রাং চিতা

জয়তী বন্দ্যোপাধ্যায়
গল্প
Bengali
রাং চিতা

সারাদিন আমি  খেলা করি, কখনও সত্যিকারের খেলা, কখনও মনে মনে। পোটলি আমার খেলার একমাত্র সঙ্গী। কখনও ধুলোবালি নিয়ে কখনও ঝোপের ধারে রাং চিতা নিয়ে। কখনও ধুতরোর ফুল নিয়ে। গোল গোল বলের মত ধুতরোর ফল, গায়ে কাঁটা।আর ধুতরোর ফুলগুলো মাইকের মত। দুর্গাপুজোয় লাইটপোস্টে বাঁধা হয় মাইকের চোঙা। ঘুম ভাঙতে ভাঙতেই গান শোনা যায়। সারাদিন ওই শব্দে বুঝি পুজো হচ্ছে। দাদু বিরক্ত হয়,চোঙাটার মুখটা একটু ঘুরিয়ে বাঁধতে পারে না?

সেজকাকু ক্লাবের প্রেসিডেন্ট। অপরাধটা কিছুটা তার। তাই গম্ভীরমুখে কিছু করতে বেরিয়ে যায় সেজকাকু।আমি মনে মনে বলি,হে দুগগা ঠাকুর, চোঙার মুখটা এমনই রেখো। সত্যি সত্যি জল না খেয়ে অঞ্জলি দেব তাহলে।

ঠাকুর কথা শোনে সকলের। দাদুর কথা শুনে চোঙার মুখ ঘুরে যায় সরকার মাঠের দিকে। আমার কথা শুনে মাইকের আওয়াজ আরও জোরে বাজে। আয়নার সামনে পুজোর নতুন জামা পরে আমি গানের সুরে নাচি।

আমাদের বাড়িতেও রেকর্ড প্লেয়ার আছে। একএকদিন মা সেটা বার করে। ধুতরো ফুলের মত একটা চোঙার সামনে একটা কুকুর। ও কি গান গাইছে না শুনছে বুঝতে পারি না।

বাড়ি থেকে বার হয়ে পায়ে পায়ে মুদির দোকান। হজমি,টিকটিকি লজেন্স,মৌড়ি লজেন্স,শোলে বিস্কুট সাজানো আছে কাচের বয়ামে। উল্টোদিকেই দুটো কুলগাছ। সরস্বতী পুজোর আগে কুল খেতে নেই কিন্তু মেজদারা খায়। ওই কুল খেয়েই একবার মেজদার বন্ধু দেবুদা ফেল করেছিল ক্লাসে। কিন্তু কেন জানি না মেজদা করে না। একদিন ঠাকুর পাপ দিলে বুঝবে।

আমাদের বাড়ির পাশেই কালু চাচার বাড়ি। ইট বার করা। ওদের বাড়িতে থাকে পোটলি,আমার বন্ধু। ও বলে ও আমার অনেক বড় দিদি। কিন্তু আমার দিদি আছে। পোটলি আমার দিদি নয় বন্ধু। আমার খেলনাবাটি নিয়ে চলে যাই ওদের বাড়ির সামনে মুরগীর ছোট্ট ঘরের ওপরে। ওখানে পোটলিই কর্তা। কিন্তু  আমাকে কি কি করতে হবে সব আগে বলে দেয়। জেনে নেয় আমি আজ কি খেলতে চাই । আমি শুধু পোটলির সঙ্গেই খেলতে চাই,ও যা বলবে তাই খেলব।

ভাঙা পাঁচিলের ওপারে এক কোণায় দাঁড়িয়ে নিঃশব্দে হাতছানি দিচ্ছে পোটলি। আজ কাঁচা আমের চড়ুইভাতি। রান্না ঘরের থেকে জামার কোচরে ভরে খানিকটা নুন আর পুরোনো ব্লেড নিয়ে বেরুনোর কথা। তক্কে তক্কে আছি। সদর দরজার সামনে রান্না ঘরের দাওয়ায় জলচৌকি পেতে বসে দাদু নারকেল পাতা থেকে কাঠি বার করেই চলেছে। জঞ্জাল পরিষ্কার হবে। পিছনে ঠাম্মার লক্ষ্মীটেরা দৃষ্টি যে কার দিকে বোঝা যায় না।

কালু মিয়ার ভাঙাচোরা বাড়ির দোতলার ঘরে সোবরাতি চাচা দলবল নিয়ে দিনে-দুপুরে গানের আসর বসিয়েছে। ‘আধো আধো বোল লা জ এ’- মোহম্মদ রফির স্টাইলে। তার মধ্যদিয়ে কার যেন ক্ষীণ কণ্ঠ ভেসে আসছে,– ‘পুটলি… ও… পুটলি’। সোবরাতি চাচার গান হলেই পুটলিকে ডাকবে সে। তার আগে তাকে গোসল করার নামে স্নান করিয়ে দেবে তার মা। পুটলির মায়ের ঘোমটার দুপাশে কান দুটো বেরিয়ে থাকে,আমার মায়ের ঘোমটায় দুকান ঢাকা থাকে। মা সবসময় বউ হয়ে থাকে না কিন্তু সুপুরির কাঠি দিয়ে বানানো বিছানা ঝাড়ার  জন্য ঝাঁটার কাঠি আনতে মা দাদুর সামনে এসে যখন দাঁড়ায় তখন বউ সেজে নেয়। আমারও বউ সাজতে ভালো লাগে।

উঠোনের বাম পাশে ড্রেনের ওধারে ছোট্ট পাঁচিল ঘেরা মুকুন্দ দাদুদের বড়ো উঠোন। আমাদের উঠোনের মাটি কালো। আশফল গাছের নীচে ওদের উঠোনঅনেক সাদাটে। মুকুন্দ দাদুর অফিস যাওয়ার ভাত ফুটছে বারান্দায়। মোক্তারির কালো কোট আর কেম্বিসের ব্যাগ তক্তপোষের ওপর রাখা। মীরা পিসির কথায়কান দিতে গিয়ে মাথায় জল ঢালা হচ্ছে না মুকুন্দ দাদুর। রান্নাঘরের থেকে লক্ষ্মী ঠামমা গজগজ করছে- ‘বুলবুলিকে আজো স্নান করানো হলো না’। বুলবুলিকে কয়েকদিন স্নান না করালে সে খেপে ওঠে। সকলকে মারধর করে। কিন্তু মুকুন্দ দাদুর সেদিকে খেয়াল নেই।

ওদিকে বুলবুলির সঙ্গে পাল্লা দিয়ে এই গরমে ম্যাডাম পাগলিও খেপে উঠেছে। পাঁচিলের পাশে ঘাড় গুঁজে শক্ত হয়ে দাঁড়িয়ে আছে সে। মুকুন্দ দাদুর মোকদ্দমানিয়ে নাকি ম্যাডাম পাগলির নালিশ -বড়’মা বলে। সকাল থেকে সন্ধ্যা তাই সে দাঁড়িয়ে থাকে। কিছু বলে না, কিছু করে না। কী যে বলতে এসেছিল মনে হয়তা এই রোদ্দুরের তাপে ভুলে গেছে। রান্না ঘরে বড়ো বড়ো দুটো উনুনে শান্তি মাসি রান্না চাপিয়েছে। পাশে গিয়ে জল চাইলে পিছনের দরোজা দিয়ে কল তলায়চলে যাবে। সেই ফাঁকে নুনের ভেতর থেকে কোচরে নুন ঢেলে নিতে হবে। কিন্তু দাদু না উঠলে ভাঙা ব্লেডের টুকরোটা নেওয়া যাবে না।

হাঁসের ঘরের পেছনে পাঁচিলের ভাঙা অংশে দাঁড়িয়ে পুটলি হাতছানি দিয়েই চলেছে। কেউ দেখে ফেললে ভেস্তে যাবে আমের চড়ুইভাতি। সরকার বাগানের বড়ো আমগাছটায় ওঠা সোজা। পাঁচিল বেয়ে খানিকটা গিয়ে একটা মোটা ডাল পাওয়া যায়। কিন্তু পুটলি আজ  আগে খবর এনেছে,কাজেই তার সঙ্গেই যেতে হবে। কুশি কুশি আমগুলোর খোসা ছাড়িয়ে নুন দিয়ে মাখবে পুটলি। কালু মিয়া জানে না। দাদু ঠামমা মীরা পিসিকে নিয়ে ব্যস্ত। মা’র স্কুল থেকে ফেরার সময় প্রায় হয়ে গেছে। ভাঙা ব্লেডটা হাতে নিয়ে অপেক্ষা শুধু উঠোনটুকু পেরুনোর। তারপরেই সরকার বাগান। চড়ুইভাতি। তেপান্তরের মাঠ…ব্যঙ্গমা ব্যঙ্গমীর পিঠে আমি আর পোটলি,পোটলি আর আমি – যেমন ঠাকুরমার ঝুলির গল্প শেষ হয় তেমন।

 

চলবে…

জয়তী বন্দ্যোপাধ্যায়। কবি। জন্ম ১৪ই ফেব্রুয়ারি। বেহালা, কলকাতা; ভারত। প্রকাশিত কাব্য গ্রন্থ: 'আগাছার চিঠি', 'বন্ধুর', 'প্রতি অংশ প্রকাশে উন্মুখ' গদ্যগ্রন্থ: সহজ রামায়ণ (জনান্তিক প্রকাশনী, বাংলাদেশ)

এই বিভাগের অন্যান্য লেখাসমূহ

বালির বেহালা

বালির বেহালা

বুড়িমাসি বলেন,জীবনটা বালির ঘর গো।ঢেউ এলে ধুয়ে যায় জীবনের মায়া।তবু বড় ভালবাসা ওদের দাম্পত্যে।রোদের চাদরের…..

তদন্ত

তদন্ত

  এক ড্রইং রুমে বসে রয়েছে সদ্য কিশোর উত্তীর্ণ তরুণ গোয়েন্দা সজীব। সামনের টেবিলে ছড়িয়ে…..