রূপকথার গল্প

পার্থজিৎ ভক্ত
গল্প
Bengali
রূপকথার গল্প

দ্বিতীয় ঘুষিটা বাঁ-চোয়াল তাক করে এগিয়ে আসছিল। একেবারে শেষ মুহূর্তে রাজু মাথাটা নীচু করে নেওয়ায় বেসামাল হয়ে রাজুর গায়ের ওপরেই হুমড়ি খেয়ে পড়ে সন্তোষ। ফলে দুজনেই জড়াজড়ি মাটিতে। অনেক কষ্টে রাজু নিজেকে  ছাড়িয়ে নেয়,পাল্টা হাত না তুলেই। অযথা বিতর্ক বাড়িয়ে কে আর অন্য সবার চোখ টাটাতে চায়। মুখের ভেতর দিকটা একটু জ্বালা জ্বালা করতে রাজু মুখ থেকে থুথু না ফেলে লালারসটা গিলে নেয়। হাজার হোক একফোঁটা রক্ত তৈরী করতে অনেক গতর খাটাতে হয়। অনেক সময় ফাউ হিসেবে জোটে গালাগালি। গা ঝাড়তে ঝাড়তে ভ‍্যান রিক্সার ব্রেক থেকে গার্ডারটা খুলে নিয়ে সিটে বসে প‍্যাডেলে চাপ দেয় রাজু। অনেক ভেতর থেকে একদলা কান্না ঘুরপাক খেতে খেতে গলার মাঝখানে কুন্ডলি পাকিয়ে উঠতে থাকে। কিছুটা জোর করেই সেটাকে আরও ভেতরে কোথাও ঢুকিয়ে দেয় রাজু। সামান্য সাত টাকা ভাড়া দেওয়ার মানসিকতা নেই অথচ রিক্সায় সওয়ারি হওয়া চাই। আগে চড়ে নিয়ে পয়সা না দেওয়ায় ওদেরকে ঘেন্না করে রাজু। অথচ বিনোদদের ঠিক সেটাই করা চাই। দলে ভারী বলে ওদের অত‍্যাচার মেনেও নিতে হয়।

রিক্সার নীচ থেকে তখনও ওর নিজের বইয়ের ব‍্যাগটা ঝুলছে। এবেলার মত শেষ ট্রিপ এটা। এরপর সওয়ারি নিলে আর তপুদার কাছে পড়তে যেতে পারবে না রাজু। তপুদা মানে রাজুর কাছে সবসময় স্নেহ মমতা ছোঁওয়া একটা ভরসার জায়গা। বছর দুয়েক আগে হঠাৎ একদিন একগাদা বাক্স – প‍্যাঁটরা নিয়ে স্টেশন থেকে বেরিয়ে লটারির টিকিট পাওয়ার মত রাজুর রিক্সায় সওয়ারি। ভাল করে হাত পাকেনি রাজুর তখনও। ওর ভ‍্যান রিক্সার নীচে বইয়ের ব‍্যাগ দেখে প্রশ্ন করেছিল – পড়াশোনা কর বুঝি? উত্তরে ঘাড় নাড়তে যারপরনাই খুশি হয়েছিল মানুষটা।

দক্ষিণ পাড়ায় যাওয়ার ভাড়ার কথা জিজ্ঞেস করতে রাজু বলেছিল – সে আপনি যা ভাল বোঝেন দেবেন। শেষে রহিম চাচাই জায়গার নাম শুনে বারো টাকা ভাড়া ঠিক করে কীভাবে সর্টকার্টে যাওয়া যাবে বুঝিয়ে দিয়েছিল রাজুকে। পরে অবশ্য খুচরোর সমস‍্যা হওয়ায় রাজু বলেছিল – থাক,এখন দশ টাকা দিন। বাকীটা পরে কোনদিন নিয়ে নেব না হয়। –  বাড়ীতো চিনে গেলে,সকালে দশটার আগে আর বিকেলে স্কুল থেকে ফিরে পাঁচটার পরে আমি বাড়ীতেই থাকি এসো না যে কোনদিন। আর স্কুলের পড়া টড়া বুঝতে যদি কোন অসুবিধা হয় – কোন লজ্জা নয়,চলে আসবে সোজা। মাথা নেড়েছিল রাজু। বাকী দুটাকা অবশ্য আর নেওয়া হয়ে ওঠেনি,কারণ ওদের দুজনের প্রয়োজন অথবা আন্তরিকতা যাই হোক – একজনকে অন্যজনের কাছে এনে দিয়েছিল।

প্রথম প্রথম অনিয়মিত হলেও পরে প্রায়দিনই স্কুলে যাওযার আগে এক দু ঘন্টা যা সময় পেত,চলে আসত রাজু। তাই তপেশ্বর বাবু থেকে তপুদা হতে বেশি সময় লাগেনি। অল্প কয়েকদিনেই আত্মগত মানুষটা অঙ্ক থেকে শুরু করে সাহিত্য – সবেতেই নিজের ব‍্যুৎপত্তির স্বাক্ষর রেখেছিল রাজুর ক্রমশঃ অবাক চোখের সামনে। আর রাজুও সারাদিনের পরিশ্রমের পরেও লেখাপড়ার ইচ্ছেটাকে বাঁচিয়ে রেখে তপুদার মন জয় করে নিয়েছিল নিশ্চিন্তে। অল্প কিছুদিন যাতায়াতের পর মাইনের কথা জিজ্ঞেস করতে ওর মাথায় আদরের চাঁটি মেরেছিল তপুদা। অতএব দেনাপাওনার ওখানেই ইতি। কথা প্রসঙ্গে রাজুকে বলেছিল ওর তপুদা – আমরা এখন বড় লোভী,স্বার্থপর,নৃশংস হয়ে গেছিরে। ব্যক্তিগত লাভালাভের বাইরে আর কোন কথা ভাবতেই শিখছি না। ওই জন্যই চারপাশে এত খুন জখম,মারপিট – বাঙালী জাতটার ভবিষ্যৎ কী ভাবতে পারিস? ভেবে দেখ এমন একদিন যদি আসে যে তোর চারপাশে একটাও মানুষ নেই – দেখতে মানুষের মত কিন্তু আসলে মানুষ নয় কেউ। কী হবে বলতো?

দৈনিক ভাড়ার ভিত্তিতে মহাজনের টাকায় কেনা ভ‍্যান চালায় রাজু। এখনকার সওয়ারি মেয়েটা ভ‍্যান মালিকের ঘরের মানুষ। সওয়ারি হিসেবে ভাল না লাগলেও উপায় তো নেই। ক্লাস নাইনে পড়া এই মেয়েটা মালিকের বড় আদরের ছোট মেয়ে। তপুদার কাছে পড়া হয়ে যাওয়ার পর রাজুর ভ‍্যানেই সকালের শেষ ট্রিপে ওকে স্কুলে নিয়ে যেতে হয়। ভীষণ গায়ে পড়া স্বভাবের হলেও তাকে কিছু বলতে যাওয়া মানে নিজের ভবিষ্যৎ তথা রোজগারের বারোটা বাজানো। স্কুলে যাওয়ার সময় অবধারিতভাবে নিজের শরীরের কোন না কোন ভারী অংশ রাজুর শরীরে ছুঁইয়ে তবে ভ‍্যানে ওঠে মেয়েটা। তারপর উঠেই ওর দিকে তাকিয়ে একটা ফিচেল হাসি – রাজুদা, তোমার লাগল?

ততক্ষণে হয়তো পরনের স্কার্টটা উঠে রয়েছে এক বিপজ্জনক বাঁকের একটু ওপরে। ভেতরের উপত্যকা ঘিরে এক একদিন এক এক রঙের সামিয়ানা। সেদিকে তাকিয়ে কেমন চোখদুটো জ্বালা জ্বালা করতে থাকে রাজুর। কিন্তু ঐ পর্যন্ত, তার বেশী কষ্ট হলে রাজু জানে খিদের কষ্ট এর চেয়ে ঢের বেশী। প্রয়োজনে নিজের জিভটাকে সজোরে কামড়ে ধরে রাজু কিংবা নীচের ঠোঁটে ওপরের পাটি দাঁতের চাপে কালসিটে পড়ে। তবু একরকম জোর করে সামনে তাকায় রাজু – আরও সওয়ারী চাই যে। দিনের শেষে নিজে পাক না পাক মালিকের হাতে চল্লিশটা টাকা তুলে দিতেই হবে ওকে। এর ওপরের রোজগার থেকেই পরিবারের প্রয়োজন কিছুটা মেটে,বাকীটা মেটায় ওর মা – চার পাঁচ বাড়ী কাজ করে করে বেলার দিকে হেদিয়ে পড়ে একেবারে।

দুই.

একেবারে ভোর পাঁচটা সাড়ে পাঁচটা থেকে শুরু করে বেলা আটটার আগে পর্যন্ত যতগুলো পারে সওয়ারি নিয়ে সাধ্যমত কিছু রোজগারের চেষ্টা চালায় রাজু। তারপর তপুদার কোচিং – বিনা পয়সায় বলে যেখানে ফাঁকি কিংবা অশ্রদ্ধার কোন ব‍্যাপার নেই। এরপর বেলা দশটা বাজলে আবার ছুট। কোনরকমে নাকে মুখে দুটি মুড়ি কিংবা রুটি গুঁজে বেলা এগারোটায় স্কুল। বিকেল চারটের পর থেকে আবার রাত্রি দশটা পর্যন্ত ওর ভ‍্যান রিক্সায় সওয়ারি হয় এলাকার মানুষজন। মাঝের মিড – ডে মিলটা না জুটলে খিদের জ্বালায় কেমন খুন চেপে যায় শালার শরীরটাতে। রবিবারটা অন্য সবার আরামের দিন হলেও রাজুর কাছে বড় দুশ্চিন্তার দিন – স্কুল বন্ধ থাকায় মিড – ডে মিলের গল্পটা লেখা হয় না। এদিন তাই দ্বিগুণ ছোটাতে হয় ভ‍্যানটাকে নইলে ভুখা পেটে ভেতরের যত জ্বালা যন্ত্রণাগুলো অযথা দাঁত নখ বার করতে থাকে। নিজেকে তখন একটা খোঁয়াড়জীবি শূয়োরের মত মনে হয় রাজুর। অবশ্য চাইলেই যে সব কিছু হাতে এসে মিলে যায় তা তো নয়। কপালের ব‍্যাপারটা ইচ্ছা না করলেও মেনে নিতে হয় শেষ পর্যন্ত। রাজুও এর ব্যতিক্রম নয়।

গত বছরের আগের বছর সপ্তমীর সন্ধ‍্যায় একটু বাড়াবাড়ি খেয়ে ফেলেছিল ওর বাপ,ভোর রাত থেকেই ভলকে ভলকে বমি,চোখ প্রায় উল্টানো, মুখে গ‍্যাঁজলা উঠে অবস্থা এখন তখন। সাতদিনের মাথায় শরীরের বাঁদিকটা সেই যে পড়ে গেল আর ঠিক হল না। ভাগ্য বাঁচিয়ে দিয়েছে ওদের নইলে আরও বেশ কয়েকজনের মত ওর বাপও ছবি হয়ে যেত এতদিনে। বিষাক্ত চোলাইয়ের খপ্পরে পড়ে খেটে খাওয়া মানুষগুলোর বেশ কয়েকজনের ছবি বেরিয়েছিল সেবার প্রায় সব কাগজে। কদিন সরকারি হাসপাতালে যমে মানুষে টানাটানি চলার পর অধের্ক হয়ে ফিরেছিল সেবার রাজুর বাপ। রাজুর মা অবশ্য তাতেই খুশি – সিঁথির সিঁদুরটা তো অক্ষত থাকল এযাত্রা। পরের পর ওষুধ বিষুধ কম তো করে নি ওর মা,কিন্তু ফল তেমন মিলল কই ? তার পর থেকেই সংসারের জোয়ালটা আপনা আপনিই চেপে বসেছে রাজুর কাঁধে। অগত‍্যা বাবার হাত থেকে ভ‍্যান রিক্সার হ‍্যান্ডেলটা এখন রাজুর মুঠোয়।

মাঝে মাঝে কী একটা ঘোরের মধ‍্যে বুঝতে পারে রাজু – ওর চারপাশে কী সুন্দর গন্ধ,ঠান্ডা হাওয়া দিলেও শীত করছেনা কখনও,গাছে গাছে অনেক নাম না জানা পাখি কিচির মিচির করে ডাকছে কিন্তু একটুও বিরক্ত লাগছে না – না ওর চেনা নয় সে জায়গাটা,হলফ করে বলতে পারে। এখানে ওখানে ঘুরে বেড়াচ্ছে ঠাকুমার কাছে রপকথার গল্পে শোনা সুন্দর ফরসা গায়ের মেয়েমানুষ – ছোটবেলায় এই কথাটা ওর বাবার মুখে বহুবার শোনা। মাঝরাতে মদ গিলে এসে যখন ওর মায়ের গায়ে হাত তুলত ওর বাপ, রেগে গিয়ে এই শব্দটা প্রায়ই ব্যবহার করত একেবারে বেহেড মানুষটা।

মেয়েমানুষ হলেও রাজুর মা নাকি মেয়েমানুষের মত থাকত না অনেক সময় তাই বাবা মায়ের চুলের মুঠি ধরে বোঝানোর চেষ্টা করত কীভাবে মেয়েমানুষের মত হতে হয়। তখন রাজুর চারপাশে ও যেন একটা খোঁয়াড় দেখতে পেত – অনেক অনেক শূয়োর চরছে চারপাশে – কখনো কখনো ওর বাবাকেও কি দেখতে পেত ওদের ভেতর! কে জানে,ঝাপসা আলোর ভেতর থেকে ঠিক ঠাওর পেত না ও বোধহয়।

চীৎকার গালিগালাজ শেষে সব শান্ত হলে মা যখন ছড়িয়ে পড়া এলো চুল গুছিয়ে নিয়ে মাথার পেছন দিকে একটা হাত খোঁপা বাঁধত তখন রাজুর মনে হত – এতক্ষণে মা ঠিক মেয়েমানুষ হয়েছে,বাবাও আর বকাবকি করছে না। কোথা থেকে যে ঠিক সেই সময় একদল অসভ্য ছুঁচো ওর পেটের ভেতর কুচুর মুচুর করে ভেতরের দেওয়াল খামচাতে শুরু করত তা বুঝতো না রাজু। মা খিদে পেয়েছে – বলা মাত্র অন্য সময় আদর করা সেই মাই রাজুর চুলের মুঠি ধরে কাঁদতে কাঁদতে পিঠে দুম দুম কিল বসিয়ে দিত। লজ্জা পেয়ে রাজু ঘরের পেছন দিকের বাঁশবাগানে পালিয়ে যেত ওর ছোট বোনগুলোর হাত থেকে রেহাই পেতে। যারা ওই ঘটনা দেখতে পেলেই হাততালি দিয়ে ওকে খেপাত – এ মা,মেয়েমানুষ – মেয়েমানুষ।

একটিমাত্র ঘরে মা,বাবা আর দুটো ছোট ছোট বোনকে নিয়ে ওদের বস্তির সংসার। অভাবের পর্দা ঢাকা ছোট্ট সেই ঘরে থাকতে থাকতে খুব তাড়াতাড়ি বড় হয়ে গিয়েছিল রাজু। ওর বয়েসী আর পাঁচজন ছেলের থেকে চিন্তায় ভাবনায় এতটা আলাদা কী করে যে ও হয়ে উঠেছিল তা ভাবলে অবাক হতে হয় বইকী! বংশের প্রথম সন্তান তায় ছেলে – জন্মের পর ঠাকুমা আদর করে নাম রেখেছিল রাজকুমার,পরে যা হয় – সবাই ডাকত রাজু। শুধু ও এখন যে স্কুলে পড়ে তার খাতায় নামটা অপরিবর্তিতভাবে লেখা আছে ,রাজকুমার। আর একজনও এ ব‍্যাপারে ব‍্যাতিক্রম, রাজু যাকে বৌদি বলে ডাকে –

তপুদার বউ। আদর করে কখনও ওকে ডাকে – রাজু কুমার বলে,কখনওবা উল্টোটা। পড়া শেষ হলে মাঝে মধ‍্যে রাজুকে বাড়ীর ভেতরে ডেকে পাঠিয়ে কাছের দোকান থেকে এটা সেটা আনতে বলে। একরাশ তরকারী কুটতে উবু হয়ে বসা মানসী বৌদির দিকে মুখ তুলে না তাকিয়েও বেশ বুঝতে পারে রাজু ও যেন মেঝেতে পড়ে থাকা গরম ফ‍্যানের ওপর ভুল করে পা দিয়ে ফেলেছে। সামনের পাহাড়ী বাঁকে পথ হারাবার আগেই ও চায় সেখান থেকে ছুটে বেরিয়ে যেতে। কিন্তু ওর লম্বা ঝুলের হাফ প‍্যান্ট ধরেই ওকে দাঁড় করায় মানসী – কী বোকা ছেলে, পয়সা নিয়ে যাবি তো। মেঝেতে ভর দিয়ে উঠে দাঁড়ানোর মাঝে মানসীর ভারী স্তন অনিবার্য ছুঁয়ে যায় উত্তেজনায় থকথকে জেলির মত নরম হয়ে পড়া এক হাঁটু। হঠাৎ রাজু নিজেকে খুঁজে পায় চোরাবালির বিভাজিকায় বন্দী ওর।

তিন.

শরীরের ভরকেন্দ্রসূচক অংশটিকে। কী এক অমোঘ মায়ায় রাজু অনুসরণ করে মানসীকে ওর বেডরুমের ভেতর পর্যন্ত। স্খলিত আঁচল মানসী ওর ভ‍্যানিটি ব‍্যাগ থেকে টাকা বার করে রাজুর হাতে দেয়,কী কী আনতে হবে আবার বুঝিয়ে দিয়ে হঠাৎ বলে ওঠে – কী বোকা রে তুই,কত বড় হয়ে গেছিস, এখনও হাফ প‍্যান্ট পরিস – তোর লজ্জা করে না। স্কুল থেকে ফেরার সময় আসিস তোর দাদার দুটো পুরোন প‍্যান্ট নিয়ে যাস। কাচাই আছে,বুঝলি হাঁদারাম। ভেতরে ভেতরে লজ্জায় ভিজে যায় রাজু। ঘড়ির দিকে চোখ পড়তে বলে – আমি আসি বৌদি,জিনিসগুলো দিয়ে আবার স্কুলে যেতে হবে। মানসীর ফিচেল হাসি ওকে যেন নতুন করে পোড়াতে থাকে। একদিকে ভ‍্যান মালিকের মেয়ে আর একদিকে মানসী বৌদির ক্রমাগত উস্কানিমূলক আচার ব্যবহারে মাঝে মাঝে বড্ড অসহায় লাগে ওর। এক একবার ইচ্ছে করে সবকিছু ছিঁড়ে খুঁড়ে তছনছ করে দিতে। বুকের ভেতর ছটফটিয়ে মরা বলগাহীন ঘোড়াটাকে লাগাম পরাতে বেশ কষ্ট করতে হয় ওকে। অভাবের ফোঁসমন্ত্রে একসময় সব শান্ত হয়,অবশ্য ততক্ষণে রাজুর শরীরটা নিজেই নিজেকে মুক্তি দেয়। তারপর ক্লান্ত হতভাগ্য শরীরটাকে বয়ে নিয়ে চলে রাজু নয়,ওর প্রতিবিম্ব বুঝি বা।

তপুদার বাড়ী থেকে বেরিয়ে মালিকের মেয়েকে স্কুলে পৌঁছে দিয়ে তবে বাড়ীতে স্নান করতে আসার সুযোগ মেলে, তাই বিশ্রামের কোন অবকাশ পায় না রাজু। স্কুলের জন্য বেরিয়ে বকুলতলার কাছাকাছি এলেই ওর ভেতরটা কেমন এক আনচান করে ওঠে। এই মোড়টা থেকেই রূপালী রোজ ওর ভ‍্যান রিক্সার সওয়ারী হয়। এক ক্লাসে পড়লে‍ও ওর স্কুল অবশ্য আলাদা – মফঃস্বল এ শহরের নামকরা হেমনলিনী গার্লস্ স্কুলের ক্লাস নাইনের ছাত্রী রূপালী। যথেষ্ট মেধাবী হওয়ায় কাছাকাছি পাড়ার মানুষজন তো বটেই একটু দূরের পাড়াতেও লেখাপড়া করা বাড়ীগুলোর কম বেশী সবাই ওকে অন্তত নামে চেনে। আপাত শান্ত মেয়েটাকে স্কুলে এবং স্কুলের বাইরের সবাই একরকম সমীহ করে চলে বলা যায়। অথচ রাজুর ওর সাথে কথা বলতে একটুও সংকোচ হয় না। ভ‍্যান রিক্সায় ওঠার আগে রোজই একটা সলজ্জ হাসি উপহার দেয় রাজুর মুখের দিকে তাকিয়ে। তারপরই অবশ্য ঢুকে পড়ে আপন মনের রাজ‍্যে যার তল রাজুও পায় না সময় বিশেষে। গার্লস্ স্কুলের সামনে রূপালীকে নামানোর সময় ভ‍্যান মালিকের মেয়ে অযথা রাগে ফুঁসতে থাকে ওদের এতক্ষণের না বলা কথাবার্তার হদিস খুঁজে না পেয়ে। কিন্তু রূপালীর গম্ভীর মুখের দিকে তাকিয়ে চুপচাপই থাকে। প‍্যাডেলে চাপ দিয়ে রাজু এগিয়ে যায় নিজের স্কুলের দিকে। লাইব্রেরীর বই আর স‍্যারেদের মিলিত সাহায্য না থাকলে কীভাবে রাজু যে এগোত তা ভাবলে এখনও দিশেহারা লাগে ওর।

এসব নিয়ে বেশিক্ষণ ভাবাটাও আবার আদিখ‍্যেতা কারণ স্কুলের ছুটি হলেই রূপালী ও আরও কয়েকজনের সাথে ভ‍্যান মালিকের মেয়েকেও বাড়ী পৌঁছে দিয়ে তবে স্টেশান রোডে ট্রেন ফিরতি সওয়ারী ধরার পালা। সেখানেও জ্বালা কি কম! যাত্রী পাকড়াও করা নিয়ে নিজেদের মধ‍্যে গোপন রেশারেশি তো আছেই সঙ্গে ফোয়ারার মত মুখ খিস্তি। ফাঁক অবসরে সঙ্গে ব‍্যাগে রাখা বই খুলে সদ্য হয়তো বসেছে – কারণ একবার সওয়ারী পেলে আবার নিজের পালা আসতে অপেক্ষা করতে হয়। গণতান্ত্রিক পরিকাঠামো দেশের অন্য কোথাও অনুসৃত হয় কিনা তা বিশেষ জানা নেই কিন্তু ওদের এখানে অর্থাৎ এই স্টেশান রোডে সওয়ারী ধরার ব‍্যাপারে গণতন্ত্র একেবারে ষোলআনা মানা হয়। এর একটা সুফল অবশ্য আছে – কাউকেই চিন্তা করতে হয় না,যার যখন পালা আসবে সেই ঠিক সুযোগ পাবে। কিন্তু কখনও কখনও ওর কান্না পেয়ে যায়। কাকার বয়েসী মানুষ হয়ত কখনও বারোয়ারী পেচ্ছাপখানায় আড়াল খুঁজে নিজের গোপনাঙ্গ ওর হাতে ঠেসে ধরে। কখনও ওর বয়েসী কিংবা ওর চেয়েও ছোট ছেলে রাঙতা মোড়া মাদকের গুঁড়ো মেলে ধরে ওকে আগুন ছোঁওয়াতে বলে।

এতদিনে ও বেশ বুঝে গিয়েছে – এর থেকে মুক্তি পাওয়ার এখনই কোন সম্ভাবনা নেই। বাড়ীতে অনেকগুলো অসহায় মুখ ওর পথ চেয়ে বসে আছে – একথাটা কোনভাবেই ও যেন ভুলতে পারে না। তাই চাতক দৃষ্টিতে চেয়ে থাকে নতুন কোন ট্রেন আসার শব্দ শোনা যায় কিনা তার পরীক্ষায়। শেষ ট্রেন থেকে ব‍্যাপারীরা নামলে রাজুর এবং অন্যদের মুখে হাসি ফোটে,সংখ‍্যায় ওরা যে অনেক। শেষ পর্যন্ত দাঁড়িয়ে থাকা ওদের সবার ভাগ‍্যেই শিকে ছেঁড়ে তখন। এক একদিন রোজগারপাতি ভাল হলে ব‍্যাপারীরাও দরাজ হাতে বখশিস্ দিয়ে দেয় রাজুদের। তখন ওদেরকে বড় কাছের মানুষ বলে মনে হয়। আর তাই দুচোখে মানুষ হওয়ার স্বপ্ন নিয়ে ভ‍্যান রিক্সায় মানুষ টানতে থাকে রাজু ওরফে রাজকুমার।

এই বিভাগের অন্যান্য লেখাসমূহ

বালির বেহালা

বালির বেহালা

বুড়িমাসি বলেন,জীবনটা বালির ঘর গো।ঢেউ এলে ধুয়ে যায় জীবনের মায়া।তবু বড় ভালবাসা ওদের দাম্পত্যে।রোদের চাদরের…..

তদন্ত

তদন্ত

  এক ড্রইং রুমে বসে রয়েছে সদ্য কিশোর উত্তীর্ণ তরুণ গোয়েন্দা সজীব। সামনের টেবিলে ছড়িয়ে…..