লকডাউনের কবিতা

মাসুম মুনাওয়ার
কবিতা
Bengali
লকডাউনের কবিতা

জালালাইন শরীফ পড়ার সময় খেচতে ইচ্ছা করে

জালালাইন শরীফ পড়ার সময় খেচতে ইচ্ছা করে। তেতরিশ বছরেও আমার বিয়ে হয়নি। বিয়ের নাকি বয়স লাগে। কত বছর তা নির্ভর করে চাকরির উপর। এক বছর হয় চাকরি করি, তাও না। বলে ভালো চাকরি দরকার। সরকারি চারকি। সরকারি চারকি দূরে থাক কোনো চারকিই বাজারে নাই। যা আছে তার লাইগ্যা মামা লাগে। মামা নাই। মন চায় বউ নিয়া শুইয়্যা থাকতে। কিন্তু কি করাম চারকি নাই, তাই বিয়াও নাই।

দুইচার খান কবিতা লিখছি। বাজারে তিনটা বইও আছে। বিক্রি নাই। কবি হিসেবে খুব একটা পরিচয়ও নাই। (তবে এই নিয়া আফসোস নাই। কিছু বই যে মানুষ কিনে তাতেই খুশি।) আর কয়টা বই বেশি বিক্রি হইলে হেই ট্যাহা দিয়া হয়তো কয়ডা দিন চলা যাইতো! কবিতার বই তো চলে না। এই আবালের দেশে আঁইশঠা বেইচ্যা পেট চালানো গেলেও লেখা বেইচ্যা পেটা চালানো দায়! তাই ছোট-মুড একটা চাকরি করি। চাকরি না ঠিক মাস্টারি বলতে পারেন। পেটে-ভাতের চাকরি। কোনো মতে চলে দিন। বাপের ক্যান্সার হইছে। তারে টাকা পাঠানোর বেবস্থা নাই। বাসার সবাই বেজার। অখুশি। হেরা মনে করে ছ্যাড়াডা ট্যাহা ওড়াই। সত্যি বলতে আমার নিকট টাকা নাই, ওড়াইয়াম কইনতো? যাইহোক তবুও বিয়ে হয় না।

জালালাইন পড়ার সময় আমার হাত মারতে ইচ্ছে করে। গুণার ভয়ে ঠিক মত হাতও মারতে পারি না। ধর্মের প্রতি বিশ্বাসও আছে। হেই বিশ্বাস নানান গুণা ও জাহান্নামের ডর দেখায়। ভয়ে কাইত হইয়্যা থাকি। তবুও বিয়া অয় না।

করোনার এই কালে বাড়ি আইছি এক মাস। দুই হাজার সাতের পর এই প্রথম বাড়িতে দীর্ঘদিন একটানা থাকা। নেট নাই। বালের নেট। ফোর জি দূরে থাক কথাই কইতে তিনবার ফোন কাটে। জীবন চলে না। সময় যায় না। কাজ-কাম নাই। পড়তেও ভাল্লাগেনা। যে কয়টা সিনেমা আছিলো ল্যাপটপে হেইডিও দুইবার কইরা দেখা শেষ।

দুইডা বই আনছিলাম। একটা কফিল আহমেদের কবিতার বই। হেইডা পড়ছি কোনোরহম। আরেকটা প্রবন্ধের বই। বাংলার অধ্যাপক মোহাম্মদ আজমের লেখা ‘হুমায়ুন আহমেদ পাঠপদ্ধতি ও তাৎপর্য।’ সরস বই। এমন কইরা হুমায়ুনরে নিয়া আরেকজন কয়েকটা লেখা লেখছে। হের নাম রণি। রেজাউল করিম রণি। মানুষটা গোঁয়াড় হইলেও বেশ পড়াশোনা আছে। আজমের বইটাও ভালো। কিন্তু এরপরও আমার সঙ্কট কাটে না। হুমায়ুন আহমেদের লেখা নিয়া আমাদের সাহিত্যেকেরা যেমন আলাপ করতে চায় না এড়ায়ে যায়, তেমনি আমার সমস্যা নিয়াও কেউ কথা কয় না। পরিবার-পরিজন, সমাজ-রাষ্ট্র, সবাই এড়ায়ে যায়। ফলে আমার বিয়ে অয় না।

করোনার কালে সময় যায় না। মাঝে মাঝে মইরা যাইতে ইচ্ছে করে। আবার মরণরে খুব ভয় করে। ঢর পাই। কিতা করাম কিছুই বুঝি না। বাপটা অসুখ। ভাইটা পড়তেছে। পড়াইতে পড়াইতে বাপের সম্পত্তিও সব বন্ধক। গত মাসের বেতন পাই নাই। ঘরে টানাপোড়েন। আগামী মাসের বেতন তো পাইতাম না এইটা নিশ্চিত। করোনা হুগা মাইরা গেছে।

আর কার কি হইছে জানি না। মানসিক ভাবে সিক হইয়্যা গেছি। মানুষের সাথে কোনো যোগাযোগ নাই। কথাও বলতে পারি না। ভালো লাগে না। বাড়িতে বাচ্চাদের সাথে ‘জলে-ডাঙায়’ খেলি। চোর-পলান্তি খেলি। গাছ ঘুইর‌্যা খেলি। ভালো লাগে না। পুরান সিনেমা দেখি। বারবার দেখি। কেমন সময় এইটা। সময় যায় না। সময় খালি ঠ্যালে। ঠ্যাইলা ঠ্যাইলা পাগাড়ে পালতাছে। আর আমরা চুদে যাইতাছি। কিন্তু কাউরেই কিছু কইতে পারতেছি না। বিয়াও অইতেছে না।

এই যে আমরা কোনো রকম চলতাম, এখন চলতে পারতেছি না। বাবার চাকরি শেষ হইছে আঠারোতে। বড় ভাইটা একটা ফার্মেসি দিছে। কোনো রকম চলে। তাতে সবার খরচ হয় না। আমার বেতন নাই। ঘরে চাল নাই। ডাল নাই। তরি-তরকারি নাই। মাছ খাই না এক সপ্তাহ। পচা শুটকি, ডাল আর আলুর ভর্তা দিয়া চলতাছে কোনো রকম। এইডাও কয়দিন চলবো জানা নাই।

ঘরে টাকা নাই। বাবার চিকিৎসা বাবদ তিন লাখ ঋণ হইছে। দোকানে বাকি পড়ছে দশ হাজার। মাইনষ্যের কাছে কইতেও পারি না, কারণ মাস্টারের ছেলে। কইলে বদনাম অয়। বাবা মাস্টার। গ্রামে মাস্টারদের কিছুটা সচল ধরে লোকে। তো ত্রাণ পাই না। বিয়েও হয় না। হেন্ডেলিংও করতে পারি না।

ধর্মের ভয়, সমাজের ভয়, আমাদের পুটকি মারা। আমরা বসে বসে বাল ফালাই। বালও ছিঁড়তে পারি না। ব্যথা লাগে। কেননা ছোট বেলা থাইক্যা ব্যথা পাওন যায় এমন কাজ করি নাই। তাই সহ্য-শক্তিও নাই।।

করোনাকালের ঘটনা নিয়া বন্ধু কবিতা দিতে কইছে, কবিতাও হয় না। কবিতা লেহাম কেমনে মন তো ভালো না। কেমন অস্থির দিন পার করতেছি। মনে হয় প্রতিটা মিনিট প্রতিটা বছরের থেকেও ভারি। দিন যায় না। বিয়েও হয় না।

প্রেমিকা সন্দেহ করে। বাবা-ভাই, আত্মীয়-স্বজন সন্দেহ করে। লুকোচুপি খেলি। মজা লাগে না। গল্প লিখতে বসছিলাম কেমন সব তেতো হয়ে আসে। গুদমারানির জীবন আর ভাল্লাগতাছে না।

যারা শিল্প চুদায় তাদের ঘাড় মারতে ইচ্ছে করে। কারণ এদের লাইগ্যা নিজের মাথাটা গেছে। চাকরির পিছে দৌড়ি নাই। পড়ি নাই। সাহিত্য চুদাইছি। এখন নিজেরেই গুয়ামারা। খানকির পোলাররা ঠিকই ক্ষমতার ধোন চুইসা বিভিন্ন জায়গায় ঠিক মত বইস্যা গেছে। হেদের অভাব নাই। আমাদের গুয়ামারা সাড়া। সরকারের ঘাড় মারতে ইচ্ছে করে। নিজেরে মেরে ফেলতে ইচ্ছে করে। কিন্তু বিয়ে হয় না।

জালালাইন শরীফ পড়তে পড়তে আমার হেন্ডেলিং করতে ইচ্ছে করে। পাশে ছোট ভাইটা ঘুমায় দেখে শরমে হেন্ডেলিংও করতে পারি না। অসুস্থ একটা সময়। নিজের ভিতরে ঢুইক্যা চুপ কইর‌্যা আলাগ-ঘরে বইস্যা থাকি। বিড়িও টানতে পারি না- যদি কেউ দেইখ্যালায় এই ভয়ে। পুটকিমারার জীবন। তাই ঘরে বইস্যা বাল টানি আর ভাবি এই জনম কবে কাটবে? কবে আমার বিয়ে হবে! কবে আমি চুদে চুদে একটু সুখ নিব!

নামাজ পড়ি না দেইখ্যা মানুষ আমার দিকে চোখ লাল কইর‌্যা তাকায়

নামাজ পড়ি না দেইখ্যা মানুষ আমার দিকে চোখ লাল কইর‌্যা তাকায়। ছেলে মাদরাসায় পড়ছে নামাজ পড়ে না। হায় আল্লাহ! ছেলেটা নষ্ট হইয়্যা গেছে। আড়ালে মানুষ আরো কথা কয়। সামনে চাকরির আলাপ করে। করোনার কথা জিগায়। দেশের কথা, বৈদেশের কথা জিগায়। উত্তর দেই। শুনে চলে যায়। লাল চোখে তাকানো মানুষগুলোর মধ্যে বাপ-চাচা, ভাই-বেরাদর, পাড়া-প্রতিবেশি আত্মীয়-স্বজন সবাই আছে। কয়েকটা ল্যাংঠা কালের বন্ধু, তারা কেউ কেউ বুঝে। কেউ কেউ কাছে ভিড়ে না। কোনো কোনো বন্ধুর আবার বিশাল সংসার।

প্রকৃত অর্থে আড্ডা দেওয়ার মানুষ নাই। সবাই সংসার বাল-বাচ্চা নিয়া ব্যস্ত। কারো কারো তিন চারটা ছেলে মেয়ে। কারো মেয়ের আবার বিয়া দেওনের টাইম হইছে। হেই নিয়া অনেক চিন্তা।

গ্রামে এই কালে ভাইগ্যা বিয়া করার দুম লাগছে। অল্প বয়সে বিয়া দেওন পাপ। সামাজিক গুণা। মামলা-কোট কাচারির ব্যাপার। ভয়। কিন্তু মেয়ে তো ঘরে থাকতে চায় না। মেয়ে তো অন্যের হাত ধরে উড়তে চায়। উড়তে পারে না। বাপ-মার ভয়। সমাজের ভয়। ধর্মের ভয়। অর্থের অভাব এদেরকে শেষ পর্যন্ত পালায়ে যাইতে বাধ্য করে। পালায়ে গেলো বাপ-মা আবার সমাজে মুখ দেখাতে পারে না। তাই তারা বিয়ার কথা ভাবে। নাইন পাশের পর লুকায়া মেয়েরে বিয়া দিয়া দেয়। ভাবে অন্তত নাক কাটা থেকে বাছা গেলো। ভয়ংকর এই সমাজ।

এইসব দেখতে দেখতে ক্লান্ত হয়ে যাই। সময় কাটে না। নিজেরে আরো অবরুদ্ধ লাগে। কাউরে বুঝ দিতে পারি না। কারো কাজে লাগি না। নিজেরে অপরাধী লাগে।

মানুষ গসিপ করতে ছাড়ে না। মাসুম তো নষ্ট হয়ে গেছে। শুনলাম গাজাও নাকি খায়। এইসব শুনতে শুনতে একা একা, রাস্তায়, গাঙের পাড়ে চুপ কইর‌্যা হাটতে থাকি। দুয়েকটা বিড়ি খাই। কেউ দেখে ফেলবে এই ভয়ে শান্তিতে বিড়িও খাইতে পারি না। বালের সামাজিকতা। এইসব সামাজিকতা চুদতে চুদতে বারোটা বাজে। আমি যে বড় হইছি এইটাই কেউ বুঝতে চায় না। তো কি করা লুকায়া লুকায়া জীবন কাটাই। বালের লক ডাউন।

প্রতিবেশিরা আমার দায়িত্ব নিয়া আলাপ চুদায়। কেউ কেউ সন্তানদের পড়াইতে বলে। অঙ্ক বা ইংরেজি। পড়াইতে ভালো লাগে না। জীবনে কখনো প্রাইভেট পড়াইনি।

মন ভালো না। একাকী সময় কাটে না। চুপ থাকি। ঘুরি ফিরি। ধান খেত দেখি। নাইল্যা খেত দেখি। ধানের সাথে, পাটের সাথে আলাপ করি। সময় কাটাই।

একটা বন্য কুত্তা পাইছি হেইদিন। হেইডারে পোষ মানানোর চেষ্টা করি। পোষ মানে না। যেমনটা আমি। এইটা বাপের কয়। বাপ হেইদিন কইলো- আমি তো তোমার নিকট কত কিছু আশা করছি। তুমি তার কিছুই রাখনি। বাপের সামনে মাথা নিচু কইরা বইস্যা থাকি। কিছু কইনা। ভেতরে দহন হয়। বুঝতে দেই না। তাদের ভেতরের দহনের কথা চিন্তা করি।

প্রতিটা প্রজন্ম যে আলাদা এইটা কেউ বুঝতে চায় না। দিন কেটে যায়। মনে মনে ভাবি কোনো পুত্রই তার বাপের মত হইতে পারে না। সন্তানের যে আলাদা জীবন আছে এইটা বাপরা বুঝতে চায় না। প্রত্যেককেই আলাদা জীবন যাপন করতে দেয়া উচিত। জীবন তো একটাই। আমার কথায় কিছুই যায় আসে না। তারা তাদের কথা কয়। ভাবি করোনার কারণে যত যন্ত্রণা।

এত দিন ভালো ছিলাম। এই তের বছরে দুই ঈদ ও বড় ছুটি ছাড়া বাড়ি আসি নাই। বাড়ি কম আসতাম দেখে অপরাধবোধ হতো। যারা আমার মত এমনি বাড়ি আসে না তাদের বকতাম। এখন বুঝতেছি একবার শেকড় ছেড়ে গেলে আর শেকড়ে মিশা যায় না। খোঁয়াড়ের দিনগুলোতে বুঝতে পারছি আমার মত হাজারো যুবকের অন্তরের দহন।

বাপরা কবিতা বোঝে না। আমি কবিতা লিখি। ভাব মাড়ায়া চলি। হায়রে কবি, তোমার কবিতায় তোমার বাপের ক্ষুধা মিটে না! বাপ কাতরায়। ভাই চোখ বড় বড় কইর‌্যা তাকায়। মা দীর্ঘশ্বাস ছাড়তে ছাড়তে কয় বাজান তোর নিকট অনেক আশা। বন্ধক জমিটা ছুডায়া দে। জমিটা নিজের হাতে থাকলে কোনো রকম চইল্যা যাইতে পারি। চাউল কিনা লাগে না। বাকি বাজার সদাই নিয়া এত চিন্তা নাই।

আমি টাকা না দেওয়ার অপরাধে, ভালো চাকরি না করার অপরাধে, কবিতা লেখার অপরাধে চুপচাপ বইস্যা থাকি। ঘরে বিড়ালের মত যাই আর খাইয়্যা চইল্যা আসি। করোনা কাটে না। খোঁয়াড় কাটে না। আমিও জীবনের জল-জ্যান্ত যন্ত্রণায় কাতরাতে কাতরাতে মরি। কেউ দেখতে পায় না।

এত দিন ভাবতাম গ্রামে গিয়া এই করাম সেই করাম। অথচ কোয়ারান্টাইনের দিনগুলো যাপন করতে গিয়ে মনে হচ্ছে আমি এপাড়ার কেউ না। আগুন্তুক। বেমানান। বড্ড বেমানান। নিজেরে বেশ বিদেশি বিদেশি লাগে। বালের ভার্সিটি ১৮ বছরের গ্রামের বন্ধন ভেঙে চুরমার করে দিছে। আমি চুদে গেছি।

আল মাহমুদের খড়ের গম্বুজের নায়কের মত আমিও বেমানন হয়ে গেছি। রুচি ও আচারণের বদলের সাথে সাথে নিজেরে চিড়িয়া মনে হচ্ছে। উটকো মনে হচ্ছে।

কবে এই রক ডাউন (লক ডাউন) কাটবে? কবে জীবন ফিরে পাবো!

মাসুম মুনাওয়ার। কবি। জন্ম ১৭ ফাল্গুন ১৩৯৪, ১ মার্চ, ১৯৮৮, রাম জীবনপুর, মোহনগঞ্জ, নেত্রকোণা। প্রকাশিত বই: 'সূর্যকুসুম' (কাব্যগ্রন্থ, ২০১৬), 'জলবন' (কাব্যগ্রন্থ, ২০১৭), 'সূর্যোদয়ের দৃশ্যাবলী' (কাব্যগ্রন্থ, ২০১৯)

এই বিভাগের অন্যান্য লেখাসমূহ