ফিরে এসো
আমার বাবা ছিলেন অত্যন্ত সাহসী একজন লড়াকু মনের মানুষ।শত অভাব অভিযোগেও তাকে কোনোদিন ভেঙ্গে…..
বেলা বেশি হয়নি। কিন্তু রোদ চড়ে গিয়েছে। ব্যানার্জিবাবুর বাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে এক মহিলা ওঁর নামে গাল পাড়ছে। অ্যাঁ, বিটলে বামুন কোথাকার, হাড় হাভাতে মিনসে, আমার ছেলের নামে যা নয় তাই লেখা! মজা পেয়েছ না? হতচ্ছাড়া ড্যাকরা, আজ তোরই একদিন কি আমারই একদিন!
রাখালের মা। সাত সকালে বাড়ি থেকে বেরিয়ে ব্যানার্জিবাবুর দোতলা বাড়ির সামনে চেঁচামেচি শুরু করেছে।
বাড়ির বাগান থেকে এগিয়ে এলেন ছেষট্টি সাতষট্টির এক লোক। বেশবাস অতি সাধারণ। তিনি এসে বললেন, কি হয়েছে গা? সাত সকালে রাগ হল কেন?
রাখালের মা বললে, তা তোমাকে বলব কেন বাপু?
বয়স্ক লোকটি বললেন, তা কাকে গালমন্দ করছ গা?
রাখালের মা বললে, কাকে আবার! ওই হতচ্ছাড়া মিনসেকে গাল দিচ্ছি।
বয়স্ক মানুষটি বললেন, তা দোষটা কি করেছে শুনি?
রাখালের মা তেরিয়া হয়ে বলল, তা তোমাকে কেন বলব শুনি! যাকে বলছি, সে ঠিক বুঝবে। বাড়ির নফর পেয়াদা কী বুঝবে?
লোকটি বললেন, তা রাগ করার হক আছে বাংলাদেশের লোকের। দোষ তার অনেক। কিন্তু আজ তুমি কি নিয়ে বলতে এলে?
রাখালের মা বললে, তবে শোনো, বেধবাদের বে’র কথা বলে তার পণ্ডিতি ফুরোয় নি। আমার কচি ছেলেটার নামে আকথা কুকথা লিখেছে গো! তাই গায়ের জ্বালায় গাল পাড়ছি।
প্রৌঢ় বললেন, অঃ, এই ব্যাপার? তা ভেতরে এসে বসো। আমি তাকে খপর দিইগে।
রোদের ঝাঁঝে গায়ে জ্বালা চাষি ঘরের বৌয়ের করতে নেই। রাখালের মায়ের করেও না। তবু এই লোকটির কথায় সে বাড়ির ভিতরে ঢুকল। লোকটি তাকে বলল, বসো এইখানে। সে আসবে।
আহা, লোকটির গলায় যেন কেমনধারা মায়া মাখানো। এমন ভাল করে কথা তো কোনোদিন পুরুষের মুখে শোনেনি রাখালের মা।
বয়স্ক লোকটি বাড়ির ভিতরে চলে গেলেন। অন্দর থেকে এক বয়স্ক মহিলা বেরিয়ে এসে কাঁসার রেকাবিতে দুটো মণ্ডা আর এক গেলাস জল নিয়ে হাজির।
রোদে তেতে পুড়ে এয়েছ, একটু জল মুখে দাও।
কালো পেড়ে শাড়ি পরনে। এ আবার কে?
রাখালের মা রাগ দেখিয়ে বলে, কখন থেকে চেঁচাচ্ছি, তা হাড়হাভাতে মিনসের দেখা নেই। বেরোবে কোন্ লজ্জায়? আজ হাটে হাঁড়ি ভাঙব। আমার ছেলের নামে আকথা কুকথা লেখা? রাখালের মা কাউকে রেয়াৎ করতে শেখেনি, তো সে তুমি যত বড় নামকরা লোক হও না?
বাড়ির মহিলা বললে, তা যা বলবে বলবে। কিন্তু দুটি জল খাও বাছা। এ বাড়িতে এসে কেউ শুকনো মুখে থাকবে, এ কোনোদিন হয় নি।
রাখালের মা মণ্ডার রেকাবিটি নেয়। এমন করে গুছিয়ে কেউ তাকে কোনো দিন খেতে দেয় নি। শীতল জল খেয়ে সে বুঝল, তেষ্টা তার পেয়েছিল। রাগ পড়ে আসতে চাইছে। তবুও নিজেকে চাঙ্গা রাখতে চাইছে রাখালের মা।
একজন প্রবীণ এসে বারান্দার চেয়ারে বসলেন। তাঁকে দেখে আড়ালে সরে গেল বাড়ির মহিলা।
প্রবীণ বললেন, বলো মা, তোমার জন্য কী করতে পারি?
রাখালের মা অবাক। এই লোকটিই না একটু আগে তার সঙ্গে কথা বলছিল, আর সে বলেছে বাড়ির নফর পেয়াদার সঙ্গে কথা বলব না। বই যে লিখেছে সেই বাবুকেই বলব। কি আশ্চর্য, এই কি সেই?
রাখালের মা একটু থতমত খেয়ে বলল তুমিই, ইয়ে আপনিই কি বিদ্দেসাগর?
প্রৌঢ় হেসে বললেন, পিতামহ রামজয় তর্কালঙ্কার আমার নাম রেখেছিলেন ঈশ্বরচন্দ্র। আমার পিতৃদেবের নাম ঠাকুরদাস বন্দ্যোপাধ্যায়। আমি নিজের নাম লিখি ঈশ্বরচন্দ্র শর্মণঃ।
রাখালের মা বললে, তা আপনি নিজের নাম যাই লেখো, আমার ছেলেটার নামে বইতে আকথা কুকথা লিখলে কেন? বাছা আমার ইশকুলে যেতে চায় না। পোড়োরা তাকে খেপায়। সে বলে, মা রে, ইশকুলে মাস্টার আমায় ভ্যাঙায়।
প্রৌঢ় বললেন, কী নাম তোমার ছেলের?
রাখালের মা বললে, আমাকে সবাই রাখালের মা বলে। গর্ভবতী হবার পর পর কর্তা চোখ বুজলেন। আমি বেওয়া মানুষ। ছেলেকে পড়িয়ে মানুষ করব। তা না, তুমি তার মন বিগড়ে দিয়েছ।
হো হো করে হেসে উঠলেন প্রৌঢ়। এই ব্যাপার? কোন্ ইশকুলে পড়ে তোমার ছেলে? আমি হেড মাস্টারকে লিখে দেব, তোমার ছেলের যেন কোনো অযত্ন না হয়।
রাখালের মা রাগ দেখিয়ে বললে, হ্যাঁ, তুমি বললে আর আমি চললাম। আমি বাপু ভদ্রলোকেদের মোটেও বিশ্বাস করি না।
প্রৌঢ় বললেন, আমিও করি না। বাঙালি ভদ্রলোকেদের তো একেবারেই নয়।
রাখালের মা বললে, ওসব ভুজুং ভাজুং দিয়ে আমায় ফেরত পাঠাতে পারবে না। আমার ছেলের নামে যা ভুলভাল লিখেছো, সঅব শোধরাতে হবে।
আনমনা হয়ে পড়েন প্রবীণ পণ্ডিত।
গাঢ় গম্ভীর গলায় বলেন, মা রে, আমি রাখালকেই ভালবাসি। গোপালদের আমি দুচক্ষে দেখতে পারি না। আমি চাই আমাদের বাংলাদেশের জেলায় জেলায় থানায় থানায় গোটা কতক রাখালের জন্ম হোক। গোপাল অনেক আছে। আমার রাখাল চাই। আমি রাখালের দলে মা।
রাখালের মা অবাক হয়। দ্যাখো পণ্ডিত, আমি মুখ্যু মেয়েমানুষ। আমি চাই আমার ছেলের পড়াশুনাটা হোক। তারপর একটা ছোটখাটো চাকরি বাকরি, কোর্টের পেশকার বলো, আর সাহেবি আপিসের কেরানি বলো, ওই আমার স্বপ্ন।
বিদ্যাসাগর বজ্রকণ্ঠে বললেন, খবরদার! রাখাল ওসব করবে না। সে লড়বে!
রাখালের মা রেগে উঠে বলে, হ্যাঁঃ লড়বে। ভেতো বাঙালির ঘরে সাহেব সুবোর সাথে লড়াইয়ের মিথ্যে স্বপন দেখিও না পণ্ডিত। বইয়ের কারবারে তোমার অনেক টাকা। তুমি কি বুঝবে গরিবের মর্ম!
আনমনা হয়ে যান পণ্ডিত। সহসা দেখতে পান ঠাকুরদাস কলকাতার কলের জল খেয়ে দুপুরের খিদে তাড়াচ্ছেন। রাসমণি মায়াভরা চোখে বলছেন, বাপা ঠাকুর, শুধু জল খেও নি। এই মুড়কি বাতাসা মুখে দিয়ে জল খাও। গরিব ঠাকুরদাস সেই মাতৃমূর্তির প্রতি সসম্ভ্রমে দাঁড়িয়ে।
বিদ্যাসাগর বললেন, আমি তো তোমার কথায় আমার লেখা বদলাবো না। রসময় দত্ত বলেছিল, বিদ্যাসাগর চাকরি ছাড়লে খাবে কি? আমি লোকের কাছে সে কথা শুনে বলেছিলাম, বরং ফুটপাতে বসে আলু পটল বেচব, তাও মাথা নোয়াবো না।
রাখালের মা বললে, আমার ছেলেকে আলু পটল বেচতে বলছ?
বিদ্যাসাগর হেসে বললেন, তা আলু পটল বেচা মন্দ কিসে? কলকাতায় কত বড় মানুষ ফেরিওলার কাজ করে বড়লোক হয়েছেন।
রাখালের মা বললে, তুমি এত বড় পণ্ডিত, তোমার মনে দয়া মায়া একটুসখানিও নেই।
এমন সময় এক দশাসই ব্যক্তি হাঁফাতে হাঁফাতে প্রবেশ করলেন। রাখালের মা ঘোমটার আড়ালে জড়োসড়ো হয়ে বসল।
বিদ্যাসাগর বললেন, কিহে শাস্ত্রী মশায় খবর সব ভাল তো?
হরপ্রসাদ শাস্ত্রী আভূমিপ্রণত হয়ে বললেন, নাঃ মন বড় চঞ্চল হয়েছে।
বিদ্যাসাগর হেসে বললেন, কেন?
হরপ্রসাদ বললেন, গতকাল গিয়েছিলাম এক সভায়। সেখানে তারা আমায় এক মানপত্র দিল। তাতে কী লিখেছে জানেন?
শাস্ত্রী, মানপত্রে তো লোকে খারাপ কথা লেখে না হে!
হরপ্রসাদ বললেন, জানেন, পাষণ্ডগুলি আমার নামের আগে লিখেছে বিদ্যাসাগর! আমি তাদের চোখের সামনে রেগেমেগে অন্ততঃ পঞ্চাশবার ওই কথাটা কেটে দিয়ে বলেছি, বিদ্যাসাগর একজনই হয়! বলে আবার তিনি বিদ্যাসাগরের পায়ে মাথা রাখতে গেলেন।
আহা করো কি, করো কি। বসো জল খাও। তারপর দ্যাখো, এই মহিলা কী বলতে এসেছেন। বলো তো মা, আমার বিরুদ্ধে যা অভিযোগ আছে, এঁকে বলো। খুব বড়মাপের লোক।
হরপ্রসাদ মহিলার দিকে তাকিয়ে বললেন, ওঁর বিরুদ্ধে অভিযোগ!
রাখালের মা বললে, বর্ণপরিচয় থেকে রাখালের নামে আকথা কুকথা বাদ দিতে হবে। তবে আমি বিদায় হব।
বিদ্যাসাগর বললেন, তবে শেষ কথা শুনে নাও মা। আমার দেশে আমি রাখালকেই চেয়েছি। যারা ভাল ছেলে হয়ে জলপানি পেয়ে মোটা মাইনের চাকরি খোঁজে আর বাড়ি গাড়ির স্বপ্ন দ্যাখে, তাদেরকে আমি মানুষ বলেই মনে করি না। আমাদের কবি লিখেছেন, যৌবরাজ্যে বসিয়ে দে মা লক্ষ্মীছাড়ার সিংহাসনে, ভাঙা কুলোয় করুক পাখা তোমার যত ভৃত্যগণে…আমাদের নিমাই চৈতন্য কাজীর বিরুদ্ধে মিছিল বের করেছে.. আমাদের সুভাষ গোষ্ঠীরাজনীতির অনেক উপরে উঠে দেশ ছেড়ে চলে যেতে দ্বিধা করে নি। আমার সোনার বাংলা বারে বারে রাখালকে বুকে পেতে চেয়েছেন। মা গো তোরা আরো রাখালের জন্ম দে, গোপাল দেখে দেখে আমার ঘেন্না ধরে গেছে।
আমার বাবা ছিলেন অত্যন্ত সাহসী একজন লড়াকু মনের মানুষ।শত অভাব অভিযোগেও তাকে কোনোদিন ভেঙ্গে…..
ভার্সিটির বাস ধরতে হয় আমাকে খুব সকালে। বাড়ি থেকে একটু হেঁটেই রিকসা। তারপর বাস। হাঁটা…..
আজকের সন্ধ্যাটা থমকে যাওয়া মেঘেদের। ঝিরিঝির বৃষ্টি ছিল দিনভর। ঢাকা শহরের পথঘাট জল কাদায় মাখামাখি।…..
জোছনা করেছে আড়ি আসে না আমার বাড়ি গলি দিয়ে চলে যায়, গলি দিয়ে চলে যায়…..