রমণীবাস (পর্ব- ৪)

ফারজানা নীলা
গল্প, ধারাবাহিক
Bengali
রমণীবাস (পর্ব- ৪)

আগের পর্ব পড়ুন এখানে >>>

তাঁরা তিনজন একটি জ্যাজ ক্লাবে বসে আছে। নিক নিরুপমা আর লরাকে দাওয়াত দিয়েছে সন্ধ্যা যাপনের জন্য। লরা বেশ হাসিখুশি, গানের তালের তালে হা পা মাথা দুলাচ্ছে। হাতে সাদা ওয়াইনের গ্লাস। এখানে আসার আগে ঘণ্টার মত কথা বলেছে হেলালের সাথে ভিডিও চ্যাটে।

লরা অবাক হয়ে দেখেছে হেলাল কি সুন্দর দোকান সামলাচ্ছে। কি চটপটে আচরণ তাঁর। লরা যেন এতটুকু আশাও করে নি। অবাক চোখে হেলালের কর্মকাণ্ড দেখছে আর প্রশ্ন করে যাচ্ছে একের পর এক।

তুমি জানতে কোথা থেকে বাজার আসে?

হ্যাঁ জানব না কেন? কোনোদিন যাই নি ঠিক আছে, কিন্তু জানতাম তো।

একা একা গিয়েছ আনতে?

না প্রথম দিন তোমার দোকানের ছেলেটাকে নিয়ে গিয়েছিলাম। এরপর আমি যাই।

লরা নিশ্চুপ দেখছে হেলালকে।

হেলাল একটু হেসে বলে, কি হল, কিছু বলবা না? চুপ হয়ে গেলা যে?

লরাও হেসে জবাব দিল, তুমি যে আসলেই দোকান সামলাতে পারবে ভাবি নি। তাও এত ভাল করে।

কেন তোমার স্বামী কিছু করতে পারে না এমনই কি ভেবে বসেছিলে? হেলালের তীক্ষ্ণ খোঁচা লরা বুঝতে পারে সহজেই।

তবুও হেসেই জবাব দিল, আমার স্বামী পারে অনেক কিছু কিন্তু জানান দেয় না। তাই জানতাম না।

হেলাল আর কিছু বলল না, কিন্তু খুব গভীর করে লরার দিকে তাকায়।

লরা এই তাকানোর মানে না বুঝে জিজ্ঞেস করল, কি হল, কি দেখো?

হেলাল নিশ্চুপ। নিস্পলক তাকিয়েই দেখছে লরাকে।

এই, কি হয়েছে? হেলাল?

লরা, হেলাল বলে উঠল। তুমি আসবে কবে? মনে পড়ে তোমাকে।

লরার বুক কেঁপে উঠল। কত দিন কত বছর কত সময় পার হওয়ার পর আজ আবার এই কথাটা শুনল লরা। বিয়ে থেকেই তাঁরা এক সাথে। কখনও একে অপরকে ছেড়ে দুরে যাওয়া হয় নি। বিয়ের পর কখনও  কোনোদিন কেউ কাউকে বলে নি , কবে আসবে? অথচ এই সামান্য লাইনটি বিয়ের আগে কত হাজার বার বলা হত। কি ভীষণ আবেগ ভালবাসা লুকিয়ে থাকে সামান্য একটি লাইনে। কাউকে তুমি মিস করছ, কারো অভাব বোধ করছ, এটি বুঝানর জন্য আকাশ পাতাল এক করার কোন প্রয়োজন নেই। সাত সমুদ্র পাড়ি দেওয়ার দরকার এই। মরে যাওয়ারও দরকার নেই। শুধু একটি লাইন।

“তোমাকে মনে পড়ছে”। ব্যাস, হৃদয়কে নিংড়ানোর জন্য এটাই যথেষ্ট। চোখে জলের উঁকিঝুঁকি দেওয়ার জন্য এটাই যথেষ্ট। ঘুমিয়ে পরা প্রেম জাগানোর জন্য এটাই যথেষ্ট।

লরা চোখ নামিয়ে ফেলল, চোখ জ্বলছে। লজ্জাও পাচ্ছে। হেলাল না দেখে ফেলে এমন একটা ভঙ্গি করে চোখ মুছল।

হেলাল ঠিকই টের পেলো। তাঁর জন্য লরার চোখে জল দেখে নিজেকে খুব ভাগ্যবান মনে হচ্ছে। সস্থিও পাচ্ছে। লরা যাওয়ার পর, বহুবার এই কথা তাঁর মনে হয়েছে যে তাদের মধ্যে প্রেম ভালোবাসা কি মরে গেছে? তাঁরা কি আগের মত ভালোবাসে না একে অপরকে? লরা কি বিরক্ত হয়ে গেছে তাঁর সাথে থাকতে থাকতে? এই জন্যই কি এই সাময়িক প্রস্থান?

এই যে সে উঠেপড়ে লেগেছে দোকান সামলাতে, সেটা কি লরাকে বুঝানর জন্য যে সে তাঁর যোগ্য স্বামী? লরাকে খুশি করতে? খুশি করলে লরা ফিরে আসবে এই আশায়?

এই চিন্তায় নিজেই নিজের উপর হেসেছে। ভালোবাসা যদি মরেই যায় কারো সাধ্য কি আছ তাঁকে জাগানোর?

কিন্তু অবাক হয়ে হেলাল খেয়াল করল, দোকানের কাজ করতে তাঁর খারাপ লাগছে না। বরং আগ্রহই পাচ্ছে। কেন এতদিন সে কিছু করে নি বা লরাকে সাহায্য করে নি সেটাই বরং অবাক করার বিষয়। করে নি সেটা কি লরার সবকিছুতে আধিপত্য ফলানোর জন্য? সে যদি লরার সাথে এক সাথে কাজ করত, লরা কি তাঁকে নিজের মত করতে দিত? হয়তো দিতো, হয়তো দিতো না। কিন্তু চেষ্টাই তো করা হল না কোনোদিন। একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে হেলাল আপনমনেই কাজ করে গেছে। রাতে যখন ঘুম আসত না লরাকে খুব করে মনে পড়েছে। অনেকবার মোবাইল হাতে নিয়েও কল করা হয় নি। লরাকে একা থাকতে দিতে চেয়েছে। হেলালকে ছাড়া থেকে যদি হেলালের কথা মনে পড়ে লরার। এই মনে পড়ার  প্রক্রিয়ায় সয়ং হেলালই বাঁধা হয়ে দাঁড়াতে চায় নি।

আজ লরার চোখে হেলালের জন্য জল দেখে কে যেন হেলালের কানেকানে বলে গেছে, না, লরাও তোমাকে মনে করে, ভালোবাসা এখনও বহাল তবিয়তে আছে।

চোখ লুকাচ্ছ কেন? দুষ্টুমির সুরে বলল হেলাল।

লুকাব কেন? এমনেতেই।

দেখতে দাও। অনেকদিন বাদে তোমার চোখে আমার জন্য কিছু দেখতে পেলাম। একে আড়াল কোরো না।

লরা কিছু বলতে পারল না। তাকিয়ে রইল হেলালের চোখের দিকে। ঠিক সেই মুহূর্তে লরার ভীষণ ইচ্ছে করল ফিরে যেতে। হেলালকে জড়িয়ে ধরতে। প্রচণ্ড আকুতি জাগল মনে। এমন আকুতি বহু বছর জাগে নি।

লরা কাঁদছে। অকারণ দুঃখহীন নীরব কান্না। দর্শক হেলাল। লোভনীয় দৃশ্যের মত গিলছে সে।

কিছু কান্নায় মন পরিষ্কার হয়। ভার হালকা হয়। মনে সস্তি ফিরে আসে। কিছু যে হারিয়ে যায় নি, যা ছিল যেখানে ঠিক সেখানেই তা আছে এই ব্যাপারে নিশ্চিত হওয়া যায়।

সেই সস্তির কান্নার পর লরা বেশ ফুরফুরে এখন। গল্প করছে নিকের সাথে। নিরুপমাকেও টানছে মাঝে মাঝে। কিন্তু নিরুপমা সেই যে মনমরা, এখনও তেমনই। তাঁকে ঠিক করার জন্য  নিক বিভিন্ন রকমের চেষ্টা করে যাচ্ছে। লরা চেষ্টা করতে করতে অনেকটা হাল ছেড়ে দিয়েছে। এখন নিক কিছু করতে পারলে হয়।

 নিক ছেলেটা কেমন যেন। সব কিছুতে সে আনন্দ খুঁজে পায়। একদম পাখির মত জীবন যেন তাঁর। সারা বছর কাজ করে বছরে এক মাস ছুটি নেয়। এদিক সেদিক ঘুরে বেড়ায়। যেখানে যায় একা একা যায়।  কোনও পিছুটান আছে বলে মনে হয় না। কিন্তু থাকার তো কথা। কেউ না কেউ তো নিশ্চয়ই থাকবে যার জন্য ঘরে ফিরতে মন চাইবে। নিকের কি তেমন কেউ নেই? যদি না থাকে কোনও হতাশা কি আঁকড়ে ধরবে না? একাকীত্ব? লরার ইচ্ছে করছিল জানার জন্য। কিন্তু জিজ্ঞেস করা হয়ে উঠে নি।

নিরুপমাকে আকর্ষণ করার জন্য নিক প্রথম পরিচয়ের মত বলে উঠলো,

তোমার যদি মনে থাকে তাহলে একই প্রস্তাব আমি আজো করতে চাই নিরুপমা?

নিরুপমা চকিত হল, কিন্তু বুঝতে পারল না নিকের কথা। ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকল।

তুমি যদি চাও তাহলে আজকে রাতে আমার সাথে কাটাতে পারো। বা আমি যেতে পারি তোমার সাথে।

নিরুপমা স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকল নিকের দিকে। লরা হোহো করে হেসে উঠল। লরার সাথে নিকও যোগ দিল। দুজনের হাসিতে নিরুপমার স্থির শান্ত দৃষ্টি বেমানান লাগছে। নিক সেটা বুঝতে পেরে মনে করল, নিরুপমা হয়ত ব্যাপারটা হালকা করে দেখছে না। তাই সরিও বলল। তবুও নিরুপমা স্বাভাবিক হল না। লরা অবস্থা স্বাভাবিক করার জন্য নিরুপমাকে বুঝাতে চেষ্টা করল।

নিরু, নিক দুষ্টুমি করছিল। সত্যি সত্যি যেতে বলে নি। তুই মাইন্ড করিস না।

নিরুপমা হুট করে যেন স্বাভাবিক হয়ে গেলো। সোফায় হেলান দিলো খুব শান্ত ভাবে। নিকের দিকে তাকাল মিষ্টি ভাবে। মুখে সামান্য হাসি ফুটিয়ে নিককে বলল, যদি তুমি চাও তাহলে আমাকে তুমি একটি ড্রিঙ্ক অফার করতে পারো।

নিক লরা দুজনই দুজনের দিকে চাওয়াচাওয়ি করল। নিক উৎসাহের সঙ্গে নিরুপমার জন্য ড্রিঙ্ক আনতে গেলো।

নিরুপমা সোফায় হেলান দিয়ে চোখ বুজে আছে। মনে হচ্ছে যেন গান শুনছে। তবে ঠোঁটের কোণে কিঞ্ছিত হাসির আভা। লরা খেয়াল করে দেখল নিরুপমাকে। আরও কাছে গিয়ে বসল লরা। আদুরে স্বরে ডাকল নিরুকে।

নিরু?

হুম।

আমরা আর মাত্র তিন দিন আছি এক সাথে।

হ্যাঁ।

এরপর আবার যার যার পথ ধরতে হবে।

হ্যাঁ।

কি হ্যাঁ হ্যাঁ করছিস। কিছু বল।

নিরু চোখ খোলে। তাকায় লরার দিকে। তুই সুখি তো লরা?

আচানক এমন প্রশ্নে একটু অবাক হয় লরা। কিন্তু বেশিক্ষণ এই অবাক ভাব থাকে না তাঁর।

কি মনে হয় তোর? গ্লাসে চুমুক দিয়ে জিজ্ঞেস করে নিরুকে।

আমার মনে হয় তুই ক্লান্ত। সোজা উত্তর নিরুর।

লরা নিরুর দিকে তাকাল। যেন নিরুকে বুঝতে চেষ্টা করছে।

এভাবে তাকানো দেখে নিরু জিজ্ঞেস করল, কিরে, কি দেখছিস? রাগ করলি নাকি?

চোখ নামিয়ে লরা বলল, না রাগ করি নি। বরং ভাল লাগছে।

কেন, ভাল লাগার মত কি বললাম?

তুই ভীষণ একটা খারাপ সময়ের ভেতর দিয়ে যাচ্ছিস আমি বুঝতে পারছি। এখন তোর সকল চিন্তা ভাবনা এককেন্দ্রিক থাকবে সেটাই স্বাভাবিক। এরপরও তুই যে আমাকে নিয়েও ভেবেছিস এটা জেনে ভাল লাগল।

নিরু হাসল। কিছু বলল না।

লরাই আবার বলল, আমরা অনেক কাছের বন্ধু ছিলাম। আছি এখনও। তাই তো নিজের অজান্তেই অন্যকে নিয়ে ভেবে বসি তাই না।

নিরু লরার হাত ধরল। মুখ মলিন হল তাঁর। হাসি উড়ে গেলো। হতাশা মেশান গলায় বলল, তুই যদি থাকতি দেশে আমার বড় উপকার হত। কিছু না শুধু তোর কাছে গিয়ে বসে থাকতাম।

লরা আর কিছু বলতে পারে না। বুকটা কেঁপে উঠে। কি বলবে সে? কতবার সে নিজেই চেয়েছে নিরুপমার সাথে একটু সময় কাটাতে। কতবার ভেবেছে, আজ যদি সে দেশে থাকত তাহলে এখনই নিরুর কাছে চলে যাওয়া যেত। ওর সাথে রাত জেগে মুভি দেখা যেত। একসাথে রান্না করা যেত। একসাথে ছাদে আড্ডা দেওয়া যেত। একসাথে তাদের ক্যাম্পাসে যাওয়া যেত। কিন্তু কিছুই করা হয় না। হওয়াটা সম্ভব হয় না। দুই প্রান্তে দুই বন্ধু দুজনের জন্য হাহাকার করে। কিন্তু দূরত্ব অতিক্রম করা যায় না।

নিক একটা মাগারিটা আনে নিরুপমার জন্য নিজের জন্য হুইস্কি।

কিন্তু নিরুপমা আবারও সেই মুচকি হাসি দিয়ে বলে, আমি হুইস্কি নিতে চাই, তোমারটা নিতে পারি? যদি তোমার কোন আপত্তি না থাকে।

নিক মাথা নেড়ে সায় দিলো।

তিনজন তিন বিপরীত ধর্মের বিপরীত রীতির বিপরীত বৈশিষ্ট্যের মানুষ একসাথে বসে আছে পৃথিবীর কোনও এক কোণে। তাঁরা কেন একই সাথে আছে, বা মিশছে সেটা হয়ত তাঁরা জানে না। তাদের কেউ জীবন থেকে দুরে যেতে চায়, কেউ কষ্ট থেকে, কেউ বা জীবনকে কাছে পেতে চায় আরও। তিনজনই চাহিদা ভিন্ন। রুচি ভিন্ন। তবু তাঁরা এক সাথে। বিপরীতে কাছে আসে।

নতুন গান শুরু হয়েছে। কান ফাটা সুর ধপধপ করছে রুম জুড়ে। কেউ কাউকে শুনতে পাবে না এমনই উচ্চস্বর। কেউ আর নিজের মধ্যে নেই। সবাই মাতাল। সবাই উদগ্রীব এই সুরের সাথে ভেসে যেতে। ষ্টেজ মানুষে কিলবিল করছে। কেউ জোড়ায় জোড়ায় কেউ বা নিজে নিজেই নাচছে। উদ্দাম নৃত্য।

লরা কিছুটা দুলছে। নিক তাঁকে ষ্টেজে যাওয়ার জন্য আমন্ত্রণ জানালো। নিরুপমা যাবে না ধরে নিয়ে তাঁরা দুজন স্টেজের দিকে এগোলো। নিরুপমা তিন শট টাকিলা নিলো। শেষ করে লাল চোখে চারিদিক দেখছে। সব অচেনা চেহারা আরও অচেনা লাগছে। কেউ স্থির হয়ে বসে নেই। সবাই যার যার মত যেখানে পারছে হেলে দুলে অথবা নেচে গেয়ে কি যেন করতে চাইছে।

মানুষের ভিড় বাড়ছে। যত রাত এখানে মানুষ বাড়ে তত এখানে। অথচ দিনের বেলায় এরা কোথায় থাকে? নাকি দিনের বেলায় এদের অফিশিয়াল পোশাকের কারণে চেনা যায় না। কি অদ্ভুত! একই মানুষকে পোশাক দিয়ে কত রকম লাগতে পারে।

নিরুপমা ঘুরে ঘুরে সব দেখছে বা সবাইকে দেখছে। টেবিল ছেড়ে উঠে এদিক সেদিক যাচ্ছে, ধাক্কাও খাচ্ছে। কেউ ফিরেও দেখছে কে ধাক্কা খেলো। নিরুপমাও দেখছে না। সে শুধু তাঁর আশেপাশের মানুষজনদের দেখতে মনোযোগী। প্রবল আগ্রহের সাথে সে দেখে যাচ্ছে। যেন কিছু খোঁজার চেষ্টা করছে। কিন্তু কি সেই জিনিশ নিরুপমা জানে না। হয়ত সে খুঁজছে তাঁরই মত কাউকে। সে যেমন বিষণ্ণ মনহারা হয়ে অসুখি চেহারা নিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে তেমন আর কেউ আছে কিনা খোঁজার চেষ্টা। হন্ন হয়ে খুঁজে বেড়াচ্ছে সে। এখানে কত ধরণের মানুষ রোজ আসে। একজনও কি তাঁর মত নেই? যারও ভেতরে দগদগে ঘা। নড়বড়ে মনোবল। এলোমেলো দৃষ্টি। নেই কেউ? না কাউকে নিরুপমা নিজের মত পায় নি। এখানে সবাই মগ্ন। নাচে গানে সুরে আর সুরায়।

এখানে নিরুপমা একা। ভীষণ একা। অতুলনীয় নিঃসঙ্গ। এখানে কেউ দুখি চেহারা নিয়ে বসে থাকতে আসে না। আসে সব কিছু ভুলে গিয়ে সাময়িক মাতাল সুরে ভেসে যেতে। আসে শারীরিক উত্তেজনা সৃষ্টি করে মানসিক অবসাধকে দূর করতে। মগজের ভেতর উচ্চ ভলিউমে গান সেঁধিয়ে ভেতরে নিস্তব্ধতাকে মেরে ফেলতে। যেন নিশ্চুপ্তার অস্তিত্বও টের না পাওয়া যায়।

ক্লান্ত নিরুপমা হেরে যায় খুঁজতে খুঁজতে। লাল চোখ জ্বালা করে উঠে। হাত পা ভার শুন্য অনুভব করে। চোখ যায় ষ্টেজে নাচে মত্ত এক জোড়ার দিকে। নিক আর লরা। সম্পুর্ন আচেনা দুই মানুষ কি চমৎকার ভাবেই না মিশে যাচ্ছে একে অপরের সাথে। কে কোথায় থাকে, কি করে, আর কোনোদিন একে অপরের সাথে দেখা হবে কিনা সে ব্যাপারে কারো কোন ভ্রূক্ষেপ নেই। এরা এখানে পরিচিত হয়েছে। এখানে মিশেছে। এখান থেকে বিদায় নিবে। এরপর ভুলে যাবে। সাময়িক বন্ধুত্ব। আজীবন বয়ে বেড়ানোর কিছু নেই। যে সম্পর্ক  আজীবন গড়াবে, আশা হতাশা ঠায় নিবে সেই সম্পর্কে। নিক আর লরার বন্ধুত্ব আজীবনের জন্য নয়। এখানে আশা নেই চাহিদা নেই। কিছু সম্পর্ক নির্ভেজাল হয় এর স্থায়িত্ব কম বলেই।

নিরুপমার লোভ হয়। সেও চায় এদের মত মগ্ন হতে। ভুলে যেতে সব কিছু। যে ঝিম ঝিম ভাব ধরেছে মাথায়, সেটা সারা অঙ্গে ছড়িয়ে দিতে ইচ্ছে করছে। নিজের সঙ্গে নিজেই নাচতে ইচ্ছে করছে। যেন পৃথিবীতে সে ছাড়া আর কেউ নেই।

নিরুপমা ধীরে ধীরে দুলে দুলে ষ্টেজে উঠে। চোখ লাল থেকে লালতর হচ্ছে। হাত পা শরীর জুড়ে ঝিমানো এক মাদকতা।

সে নড়ছে, হাত পা নাড়ছে, শরীর দুলাচ্ছে সুরে সুরে। বীটের সাথে সাথে সেও নড়ছে। ধীরে থেকে দ্রুত। দ্রুত থেকে দ্রুততর হচ্ছে তাঁর শরীরের বাঁকানো। তাঁর চুল উড়ছে। শরীর ঘামছে। এবং সে যা চাইছে তাই হচ্ছে। সে মগ্ন হতে পেরেছে। সুরের সাথে উচ্চ ভলিউমের আওয়াজের সাথে কান ফাটা গানের কথার সাথে সে নিজেকে উজার করে দিতে পারছে। নিজেকে হারিয়ে ফেলে ভাসতে পারছে। কোন এক উন্মাদনায় সে উড়ছে। ক্লান্তিহীন। বিরতিহীন।

ভাসতে ভাসতে উড়তে উড়তে নিরুপমা নিজেকে বেমালুম  ভুলে গেলো। সে কেন এখানে এসেছে কি যন্ত্রণা বুকে পুষে রেখেছে সব সাদা কাগজ হয়ে গেলো তাঁর মননে। উত্তাল সুরে সেও উত্তাল হয়ে গেলো।

দূর থেকে নিক আর লরা নিরুপমাকে দেখতে পেলো। তাঁর এই মত্ত নৃত্য দেখতে দেখতে লরা এগিয়ে যেতে চাইল থামাবে বলে। নিক বাঁধা দিল।

না এখন যেও না। ওকে ওর মতো করতে দাও। যা ইচ্ছে করুক। হালকা হবে।

লরা করুণ চোখে নিরুপমা দেখতে লাগল। একটা ছোট শ্বাস বের হয়ে গেলো ভেতর থেকে।

 

চলবে…

ফারজানা নীলা। গল্পকার, নারী ও প্রাণি সংরক্ষণ অধিকারকর্মী।  

এই বিভাগের অন্যান্য লেখাসমূহ