রাহুগ্রাস

বদরুদ্দোজা শেখু
কবিতা
Bengali
রাহুগ্রাস

এমন সন্ধ্যায়

কোন্ দিকে যাবো?
ভাড়াটে কুঠিতে কড়ি-কাঠ গোনা নিঃসঙ্গ প্রহর,
বন্ধুদের অনুবন্ধ আদর্শিক বিদ্বেষে বিলীন,পাশাপাশি
খিস্তি-খেউড়-মুখর বস্তিবাসী ঘিঞ্জির ঝঞ্ঝাট,
উঠতি গুণ্ডা অধ্যুষিত সরীসৃপ পার্ক,নদীতট ,
সামনে পরস্পরের শীর্ণ শ্বাস চুষে-খাওয়া বিরক্ত শহর
আমাদের মতো অশাকীন উদ্বাস্তু বাসিন্দা ভর্তি ;
বহুদিন পরিত্যক্ত পাড়াগাঁর বসতবাড়িতে
কোনোক্রমে অতিথি সৎকার করা অনাগ্রহ মনোভাব
বিদায় দেওয়ার প্রতিকল্প আড়ষ্ট উচ্ছ্বাসে
খামার বাড়ির খড়ের গাদার প্রান্তে পৌঁছে দিয়ে যায়
অস্তগামী সূর্যের মতোই ,পরাঙ্মুখ প্রকৃতিও বাড়ায় না হাত
ঘাসের গালিচা পেতে বিষয়-ধূসর শীতের শহরে ।
এমন সন্ধ্যায় কোন্ দিকে যাবো?

এখন নিজেকে দূর থেকে দৃশ্যমান
একটা গগনচুম্বী চিমনির মতো আষ্টেপৃষ্ঠে
টান-টান বাঁধা মনে হয়— কোনোদিকে
যাওয়ার সামর্থ্য নেই হৃদয়ের পোড় থেকে বাঁচার আশায়।
বিমর্ষ চিন্তার বিচ্ছিন্ন প্রবাহ-ক্লিষ্ট দ্বিধান্বিত মন
অসংলগ্ন চরণে চলায় । বিলম্বিত
গোধুলির অন্ধকারে চুপি চুপি চ’লে যাওয়া শেয়ালের মতো
উঞ্ছবৃত্তি ইচ্ছা কিছু হেঁটে যায় চৌরাস্তার মোড় ,
মোচ্ছবের ঝোপঝাড়
দুর্গন্ধ নর্দমা,অন্ধকার গলি, অকিঞ্চন বেশ্যার সরণি
আসক্তির কামনা-মঞ্জুল।
পশুত্বের চঞ্চুগুলো ব্যগ্রভাবে উগ্র হ’তে চায়
সন্নিকট আঁধারের অপগণ্ড লোভে ।
নির্বিঘ্ন শান্তির উৎস
সদ্যোজাত কবিতার গর্ভিনী চাঁদের উষ্ণ আলিঙ্গন
এখন কোথায় ? এখন কেবল
কিশোরীর উৎফুল্ল শাড়ির পিছু ধাবমান মাংস-লিপ্সু ময়ূরের চোখ ,
ধোপ-দুরস্ত সফেদ ডানায় ছদ্মবেশী চঞ্চুবান চিল,
এবং আত্মিক নন্দনতত্বের অলৌকিক মাধুকরী
এখন অমিল সবখানে।
শহরতলীর গোধুলির ছায়ান্ধ রাস্তায়
হেঁটে যাই নিঃসঙ্গ শেরপা এক আদিম যুগের ,
বওয়ার সামর্থ্য নেই তবু কাঁধে দুর্বহ দায়িত্ব আছে
পরিবেশ নির্বিঘ্ন করার ; চোখে ভাসে
শান্তির রহস্যভরা শিখরের অভিনব উদ্ভাসন ।অকস্মাৎ
প্রতিবার পদক্ষেপে পরিপার্শ্ব মানুষের চোখে
নিজেকে ক্যামন্ মনে হয়
আজন্ম বিদেশী ।

 

রাহুগ্রাস

হে মহাজীবন,দুঃস্থ জীবনে নতুন আশার আলো
কখন্ আনবে, কখন্ ঘুচাবে এ আঁধার জমকালো?
চারিদিকে আজ বড়ো বেপরোয়া মারণাস্ত্রের ভিড়,
কোটি কোটি প্রাণ ধুঁকছে মাগিয়া অন্ন-বস্ত্র-নীড়;
এতো হাহাকারে ভ্রুক্ষেপহীন যুদ্ধবাজের দল
ক্ষমতার মোহে করে অপচয় জীবনের সম্বল।
প্রতিযোগিতায় বিষাক্ত আজ জল স্থল নভঃ বায়ু
তবু তারই ঘনঘটা করে দুই পরাশক্তির স্নায়ু।
বিকৃত হয় হৃদয়ের যতো সুন্দর অনূভূতি :
উদারতা অনুকম্পা সততা শান্তি সহানুভূতি —
যতো মানবিক গুণাবলী সব কোমল ফুলের মতো
উদ্ধত জ্যাক-বুটের তলায় হয় ক্ষতবিক্ষত।
সৌন্দর্যের মৃত্যু তবে কি বারুদের কব্জায় ?
কণ্ঠ রুদ্ধ পারমানবিক অস্ত্রের সজ্জায়?
কোথায় দাঁড়াবে কবি ? এইবার গদ্যেরও নাই ছুটি,
কঠোর ধ্বংস-রোলার চালানো মারাত্মক ভ্রুকুটি
সামনে পিছনে আকাশে জমিনে,প্রলয়ের তাণ্ডব
চোখের পলকে ভস্ম-চূর্ণ ক’রে দিতে পারে সব ।
সন্দেহ-ভারাতুর মনে তবু কী দুঃস্বপ্ন জাগে–
এতো বিভীষিকা মাথায় ক’রে সে জীবনের ভিখ্ মাগে !
এক জোটে চায় এ বিধ্বংসী প্রবৃত্তির বিরোধ–
বিশ্ব ব্যাপিয়া প্রয়োজন আজ মানবিক প্রতিরোধ:

হে মহাজীবন ,মনের সুস্থ চেতনাকে আজ শানো ,
যুদ্ধ নয়কো, চিরসুন্দর সবুজ শান্তি আনো ,
দুঃস্থ আবাস-ভূমি কেন হবে আমাদের প্রিয় গ্রহ ?
ক্ষুধা-তৃষ্ণার জগতে যুদ্ধ নিছক দুঃখ-বহ ;
অস্ত্র-ভাঁড়ারে সভ্যতা যেন রাহুগ্রাসে পূর্ণিমা ,
মানবিকতার দুয়ারে কাঁদছে নাগাসাকি হিরোশিমা।।

 

এক রমণী

এক রমণী চোক্ষে ভাসে
পরণে তার বেওয়ার সাদা শাড়ি
ন্যূব্জ দেহ হাড়েমাসে,
পুকুর পাড়ে খড়ের ছাওয়া বাড়ি।

দাওয়ায় ব’সে মুরগী তাড়ায়
বেড়ার পাশে চুলোয় রাঁধে ভাত,
ভাবলে আজো , কেবল বাড়ায়
সোহাগ-ভরা মানুষ-করা হাত।

প্রতিদিন সে ধূসর চোখে
কুশল পুছে “ক্যামন আছো বাপ? ”
বুক ভরা সেই কথার শোকে
নগরবাসী মন হয় ছয়লাপ।

ভালো আছি, বলবো ভাবি,
ভালো আছি বলবো কেমন ক’রে?
অহরহ প্রাণের দাবী
দাঁড়ায় তার সে দুখের দুয়ার ধ’রে।

মজুর খেটে মজরি আনে
শেষ সম্বল দশ নম্বর ছেলে
তারি ছায়ায় বাঁচে প্রাণে
খেয়ে না-খেয়ে জীবনটা যায় ঠেলে।

পারিনি তো একটুখানি
করতে তার সে দুখের অবসান,
দৈন্যদশার কঠোর গ্লানি
বইছে সে যে, সইছে অপমান।

হাতড়ে’ হাতড়ে’ মৃত্যু-পথে
যাচ্ছে স’রে নামাজ -রোজার মালী
নুয়ে নুয়ে কোনোমতে
জীবদ্দশায় দিচ্ছে জোড়াতালি।

পুত্র-কন্যা-স্বামীহারা
কয়লা বুকের করুণ প্রতিচ্ছবি…
আজো আঁধার দ্যায় পাহারা
যেন সে এক অস্তায়মান রবি ।

বারেক দেখার বার্তা পাঠায় ,
দেখতে যাওয়ার সময় কবে হবে?
ভালোবাসার মণিকোঠায়
হায়রে, কী সাধ আমার অবয়বে?

চোক্ষে ছানি , ভোঁতা শ্রবণ,
ডাকছে মরণ, করছে তবু কাম,
হায়রে মানুষ , হায়রে জীবন
হায়রে প্রাণের নিঠুর পরিণাম!!

 

ভূপালের পায়রা

শিশুর কথাই শুধু দিনরাত পোড়ায় আমাকে
যারা ছিল আকাশে নতুন-ওড়া পায়রার মতো,
চঞ্চল খেলায় মেতে যেত দিন, ছোঁয়নিকো যাকে
কঠোর আয়াসলদ্ধ অপ্রচুর জীবিকার ব্রত।
ডানা ঝাপটানো ছিল না তখন ঘুমানো পাখির
মায়ের আঁচলে ছিল আলু-থালু লুটানো মানিক,
শান্তি থেকে বহুদূরে প’ড়ে আছে পৃথিবীর নীড়,
ওরা আর হ’তে পারবে না কভু শান্তির সৈনিক।

তুমি তো জানোই যীশু কেন হলো ঘুমন্ত ভূপাল
মর্মান্তিক মৃত্যুভূমি, কে ছিল জুডাস ,মৃত্যুবাণ-
হানা অন্তরাল কা’রা ছিল সেই খুনের দালাল ।

পায়রাগুলোই আজ দিতে পারে পথের বিধান :
অন্ততঃ শুদ্ধ বিকেকটাতে দিই পুরাতন শান–
বধ্যভূমি ছিল কেন শান্তিপ্রিয় যীশুর কপাল ?।

উড়ির চর

জানি না তোমরা কা’রা ,কতজন ভেসে গেছো ঘূর্ণিঝড়ে, স্রোতে
অকস্মাৎ, মিলবে না কোনোরূপ সঠিক হিসাব, র’য়ে যাবে
বড়োসড়ো গরমিল সরকারী আর বেসরকারী হিসাবে,
অবশ্য অমন চিরকাল থাকে ; হতভাগ্য চরের বসতে
কীই-বা আসবে যাবে তাতে ? চুল-চেরা গোণাগাঁথার উৎপাত
বাদ দিয়ে ক’জন দুর্গতদের বাড়িয়েছি সাহায্যের হাত?
রোজ প্রাতরাশে তাজা খবরের খদ্দের আমরা পরাঙ্মুখ
অক্ষমতা নিয়ে নির্বিকার উপভোগ করি শহরের সুখ।
তবু যেন মধ্যরাতে অসম্ভব আর্তরোলে কা’রা কেঁদে ওঠে
বহু মানুষের মৃত্যুর খবরে আহত আত্মার সন্নিকটে,
কে যেন কলার চেপে ধরে বিপন্নের প্রয়োজনে পরাঙ্মুখ
আড়ষ্ট সত্ত্বার , ক্যানভাস হ’য়ে অগুণতি অসহায় মুখ
দ্যায় বিব্রত ধিক্কার ; পাশাপাশি দন্ত-বিস্ফারিত রাশি রাশি
ফেনায় ফেনায় উঠে উচ্ছ্বসিত সমুদ্রের ক্রূর অট্টহাসি।।

বদরুদ্দোজা শেখু। কবি। জন্ম ১৯৫৫ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে, ভারতের পশ্চিমবঙ্গরাজ্যের মুর্শিদাবাদ জেলার সাগরদিঘিতে। অভাব অনটনের মধ্যে তাঁর বেড়ে উঠা। প্রথাগত শিক্ষায় স্নাতকোত্তর। পেশায় অবসরপ্রাপ্ত রাজ্য সরকারি কর্মচারী, নেশায় কবিতা লেখালিখি। প্রকাশিত কাব্যগ্রন্থ: অলৌকিক আত্মঘাত, দুঃস্বপ্নের নগরে নিভৃত নগ্ন, শব্দ ভেঙে...

এই বিভাগের অন্যান্য লেখাসমূহ

ঝরা পাতা

ঝরা পাতা

  চারিদিকে কোলাহল শূণ্যতা করেছে গ্রাস, বেদনা বিধুর অতৃপ্ত বাসনায় হাহাকার, অজান্তে নীরবতা তোমার স্পর্শে…..