ইমন কল্যাণ
পরিচ্ছেদ ৬ অনেক রাতে ফিরেছিল কল্যাণ ওরফে শহীদুল।গাড়িটা শেডে রাখার পর দু’বার হালকা করে মা…..
ঘুম যখন ভাঙল নিরুপমার তখন দুপুর গড়িয়ে বিকেল ছুঁই ছুঁই। মাথা একটু ভার ভার লাগছে। আর মুখ থেকে উৎকট মদের গন্ধ যেন এখনও লেগে আছে। নিজের মুখের গন্ধে নিজেরই বমি হয়ে যাওয়ার দশা। বিছানা থেকে উঠতে গিয়ে টের পেলো শরীরে এক ফোঁটা শক্তি নেই। ভীষণ ক্লান্ত আর দুর্বল লাগছে। পা ব্যথা করছে।চুলে হাত দিয়ে বুঝল জঙ্গল হয়ে গেছে। গলা শুকিয়ে জিভের সাথে লেগে গেছে। দু হাতে ভর দিয়ে অতি কষ্টে বিছানায় হেলান দিতে পারল। পাশে রাখা পানির বোতল পুরোটাই শেষ করে ফেলল এক নিঃশ্বাসে। যেন প্রাণ ফিরে পেলো।
পুরো শরীর যেন পানি পেয়ে শিথিল হল। কিন্তু মাথাটা ফেটে যাচ্ছে ব্যথায়। লরাকে ডাকল চোখ বুজে মাথা চেপে। কয়েকবার ডেকেও সাড়া পাওয়া গেলো না। বোধহয় নেই রুমে। মোবাইল দেখে বুঝল লাঞ্চ সারতে গেছে। নিরুপমারও ক্ষুধা লেগেছে প্রচণ্ড ,এতক্ষণে টের পেলো। কিন্তু এই মাথা ব্যথা নিয়ে নড়তেও ইচ্ছে করছে না।
রুম সার্ভিসে কফি আর সেন্ডুইস অর্ডার করলো। রুমের পর্দা সরানো হয় নি। এই রুমটা চমৎকার। দেয়াল এক পাশ পুরোটাই কাঁচ। পর্দা সরিয়ে দিলেই পুরো শহর দেখা যায়।
নিরুপমা উঠে পর্দা সরিয়ে পাশের চেয়ারে বসল। দুরে সমুদ্রের কিনারা দেখা যাচ্ছে। হোটেল লাগোয়া বড় বড় নারিকেল গাছ দুলে দুলে বাতাস দিচ্ছে। জানালা খোলার ব্যবস্থা থাকলে ভাল হয়। হাওয়া মাখা যেত গায়ে। কিন্তু নিঃশব্দে বাতাস দেখা ছাড়া উপায় নেই। রোদ কমতে শুরু করেছে। গনগনে সূর্য আস্তে আস্তে লালচে হচ্ছে। একসময় গাঢ় কমলা হবে। এরপর রক্তিম হবে। এবং দেখতে দেখতেই টুপ করে ডুবে যাবে। হারিয়ে যাবে কোথাও। কিন্তু এ আবার ফিরে আসে। আবার সতেজ হয়ে উঁকি দেয় কয়েক ঘণ্টা বাদে।
নিরুপমা সূর্যের নরম আলোর দিকে তাকিয়ে আছে স্থির। চোখ বুজে যাচ্ছে মাথা ব্যথার যন্ত্রণায়। কিন্তু এই দৃশ্য দেখতে ইচ্ছে করছে। সব সময় করে।
কি অপূর্ব এই প্রকৃতি। কত শত বছর ধরে নিয়ম মেনে রূপ বিলিয়ে যাচ্ছে। মাঝে সাঝে ক্ষেপেও যায় কিন্তু আবার সেই আগের স্নিগ্ধ রূপে ফিরে আসে। মানুষ একে দেখে পাগল হয়। মানুষকে পাগল বানানর জন্য নিজের অদেখা কত রূপ মেলে দেয়। আজীবন সে মুগ্ধ করে যাচ্ছে। বিনা পারিশ্রমিকে। ভাবতে ভাবতে নিরুপমা আবার নেতিয়ে পড়ে। ডোর বেল বাজে। কফি আর সেন্ডুইস আসে। কফির ঘ্রাণেই অনেক তরতাজা লাগে নিজেকে। বুক ভরে ঘ্রাণ নেয় নিরুপমা। কয়েক কামড় সেন্ডুইসে বসিয়েই ব্যাগে ওষুধ খুঁজতে থাকে।খুঁজতে খুঁজতে কপালে ভাজ পড়ে। বিরক্ত হচ্ছে। কেন সে কালকে এত প্যাগ খেলো। অসহ্য যন্ত্রণায় এখন দাঁড়িয়ে থাকাও কষ্টকর হচ্ছে।
ধ্যাত। বিরক্ত হয়ে ব্যাগ ছুঁড়ে মারে বিছানায়। ভাল লাগে না তাঁর। কিচ্ছু ভাল লাগে না। এই ভাল না লাগাটাই সবচেয়ে বেশি বিরক্তির কারণ। সবচেয়ে বেশি অসহায়ত্বের কারণ। নিজের উপর এতই রাগ আসে নিরুপমার যে চোখ দিয়ে হুট করেই পানি গড়িয়ে পড়ে।
দরজা খোলার আওয়াজ পাওয়া যায়। লরা এসেছে সাথে নিক।
পিছন ফিরে তাদের দেখে নিরুপমার আরও রাগ লাগে। মাত্র দুইদিন হল পরিচয় হয়েছে তাতেই এত মেলামেশা কীসের। একসাথে মনে হয় খেয়ে এসেছে। আশ্চর্য! লরা এমন হ্যাঙলার মত করছে কেন? সে এসেছে নিরুপমার সাথে, আর তাঁকে ফেলে আরেকজনের সাথে দিব্বি ঘুরে বেড়াচ্ছে।
বিরক্তিতে মুখ ফিরিয়ে নিলো নিরুপমা। লরা সামনে এসে ওষুধ ধরিয়ে দিল হাতে।
ধর, এটা খেয়ে ফেল। মাথা ব্যথা করছে নিশ্চয়ই।
নিরুপমা তেমনই বিরক্তি মুখে বলল, কোথায় গেছিলি, আজব আমি এখানে একা।
লরা চোখ কপালে তুলল। অবাক হওয়া মুখে বলল, ওমা তুইই না একা একা থাকতে চাস। আমি কোথাও যেতে বললে তো জোর করে নিয়ে যেতে হয়।
নিরুপমা নিচে তাকিয়ে আছে দেখে লরা আবার বলল, তুই ঘুমচ্ছিল খুব। আর কালকে রাতে অনেক খেয়ে ফেলেছিলি তাই তোকে জাগাই নি। নিক আসল, তাই ওর সাথেই খেয়ে আসলাম। এখন তুই উঠ। ওষুধ খেয়ে গোসল করে নে। ভাল লাগবে। এরপর তোকে খাইয়ে নিয়ে আসি। চল উঠ।
নিরুপমা উঠতে চাইছে না। বসেই আছে। এটা তাঁর গত কয়েকমাসের রোগ। কিছুই করতে ইচ্ছে করে না। না খেতে না শুতে না নড়তে। যখন যেখানে যেভাবে থাকে সেভাবেই পড়ে থাকতে ইচ্ছে করে। যেন নড়লে বুকের ভেতর খাপটি মেরে থাকা যন্ত্রণাটা আরও বেড়ে যাবে। যেভাবে আছে সেভাবেই যেন সেটা কম আছে। বা থেমে আছে। নড়াচড়া করলে ছড়িয়ে যেতে পারে।
সেই ভয়ে নিরুপমা নড়ে না। নড়তে চায় না। যেন দগদগে ঘা, টনা পরলেই ছিঁড়ে যাবে।
কিরে উঠ না। লরার ঠেলাঠেলিতে নিরুপমা উঠে বাথরুমে যায়।
বিকেলের দিকে ঠাণ্ডা হাওয়া দেয় এখানে। নীরব দুপুর সন্ধ্যা হতে হতে মুখর হয়ে উঠে। যেন ভাত ঘুম থেকে জেগে উঠেছে সবাই। অথচ এখানে সবাই যে যার মত কাজে ব্যস্ত। তবু সন্ধ্যা নামতেই হই হই করে বের হয়ে পড়ে। যেন উৎসব। কোলাহল কোন কালেই নিরুপমার ভাল লাগে না। এখন তো আরও ভাল লাগে না। স্নান সেরে ভরপেট খেলো। মাথা ব্যথা অনেকটাই চলে গেছে। হোটেল থেকে অল্প দুরে খোলা রেস্তোরায় খেতে বসেছিল। প্রায় রেস্তোরা এখানে এমন। ভেতরে এবং বাইরে বারান্দায় খাওয়ার ব্যবস্থা আছে। খোলা বারান্দা দিয়ে মানুষ ভেতরে কেন খায় বুঝে না নিরুপমা। সাথে নিক ছিল। যদিও নিরুপমা আসতে বলে নি। লরাকে বলেছে , সে নাকি শপিং করবে। আর বেশিদিন যেহেতু নেই এখানে তাই শপিং করা লাগবে। নিরুপমার এসবে আর ইচ্ছে নেই। তাও মার জন্য কিছু নেওয়া উচিত। এটা ভাবতেই আবার বিরক্তি চেপে বসেছে। পারবে না সে শপিং এ যেতে। লরাকে বলে দিবে কিছু একটা নিয়ে আসতে।
খাওয়া শেষে কোকের গ্লাসে চুমুক দিচ্ছে নিরুপমা। আর রাস্তার লোকজনদের দেখছে। নিক বিয়ার নিয়ে বসেছিল। কেউ যে সাথে আছে সে যেন নিরুপমা দিব্বি ভুলে বসে আছে।
নিকই শুরু করল কথা।
তুমি সমুদ্রে একা একা গিয়েছ কখন?
প্রশ্ন শুনে তাকাল নিকের দিকে নিরুপমা। অহেতুক প্রশ্ন তাই সেও অহেতুক জবাব দিল।
হ্যাঁ।
কখন?
নিরুপমা বিরক্ত হচ্ছে। জেরা করছে নাকি নিক? এখানে এসেই তো গেলাম।
আচ্ছা। নিকের শান্ত কণ্ঠ। কিন্তু তাঁকে দেখে মনে হচ্ছে আরও কিছু বলবে। নিরুপমা প্রশ্ন করল, তুমি এখানে আমাদের সাথে কি করছ? তোমার না অনেক বন্ধু, যেখানে যাও সেখানেই বন্ধু পাতাও।
প্রশ্নটা নিরুপমা ঠেস মেরে জিজ্ঞেস করেছে নিক সেটি ভালই বুঝতে পারল। কিন্তু গায়ে মাখল না। হেসেই জবাব দিল, হ্যাঁ আমার অনেক বন্ধু। তোমাদেরও আমার বন্ধু মনে হয় তাই আছি সাথে।
নিরুপমা ভেতরে ভেতরে রেগে যাচ্ছে। নিক তাঁর বন্ধু, এ তথ্য সে কোথায় পেলো? কে বানিয়েছে তাঁকে নিরুপমার বন্ধু?
আমি তোমার বন্ধু কে বলল?
নিক হোহো করে হেঁসে উঠল। কে কার বন্ধু সে কি ঘোষণা দিয়ে হয় নাকি?
নিরুপমা আরও কড়া কিছু বলতে যাচ্ছিল কিন্তু নিতান্ত ভদ্রতাবশত বলতে পারল না। কিন্তু কপালে বিরক্তির স্পষ্ট ছাপ।
নিক বুঝতে পারলো নিরুপমা তাঁর সঙ্গ পছন্দ করছে না। তাই স্পষ্ট ভাবেই বলল, দেখো নিরুপমা, আমি বুঝতে পারছি আমার সঙ্গ তোমার ভাল লাগছে না। কিন্তু আমার তোমাদের দুজনই চমৎকার লেগেছে। একটা ভিন্ন দেশের দুইজন মেয়ে নিজেদের জীবন থকে খানিক ছুটি নিয়ে অবকাশে এসেছে ব্যাপারটা সব সময় আমার চমৎকার লাগে। সেই সব চমৎকার মানুষদের সাথে মিশতে আমার ভাল লাগে। তাই মিশছি। যদি তোমার খুব সমস্যা হয় তাহলে আমি চলে যাচ্ছি।
নিরুপমা আবারও বাঁকা জবাব দিল, আমরা জীবন থেকে পালিয়ে এসেছি তোমাকে কে বলল? লরা?
নানা, কেউ আমাকে কিছু বলে নি। আমি অনুমান করে নিয়েছি।
না জেনে অনুমান করা ঠিক না জানো না?
হ্যাঁ জানি। তবে এ ক্ষেত্রে অনুমান ভুল বলে মনে হচ্ছে না আমার।
নিরুপমা রেগেই বলে ফেলল, অন্যের জীবন নিয়ে গবেষণা করতে কেউ তোমাকে বলে দিয়েছে?
তুমি রেগে যাচ্ছ নিরুপমা। আমাকে ভুল বুঝছ। যাক, আমি যাই।
রেগে গেলেও কেন জানি নিরুপমা নিককে যেতে দিল না। নিক উঠতেই বলল, আচ্ছা এসেছ যখন থাকো আর কিচ্ছুক্ষণ।
নিক একটু দাঁড়াল এবং হালকা হাসল।
না বসব না। চলো তোমাকে নিয়ে সমুদ্রে যাই।
নিরুপমা তাকাল নিকের দিকে কিছুক্ষণ। ৬ ফুটের বেশি লম্বা একদিন ভিনদেশী সুঠাম শরীর আর আকর্ষণীয় ব্যক্তিত্বের এক যুবক নিরুপমার সামনে হাসিমুখে দাঁড়িয়ে আছে। নিরুপমার জায়গায় অন্য মেয়ে হলে কি কোন টান অনুভব করত না? হয়তো করত। তাহলে নিরুপমার কোন টান লাগে না কেন? কোন আকর্ষণ জাগে না কেন ? সব কি মরে গেলো ভেতরে?
তাঁরা দুজন হাঁটছে। নীল জলের ধারে সাদা ধোঁয়াটে বালির মাঝে দুই জোড়া পা হেঁটে যাচ্ছে মৃদু তালে। কেউ কাউকে দেখছে না, কথা বলছে না। শুধু হেঁটে যাচ্ছে। এখনও আলো নিভে যায় নি পুরোটা। সূর্য নিচে নেমে যাচ্ছে ক্রমশ। নিরুপমার পড়ন্ত সূর্য দেখার বড় সাধ। কিন্তু কখনই কেন জানি দেখা হয়ে উঠে না। দেখতেই দেখতেই কোথায় যেন মিলিয়ে যায়। আজ সূর্যের দিকে খেয়াল নেই। আপনমনে হেঁটে যাচ্ছে। নিকের গলা পেয়ে হঠাৎ চমকে উঠল।
হ্যাঁ? কিছু বলছ?
তোমাকে ডাকছি। তুমি তো কি চিন্তায় যেন হারিয়েই গেলে। এখানে আছ?
হ্যাঁ আছি। এক ভারী দীর্ঘশ্বাস ফেলে জবাব দিল নিরুপমা।
এত বড় শ্বাস ফেলার মত কিছু বলছি না।
নিরুপমা চুপ।
তোমাকে একটা কাজ দেই করবে?
কাজ? কি কাজ? ভারী অবাক হয় নিরুপমা।
নিক দাঁড়িয়ে পড়ে। নিকের দেখাদেখি নিরুপমাও হাঁটা বন্ধ করে দাঁড়ায়।
নিক কিছু বলছে না শুধু তাকিয়ে আছে নিরুপমার দিকে। নিরুপমা কপাল কুঁচকে তাকায় নিকের দিকে।
আসো এখানে একটু বসি।
নিরুপমা আর নিক বালিতে বসল পাশাপাশি। সন্ধ্যা নামার আগে আগে টুরিস্ট কিছু কম থাকে সমুদ্র পাড়ে। আজ মনে হচ্ছে আরও কম। এদিক সেদিক কয়েকজন দেখা যাচ্ছে শুধু।
খানিক চুপচাপ দুজন বসে থেকে নিক কোন রকম ভূমিকা ছাড়াই বলল, তুমি এখন চোখ বন্ধ করবে নিরুপমা।
মানে? চোখ বড় বড় করে তাকায় নিরুপমা।
কিন্তু নিরুপমার অবাক হওয়াতে নিকের কথায় কোন পরিবর্তন হল না। সে হঠাৎ কেমন যেন স্থির শান্ত হয়ে গেলো। যেন ধ্যানে যাচ্ছে সে। চেহারায় কেমন যেন একটা কোমল কোমল ভাব। হাসি নেই মুখে তবু যেন মনে হয় হাসি হাসি মুখ।
হ্যাঁ নিরুপমা তুমি এখন চোখ বন্ধ করবে।
কেন বন্ধ করব?
নিক নিরুপমার হাত ধরে ফেলে। নিরুপমা একটু চমকায়। কিন্তু ছাড়িয়ে নেওয়ার চেষ্টা করল না। কেন যেন মনে হল নিক কোন খারাপ উদ্দেশ্য নিয়ে হাত ধরে নি।
নিরুপমা, চোখ বন্ধ করো। নিক নিরুপমার চোখের দিকে গভীর করে তাকিয়ে বলল। নিরুপমা কিছু বলতে পারল না।
সমুদ্রের দিকে মুখ করে চোখ বন্ধ করল নিরুপমা।
কানে যাচ্ছে সমুদ্রের গর্জন আর নিকের কিছু কথা।
নিরুপমা, তুমি এখন একদম শান্ত স্থির। তুমি সমুদ্র পাড়ে বসে আছ। একা একদম একা। নিঃসঙ্গ। এই পুরো সমুদ্র পাড়ে তুমি ছাড়া আর কেউ নেই। শুধু তুমি আর এক বিশাল সমুদ্র। বিশাল তাঁর ঢেউ। একটির উপর আরেকটি আছড়ে পড়ছে। নীল সমুদ্র জল। মাথার উপর অসমাপ্ত আকাশ। আকাশের বুক ঘেঁষে সাদা মেঘ। ছুটোছুটি করছে।তোমার পায়ের নিচে চিকচিক করছে বালি। শুভ্র বালি। চারিদিকে মিষ্টি সুভাস। মৃদু বাতাস তোমাকে ছুঁয়ে যাচ্ছে। তুমি আকাশের দিকে তাকিয়ে জোরে শ্বাস নিলে। চারিদিকের শুভ্রতা স্বচ্ছতা পবিত্রতা যেন নিঃশ্বাসের সাথে ভেতরে গ্রহণ করছ।
নিরুপমা এখন তুমি একদম শান্ত। চমৎকার একটা পরিবেশে তুমি বসে আছ। চমৎকার প্রকৃতির মাঝে তুমি নিজেকে সুখী অনুভব করছ।এই মুহূর্তে তোমার কোন দুঃখ নেই। কোন রাগ নেই কোন কষ্ট নেই । নির্দাগ মন নিয়ে তুমি প্রকৃতির রূপ দেখছ। এই মুহূর্তে তুমি সবচেয়ে সুখী মানুষ।
তোমার পাশে কেউ এখন এসে বসেছে নিরুপমা। তাঁর দিকে তুমি তাকাচ্ছ না। কিন্তু তুমি জানো সে কে? যে ব্যক্তির জন্য তোমার জীবনে অনেক ঝড় গেছে, তোমার মনটা বিষিয়ে আছে, যন্ত্রণায় কুঁকড়ে আছ সারাক্ষণ এই সেই ব্যক্তি। তুমি তাঁর অস্তিত্ব টের পাচ্ছ। তাঁর গন্ধ পাচ্ছ। পাশ ফিরলেই তুমি তাঁকে দেখতে পাবে। এবং তুমি তাঁকে দেখেছ। সে মাথা নিচু করে আছে। তুমি চাইলেই এখন তাঁকে তোমার মনের সব যন্ত্রণার কথা সব কষ্টের কথা , যত রকম রাগ ক্রোধ জমা আছে সব উগড়ে দিতে পারো। যত তুমি বলবে তাঁকে ততই তোমার জমানো রাগ কষ্ট যন্ত্রণা অভিমান কমতে থাকবে। তোমার ভেতরে জমানো ভাণ্ডার ধীরে ধীরে খালি হতে থাকবে। আর এই সব কালো কালো যন্ত্রণা সামনে থাকা বিশাল সমুদ্র নিজের মধ্যে টেনে নিবে। একেকটা ঢেউ আসবে আর তোমার উগড়ে দেওয়া যন্ত্রণা টেনে নিয়ে যাবে।
তোমার মধ্যে আর কোন খারাপ লাগা থাকবে না। তুমি সম্পূর্ণ হালকা মানুষ হবে। হালকা স্বাধীন উড়ন্ত।
নিরুপমা তুমি পারবে। কানের খুব কাছে এসে নিক শেষের লাইনটি বলে।
এরপর চুপ করে পাশ থেকে উঠে যায়।
নিরুপমা গভীর মগ্নতায় কোথায় যেন হারিয়ে যায়। সে চোখ বুজেই বসে থাকে। তাঁর কানে শুধু সমুদ্রের গর্জন ঢেউ খেলে যায়। বন্ধ চোখে সে নিজেকে আবিষ্কার করে সমুদ্র পাড়ে একা তবে সেই একাকীত্বের মাঝে নিরুপমা নিজেকে নিঃসঙ্গ মনে করে না। সমুদ্র বাতাস জলরাশি সবুজতা বালিরাশি পাথরযুগল সব কিছু যেন তাঁকে সঙ্গ দিচ্ছে। অনেক অনেক দিন পর নিরুপমা নিজেকে ভরপুর মনে করছে। জনহীন পরিবেশে নিজেকে উন্মুক্ত মনে করছে। ভেতরে কেমন একটা সুখী সুখী ভাব উঁকি দিচ্ছে। কোত্থেকে যেন ভাল লাগার ভীষণ ভাল লাগার পরম আবেশ নিরুপমাকে জড়িয়ে ধরছে। ঠিক যে শান্তির খোঁজে নিরুপমা এতদিন হন্য হয়েছিল সেই শান্তির দেখা পেলো যেন অবশেষে।
ঠোঁটের কোণে হালকা এক চিলতে হাঁসি বসে গেলো নিরুপমার অজান্তে।
খানিক পড়ে নিরুপমা অসীমকে আবিষ্কার করল নিজের পাশে। একটি সাদা শার্ট আর ব্লু জিন্স পরনে অসীমকে চমৎকার লাগছে। তাঁর উষ্কখুষ্ক চুল মৃদু মৃদু উড়ছে। নিরুপমার ইচ্ছে করলো অসীমকে সে দেখুক। সে পাশ ফিরে তাকাল। একদম স্পষ্ট সে অসীমের চেহারাটা দেখল। মাথা নিচু মুখ গম্ভীর । চেহারায় কোথায় যেন একটা দুখী দুখী ভাব। নিরুপমার এই চেহারা দেখে কেমন যেন শান্তি লাগলো। সে কি এই চেহারাই দেখতে চেয়েছিল? অসীমের দুখী কাতর অনুতপ্ত চেহারা? এই চেহারা দেখে সে যে তৃপ্তি পাচ্ছে সেটা কি তাঁর অনেকদিনের যন্ত্রণার মলম?
নিরুপমা চোখ সরিয়ে নেয় অসীম থেকে। সে মুখ খোলে কিছু বলার জন্য।
তোমাকে যা দিয়েছি অসীম তুমি তাঁর মান রাখতে পারো নি । তুমি আমাকে ভীষণ কষ্ট দিয়েছ। তোমার দেওয়া কষ্টের পরিমাণ আমার দেওয়া ভালোবাসার চেয়েও অনেক বড়। একে আমি গ্রহণ করতে পারছি না। তোমাকে আর রাখতে পারছি না। আজ এখন এই মুহূর্তে তোমার দেওয়া সব কষ্ট দুঃখ যন্ত্রণা এই সমুদ্রের পানিতে বিসর্জন দিলাম। ঢেউ এসে নিয়ে যাবে। আর ফেরত দিবে না।
নিরুপমা আবারও অসীমের দিকে তাকাল। নির্বাক অসীমের মাথা আরও নিচু হয়ে গেল।
নিরুপমা উঠে দাঁড়াল। ধীরে ধীরে অসীমকে পিছনে রেখে হেঁটে দুরে চলে যেতে লাগল। একবারের জন্যও সে ফিরে তাকাল না। সে যে ফিরে তাকাচ্ছে না সেই বোধ নিরুপমাকে ভীষণ আনন্দ দিচ্ছে। খুশির একটা ফোয়ারা বয়ে যাচ্ছে নিরুপমার মনে। সে হেঁটে যাচ্ছে। ভীষণ সুখী নিরুপমা এখন।
নিরুপমা যখন চোখ খুলল তখন পাশে কাউকে পায় নি। এমনকি নিকও ছিল না । শুধু সামনে আস্ত একটা কমলা সূর্য পানিতে ডুবে যাওয়ার জন্য অপেক্ষা করছে। যেকোনো মুহূর্তে সে টুক করে ডুবে যাবে। নিরুপমার বহুদিনের ইচ্ছে আজ পূরণ হল। সূর্যাস্ত দেখা। সে দেখছে। নিস্পলক চোখে দেখছে। সূর্যটা তাঁকে সাক্ষী রেখে খুব আস্তে আস্তে পানিতে হারিয়ে গেলো চারিদিকে শুধু তাঁর গায়ের কমলা আলোটা ছড়িয়ে রেখে।
নিরুপমা পলক ফেলল। সাথে আলতো একটু জল গড়িয়ে পড়ল চোখ দিয়ে। এবং কিছুক্ষণ নিঃশব্দে জল গড়িয়েই পড়তে লাগল। জল পরা যখন শেষ হল নিরুপমা চোখ মুছে উঠে দাঁড়াল। এবং আশ্চর্যজনক ভাবে নিজেকে সে ভীষণ হালকা অনুভব করল। এই বিস্ময়কর অনুভূতির জন্য নিজেই অবাক হয়ে গেলো। এতদিনের জমানো একটা ভার যেন সত্যি সমুদ্রে বিসর্জন দিয়েছে। সত্যি কি এত সোজা? নাকি এখনও সে কল্পনায় আছে?
মানুষ কি সত্যি এত সহজেই তাঁর জীবনের খারাপ সময় থেকে মুক্তি পায়? ঝেড়ে ফেলতে পারে সকল যন্ত্রণা? এত সহজেই কি ভরে যায় সব ঘা? এই যে প্রতিদিন নিরুপমাকে একটা পোকা কুড়ে কুড়ে খেত, রাত দিন একটা গা জ্বালা ধরা যন্ত্রণা সাপের মত জড়িয়ে রাখতো সে কি এত সহজেই নেমে গেলো?
এখন কি সে আগের মত হাসতে পারবে? গল্প করতে পারবে? সমুদ্রে ডুব দিতে পারবে? সবুজে গা ভাসিয়ে দিতে পারবে?
হাসতে হাসতে কি ধুপ করে একটা কালো ছায়া ঝাপটে ধরবে না? মুখ চেপে ধরবে না গল্প করার সময়? মোচড় দিবে না বুকে যন্ত্রণায়? হাহাকার থাকবে না আর?
নিরুপমা এদিক সেদিক তাকায়। নিককে খোঁজে? যেন নিকই উত্তর দিতে পারবে।
কিন্তু এখন এই মুহূর্তে নিরুপমা মনে শরীরে যে ভাল লাগার রেশ বয়ে যাচ্ছে সেও তো মিথ্যা নয়। যে ভাল লাগার খোঁজে সে এখানে এসেছিল এ ঠিক সেই ভাল লাগা। একে সে অস্বীকার করতে পারে না।
নিরুপমা একটা শ্বাস নিলো। এরপর হাস্যজ্জ্বল মনে এবং মুখে সমুদ্র পাড় ধরে হাঁটতে লাগলো। এই বাতাসে এই সবুজের সৌরভে এই বিশাল আকাশের নিচে প্রাণ খুলে হাঁটা হয় নি এতদিন। আজ সে প্রতিটি মুহূর্ত যেন লুফে নিচ্ছে। নিরুপমা চুলে হাত দিয়ে আরও এলোমেলো করে দিল। হাঁটতে হাঁটতে হুট করে একটু দৌড় দিলো। বাচ্চার মত খিলখিল করে হাসল। দু হাত মেলে যেন কিছুকে আলিঙ্গন করল। হারিয়ে যাওয়া প্রাণশক্তি যেন হুট করে এসে নিরুপমাকে জড়িয়ে ধরল।
চলবে…
পরিচ্ছেদ ৬ অনেক রাতে ফিরেছিল কল্যাণ ওরফে শহীদুল।গাড়িটা শেডে রাখার পর দু’বার হালকা করে মা…..
পরিচ্ছেদ ৫ আকাশে এখন আর মেঘ নেই। হাওয়া হচ্ছে।কদিন পরেই বর্ষা নামবে।একদিন হাসপাতাল থেকে ফিরতে…..
পরিচ্ছেদ ৪ ভোর হয়ে আসছে।রাতে ভালো ঘুম হয়নি।ঘুমের ঘোরে মনে হচ্ছিল দম বন্ধ হয়ে আসছে।এরকম…..
তারপর ইলেকট্রিক বিল জমা দিতে যাবো। আমার দেরি হবে আসতে। স্বামী অমর বলে, ঠিক আছে।…..