রাজনীতি ও দাবা খেলার গল্প

মাসকাওয়াথ আহসান
গল্প
Bengali
রাজনীতি ও দাবা খেলার গল্প

জেলখানার আমদানি ওয়ার্ডে একজন আসামিকে ধাক্কা দিতে দিতে নিয়ে আসে পুলিশ। সেখানে আগে থেকেই মেঝেতে গুটিশুটি মেরে বসে থাকা আরেক আসামি টিটকারি দেয়।

–কী ভাই সরকারি দলের লোক; আপনে শ্বশুর বাড়িতে কেন! এইখানে তো শুধু আমাদের বিরোধী দলের লোকদের আসার কথা।

নতুন আসা আসামির প্রচন্ড মেজাজ খারাপ হয়। সে টিটকারি মারা আসামির নাক বরাবর ঘুষি বসিয়ে দেয়। অন্য আসামিরা দুজনকে দুদিকে সরিয়ে নেয়।

শিল্পী: রিয়া দাস

একজন আসামি বলে, রাজনীতি হইতেছে বড় বড় মানুষের খেলা; আর এই খেলাডা হইতেছে ছোড মানুষগো নিয়া। অহন সরকারি দলের নেতাই কও-বিরোধী দলের নেতাই কও; ব্যস্ত তাদের ইলেকশান নিয়া। দাবা খেলা দেখছো কখনো!

উভয় দলের আসামি মাথা নাড়ে। সেই আসামি বলতে থাকে, দাবা খেলায় দেখবা তোমাগো মতন ছোড বইড়া খাওয়া যায় একে একে। আর খেলা শেষ হইয়া যায়; তাও রাজা-মন্ত্রীরা প্রায় অক্ষতই থাকে। এইডাই হইতাছে রাজনীতি; রাজা-মন্ত্রীগো মোউজ মারানীতি। সেইখানে তোমরা কেডা; ফইন্নির পুতরে মিছিলে লাগে-মারামারিতে লাগে; কিন্তু তারে অরা -লডা দিয়াও পুছে না। তোমরা ফইন্নির পুতেরা এইডা না বুইঝা বড় বড় নেতাগো লাইগা জীবন বাজি রাখো; দুই দলের মারামারিতে মারা পড়ে ফইন্নির পুতেরাই। কিন্তু অগো নিজের পোলা মাইয়া কিন্তুক বিদেশে পড়ে; দেশে জমিদারি সামলাইতে কালে-ভদ্রে আসে কেউ কেউ। কিন্তু কোনদিন অগো গায়ে পাখির পালকের টোকাডাও লাগে না। তোমরা ফইন্নির পুত বাপ-মায়েরে কাঁদাইয়া জেলে আসছো; অহন দলাদলিডা ছাড়ো।

বিরোধী দলের আসামির ডাক আসে; তার মা এসেছে দেখা করতে। সে দৌড়ে চলে যায়। মা পাথরের মতো শক্ত হয়ে বসে আছে; তার চোখের নীচের অশ্রু শুকিয়ে মুখের চামড়ায় লেপ্টে আছে। ছেলের মুক্তির জন্য মানত করে রোজা রেখে রেখে মা হাড় জিরে জিরে এক কংকাল হয়ে গেছে যেন।

ছেলেটা গরাদের ওপার থেকে মায়ের হাত স্পর্শ করে; ডুকরে কেঁদে ওঠে। মা আর সামলাতে পারে না। সে-ও হাউমাউ করে কাঁদে। পুলিশ এসে বলে, সময় শেষ; কথা শেষ করেন খালা। ছেলেটির মা পুটলিতে করে চিতই পিঠা বানিয়ে এনেছে; ছেলেটা খুব শখ করে খেতো সবসময়।

পুলিশ তার চোখের অশ্রু লুকিয়ে বলে, আর একটু সময় থাকেন খালা; কিন্তু কান্দাকাটি কইরেন না।

ছেলেটির মা জিজ্ঞেস করে, বাবা আমার পোলারে কবে ছাড়বা তোমরা!

পুলিশ বলে, আমরা হইতাছি স্মল ফিশ খালা; মানে ইঁচা মাছ। ছাড়ার ক্ষমতা তো বিগ ফিশ স্যারদের; মানে যারা মাগুর মাছ। তয়; পলিটিক্যাল কেস মানে নিশ্চয়ই বিস্ফোরক মামলা টামলা হইছে; কোর্ট কী করে কে জানে!

পরদিন একই দড়িতে কোরবানির পশুর মতো বেঁধে সরকারি দল-বিরোধি দলের দুইজনসহ আসামিদের আদালতে হাজিরা দিতে নিয়ে যাওয়া হয়।

অনাহারী আসামিদের আদালতের খাঁচায় তালা দিয়ে রাখা হয়। ওদিকে বিচারক ব্যস্ত। ঠিক কী নিয়ে ব্যস্ত বলা কঠিন; বিরাট ব্যাপার-স্যাপার তো; ভাবভঙ্গি দেখে মনে হয়; এরা একেকজন হোয়াইট হাউজ চালাচ্ছে। বিচারক আজ ব্যস্ত সাংবাদিকের কাছে তার সাকসেস স্টোরির ইন্টারভিউ দিতে। কীভাবে সামান্য বাদামওয়ালার ছেলে থেকে দারিদ্র্য জয় করে উনি বিচারক হয়েছেন; সে কথা বলতে গিয়ে বিচারকের চোখ ছল ছল করে। অবশ্য বাদামওয়ালা বাবার জন্য তেমন কিছুই উনি করতে পারেননি। অবসরপ্রাপ্ত এক বিচারকের মেয়েকে বিয়ে করায় স্ত্রী পঁই পঁই করে বলে দিয়েছে, আমাদের বাংলোয় কোন বাদামওয়ালাকে দেখতে চাইনা। কাহিনীর এ অংশটি অবশ্য সাংবাদিককে বলা মানা। কীভাবে প্রেসের লোক হ্যান্ডল করতে হয়; স্ত্রী তা পঁই পঁই করে বুঝিয়ে দিয়েছে।

এই ইন্টারভিউ দিতে গিয়ে বিচারকের অনেক দেরী হয়ে যায় এজলাশে আসতে। সবাই উঠে দাঁড়ালে; বিচারকের বুকটা গর্বে ফুলে ওঠে। ওদিকে ক্রীতদাসের মতো এক দড়িতে বাঁধা অসংখ্য আসামিকে টেনে হিঁচড়ে আদালত কক্ষে নিয়ে আসা হয়েছে। সবার চোখে প্রত্যাশা; আজ যদি জামিন হয়!

অধিকাংশেরই জামিন হয়না। সরকারি দল ও বিরোধি দলের আইনজীবীরা বিগশট নেতা-নেত্রীদের মামলার শুনানিতে ব্যস্ত থাকায়; সরকারি দল ও বিরোধী দলের ছেলে দুটি ভগ্নমনোরথ হয়ে আবার প্রিজন ভ্যানে ওঠে। ভ্যানের ওপরের খুপরিতে চোখ রেখে মুক্ত আকাশ; গাছ; বাতাস-দালান কোঠা দেখতে থাকে। সরকারি দলের ছেলেটা বলে, একটা সিএনজি চালাইলেও আজ জীবনডা এইরম হইতো না। বিরোধী দলের ছেলেটা বলে, রাজমিস্ত্রীর জোগালদারের কাজ করলেও আজ মায়ের বুক খালি কইরা জেলে থাকতে হইতো না।

মাইকে শোনা যায় জনসভার বক্তৃতার শব্দ। সরকারি দলের মিটিং-এ সেই বড় বড় নেতাদের হত্যাকান্ডের বিচার হইলেও এখনো সম্পন্ন হয়নি; এবার ষড়যন্ত্রকারীদের বিচার চাই; বলে কান্দন চলছে।

একটু পর বিরোধী দলের একটা মিছিলের শব্দ শোনা যায়। তারা জেলের তালা ভেঙ্গে শীর্ষ নেতা-নেত্রীদের মুক্ত করার অঙ্গীকার করে মিছিল করছে।

প্রিজন ভ্যানে বসা সরকারি দল ও বিরোধী দলের দুই ছোট কর্মী মুখ চাওয়া-চাওয়ি করে।

ঐ যে জেলখানার আমদানি ওয়ার্ডে যে লোকটি রাজনীতি ও দাবা খেলার গল্প বলেছিলো; সে সরকারি দল ও বিরোধি দলের দুই ছোট কর্মীকে সান্ত্বনা দেয়, আল্লাহ আল্লাহ করো। ফইন্নির পুতেগো; যাগো কেউ নাই; তা গো আল্লাহ আছে।

মাসকাওয়াথ আহসান। লেখক, শিক্ষক ও সাংবাদিক। 'শিল্পের জন্য শিল্প নয়, সমাজ-রাজনৈতিক উত্তরণের জন্য শিল্প' এই ভাবনাটিই মাসকাওয়াথ আহসানের লেখালেখির প্রণোদনা। নাগরিক বিচ্ছিন্নতার বিচূর্ণীভাবনার গদ্য ‘বিষণ্ণতার শহর’-এর মাঝ দিয়েই লেখকের প্রকাশনার অভিষেক ঘটে। একটি পাঠক সমাজ তৈরি হয় যারা নাগরিক জীবনের...

এই বিভাগের অন্যান্য লেখাসমূহ

বালির বেহালা

বালির বেহালা

বুড়িমাসি বলেন,জীবনটা বালির ঘর গো।ঢেউ এলে ধুয়ে যায় জীবনের মায়া।তবু বড় ভালবাসা ওদের দাম্পত্যে।রোদের চাদরের…..

তদন্ত

তদন্ত

  এক ড্রইং রুমে বসে রয়েছে সদ্য কিশোর উত্তীর্ণ তরুণ গোয়েন্দা সজীব। সামনের টেবিলে ছড়িয়ে…..