ঝরা শিউলি
এক মেয়েটা মুঠো মুঠো জ্যোৎস্না কুড়িয়ে অপরের মুখমন্ডলে চাঁদ দেখত। মানুষের উপকার করার ক্ষেত্রে,…..
কয়েকদিন হলো একটা ভারী অদ্ভূত স্বপ্ন দেখে ঘুম ভেঙে যাচ্ছে সুখেনের ৷ ঘুম ভাঙতেই সাময়িকভাবে লোপ পাচ্ছে তার সব জৈবিক বোধগুলি ৷ চোখের সামনে শুধু ভাসছে একটা অন্ধকার ঘর। কোণে আলোআঁধারি’তে একটা টেবিলকে ঘিরে চারটে মুখ ৷ চারটে মুখ না বলে চারটে ছায়া বলা-ই ভালো ৷ পুরোপুরি অন্ধকারে আচ্ছন্ন হয়ে আছে। ওই ঘরের-ই এককোণ থেকে সুখেন তাদের দিকে একদৃষ্টে চেয়ে আছে ৷ তারাও সুখেনের দিকে চেয়ে বিড়বিড় করে কী যেন বলে চলেছে একইভাবে ৷
গত একমাস প্রতিদিনই সে এই স্বপ্নটা দেখে চলেছে ৷ ধড়মড় করে উঠে পড়ে তারপর ৷ কিছুক্ষণ ধাতস্থ হতে সময় নেয় ৷ তারপর ঘামে ভিজে যাওয়া গেঞ্জিটা টান মেরে খুলে ফেলে ৷ বাকি রাতটা বিছানা’র এ’দিক-ও’দিক ছটফট করতে করতে কাটায় ৷ এই তার গত একমাসের নিত্যরাতের রুটিন৷
তবে আজ স্বপ্নটা দেখলো সে ভোররাতে। সেই চারটে ছায়ামূর্তি। হাত ধরাধরি করে বসে আছে টেবিলটাকে ঘিরে ৷ কোন মুখ-ই স্পষ্ট নয় ৷ হঠাৎ সেই চারটে ছায়ামূর্তি অট্টহাস্য করে উঠলো ৷ মুখ দিয়ে একটা আঁ-আঁ করে গোঙানি বেরিয়ে এলো সুখেনের ৷ জৈবিক বোধটা ফিরে আসতেই তিরতির করে কেঁপে উঠলো চোখের পাতাদু’টো ৷ সকালের নরম রোদ এসে পড়েছে তার মুখে ৷ আড়ষ্টভাবে খাটের এ’দিক ও’দিক করলো কিছুক্ষণ ৷ তারপর উঠে বসলো ৷
আজ সারাদিনই কোন কাজ নেই ৷ আসল কাজটা রাত ৯টা’র পর ৷ কালকে সবকিছু ঠিক করে রেখেছে সে ৷ পঞ্চা আর কালু তার অনেকদিনের পুরোনো সাকরেদ ৷ সবকিছুই জানে তারা ৷ তবু হাত বাড়িয়ে ফোনটা নিয়ে পঞ্চাকে একটা ফোন লাগালো।
ওপার থেকে পঞ্চা’র পরিচিত কণ্ঠস্বর ৷ ‘বলো বস’।
-‘তোরা আজ রেডি তো? কি কি আনতে হবে বলতে হবে না নিশ্চয়-ই…’
-‘তোমার সঙ্গে কি কম দিন কাজ করছি ৷ চাপ নিয়ো না গুরু। সব নিয়ে যাবো…’ ৷ পঞ্চা’র খ্যাক খ্যাক হাসিটা শেষ হবার আগেই ফোনটা কেটে দিলো সুখেন ৷
ছেলেটা’র নাম নির্মল মিত্র ৷ নতুন দোকানটা কিনেছে বাজারের একেবারে তিনমাথা’র মোড়ে ৷ বেশ ভালো পজিশনে পেয়েছে দোকানঘরটা ৷ খোঁজ নিয়ে সুখেন জেনেছে লাখ তিরিশের ডিল হয়েছে ৷ বেশ বড়ো দোকানঘরটা ৷ অনেকগুলো মোবাইল সেট নিয়ে ঝাঁ চকচকে বানিয়েছে বেশ। এর মধ্যে কেনাকাটাও রমরমিয়ে চলছে ৷ তাইতো সুখেন লাখখানেক টাকা সিকিউরিটি মানি চেয়েছিল ৷ কী এমন বেশি চেয়েছিল? কিন্তু, কী ছোট মন ছেলেটা’র ৷ কিছুতেই দিল না টাকাটা। উপরন্তু চ্যালেঞ্জ করে বসলো..’যা পারবে করে নাও গে…’। সব সহ্য করতে পারে সুখেন, কিন্তু চ্যালেঞ্জ সহ্য করতে পারে না। সেদিন-ই ফাইনাল ডিসিশানটা নিয়ে নিয়েছিল সে। রাত ন’টার পর দোকান বন্ধ করে বাড়ি ফেরে শালাটা মোটরবাইকে চেপে ৷ তখন-ই কাজটা সারতে হবে ৷ একেবারে ওপরে পৌছে দেবে ব্যাটাকে ৷ থু করে জানালা দিয়ে একদলা থুথু ফেললো সে ৷
সুখেন দাস ৷ বয়স ৩২ ৷ পেশাদার তোলাবাজ ৷ সঙ্গী পঞ্চা আর কালু এলাকা’র কুখ্যাত মস্তান। সবাই একবাক্যে ডরায় ওদের ৷ কনট্র্যাক্ট নিয়ে খুন করে সুখেন I আর বাজারের ছোটবড়ো সব ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে একটা নির্দিষ্ট অঙ্কের মোটা মাসোহারা আদায় করে ৷ অবশ্য, তাকেও উপরতলা’র অনেক লোককে খুশি করতে হয় ৷
দুই
রাতটা প্রায় সাড়ে ন’টা ৷ রেললাইনের পাশের এই রাস্তাটা দিয়েই আসে নির্মল ৷ ঘাপটি মেরে তিনজন বসে আছে রাস্তার ধারে টিউবওয়েলের পাশে ঝোপের ভিতর। দূর থেকে মোটরসাইকেলের হেডলাইটটা দেখা যাচ্ছে ৷ কাছাকাছি আসতেই কালু নিখুঁত নিশানায় হাতের থান ইটটা ছুঁড়ে মারলো হেডলাইটের মাঝবরাবর লক্ষ্য করে ৷ পাক খেয়ে বেশ জোরেই শব্দ করে পড়লো বাইকটা ৷ একটা তীব্র আর্তনাদ বেরিয়ে এলো নির্মলের মুখ দিয়ে ৷ হাতের বস্তাটা আগে থেকেই রেডি করে রেখেছিল পঞ্চা ৷ ছুটে গিয়ে নির্মলের মুখটা চটের বস্তায় ঢেকে দিয়ে দড়ি দিয়ে শক্ত করে বেঁধে দিল ৷ তার আগে অবশ্য লোকটার মুখে টর্চ মেরে নিশ্চিত হয়ে নিয়েছে সুখেন। শিকারটি তাদের কাঙ্ক্ষিত নির্মল মিত্র-ই।
হাতদু’টো পিছমোড়া করে বেঁধে পেটে বেশ জোরে একটা লাথি মারলো সুখেন। ‘মাগো’ বলে বসে পড়লো নির্মল ৷ জামা’র কলার ধরে হিঁচড়াতে হিঁচড়াতে নিয়ে চললো মানুষটাকে রেললাইনের দিকে৷ আপ্রাণ চেষ্টা করছে লোকটা মুক্তি’র জন্য। আবার একটা লাথি মারল সুখেন। এবার তলপেটে। একটা তীব্র গোঙানি ছাড়া আর কিছু বেরলো না লোকটা’র মুখ দিয়ে ৷ দুই নম্বর লাইনের উপর লোকটাকে চেপে ধরে লাইনের উপর শক্ত করে অর্ধচেতন দেহটাকে বেঁধে ফেলল পঞ্চা আর কালু। একটু পরেই দু’নম্বর লাইন দিয়ে আপ হাওড়া-মালদা ইন্টারসিটি এক্সপ্রেস যাবে ৷ সরে এলো তারা ৷
ট্রেনটা শব্দ করে চলে যাবার পর পঞ্চা বললো ‘বাইকটা আমি নিয়ে যাচ্ছি গুরু। রতনদা’র গ্যারেজে ভরে দেবো’ ৷
-‘নাম্বার প্লেটটা খুলে নিস’ ৷ নিজের ঘরের দিকে রওনা দিলো সুখেন। কাজটা বেশ নির্বিবাদে শেষ করা গেছে ৷ মৃদু শব্দে হেসে উঠলো সে।
ঘরে ঢুকে ফ্রিজ থেকে একবোতল ঠান্ডা জলের অর্ধেকটা সাবড়ে দিলো এক ঢোকে ৷ তারপর জামাকাপড় না ছেড়েই আলো নিভিয়ে শুয়ে পড়লো উপুড় হয়ে।
তিন
খুট করে একটা শব্দে চোখ মেলে তাকালো সুখেন। সেই অন্ধকার ঘর ৷ সেই টেবিল ৷ আর টেবিলকে ঘিরে… কিন্তু একি? পাঁচটা ছায়ামূর্তি দেখতে পাচ্ছে সে ৷ এতদিন তো চারটে ছায়া দেখতো সে ৷ ছায়াগুলি নিশ্চুপ বসে আছে ৷ ধীরে ধীরে টেবিলের কাছে এগিয়ে যাচ্ছে আজ ৷ টেবিলের একেবারে সামনে উপস্থিত হলো এবার।
–‘তুমি এসেছো’? একটা কন্ঠ বলে উঠলো ৷
কথা বলতে গিয়ে ব্যর্থ হলো সুখেন ৷ মুখ খুলতে পারছে না ৷ জিভটা মুখের মধ্যে আকুলিবিকুলি করছে বেরিয়ে আসার জন্য ৷ কিন্তু সে মুখ খুলতে পারছে না কোনমতে ৷ টেবিলের উপর একটা সাদা কাগজ আর পেন রয়েছে ৷ পেনটা তুলে সাদা কাগজে লিখতে লাগল সে –
-‘হ্যাঁ’ ৷
-‘কী নাম তোমার’?
-‘সুখেন দাস’।
-‘বাবা’র নাম কী’?
-‘অমর দাস ‘ ৷
-‘কী করো’?
-‘তোলাবাজি করি’ ৷
-‘আমাদের মেরে ফেললে কেন’?
-‘তোমরা কারা’? টেবিলের চারদিকে যে ছায়াগুলো বসে তাদের কাউকেই দেখতে পাচ্ছে না সে ৷ এমনকি স্পর্শও করতে পারছে না ৷
-‘আমরা তোমারই হাতে সৃষ্টি’ ৷
ভাবতে লাগলো সুখেন অবাক হয়ে ৷ কন্ঠস্বরটি আবার সচল হলো ৷
-‘প্রিয়নাথ দে’কে মেরে ফেললে কেন’?
-‘উনি ভাড়া’র ঘর ছেড়ে উঠছিলেন না ৷ অনেকবার শাসিয়েছিলাম ৷ কোন লাভ হয়নি ৷ বরং উনি আমার নামে থানায় গিয়ে ডায়েরি করলেন ৷ তাছাড়া, ওনার বাড়ি’র মালিক অমিয়বাবু আমায় পঞ্চাশহাজার টাকাও দিয়েছিলেন ৷
-‘আর, অংশুমান কর’কে কেন মারলে’?
-‘উনি তো প্রোমোটারি করতেন ৷ আমার ভাগের টাকাটা মেরে দিলেন ৷ ওনাকে ওনার বাড়ি’র ছাদ থেকে ঠেলে ফেলে দিয়েছিলাম’ ৷
-‘বিভূতি ঘোষাল’কে’?
-‘ওঁর ছেলে আমায় দু’লাখ টাকা দিয়েছিল ৷ বাড়িটাকে প্রোমোটারের হাতে দিতে পারছিল না বাপের কারণে ৷ ঘরেই ওকে গলা টিপে মেরে বিছানা’র চাদর দিয়ে ঝুলিয়ে দে’ই সিলিং ফ্যান থেকে’ ৷
-‘মন্টু’কে’?
-‘ও আমার শাকরেদ ছিল ৷ বখরা নিয়ে গন্ডোগল হওয়াতে আমায় দেখে নেবে বলেছিল ৷ ওটাকে পুকুরের জলে চুবিয়ে মেরেছিলাম’।
-‘আমাকে মারলে কেন’?
-‘কে তুমি’?
হঠাৎ করেই আলোকিত হয়ে উঠলো টেবিলের চারপাশের মুখগুলি ৷ গোল হয়ে বসে আছে প্রিয়নাথ দে, অংশুমান কর, বিভূতি ঘোষাল, মন্টু আর… নির্মল মিত্র। প্রত্যেকের মুখ মার্বেল পাথরের মতো সাদা ৷ মুখগুলিতে অজস্র লালচে ফাটল। এতক্ষণ নির্মল মিত্রের গলা’র স্বরই শুনছিল সে ৷
-‘আমরা তোমার কী ক্ষতি করেছিলাম’? সবাই এবার একসঙ্গে বলে উঠলো ৷
ঘুমটা ভেঙে গেলো সুখেনের ৷ চোখ চেয়ে ঘরের কোণের টেবিলটাকে চিনতে পারলো সে। টেবিলকে ঘিরে এখনো বসে আছে সেই পাঁচটি প্রেতাত্মা ৷ ছিটকে ঘর থেকে বেরিয়ে আসলো পাগলা কুকুরের মতো ৷ রাত ক’টা বাজে কে জানে! পেছন থেকে এখনো চিৎকার ভেসে আসছে , ‘আমাদের মেরে ফেললে কেন’? বদ্ধ উন্মাদের মতো দু’হাতে মাথা ধরে ছুটতে লাগলো ট্রেনলাইন ধরে ৷ একবার নির্মলের বস্তাবন্দী কাটা শরীরটাকে দেখতেই হবে তাকে। প্রায় পৌছে গেছে সে জায়গাটায় ৷
প্রতিদিনের মতো রাত আড়াইটা’র আপ ট্রেনটা বিকট দানবের মতো শব্দ করে দু’নম্বর লাইন ধরে ছুটে চলে গেলো!
সম্পাদনা: শাহানাজ ইয়াসমিন
এক মেয়েটা মুঠো মুঠো জ্যোৎস্না কুড়িয়ে অপরের মুখমন্ডলে চাঁদ দেখত। মানুষের উপকার করার ক্ষেত্রে,…..
শেষ থেকে শুরু। আমি রজকিনী রামী,ধোপার বংশে জন্ম আমার।ঘাটে সখিদের সঙ্গে কাপড় কাচি। একাজটা আমি…..
মালঞ্চার পথে ভোরবেলা। সূর্য সবে উঠছিল। বৈশালী দূর থেকে দেখতে পেল,বুনিয়াদপুর বাসস্ট্যান্ডে বালুরঘাটের দিকে মুখ…..
আমার বাবা ছিলেন অত্যন্ত সাহসী একজন লড়াকু মনের মানুষ।শত অভাব অভিযোগেও তাকে কোনোদিন ভেঙ্গে…..