রশীদপ্রেমিকা

দাউদ হায়দার
প্রবন্ধ
Bengali
রশীদপ্রেমিকা

চোখে দেখিনি, বাঁশিও শুনিনি। চিনি ইমেলে। বছর কয়েক আগে মেলবোর্নে থেকে যোগাযোগ করেন। মূল উদ্দেশ্য নিমন্ত্রণ। সাহিত্য-সংস্কৃতিক মেলা উপলক্ষে। সরাসরি প্রত্যাখ্যান করিনি। বলি ‘ভারতে যাবো তখন, আত্মীয় স্বজন আসবেন। অনেকদিন দেখিনি। প্রত্যেকে প্রতীক্ষারত। শুনে, ‘রশীদ হায়দারের সাথে যোগাযোগ করতে চাই, ফোন নাম্বার দেবেন? দিয়েছিলাম। পরে কি ঘটে, অজানা। মেলবোর্নেরই দুই বন্ধুর ফোনে শুনি মেলা নিয়ে ঝামেলা। কিমিটি থেকে ভদ্র মহিলা বাদ। বেমালুম ভুলে গিয়েছিলাম তাঁকে। রশীদ হায়দারের মৃত্যুর চারদিন পর তাঁর কণ্ঠ, ফোনে। “রশীদ হায়দারের সাথে দেখা হলো না। আফসোস রয়ে গেলো। দেখা হলে কয়েকটা প্রশ্ন করতাম। “জানতে চাই, কী প্রশ্ন আপত্তি না থাকলে বলবেন কি। ‘আপত্তি আর কি, তিনি তো চলেই গেলেন, আচ্ছা বলছি।“ শুরু করেন-

এক) আপনারা সব ভাই সাহিত্য করেন। আপনাদের বাবা-মা কি গল্প কবিতা লিখতেন?

দুই) আপনাদের বোনেরা বাদ কেন?

তিন) রশীদ হায়দার গল্প উপন্যাস নাটক লিখেছেন, গবেষণা করেছেন। আপনারা অন্যান্য ভায়েরা কবিতা লেখেন, তিনি লেখেননি?

চার) তিনি কোনো রাজনৈতিক দলের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন না। থাকা না থাকাও রাজনীতি। কিন্তু তিনি আওয়ামী মনোভাবাপন্ন। আওয়ামী লীগার সন্দেহ নেই। যদিও প্রকাশ্যে বলেননি কোথাও। না বললেও তার লেখালেখিতে স্পষ্ট অনেকটাই। যেমন বঙ্গবন্ধুর স্ত্রীকে নিয়ে বই লিখেছেন। আওয়ামী মেজাজে না হলে ‘স্মৃতি ৭১’, শহীদ বুদ্ধিজীবী কোষ স্বতস্ফ‚র্ত সম্পাদনা করতেন না। মুক্তিযুদ্ধ ও স্বাধীনতা নিয়ে এত লেখালেখি করতেন না। তার অনেক গল্প উপন্যাসে মুক্তিযুদ্ধ স্বাধীনতা নানাভাবে ঘুরেফিরে দানা বেধেছে। আপনি বাদে আপনার বাকি ভায়ের (এর আগে বলেছেন ভায়েরা) আওমী লীগে বিশ্বাসী মনে হয়। আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে কেউ কিছু বলেন না। আপনি ছাত্র অবস্থায় ছাত্র ইউনিয়ন করতেন। এখনও কমিউনিজমে ঘোরতর বিশ্বাসী। লিখেছেন একটি লেখায়। যদিও থাকেন জার্মানির মতো ধনতান্ত্রিক দেশে। রশীদসাহেব কি সমাজতন্ত্রে বিশ্বাসী ছিলেন?

হেসে কই, চার নম্বরে আপনি সব কইলেন, প্রশ্ন বাহুল্য।

রশীদ হায়দার (১৯৪১-২০২০), আলোকচিত্রী: শাকুর মজিদ

রশীদ হায়দার ইহলোকে নেই তাঁর হয়ে, তাঁর জবান রচনা অসম্ভব। বললাম, এক থেকে চার প্রশ্নের উত্তর এই পয়লা. বাবা-মা সাহিত্যটাহিত্য করতেন না। দ্বিতীয়, দুই বোন মাঝে মাঝে কবিতা লেখেন। বাকিরা কেন লেখেন না, ওদের জিজ্ঞেস করুন। তৃতীয়, বঙ্গবন্ধুর আওয়ামী লীগে আস্থাশীল। সরাসরি রাজনীতি না করেও আওয়ামীর প্রতি বিশ্বাসী। আওয়ামী না থাকলে বাংলাদেশের অস্তিত্ব সংকটাপন্ন। আওয়ামীর সাম্প্রতিক রাজনীতি হরেক ডামাঢোলে, বেখাপ্পা সত্বেও বাংলাদেশ চির উন্নতশির। রশীদ হায়দার সমাজতন্ত্রের নিবেদিত প্রাণ, ঠিক তবে, সরব ঘোষণা ছিলো না। না থাকাও রাজনীতি। আওয়ামী রাজনীতির অন্তরঙ্গে সমাজতন্ত্র আছে। বৈশি^ক চাপ, করপোরেট অর্থনীতি ছলকাল এবং ধর্মীয় মৌলবাদের আগ্রসনে আপত মৌনী ছিলেন। সোচ্ছার হননি। কিন্তু বিশ্বাস ছিলো দৃঢ়। সূর্যকে মেঘ যতই ঘিরুক, সাময়িক। সূর্যের তেজে ধূলিসৎ। আঁধারের পরে সূর্যালোক। চারদিকে আলোকিত। উদ্ভাসিত। সূর্য বলতে রশীদ হায়দার বলতেন,

বাংলার অসম্প্রদায়িক সূর্য সন্তানকুল, সূর্যসন্তানেরাই মুক্তিযোদ্ধা বাংলাদেশের স্বাধীনতার সেনানী

চতুর্থ, এরশাদ, বেগম জিয়ার পান্ডাকুল হাড়ে মজ্জায় জানতেন রশীদ হায়দার ভাঙবে, মস্কাবে না। বঙ্গবন্ধুর আওয়ামী দর্শনে, সমাজতন্ত্রে একনিষ্ঠ, এই কারণে হেনেস্তা বহুবার, চাকরিতে, প্রমোশন হয়নি। সটান ছিলো শিড়দাড়া। কখনো বাঁকাননি। নত হননি। আদর্শে অবিচল। আরও অনেকের আরও বলি রশীদ হায়দার কতটা দৃঢ় চিত্তের শুনুন, আপনার অজানা জানেন শেখ হাসিনা। দ্বিতীয় টার্মে, তথা দ্বিতীয়বার ক্ষমতাসীন হওয়ার পর শেখ হাসিনা অনুরোধ করেন রশীদকে স্পিচ রাইটার হিসেবে যোগদানে। নিসন্দেহে লোভনীয়। পদমর্যাদায় যুগ্মসচিব (জয়েন সেক্রেটারি) রশীদদের সবিনয় প্রত্যাখান। প্রত্যাখানে রশীদের যুক্তিতে হাসিনা শ্রদ্ধাশীল। যুক্তি কি? মৌলিক লেখক। গবেষক। যোগ দিলে দুটো ব্যাঘাত গোল্লায় যাবে। স্পিচ রাইটারের কাজ, সকালে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে যাওয়া, তাঁর সমস্ত কথা শোনা, প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে নানা জায়গায়, নানা সভা সমিতিতে উপস্থিতি, ঘরে ফিরবেন কখন। পড়বেন কখন। লিখবেন কখন। গবেষণা করবেন কখন? চিন্তার স্বচ্ছতায় বাধা পড়বে। বাধা দিলে বাধবে লড়াই। যদি তোর ডাক শুনে কেউ না আসে তবে একলা চলো রে। ভদ্র মহিলা বললেন, “এত কিছু জানতাম না। রশীদ হায়দার নমস্য। এই মানুষটি কেবল শ্রদ্ধারই নয়, আদর্শের। তিনি আমার মর্ম মূলে প্রেমিক। তার নাম, তাঁকে চোখে দেখিনি। বাঁশিও শুনিনি। তাঁর ভদ্র মহিলার নাম রাশীদা জান্নাত।

 

(অক্ষর বিন্যাস: শঙ্খচূড় ইমাম)

দাউদ হায়দার। বিপ্লবী কবি। জন্ম বাংলাদেশের পাবনা জেলায়। ইসলামি মৌলবাদীদের হুমকী ও সরকারের মামলার কারণে তাঁকে ১৯৭৪ সালে দেশত্যাগ করানো হয়। বর্তমানে তিনি জার্মানিতে নির্বাসিত। প্রকাশিত বই: কাব্যগ্রন্থ: 'জন্মই আমার আজন্ম পাপ', প্রথম প্রকাশঃ নভেম্বর, ১৯৭৩, প্রকাশকঃ প্রগতি প্রকাশনী, ঢাকা। প্রচ্ছদ শিল্পীঃ...

এই বিভাগের অন্যান্য লেখাসমূহ

গণতন্ত্র, সংবাদপত্রের স্বাধীনতা ও বাংলার নবজাগরণের দু একটি কথা

গণতন্ত্র, সংবাদপত্রের স্বাধীনতা ও বাংলার নবজাগরণের দু একটি কথা

একটি পরাধীন দেশ আর তার বাসিন্দাদের মনে স্বাধীনতার আকুতি আমরা দেখেছিলাম ব্রিটিশ শাসনাধীন ভারতে। এর…..