প্রক্সি
তারপর ইলেকট্রিক বিল জমা দিতে যাবো। আমার দেরি হবে আসতে। স্বামী অমর বলে, ঠিক আছে।…..
– তোমার এত সাহস হল কী করে? তোমার জন্য আমরা কেন সবার সামনে অপমানিত হব?
– সাব্বির! মুখ সামলে কথা বল।
– না বললে কী করবে? কী করবে তুমি? চোরের মায়ের বড় গলা, না? তুমি একটা হারামি! চোর! লুচ্চা! দাঁড়াও, আজ তোমাকে আমি মেরেই ফেলব। তোমার মত বাপ থাকার চেয়ে না থাকা ভাল।
সাব্বির বাবার গলা টিপে ধরে আছে। রাগে সে উন্মত্ত। এত প্রিয় যে বাবা, আজ সেই বাবাকেই সে সবচেয়ে বেশি ঘৃণা করে।
পলা কষ্টে, অপমানে কথা বলতে পারছে না। সেও ভীষণ রেগে আছে। এখন তার কী করা উচিত, সে বুঝতে পারছে না। এইমাত্র সে জানতে পেরেছে যে, তার এমপি স্বামী গোপনে আরেকটা বিয়ে করেছে। তাও বছর খানেক আগে।
– কী করছিস্? ছাড়। ছেড়ে দে।
– না ছাড়ব না। এই কুত্তাকে খুন করে আমি জেলে যাব মা।
এ সময় সুমি দরজায় এসে দাঁড়ালো। তার চোখেও আগুন।
– মা, এখনও তুমি এই লোকটাকে বাড়ি থেকে বের করে দাওনি? এক্ষুনি ওকে চলে যেতে বল। নাহলে আমি কিন্তু সুইসাইড করব।
পলা জানে, যত কষ্টই হোক, এখন মাথা গরম করলে চলবে না। তাকে কৌশলী হতে হবে। তার স্বামীর চরিত্র যে খারাপ, সেটা সে অনেক আগে থেকেই জানতো। কিন্তু সে যে আরেকটা বিয়ে করে ফেলবে, এটা সে ভাবেনি।
– শোন, আমি তোমাকে ক্ষমা করে দিতে পারি। আমার কিছু কথা শুনতে হবে।
– কী কথা?
– গুলশানের বাড়ি আর ধানমন্ডির তিনটা ফ্ল্যাট আমার নামে লিখে দিতে হবে।
– কী বলছ তুমি? তোমাদের নামে আমি অলরেডি অনেক প্রপার্টি দিয়েছি। ক্যাশ দিয়েছি। এফডিআর…।
– ওসব বাদ। আরও তিন হাজার কোটি টাকা আমাকে দিতে হবে। আর তিনটা গাড়ী।
– না দিলে কী করবে?
– নারী নির্যাতনের মামলা করব। তারপর সংবাদ সম্মেলন করে তোমার সব গুণের কথা বলে দেব।
দুই
এমপি সোহরাব হোসেনের সাথে সাব্বির, সুমি কেউই আর কথা বলেনা। এ বাড়িতে তার আসা নিষেধ। তবে পলা স্বামীর সাথে কথা বলে। পলার ইচ্ছা, সাব্বিরকে সে একসময় বাপের আসন থেকে নির্বাচন করাবে। বুঝিয়ে সুঝিয়ে পলা সাব্বিরকে ইংল্যান্ডে ফেরত পাঠিয়েছে। এখনও সে বার এ্যাট ল’ পাস করেনি। তবে সুমি অনার্স পাস করেছে। পলা এখন ওর বিয়ের কথা ভাবছে।
পলা সেদিন বাপের বাড়িতেই ছিল। হঠাৎ খবর পেল, ওর এলাকার আশরাফ মাস্টার খুন হয়েছেন। খুব জনপ্রিয় নেতা ছিলেন। সাদাসিধা নির্লোভ মানুষ। পেশায় ছিলেন স্কুলশিক্ষক। পলা একগাদা বাজার করে নিয়ে আফজাল মাস্টারের বাড়িতে নামলো। সাথে সালেহা। তার পুরনো এবং বিশ্বস্ত কাজের মেয়ে।
পুরা বাড়ি লোকে লোকারণ্য। নেতা-কর্মী, এলাকার মানুষে ভর্তি। পলা আশরাফ মাস্টারের বৌ-বাচ্চাদেরকে সান্ত্বনা দেয়ার পর রান্নাঘরে ঢুকলো। তার করে আনা বাজার বের করে রান্না করতে লাগলো। নিজেই। সালেহা সব রেডি করে দিচ্ছে। ঢাকা থেকে পার্টি মহাসচিব রওনা দিয়েছেন। দুপুরে তাদের খাওয়ার ব্যবস্থা করতে হবে।
পলার তৎপরতায় সবাই মুগ্ধ। খাওয়ার পর মহাসচিব পলার মাথায় হাত রাখলেন।
– দোয়া করি, আপনার মত মেয়ে বাংলার ঘরে ঘরে জন্ম নিক। এই পরিবারটাকে আপনি দেখবেন ভাবী। আর আমরা তো আছিই। কোন দরকার মনে করলে ফোন করবেন। কেমন?
সবাই চলে যাবার পর পলা মীনা ভাবীর কাছে এলো বিদায় নিতে।
– ভাবী, ধৈর্য্য ধরেন। ছেলেমেয়েগুলাকে দেখতে হবে। আমি আবার আসবো। আপনাকে নিয়ে প্রধানমন্ত্রীর সাথে দেখা করতে যাব। আফজাল ভায়ের জায়গা এখন আপনাকেই নিতে হবে।
আফজাল ভায়ের আসনে পার্টি মীনা ভাবীকেই নমিনেশন দিবে, সেটা পলা জানে। কারণ গত ইলেকশনে আফজাল মাস্টার মাত্র তিন হাজার ভোটে হেরেছে। ওনার চেয়ে ভাল ক্যান্ডিডেট এলাকায় আর কেউ নেই। যদিও মীনা ভাবী কথা বলতে পারেনা। মাইকের সামনে তার হাতপা কাঁপে। তাছাড়া বয়সও হয়েছে। অবশ্য তাতে তেমন কোন সমস্যা হবেনা। লোকে ভোট দেবে আফজাল মাস্টারকে। খুন হওয়ার কারণে তার পরিবারের প্রতি জনগণের দয়া কাজ করবে। ফলে সামনে নির্বাচনে মীনা ভাবীর জেতার সম্ভাবনা প্রায় শতভাগ। কিন্তু পলা চায়, সীটটা নিজে নিতে।
তিন
পলার বাপের বাড়িতে মোটেই চারটা ঘর। পলা স্থির করলো, আগে বাড়িটা ঠিক করবে। এলাকায় রাজনীতি করতে হলে বাড়ি দরকার। এতদিন স্বামীর সাথে কাজ করে করে সে রাজনীতির অনেককিছু বুঝে গেছে।
পলা বড়ভায়ের সাথে কথা বলে বাপের বাড়ির একপাশে পুকুরপাড়ের পুরো জায়গাটা জুড়ে বড় করে বাড়ি করার সিদ্ধান্ত নিল। বাড়িতে এসি লাগাবে, গ্যারেজ করবে। পার্টির নেতারা ঢাকা থেকে এলে যেন তার বাড়িতে রাখতে পারে। বাড়ির সাথে লাগোয়া কিছু খাস জমি আছে, যেগুলো সে নিজের নামে দলিল করে রেখেছে। পলার ইচ্ছা, পরে নিজের নামে ওখানে বড় একটা মার্কেট করবে।
সে মালেককে ডেকে পাঠালো। মালেক হলো পলার এলাকার সবচেয়ে বড় কন্ট্রাক্টার। পাশাপাশি রাজনীতি করে। আফজাল মাস্টারের ডান হাত। ছোট-বড় সব নেতা তার কথা শোনে।
– যত তাড়াতাড়ি পার, আমার বাড়ি করে দাও।
বাড়ি করতে গিয়ে মালেকের সাথে পলার সম্পর্ক আরও ঘনিষ্ঠ হলো। এলাকার কোন রাজনৈতিক প্রোগ্রামই পলা মিস করেনা। বাড়িটা পলা খুব সুন্দর করে সাজালো। বসার ঘরটা বিশাল বড় করেছে, যেন একসাথে অনেক লোক বসতে পারে।
এখন সে বেশিরভাগ সময়ই বাড়িতে থাকে। এলাকার লোকজনদের সাথে নিয়মিত দেখা করে। এলাকায় কার মেয়ের বিয়ে হচ্ছে না, কে বুড়ো বাপ-মাকে ভাত দেয়না, কার বাচ্চা প্রতিবন্ধী, কার রোগের চিকিৎসা হচ্ছে না – এসব খোঁজ নিয়ে সে সাহায্য করে।
পলা ওর বাড়ির পাশের মসজিদটা দোতলা করে দিল। টাইলস, এসি সব লাগিয়ে দিয়েছে। এলাকার লোকজন খুব খুশি। বড় করে সে বাবামার মৃত্যুবার্ষিকী পালন করল। এলাকার সব গরীব মানুষকে ডেকে খাইয়েছে। এতদিন জাকাতের কাপড়, সরকারী ত্রাণ, শীতের কাপড় – এসব সে সোহরাবের এলাকায় দিত। স্বামীকে ভোটে জেতানোর জন্য সে অনেককিছু করেছে। নাওয়া-খাওয়া ভুলে রাতদিন ভোটারদের বাড়ি বাড়ি ঘুরেছে। এবার সে নিজের জন্য করতে চায়।
ডবলু এমপির মেয়ের বিয়ের খবর পেয়ে পলা তাকে ফোন করলো। এই ডবলু উকিলের কাছেই আশরাফ মাস্টার গত নির্বাচনে হেরেছে।
– ভাই, মেয়ের বিয়ে দিচ্ছেন শুনলাম।
– জ্বি আপা। ভাইকে কার্ড পাঠিয়েছি। আসবেন।
– অবশ্যই যাব। খেয়েদেয়ে মেয়েকে দোয়া করে আসব।
– জ্বি আপা। অবশ্যই। খুব খুশি হব। সোহরাব ভাই কেমন আছেন?
বিয়ের দিন বিশাল এক ফ্রিজ নিয়ে পলা হাজির। এলাকার মানুষ যেন দেখতে পায়, বিরোধী দলের লোকের জন্যও সে খুব আন্তরিক।
চার
ইলেকশন ঘনিয়ে আসছে। পলা দশটা সুন্দর জামদানি শাড়ীর অর্ডার দিল। সুন্দর ডিজাইন দেখে হীরার আংটি কিনলো দুইটা। কয়েকটা বড় জারে করে আমের চার রকমের আচার নিয়ে পলা এলো প্রধানমন্ত্রীর সাথে দেখা করতে।
প্রধানমন্ত্রীর পছন্দ সে খুব ভালো জানে। আরও জানে, রাজনীতিতে যোগ্যতার চেয়ে টাকা বেশি কাজ করে। নমিনেশন পেতে কত টাকা দিতে হবে, সেটাও সে জানে। টাকাভর্তি ট্রলিব্যাগটা সে নিজেই ঠেলে নিয়ে এলো।
রাত তখন সাড়ে বারোটা। তখনও কিছু লোকজন আছে। মহাসচিবও আছে। পলা একা কথা বলতে চাচ্ছিল। মনে হচ্ছে সেটা সম্ভব হবেনা।
– বল পলা, কেমন আছ?
– ভাল আছি ম্যডাম। আপনার শরীর কেমন?
– আছি। ভালোই আছি। তোমাদের দোয়া। সোহরাব কেমন আছে?
– আছে। ভালোই। ম্যাডাম, আমি আপনার জন্য কিছু জিনিস এনেছিলাম।
– কী এনেছ?
– তেমন কিছু না ম্যাডাম। সামান্য জিনিস।
বলে পলা শাড়ীগুলো বের করলো। প্রথমে পেস্ট কালারের জামদানিটা খুলে ম্যাডামকে দেখালো।
– আপনাকে খুব মানাবে ম্যাডাম। দশটা এনেছি। স্পেশাল অর্ডার দিয়ে করিয়েছি। আপনার জন্য।
– কী করেছ তুমি পলা? এত শাড়ী?
– দুটো আংটিও এনেছি ম্যাডাম। আমি জানি ডাইমন্ড আপনার খুব প্রিয়। মাপ ছাড়া অনুমান করে কিনেছি। ফিট না হলে পাল্টানো যাবে।
আংটি দুটো দেখে প্রধানমন্ত্রী খুব খুশি হলেন।
– তোমার চয়েস খুব ভাল পলা। কিন্তু এসবের কী দরকার ছিল?
– ম্যাডাম, আমার খুব ইচ্ছে, একদিন আমি নিজে হাতে আপনাকে একটু রান্না করে খাওয়াব। একদিন যদি সুযোগ দিতেন।
– হবে হবে। আমি এখনও ম্যালাদিন বাঁচবো। সহজে মরছি না। চিন্তা করোনা। কী বলবে বল।
– ম্যাডাম, বলছিলাম, আফজাল ভায়ের সীটটা যদি আমাকে দিতেন।
– কিন্তু ওখানে মীনা ছাড়া আর কেউ জিততে পারবে কি?
– মীনা ভাবীকে অবশ্যই কিছু দিতে হবে। পার্টির জন্য আফজাল ভায়ের অনেক অবদান।
– আমিও তাই ভেবেছি। তাহলে তোমাকে দেব কীভাবে?
– মীনা ভাবীকে সংরক্ষিততে দিলে ভাল। পাবলিক হ্যান্ডেল করা ওনার পক্ষে একটু কঠিণ। এখানে দুই আছে। পার্টি ফাণ্ডের জন্য এনেছি।
বলে পলা ট্রলিব্যাগের দিকে ইশারা করলো। প্রধানমন্ত্রী একটু ভাবলেন। পলা প্রধানমন্ত্রীর জবাবের জন্য অপেক্ষা করছে।
– আপনার জন্য একটু আমের আচার এনেছিলাম ম্যাডাম। আমার নিজের হাতে বানানো। খেলে আমি খুব খুশি হব।
প্রধানমন্ত্রী মহাসচিবকে ডাকলেন।
– আবেদ, এদিকে আসো। তুমি আফজাল ভায়ের এলাকার লোকজনের সাথে কথা বল। ওরা এবার পলার হয়ে কাজ করবে।
তারপর পলার দিকে তাকিয়ে মৃদু হাসলেন।
– এলাকায় থাকতে হবে কিন্তু। দিনরাত কাজ কর। এবার যেন সীটটা আমরা পাই। সোহরাবের চেয়ে বেশি ভোটে জিততে পারবে তো?
– দোয়া করবেন ম্যাডাম। আপনার দোয়া থাকলে নিশ্চয়ই পারব।
পলা প্রধানমন্ত্রীর পা ছুঁয়ে সালাম করে উঠে দাঁড়ালো।
পলা টিভির সামনে বসে আছে। সে নির্বাচনের ফলাফল দেখছিল। লোকজনে তার বাড়ি ভরে গেছে। একটু আগে মহাসচিব তাকে ফোন করে অভিনন্দন জানিয়েছেন। নিজের বিজয়ে আজ পলা যতটা খুশি হলো, তারচেয়ে অনেক অনেক বেশি খুশি হলো স্বামীর পরাজয়ে।
সাব্বির আর সুমি মাকে জড়িয়ে ধরে হাসছে। কিন্তু ওদের তিনজনেরই চোখে পানি। এই পানির খবর সোহরাব সাহেবরা কোনদিন রাখে না।
( রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস, এপ্রিল; ২০২০।)
তারপর ইলেকট্রিক বিল জমা দিতে যাবো। আমার দেরি হবে আসতে। স্বামী অমর বলে, ঠিক আছে।…..
নভেম্বর চলছে। অনির সাথে আজ দেখা হবে তা জানাই ছিল। এই তো ক’দিন আগেই দেখা…..
বুড়িমাসি বলেন,জীবনটা বালির ঘর গো।ঢেউ এলে ধুয়ে যায় জীবনের মায়া।তবু বড় ভালবাসা ওদের দাম্পত্যে।রোদের চাদরের…..
এক ড্রইং রুমে বসে রয়েছে সদ্য কিশোর উত্তীর্ণ তরুণ গোয়েন্দা সজীব। সামনের টেবিলে ছড়িয়ে…..