রাজরাপ্পা

ব্রতীন দাস
ভ্রমণ
Bengali
রাজরাপ্পা

অনেক দিন থেকেই বন্ধুবর সন্দীপ বলছে, “ব্রতীন ধানবাদটা ঘুরে যা।’’ অবশেষে এক গ্রীষ্মের দিনে প্ল্যান করলাম।

সকালে উঠতে একটু দেরী হয়ে গিয়েছিল। যুদ্ধকালীন তৎপরতায় হাওড়া স্টেশনে পৌঁছে দেখি তখনও ইন্টারসিটি হাওড়া-ধানবাদ এক্সপ্রেস দিব্যি দাঁড়িয়ে আছে। চটপট নিজের কামরায় উঠে পড়া গেল। পুরো ট্রেনটাই বাতানুকূল। আর খাওয়া দাওয়ার ব্যবস্থাও বেশ ভালো। ক্ষণেক্ষণে চা, কফি, স্যান্ডুইচ, অমলেট এই সব আসতেই থাকছে। আর ইয়ে বলতে নেই খাবার দেখলেই টেনিদার ভাষার আমি একটু “মেফিস্টোফিলিস” “মেফিস্টোফিলিস” হয়ে যাই। ট্রেন মোটামুটি ঠিক সময়েই গন্তব্যে পৌঁছলো। বন্ধুবর সন্দীপ প্ল্যাটফর্মে অপেক্ষা করছিল। ওর গাড়ি করে সোজা আই এস এম এর ক্যাম্পাস। সন্দীপ আই এস এম এ অধ্যাপনার সাথে যুক্ত| ধোকলা আর আমপোড়ার শরবত দিয়ে ওয়েলকাম জানাল সৌমিতা। বেশ খানিকক্ষণ গল্পগুজব হল। আই এস আই ছাড়ার পরে সন্দীপের সাথে এই দেখা। নয় নয় করে মাঝে পার হয়ে গেছে প্রায় পনেরোটা বছর । সৌমিতা তাড়া লাগালো স্নানে যাবার জন্যে। দুপুরে রাজকীয় ভোজ। ভাত,ডাল ,শুক্তো,আলুভাজা,পার্শে মাছ, মাটন, চাটনি, দই। পথশ্রমে এবং প্রচুর আহারে যারপরনাই ক্লান্ত বোধ করছিলাম। তাই একটু গড়িয়ে নিলাম। ঘুম ভাঙলো সন্দীপের ডাকে। চা হয়ে গেছে। চা খেয়ে আমরা বেরিয়ে পড়লাম মাইথনের উদ্দেশ্যে।

ধানবাদ থেকে মাইথন ৪৮ কিমি। ঘন্টাখানেকের মধ্যেই পৌঁছানো গেল সেই গন্তব্যে। ৬০০০০ কিলোওয়াট ইলেক্ট্রিক পাওয়ার উৎপাদনক্ষম এই বাঁধ। প্রধাণত বন্যানিয়ন্ত্রণের জন্য বরাকর নদীর ওপর নির্মিত এই বাঁধটি ১৫,৭১২ ফু (৪,৭৮৯ মি) দীর্ঘ ও ১৬৫ ফু (৫০ মি). উচ্চ। এখানে একটি ভূগর্ভস্থ পাওয়ার স্টেশন রয়েছে, যা সমগ্র দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় প্রথম ভূগর্ভস্থ পাওয়ার স্টেশন। এইসব শুকনো তথ্য বাদ দিয়ে আমার বরং মনে হচ্ছিল‚ “যদিও সন্ধ্যা নামিছে মন্দ মন্থরে…”। শেষ বিকেলের ম্লান আলোয় বড় মায়াবী সেই বিশাল জলাশয়। ছোট ছোট কিছু দ্বীপ চোখে এল এখানে ওখানে। দিনের বেলায় সেখানে প্রমোদ ভ্রমনের ব্যবস্থা আছে।মন প্রাণ স্নিগ্ধ করা এই পরিবেশে কিছু ফটো তোলা হল। এবারে ফেরার পালা। ফেরার পথে আমি ধরলাম আমার প্রিয় গান ” তাই তোমার আনন্দ আমার পর”। সৌমিতা শোনাল ” আমি তোমায় যত শুনিয়েছিলাম গান”।

ফেরার পথে সন্দীপ নিয়ে গেল ওর কলেজ দেখাতে। ইন্ডিয়ান স্কুল অফ মাইনস (সংক্ষেপে ISM) স্থাপিত হয় ১৯২৬ এ। বর্তমানে মোট ১৮টি বিভাগ। পড়াশুনা করে ৫০০০-এর বেশি ছাত্র ছাত্রী। ছেলেদের হোস্টেল গুলোর নাম বিভিন্ন রত্নের নামে যেমন ডায়মন্ড, সাফায়ার, টোপাজ ইত্যাদি। আর মেয়েদের হোস্টেলের নাম রুবি। ফিরে এসে ভারত পাকিস্তানের ম্যাচ দেখতে দেখতে আড্ডা চলল। সেই আড্ডা প্রলম্বিত হল ডিনারের পরেও। শেষে রাত প্রায় ১ঃ১৫ তে আমরা ক্ষান্ত দিলাম।

পরের দিন ঘুম ভাঙল সন্দীপের ডাকে। আজকের গন্তব্য রাজরাপ্পা| গাড়ি এসে গেছে। খুব তাড়াতাড়ি করেও নির্দিষ্ট সময়ে বেরোনো গেল না। অদ্ভুত রুক্ষ ঝাড়্খন্ডের নৈসর্গিক পরিবেশ মন টানছে। ব্যাগের মধ্যে পছন্দের গল্পের বই। গান। ইন্টারনেট। কিন্তু সব ছাড়িয়ে চোখ চলে যাচ্ছে বাইরের দিকে, ছোট ছোট গ্রাম। শান্তি মাখানো। বাড়ির কর্তা, গিন্নী এবং অন্যান্যরা মিলে চাষ করছেন। অসহনীয় সেই গরমে সম্বল মাথায় এক ফালি ছোট্ট কাপড়। কারো কারো বা মাথায় টুপি। প্রায় ঝলসে যাওয়া গাছের ছায়ায় ধুঁকছে মৃতপ্রায় এক কুকুর। ঘাস খাওয়ার জন্যে বেঁধে রাখা দু একটা গরু দড়িটাকে একবারে শেষ প্রান্ত অবধি টেনে নিয়ে সেই ঝলসনো রোদের তাপ থেকে বাঁচতে চাইছে।

রাস্তা বেশ ভালো। আড়াই ঘন্টার মধ্যেই পৌঁছে গেলাম রাজরাপ্পায়। ফেলুদার গল্প” ছিন্নমস্তার অভিশাপ” গল্পেই প্রথম শুনি রাজরাপ্পার নাম। রাজরাপ্পা এক হিন্দু তীর্থস্থান। দশমহাবিদ্যার অন্যতমা ছিন্নমস্তা রূপে দেবী এখানে পূজিতা। ভারতের অন্যতম ছিন্নমস্তার মন্দির। অন্যান্য ভক্তদের সাথে সাথে সাঁওতাল এবং অন্যান্য আদিবাসী সম্প্রদায় এখানে পুজো দিতে আসে। বৃহস্পতি ও শনিবারে এখানে ছাগ বলি দেওয়া হয়।

আর অসংখ্য বলি দেওয়া হয় কালী পুজোর দিন। রক্তে সেদিন লাল হয়ে ওঠে ভৈরা নদীর জল । গড়ে দিনে ২৫০০ – ৩০০০ জন ভক্তসমাগম হয় এখানে। বলাবাহুল্য আমি সেই অর্থে ভক্ত নই| কিন্তু ঘুরতে ভালোবাসি| ভালো লাগে এইসব মন্দিরের প্রাচীন গাথা‚ মন্দিরের গঠনশৈলী‚ বুঝতে চেষ্টা করি সেই সময়ের আর্থসামাজিক অবস্থান| মন্দিরের গঠনশৈলীতে তান্ত্রিক আর্কিটেক্চারের ছাপ পরিস্ফুট। তেমন ভিড় নেই। ড্রাইভার ছেলেটি এল আমাদের সাথে। একটা দোকানে গিয়ে জিনিসপত্র রেখে ভৈরবী বা ভৈরা নদীর ঠান্ডা জলে চোখ মুখ হাত পা ধুয়ে পুজোর প্রস্তুতি নেওয়া গেল।এখানে প্রধান প্রসাদ হল পেঁড়া। মন্দিরে মূল বিগ্রহ নেই। চুরি হয়ে গেছে। দায়িত্ব নিয়ে পুজো দিয়ে দিলেন পান্ডা গোছের একজন। ভক্ত না হলেও নিজেকে নাস্তিক বলার ধকও নেই| তাই পূজান্তে সাষ্টাঙ্গে প্রণাম করে বাইরে এলাম। মন্দিরের মাথায় বাংলায় লেখা “তোমার কর্ম তুমি করো মা, লোকে বলে করি আমি”

বাইরে এক জায়গায় নারকেল ভাঙা হচ্ছে আর মূর্তির মাথায় ঢালা হচ্ছে। ছিন্নমস্তার মাপে বেশ কয়েকটি বিগ্রহ করা আছে। কিন্তু এত লাল সুতো জড়ানো হয়েছে তার ওপর যে সেগুলো কে চেনার জো নেই। বাইরে গিয়ে প্রফেশন্যাল ফটোগ্রাফার দিয়ে একটা ছবি তুললাম। ভৈরা নদীতে কিঞ্চিত নৌকাবিহার করলাম। একসময়ের প্রবল নদী যদিও এখন অনেকটাই ক্ষীণকায়া হয়ে গেছে, তবুও। এক দিকে ছোট্ট এক ঝর্ণা একে অন্যরকম সৌন্দর্য্য দিয়েছে।

এইবার ফেরার পালা। ঝকঝকে রাস্তায় খুব অল্প সময়ে পৌঁছে গেলাম গন্তব্যে। মনে রয়ে গেল রাজরাপ্পায় অমলিন স্মৃতি।

ব্রতীন দাস। পেশায় তথ্যবিজ্ঞানী। মান্নাদে'র অন্ধ ভক্ত। গল্পের বই আর গান সময় কাটানোর প্রিয় উপায়। ক্রিকেট খেলার খুব ভক্ত। দাবা খেলা তাঁর জীবন।

এই বিভাগের অন্যান্য লেখাসমূহ

রে এলাম সিঙ্গিগ্রাম, কবি কাশীরামদাসের জন্মস্থান।

রে এলাম সিঙ্গিগ্রাম, কবি কাশীরামদাসের জন্মস্থান।

কবি কাশীরামদাসের জন্মস্থান পূর্ববর্ধমান জেলার সিঙ্গিগ্রামে বেড়াতে গেলাম।তাঁর জন্মভিটের ভগ্নাবশেষ দেখলাম।আমি,মিহির,রিমি,সোমা,রজত সকলে গ্রাম ঘুুুুরলাম। চারদিকে…..

শিশিরবিন্দু

শিশিরবিন্দু

ভ্রমণবিলাসী চারজন বেরিয়ে পরলাম ভ্রমণে। আমিও গেলাম।প্রথমে ওরা গেল মুকুটমণিপুর। সপ্তাহান্তে পিকনিক বা একদিনে ছুটিতে…..