ইমন কল্যাণ
পরিচ্ছেদ ৬ অনেক রাতে ফিরেছিল কল্যাণ ওরফে শহীদুল।গাড়িটা শেডে রাখার পর দু’বার হালকা করে মা…..
লরা একের পর এক খাবার গিলেই যাচ্ছে। তাঁর খাওয়া দেখলে মনে হবে সে অনেকদিন খায় নি। কিন্তু এক বেলাও সে না খেয়ে কখনও থাকে নি। কিন্তু খাওয়াগুলো স্বাদ না বিস্বাদ খেয়াল করত না।
আজ সে সব কিছুই খেয়াল করে যত্ন করে খাচ্ছে বা করছে। আয়েশ করে শাওয়ার নিলো প্রায় এক ঘণ্টা ধরে। রিসোর্টে লাগোয়া একটা ছোট কাপড়ের দোকান আছে। সেখান থেকেই কেনা নতুন একটা টপস গায়ে দিলো। মুখে হালকা মেকআপ। ঠোঁটে লিপস্টিক। চোখে ক্যাটলাইনার। মাথায় সানগ্লাস লাগানো, কাঁধে ছোট পার্স। দোকান আর বাসা করে করে লরা যে লাবণ্য হারিয়েছিল সেটা একরাতেই যেন খানিকটা ফিরে এলো। এখন আর তাঁকে রুক্ষ লাগছে না। বরং শ্যাম বরণ থেকে একটা জ্যোতি বের হচ্ছে যেন। দুপুরে খেতে বসেছিল লরা আর নিরুপমা একটা রেস্তোরায়। নিরুপমা যে কিছুই খাচ্ছে না সেটা একটু পর লরা খেয়াল করলো। নিজের খাওয়া প্রায় শেষ হয়ে এলে, ড্রিঙ্কস গ্লাসটা হাতে নিয়ে তাকাল নিরুপমার দিকে।
তাকিয়ে নিরুপমাকে বুঝার চেষ্টা করলো। অনেকক্ষণ তাকিয়ে থেকে অবশেষে প্রশ্ন করল,
নিরু তুই যে এমন হয়ে যাচ্ছিস এটা কি তোর সাথে যায়?
চামচ দিয়ে খাবার নাড়া বন্ধ করে নিরুপমা লরার দিকে তাকালো। বুঝতে পারল লরা কি বলতে চাচ্ছে। কিন্তু এসব সে জানে বুঝে, শুধু মানতে পারছে না। তাই কিছু না বলাই শ্রেয় মনে করে চুপ থাকল।
উত্তর না পেয়ে লরা আবার বলল, সকালেও খাস নি মনে হয়। আমি উঠার আগেই কোথাও চলে গেলি, এখনো কিছু খাচ্ছিস না, রাতেও তো প্রায় আধাচেতন ছিলি। এভাবে কি চলতে পারে?
নিরুপমা বিরক্ত হচ্ছে। ভ্রু কুচকে যাচ্ছে। চামচ শক্ত করে ধরে আছে।
নিরু, কিছু বল। বুঝতে পারছি অসীমের সাথে কিছু হয়েছে। কি হয়েছে বল আমাকে। ছাড়াছাড়ি হয়ে গেছে? নিরু?
লরা প্রশ্ন করেই যাচ্ছে।
নিরু এবার ক্ষেপে গেলো।
হ্যাঁ ছাড়াছাড়ি হয়ে গেছে। খুশি? গলার স্বর এতই উপরে উঠে গেলো যে আশেপাশে অনেকেই ফিরে তাকাল। নিরু বুঝতে পেরে সামলে নিলো।
লরা চুপ করে থাকল কিছুক্ষণ। আরেকটা ড্রিঙ্ক অর্ডার করলো। ধীরে ধীরে বলল, তাতে কি তোর জীবন থেমে গেছে? কি হাল হয়েছে দেখেছিস?
নিরু এবার গলার স্বর আর বাড়াল না, তবে খুব ভারী গলায় বলল, লরা এসব কিছু আমি জানি। আমি বাচ্চা না। কিশোর বয়সী পাগলী না। দয়া করে এসব বলা বন্ধ করবি?
তুই কিশোরী না বলেই তো জানতে চাচ্ছি কেন এমন হয়ে যাচ্ছিস?
লরা প্লিজ। চুপ থাক। একা থাকতে দে আমাকে।
লর আর কিছু বলল না। মন খারাপ হল নিরুর জন্য। এমন উচ্ছল মেয়ের এমন মনমরা ভাব তাঁর ভাল লাগছে না।
চল বীচে যাই।
ইচ্ছে করছে না। সকালেও গেছি।
তবে? কোথায় যাবি? এখানে এসে নিশ্চয়ই হোটেলে বসে থাকবি না?
নিরু কিছু বলল না।
লরা আবার বলল, চল যাই। একসাথে বীচে কিচ্ছুক্ষণ কাঁটাই। একসাথে অনেকদিন সময় কাঁটাই না। চল যাই।
নিরু তাকাল লরার দিকে। খানিক হাসে বল, চল।
এখানে সবাই জীবনকে উপভোগ করতেই আসে। পানিতে সাঁতরায়। রোদে স্নান করে। সবাই প্রায় বিকিনি আর শর্টস পরা।সেদিকে কেউ ভ্রূক্ষেপ করছে না। এটা ভ্রূক্ষেপ করার দেশ না। এটা যার যার জীবন তাঁর তাঁর দেশ। এখানে হয়ত কেউ প্রেমে ধোঁকা খেয়ে হাহুতাস করার জন্য আসে না। বা আসে। বিশাল সমুদ্র নীল আর অফুরন্ত সৌন্দর্যের মাঝে নিজেকে খুঁজে পায়। যেভাবে নিজেদের খুঁজতে লরা আর নিরুপমাও এসে হাজির।
লরা নিরুপমা কেউ সাঁতার জানে না বলে পানিতে সাঁতরাচ্ছে না। পানির ধারে বসে আছে একসাথে। দুজনই চুপ। সামনে বৃহদাকার পাথর দাঁড়িয়ে আছে সমূদের মাঝে মাঝে। যেন সমুদ্রের পাহারাদার।
এই বিশালতার মাঝে বসে লরার ভীষণ ভাল লাগছে। ভীষণ হালকা লাগছে। কোনও চাপ নেই, কোনও দায় নেই, কোনও চিন্তা নেই, কোনও রুটিন নেই। আছে শুধু শান্তি। নির্মল বাতাস। আছে প্রকৃতির সাথে নিজেকে একাত্ম করার অদম্য তৃষ্ণা। লরা চোখ বুজে জোরে জোরে শ্বাস নিচ্ছে। যেন বাতাসের ঘ্রাণ নিচ্ছে। যেন সবকিছুকে নিজের মধ্যে সেঁধিয়ে দিচ্ছে। এরপর চোখ বুজেই বালুতে শুয়ে পড়ল। নিরু দেখছে লরাকে। কি রকম নিশ্চিন্তে উপভোগ করছে সব। আহা সেও যদি পারত।
নিজের অজান্তেই একটা দীর্ঘশ্বাস বের হয়ে গেলো। এমন তো ছিল না সে। এমন নির্জীব নিষ্প্রাণ নিস্তরঙ্গ। তাঁর তো এখানে এসে হইহুল্লর করার কথা। নাচানাচি করার কথা। পানিতে দাপাদাপি করার কথা। সাথে লরা আছে, লরার সাথে তো তাঁর রাজ্যের কথা বলার কথা। রাত ফুরিয়ে যাওয়ার কথা বলতে বলতে। অথচ এখন সময়ই কাটতে চায় না। যেন থেমে গেছে। সেই দিনের পর তারিখ তো বদলাচ্ছে, কিন্তু সময় বদলাচ্ছে না। সে যেন এখনও সেই পর্দার আড়ালেই দাঁড়িয়ে আছে। এখনও যেন সেই মুহূর্তেই গেঁথে আছে। নিরু নিজের মনেই ডুবে ছিল, আচানক চমকে গেলো কারো গলার আওয়াজ পেয়ে।
হেই নিরুপমা। চিনতে পেরেছ আমাকে?
নিরুর একটু সময় লাগল, কিন্তু নিরুপমা শব্দটা উচ্চারণের ধরণ দেখে চিনতে পারল এ নিক। সেদিন ডিস্কতে যে অফার দিয়েছিল তাঁর সাথে যাওয়ার জন্য। সে তাঁর নামও মনে রেখেছে।
হ্যাঁ চিনতে পেরেছি। নিক।
বাহ। ধন্যবাদ আমাকে মনে রাখার জন্য।
নিরু কি তাঁকে বসতে বলবে? ভাবতে ভাবতে নিক নিজেই বসে পড়ল পাশে। লরাও উঠে বসল।
পরিচয় করিয়ে দেই, আমার বন্ধু লরা। এঁর নাম তুমি সহজেই উচ্চারণ করতে পারবে। হেসে পরিচয় করিয়ে দিল লরার সাথে।
তোমরা কোন রিসোর্টে উঠেছ? নিক অবলীলায় জানতে চাইল।
বাঙালি যেখানেই যায় না কেন বাঙ্গালিই থেকে যাবে সেই সুবাদে জায়গা বলতে একটু ইতস্তত করল নিরু। লরা ফোঁস করে বলে দিল। লরার দিকে একটু রাগান্বিত চোখে তাকাল নিরু। লরা বুঝতে পারল না কেন?
দুই বন্ধু মিলে বেড়াতে এসেছ? ওয়াও চমৎকার।
সব কিছুতে ওয়াও বা অবাক হওয়ার ক্ষমতা আছে মনে হয় ছেলেটার। নিরু একটু বিরক্ত হয়ে বলে, না লরা এখানেই থাকে। আমি এসেছি বেড়াতে।
অহ আচ্ছা। কতদিন থাকবে?
নিরু প্রশ্নটা এড়িয়ে গেলো। কথা ঘোরানর জন্য জিজ্ঞেস করল, তুমি একা কেন? কেউ নেই সাথী?
নিক মনে হয় বুঝতে পেরেছে সেই রাতের জন্য একটু ঠেস মেরে কথা বলছে নিরুপমা।
খুব প্রাণবন্ত ভাবে হেসে জবাব দিল নিক, আমি সাধারণত একা বেড়াতে যাই।
একা? একা কেন? লরার বলে উঠে।
একাই তো ভাল। বন্ধু বান্ধব তো যেখানে থাকি সেখানে আছেই। একা বেড়াতে মজাই ভিন্ন। একা একা প্রকৃতি দেখা। একা একা নিজের সাথে নিজের বাস। নিজেকে উপভোগ করা। নতুন জায়গায় নতুন বন্ধু পাতানো।
কি হল? এভাবে তাকিয়ে আছ যে তোমরা?
লরা নিরু দুজনেই চোখ নামিয়ে নিলো। আসলে নিক এত দ্রুত ইংরেজি বলে যে নিরুর একটু সময় লাগে বুঝতে।
মুখে বলল , না শুনছিলাম তোমার কথা। আচ্ছা তাহলে ডিস্কোতে যে তোমার সাথে কয়েকজন দেখলাম, তাঁরা কারা?
ওহ তাঁরা আমার ব্যাংককের বন্ধু। তাঁর আগের দিন পরিচয় হয়েছিল।
বাহ, বেশ উপভোগ্য তোমার জীবন তাহলে। যেখানে যাও বন্ধু পাতাও। লরা বলল।
নিক হাসল। একটা সিগারেট ধরাল। হ্যাঁ আমি মনে করি জীবন তো এমনই হওয়া উচিত। উপভোগ্য। একটাই তো জীবন তাই না। হেসে তাকাল দুজনের দিকে। তোমরা কি মনে করো?
নিরু চুপসে গেলো। লরা নিরুর চুপসে যাওয়া দেখে তাঁকে শুনিয়ে শুনিয়ে বলল, হ্যাঁ আমিও তাই মনে করি। জীবন যদি উপভোগ্যই না হয় তবে আর জীবন কি! তাই না নিরু?
নিরু তাকাল লরার দিকে খুব করুণ চোখে। লরা চমকে গেল। কেঁদে ফেলবে নাকি। মায়া হল নিরুর জন্য।
নিক নিরু আর লরার এই চাওয়া চাওয়ি দেখে একটু চুপ হয়ে গেলো। কি বলবে বুঝতে পারছে না।
আচ্ছা আমি কি তোমাদের বিরক্ত করছি? তাহলে আমি উঠি।
না না, বিরক্ত করছ না। আসলে আমার বন্ধুটির মন একটু খারাপ তো। লরা বলে তো ফেলল কিন্তু নিরু রেগে গেলো। অপরিচিত কারো কাছে তার মন খারাপের ফিরিস্তি দিতে লরাকে কে বলেছে?
কিন্তু লরাকে কিছু বলল না। নিকের দিকে তাকিয়ে বলল, নিক কিছু মনে করো না, আমি উঠছি। কিছু খাবো। গলা শুকিয়ে যাচ্ছে। তোমরা বসো, গল্প করো।
বলেই উঠে গেল নিরু। লরা পিছনে পিছনে আসতে যাচ্ছিল, কিন্তু নিকই তাঁকে ডেকে থামাল। বলল, আমার কেন জানি মনে হচ্ছে তোমার বন্ধুটির একা থাকা উচিত । যদিও আমি ভুল হতে পারি।
লরা একটু ভেবে বসে পড়ল নিকের সাথে।
নিরু বিচের সাথে লাগোয়া একটা রেস্তোরায় বসে একটা ড্রিঙ্ক অর্ডার করল। কেন তাঁর রাগ হচ্ছে, কেন সে সব কিছুর উপর বিরক্ত । এখানে এসেছে সে একটু স্থির হওয়ার জন্য। অথচ এক দণ্ড শান্তি পাচ্ছে না। অসহ্য।
ফোনটা কেঁপে উঠল নিরুর। তাকিয়ে দেখল, মা।
একটু থিতু হল নিরু। মাকে ফোন করা হচ্ছে না, মা নিশ্চয়ই চিন্তা করছে। করছে কি এসব নিরু। নিজের উপর রাগ আরো বেড়ে গেলো।
হ্যালো মা?
কিরে নিরু, কোনও খবর নাই, আছিস কেমন? সব ঠিক?
হ্যাঁ মা, সব ঠিক। আসলে এখানে নেট একটু স্লো তো তাই কল দিতে পারি নি। তুমি কেমন আছ মা?
নাজমা বুঝতে পারলেন মেয়ে মিথ্যা বলছে। কিছু বললেন না। আছি ভালই। তোর জন্য চিন্তা হচ্ছিল।
চিন্তা করো না, সব ঠিক আছে। বলতে বলতে নিরুর গলা কেমন যেন ধরে এলো। কিন্তু আপ্রাণ চেষ্টা করলো যেন মা কিছু না বুঝে। মুখ চেপে ধরল নিরু নিজের।
নাজমা বুঝতে পারলেন ঠিকই। কিন্তু কিছু জিজ্ঞেস করলেন না।
কিছুক্ষণ ইচ্ছে করে চুপ থাকলেন যেন নিরুকে সময় দিলেন সামলে নিতে।
নিরু, ঠিক মত থাকিস, সাবধানে থাকিস। আর শোন, জীবন এত সোজা না রে। যা চাইবি তাই যে তেমনই হবে এমন ভেবে বসে থাকিস না। তুই যেভাবে গড়তে চাইবি, সেভাবে গড়তে হয়তো পারবি না। একবার ভাঙবে একবার জোড়া লাগবে। এই ভাঙা গড়ার মাঝে এক সময় তুই ঠিকঠাক জীবন পেয়ে যাবি। পেতে শিখে যাবি। এই শিক্ষাটা অর্জন করতে না পারলে জীবনে ঠকবি। তোকে আমি ঠকার জন্য বড় করি নি নিরু।
নিরু কিছু বলতে পারল না। নিশ্চুপ কাঁদছে।
চলবে…
পরিচ্ছেদ ৬ অনেক রাতে ফিরেছিল কল্যাণ ওরফে শহীদুল।গাড়িটা শেডে রাখার পর দু’বার হালকা করে মা…..
পরিচ্ছেদ ৫ আকাশে এখন আর মেঘ নেই। হাওয়া হচ্ছে।কদিন পরেই বর্ষা নামবে।একদিন হাসপাতাল থেকে ফিরতে…..
পরিচ্ছেদ ৪ ভোর হয়ে আসছে।রাতে ভালো ঘুম হয়নি।ঘুমের ঘোরে মনে হচ্ছিল দম বন্ধ হয়ে আসছে।এরকম…..
তারপর ইলেকট্রিক বিল জমা দিতে যাবো। আমার দেরি হবে আসতে। স্বামী অমর বলে, ঠিক আছে।…..