দৌড়
একবার এক দৌড় প্রতিযোগিতায় কেনিয়ার হয়ে দৌড়চ্ছিলেন আবেল মুতাই। খুবই ভালো দৌড়াচ্ছিলেন তিনি। সবাইকে পেছনে…..
ঠা ঠা তপ্ত অলস দুপুর। কেবল প্রজাপতি্রা উড়ে বেড়াচ্ছে বাগানে। মার মত গাছগুলোও গভীর ঘুম অঘুমে দুলছে। দোতলার বারান্দায় আমরা দু ভাইবোন ঘুড়ি বানাচ্ছি। ভাইয়া বলছে, উউউং দেং—
আমি লম্বা নারকেলের কাঠি দেখিয়ে বলছি, এটাং?
নাং নাং ভাইয়ার চোখ অন্যদিকে দেখায়, ওটাং। ওং ওং আচ্ছাং আচ্ছাং দিচ্ছিং বলে অন্য কাঠিটা ভাইয়াকে তুলে দিই।
ভাইয়া আজকে আমাকে আটকে রাখছে। উড়নচণ্ডী আমাকে মা বাপি ভাইয়া ঘরে আটকানোর নানা ফন্দি বের করে। আর আমি সব ফন্দি উলোট পালোট করে রোজ বেরিয়ে যাই। কখনো গেট বেয়ে। কখনো গাছ বেয়ে দেওয়ালে। দেওয়াল থেকে এক লাফে ঝামটি, হাতিশুঁড়, বনতুলসী, ভেন্না, আকন্দ বুনোকচুর পাতা মাড়িয়ে হই হই করে পাড়ার ছেলেদের সাথে মাঠে, নদীতে ঘুরে বেড়াই।
ধরতে পেলে পাখার ডাঁটি পিঠে ভেঙ্গে মা প্রায়ই বলে, ওরে শাসেডানি পদ্মরাণী মেয়ে, দুপুর হচ্ছে অংক করার সময়। তা না, সারাক্ষণ খালি চৈমক্কর চৈমক্কর। কি মেয়ে রে বাবা!
আমি মার খেয়েও ঠোঁট উল্টাই। ছাই সময়, কচু সময়। আমার কাছে দুপুর মানেই হ্যাংলা সময়। জিলিপি সময়, নদী সময়, বন্ধুদের সাথে রোদের সাথে ছোটার সময়। রোদ্দুরে ছায়া ফেলে সেই ছায়া লাফিয়ে ডিঙ্গোনোর সময়। কেউ কি জানে এই সময় রোদ্দুর নদীর জলে কত রঙ্গের জ্যামিতি আঁকে? সেই জ্যামিতির ছবি আবার নৌকার কালো গায়ে অনেক অনেক প্রতিচ্ছবি হয়ে ফুটে উঠে?
আমরা নৌকা ঘুরিয়ে দিই একটুখানি, এবার কি রে?
আরে শালা দেখ দেখ কতগুলো ত্রিভুজ দুলছে! নদীও দেখি জ্যামিতি জানে! দেখেছিস, দেখ দেখ ত্রিভুজগুলো কেমন কাঁপছে। আরেকটু ঘুরাই, উরে খাইছে, এত চতুর্ভূজ। আরে এবার তো সার্কেল্ সার্কে্ল, বৃত্ত! হাহাহা দেখেছিস এবার সব স্টার হয়ে জড়িয়ে গেছে!
আমাদের সাথে নদীও হেসে উঠে। কেউ দেখে না, কেবল আমরা দেখি। সোনালি রূপালি গালে টোল ফেলে নদী এবার ঢেউ দেয়। হালকা উষ্ণ ঢেউ। আমরা প্যান্টের পকেট থেকে যার যার নাম লেখা কাগজের নৌকা বের করে তীরে রাখি। জলের সামান্য দূরত্বে। এমনভাবে রাখি যেনো একটুখানি ঢেউ পেলেই নৌকাগুলো ভেসে যেতে পারে। তারপর অপেক্ষা! কার নৌকা আগে, কারটা পরে ডুবলো তার।
মাঝে মাঝে মারামারিও হয়ে যায় আমাদের। ছেলেরা ঝাপাঝাপি করে তখন নৌকা ডুবিয়ে দেয়। ঝগড়া করে জীবনের মত আড়ি দিয়ে আমরা আলাদা হয়ে যাই। যেতে যেতে দেখি জামাপ্যান্ট খুলে মাথায় বেঁধে ছেলেরা নদী পেরিয়ে চলে যাচ্ছে ওপারে। কিছুক্ষন দাঁড়াই। ভাবি। যাবো? সাঁতার তো আমরাও পারি! একই প্যান্ট জামা, মাথায় বেঁধে নিতেও জানি। কিন্তু ন্যাংটো হতে হবে যে! থমকে দাঁড়িয়ে আমরা চলে যাই। কারণ ততদিনে বুঝে গেছি আমাদের ন্যাংটোটা লজ্জার আর ওদেরটা কিছুই না।
স্রেফ অ্যাডভেঞ্চার!
কামরাটা কেমন ঠাণ্ডা ঠাণ্ডা লাগছে হঠাত। মনটাও শিরশির করছে। একটু আগেও স্ত্রী, সন্তান, নাতি নাতনী আত্মীয় পরিজনে ভরে ছিল তার চারপাশ। এখন কেউ নেই। এতদিনে সে বুঝতে পারে, বেঁচে থাকার একটি সুঘ্রাণ আছে। ব্যাপারটা আগে কখনো বুঝতে পারে নাই কেন কে জানে! আসলে তার ভারি অহংকার ছিল। ভেবেছিল মৃত্যুও তাকে ছুঁতে পারবে না।
চশমার কাঁচ ঘিরে ঘাম জমেছে। মুছবে বলে চশমাটা খুলতেই দেখে একটি কিশোর বসে আছে তার কামরার দরোজায় ঘেঁসে। পানি গড়াচ্ছে কিশোরের জামাপ্যান্ট থেকে। স্বাভাবিক কর্কশ সুরে কে কে বলার আগেই কিশোরটি সালাম দেয়, কেমন আছেন বদ্দা? আমি জসিম। চিনতি পারতিছেন?
জসিম! কোন জসিম? কি চাস তুই? চিনতে না পারলেও তার অহংকারী গলা শোনা যায়।
জান্নাত চাই বদ্দা। কর্ণফুলির জলে আর ভাল্লাগছে না। কেমন জানি স্যাতলাঁ স্যাতলাঁ গন্ধ লাগে গো বদ্দা। মাইরে যখন লাশই করলেন তখন পাহাড়ে ফেলাতি পারতেন ত বদ্দা।
জল! এই তুই জলে নামিছিস ক্যান? কি নাম য্যান বললি? জসিম! অ তা হিন্দুগের মত জল জল বলতেছিস যে! কেমুন মুসলমান তুই অ্যা! সাচ্চা নাকি ভেজাল!
কুলকুল করে হাসে জসিমুদ্দিন, সত্যি মুসলমান। প্রথম কলেমা মনে আছে বদ্দা। বলব? আর নালি এই যে দ্যাহেন—ইংলিশ প্যান্টের বোতাম খুলে খৎনা করা কিশোর পুরুষাঙ্গটি দেখাতে যেতেই ধমকে উঠে বদ্দা। এতক্ষণে সে বুঝতে পারছে কেন এত হিম হিম ঠাণ্ডা লাগছে এই কামরা। আজকাল দেখি যখন তখন সংরক্ষিত এলাকায় ঢুকে পড়ছে বিচ্ছু গেরিলাদের দল। এটা কি একাত্তর নাকি অ্যা।
তার রক্ত অনেক গরম। একাত্তরের ইসলামি জোশে সে এখনো বিশ্বাসী। ইসলাম বাঁচাতে খুন, হত্যা, রাহাজানি, ধর্ষণ, লুন্ঠনকে সে একাত্তরে পাপ মনে করে নাই। এখনও করে না। তার দিল সাফ। ঈমান খাস, সোনার মত খাঁটি। কারো কাছে ক্ষমা চেয়ে নিজেকে সে ছোট করে নাই। মরতে ত একদিন হবেই। মৃত্যু কি অচেনা তার কাছে! একসময় কত মৃত্যু সে ডলে দিয়েছে একেকজনের গায়ে, মাথায় বুকে। নারীদের ইজ্জতের মশালঘরে। ওসব পাতি ব্যাপার নিয়ে ভাবার সময় কই তার!
সে ভাবছে তার ছড়ানো নেটওয়ার্ক নিয়ে। দেশে বিদেশে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা একাত্তরের স্বাধীনতা বিরোধীদের সে এক সূতায় গেঁথে নিতে পেরেছে। কিন্তু তার অবর্তমানে এরা এক হয়ে থাকতে পারবে ত? তাছাড়া লালঘর, নীলঘর, হাঘর থেকে যারা এসেছে আনুগত্যের মাথা নুইয়ে তারা থাকবে ত নাকি মধু ফুরিয়ে গেছে বলে ভেগে যাবে নাস্তিক নাসারাদের দলে! স্ত্রীকে সে বলেছে, একদিন এইদেশে ইসলামের শাসন প্রতিষ্ঠিত হবেই হবে। এটা একটি মেসেজ। প্রচারে খামতি হবে না কিন্তু যাদের বোঝার তারা বুঝবে ত?
জসিমুদ্দিনকে কাছে ডাকে সে, অই পুলা এদিক আয়। জয়বাংলা ছাড়া আর কি জানিস? ইংরেজি ভি অক্ষর চিনিস? মাথা নাড়ে একাত্তরের কিশোর গেরিলা। জসিমের চোখের সামনে ভি এঁকে সে বলে, ভি র মানে কি তা জানিস? জানিস না? তো শোন্, ভি মানে ভিক্টরি। এই দেখ কত বড় ভি। একাত্তরে তুই বিচ্ছু হইছিলি তাই না? মরার পরও তেজ দেখাতিছিস হারামজাদা। কিছু জানিস দেশের খবর? ওরে ও শূয়র কা বাচ্চা, হারাম কা আওলাদ, বেশি দিন আর দেরি নাই। আসছে দিনে বাঙালি আমাদেরই শহিদ বলে ফুল দেবে। বাম ডান, আম, জামের কত নেতা ভুলে গেছে ধর্মনিরপেক্ষতা। আমাগের পয়সায় তারা খায় পরে ঘুরে বেড়ায়। ভি চিনে রাখা। দেখেছিস ত কিতনা বড়া ভি! এবার যা ভাগ শালা মুক্তির পুটকি।
বাপি আশ্চর্য অতল চোখে জোনাক আলো জ্বেলে মাকে বলতেন, এই ত আমি! কেন যে ভয় পাও আমাকে হারাবার!
শেষ বিকেলের আলো মেখে মিস জোন্স আসতেন আমাদের বাসায়। বাপির বন্ধু। ভয়ে ভয়ে নিজের হাতে বানানো প্যানকেকের বক্স দেখিয়ে মাকে বলতেন, তোমার চায়ের পাশে এগুলো কি রাখতে পারি বিজয়নী?
ঈর্ষার জলবিছুটি ঝিকিয়ে উঠত মার মনে। তার স্বামী কি ভালোবাসে এই সন্ন্যাসিনীকে! কতটুকু? যখন কথা বলে বড় মেদুর মধুর হয়ে যায় স্বামীর কণ্ঠ। সন্ন্যাসিনীর সবুজ চোখে ধাঁধিয়ে ওঠে অবারিত জীবন। গোলাপের মাটি নিড়িয়ে দিতে দিতে সন্ন্যাসিনীর ধবল পোশাকে কখনো কি রঙ ছুঁইয়ে দিয়েছে তার স্বামী? দুটি গোলাপ যে সেদিন তুলে দিলো, সেকি সৌজন্যের উপহার নাকি বন্ধুত্বের চেয়েও আরো বেশি কিছু?
সন্ন্যাসিনীর লালচুলে প্রৌঢ় সূর্যের গলিত চুমু জ্বলে! কতটুকু কাম আছে তাতে? প্রেম? ভালোবাসা? নুনঘাম স্পর্শ? আশ্রয়ের মোহন ঘন উল্লাসে এই বিদেশিনী কি তাকে হারিয়ে দিলো!
বুকের পাড় কেন এত বেশি দুলে ওঠে তার! কেন অজানিত ভয় মন ছুঁয়ে দেহের চামড়ার সমস্ত রোমকূপ জুড়ে ছড়িয়ে পড়ে আগুণের মত!
মা তড়িৎ উচ্ছ্রাসে বাপিকে ডেকে বলে, শুনছ তোমার চায়ে কিন্তু চিনি দিচ্ছি না। আর প্যানকেকও অল্প খেও। সুগার কোলেস্ট্রল কন্ট্রোলে থাকা ভাল। সন্ন্যাসিনীও মার কথায় অনূদিত হয়, ও ইয়েস ইয়েস…
মার হাতের আঙ্গুল কাঁপে। স্পুন পড়ে যায় ট্রের উপর। সন্ন্যাসিনী তুলে নেয়। মার মনে হয় তার বিজয়পথে কি কোনো কাঁটা ঝাপালো? কেনো আরো ভালো করে সে সাজিয়ে দিতে পারে না বিকেলের নাস্তার ট্রে? এই অসুখ সে কি সারবেনা কখনো? ক্রমশ কংকাল হয়ে আসা আঙ্গুল সারাক্ষণ কাঁপে। গভীর মমতায় সন্ন্যাসিনী ছুঁয়ে থাকে মার হাত।
তবু কেনো ভয়ে জাগে! কিছু কি হারালো তার? চেনা মীড়? নীড়ে থাকা আহির ভৈরব! রাত্রিসুখ, খাম্বাজ ঠাটে, রে মাপা ণিধাপা?
মার হাতে বিষ ছুরি। যখন তখন টুকরো টুকরো করে কাটে ইতালীয় হৃদয়! সন্ন্যাসিনীর দু’চোখে তবু মায়া। বাপি সাদা রুমালে মুছে দেয় মার চোখ। ঈশ্বর ক্ষমা হয়ে বয়ে যায় বিকেলের বাতাসে।
রাতে কেক খাই আর পড়ার টেবিলে বসে বুঝি চূর্ণ হচ্ছে খোঁপার মালা। বাপি অসহায়, পুরুষ বিহ্বল, এই ত আমি! কেনো যে এত ভয় পাও!
মা তবু রোজ বিকেলে ডেকে পাঠায় মিস জোন্সকে, তুমি না এলে কি যে একা লাগে! এসো এসো। প্লিজ! আমার পাশে এসে বসো ভাই! মিস জোন্স জড়িয়ে নেয় মাকে।
উষ্ণ চা ছুঁয়ে তিনটি হৃদয়! সেতারে রবিশংকর। রাগ সন্ধ্যা। আমি ভাবি, ভালোবাসা কি তবে ত্রিভঙ্গ স্রোত! পাশাপাশি, খুব কাছের, তবু কেউ কারো সম্পূর্ণ নয়!
একবার এক দৌড় প্রতিযোগিতায় কেনিয়ার হয়ে দৌড়চ্ছিলেন আবেল মুতাই। খুবই ভালো দৌড়াচ্ছিলেন তিনি। সবাইকে পেছনে…..
সকালে উঠে মায়ের মমতামাখা মুড়ি ও লিকার চা খেতাম। তারপর দাদু বলতেন, এবার পড়তে বোস।…..
রোজকার সূর্য ওঠার মত বেলি ভোরে উঠে দরজায় সামনে জল দেয়,ঝাঁট দেয়, ফুল তোলে। তারপর…..
তারপর ইলেকট্রিক বিল জমা দিতে যাবো। আমার দেরি হবে আসতে। স্বামী অমর বলে, ঠিক আছে।…..