দেখতে ভাল লাগে তাঁর। ভাবেন এই তো জীবন, প্রতি ক্ষণের অনুভবই জীবন।
এখন এই ধুসর অন্ধকারে সবুজ গাছটিকেও ধূসর লাগছে। তিনি হাত বাড়িয়ে বারান্দায় ঢুকে পড়া একটি ঢালের পাতায় হাত বুলান। পাতার ঠাণ্ডা ঠাণ্ডা স্পর্শ পেয়ে নাজমা আক্তারের মনে হয় যেন কেউ তাঁর হাতেও স্পর্শ দিয়ে যাচ্ছে। বুক ভরে শ্বাস নেন। মনে মনে বলেন আরও বড় হও, আরও ছায়া দাও, আরও শান্তি দাও।
রাত বাড়ে, ঘুম আসে। তবু নাজমা আক্তারের একটু থাকতে ইচ্ছে করে গাছটার সাথে। পৃথিবী ঘুমিয়ে পড়ে ধীরে ধীরে। জীবন যুদ্ধে জয়ী কোনও মধ্যবয়সী ক্লান্ত রমণী কোনও এক গাছের সাথে তাঁর অনুভূতি ভাগ করে নিচ্ছে। পৃথিবী এসবের খবর রাখে না।
চলবে..
পরিচ্ছেদ ৬ অনেক রাতে ফিরেছিল কল্যাণ ওরফে শহীদুল।গাড়িটা শেডে রাখার পর দু’বার হালকা করে মা…..
পরিচ্ছেদ ৫ আকাশে এখন আর মেঘ নেই। হাওয়া হচ্ছে।কদিন পরেই বর্ষা নামবে।একদিন হাসপাতাল থেকে ফিরতে…..
পরিচ্ছেদ ৪ ভোর হয়ে আসছে।রাতে ভালো ঘুম হয়নি।ঘুমের ঘোরে মনে হচ্ছিল দম বন্ধ হয়ে আসছে।এরকম…..
তারপর ইলেকট্রিক বিল জমা দিতে যাবো। আমার দেরি হবে আসতে। স্বামী অমর বলে, ঠিক আছে।…..