লকডাউনের দিনগুলোতে নানামানুষের গল্প

সুদীপ ঘোষাল
ছোটগল্প
লকডাউনের দিনগুলোতে নানামানুষের গল্প

অবসরে

বাড়িতে বসে লকডাউনের সকালে পড়তে বসি নিয়ম করে। এই কদিনে পড়ে ফেললাম আরণ্যক, পুতুলনাচের ইতিকথা, হিঙের কচুরি আর খবরের কাগজ প্রত্যেকদিন। সত্যি আমরা পুতুল। মানুষরূপী পুতুলকে, নাচিয়ে চলেছে প্রকৃতি। কি অসহায় অদ্ভূত মানবসমাজ। সুতো বাঁধা আছে নেপথ্য নায়কের আঙুলে। যেমন নাচান তেমনই নাচি। জীবনমৃত্যুর এই দোলাচলে লকডাউনে পৃথিবী থমকে গেছে মৃত ময়ালের মত লম্বা রাস্তায়। তবু অবুঝ কিছু মানুষ অকারণে খোলা রাস্তায় লকডাউন না মেনে।
মনে মনে ভাবছি এই বুঝি এল করুণ করোনার কালো থাবা। তবু মনকে সজাগ রেখে এগিয়ে চলি সকাল থেকে দুপুর, পরিবার সঙ্গে নিয়ে নকল আনন্দে।কখনও ক্যারাম কখনও দাবা আবার কখনও বা লুডো খেলি পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে। করোনাকে কেন্দ্র করে ভাঙা, মরচেপড়া সম্পর্কগুলো সেরে উঠছে হোয়াটস আ্যপে আর মোবাইলের দৌলতে। পিডিএফ আর ই বুকে ছড়াছড়ি গল্প. কবিতা পড়তে পড়তে সন্ধে গড়িয়ে আসে। রান্নাবান্না করেন স্ত্রী। তাঁকে একটু সাহায্য করি। কথা বলতে বলতে চিন্তার মাঝে উঁকি দেয় কোভিড আতঙ্ক। জীবন কত মধুর কত সুন্দর এই ঘরে বসে টের পাই। উঠোনের জুঁইগাছে আলো করে ফুটে আছে ফুল। জবা জড়ায় উঠোনজুুুড়ে লালরঙের মাস্ক।
ছাদে থেকে দেখি, সবুজ আলে আদরমাখা পথে বড় বেজিটা লেজ উঁচু করে পার হচ্ছে আলপথ।হয়ত আমাদের আনন্দের খবর দিতে মুখ তুলে বলছে, মাভৈ। সে বোধহয় বলছে, সাবধানে পা ফেলো মানুষ। এখনও বসন্তের
বাসনা আছে পৃথিবীর হৃদয়ে…

মা

মোবাইলে ছেলেটি ফোন করল মা কে।
– মা আমি আটকে গেছি কেরালায়। লকডাউনের ফলে ট্রেন বন্ধ।
মা বললেন, আমি আসছি। ভয় নেই।
– তুমি কি করে আসবে?
– তোর বন্ধুর স্কুটি নেব। আমি যাব।
– না মা। পনেরশ কিমি কি করে আসবে? তুমি অসুস্থ হয়ে পড়বে
– কিচ্ছু হবে না।

ফোন কেটে দিলেন মা।

স্কুটি চলেছে…

এবার ফিরছে মা ও ছেলে হাসিমুখে।

ছেলে বলছে আপনমনে , নেটের কভারেজ এরিয়া মাপা যায়। কিন্তু মায়ের স্নেহের কভারেজ এরিয়া হৃদয় ছাড়িয়ে অসীম দূরত্বে চলে যায় নিমেষে…

দান

– এই যে বাবা, একটু এদিকে এস বাবা
– যাই
একজন বৃদ্ধ জানলা থেকে লকডাউনের সময় পুলিশকে ডাকছেন।
পুলিশ শশব্যস্ত হয়ে কাছে এসে বললেন, বলুন আপনার কি উপকার করতে পারি?
বৃদ্ধ বললেন, আমার প্রয়োজনে বলব। কিন্তু এই দশহাজার টাকা আমি সরকারি ত্রাণ তহবিলে দেব। এটা নাও বাবা। আমার শেষ সম্বল।
পুলিশটি তার কর্তৃপক্ষকে ফোন করে টাকাটা নিলেন।

টাকাটা রেখে পুলিশটি বৃদ্ধকে প্রণাম করলেন।বললেন, মানুষের পাশে আমরা আছি।

বিকেলের সূর্য তখন প্রায় বিদায়ের পথে…

 

চাঁদ তোকে খাই

– মা খিদে পেয়েছে। খেতে দাও
– চুপ করে বসে থাক
পাঁচ ছেলেমেয়েকে নিয়ে বিধবা মা ভাঙ্গা ঘরে পেটে গামছা বেঁধে পরে আছে।কারণ লকডাউন চলছে। খেটে খাওয়ার পথ বন্ধ।
সামনে গঙ্গা নদী। তবু জলটা আছে। কিন্তু খাবার নেই এই প্রত্যন্ত জঙ্গলের গ্রামে।
আবার মেয়েটি বলে, মা খেতে দাও। আজ চারদিন কিছু খাই নি।
– শুধু খাই খাই। মরতে পারিস না অভাগির দল। কোথায় খাবার পাব। আমাকে খা।
ছেলেমেয়েরা কাঁদতে শুরু করল। তাদের মা চিৎকার করে উঠে গলা টিপে ধরল দুটো ছেলের। একে একে পাঁচজনকে মেরে গঙ্গার জলে ভাসিয়ে দিল।
এখন মা কাঁদে আর পাগলির মত বলে, আয় চাঁদ তোকে খাই,আয় তারা তোকে খাই।

পাঠ

-করোনা রোগে মরে গেছে ফুটপাতের লোকটি।
– কি করে জানলি করোনা রোগ। তুই ডাক্তার নাকি?
– না তবে শ্বাসকষ্ট হচ্ছিল লোকটার। যারা দেখেছে তারা বলেছে।
– তারা হাসপাতালে দিতে পারেনি রোগিকে।
– কে দেবে। সবাই নিজের জীবন নিয়েই ব্যস্ত।
– চল, পুলিশকে খবর দি
– একা পুলিশই সব করবে। আমরা নাগরিক। আমাদের একটা কর্তব্য থাকা উচিত।

নিয়াজুল আর ইজাজুর কথা বলছিল মরে যাওয়া লোকটিকে নিয়ে। তারা পাঁচজন বন্ধু মাস্ক পরে, রেনকোট পরে সর্বাঙ্গ ঢেকে কাছে এসে দেখল লোকটা হিন্দু। গলায় পৈতে আছে।
তারা শবদেহ প্লাষ্টিকে ঢেকে একটা বাঁশের খাটিয়ায় তুলে নিয়ে গেল শ্মশানে।নিয়াজুল ততক্ষণে পুলিশ ডেকে এনেছে। পুলিশ আইনের দিকটা দেখল।
সেখানে দাহ করে গঙ্গায় স্নান সেরে তারা ফিরে এল বাড়ি।
নিয়াজুল বলল, বিপদের কোন জাত হয় না রে কাকা..

আইসোলেশন

ছেলেটা মন মরা হয়ে ঘ্যানর ঘ্যানর করে চলেছে। আর ভাল লাগছে না। কবে লকডাউন উঠবে বাবা। কবে নতুন পৃথিবী দেখব। পরের দিন সকালে ছেলটা বলল,
– বাবা দেখ তো কপালটা গরম লাগছে আজকে।
– ও কিছু না
– না বাবা যদি করোনা হয়?
— ওরকম মনে হয় সকলের।
তারপর রাতে ছেলেটার ধুমজ্বর এল। বাবা বেগতিক দেখে ফোন করল হাসপাতালে।
ছেলেটাকে নিয়ে যাওয়া পর আর দেখতে পায় নি ওরা। কারণ লকডাউনের আইন ভেঙ্গে করোনা রোগীর কাছে যাওয়া যাবে না।

বাবার মনে হলো, ছেলের ছবিটা কথা বলে উঠল, বাবা কবে নতুন পৃথিবী দেখব?

 

পরিযায়ী

রাজু বিয়ে করে চলে গেল কাজের জায়গা কেরালায়। মোবাইলে কথা হয় দুজনার।
– আবার কবে আসবে?
– ছুটি পেলেই চলে আসব।

– তোমাকে খুব মিস করছি
-না না আমি যাব তাড়াতাড়ি
– এবার এসে আমাকে নিয়ে যাবে বলে দিলাম।
— হুম এবার তোমাকে নিয়ে আসব। একটা আলাদা ঘর নেব। শুধু তুমি আর আমি।

তারপর দুদিন পরে করোনা মহামারীতে দেশ ছেয়ে গেল। শয়ে শয়ে মানুষ মরতে লাগল বিশ্বজুড়ে। আমাদের দেশেও লকডাউন চালু হল। ঘরে থাকতে হবে। সমস্ত যানবাহন বন্ধ।

রাজুকে মোবাইলে কল করেও পায় না কেউ। কারণ রাজু করোনা পজিটিভ হয়ে আইসোলেশনে আছে।
বাড়ির কেউ জানল না রাজু একটা সংখ্যা হয়ে উড়ে গেছে পরিযায়ী পাখির মত….

 

ভালোবাসার দেশ

আমার স্ত্রী বাজারে গেছিলেন আজ। দোকানে দড়ি দিয়ে মেপে এক মিটার দূরে ইঁট পাতা আছে।লাইন দিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন গ্রাহকরা,।পুলিশ পর্যবেক্ষণ করছেন বাজার, রাস্তা। জরুরি অবস্থায় সকলে চিন্তিত। কি করে একুশ দিন কাটবে। কাটবে ঠিকই। আবার ফুটবে ফুল। আবার হাসবে শিশু পৃথিবী। আজ ঘুম থেকে একটু দেরি করে উঠলাম।এখন সকাল নয়টা বাজে ঘড়িতে। চা মুড়ি আর প্রেশারের ওষুধটা খেলাম। সাবান দিয়ে হাত ধুয়েছি অবশ্যই।খবরের কাগজ পেলাম।হেডিং -ভালবাসার দেশ কিউবা।
করোনাভাইরাসের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে সাহায্য করতে ইতালিতে একটি বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকদল পাঠিয়েছে কিউবা। দেশটি জানিয়েছে, ইতালির অনুরোধে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক ও নার্সের একটি ব্রিগেড রওনা হয়ে গেছে। করোনায় জর্জরিত ইতালির লমবার্দি অঞ্চলে কাজ করবে তারা।

দাতা

-এই যে মাস্ক পরেন নি কেন?
– না মানে নেই
– রুমাল আছে তো
– হ্যাঁ, তা আছে
– জড়ান, নাকে মুখে
– ঠিক আছে

এইভাবে পুলিশের দল কাজ করছে।
দুজন পুলিশ কথা বলছে। একজন প্রথমে বলল,
-সমাজ সচেতন লোক যারা তারা বেরোয় না বাইরে। আর একজন উত্তর দিলো,
-দিন আনে দিন খায় তাদের তো বেরোতে হবে
– তাদের ঘরে খাবার দিয়ে আসতে হবে
– কিন্তু সবাই কি পাবে। জঙ্গলমহলে, প্রত্যন্ত গ্রামে যারা থাকে তারা কি পাবে।

দুজন পুলিশের আলোচনা শুনে একজন অন্ধলোক এগিয়ে এসে বললেন, আমার এই পাঁচশ টাকা দয়া করে সেবার কাজে লাগান প্লিজ। তার মুখে মাস্ক।
আমি বাকরুদ্ধ হয়ে জানালার ওপারে ঘরে বসে আছি আর ভাবছি কত লোককে নতুন করে চিনলাম।

এই মারণ রোগ না এলে মানুষ চেনা বাকি থেকে যেত সকলের।

মাস্ক

একটা চড় খেয়েই অমৃতা যে সত্যটা সবার সামনে প্রকাশ করে দেবে, অভিজিৎ সেটা বুঝতে পারে নি।
কয়েকদিন ধরে চর পাতাইহাটে নদীর কিনারায় তারা লুকিয়ে দেখা করত। করোনার ভয়ে এখন বাড়িতে বেরোতে দিচ্ছে না অমৃতাকে বাড়ির লোক। অমৃতার স্কুলও ছুটি। তবু সে লুকিয়ে দেখা করে অভিজিৎ এর সঙ্গে।
অমৃতার বাবা বললেন একদিন, কোথায় গিয়েছিলে তুমি। অমৃতা বলল, এক বান্ধবীর বাড়িতে দেখা করতে গিয়েছিলাম।
তার বাবা বললেন, আর যাওয়ার দরকার নেই।
অমৃতা বলল, বেশ।
অমৃতার বাবা খুব রাশভারি মানুষ। বারবার এককথা বলতে ভালবাসেন না।

কিন্তু অমৃতা এক সপ্তাহ পরে ধরা পড়ে গেল তার বাবার চর পাতাইহাটের বন্ধুর হাতে। তার বাবার বন্ধু মোবাইলে ফোন করে জানালেন, চর পাতাইহাটে নদীর ধারে তোর মেয়ে একটা ছেলের সাথে গল্প করছে। তাড়াতাড়ি আয়।
অমৃতার বাবা মটোর সাইকেল নিয়ে এলেন। খুব রেগে গিয়ে মেয়ের কাছে গেলেন। সঙ্গে সঙ্গে সুযোগ না দিয়েই এক চড় মারলেন মেয়ের গালে। তিনি বললেন, লুকিয়ে প্রেম করা। এতবড় সাহস তোর। তারপর অভিজিতের দিকে তেড়ে যেতেই অমৃতা তার বাবাকে ধরে ফেলল।সে বলল,আমি সব সত্যিকথা তোমাকে বলছি।
আশেপাশে লোকজন জমে গেছে অনেক। অমৃতা বাবার দিকে দুইহাতের তালুতে ধরা মাস্কগুলো দেখিয়ে বলল, এখানে গরীব লোকগুলো মাস্ক কিনতে পারছে না। আমি আর অভিজিৎদা একত্র হয়ে চাঁদা তুলে এই মাস্কগুলো কিনেছি, এদের বিতরণ করব বলে।
তারপর অমৃতা অভিজিতের দিকে তাকিয়ে থাকল। অভিজিৎ তখন মুখে আঙুল দিয়ে চুপ থাকার ইশারা করছে।অমৃতা চড় খেয়ে সবকথা ভয়ে বলে ফেলেছে।অমৃতার বাবা ও তার বন্ধু খুব লজ্জা পেলেন। মুখ নিচু করে বললেন অমৃতা ও অভিজিতকে,পারলে আমাকে ক্ষমা করে দিও তোমরা…

খাবার

এক বৃদ্ধা তার স্বামীকে নিয়ে টোটো খুঁজছেন হাসপাতালে যাওয়ার জন্য। তারপর তারা মাস্ক পরে রাস্তা পেরোলেন। একজন পুলিশের আই সি বললেন, আপনারা বাইরে কেন?
বৃদ্ধা উত্তর দিলেন, আমরা দুদিন না খেয়ে আছি। আমি না খেয়ে থাকতে পারি কিন্তু আমার স্বামী পারে না।
বৃদ্ধ বলেন, হাসপাতালে ভরতি হলে খাবারটা তো পাব।
অফিসার বললেন, বাড়ি চলুন। আমি আপনাদের ছেলের মত। আমি দেব আপনাদের খাবার।
বাড়িতে এসে তিনি দিয়ে গেলেন চাল, ডাল আর আলু। এক প্যাকেট সন্দেশও দিলেন তাদের।
বৃদ্ধ বললেন, তোমার কল্যাণ হোক।
বৃদ্ধা কোন কথা বলতে পারলেন না। তার চোখে তখন জল…

 

শিকল

আলো দেখলো পাশের বাড়িতে জমি জায়গা নিয়ে ঝগড়া চলছে দুই চাষীর। সে বলছে, তুই আমার আলে পা দিবি না।
আর অন্য একজন, চাষী তার গরু উঠিয়ে আল ভেঙ্গে দেয়।

আমি জানলা থেকে মুখ বাড়িয়ে থামতে বললাম,বেঁচে থাকলে অনেক জমি হতে পারে। এখন ঝগড়া করার সময় নয়।
তারা আলোর কথা শুনে ঝগড়া থামালো। জমি পরে থাকে।মানুষ চলে যায়।

একজন আলোকে মেসেঞ্জার বক্সে একটা ভিডিও পাঠিয়েছিল। আলোর কথা বলা হয়নি তার সঙ্গে। তাই সে রেগে তাকে ব্লক করে দিল।

সব ঝগড়ার সূত্র সেই ভুল বোঝাবুঝি। সময়ের ঈশারা বোঝেন কজন?

যাইহোক মেসেঞ্জার, কয়েকদিনের জন্য আনইন্সটল করে দিলো আলো। এখন একটাই চিন্তা পৃথিবীর এই কঠিন রোগ। কোভিড নাইনটিন, ভাইরাস আ্যাটাকে সারা বিশ্ব রোগগ্রস্ত। এখন দূরে দূরে থাকার সময়। দূরে থাকলে বাঁচবে জীবন, একত্রে সমাবেশ করলে মরবে।
ভাইরাস মানুষের হাতে হাতে ছড়িয়ে যাচ্ছে শিকলের মত। এই শিকল ভাঙ্গার জন্য লকডাউন

 

আলাপ

লকডাউন চলছে।
– কি রে মাস্ক ছাড়া রাস্তায় কেন?
পুলিশের একটা লাঠির আঘাতে পিঠে খুব লাগল আলাপের।
– স্যার একটু বাজার যাব। মাস্ক কিনব।
– যা কিন্তু এবার বেরোলে মার খাবি।
আলাপ বাজার করে মাস্ক কিনে মুখ ঢেকে বাড়ি এল। নিজেই রান্নাবান্না করল। তারপর দুপুরে সেই দায়ীত্ববান পুলিশের কাছে খাবার নিয়ে বলল, খেয়ে নিন। আমাদের জন্য কত কষ্ট করছেন আপনারা।
– তোমাকে চেনা চেনা লাগছে।
– হুঁ স্যার।আমি সকালের সেই মাস্কবিহীন ছেলেটা।
মাস্ক পরে আলাপ বলল, বাড়িতে আপনার কে কে আছে?
– আমার মেয়ে আর তার মা।
– কতদিন বাড়ি যান নি?
– এখন তো যাব না ভাই। আমি গেলে যদি ওদের উপর করোনার কোপ পরে? তোমার কে আছে?
– আমার কেউ নেই। আমি একা। পরিযায়ী এক শ্রমিক।বাড়ি যেতে পারি না। ঘর ভাড়া করে আছি। টাকাপয়সাও ফুরিয়ে আসছে ক্রমশ…

পাগল

নীরেনবাবু স্কুলে কাজ করেন। মাইনেও ভাল পান। বাড়িতে বুড়ি মা আছেন। নীরেনবাবু অকৃতদার। করোনার সময় মানুষ সবাই ঘরবন্দি। তাই পথের কুকুরগুলোকে ধরে বাড়িতে রাখেন,খেতে দেন।

কুকুরগুলোই তার ছেলেমেয়ে। তাদের খেতে দেন। চিকিৎসা করান। কিন্তু কাজের চাপে কুকুরগুলোকে দেখশোনার সময় পান না বেশি। এখন স্কুল বন্ধ। তাই সময় আছে।

মা বলেন, কুকুর তো প্রায় একশো ছাড়িয়ে গেল। আর কত আনবি।
নীরেনবাবু বলেন, মা তুমি আমার কাছে আছ বলে ভরসা পাই। কুকুরগুলোর কেউ নেই। কেউ লেজে পটকা বেঁধে আগুন দিত। কেউ আবার গরম ফ্যান ঢেলে দিত তাদের গায়ে। বড় নিষ্ঠুর তারা।
নীরেনের কথা শুনে তার মায়ের চোখে জল চিকচিক করে।

মা বলেন, আমিও দেখব তোর পোষ্যদের। তুই বস গিয়ে যা।
নীরেনবাবু বললেন, মা আমি স্কুল এখন যাচ্ছি না,করোনার কারণে।সরকার বন্ধ রেখেছে স্কুলগুলি।

এদের দেখব আর খেতে দেব বলে, আমিই এখন থেকে রান্না করব। তোমার তো বয়স হয়েছে। তুমি বিশ্রাম নাও আর আমার সঙ্গে থাক।

তার মা বলেন তোর মত পাগলের খুব প্রয়োজন সমাজে…

আশীর্বাদ

অনুপের মা মরে গেছেন লকডাউন পিরিয়ডে। মোবাইলে খবরটা পেল।
মায়ের কাছে তো যেতেই হবে।
বন্ধু বলল, কি করে যাবি? সব চাকা বন্ধ।
– আমি হেঁটে যাব
– এতদূর হাঁটবি কি করে?
– মায়ের আশীর্বাদে ঠিক পৌঁছে যাব।
বন্ধুও সঙ্গ ধরল।
দুজনে হাঁটতে হাঁটতে তিনদিন পরে গ্রামে পৌঁছল। তখন মায়ের দাহ কাজ শেষ।
অনুপ কাছা পরে মায়ের শ্রাদ্ধের কাজ সমাপ্ত করল।
বন্ধু বলল, মায়ের আশীর্বাদ পেলে সমুদ্রও বোধহয় সাঁতারকেটে পার হতে পারি।
অনুপ শুধু বন্ধুর কাঁধে মাথা রেখে রইল কিছুক্ষণ।

মায়ের হাসি মুখটার ছবি ভেসে উঠল অনুপের মনের আয়নায় বারবার..

লকডাউনের দিনলিপি

বারবার লকডাউন ঘোষিত হয়েছে। কাজকর্ম এখন নেই। আজ আরণ্যক নিয়ে বসেছি। পড়তে পড়তে মগ্ন হয়ে গেছি প্রকৃতির রঙে, রূপে,রসে। শুনলাম লকডাউনের আর একটা ভাল দিক উন্মোচিত হয়েছে। প্রকৃতির খোলা হাওয়ায় পশুপাখি ঘুরছে। পৃথিবী নির্মল হচ্ছে।

আবার আজ সকালে দেখলাম বইগুলো গুছিয়ে রাখতে হবে। ধুলোবালি ঝেড়ে বইগুলি তাকে আবার সাজিয়ে রাখলাম।
সপরিবারে টিভি দেখলাম। ভেঙে যাওয়া সম্পর্কগুলো সাজিয়ে নেওয়ার সময় পেয়েছি। করোনা আক্রান্ত বেড়েই চলেছে। কিছু মানুষ অনুগত নয়। তারা বাহাদুরি দেখাতে গিয়ে পুলিশের মার খাচ্ছে। করোনার ভয় কি তাদের নেই। তাদের বোঝা উচিত এটা একার ব্যাপার নয়। দশ ও দেশের সমস্যা।রোগ ছড়িয়ে পড়লে আর নিয়ন্ত্রণ করা মুস্কিল হয়ে যাবে।
আজও দেখলাম কিছু লোক মশারি টাঙিয়ে জঙ্গলে তাস খেলছে।
আজকে সকালে উঠে আমি নিজে চা বানিয়ে খেলাম। স্ত্রী ও পুত্রকে বেড টি দিলাম। কিছুতেই নেবে না। শেষে রাজী করালাম।

আজ তরকারিটা আমি রান্না করলাম। ছেলে বলল,বাবা আমিও শিখব রান্না। সেও আমাকে হেল্প করল।
পুলিশ তার ডিউটি করছে যতটা পারছে। জনগণকে আরও সচেতন হতে হবে।

 

দিন যায়

মানুষ শক্তিশালী প্রাণী। কিন্তু প্রকৃতির বিচার নিরপেক্ষ। তাই আজ উল্টোচিত্র। প্রকৃতি কি হাসছে? জানি না তবু এটুকু বলতে পারি, ভাবার সময় এসেছে। কল কারখানা, ধোঁয়া আবর্জনায় পৃথিবী কলুষিত। তাই আজ এই প্রতিশোধ।চারিদিক নিস্তব্ধ। খাওয়া আর ঘুমানো ছাড়া কোন কাজ নেই। বাজার করা, মাছ কেনা, স্কুল যাওয়া সব বন্ধ। একটা কোকিল গান শুনিয়ে চলেছে। ফিঙেটা ইলেকট্রিক তারে বসে ডাকছে। ওরা মানুষের মত স্বার্থপর নয়। তাই হয়ত গান শুনিয়ে চলেছে এই দুর্দিনে। আজকের খবরে শুনলাম, করোনাভাইরাসের জেরে ধাক্কা লেগেছে অর্থনীতিতে। লকডাউনের জেরে উৎপাদন বন্ধ হয়েছে ছোট থেকে বড় সংস্থায়।

 

করোনা ও গোলাপি চাঁদ

দুই হাজার কুড়ি সালের ৮ এপ্রিল দেখা গেছে সুপার পিঙ্ক মুন বা বৃহত্তম গোলাপি চাঁদ। এতে নাকি করোনাভাইরাসের নিধন ঘটবে বলে অনেকে মনে করছেন।
যদিও জ্যোতির্বিজ্ঞানীরা বলছেন, পৃথিবী এবং চাঁদের মধ্যবর্তী গড় দূরত্ব ৩ লাখ ৮৪ হাজার ৪০০ কিলোমিটার। চাঁদের গোলাপি আভা দেখা যাবে পৃথিবী থেকে ৩ লাখ ৫৬ হাজার ৯০৭ কিলোমিটার দূর থেকে।
অর্থাৎ ওইদিন পৃথিবী থেকে চাঁদের দূরত্ব কমে যাবে ২৭ হাজার ৪৯৩ কিলোমিটার এবং দেখা যাবে এই নান্দনিক দৃশ্য। জানা গিয়েছে, অন্যান্য দিনের তুলনায় এইদিন চাঁদের আকার ৩০ শতাংশ বড় হয়ে যায়। সুপার মুনের কক্ষপথ পৃথিবীর নিকটতম হয়। গ্রহ থেকে এই নিকটতম দূরত্বের কারণেই চাঁদকে অনেক বড় এবং উজ্জ্বল দেখায়। তবে পূর্ণিমা হলেই যে সুপার মুন হবে তা কিন্তু নয়। কারণ চাঁদ পৃথিবীর চারপাশে একটি উপবৃত্তাকার কক্ষপথে ঘোরে। পৃথিবী থেকে আরও অনেক দূরে থাকলেও পূর্ণিমার পূর্ণ চাঁদ দেখা যেতে পারে।পূর্ণিমা’র চাঁদের নামকরণের বিষয়টি সাধারণত আমেরিকান অঞ্চল এবং ঋতুগুলির ওপর নির্ভর করে। ‘গোলাপি চাঁদ’ নামটি গোলাপি ফুলের নামের ওপর ভিত্তি করে দেওয়া। এই ফুল উত্তর আমেরিকার পূর্ব দিকে বসন্তকালে ফোটে এবং এটি মোটেও চাঁদের রঙ নয়। পুরো গোলাকার চাঁদকে স্প্রাউটিং গ্রাস মুন, এগ মুন এবং ফিশ মুন নামেও ডাকা হয়। তবে, লকডাউন পুরোপুরি তোলার ক্ষেত্রে কোভিড–১৯ সংক্রমণ কী অবস্থায় রয়েছে, সেটাই যে নির্ণায়ক হবে তা স্পষ্ট হয়েছে প্রধানমন্ত্রীর গড়া টাস্ক ফোর্সের সদস্য রামন আর গঙ্গাখেড়করের কথায়। তিনি জানান, সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হল সংক্রমণের শৃঙ্খলকে ছিন্ন করা।

আলো

হাওয়াতে ভেসে চলেছেন সুদর্শন বাবু । ফুরফুরে মেজাজে তার নিত্য আসা যাওয়া কলেজের পথে ।একজন ছাত্রী তার নিত্য সাথী । ছাত্রীদের সঙ্গে কথা বলা, কলিগরা অন্য চোখে দেখে । বাঙালি একটি যন্ত্র প্রথম আবিষ্কার করে ।সেটি হলো ষড়যন্ত্র । হাসতে হাসতে বলেন কলিগদের ।

উত্তরে তারা বলেন ,সত্য উদ্ঘাটিত হোক ।

বেশ কয়েক মাস পরে একদিন কলেজ ছুটির পর পিছু পিছু কলিগরা তাদের অনুসরণ করলো । সুদর্শন বাবু ছাত্রীদের নিয়ে ঘরে ঢুকলেন কলেজ ছুটির পরে।

কলিগরা বাইরে থেকে দেখলো শিক্ষক ও ছাত্রীরা পড়াশুনোয় ব্যস্ত। তারা শিক্ষার আলোর সাধনায় নিবিষ্ট ।
অব্শ্য সঠিক সময়ে ছাত্রীটির অভূতপূর্ব সাফল্যের জন্য কলেজের সকল অধ্যাপকদের পুরস্কৃত করা হলো ।

কবি

 

যে ছেলেটা পূর্ণিমা পুকুরের জ্যোৎস্না ভিজে চাঁদ হওয়ার স্বপ্ন দেখতো সে চাঁদ ছুঁতে পারেনি।সমস্ত যোগ্যতার ফানুস সে উড়িয়ে দিয়েছিলো ঘাসের শিশিরে,বাতসের খেলায়।হেলায় সে হয়েছিলো ফাঁকা মাঠের রাজা।আলপথের মাটির গন্ধে তার যোগ্য সম্মানের ঘ্রাণ নিতো প্রাণভরে।সমস্ত চাওয়া পাওয়ার বাইরে অনুভূতির জগতে তার আসা যাওয়া।বন্ধু বলতো,তোর ধনী হতে ইচ্ছে হয় না?ছেলেটিসে বলে, তার আপন জগতে সে শুধু রাজা নয়, সম্রাট।তাই সে অবহেলায় যাপন করতো সাধারণ জীবন।সে জানে তার মত ধনী কমই আছে।বাতাসের রেণু,আকাশের হৃদয় আর সবুজের হাতছানিতে সে ছুটে চলে যেতো।সেখানে গিয়ে সে কথা বলতো আপন মগ্নতায়।

তার কথাগুলো হয়ে যেতো কবিতার পান্ডুলিপি…

ফুলশয্যা

স্বামী চলে যাওয়ার পরে একদম একা হয়ে পরেছিলেন, কবিতা। মনে পরতো ফুলশয্যা, আদর। কি করে যে একটা একটা করে রাত, দিন পার হয়ে যায়, বোঝাই যায় না। তবু বুঝতে হয়, মেনে নিতে হয়। একটা ঘুঘু পাখি তার স্বামী মরে যাওয়ার পর থেকেই এবাড়িতে আসে। আম গাছের ডালে বসে আপন মনে কত কথা বলে। ঘুঘুর ঘু,ঘুঘুর ঘু। সবিতাদেবীর সঙ্গে পাখিটার খুব ভাব।তার মনে হয় স্বামী, ঘুঘুর রূপ ধরে আসেন। তিনি আম গাছের তলায় খুদকুড়ো ছিটিয়ে দেন। ঘুঘু পাখিটা খায় আর গলা তুলে কবিতাকে দেখে । কিছু বলতে চায়। তিনি বোঝেন। আর আপনমনেই পাখিটার সঙ্গে বকবক করেন। পুরোনো দিনের কথা বলেন। ছেলের বৌ বলে,বুড়িটা পাগলী হয়ে গেছে। প্রতিবেশীরা অতশত বোঝে না। হাসাহাসি করে। শুধু তার ছেলে বোঝে মায়ের অন্তরের কথা, ব্যথা। ঘুঘু পাখিটা সারাদিন ডেকে চলে। এবার আয়, এবার আয়। কবিতার বয়স হল আশি।

একদিন সবাই দেখলো, বুড়ি ফুলশয্যার রথে শ্মশানে গেলো বোধহয় স্বামীর কাছে। ঘুঘু পাখিটা ডেকে চলেছে তখনও,, ঘুঘুর ঘু…

 

পরশ

 

দাদুর বাবার লাঠি। যত্ন করে তুলে রাখা আছে বাঙ্কে। কার জন্য? বৃদ্ধ আমার জন্য। কত সুখস্মৃতি জড়িয়ে লাঠির অঙ্গ প্রত্যঙ্গে। দাদামশাই লাঠি ধরে পথ চলতেন। লাঠিকে বলতেন, বাবা ভাল করে ধরে রাখিস। ফেলে দিস না এই বুড়ো বয়সে। কোমর ভেঙ্গে যাবে তাহলে। বিশ্বস্ত লাঠি তার দায়ীত্ব পালন করেছে পলে পলে। এবার তার নাতির পালা। করোনা রোগে দাদু মরে গেলেন।
নাতি বয়স বাড়লেই পাবে তিনপুরুষের পরশ…

 

বসন্তসময়

চন্ডীদাসের মত ছিপ ফেলে বিপিন মাছ ধরা দেখছে ফাতনার কথা ভুলে। বাউরি বৌ গুগুলি আর ঝিনুক ধরছ জলের তলা থেকে। তার সুডৌল স্তন ঝুঁকে পরেছে জল ছুঁয়ে। জল কখনও সখনও রসে ডুবিয়ে দিচ্ছে যুবতী হৃদয়। বিপিন দেখছে ভিজে নিতম্ব ফুটে উঠেছে খাজুরাহের ছবির মত। বিপিন ভাবছে ঝিনুক, গুগুলির জীবন বাউরি বৌকে স্বামী সোহাগী করে তুলেছে কোমল দেহসৌষ্ঠবের মাধ্যমে। পুকুরের পাড়ে গাছ গাছালির স্নেহচ্ছায়া। এই দুপুর হয়ে উঠেছে বসন্তমায়া। কোন এক অদৃশ্য মায়ায় বৌ মাঝে মাঝে তাকায় বিপিনের দিকে। কেউ কোথাও নেই। দুপুরের অবসর বাউরি বৌ ধরে শামুক, ঝিনুক। অলস স্বামীর খপ্পরে পরে জীবনে তার লড়াই প্রকট হয়ে উঠেছে। বিপিন বেকার যুবক। তাই ছিপ নিয়ে বসে এই সময়ে বাউরিবৌকে দেখার লোভে। সুন্দরী বাউরি বৌ ভোলে না এই বসন্তসময়। কি বর্ষা, কি শীত বা গ্রীষ্ম দুজনের বসন্তসময় কেড়ে নিতে পারে না।
আজ বিপিন জলে নেমেছে। বাউরিবৌ কাপড় ঝেড়ে জলে ধুয়ে নিচ্ছে। দুজনেই ডুবে আছে আকন্ঠ শীতল জলিয় আবরণে। জলের নিচে চলে জলকেলি। একটা পানকৌড়ি ডুবে ডুবে মাছ ধরার কৌশল দেখায় দুজন প্রেমিক প্রেমিকাকে। ছিপ ডাঙায় তুলে দেখল বিপিন একটা বড় রুই ধরা পড়েছে বড়শিতে। বাউরিবৌ সোহাগী আঁচলে তুলে নেয় বিপিনের প্রেম। করোনার ছোঁয়া কি তাদের দুজনকেই মারবে।জানে না কেউ।

বাঁচার রসদ

করোনা রোগ আসার আগে সুপার মার্কেটের পুরো গাছগাছালির আড়াল ঘিরে শুরু হয়েছে পৌষ পিঠের মেলা। এই মেলার সামনের পাড়ায় বস্তি এলাকায় কিছু গরীব সংসারের আবাস। তারা সুপার মার্কেটের সামনে থাকে এই নিয়ে তাদের গর্বের শেষ নেই। কারণ এই মার্কেট জুড়ে অনুষ্ঠিত হয় মেলা,সার্কাস আর বাজার। আর সেখানে কাজ করে তাদের ভালমন্দ খাবার জুটে যায়। শুধু বর্ষাকালে কোনো অনুষ্ঠান হয় না। তখন ঝড়ে ডালপালা ভাঙ্গে আর সেই ডালপালা নিয়ে এসে তারা বাড়িতে ফুটিয়ে নেয় দুমুঠো চাল। পুকুরের গেঁড়ি, গুগুলি তখন তাদের একমাত্র ভরসা। আজ পৌষ পিঠের মেলা। দুটি বছর দশেকের শিশু চলে এসেছে মেলায়। তাদের টাকা পয়সা নেই। ঘুরে বেড়ায় উল্লাসে। তারপর বেলা বাড়ে আর তাদের খিদে বাড়ে সমানুপাতিক হারে। খিদে নেই ওদের যারা ঘুরে ঘুরে পিঠে খায়। ফেলে দেয় অর্ধভুক্ত পিঠের শালপাতার থালা। ডাষ্টবিন ভরে যায় খাবারসহ শালপাতায়। শিশু দুটি লোভাতুর হয়ে ওঠে।
পাশে আলো মুখে একজন মহিলা এগিয়ে আসে। সে বলে, তোদের বাড়ি কোথায়। শিশু দুটি দেখিয়ে দেয় তাদের পাড়া। মহিলা বলে, আমাকে তোদের বাড়ি নিয়ে যাবি?
শিশু দুটি হাত ধরে নিয়ে আসে তাকে। পথে হাঁটতে হাঁটতে মহিলাটি বল, আমি তোদের দিদি। আমাকে দিদি বলে ডাকবি।
বাড়িতে নিয়ে গিয়ে শিশু দুটি বলে, মা মা দেখ দিদি এসেছে আমাদের বাড়ি। মা তো অবাক। তারপর জানতে পারে সব। পেতে দেয় তালপাতার চটাই। একগ্লাস জল খেয়ে দিদি ব্যাগ থেকে বের করে পিঠের প্যাকেট। সকলে একসাথে বসে খায়।

দিদি বলে শিশু দুটির মা কে, আমার ছেলেপুলে হয় নি। তোমার বাচ্চাদের দেখে চলে এলাম তোমাকে দেখতে। জানো ভগবান, সকলকে সবকিছু দেয় না। তোমাকে যেমন টাকা পয়সা দেয় নি আর আমাকে আবার সন্তান দেয় নি।
তোমার পুত্রসন্তানদের আমি আজ থেকে দেখাশোনা করব…

সস্তা

সরল দে একজন সরল মানুষ। সে সস্তায় জীবন ধারণ করার জন্য ফুটপাতের সস্তা পোশাক ব্যবহার করেন। বাড়িতে এসে জামা পরতে গিয়ে দেখে সাইজে অনেক বড় হয়ে গেছে। আবার সস্তায় দর্জির দোকানে সেলাই করে ঠিক করে জামা। আবার জামা কাচাকাচি করার পরে ছোটো হয়ে যায়। সরল সস্তায় খাবার খোঁজে। মুরগীর রোগ হলে সস্তায় কিনে খায়। সস্তার শরীর সরলের, জোর কিন্তু বাড়ে। জমিতে ফসল ফলায়। খোলা আকাশের নিচে আনন্দে থাকে। সস্তায় তার জীবন চলে বলে সকলে তাকে সস্তা সরল বলেই ডাকে। সরল এতে রাগ করে না। কারণ লোকে ঠিকই বলে। সস্তায় কোনো কিছু পেলে সে বাড়ি নিয়ে যায়। তারপর বকুনি খায়। সস্তায় একবার একটা প্যান্ট কিনে সে বাড়ি গিয়ে কাচার পরে দেখে সেটা আর পরণের উপযুক্ত নয়। তবু সে পরে। সে বলে, যতই হোক টাকা দিয়ে কেনা। একবার সরল রাস্তা ধরে হেঁটে যাচ্ছিল। হঠাৎ দেখল একটি ছেলে রাস্তায় পড়ে আছে।গায়ে তার জ্বর। দামি লোকেরা, তারা তাদের দামি জীবন নিয়েই ব্যস্ত। সস্তা জীবনের জন্য তাদের সময় নেই।
কিন্তু সস্তা সরল রাস্তায় পড়ে থাকা করোনা রোগে আক্রান্ত ছেলেটিকে হাসপাতালে নিয়ে গেলো নিজে মুখে গামছা বেঁধে। ডাক্তারবাবু বললেন,প্লাজমা লাগবে। কিন্তু আমাদের স্টকে নেই। সঙ্গে সঙ্গে গ্রুপ পরীক্ষায় সস্তা রক্তের সাথে সস্তা রক্ত মিলে গেলো। সরল তার সস্তা প্লাজমা দিলো । ছেলেটি প্রাণ ফিরে পেলো। সরল রাস্তায় নেমে আবার একটা সস্তা মূল্যে পাঁউরুটি কিনে খেতে শুরু করলো। দুপাশের মূল্যবান জীবন প্রবাহ, সরলকে দেখে হাসতে থাকলো পোকা লাগা দেঁতো হাসির মত নিয়মিত সুরে।

সবুজের ভেলা

—ওরে যাস না ওদিকে, পুকুর আছে ডুবে যাবি
—- না মা, কিছু হবে না
ছোট থেকে চিনু দুরন্ত, একরোখা ছেলে। ভয় কাকে বলে সে জানে না। এই নিয়ে তার পরিবারের চিন্তা দিন দিন বেড়েই চলেছে। এইভাবে প্রকৃতির কোলে বড় হয়ে যায় মানুষ । কত কি শেখার আছে প্রকৃতির কাছে। কিন্তু কজনে আমরা শিক্ষা নিতে পারি। কিন্তু চিনু সেই শিক্ষা নিয়েছিল। গ্রামের সকলে তাকে একটা আলাদা চোখে দেখত।বেশ সম্ভ্রমের চোখে। পরিবারের সকলে জানে না, কি করে চিনু শিক্ষা পেল। প্রথাগত শিক্ষা সে পায় নি। তবু বাড়িতে দাদুর কাছে লেখাপড়া শিখেছে। বই পড়া শিখেছে। চিনু বলত, দাদু কি করে তুমি বই পড়। আমি পারি না কেন? দাদু বলতেন, নিশ্চয় পারবি। মনে মনে বানান করে পড়বি। দেখবি খুব তাড়াতাড়ি বইপড়া শিখে যাবি।হয়েছিল তাই। দুমাসের মধ্যে চিনু গড়গড় করে বই পড়ত।কোনো উচ্চারণ ভুল থাকত না।
দুপুরবেলা হলেই চিনু বন্ধুদের নিয়ে কদতলা, বেলতলা, আমতলা, জামতলা দৌড়ে বেড়াত। কাঁচা কদ কড়মড় করে চিবিয়ে খেত। লাঠিখেলা,কবাডি সব খেলাতেই তার অদম্য উৎসাহ। গ্রামের লোকের উপকারে তার দল আগে যায়।এই দাপুটে ছেলে চিনু একদিন এক সাধুর সঙ্গে ঘরছাড়া হল। বাড়ির সকলে কান্নায় ভেঙ্গে পরলো। কিন্তু চিনুকে আর খুঁজে পাওয়া গেল না। একদিন গ্রামের একজন গিয়ে দেখল, সাধুর আশ্রমে করোনা রোগীর যত্নের, কাজ করছে চিনু.।আশ্রমটি কয়েকমাসের জন্য হাসপাতাল কতৃপক্ষ আইসোলেশন ক্যাম্প করেছে…

ইচ্ছেপূরণ

সীমার ইচ্ছে ছিলো নদী হবে। কুলু কুলু বয়ে যাবে নিরন্তর। পাড় উপচে ভাসানো ঢেউ মনে রোমাঞ্চ জাগাবে। কিন্তু কিছু লোকের বদখেয়ালে আর অর্থের লালসায় সব ইতিহাস চাপা পড়ে যায়।
মিতা তার বাল্যবন্ধু। সে বলে, চাপা ইতিহাস ফুঁড়ে বেরোয় বটগাছের রূপ নিয়ে। একদিন রোদ ছিলো, সবুজ গাছ ছিলো। কিছু কাঁটাঝোপ থাকা স্বাভাবিক। সেই বাধা পেরিয়ে অনেকটা পথ একা হেঁটেছে সীমা। সঙ্গে ছিলো অদম্য ইচ্ছে।
আজ সত্তরের তরুণী সীমা সফল। ইতিহাস কথা বলে মৃদুস্বরে। বেশ কিছু প্রকাশিত গ্রন্থে তার সমস্ত ইচ্ছে, সাধনা নিঙড়ে দিয়েছে মন।

আজ সকালেই সে পেয়ে গেলো পুরষ্কার পাওয়ার সংবাদ।

সত্য, সুন্দর জীবন জয়ের উপহার।

 

চন্দনের গন্ধ

মাষ্টারমশাই দীনেশবাবু সাদাসিধা মনের মানুষ। একটা সাধারণ প্যান্ট জামা পরে কাঁধে ব্যাগ ঝুলিয়ে ট্রেনে তার নিত্য যাওয়া আসা। ট্রেনে যাওয়ার সময় অনেক বন্ধুদের সঙ্গে আলাপ হয়। তারা হাসি মস্করায় ব্যস্ত থাকে। দীনেশবাবু নিজে জানালার এক কোণে বই নিয়ে বসে পড়েন। তিনি নিজেও অনেক বই লিখেছেন। কলকাতার নামীদামী প্রকাশনা থেকে তাঁর লেখা গ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে। কিন্তু তাতে তার কোনো অহংকার নেই। ছাত্র ছাত্রীদের কি করে ভালভাবে প্রকৃত মানুষের মত মানুষ করা যায়, এই নিয়ে তাঁর চিন্তা। শিক্ষকতা শুধু পেশা নয় তার সঙ্গে মিশে থাকে বাড়তি দায়ীত্ববোধ। তিনি এইকথা ভাবেন মনে মনে। কি করে সর্বোত্তম সেবা প্রদান করা যায়, এই নিয়েই দিনরাত চিন্তাভাবনা করেন। স্কুলে পৌঁছান। ঘন্টা পড়ে প্রার্থনা সভার। জাতীয় সংগীত শেষ হওয়ার পরে শুরু হয় ক্লাস। ক্লাসে গিয়ে তিনি কোনোদিন চেয়ারে বসেন না। ছাত্রদের কাছে গিয়ে সমস্যার সমাধান করেন। পড়াশোনার কাজে সাহায্য করেন। স্টাফরুমে বসেন। তারপর কুশল বিনিময়ের পরে তিনি চলে যান ক্লাসে। কোন ক্লাস ফাঁকা আছে রুটিন দেখলেই জানতে পারেন। কোনো শিক্ষক অনুপস্থিত থাকলেই তাঁর ক্লাসে চলে যান নিয়মিত। টিফিনে ছেলেমেয়েদের সঙ্গে সময় কাটান। সদাহাস্যময় দীনেশবাবু নিজের কাজে ব্যস্ত থাকেন সারাদিন। স্কুল থেকে ফেরার পরে নিজের লেখা নিয়ে বসেন। কোনোদিন ভাষাসদনে যান। সেখানে বন্ধুবান্ধবদের সঙ্গে সময় কাটান। তারপর বাজার সেরে বাড়িতে ঢোকেন।আমার মা বলেন, ভাল লোকের কোন পারফিউম লাগে না। তাদের গা থেকে আপনা আপনি চন্দনের সুগন্ধ পাওয়া যায়। মা আরও বলেন, ভরা কলসি টগবগ করে না।জ্ঞানী লোক কথা কম বলেন। তাঁরা প্রচারবিমুখ হন। দীনেশবাবু এর প্রকৃষ্ট উদাহরণ। কথা কম বলেন কিন্তু কর্মি লোক। লোকের ভাল ছাড়া মন্দ ভাবেন না কোনোদিন। তাঁর স্বভাব দেখলেই সকলের ভাল লেগে যায়। দীনুবাবুও এই ধরণের লোক। দীনেশবাবুকে মা আদর করে দীনুবাবু বলেন। তিনি সকালে নিমকাঠির দাঁতন ব্যবহার করেন। জনশ্রুতি আছে, বারোবছর নিমকাঠির ব্যবহারে মুখে চন্দনকাঠের সুবাস হয়। কথা বললেই নাকি চন্দনের সুবাস বেরোয়। শুনে অনেকে নিমকাঠির ব্যবহার করেন। কিন্তু মা বলতেন, শুধু নিমকাঠির ব্যবহার নয়, তার সঙ্গে মানুষকে ভালবাসতে হয়। কারও অমঙ্গল কামনা করতে নেই। মিথ্যা কথা বলতে নেই। তাহলেই মানুষের মুখে সুগন্ধ হয়। এমনকি দেহের সুগন্ধ ছড়িয়ে পড়ে দিকে দিকে। মানুষ তো দেবতার আর এক রূপ। দীনেশবাবু ছুটির দিনগুলোতে ফুটপাতের অসহায় লোকগুলোর জন্য হোটেল থেক ভাত তরকারি কিনে, প্যাকেটে ভরে তাদের হাতে দেন। তাঁর ইচ্ছে আছে গরীব লোকগুলোকে প্রত্যেকদিন একমুঠো করে মুখে অন্ন তুলে দেওয়ার।
তিনি সংসারী লোক। তাই এগোতে হবে ধীরে ধীরে।তিনি জানেন, এসব কাজে সবদিক চিন্তাভাবনা করে এগোতে হয়। তিনি ভাবেন, সামাজিক, আর্থিক, আইনগত সমস্ত দিক দেখে তবেই কাজে নামা প্রয়োজন।
আজ সকাল সকাল দীনেশবাবু ছেলেকে ডেকে তুললেন ঘুম থেকে। ছেলেকে বললেন, পড়তে বোসো বাবু। সকালে পড়া মুখস্থ হয় ভাল। ছেলে বলে, বাবা তোমার মুখ থেকে চন্দনের সুন্দর গন্ধ পাচ্ছি । দীনেশবাবু বলেন, ও তাই নাকি? তোমার মুখেও তে সুন্দর গন্ধ।রাস্তায়, স্কুলে যেখানেই দীনেশবাবু যাচ্ছেন সকলের মুখেই এক কথা,দীনুবাবু আর একটু কথা বলুন। আপনার মুখে চন্দনের সুবাস। বসুন বসুন। সকলের আদরে তিনি নিজেও যেন চন্দনের সুবাস অনুভব করছেন। আদরের আতিশয্যে তিনি খুশি।
একটি শিশু দৌড়ে তাঁর কাছে এল চন্দনের সুবাস নিয়ে। দীনুবাবু শিশুটির কপালে একটা চন্দন সুবাসের চুমু এঁকে দিলেন সস্নেহে….। করোনা ভাইরাস আসার পরে স্কুলগুলো আইসোলেশন ক্যাম্প করেছে সরকার বাহাদুর।দীনুবাবু সমস্ত সাবধানতা মেনে রোগীদের সেবা করেন।

১৮৩৫৯০০.

সুদীপ ঘোষাল। গল্পকার। জন্ম ভারতের পশ্চিমব্ঙ্গরাজ্যের কেতুগ্রামের পুরুলিয়া গ্রামে। প্রকাশিত বই: 'মিলনের পথে' (উপন্যাস)। এছাড়াও কয়েকটি গল্প ও কবিতার বই আছে।

এই বিভাগের অন্যান্য লেখাসমূহ