রাতের প্রবোধে

বদরুদ্দোজা শেখু
কবিতা
Bengali
রাতের প্রবোধে

মনের গহ্বরে 

রাত আসে, ফ্যাকাশে আকাশে হুতাশের প্রতিধ্বনি
ঘুরে ঘুরে ফিরে বাতাসে বাতাসে বনানী শিহরি’ ,
ঘোলা বুকে ঘুরে শুধু অনুক্ষণ কাঙ্ক্ষিত রমণী ,
পায়চারি করি আর জাগি নিঃসঙ্গতার প্রহরী ।

শুধু ভাবি , ভাবনার এই এলোপাথাড়ি প্রবাহ
পায়না তো খুঁজে তার প্রণয়ের অভীষ্ট কিনারা ,
কখনো অস্থির-উদগ্রীব , কখনো নিরুৎসাহ ,
নিভে না কিছুতে কামনার এ নিরবচ্ছিন্ন ধারা ।

এতো বোঝা জীবনের , এতো সংঘাত , টালমাটাল
খেতে খেতে কোনক্রমে সময়ের সাথে দাঁড় টানা ,
টানাটানি , কানাকানি আর কোলাহলের আড়াল
ব্যস্ততার মাঝে শুধু ডুবে যায় হৃদয়-ঘরাণা ।

দিন নাই , রাত নাই , ব্যতিব্যস্ত মন অনিবার
সেই নারীকে ঘিরেই শুধু আনাগোনায় উদ্বেল ,
বুকের এ প্রেম যেন ব্যস্ত বিক্ষুদ্ধ কলকাতার
নিঃশব্দ নিথর গহ্বরে চলন্ত পাতাল রেল ।।

 

খেই-হারা

বসন্তের রাত এলো , এলোমেলো ভাবনায় চোখে নাই নিদ ,
বাইরে ডাইনী নাচে –নৃত্যপর ছায়া-ছায়া উদ্বাহু উদ্ভিদ ,
যুবতী আলেয়া যায় ভেঙে ভেঙে দূর মাঠ– সরু টানা পথ ,
আলোর খেয়ালে তার পিছু পিছু উড়ে যায় মননের মথ ।

জলের পরীরা নাচে ওইখানে — হবে বুঝি বসোয়ার বিল ,
ঝিলমিল নারিকেল চিরোল পাতায় সেই নাচনে সামিল
জ্যোৎস্নার স্বপ্নালুতা , গন্ধ ঢালে অপব্যয়ী স্ফূরিত কুসুম ,
মৌসুম বাজায় বুকে যেন কা’র নূপুরের মৃদু ঝুমঝুম ।

অবসাদ জ’মে আসে , আঁধারের পাদদেশে উন্মন উদাসী
হৃদয়ের বাঁশবনে বাজে কোন্ কত যুগ
বিরহের বাঁশি ,
আবেশে আচ্ছন্ন করে তার সুরে না-পাওয়ার প্রচ্ছন্ন বিষাদ ,
কস্তুরী-মৃগের মোহে অবসন্ন রক্তচক্ষু প্রেমের নিষাদ ;

কেবল-বুকে-পাওয়ার অজস্র স্ফটিক ফিটকিরির মতন
অনুভূতিগুলো এসে কামনার ঘোলা জলে তোলে আলোড়ন ,
অকস্মাৎ স্বচ্ছ জলে ভেসে উঠে ইতস্ততঃ কত মুখচ্ছবি
মরমী সত্ত্বার সাথে ছড়ায় বোধন যার বিমূর্ত সুরভি ।

মননের চারপাশে ছড়াছড়ি আজ এত নারীর প্রতিমা
সুষমার ছায়া-ছায়া অবয়ব — যেন তার নাই কোনো সীমা ,
তবু খুঁজি তাকে , যেন সনাক্ত করার সব প্রয়াস বেকার ,
অযুত যাত্রীর গেটে খেই-হারা আমি এক টিকিট চেকার ।

 

রাতের প্রবোধে

আলোটা নিভিয়ে দিই , শুয়ে পড়ি , জন্ম-লব্ধ প্রথা
আজীবন আওড়াই ; কবিতার প্রচ্ছন্ন প্রয়াস
ঝ’রে যায় একে একে ;আঁধারের ঘন নিবিড়তা
মনকে শিথিল করে , আমি এক অভ্যাসের দাস ।

আনাগোনা করে নিত্য কত মুখ মনের গহীনে
সড়কে চলতে সব ফলকের হারিয়েছি খেই ,
কোথায় সে কে রমণী কবে কোন্ কৈশোরের দিনে
ভীরু ভীরু ঢেউ তুলেছিল বুকে , আজ মনে নেই ।

কোথায় পথের শেষ ? ঘোলা বুকে ঘুরে নিরবধি
প্রেমের প্রথম সেই বহমান নিষিদ্ধ নহর ;
কালেভদ্রে ঝনঝন্ ক’রে উঠে কাব্যের ধ্রুপদী —
মন-মাঝি দাঁড়-টানা শব্দে ভাঙে আচ্ছন্ন প্রহর ।

এ কোন্ কুহকে আমি ? দিন যায় , রাতের প্রবোধ
নিয়ে আসে নৃত্যপর প্রতিমায় মতিচ্ছন্ন রতি ,
মিলনের গরমিলে খেলা করে অবাধ্য অবোধ
সমস্ত চেতনা জুড়ে যৌবনের আরাধ্য অসতী ।

 

 

স্ববিরোধ 

যা কিছু পেয়েছি আমি প্রকৃতির জৈবিক নিয়মে
তাতে দেখি শুধু দু’টি স্ববিরোধী ধারার মিশ্রণ—
পাশাপাশি প্রেম-পাপ শিশু-পশু তোলে আলোড়ন ,
অনুরাগ আবেদন মাথা কুটে সঙ্কোচ শরমে ,
দিনরাত দ্বন্দ্ব হয় কামনার আসক্তি সংযমে।
প্রতীক্ষার প্রবোধে এড়াতে চাই মনন-দূষণ ,
শরীরে যৌবন পুষি, জ্বালা পুষি,পুষি শিহরণ ;
আসক্তি বন্ধক রাখি সংযমের মুনির আশ্রমে ।

তবু দ্যাখো : প্রতিদিন কিশোরীর সুচারু কামিজে
আর যুবতীর বে-আব্রু ব্লাউজ শাড়ি ও শেমিজে
সম্মোহনী দেহলিকে মনে হয় কামুক কার্ত্তুজ ,
বিঁধে তার প্রতিচ্ছবি জংঘাময় মাংসের ত্রিভুজ ,
প্রলুদ্ধ মনকে টানে মিলনের শুদ্ধতম ঘৃণা ;
প্রেমের পিয়াসী দেহে সে আমার তীর্থের মদিনা ।।

 

বদরুদ্দোজা শেখু। কবি। জন্ম ১৯৫৫ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে, ভারতের পশ্চিমবঙ্গরাজ্যের মুর্শিদাবাদ জেলার সাগরদিঘিতে। অভাব অনটনের মধ্যে তাঁর বেড়ে উঠা। প্রথাগত শিক্ষায় স্নাতকোত্তর। পেশায় অবসরপ্রাপ্ত রাজ্য সরকারি কর্মচারী, নেশায় কবিতা লেখালিখি। প্রকাশিত কাব্যগ্রন্থ: অলৌকিক আত্মঘাত, দুঃস্বপ্নের নগরে নিভৃত নগ্ন, শব্দ ভেঙে...

এই বিভাগের অন্যান্য লেখাসমূহ