প্রক্সি
তারপর ইলেকট্রিক বিল জমা দিতে যাবো। আমার দেরি হবে আসতে। স্বামী অমর বলে, ঠিক আছে।…..
নিরুপমার সাথে কথা বলার পর থেকে লরার কেমন যেন বিরক্ত লাগছে নিজের উপর । কেউ সত্যিটা মুখের উপর ঠাস করে বলে দিলে রাগটা অন্যের উপর নয় নিজের উপর হয়। নিরুপমা সত্যি বলেছে। লরা নিজেকে নিয়ে ভাবে না, নিজেকে সময় দেয় না। এমন না যে সে স্বামী সংসার নিয়ে খুব ব্যস্ত। সে শুধু তার দোকান নিয়ে ব্যস্ত। একটি টিনের চালার নাস্তার দোকান নিয়ে ব্যস্ত। যেখানে থাই খাবারের পাশাপাশি লরা দেশীয় কিছু খাবারও রেখেছে। এই নিয়ে কেটে যায় তার সারাদিন। এরপর ঘরের রান্না, ঘরের কাজ আর রাতে ঘুম। কোথাও নিজের জন্য কিছু করার নেই যেন লরার। আশ্চর্য, এমন কখন থেকে হয়ে গেলো সে? কেন হল?
হেলালের সাথে তার পরিচয় সেই কলেজ জীবন থেকে। একই সাথে কলেজ, একই সাথে ইউনিভার্সিটি, এরপর বিয়ে। ভালোই ছিল তারা। বা এখনও হয়তো আছে। কিন্তু আগের মত সেই উচ্ছ্বাস, উত্তেজনা কি আছে? আগের মত তারা দুজনই কি আছে ? হেলালের বড় গা এড়ানো ভাব। সংসার দোকান কাজ কোন কিছু নিয়েই তার কোন মাথাব্যথা নেই। নিজে কোন আলাদা কাজও করে না। লরার দোকানে থাকতে পারে, সেটাও করে না ঠিকঠাক। হেলাল যদি দোকান সামলাত তবে লরা হয়ত নিজের জন্য কিছু করতে পারতো।
আসলেই কি পারতো? লরা কি কখন হেলালকে জোর করেছিল দোকান সামলাতে? কেন করে নি? ভেতরে কোথাও লরার অভিমান জমেছিল এই ভেবে যে আমাকে কেন বলতে হবে? হেলাল নিজ থেকে কেন করে না! অভিমানের তোড়ে লরা কখনো হেলালকে কর্মঠ বানাতে পারে নি।
“সব আমি নিজেই সামলাতে পারবো” এই তেজের কারণে অনেকটা রোবটের মত ঘর এবং বাহির সবই সামলিয়েছে। কখনো নিজেকে ক্লান্ত হতে দেয় নি। আজ নিরুর কথায় কোত্থেকে যেন একটা আলসেমির ভাব ঝাপটে ধরেছে লরাকে। বিকেলে দোকানে যাওয়ার কথা, সেটাও যায় নি আজ। খুব বেশি অসুস্থ না হলে সে কখনো দোকান কামাই করে না। দোকান থেকে ফোনও এসেছে বার কয়েক। সে ধরেও নি।
বেডরুমে গিয়ে লরা ড্রেসিং টেবিলের আয়নায় নিজেকে দেখে। শ্যামলা রঙের তীক্ষ্ণ মুখের একটু মেদবহুল লম্বাটে শরীর। আগে যে ছিল একদম ছিপছিপে আজ তার তলপেটে মেদের উঁকিঝুঁকি। গালের দু পাশে বয়সের ছাপের গভীর দুইটি লাইন। এই বত্রিশেই বয়সের ছাপ?
কপাল ভাঁজ করে বিরক্ত হয় লরার নিজের উপর। থাইল্যান্ডে থেকেও যদি শরীর চেহারার এই হাল হয় ! তার বাসার পাশেই একটা স্পা এন্ড পার্লার আছে। কখনো গিয়ে কি একটু ঘষামাজা করেছে? এমন হয়ে গেলো কবে থেকে সে? ইউনিভার্সিটি থাকতে যে সব সময় সাজগোজ করে চলতো, কপালে বড় বড় টিপ, শাড়ি চুরি গয়নার শেষ ছিল না যার সে আজ দিব্বি একই ধরণের শার্ট প্যান্ট পরে কাটিয়ে দিচ্ছে সপ্তাহের ৭ দিন।
লরার পরনে এখন একটা কালো সাদা স্ট্রাইপ শার্ট, নীচে কপার কালারের জিন্স, হাতে একটা ঘড়ি, চুল উঁচু করে বাধা। এই তার পোশাক, এই তার সাজ। কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে রাগে গড়গড় করতে থাকল। নাক ফুলে জোরে জোরে শ্বাস নিচ্ছে লরা। আচানক এই রাগের কোন হেতু নেই, তবু রাগ হচ্ছে। হাত মুঠি পাকিয়ে দাঁড়িয়ে কিছুক্ষণ ফোঁস ফোঁস করল ।
যেন আয়নার ভেতরে মেয়েটি সে নয়। তার উপর ভর করা কোনও কুৎসিত ছায়া যে তার জীবনকে রসকষহীন করে তুলেছে। এক টানে চুল খুলে ড্রেসিং টেবিলের সামনে রাখা টুলে বসে পড়ে। বুক ঠেলে কান্না আসতে থাকে। যে কান্না দুঃখের চেয়ে বেশি রাগের। যে রাগ তার নিজের উপর। যে রাগ এই অহেতুক বেঁচে থাকার উপর।
“টিকিট কেটেছিস?” লরা ফোন করে নিরুপমার থেকে জানতে চায়।
“কথা বলে রেখেছি, এখনো কনফার্ম করে নি। তুই যাবি তো?”
“হ্যাঁ যাবো” বেশ গাঢ় শোনায় লরার গলার আওয়াজ। নিরুপমাও বুঝতে পারে গলা কেমন যেন লাগছে। কিন্তু কিছু জানতে চাইল না।
“আচ্ছা তাহলে কনফার্ম হলে তোকে জানিয়ে দিবো। রেডি থাকিস”
ফোন রেখে দিলো লরা।
পর্দা টেনে বিছানায় এলিয়ে পড়ল । ক্লান্ত লাগছে ভীষণ। কাজ না করেই আজ সে বড্ড ক্লান্ত। নিদারুণ আলস্যে আস্তে আস্তে ঘুমিয়ে পড়ল লরা।
ঘুম ভাঙ্গে কলিংবেলের আওয়াজে। বিছানাতেই শুয়ে ঘড়ি দেখে বুঝতে পারে হেলাল এসেছে। রাত যেহেতু সাড়ে এগারটা সেহেতু এখন হেলালেরই আসার সময়।
উঠে দরজা খুলে দিয়ে হেলালের দিকে ফিরেও চায় না লরা। সোজা রান্নাঘরে ঢুকে খাবার গরম করতে থাকে। মুখে চাপ দাড়ি, ব্যাক ব্রাশ করা চুল, ফর্সা গোলগাল চেহারা, চোখে চশমা, ভারী শরীর নিয়ে হেলাল প্রতিদিন এই সময়ে ঘরে ফিরে। সারাদিন বিশেষ কোনও কাজ করে না হেলাল। এখানে আসার পর কয়েকজন বন্ধু হয়েছে, তাদের সাথেই এখানে সেখানে আড্ডা দিয়ে বেড়ায়। কোত্থেকে যেন তার মতই বেকার লোকজন জুটিয়ে নিয়েছে সে। যেদিন আড্ডা থাকে না সেদিন একা একাই পথে হাটে। কেন সে এমন কাজ কর্ম থেকে বিচ্ছিন্ন থাকে, সে ঠিক নিজেও জানে না। অথবা জানে, স্বীকার করতে চায় না। হেলালেরও কোনও এক জায়গায় হয়ত অভিমান আছে লরার উপর। কিন্তু সেটা কোন জায়গায় না জানে লরা না জানে হেলাল।
আজ কিছুই রান্না হয় নি, গতকালের গুলোই গরম করছে লরা। বাথরুমে দরজা খোলার আওয়াজ পেলো। কিছুক্ষণ পর ডাইনিং রুমে চেয়ার টানার আওয়াজ সাথে টিভির আওয়াজ। হেলাল খাওয়ার টেবিলে বসে টিভি দেখছে। দুজনে মিলে খাবে, টিভি দেখবে, এরপর ঘুমিয়ে যাবে। মাঝেমাঝে তাদের মধ্যে কিছু শারীরিক ক্রিয়া হয় তাও এক ঘেয়ে পানসে। তারা একে অপরকে ভালোবাসে না তাও নয়। কিন্তু আগের মত উত্তেজনা খুঁজে পায় না কেউ।
“আজ কিছু রাঁধো নি? কালকের মাংস যে?” সরল ভাবেই বলল হেলাল। কিন্তু লরা ভেতরে জ্বলে গেল। এটাই এতদিন হয়ে এসেছে যে দোকান সামলে লরাই এসে ঘরের জন্য রান্না করে। এর ব্যতিক্রম হলো, মাঝে মাঝে দোকান থেকে খাবার নিয়ে আসা। আজ যেহেতু দোকানেরও খাবার নেই সেহেতু হেলালের এই প্রশ্ন স্বাভাবিক। অন্যদিন হলে লরাও স্বাভাবিক ভাবে নিতো। কিন্তু আজ নিতে পারছে না। খাওয়া থামিয়ে হেলালের দিকে তাকিয়ে থাকল অপলক। রাগে, ক্রোধে। সেদিকে খেয়ালই নেই হেলালের। সে টিভির দিকে তাকিয়ে খাচ্ছে।
হুট করে বলে উঠলো লরা, “আজ সারাদিন কোথায় ছিলে?”
সারাদিন হেলাল বিশেষ কিছু করে না বলেই লরা জানে। জেনে শুনে এই প্রশ্ন অবাক করেছে হেলালকে। টিভি থেকে চোখ নামিয়ে খাওয়ার দিকে তাকিয়ে বলে, “এই তো ডেইলি যা করি”
“কী করো?” লরার শীতল জিজ্ঞাসা।
এবার হেলাল তাকায় লরার দিকে। বুঝতে পারে না লরা কেন এমন অদ্ভুত প্রশ্ন করছে। তবে চোখে মুখে লরার কঠিন একটা ভাব ফুটে উঠছে সেটা স্পষ্টই বুঝতে পারছে।
“এই তো সামনের মাঠে ছিলাম, এরপর লাইব্রেরি গেলাম, আড্ডা দিলাম” একটু হেসে উত্তর দেওয়ার চেষ্টা করে হেলাল।
যেন কোন অপরাধ ধরা পড়ে যাবে এমন একটা লুকোচুরি ভাব চোখে মুখে।
লরা একটা শ্বাস ফেলে খাওয়ায় মনোযোগ দিলো। দুজনে কেউ আর কোনও কথা বলল না।
খাওয়া শেষ করে লরা সোজা বিছানায় গেলো শুতে । নিরুর মেসেজ এসেছে। আগামী পরশু ফুকেটের ফ্লাইটের টিকিট মেইল করে দিয়েছে। ফোন সাইডে রেখে লাইট অফ করে দেয়। কালই সে শপিং এ যাবে। যা কিনতে ইচ্ছে হয় সব কিনবে। অনেক অনেক দিন পর একটা উত্তেজনাবোধ করে ভেতরে লরার। সারাদিন জুড়ে যে খারাপ লাগা ভাবটা ছিল নিরুর এই মেসেজেই সেটা ভাল হয়ে গেলো।
একটু পর হেলাল আসে বিছানায়। হেলালের উপস্থিতিতে লরার তন্দ্রা কেটে গেলো।
দোকান সামলাবে কে? হেলাল পারবে? যদি না পারে। টেনশন হচ্ছিল লরার, কিন্তু পড়ে মনের জোরেই টেনশনকে পাশ কেটে ঘুমিয়ে পড়লো।
সকালে হেলাল খেয়াল করলো লরা এখনো দোকানে যায় নি। কিন্তু অন্যদিন লরা হেলালের আগেই বেরিয়ে যায়। সে লরাকে লক্ষ্য করতে লাগলো। আড়চোখে দেখতে লাগলো লরা যেন কী গোছগাছ করছে। কিন্তু এখন তো তার দোকানে থাকার কথা।
টিভি ছেড়ে বসেছিল হেলাল। লরা সামনে এসে দাঁড়ালো। হেলালের জন্য এক কাপ চা সামনে রেখে বলল , “আমি কাল ফুকেট যাচ্ছি। নিরু এসেছে, ওর সাথে। হয়ত কিছুদিন থাকবো। তুমি দোকান সামলে নিও এই কয়দিন”
হা করে শুনল হেলাল, যেন কী বলছে লরা বুঝতেই পারে নি।
“আমি সামলাবো মানে? আমি কখনো দেখেছি নাকি?”
“দেখো নি এখন দেখবে। দোকানও তো তোমার আমার। আমি না থাকলে তুমি দেখবে এটাই তো স্বাভাবিক”
খুব শান্ত ভাবে কথা গুলো বলল, যেন সব সময় এমনই হয়ে এসেছে। যেন লরা আর হেলাল মিলেই দোকান সামলায়। কেউ একজন না থাকলে অন্য জন দেখাশোনা করে। অথচ আদৌ কোনদিন এমন হয় নি। যে হেলাল দোকানে একদিনের জন্যও বসে নি সে আজ থেকে দোকান সামলাবে।
বিস্মিত ভাব বজায় রেখে হেলাল আবারও বলল, “আমি কীভাবে দেখবো? আজব তো” কণ্ঠে এখন একটু বিরক্তি ফুটে উঠলো।
লরা চুপ করে শুনল এবং ভাবল, আমি থাকব না এই কয়দিন সেটা কোনও বিষয় না হেলালের কাছে। হেলালের কাছে বিষয় হচ্ছে দোকান সামলানো। সে একবারও বলল না, আমিও যাব তোমাদের সাথে।
লরা সামনে থেকে চলে গেল। রেডি হয়ে বের হওয়ার আগে দরজায় দাঁড়িয়ে শীতল গলায় বলল, “এতদিন সামলাও নি জানি। কিন্তু এবার সামলাতে হবে। সবসময় আমি বেঁচে থাকবো এমনতো না হেলাল”
শেষ কথায় হেলাল চমকে উঠে।কী বলছে এসব লরা! বাঁচা মরার কথা কেন আসছে?
লরা বেরিয়ে যায়, হেলাল সেইদিকে তাকিয়ে থাকে অনেকক্ষণ।
*
রাতে থাই শহর দিনের চেয়ে বেশি সরগরম থাকে। রেস্টুরেন্ট ডিস্কো নাইট ক্লাব ভর্তি মানুষ । আজ যেহেতু শনিবার আজ অন্যদিনের চেয়ে বেশি মানুষ। উপচে পড়ছে, ঢলে পড়ছে, মাতাল হচ্ছে, এলোমেলো থাকছে যে যার মত থাকছে। কেউ তাকাচ্ছে না, কেউ মাথা ঘামাচ্ছে না। যার যেভাবে খুশি আনন্দ খুঁজে নিচ্ছে। আনন্দ এখানে অনেক সহজ সস্তা, প্রতি পেগ হিসেবে কিনতে পাওয়া যায়। অথবা জীবনই এখানে অনেক সোজা। হেসে খেলে পার করে দেওয়া যায়। নিরুপমা পার করতে চাচ্ছে।
ইন্সেনিটি নামে একটা নাইট ক্লাবে বসে টাকিলা খেয়ে ফেলেছে ৩ শট। নিরুপমা খুব বেশি পান করতে পারে না। করলেই মাতলামি শুরু করে দেয়। তাও আজ জেনে শুনেই পান করছে। কিছু একটা ভুলতে অথবা ভেতরের অস্থিরতা কমাতে। কান ফাটা ভলিউমে ডিজে চলছে। স্টেজে নাচ হচ্ছে। দলে দলে কেউ বসে পান করছে, কেউ নাচছে, কেউ অট্টহাসিতে ফেটে পড়ছে। সবাই এখানে উন্মত্ত, সবাই এখানে দিশেহারা, সবাই এখানে ফুর্তিতে মগ্ন।
নিরুপমার একটু একটু নেশা হয়েছে। একা বারের চেয়ারে বসে সবাইকে দেখছে। তার সামনেই একটা জটলা, তিনটা মেয়ে আর দুইটা ছেলে। মেয়ে তিনটার সাজ একটু বেশি লাগছে। একটু দূরে বামে সোফার মধ্যে দুই জোড়া কাপল বসে আছে। একে অপরের খুব কাছাকাছি, ঠোঁট লাগাচ্ছে একে অপরের গালে গ্রীবায় কাঁধে। চোখে মুখে প্রেমেভরা কাম। অসীমও আমার দিকে এভাবে তাকাতো? নিজের অজান্তে অসীমের কথা মনে হাওয়াই আবারও বিরক্ত হলো নিজের উপর নিরুপমা।
ধুর, বলে শব্দ করে ঘুরে তাকালও। সামনের বারটেন্ডার তার দিকে তাকিয়ে মুচকি মুচকি হাসছে। নিরুপমা পাল্টা হাসি ফেরত দিয়ে উঠে গেলো। সে কী করছে এখানে? এখানে বন্ধুদের সাথে আসা যায়, একা একা কী জন্য এসেছে? গ্লাসের দিকে তাকিয়ে রাগে গড়গড় করতে থাকে আর নিজেকে নিজেই প্রশ্ন করে নিরুপমা।
এই হাই ভলিউমে মিউজিক কি ভাল লাগছে?
এই নাচানাচি কি ভাল লাগছে?
একরাশ মানুষের ভিড়ে একা একা বসে থাকতে ভাল লাগছে?
সব প্রশ্নের উত্তর না। প্রচণ্ড রাগ নিজের উপর জমতে জমতে হালকা একটু জলের দেখা পাওয়া গেলো নিরুপমার চোখে।
নিজেতে মগ্ন নিরুপমা শুনতে পায় কে যেন ইংরেজিতে বলছে সে কি ঠিক আছে কিনা?
ফিরে তাকিয়ে দেখে লাল টিশার্ট আর ব্লু জিন্স পরা সাদাটে রোদে পোড়া চামড়া, লম্বায় ৬ ছাড়ানো, সুঠাম দেহের ভিনদেশি ছেলে। দাঁড়িয়ে তাকেই উদ্দেশ্য করে জিজ্ঞেস করছে। চোখে মুখে একটু দুষ্টুমি মাখা হাসি।
“হ্যাঁ আমি ঠিক আছে। ধন্যবাদ”
“না তুমি ওভাবে বসেছিলে তাই জিজ্ঞেস করছিলাম। শরীর খারাপ হলো কিনা”
হেসে নিরুপমা জবাব দিলো সে ঠিক আছে। পাশের চেয়ার খালি দেখে সেখান বসলো ছেলেটি, হাতে একটা গ্লাস।
জানা গেলো ছেলেটির নাম নিক। এসেছে কুইন্স থেকে। বন্ধুদের সাথে। ষ্টেজে বন্ধুদের দেখাল।
“তুমি যাচ্ছ না কেন নাচতে?” জিজ্ঞেস করে নিরুপমা।
“এখন ইচ্ছে করেছে না। কালও অনেক নেচেছি”
এরপর কী বলা যায় ভেবে পাচ্ছে না নিরুপমা। নিকই বলল “নাচবে আমার সাথে?”
না বলে প্রত্যাখ্যান করলো। এরপরও কিছুক্ষণ বসে থেকে নিক উঠে যাচ্ছিল, উঠতে উঠতে বলল, “এশিয়ান মেয়েদের এই কালার আমার পছন্দ খুব। আমি সয় ১১ তে থাকছি, তুমি যদি চাও আমার সাথে আজ রাতে যেতে পারো”
অত্যন্ত ভদ্র ভাষায় কোনোরকম সংকোচ ছাড়া বলে ফেলা যে আমি আজকে রাতে তোমার সাথে শুতে চাচ্ছি। খুব সহজ একটা প্রস্তাব এই দেশের জন্য। নিরুপমার দেশের জন্য যা খুবই অশালীন। যদিও প্রস্তাবটি যৌক্তিক ভাবে নিলো নিরুপমা কিন্তু বিস্মিত না হয়ে পারলো না।
স্বাভাবিক থেকেই হাসি মুখে উত্তর দিলো যে সে আগ্রহী নয়। ছেলেটিও হাসিমুখে বিদায় নিয়ে চলে গেলো। একজন রাজি না হলে কি হয়েছে, এখানে আরও অনেকে আছে যে আজকে রাতে তার সঙ্গী হয়ে যাবে । কেউ হয়তো টাকার বিনিময়ে, কেউ শুধুমাত্র শরীরের খাতিরে। এখানে শরীর নিয়ে কারও কোন আদিখ্যেতা নেই। এখানে ‘যাকে মন দিবো তাঁকে শরীর দিবো’ এই রীতি মানা হয় না। এখানে ‘ক্ষুধা লাগলে খাবার খাওয়ার মত শরীর জেগেছে চাহিদা মেটাব’ রীতি চলে।
কত সহজ কত নির্ভেজাল কত রাখঢাকহীন সব কিছু। নিয়ম যেখানে যত বেশি নিয়ম ভাঙার প্রবণতাও সেখানে তত বেশি।
নিরুপমার অস্বস্তি লাগছে। জীবনে এই প্রথম কেউ তাঁকে এমন প্রস্তাব দিয়েছে। সে বের হয়ে যায়, রাত তখন ২টার কাছাকাছি। ক্লাবের সামনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কিছু মানুষের ভিড়। সবাই তরুণ তরুণী। এদের কারও মধ্যে কোন ভয় নেই, এত রাতে বাসায় ফিরবে কীভাবে। কেউ তাদের জিজ্ঞেস করবে না কেন তুমি এত রাতে বাইরে। এরা প্রশ্নহীন সমাজে বাস করে।
নিরুপমা ফুটপাতে নেমে ট্যাক্সির জন্য অপেক্ষা করতে করতে মেয়েদের দেখছে। এতো যে তারা হাসছে এদের জীবনে কোন দুঃখ নেই? এদের কেউ কোনদিন ছেড়ে যায় নি? কারও জন্য হাহাকার করে নি বুক? বিষণ্ণতায় ভুগে নি কোন রাত?
হয়তো তারাও বাসে কাউকে ভাল, তারাও হয়তো হারায় কাউকে। তাদেরও গলায় উঠে আসে কান্নার রোষ। তারাও শিকার হয় বিশ্বাসঘাতকতার।
একটা লাল শর্ট স্কার্ট আর সুন্দর ফর্সা দু’পা সহ মেয়েকে দেখছে অনেকক্ষণ ধরে নিরুপমা। থাই মেয়ে, লালচে কালারের চুল, চমৎকার শরীর। খিল খিল করে হেসেই যাচ্ছে, উচ্ছলতা চুইয়ে চুইয়ে পড়ছে মেয়েটির মুখ থেকে। কিছুক্ষণ বাদে একটা লাল গাড়ি আসে, মেয়েটি একটা ছেলের সাথে উঠে চলে যায়।
বুকটা মোচড় দিয়ে উঠে নিরুপমার। এমনই একটি লাল গাড়িতে সে প্রথম চুমু খায় অসীমকে। তাদের প্রথম চুম্বন। এপ্রিলের কোন এক দিনে সন্ধ্যায় হুট করে কালবৈশাখী ঝড় শুরু হলে সে লেপটে যায় অসীমের গায়ের সাথে। কমলাপুর রেলস্টেশনের সামনে, চারিদিকে মানুষের আচানক দৌড়োদৌড়ি। কোথাও নিরাপদ আশ্রয় খুঁজে পেতে অস্থির। নিরুপমা আশ্রয় নিয়েছিল অসীমের পিঠের কাছে। অসীম মুচকি হেসে তাকিয়েছিল নিরুপমার দিকে। যে চাহনিতে নিরুপমা চুম্বকের মত আকর্ষণ বোধ করে।
“ভয় পাচ্ছ? আমার তো বেশ লাগছে। কী চমৎকার হাওয়া! কী চমৎকার তেজ এর!”
নিরুপমা ঝড়ে উড়তে থাকা এলোমেলো চুল সামলাতে সামলাতে বলে, “অনেক ধুলো”
অবাক দৃষ্টিতে অসীম নিরুপমার দিকে তাকিয়ে বলে “তুমি এখানে ধুলাই দেখলে শুধু, এর রূপ দেখলে না? কী ভয়ংকর সুন্দর!”
সে নিরুপমার কাঁধ জড়িয়ে ধরে বলে, “চোখ বন্ধ করে, আর এই ঝড়ের রূপ অনুভব করো”
নিরুপমার ভয় কেটে যায়। সে চোখ বুজে, আর বুঝতে পারে ঝড়ের প্রতিটা বালুকণা তার অঙ্গে লেপটে যাচ্ছে। ঝড়ের হাওয়া তার শরীর মন ছুঁয়ে যাচ্ছে। কিছুক্ষণ আগের প্রচণ্ড গরমের তেজ নিমিষেই পালিয়ে যায়। আর নিয়ে আসে একরাশ ঠাণ্ডা কুমকুম হাওয়া। নিরুপমা চোখ খোলে, দেখে অসীম তাকিয়ে আছে তার দিকে মন্ত্রমুগ্ধের মত।
অসীম তাকে টেনে গাড়িতে বসায়। এবং প্রথমবারের মতো তারা একে অপরের ঠোঁটের উষ্ণতা পান করে। সেটা নিরুপমার জীবনে প্রথম চুম্বন ছিল না। তবু অসীমের চুমুতে কিছু ছিল যা তাকে ভেঙ্গেচুরে ফেলত। মনে হত অসীম তাকে নিঃশেষ করে পান করছে। সেই লাল গাড়ির ভেতর দুই নরনারী সেদিন একে অপরকে ছুঁয়ে যাচ্ছিলো পরম ভালোবাসায় আর বাইরে উন্মাদ কালবৈশাখী সবকিছু উড়িয়ে নিয়ে যাচ্ছিল।
ট্যাক্সিতে অনেকটা অর্ধচেতনে ছিল নিরুপমা। কিন্তু ড্রাইভার তাকে কোন রকম সমস্যা করা ছাড়াই হোটেলে পৌঁছে দেয়। রুমে ঢুকে নিরুপমা বিছানায় পড়ে তারস্বরে কেঁদে উঠে। যতটা সম্ভব গলা ফাটিয়ে সে কাঁদে। অসীমকে ছেড়ে আসার পর এমন উন্মাদের মত সে কাঁদে নি কখনো। কান্না চেপে রেখে সে দিনের পর দিন কাটিয়ে দিয়েছে। কাটিয়ে দিয়েছে ৭ টা মাস। কান্না গলা পর্যন্ত উঠে আসত, সেটাকে গিলে ফেলত। কোনভাবে কাঁদা যাবে না, কোনও বিশ্বাসঘাতকের জন্য কাঁদা যাবে না এই নীতিতে চলে সে কান্নাকে দমিয়ে রেখেছিল। আজ সেই কান্না তার উপর প্রতিশোধ নিচ্ছে। তাকে ঠেলে ঠেলে ভেতরে পাঠিয়ে দেওয়ার শাস্তি আজ নিরুপমাকে পেতে হবে। নিরুপমা কাঁদতে থাকে। বিধ্বস্ত বিমর্ষ নিঃসঙ্গ এক তরুণী ব্যাংককের কোনও এক পাঁচ তারকা হোটেলের রুমে নিজ জীবনের যন্ত্রণায় ছটফট করে আর্তনাদ করে। সে আর্তনাদ কাঁচের দেওয়াল ফুঁড়ে বাইরে শোনা যায় না। শহরের এক প্রান্তে নাচ,পানীয়,কামে মগ্ন মানুষ, আরেক প্রান্তে আঘাত পাওয়া নারীর আহাজারি। শহর সব কিছু হজম করে। যন্ত্রণাও আনন্দও।
তারপর ইলেকট্রিক বিল জমা দিতে যাবো। আমার দেরি হবে আসতে। স্বামী অমর বলে, ঠিক আছে।…..
নভেম্বর চলছে। অনির সাথে আজ দেখা হবে তা জানাই ছিল। এই তো ক’দিন আগেই দেখা…..
বুড়িমাসি বলেন,জীবনটা বালির ঘর গো।ঢেউ এলে ধুয়ে যায় জীবনের মায়া।তবু বড় ভালবাসা ওদের দাম্পত্যে।রোদের চাদরের…..
এক ড্রইং রুমে বসে রয়েছে সদ্য কিশোর উত্তীর্ণ তরুণ গোয়েন্দা সজীব। সামনের টেবিলে ছড়িয়ে…..