রমণীবাস (পর্ব- ৩)

ফারজানা নীলা
গল্প, ধারাবাহিক
Bengali
রমণীবাস (পর্ব- ৩)

আগের পর্ব পড়ুন এখানে >>>

পূর্ব প্রকাশিতের পর…

নিরুপমা  খুব সকালে  উঠে যায় যেহেতু আগের রাতে অনেক তাড়াতাড়ি ঘুমিয়ে পড়েছিল। লরা ঘুমোচ্ছে। বেচারি কি রাতে কেঁদেছিল নাকি। চোখের কোনে দাগ দেখা গেল মনে হয়। রাতে লরা অনেকবার চেষ্টা করেছিল তাঁকে জাগানোর জন্য। কিন্তু এমনই ক্লান্ত লাগছিল যে কোনমতেই উঠতে পারে নি। এখন ক্ষুধার জ্বালায় হাঁটতেও কষ্ট হচ্ছে। ভোরবেলা থেকে নাস্তা দেওয়া শুরু হয়। নিরুপমা গোগ্রাসে গিলল।

কটেজ থেকে সামনে কিছুদূর হাঁটলে বিচ পড়ে। এটাই মুল বিচ না। তবে এটাও সমুদ্রের শাখা প্রশাখা কিছু হবে। এখানে পর্যটক জমে না । কেউ আসে মাঝে মাঝে, রোদ স্নান করে। বীচের কিনারা ধরে উপরে ফুটপাতে হরেক রকমের খাবার পাওয়া যায়।বাংলাদেশের ভ্যানগাড়ির খাবারের মত।  অধিকাংশই সামুদ্রিক মাছ ভাজা। খেতেও চমৎকার । এত সকালে  এখনো কোনও দোকান খুলে নি। ফুকেট এমনেতেও শান্ত শহর এখন এই সকালবেলা আরও শান্ত।  হালকা শীতে মৃদু বাতাসে চুল উড়িয়ে নিরুপমা হেঁটে চলছে। হাঁটতে ভাল লাগছে। বছর খানেক আগে করা রিবন্ডিং চুল যত্নের অভাবে রুক্ষ। এতই রুক্ষ যে  উড়ে এসে যখন মুখে লাগে মনে হয় যেন শলা লাগছে।

নিরুপমা বিচের বালুতে বসে পড়ে। এখানে সব কিছুই পরিষ্কার। পানি স্বচ্ছ তাতে নিজের চেহারাও দেখা যায়। সূর্য ক্রমশ উপরে উঠছে তবু তেজ কম মনে হচ্ছে। নরম রোদের ছোঁয়া ভাল লাগছে।  আহা এমন ভাল লাগায় যদি সারাক্ষণ ভরে থাকত মন , সারাদিন প্রতিদিন।

কিন্তু নিরুপমা জানে বা মেনে নিয়েছে এই ভাল লাগার অনুভূতি তার খানিকের। একটু পরেই আবার সেই যন্ত্রণা শুরু হবে। ভেতরে মোচড়াবে । বুকের কোনায় অদৃশ্য ব্যথা। হাহাকার , সময় জুড়ে শূন্যতা। জগত-জুড়ে স্থিরতা। জীবনটাকে নিরর্থক মনে হওয়া। ভেতরে ক্রমাগত কিছু পুড়ে যাচ্ছে অথচ তার কাছে একে নেভানোর কোনও উপায় নেই। কি অসহায় লাগে নিজেকে! নিজেকে সে আত্ম নির্ভরশীল বানিয়েছে কিন্তু কষ্ট থেকে মুক্তি দিতে পারছে না। এই কুৎসিত অনুভূতির কাছে সে বন্দি। এই নির্মল আলো শীতল বাতাস ঝকঝকে পরিবেশ দূরে দেখা যাওয়া উচ্চ পর্বতমালার উদ্যত সৌন্দর্য কিছুই তার ভেতরটাকে আলোকিত করতে পারছে না। নিঃশ্বাস নিতে মাঝে মাঝে কষ্ট হয়। সেটা কি সিগারেট বেশি খাচ্ছে সেজন্য?

নিরুপমা চোখ বুজে জোরে শ্বাস নেয়। কিছুক্ষণ বাদে  চোখ খোলে। দেখে সে আর অসীম হাত ধরে হাঁটছে সমুদ্র পার ঘেঁষে। তাদের দুজনরেই পরনে সাদা শার্ট আর ব্লু জিন্স। আলোটা কেমন যেন ম্লান লাগছে। যেন বিকেলের আলো। এখন না সকাল বেলা? সন্ধ্যা হলো কী করে? সে কি পাগল হয়ে যাচ্ছে নাকি? নাকি হেলুশেনেশন হচ্ছে? তবে দৃশ্যটা পরিচিত। এমন ভাবেই তারা হেঁটেছিল সমুদ্রপারে যখন গিয়েছিল সমুদ্র পাড়ে এক সাথে। তাদের প্রথম ভ্যাকেশন। প্রথম একে অপরের গভীরে যাওয়া। এই তো এখন অসীম তাঁর কোমরে হাত দিবে। নিরুপমা দূরে বসে ঠিক ঠিক তাই দেখছে যা সে করে এসেছে বছর দুয়েক আগে।

নিরুপমার কোমর জড়িয়ে হাঁটা অসীমের ভীষণ প্রিয়।  তাঁরা হাঁটছে পাড় ঘেঁষে, বালি পায়ে চিকচিক করছে। নিরুপমার চুল উড়ছে বাতাসে। অসীম সেগুলো আলতো করে ছুঁয়ে দিচ্ছে। ক্ষণে ক্ষণে তাকাচ্ছে একে অপরের দিকে। খানিক মুচকি হাসির আদান প্রদান। খানিক কিছু চাওয়া পাওয়ার ইঙ্গিত। সূর্যটা ডুবে যাচ্ছে ধীরে। সেদিকে কারো খেয়াল নেই। অসীম তাকিয়ে আছে মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে নিরুপমার দিকে। নিরু তীব্র আকর্ষণে অসীমের দিকে ঝুঁকে যাচ্ছে। বুক কাঁপে, এই বুঝি অসীম মাঝ সমুদ্র পাড়ে, নগ্ন আকাশের নিচে কিছু ঘটিয়ে ফেলবে।

দেখো, ডুবে যাচ্ছে। নিরুপমা চোখ সরিয়ে সূর্যের দিকে তাকিয়ে বলে।

কী? অসীম তখন নিবিড় ভাবে তাঁর দিকে তাকিয়ে।

সূর্য।

আমিও ডুবতে চাই।

এই কথায় নিরুপমা ফিরে তাকায় আবার অসীমের দিকে। চোখ আটকে যায়। পাশে কোথাও বোম পরলেও যেন এই তাকানো সরানো যাবে না। যেন এভাবেই অনন্ত সময় বয়ে যাবে। যেন এখানেই শেষ, এখানেই জন্ম।

অসীম আরও কাছে ঘেঁষে দাঁড়ায় নিরুপমার। যতটা কাছে আসলে একে অপরের নিঃশ্বাস ছোঁয়া যায়।

মাঝ সমুদ্র পাড়ে, নগ্ন আকাশের নিচে সেদিন দুজন নরনারীর ঠোঁট নিবদ্ধ হয়েছিল গভীর ভাবে।

নিরুপমা আজ তেইশ’শ কিলোমিটার দুরে বসে খোলা চোখে দু বছর পুরনো ঘটনার পুনরাবৃত্তি দেখতে পায়। জীবন্ত, সতেজ, সাবলীল। ঠোঁটে এখনও সেই আগের মতই উষ্ণতা অনুভব করছে। সেই দিনের মতই এখনও সে থরথরে কেঁপে উঠছে। এখনও অবশ হচ্ছে শরীর যেমনটা হয়েছিল সেদিন, অসীমের বুকে।

কয়েকপা দিলেই সমুদ্র ছোঁয়া যাবে। নিরুপমা উঠে সমূদের কাছে যায়। পা ডুবায়, ঠাণ্ডা জল এসে বার বার তাঁকে ধাক্কা দিয়ে যায়। কোমল হাওয়া শরীর ছুঁয়ে যায়। নিরুপমা চোখ বুজে জোরে শ্বাস টানে। মনে মনে বলে, আর কত!

***

নাজমা আক্তারের সাপ্তাহিক একটা কাজের মধ্যে একটা হল বুক শেলফের সব বই বের করে  রোদে দিয়ে আবার সেগুলো সাজিয়ে রাখা। আজ রুটিনে সেই দিন। বই গুলো সাজাচ্ছেন তবে মনটা খানিক উদাস। নিরুর সাথে কথা হচ্ছে না দুই দিন। মেয়েটা বাইরে গেলে প্রতিদিনই ফোন করত, এবার কি যে হয়েছে। কি হয়েছে সেটা তিনি বুঝতে পারছেন কিন্তু কিছু বলেন নি। মেয়েকে তিনি পূর্ণ স্বাধীনতা দিয়েছেন। একটা বয়সের পর নিজের সিদ্ধান্ত নিজেই ঠিক করবে, এই রীতিতে মেয়েকে বড় করেছেন। সে যদি ভুল কোন সিদ্ধান্ত নেয় তাও মেয়ে নিজে বুঝবে, সঠিক নেয় সেটাও মেয়ের কৃতিত্ব। তবু মাঝে মাঝে বুকটা কেমন করে উঠে। মা বলে হয়ত। যেমন তিনি সেদিন থেকেই জানতেন যেদিন প্রথম নিরু অসীমকে নিয়ে এসেছিল বাসায়। অসীমকে দেখেই তাঁর মনে কু ডেকেছিল। কেন যেন ছেলেটির চোখের দিকে তাকিয়ে মনে হয়েছিল এ যেন ভালোবাসার যোগ্য নয়। এ যেন ঠিক ঘরে ফেরা পাখি না। রাত জাগা ঘুঘু। একে নিরু পছন্দ করেছে? মেয়ের পছন্দ তাই সরাসরি  নেগেটিভ কিছু বলে নি। কিন্তু আজ নিরুর এই দশা দেখে বুঝাই যাচ্ছে অসীম উড়ে গেছে।

সেদিন রাতে নিরু ফিরে এসেছিল বেহাল দশায়। চুল এলোমেলো, চোখ ঘোলা, থরথর করে কেঁপে কেঁপে সে ঘরে ঢুকেছিল। নাজমা আক্তার  কিছু জিজ্ঞেস করার আগেই মেয়ে রুমে ঢুকে দরজা লাগিয়ে দেয়।

সে রাতে তিনি এক ফোঁটা ঘুমাতে পারেন নি। বার বার মেয়ের রুমে এসে দরজায় কান পেতে শুনার চেষ্টা করেছেন মেয়ে বেঁচে আছে তো। কোনও পাগলামি করে বসে নি তো। বুকটা কে যেন সেদিন খামছে ধরেছিল। যদি কিছু হয় এই ভয়ে অস্থির রাত পার করেছিলেন। ভোরের দিকে দেখেন নিরু তাঁর রুমে এসে দাঁড়িয়ে। মেয়েকে দেখে আঁতকে উঠেন। এ কি অবস্থা! চোখ মুখ নাক ফুলে যেন চেনা যায় না। তাকিয়ে আছে মেঝের দিকে। যেন মেঝে  ভয়ংকর কিছু দেখেছে। দাঁড়াতে পারছে না সোজা। দরজা ধরে সোজা হয়ে থাকার চেষ্টা। নাজমা আক্তার  ভয় পেয়ে ডেকে উঠেন, নিরু?

নিরু আসে তাঁর কাছে। ধীরে খুব ধীরে। ঠিক যেমনটা প্রথম হাঁটতে শেখার পর থপথপ পায়ে মার দিকে আসত। যেন সেই ছোট্ট হাঁটতে শেখা নিরুকে ধরতে ঝাঁপিয়ে পরেন, যেন এখনই পরে যাবে, ব্যথা পেয়ে কেঁদে উঠবে।

নিরু জাপটে ধরে মাকে। হাউমাউ করে কেঁদে উঠে। নিরুর চিৎকারে যেন ঘরের দেয়ালগুলোও একটু নড়ে উঠে। নাজমা আক্তার সেদিন সত্যি ভয় পেয়ে গিয়েছিলেন নিরুর এই রূপ দেখে। তাঁর মেয়ে, যাকে তিনি  একজন শক্ত মনের মানুষ করে গড়ে তুলেছেন। যে যেকোনো ঝড়ে অনড় থাকতে পারবে। যার জীবনে আবেগের স্থান সবার নিচে থাকবে। কিন্তু সেইদিন  ভুল ভেঙেছিল। না তিনি পারেন নি মেয়েকে তাঁর বিপরীত বানাতে। রক্ত তাঁর পরিচয় দিয়েছে। তিনি যে আবেগের আঘাতে জীবনে ভালোবাসা থেকে বঞ্চিত হয়েছেন সেই আবেগের বীজ মেয়ের মধ্যেও আছে। মেয়ে তাঁর আজ বিধ্বস্ত। ভেঙ্গেচুরে  একাকার। এই মেয়ে জীবনে সুখি হতে পারবে তো? মেয়েকে জড়িয়ে ধরে মাথায় হাত বুলিয়ে সেদিন এই কথাই ভাবছিলেন। বলেন নি কিছু, জিজ্ঞেস করেন নি কিছু। কাঁদতে দিয়েছিলেন। কাঁদুক। মন মতো কাঁদুক। কাঁদার পর উঠে দাঁড়াক। সময় লাগুক, তবু কেঁদে নিক। বুকভরে।

বই গুছিয়ে  নাজমা আক্তার ফোন দিলেন মেয়েকে। ধরে নি। একটা ছোট শ্বাস ফেলে টিভি ছেড়ে বসেন। বাক্স ভর্তি মানুষগুলো  বিনোদন দেওয়ার জন্য আপ্রাণ চেষ্টা করে যাচ্ছে। কিন্তু আজ তিনি  বিনোদন পাচ্ছেন না। আজ তাঁর মন বসছে না। আজ তাঁর মন বার বার হাতছাড়া হচ্ছে। বহু বছর ধরে তিনি এই মনকে নিজের হাতে রেখেছেন। রাখতে  শিখেন অনেক কষ্টে। আজ একটু আলগা হয়ে গেল কি বাঁধন?

বার বার আজ তাঁকে কেন মনে পড়ছে? নিরুর বাবা। আতিক। কেন মনে পড়ছে? যাকে নিজ থেকে দুরে ফেলে এসেছেন ২২ বছর আগে। এখনও কি তাঁকে ভালোবাসেন? নাজমা আক্তার চুল চেপে ধরেন। হঠাৎ একটা কষ্ট চেপে ধরে তার সারা অস্তিত্ব জুড়ে। বুক ধড়ফড় করে। পানির পিপাসা পায়। বুক জ্বলে। নিস্তেজ হয়ে যান। সোফায় শুয়ে পড়েন। চোখ বুজে কাউকে দেখতে চান। যদিও এই কাজ তিনি করতে চান না স্বেচ্ছায়। কিন্তু আজ মনকে ছাড় দিয়েছেন। ছাড় দিতে ইচ্ছে করেছে। আজ একটু দুঃখবিলাস হোক। আজ একটু রোমন্থন হোক। আজ একটু অতীতে ফিরে যাওয়া হোক। আজ নিরুর বাবাকে একটু মনে করা হোক।

সিনেমায় সাজানো সংসার যেমন দেখানো হয়, নাজমা আক্তারের সংসার ছিল তেমন সাজানো। ডিগ্রি পড়া থেকে প্রেম আতিকের সাথে। সেই যুগের প্রেম বলতে যা বুঝায় , মাঝে মাঝে রিকশায় ঘুরা, দূর থেকে একে অপরকে দেখা। আর প্রতি সপ্তায় চিঠি। একেকটা চিঠি ছিল একেকটা কাব্য। অনুভূতির ফোয়ারা বয়ে যেতো চিঠির প্রতিটি অক্ষরে। কত আবেগ দিয়ে লেখা হত একেকটি চিঠি। যেদিন আতিকের চিঠি পেতেন সেদিন যেন মনে হত রাজ্য পেয়ে গেছেন হাতে। প্রতিবার চিঠি খোলার সময় বুক কেঁপে যেতো। চোখে মুখে লজ্জা ফুটে উঠত। সুখের চিহ্ন দেখা দিত ঠোঁটের কোণে হাসির ফাঁকে।

স্বপ্ন ছিল একটাই। বিয়ে সংসার। আতিকের সাথে একটা ছোট সংসার। কোল জুড়ে আসবে কোন শিশু। তাঁর আর আতিকের মিলিত অস্তিত্ব। এই। এই ভেবেই কেটে যেতে পারত এক জীবন। অথবা এর পরের জীবনও।

বিয়ে হল, সংসার হলো, নিরুপমা হলো। সুখে ভেসে যাচ্ছিলেন নাজমা আক্তার। নিজেকে নিজেই হিংসে করতেন। এক জীবনে এত সুখ সইবে কিনা, এক জীবনে সব কি পূরণ হতে হয়!

এখন মাঝে মাঝে ভাবেন নাজমা আক্তার হয়ত নিজেই নিজের সুখে নজর লাগিয়েছেন। নইলে কেন এমন ছারখার হবে সব?

স্বামীর চাকরি সুবাদে ঢাকায় চলে আসেন তারা। পড়া শেষ করে কোন চাকরি করবেন এই চিন্তা কোনোদিন বেখেয়ালেই ভাবেন নি। তখন কতজনই বা করত চাকরি। মেয়ে মানেই সংসার আর সন্তান। এই চিন্তাতেই বড় হয়েছেন, এই চিন্তাতেই সুখি ছিলেন।

সুখ! সে হচ্ছে একটা ছায়া। আলো নিভলেই হারিয়ে যায়। অন্ধকারে ভয় পেয়ে লুকিয়ে যায়।

সবই ঠিকঠাক চলছিল। নিরু হওয়ার পর আতিক কেমন যেন তাঁর থেকে দুরে দুরে থাকা শুরু করলেন। প্রথমে ভাবলেন, হয়তো শারীরিক কষ্ট হবে এই ভেবে স্বামী দুরে থাকেন। কিন্তু দূরত্ব বাড়তেই লাগল যখন নিরু বড় হতে লাগলো। লাজ লজ্জার মাথা খেয়ে নাজমা আক্তার এগিয়ে গেলেন। কিন্তু ফল তেমন কিছু হল না। আগের মত স্বামীকে কাছে পান না। কাজের চাপ যেন হুট করেই বেড়ে গেলো। রাত করে ফেরা। যখন তখন ঢাকার বাইরে চলে যাওয়া। বাইরে গেলে খবর রাখে না বাসার। বাসায় থাকলে মেয়েকে খানিক আদর করে শুধু। স্ত্রীর দিকে ফিরেও তাকান না। ছোটখাটো ব্যাপার নিয়ে তুমুল ঝগড়া।  এই হয়ে উঠে নাজমা আক্তারের সংসার।

এক সময় হয়ত আতিকই অসহ্য হয়ে উঠেন। রাগের মাথায় বলে ফেলেন যা শুনে নাজমা আক্তারের শরীর কাঠ হয়ে যায়। অন্য নারী। কখন কীভাবে কেন , কোনও উত্তর দিতে পারেন নি আতিক। শরীরের সব হাড্ডি যেন কেউ এক এক করে ভেঙ্গে দিচ্ছিল নাজমা আক্তারের।

এরপর সময় মলম লাগায় রীতিতে সব শীতল হয়ে আসে। সব আসলেই শীতল হয়ে যায়। আতিক হয়তো ওই নারীর সম্পর্ক রাখেন বা রাখেন না। তবে আগের মত রাত করেন না। ঢাকার বাইরেও তেমন যান না। তবু সম্পর্ক আগের মত হয় না। আগের মত নাজমা আক্তার  মন দিয়ে রাঁধেন না। ভাবেন না কোনট স্বামীর প্রিয় কোনটা খান না। ভাবেন না আজ বিকেলে কোন শাড়িটা পরে স্বামীর জন্য অপেক্ষা করবেন। ভাবেন না শক্রুবারে রিকশায় ঘুরবেন। ভাবেন না আজ রাতে স্বামীর বুকে মাথা রেখে ঘুমবেন।

ঘরে রাখা আসবাবপত্রের মত ঘরের দুটো মানুষও আসবাবপত্র হয়ে যায়। তাঁরা খায় দায় ঘুমায় এক সাথে। সকালে সূর্য আসে, রাতে আঁধার। নাজমা আক্তার সকালে নাস্তা রেডি করে দেন, মেয়েকে আর ঘর সামলান। সন্ধ্যায় আতিক আসে, টিভি দেখে, রাতে এক সাথে খায়। এরপর বাতি নিভিয়ে যে যার মত শুয়ে পরে। একটা সংসার যেখানে কোন আবেগ নেই, সুখ নেই, উত্তেজনা নেই, মনে কোন আশা নেই। শুধু মাঝে মাঝে নিরুর কান্নার চিৎকার অথবা হাসির কোলাহল শোনা যায়।

ক্লান্ত হয়ে পড়েন নাজমা আক্তার। এক বিকেলে মন খুব খারাপ করে বারান্দায় বসে থাকেন। নিরুকে পাশের বাসার মেয়ে নিয়ে গেছে খেলতে। তিন বছরের নিরু কত কথাই না বলতে পারে। সবার বড় আদরের হয়ে গেছে। সেদিন খালি বিকেলে একলা নাজমা আক্তার ভাবতে বসেন। এই কি ছিল তাঁর স্বপ্নের সংসার? এমন রঙ হীন? এমন ছোঁয়া হীন? এমন ভালোবাসাহীন? ভালোবাসা কি নেই? স্বামীর ঘটনা জানার পর রাগ হয়েছে, ভীষণ রাগ হয়েছে। কিন্তু ঘৃণা কি করতে পেরেছেন? এখনও কি পারছেন? পারছেন না। পারাও কি সম্ভব? যে মানুষটা তাঁর রন্ধ্রে রন্ধ্রে বাস করে তাঁকে কীভাবে ঘৃণা করবেন? যাকে ছাড়া জীবন ভাবতে পারেন না, তাঁকে কীভাবে ঘৃণা করবেন? যাকে নিয়ে অতীত বর্তমান ভবিষ্যৎ সাজিয়েছেন তাঁকে কীভাবে ঘৃণা করবেন?

ভাবতে ভাবতে যেন সমাধান পেয়ে গেলেন। যুক্তিহীন আবেগ নাজমা আক্তারকে বুঝিয়ে দিলো দোষ তাঁর। তিনি মেয়েকে নিয়ে এতই ব্যস্ত থাকতেন যে স্বামীর দিকে নজর দেন নি। বেচারা একা থাকতে থাকতে অনিচ্ছায় অন্য নারীর দিকে ঝুঁকে গেছে। কিন্তু এখনও তাঁকেই ভালোবাসেন। নইলে কি এখনও রাত করে বাড়ি ফিরত না, এখনও ঢাকার বাইরে যেত না? যাচ্ছে না তো। কারণ আতিক এখনও তাঁকে ভালবাসে। হ্যাঁ তাকেই ভালবাসে। মুহূর্তেই শরীরে মনে যেন বিদ্যুৎ জ্বলে গেল। আচানক এক আনন্দ এসে ভাসিয়ে দিলো তাঁকে। হারিয়ে যাওয়া সুখ যেন এই মুহূর্তে গুটিসুটি পায়ে এসে নাজমা আক্তারের কোলে টুপ করে বসে পড়ল।  চোখ দিয়ে জল গড়াতে লাগল। অনেকক্ষণ কাঁদলেন। সুখের কান্না না অসুখের সেটা বুঝতে পারলেন না। শুধু বুঝতে পারলেন আতিক তাঁকে এখনও ভালবাসে, এবং তিনিও বাসেন। একটা ভুলের জন্য তাঁর সংসার নষ্ট হতে পারে না। ভুল আতিকের চেয়ে তাঁরই বেশি। এই বোধটা জন্মাবার পর থেকেই তিনি স্বস্তি পাচ্ছেন। স্বস্তি পাচ্ছেন স্বামীর ঘাড় থেকে দোষটা সরাতে পেরে। নিজের ঘাড়ে দোষ নিয়ে নিজেকে নির্ভার মনে হচ্ছে। কারণ নিজের দোষ নিজে শোধরানো যায়। অন্যের দোষ নিজে শোধরাতে পারবেন না। যদিও অন্যের দোষ তিনি এখন আর মানতে রাজি নন।

কষ্টের দিন শেষ ভেবে নাজমা আক্তার উঠে সোজা চলে যান রান্না ঘরে। আজ স্বামীর প্রিয় খাবার পুডিং বানাবেন। স্বামীর প্রিয় লাল রঙের শাড়িটা পরে আজ অপেক্ষা করবেন। আতিক যেন ঘরে ঢুকেই চমকে যায়। ভাবতেই নাজমা আক্তার লজ্জায় নিজের শরীরের ভেতর লুকিয়ে যান। আজ অনেক দিন পর নাজমা আক্তার সাজবেন। তাঁর প্রিয় মানুষটার জন্য। রান্না ঘরে দুধের সাথে যখন ডিম মেশাচ্ছিলেন টুপ করে  চোখের জল দুধে পড়ে মিশে যায়, সেদিকে  খেয়াল করেন নি।

জগতের সকল মেয়ে এমন কিনা জানা নেই। তবে বাঙালি মেয়ে মাত্রই আপনজনদের সুখি করতে বেপরোয়া, এমন কি অন্যের দোষও তাঁরা নিজের কাঁধে নিয়ে নেয়।

সে রাত অনেক সুখের রাত ছিল নাজমা আক্তারের জন্য। সব কিছুই তেমন হয়েছিল যেমন তিনি আশা করেছিলেন। আতিক তাঁকে দেখে অবাক হয়েছিলেন, খুশিও হয়েছিলেন। রাতও কেটেছে সুখের আদরে।

সকালে অফিসের জন্য স্বামীকে  বিদায় দিয়ে নাজমা আক্তার  ভাবেন অবশেষে তাঁর সুখের সংসার আবার সব ঠিকঠাক। একে আর হাতছাড়া করা যাবে না। শিশুদের মত অদৃশ্য কিছুকে দেখে বলে উঠেন, এসো গো সুখ, এবার তোমায় আর কোথাও যেতে দিচ্ছি না।

সুখের রাজ্যে তৈরি করতে  নাজমা আক্তার ব্যস্ত তখন। শ্বাস ফেলার সময় নেই। ঘরদোর পরিপাটী, নিরু আদরে আদরে বড় হচ্ছে। সামনের বছর স্কুলে দিবেন। মেয়েকে নিয়ে প্রায় শপিং এ যান। নিজের চেয়ে বেশি স্বামীর  জন্য কেনেন। আতিকও এখন আগের চেয়ে বেশি আয় করছেন। স্ত্রীকে  আগের চেয়ে বেশি টাকা দেয় হাত খরচের জন্য। ব্যাপারটা দেখলে মনে হতে পারে নিজের অপরাধবোধ থেকে বাঁচতে স্ত্রীর হাত ভরে রাখেন। অথবা ঘুষ। অথচ তেমন কিছু ভাবার কথা নাজমা আক্তার  দুঃস্বপ্নেও ভাবতে পারেন না। তিনি ভাবতে জানেন শুধু তাঁর স্বামী  তাঁকে ভালোবাসে।

শপিং শেষে মেয়েকে নিয়ে আইসক্রিম খেতে রেস্তোরায় ঢোকেন। ঢুকতেই অনেকটা কোনও হিন্দি সিনেমার দৃশ্যের মত থমকে যান নাজমা আক্তার। নিরু টানছে মাকে ভেতরে যাওয়ার জন্য। নিরু হা করে হা করা মার দিকে তাকিয়ে থাকে। হলো কি মায়ের? ঢুকছে না কেন?

 মা চলো না ভেতরে।

ছোট নিরু ছোট ছোট হাতে মার হাত ধরে টানছে। নাজমা আক্তার ভেতরে যেতে পারছেন না। নিথর হয়ে স্থির তাকিয়ে আছেন সামনে বসা দুই নরনারীর দিকে।তাঁর স্বামী এবং তাঁর স্বামীর অন্য নারী। পাশাপাশি বসা। মেয়েটি হাত রাখছেতাঁর স্বামীর হাতে। আতিক কিছু যেন বললেন, হাত সরিয়ে নিলেন মেয়েটি থেকে। তবু উঠে গেলেন না। নাজমা আক্তারের আশেপাশে অনেক মানুষ, অনেক আওয়াজ। অথচ তিনি  কিছু শুনছেন না। তাঁর কানে কোনও আওয়াজ যাচ্ছে না। কোন শব্দ তিনি উচ্চারণ করতে পারছেন না। নিরু যে তাঁর হাত ধরে টানছে, সেটা তিনি বুঝতে পারছেন। বলতে চাইছেন তিনি ভেতরে যেতে পারবে না। চলো নিরু আমরা ফিরে যাই, আরেকদিন আইসক্রিম খাবো।

কিন্তু কিছুই তিনি বলতে পারছেন না। মুখ খুলতে চাচ্ছেন কিন্তু ঠোঁট দুটো আলাদা  করতে পারছেন না। অনেক কষ্ট হচ্ছে দাঁড়িয়ে থাকতে কিন্তু বসতেও পারছেন না। কোথায় বসবেন? রাস্তায়? মাটিতে? হুট করে মনে হলো, তাঁর পায়ের নিচে তো মাটি নেই। মাটি সরে গেছে অনেক আগেই  তিনি অবুঝই থেকে গেছেন।

ক্ষিপ্ত হাতে নিরুকে কোলে নিয়ে নাজমা আক্তার দৌড় দিলেন।  নিরু কিছু বুঝতে পারছে না মা এমন করছে কেন? সে হাউ মাউ করে কাঁদছে। আশেপাশের মানুষ হা করে তাকিয়ে আছে তাঁর দিকে। সেদিকে তাকানোর সময় নেয় নিরুর মায়ের। মেয়েকে এমন ভাবে বুকে জড়িয়ে দৌড়চ্ছেন যেন কেউ তাঁর মেয়েকে ছিনিয়ে নিয়ে যাবে। তাঁর মেয়ে, তাঁর একমাত্র ধন, একে হারিয়ে ফেললে সে বাঁচবে কীভাবে? একে হারানো যাবে না। কিছুতেই না।

বাসায় ঢুকে হাঁপাতে হাঁপাতে নাজমা আক্তার এক জগ পানি শেষ করলেন। পানি অর্ধেক গলায় গেলো, অর্ধেক বাইরে পড়লো, শাড়ি ভিজে একাকার। নিরুর মায়ের এই রূপ দেখে ভয়ে কাঁপছে। কাঁদতে কাঁদতে দুরে সরে যাচ্ছে মার থেকে। তাঁর মা পাগল হয়ে গেছে। সে চিৎকার করে কাঁদছে। নাজমা আক্তার যখন দেখলেন তাঁর মেয়ে ভয় পাচ্ছে তখন একটু শান্ত হতে চেষ্টা করলেন। মেয়ের দিকে হাত বাড়িয়ে বললেন, নিরু এদিকে আয়, আয় আমার কাছে।

নিরু আরও পেছনে সরে গেলো  ভয়ে।

আয় না মা, এদিকে আয়। মার কাছে আয়।

নিরু কাঁদছে।

নাজমা আক্তারের গলা ধরে গেলো, কাঁদো কাঁদো গলায় মেয়েকে ডেকেই যাচ্ছেন।

আয় না মা, মার কাছে আয়। মাকে একটু জড়ায় ধর। ও নিরু মার কাছে আয়। আয় না নিরু। আয় না।

নাজমা আক্তার  মেঝে গড়িয়ে কাঁদতে লাগলেন।  যেন আহাজারি।

ও নিরু আয় না মা কাছে। ও নিরু। তুইও মাকে ছেড়ে যাবি? নিরু ও নিরু।

মার এমন কান্না দেখে নিরু ছুটে গেলো মার কাছে।

মা কাঁদছ কেন? ও মা। মা।

নাজমা আক্তার মেয়েকে জড়িয়ে হাউমাউ করে কাঁদতে লাগলেন। ঠিক  যেভাবে নিরুপমা কেঁদেছিল মাকে জড়িয়ে ধরে।

 নিরু তাঁর ছোট হাতে মার গায়ে হাত বুলিয়ে দিচ্ছে। ছোট নিরুর কোলে মাথা রেখে নাজমা আক্তার কেঁদেই চলছেন। নিরু বার বার চোখ মুছে দিচ্ছে। মা কাঁদছ কেন? কাঁদে  না মা। ও মা।

অবশেষে ক্লান্তি নেমে এলো। তবু নিরুর কোলে শুয়ে থাকলেন। নিরুর ছোট ছোট পা ব্যথা করছে তবু সে মায়ের মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে লাগলো। সন্ধ্যা নেমে রাত হতে শুরু করছে। নিরুর ক্ষুধা লাগছে। কিন্তু মাকে বলতে ভয় লাগছে। মা যদি আবার কাঁদা শুরু করে। তবু আর থাকতে না পেরে বলে ফেলল খুব আস্তে। মা, ক্ষুধা লাগছে।

নাজমা আক্তারের যেন হুশ ফিরলো। তাঁর মেয়ে এতক্ষণ না খেয়ে আছে ভাবতেই খারাপ লাগল। উঠে নিজেকে ঠিকঠাক করে মেয়েকে কোলে নিয়ে রান্না ঘরে ভাত গরম করে সেখানেই বসে মেয়েকে খাওয়ালেন। যতক্ষণ মেয়ে খেলো ততক্ষণ মেয়ের দিকে তাকিয়ে থাকলেন। থেকে থেকে চোখে পানি আসছে, আচলে চোখ মুছে মেয়েকে খাওয়াচ্ছেন। নিরু ভয়ে ভয়ে কিছু না বলেই খাচ্ছে।

খাওয়া শেষে মেয়েকে রুমে নিয়ে গিয়ে, জামা পালটিয়ে বললেন, আজ ঘুমিয়ে পরো মা।

 নিরু বুঝতে পারছে না আজ এত তাড়াতাড়ি ঘুমাতে বলছে কেন মা । এখন তো তাঁর টিভি দেখার কথা। নিরু কিছু বলল না ভয়ে। মাথা নেড়ে হ্যাঁ বলল।

নাজমা আক্তার নিজের রুমে এসে আলো না জ্বালিয়ে বসে থাকলেন বিছানায়। একা। নিঃসঙ্গ নিঃশেষ। এখন চাইলেই সে ইচ্ছেমত কাঁদতে পারেন। কিন্তু এখন আর তাঁর কান্না আসছে না। আশ্চর্য! এখন কান্না পাচ্ছে না কেন!

এখন কেন মনে হচ্ছে না দোষ তাঁর? এখন কেন কোনও সমাধান পাচ্ছেন না? এখন কেন মনে হচ্ছে না তাঁর স্বামী নির্দোষ?

কলিং-বেল বেজে উঠল। বুকটা ধস করে উঠল। আতিক এসেছেন। একবার দুইবার। নাজমা  আক্তার উঠল না। আতিকের কাছে চাবি আছে।তিনি  নিজে দরজা খুলে ভেতরে এসে দেখলেন ঘর অন্ধকার। ডাকলেন, নাজমা?

বেডরুমে এসেও আলো নেভানো দেখে  নিজে আলো জ্বালিয়ে প্রথমেই স্ত্রীকে এভাবে বসে থাকতে দেখে ভয় পেয়ে গেলেন।  ছুটে এলেন কাছে।

নাজমা, কী হয়েছে? কী হয়েছে এভাবে বসে আছো কেন?

নাজমা আক্তার শীতল চোখে আতিকের দিকে তাকিয়ে রইলেন।

আতিক স্ত্রীকে  একবার জড়িয়ে ধরলেন। নাজমা, এই নাজমা। কি হলো? নিরু ঠিক আছে? ও কই?

আতিক নিরুর রুমে ছুটে গেলেন। বাপ মেয়ের মধ্যে কিছু কথা হল। কি কথা হল নাজমা শুনতে পেলেন না। খানিক পর আতিক ফিরে আসলেন রুমে চোখ নিচে নামিয়ে। তাঁর স্ত্রী  আজ সেই রেস্তোরায় গেছে যেখানে তিনিও গেছেন। নিরুর কাছ থেকে শুনেছে মা রেস্তোরা থেকে কাঁদতে কাঁদতে ফিরে এসেছে। বাকিটা আতিক বুঝে নিলেন।

আতিক রুমে ঢুকে স্ত্রীর পাশে বসলেন। অনেকক্ষণ চুপ থেকে অবশেষে মুখ খুললেন। নাজমা…

নাজমা নিশ্চুপ।

নাজমা, যা তুমি ভাবছ ঠিক তেমন কিছু না।

নাজমা নিথর।

আতিক স্ত্রীর দিকে ফিরে বসে হাত ধরলেন। একটু অবাক হলেন, এই হাত ঠিক তাঁর স্ত্রীর হাত না। এমন নিস্তেজ হাত নাজমার হতে পারে না।

আতিক তাও হাত ধরে বসে থাকলেন। আমাকে একটু বলার সুযোগ দাও নাজমা। ওর সাথে আমার সম্পর্ক নেই। অনেক আগেই শেষ করে দিয়েছি। আজ… আতিকের গলা একটু কেঁপে যাচ্ছে।

আজ ওকে সেটা বুঝানর জন্যই ওখানে গিয়েছিলাম। বিশ্বাস করো।

আতিক স্ত্রীর হাত চেপে মিনতি করলেন যেন।

নাজমা প্লিজ কিছু বলো। এভাবে চুপ থেকো না। আমাকে ভুল বুঝো না। প্লিজ। আতিক মাথা নত করে স্ত্রীর পাশে বসে থাকেন।

নাজমা আক্তার আস্তে করে হাতটা সরিয়ে নেয়। এরপর আতিকের দিকে তাকান। সোজা শীতল এবং স্পষ্ট চোখে চোখ রাখেন স্বামীর।

বললেন, আমি কালকে মা’র বাড়ি যাবো, নিরুকে নিয়ে।

খুব শান্ত গলায় নাজমা আক্তার কথাটা বললেন। যেন এমন শান্ত স্বর কোনও মানুষের হতে পারে না। এ এক অন্য নাজমা। পৃথিবীর সাথে এঁর সম্পর্ক ছিন্ন হয়েছে । সে কথা বলছে যেন অন্য কোনও দুনিয়া থেকে।

আতিক মাথা তুলে তাকালেন স্ত্রীর দিকে। কিন্তু স্ত্রীর সে  দৃষ্টি তিনি বেশিক্ষণ সহ্য করতে পারলেন না।  যেন চোখের জায়গায় চকচকে মারবেল বসানো। এই দৃষ্টির সামনে মানুষ কথা বলতে পারে না। আতিক চোখ সরিয়ে ফেললেন। আর কোন কথা বলার শক্তি ছিল না তাঁর।

সেই যে চলে আসলেন, নাজমা আক্তার  আর ফেরত যান না। চাকরির জন্য নাকমুখ গুঁজে পড়েছেন। চাকরি পেয়েছেন, আলাদা বাসা নিয়েছেন নিরুকে নিয়ে। সম্পর্ক ছেঁদ করেছেন। নিরুর নানা নানী , দাদা দাদি সবাই অনেক চেষ্টা করেছেন তাদের বৌকে বুঝাতে, মেয়েকে বুঝাতে। কিন্তু নাজমা আক্তারের অনড় সিদ্ধান্তের সামনে কেউ টিকতে পারল না। শুধু আতিক কোনও দিন স্ত্রীর সামনে আসেন নি। একটা ফোনও করেন নি।

আতিকের বাবা মা অনেক বলেছেন ছেলেকে, সে নিজে গিয়ে বোঝালে বউ রাজি হতে পারে। কিন্তু কেন জানি আতিক আর কোনও দিন স্ত্রীর সামনে যাওয়ার সাহস করেন নি। তাঁর মনে হয়েছে এই নাজমাকে সে বুঝাতে পারবে না। এ নাজমা অন্য নাজমা। তাঁর আগের নাজমা মরে গেছে। বা সেই তাঁকে মেরে ফেলেছে।

চলবে…

ফারজানা নীলা। গল্পকার, নারী ও প্রাণি সংরক্ষণ অধিকারকর্মী।  

এই বিভাগের অন্যান্য লেখাসমূহ