প্রক্সি
তারপর ইলেকট্রিক বিল জমা দিতে যাবো। আমার দেরি হবে আসতে। স্বামী অমর বলে, ঠিক আছে।…..
ট্রেনে উঠে বসে থাকতে আজম আদিত্যের সব সবসময় বিরক্ত লাগে। সেই ছোটবেলা থেকে যখন মায়ের সাথে যেত তখন থেকে আজমের বিরক্ত লাগত ট্রেন জার্নি। মনে হতো কেন ট্রেন চলে না, কেন অপেক্ষা করতে হবে। অথচ এই অপেক্ষা করার ব্যাপারটা আবার খারাপ লাগে না যখন বিমানে জার্নি করে আজম। সেখানেও অপেক্ষা করতে হয়। কিন্তু কেন জানি বিমানের সাথে আজম এক ধরনের উচ্চ বিলাসের গন্ধ পায়। যেহেতু বিমান মাটির সাথে লেগে থাকে না, আকাশে উড়ে যেখানে সবাই যেতে পারে না, তাই বিমান হচ্ছে উচ্চ বিলাসের বস্তু।
বিমান মানেই আকাশ। আকাশ মানেই উপরে। উপরে থাকতেই আজমের আজন্ম ইচ্ছে। আর উপরে থাকা বলতে আজম শুধু টাকাই বুঝে। যত টাকা তত উপরে। এবার সে টাকা যে ভাবেই আসুক।
আজমের কাঁধে মাথা দিয়ে বসে আছে রেশমি। আজমের নিজস্ব নারী। যাকে সে পুষ্প ডাকে। যার কারণে আজমের বিরক্তিকর ট্রেন জার্নি আজ ভাল লাগছে। ট্রেন চলতে শুরু করে। আজম বুক থেকে একটা দীর্ঘশ্বাস বের হয়ে যায়।
রেশমি মাথা তুলে জানতে চায়, কোথায় যাচ্ছি আমরা?
আজম জবাব দেয়, যেখানে ট্রেন শেষবারের মত থামবে সেখানে।
ট্রেন শেষবার কোথায় থামবে?
যেখানে আমরা নেমে যাবো।
রেশমি কিছু জিজ্ঞেস করে না আর। আবার কাঁধে মাথা রেখে চোখ বুজে।
আজমের পকেটে এখন অনেক টাকা আছে বলা যায়। এই টাকায় সে নিশ্চিন্তে কয়েক রাত কাটিয়ে দিতে পারবে। টাকা গুলো তার নিজের উপার্জনের। তার বই বিক্রির টাকা। না ভুল হলো, বই বিক্রির টাকা না, পাণ্ডুলিপি বিক্রির টাকা।
সে লেখে। লেখা বেচে। মানুষ তার থেকে কিনে নেয়। এতে তার কোনও আফসোস নেই। নিজের নামের লেখা ছাপে না বলে আজমের কোনও কষ্ট নেই। পাণ্ডুলিপি বেচে যে টাকা আসে সে টাকা বই ছাপিয়ে আসে না বলে আজমের দৃঢ় বিশ্বাস।
নামে কি এসে যায়, এই রীতিতে আজম বিশ্বাসী। নামের প্রতি মোহ জন্মায়নি একেবারে সেটা বলা যাবে না। মোহ জন্মেছিল।একবার। ভেঙ্গেও যায় সেই মোহ।
একটা কাব্যগ্রন্থ লিখে জমা দিয়েছিল বন্ধু প্রকাশক আজমল শরিফের কাছে।
তুমি এটা কোনো কাম করলা আজম?
কেন কি করলাম?
আস্ত একতা কাব্যগ্রন্থ লেইখা ফেলাইলা?
কেন লেখা উচিত হয় নাই
অবশ্যই হইছে। তুই যে কেমন লেখস তাতো আমি জানি। এই বই হিট করবে হিট।
আমি সিনেমা লিখি নি, বই লিখেছি।
ওই একই। হিট দিয়েই কারবার আমাদের। আগামী মেলায় বের হবে। নো চিন্তা দোস্ত।
আজমের সেদিন খুব চমৎকার দিন কাটে।
নতুন করে স্বপ্ন দেখে, নতুন করে অপেক্ষা করে কখন সে তার বই দেখবে। স্পর্শ করবে। গন্ধ নিবে। বুকে জড়িয়ে ধরবে।
আজমলের সাথে এরপর আর তেমন যোগাযোগ হয় নি। আজম আশায় ছিল আজমল নিজেই তাকে জানাবে।
অবশেষে আজম বই মেলায় যায়। উচ্চারণ নামের স্টল খুঁজতে থাকে। সেখানেই সে হয়ত তার বইয়ের দেখা পাবে। উচ্চারণ স্টলে আজম অনেক ভীর দেখে। পাঠকের সমাবেশ দেখে আজমের ভাল লাগে। আজমলকে দেখতে পায়। এক পাল তরুণ তরুণী তাকে ঘিরে দাড়িয়ে আছে। আজম কাছে যেতেই এক ছেলে তার হাত একটা বই ধরিয়ে দেয়, বলে, ভাইয়া এই বই টা দেখেন। খুব চলতেছে। খুব ভাল লেখছে।
আজম তাকিয়ে থাকে বইয়ের দিকে। “ছন্নছাড়া ভাবনার রাশ ধরে টেনেছি”। আজমের মনে পরে এ তো তার পাণ্ডুলিপির নাম,যেটা সে আজমলকে জমা দিয়েছিল। কিন্তু সেখানে তার নামের জায়গায় আজমলের নাম লেখা। বইটি আজমলের। তার নয়।
আজম স্থির চোখে তাকিয়ে থাকে বইয়ের দিকে। তার হাত শীতল হয়ে আসে। পা শক্ত হয়ে আসে। আজমল ভিত চোখে আজমের দিকে তাকায়। তার কপালে ঘাম। সে হয়ত ভাবছে এখন যদি আজম একটা চিৎকার করে বলে এই বই আজমলের লেখা না আজমের লেখা। পরিস্থিতি কেমন হবে?
আজম এমন কিছুই করে না। সে নির্বাক কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে সেখান থেকে বের হয়ে যায়।
বইমেলা থেকে বের হয়ে আজমের মনে হয়, বইমেলা তার জন্য না। সে বইমেলার যোগ্য না।
এরপর বহু রাত সে ঘুমোতে পারে নি। রাতে একা একা রাস্তায় হেঁটেছে। দালানের সাথে গাছের সাথে ল্যাম্পপোস্টের সাথে কথা বলেছে। কিন্তু বইয়ের প্রচ্ছদে নিজের নামের জায়গায় আজমলের নাম ভুলতে পারে নি।
ভুলে যাওয়ার আগেই আজমল এসে হাজির। সে আজমকে তার অফিসে নিয়ে যায়।
গাড়িতে আজমল বলে, দোস্ত, রাগ করিস না। বইটা আমার দরকার ছিল।
আজম কিছু বলে না, সে কি বলতে পারে?
সে নিশ্চুপ বসে থাকে আজমলের গাড়িতে। গাড়িতে চড়তে তার খারাপ লাগে না।
আজমলের অফিসে গিয়ে এক কাপ চা খেয়ে আজম ৫ লাখ টাকার চেক নিয়ে বের হয়ে পড়ে। তাঁর পাণ্ডুলিপির দাম। সে অবশ্য জিজ্ঞেস করেছে আজমল বই বিক্রি করে আরও বেশি পাবে কিনা? আজমল হেসেছে। তাঁর সিগারেট খাওয়ার কালোর ঠোঁটের কুৎসিত হাসি। আজমল বিনা মূল্যে তাঁর পাণ্ডুলিপি নেয় নি। কিনে নিয়েছে। না কিনলেও পারত, সেটা তো সে করে নি। আজমল মহান।
আজম এই চেক ভাঙিয়ে প্লেনে চড়ে। প্রথমবার। সেই থেকে তাঁর আকাশে উড়ন্ত যানে চড়ার সখ জেগেছে। এবং ট্রেনকে আরও বেশি অপছন্দ করেছে।
এরপর আজমের আরও দুইজন খদ্দের হয়। সেই দুইজন তাঁকে আরও বেশি দাম দেয় তাঁর পাণ্ডুলিপির। আজমের আর্থিক কোনও চিন্তা নেই। টাকা লাগলেই সে নিজেকে বিক্রি করত বসে পড়ে। ভাবে, ভাবতেই থাকে। এরপর মগজ ফুঁড়ে বের হয় বিক্রি হওয়ার রশদ। বিক্রি করে, টাকা নেয়, ফুর্তি করে।
বহুদিন বাদে এক কবিতা সভার বাইরে আজম দাঁড়িয়ে সিগারেট খাচ্ছিল। ভেতর সভাপতি প্রধান অতিথি বিশেষ অতিথি একের পর এক বক্তব্য দিয়ে যাচ্ছে। আজম সেগুলো খুব মন দিয়ে শুনছে।
লেখার প্রশংসায় প্রধান অতিথি অনেক সুন্দর সুন্দর বাক্য ছুড়ছেন যা আজম সিগারেট হাতে এবং মুখে নিয়ে উপভোগ করছে। তিনি বলছেন, এই বইটি না লিখলে আমরা জানতামই না আব্দুল মালেকের এমন সুপ্ত প্রতিভা আছে। রাজনীতি বিষয়ে তিনি তো বিস্তর জানেনই এখন দেখি লেখালিখিতেও তিনি অসাধারণ।নেত্রীকে নিয়ে তিনি যা লিখেছেন তা পড়েই আমার চোখ ভিজে যাচ্ছে।
আব্দুল মালেকের চেহারা লালে অনেকটা টমেটোর মত হয়ে যাচ্ছে। কিন্তু আজম সেই দৃশ্য দেখতে পারছে না। আজমের সিগারেট শেষ হল কিন্তু প্রশংসার বাক্যসমুহ চলতেই থাকল।
অনুষ্ঠান শেষে খাওয়া দাওয়ার আয়োজন ছিল। আজম সুযোগ পেলো আব্দুল মালেকের কাছে গিয়ে কথা বলার।
আজমকে দেখে আব্দুল মালেক রীতিমতো ভিমড়ি খেলো।
তুমি এখানে কি করো? কে আসতে বলছে?
আজম সাদা একটা হাসি দিয়ে বলল, কেউ আসতে বলে নাই। বই প্রকাশের অনুষ্ঠান দেখতে ইচ্ছে করলো তাই আসলাম। বই তো মনে হয় ভালই হয়েছে , কি বলেন?
বই ভাল হইছে না খারাপ হইছে আমি বুঝবো। তুমি চুপ থাকো। এখান থেকে বিদায় হও।
আরে এমন করেন কেন?
এমন করি মানে? বই লেখছো টাকা পাইছো, এখন এখানে তোমার কাম কী ?
কোন কাম নাই, এমনেতেই আসছি। আচ্ছা, নাস্তা পানি কিছু আছে নাকি, দেন খাই।
কিচ্ছু নাই। তুমি বিদায় হও।
খেয়েই চলে যাবো।
আব্দুল মালেক এবার প্রচণ্ড রেগে পাঞ্জাবির পকেট থেকে বন্দুকের মাথা বের করে দেখাল। এটা খাবি? না খাইতে চাইলে বিদায় হ।
আজম চুপচাপ এক দৃষ্টে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে সেখান থেকে বের হয়ে যায়।
তার পাণ্ডুলিপির মূল্য ছিল ১০ লাখ। ১০ লাখ দিয়ে সে আজ অপমানও কিনে নিয়েছে।
সেদিন ফুটপাতে অনেকক্ষণ বসে ছিল আজম। পাশে ঘুমচ্ছিল একটি সাদা কালো কুকুর। সে কুকুরটিকে কয়েক প্যাকেট বিস্কিট কিনে খাওয়ায়। এরপর সে আজমের পাশেই ঘুমিয়ে পড়ে।
রাত গভীর হয় , রাত-মেয়েদের আনাগোনা বাড়ে।
রঙ বেরঙের পোশাকে ঢাকা হরেক রকমের মেয়ে।
আজম তাদের মধ্যে নিজেকে দেখতে পায়। এরা ভাতের জন্য শরীর বেঁচে। আজম কিসের জন্য বেচে? ওই একই টাকার জন্য। শুধু শরীর বেচলেই বেশ্যা হয় না, মনন বেচলেও বেশ্যা হয়। আজম নিজেকে বেশ্যা মনে করে চমকে উঠে। পর মুহূর্তে হেসে উঠে। তাতে কি! সে কি বেশ্যা অপছন্দ করে? না। তারা শারীরিক শ্রমিক।
আজম একজন শারীরিক শ্রমিককে সেদিন কিনে নেয়। এক রাতের জন্য মেয়েটি মাত্র ১০০০ দাবি করেছে। আজম বিস্মিত হয়।
মাত্র ১০০০? এতেই হয়ে যাবে তোমার?
মাইনষে আরও কম দেয়।
তোমার নাম কি?
রেশমি।
আসল না নকল?
এক নাম হইলেই হইল।
বেশ আমি তোমাকে একটা নাম দেই?
দেন।
পুষ্প।
হাহাহাহা, আপনি কি হুমায়ুন আহমেদ পড়েন নাকি?
আজমের রীতিমতো ধাক্কা লাগল, এই মেয়ে হুমায়ুন আহমেদ চিনে?
তুমি হুমায়ুন আহমেদ পড়ো?
পড়তাম।
এখন পড়ো না?
কি সব কথা কন আপনে। কাম করতেন না?
না।
কয় কি, তয় আছসেন কেন?
আজমের কেমন যেন বিবশ লাগে। এই মেয়ে অতি সাধারণ। অতি সাধারণ তার পোশাক, বাচন, অঙ্গ। তবু কেন যেন চোখে তাকালে ভেতরে ধক করে উঠে। কিছু যেন ভেঙ্গে যায়। কিছু যেন মোচড় দেয়। আজম বুঝতে পারে না সেটা কেন।
সারারাত তোমার সাথে গল্প করবো।
রেশমি হাহা করে হেসে উঠে। আপনে কি খোঁড়া নাকি?
আজম খোরা মানে প্রথমে বুঝতে পারে নি পরে বুঝে একটা হাসি দিয়ে তীব্র আবেগে রেশমিকে জড়িয়ে ধরে। যেন পিষেই ফেলবে তাকে। রেশমি আহ শব্দ করে একটু নড়তে চায় কিন্তু পারে না। নিজেকে ছাড়াতেও চায় না।
প্রবল আবেগে আজম রেশমির ঠোটে চুমু খায়। রেশমি মগ্নতায় অনেক ক্ষণ চোখ বুজে থাকে। যেন সে কোথাও ভাসছে। কোথাও উড়ছে। উড়ার পর ভাসার পর যখন চোখ খুলে, দেখে আজম দূরে দাড়িয়ে সিগারেট ধরাচ্ছে।
তুমি কয়েক রাত আমার সাথে যেতে পারবে কক্সবাজার? ধোয়া ছাড়তে ছাড়তে আজম জিজ্ঞেস করে।
রেশমির অবশতা কাটে না। তাও বলে, যেখানে আপনি বলবেন সেখানেই যেতে রাজি আমি।
আজম আর একবার ধাক্কা খায় রেশমির মুখে শুদ্ধ ভাষা শুনে।
সে কিছু বলে না। আজমও কিছু বলে না। সারারাত তারা একে অপরের দিকে তাকিয়েই কাটিয়ে দেয়।
কয়েক রাতের অবকাশের পর আজম নতুন খদ্দের জোগাড় করে।
নতুন খদ্দের একজন নায়িকা। উঠতি নায়িকা। এখনও বড় রোল পায় নি। পাবে পাবে করছে। ডিরেক্টরের আশে পাশে ঘুরছে। এর মধ্যে নিজের আরেক প্রতিভা দেখিয়ে দিতে চাচ্ছে। গত দুই বই মেলায় নাকি দুইখান বই বেরিয়েছে। একটি গল্পের একটি কবিতার। একটির নাম জুই পাতার কাব্য। অন্যটির নাম জানে না আজম। দেবলিনা নাম। দেখা করতে তারা একটি সুসজ্জিত রেস্তোরা বেছে নেয়। শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত লাল সোফা সমৃদ্ধ রেস্তোরা। বসে মুখোমুখি।আজম কিছুক্ষণ চুপচাপ দেবলিনাকে দেখতে থাকে। অত্যন্ত আকর্ষণীও ফিগারের সুন্দর স্বচ্ছ কাপড়ের তরুণী। চোখে মুখে দারুণ উত্তেজনা। দেখলেই তাঁকে নায়িকা করে পেতে ইচ্ছে করে।
আজম বলে, আপনাকে আগেও কি কখনও দেখেছি?
এই লাইনটি খুব বহুল ব্যবহৃত নয় কি?
না আপনাকে আগেও কোথাও দেখেছি আমি।
বিভিন্ন চ্যানেলে দেখে থাকতে পারবেন।
আপনি ইডেন কলেজে পড়েছেন?
হ্যাঁ।
আপনি সোমা সরকার?
দেবলিনা অবাক হয়। চোখ খুলে বড় করে তাকায় আজমের দিকে।
আপনি এই নাম কীভাবে জানেন?
আমি আজম। আপনাকে প্রেমের প্রস্তাব দিয়েছিলাম। টিএসসি মোড়ে দাঁড়িয়ে। মনে আছে আপনার?
না তো। দেবলিনার বেমালুম ভুলে যাওয়ার অভিনয় আজমের কাছে ভালও লাগে। সে অভিনয় জানে। শাইন করতে পারবে।
এমন একটি ঘটনা তুমি ভুলে গেলে?
তুমি করে বলছেন হঠাৎ?
তোমাকে দেখেই প্রেমে পড়ে গিয়েছিলাম। অনেক গুলো বিষণ্ণ রাত জেগে তোমাকে নিয়ে অনেক কবিতাও লিখেছিলাম। সেগুলো এক সাথে করে নিয়ে তোমাকে উপহার দিতে চেয়েছিলাম। সেদিন তপ্ত দুপুরে তুমি ক্লাস শেষ করে টি এস সি এসেছিলে বন্ধুদের নিয়ে। আমাকে তুমি প্রায় দেখো। আমিও দেখি তোমাকে। সেদিন সাহস করে তোমাকে কবিতার লেখা গুলো উপহার দিলাম। বললাম, তোমার জন্য।
তুমি হেঁসে গড়িয়ে পড়লে বন্ধুদের গায়ে। কবিতার পৃষ্ঠাগুলো ছিঁড়ে উড়িয়ে দিলে। কেন এমন করলে আমি ঠিক বুঝে উঠতে পারি নি। তোমার আমাকে পছন্দ অপছন্দ নিতান্তই ব্যক্তিগত ব্যাপার। মানা করে দিলেই হত। এভাবে ছিঁড়ে ফেললে কেন বুঝি নি।
সেদিনের পর অনেক বছর আমি ঠিক মত ঘুমোতে পারি নি। ছেঁড়া পৃষ্ঠাগুলো আমার স্বপ্নে আসত। আমি ভয়ে কেঁপে কেঁপে উঠতাম।
আজম একটা কোল্ড ড্রিঙ্ক অর্ডার করে।
দেবলিনা অসস্থি বোধ করে। সে টেবিল থেকে টিস্যু নিয়ে মুখে কি যেন মুছে। যদিও সেখানে আজম মেকআপের আস্তরণ ছাড়া আর কিছু দেখতে পায় না।
আজম বলে, তুমি অস্বস্তি বোধ করো না। আমি তোমার জন্য কাজ করে দিবো। বলো কি লেখাবে? আমি লিখে দিবো।
দেবলিনা একটু ভেবে উত্তর দেয়, আসলে এটা আমার জন্য না। আমি তো নিজেই লিখি।
হ্যাঁ তোমার এই প্রতিভার কথা সেদিন আমি জানতাম না। যে লেখে সে কীভাবে লেখার এমন অমর্যাদা করে!
দেবলিনা এবার বিরক্ত হয়। বলে, দেখো, আমি টাকা দিবো তুমি লিখে দিবে। যদি পারো তো করো, না হলে আমি উঠি।
আজম হাসে।
না না উঠবে কেন। অনেকদিন পর তোমাকে দেখেছি। তোমার কাজেও আসতে যাচ্ছি। এই সুযোগ হাত ছাড়া করা ঠিক হবে না। আর আমার টাকাও লাগবে। বলো তুমি।
আসলে এটা আমার এক ডিরেক্টরের জন্য। শাকিল ভাই।
শাকিল? ঐ যে গত বছর একটা সিনেমা বানিয়েছে, মাস্তান রাজা?
হ্যাঁ। উনি। উনি নেত্রীর উপর সিনেমা বানাবে। নেত্রীর উপর একটা লেখা চাচ্ছে। সেটার উপর উনি স্ক্রিপ্ট সাজাবে।
নেত্রীর উপর কেন?
নেত্রী খুশি হবে হয়ত। জাতীয় পুরষ্কার পাবে টাবে এই আশায়।
তাতে তোমার লাভ?
আমি জোগাড় করে দিতে পারলে আমি হবো মুল চরিত্র।
তুমি হবে নেত্রী?
হ্যাঁ কোনও সমস্যা?
আরে না সমস্যা কেন? তোমাকে বড় পর্দায় গম্ভীর কোনো চরিত্রে দেখা যাবে এ তো সৌভাগ্য।
তুমি কি লিখে দিবে না এমন হেঁয়ালি করে যাবে? তুমি সেই আজম জানলে আমি আসতামই না।
লিখে দিবো। কিন্তু জানতে চাচ্ছি শাকিল ভাই নিজেও তো আমার কাছে আসতে পারত।
না পারত না। তাতে জানাজানি হয়ে যেতে পারার ভয় আছে। মুল লেখা মুল ভাবনা স্ক্রিপ্ট সব উনার নামে যাবে।
আচ্ছা। বেশ তাহলে। কত পাবো আমি?
তুমি যা চাও।
তোমার অনেক টাকা।
না আমার না। শাকিল ভাই টাকা দিবে।
আমি যদি শাকিল ভাইয়ের নাম বলে দেই কাউকে?
তুমি বললে তুমিই বিপদে পড়ে যাবে। শাকিল ভাইয়ের অনেক পাওয়ার।
এত পাওয়ার যে নিজে লিখতে পারছে না?
তুমি লিখে দিবে কি দিবে না?
আজম হাসে। হ্যাঁ দিবো। পেয়ে যাবে।
বেশ, পাণ্ডুলিপি দিয়ে টাকা নিয়ে নিও।
অনেক রাত পার হওয়ার পর আজম ফিরে যায় রেশমির কাছে। সেই রাস্তায় তাঁকে পাওয়া যায়। পাওয়ার পর সে তাঁকে নিয়ে রাত কাঁটায়। একই ভাবে শুধু তাকিয়ে।
ভোরে সে যখন বিদায় নিচ্ছিল রেশমির কাছ থেকে, জিজ্ঞেস করলো, পুষ্প তোমাকে কোনোদিন ডাকলে তুমি কি আমার সাথে যাবে?
রেশমি তাঁকে জড়িয়ে ধরে বলে, যখনই ডাকেন, আসি না?
এই ডাক সেই ডাক না। অন্য কোন ডাক।
রেশমি ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকে আজমের দিকে।
সকালে যায় বন্ধু আজমলের অফিসে। আজমকে দেখে আজমল খুব অবাক হয়। সে আশা করে নি আজম আর কোনোদিন তাঁর কাছে আসবে।
আজম হাসি মুখে বসতে বসতে বলে, দোস্ত চা আর নাস্তা খাওয়া। খিদে পেয়েছে ভীষণ।
আজমল থতমত খেয়ে বলে, হ্যাঁ হ্যাঁ বস, আনাচ্ছি।
তুই অবাক হচ্ছিস কেন আমাকে দেখে।
না কই অবাক হচ্ছি না তো।
অবাক হোশ না। কাজে এসেছি। খাওয়া আসুক, খেয়ে বলি।
নাস্তা আসে। আজম খেয়ে একটা সিগারেট জ্বালিয়ে আরাম করে বসে বলে, দোস্ত, তোর জন্য একটা পাণ্ডুলিপি আছে। তুই তো এখন নামকরা লেখক। সেই বই তো তোকে অনেক নাম আর টাকা দিয়েছে। আমিও আমার লাভ বুঝে নিয়েছি। তাই এখন ঠিক করেছি এই করেই কামাবো। খারাপ কি। আমার তো টাকা হলেই হলো। কি বলিস?
বলেই আজম আজমলের দিকে তীক্ষ্ণ ভাবে তাকায়।
আজমল যেন নিজের কানকে বিশ্বাস করতে পারছে না।
সে হা করা মুখ নিয়েই বলে, মানে কি দোস্ত। সত্যি? আমি তো আরও ভেবে অস্থির হচ্ছিলাম যে আর বই বের করবো কীভাবে?তুই সত্যি দিবি?
হ্যাঁ দিবো। টাকা দিলেই দিবো।
আজমল রীতিমত নাচতে থাকে। টাকা নিয়ে কোন চিন্তা নাই দোস্ত। কত চাস বল। তুই যা চাইবি তাঁর থেকেও বেশি দিবো।
আগের দাম।
কোনও ব্যাপারই না। বল কবে চাস।
সাথেই আছে। টাকা দিলেই দিয়ে দিবো। আজম ব্যাগ থেকে পাণ্ডুলিপি বের করে।
আজমলের চোখ চক চক করে উঠে।
আজম চেক নিয়ে সোজা ব্যাংকে যায়। যাওয়ার আগে বলে, নেত্রীকে নিয়ে লেখা। হয়ত পুরস্কারও পেয়ে যেতে পারিস।
আজমল মনে হয় খুশিতে মূর্ছা যায়। সেটুকু দেখার সুযোগ হয় না আজমের।
আজমের কাছে এরপর অখণ্ড অবসর। সে নায়িকাকে ডাকে। তাঁর সাথে ঘুরে। তাঁকে পাণ্ডুলিপি দেওয়ার আশ্বাস দেয়। কিন্তু কখন দিবে বলে না।
অবশেষে এক রাতে সে নায়িকাকে পাণ্ডুলিপি দেয়। নায়িকা খুশিতে নেচে উঠে। আজমের সেই নাচ দেখতে ভাল লাগে। নায়িকা তাঁর দিকে গভীর আকর্ষণ নিয়ে তাকায়। তাকিয়ে তাঁকে আহবান করে। কিন্তু আজম সেই আকর্ষণ উপেক্ষা করে বলে, আমার টাকা?
দেবলিনা যেন আহত হয়। সেই আহত হওয়া চোখ দেখতে আজমের ভাল লাগে।
আজমের এই শহর আর ভাল লাগে না। এই শহরের আকাশ আর নীল হয় না। গাছেরা আর সবুজ হয় না। পাখিদের কণ্ঠ সুরেলা হয় না। এই শহরে সে আর লেখার উপকরণ পায় না। তাঁর তো উপকরণ লাগবে। উপকরণ ছাড়া সে লিখবে কীভাবে? লেখা ছাড়া সে বাঁচবে কীভাবে।
সে রেশমিকে ফোন দেয়। বলে, আজ আমি তোমাকে ডাকছি। তুমি আসবে আমার কাছে?
রেশমি মন্ত্রমুগ্ধের মত চলে আসে আজমের কাছে। তারা ট্রেনে উঠে।
ট্রেনে উঠার পর তাদের দুজনের ফোনই স্টেশনে রাখা ডাস্টবিনে ফেলে দেয়।
আজমল, নায়িকার ডিরেক্টর আর আব্দুল মালেক কোনও এক দিন এক সাথেই গ্রেপ্তার হয়। তিনজনের পাণ্ডুলিপি একই। দেবলিনার ডিরেক্টর পাণ্ডুলিপি জমা দিয়ে সরকারি অনুদানের আশা করেছিল। অনুদান পেয়েছে সে গ্রেপ্তার হয়ে।
গ্রেপ্তার হওয়ার আগে সে নাকি দেবলিনাকে ফোনে হুমকি দিয়েছে। বলেছে সে নাকি তাঁকে ইচ্ছে করে এমন নকল পাণ্ডুলিপি দিয়েছে। দেবলিনাকেও নাকি জেলের ভাত খাওয়াবে সে।
তারপর ইলেকট্রিক বিল জমা দিতে যাবো। আমার দেরি হবে আসতে। স্বামী অমর বলে, ঠিক আছে।…..
নভেম্বর চলছে। অনির সাথে আজ দেখা হবে তা জানাই ছিল। এই তো ক’দিন আগেই দেখা…..
বুড়িমাসি বলেন,জীবনটা বালির ঘর গো।ঢেউ এলে ধুয়ে যায় জীবনের মায়া।তবু বড় ভালবাসা ওদের দাম্পত্যে।রোদের চাদরের…..
এক ড্রইং রুমে বসে রয়েছে সদ্য কিশোর উত্তীর্ণ তরুণ গোয়েন্দা সজীব। সামনের টেবিলে ছড়িয়ে…..