ঝরা শিউলি
এক মেয়েটা মুঠো মুঠো জ্যোৎস্না কুড়িয়ে অপরের মুখমন্ডলে চাঁদ দেখত। মানুষের উপকার করার ক্ষেত্রে,…..
পচাখালের ধার দিয়ে যে রাস্তাটা মুকুন্দপুরের দিকে বাঁক নিয়েছে,যেদিক থেকে নর্থের লাইন গঙ্গার গা ঘেঁষে বেরিয়ে গেছে,ঠিক সেদিকটাতেই ওরা থাকতো।রাত আটটার পর ওদিকটা শুনশান।এখানে একটা স্টেশন থেকে আরেকটা স্টেশনের দূরত্ব কম করে সাত আট কিলোমিটার তো হবেই।ঠিক মাখখানটাতেই ওদের চিটে বস্তার ঘর ছিল।সন্ধ্যার পর চোলাই মদের আড্ডা আর দু-তিনটে হিরোইন খোর ছাড়া ওদিকে কেউ ভুল করেও পথ মাড়ায় না।লোক মুখে শোনা যায় লাইনের ওপর থেকে যে হাইওয়েটি গেছে ওটা নাকি কড় খাওয়া প্লেস।ওখান থেকে বহুলোক চলন্ত ট্রেনের ওপর ঝাঁপ মেরেছে।ওটা নাকি একটা সুইসাইড স্পট।
ওদের পরিবার বলতে মা বাবা আর তিন বছরের মেয়ে ইমলি।আধো আধো মিষ্টি সুরে কথা বলে।আমি অফিস ফেরত প্রায়শই ঐ ট্রেন লাইনের পথ ধরে বাড়ি ফিরি।আমার আকর্ষণ ঐ পুচকিটার ওপর।দু-পাঁচটাকার চকোলেট দিলেই কটকটির কথা বলা শুরু হয়ে যায়।ওই পাকাপাকা কথা শোনার জন্যই ও পথ দিয়ে ফেরা।ওর মা ওকে পিঠে বেঁধে লাইনের ধারের জলা থেকে শাক পাতা তুলে স্টেশনে বিক্রি করে।ইমলিরা শুনেছিলাম পরিযায়ী।ওরা শীতকালে ওদের রাজ্যে চলে যায় আর গরম কালে কোলকাতায় ফিরে আসে।ওর বাবা এপাড়া ওপাড়া ঘুরে ফালুদা বিক্রি করে।
ইমলির মাথা ভর্তি চুল।টুকটুকে মেয়েটার ঘাড়ের দু-পাশ থেকে ফিনফিনে বেণী।কী যে মিষ্টি হাসি –সে যে না দেখেছে সে বিশ্বাস করবে না।মা বাবার ও আধভাঙা বাংলা ভাষা রপ্ত করে নিয়েছিল।আমি ওদের ঘরের সামনে দাঁড়ালেই ওর মা বলতো, ইমলি…ও ইমলি…বাহার আও বিটিয়া।দ্যাখো লজেন্স ওয়ালা আঙ্কেল আয়া হে।ওমনি চিটে ঘরের ফোঁকর থেকে এক টুকরো চাঁদের আলো খিলখিল করে উঠতো।উফফ সে কি পাকা পাকা কথা।সত্যিই পৃথিবীতে সব বাচ্চাই এক।কত নিষ্পাপ।কত মায়ার…।
সে বছর মার্চ মাসে করোনার জন্য কেন্দ্রীয় সরকার লকডাউন ঘোষণা করলো।ইমলির মা বাবা রাতারাতি বোঁচকা বেঁধে ইমলিকে নিয়ে হাঁটতে শুরু করে।আমি অবশ্য জানতে পেরেছি অনেকদিন পর।লকডাউন ভাঙল প্রায় তিনমাস পর।সেদিন অফিস যাওয়ার পথে ইমলিদের ঘরটার সামনে থমকে দাঁড়ালাম।দু-একবার হাঁক পারলাম –ইমলি…।
কোথা থেকে এক মাতাল এসে বলে গেল,ওরা তো লকডাউন পায়ে হেঁটেই ভেগেছে গো।
আমি আশ্চর্য হলাম।পায়ে হেঁটে এতদূর!ইমলির জন্য বুকটা কেঁপে উঠলো।ঐটুকু মেয়ে।এতটা রাস্তা।ইসসস…
এরপর অনেকদিন কেটে গেছে।এখনো নিয়মিত অফিস যেতে হয়।করোনা আর গেল না।তবে আগের মত অতটা মারমুখী নয়।মাস্ক জীবনের নিত্য সঙ্গী হয়ে গেল।করোনা হয়েছে গৃহপালিত বাঘ।মানুষ আর বাঘ এখন একসাথে ব্যালেন্স করে বাঁচতে শিখে গেছে।উল্টোপাল্টা হলেই বাঘ এসে ঘ্যাচ করে ধরে।
এর মধ্যে একদিন অফিসে তাড়াতাড়ি ছুটি হয়ে যাওয়ায় বহুদিন পর লাইনের ধার দিয়ে বাড়ি ফিরছি।দূর থেকে দেখতে পেলাম মাটির সাথে মিশে যাওয়া ইমলিদের ঘরটা কে যেন আবার তাজা করে তুলেছে।দ্রুত পা চালিয়ে ঘরের কাছে এলাম।
আরে চাচি না! হ্যাঁ তো।ইনিই তো ইমলির মা।স্বপ্ন!পুরো স্বপ্ন দেখছি যেন!
ইমলির মা আমাকে দেখে আমার কাছে এগিয়ে এলেন।
—-তুমি সেই লজেন্সওয়ালা বেটা না!
—-চাচি তোমরা!
—-এই তো দু-দিন হল এসেছি গো।আর কতদিন চলবে বোলো।বিক্রি বাট্টা না হলে তো ভুখা মরবো!এই তো গরম পড়েছে।তোমাদের শহরে এটাই তো আমাদের সিজন গো।
আমার মন খারাপ হয়ে গেল।ওরা কেউ নয়।আপন জনও নয়।তবু যেন পুরোনো স্মৃতিগুলো ফিরে আসতে লাগল।ইমলির মা অনেকটা শুকিয়ে গেছে।বয়সের ছাপ,চোখের কোণে কালি সব মিলে মিশে একাকার।কিন্তু মাথায় ঘোমটা এখনো বর্তমান।
আমি খুব উচ্ছাসের সাথে বললাম,ইমলি!পুচকিটা কেমন আছে?
—ও কি আর পুচকি আছে বেটা।সে ইমলি এখন অনেক সেয়ানা হয়েছে।তাকে দেখলে তুমি চিনতে পারবে না!
—কই ও?ওকে ডাকো।বলো, লজেন্স আঙ্কেল এসেছে।
—ঘুমোচ্ছে বেটা।এই সবে শুলো।
—আচ্ছা আচ্ছা থাক।আমি তো এই পথেই ফিরি।অন্যদিন না হয় দেখে যাব।সেদিন ওর জন্য অবশ্যই চকোলেট আনবো।আচ্ছা চাচি, তোমরা সব গেলে কি করে! এত দূরের পথ!
—সে অনেক বাত আছে বেটা।মুলুক মে ইমলির দাদু নানী আছে।তাছাড়া এখানে তো আমাদের কিছু ছিল না।আজ না কামালে কাল কি খাবো উসকে সোচ্!কতদিন আর লোকে দিত বোলো!আমাদের যে করেই হোক যেতে হতো।
—সে তো ঠিকই।আমার শুধু ইমলিকে নিয়ে চিন্তা ছিল।কত ছোট্ট ও!
— ওকে নিয়েই ভুগেছি বেটা। ইমলির মা দীর্ঘশ্বাস ফেলল।
যেন কত স্মৃতি চোখের সামনে মুহূর্তে ভেসে উঠল।একটা কাঠের পিঁড়ি দিয়ে আমাকে ঘরের সামনে বসতে বলল।
—বৈঠো …বৈঠো… তোমার অনেক বড় দিল বেটা।একথা আমাদের জন্য কেউ ভাবেনি কখনো।এই তুমিই পথ্যম পুছলে।বৈঠো এই পিঁড়িতে।ইমলির পাপাও ঘুমোচ্ছে।এই ফাঁকে তোমার সাথে দুঠো মনকি বাত বলি।
বসলাম কিছুক্ষন।বলতে বলতে ইমলির মায়ের কোঁচকানো চোখের কোণে মুহূর্তে জল চিকচিক করে উঠলো।বলতে বলতে কোথায় যেন হারিয়ে গেল অবাঙালি মহিলাটি…
—হাঁটছি হাঁটছি।ইমলিকে ওর পাপা কোলে নিয়ে হাঁটছে।পিছে আমি।দিন যায় ।রাত যায়।আমরা হেঁটে চলি।কেউ একদিন রাস্তার মাঝে একটু খাবার দেয়।কেউ আবার লাঠি উঁচিয়ে তাড়া করে।রাতের বেলা ভুখাই ঘুমিয়ে পড়ি।ইমলিটাকে কিছু দিতে না পারলে খালি কাঁদে।ও ঘুমোয় না।আমি ওর বাপকে বলি আর কতটা পথ বাকি? ওর বাপ খালি বলে সবে তো একশো কিলোমিটার হলো…সবে দুশো কিলোমিটার হলো…আমরা হাঁটছি আর হাঁটছি।ইমলিটা ধূপে আস্তে আস্তে ঝিমিয়ে পড়ে।রাতে আবার তাজা হয়ে যায়।রাতে কোনো স্টেশন দেখে ঘুমিয়ে পড়ি।
হাঁটতে হাঁটতে পাঁচদিন হয়ে গেল।ইমলির বাপের পায়ে আর কুছু নেই।জুতো ছিঁড়ে পায়ের চামড়া ফালা ফালা হয়ে গেছে।আমারও শরীরে আর কুছু নেই।সেদিন রাতে লাইনের ধারে উঁচু একটা জমি পেলাম।চারিদিকে গাছপালা।দূরে কোথাও কোনো জনমানুষ্যি নেই।তার আগের দিন পেটে কোনো দানা পানিও পড়েনি জানো!কে দেবে?চারিদিকে কেবল ধু-ধু মাঠ আর জঙ্গল।ইমলিটা খালি মরা কান্না কাঁদে।কাঁদতে কাঁদতে বেটি আমার ঝিমিয়ে গেল।আমিও আর পারছি না।ইমলির পাপাকে পুছলাম, মুলুক যেতে অউর কিতনে দিন বাকি?ও বলল,এখনো বহুত দিন বাকি।এখন না যাবে পিছে হটা অউর না যাবে সামনে তোমার কাকু আমাকে বলল,চলো ইমলির মা আমরা গলায় ফাঁস লাগিয়ে দিই।আমার চোখে আর পানি নাই।আমি পুছলাম,ইমলির কি হবে!ওর বাপ বলে বেটি আমার এমনিতেই মরে যাবে।ওকে একা রেখে গেলে শিয়াল কুকুরে ছিঁড়বে।তার চেয়ে এখন ও নিন্দ মে হ্যায়।চলো আগে ওর গলায় ফান্দা ডালি, উসকে বাদ আমাদের!আমি বেটির মুখটা ভাল করে দেখে নিলাম।বেটি আমার খিদেয় ঘুমিয়ে পড়েছে।এ বুকে একটুও দুধ নেই যে ওকে পিলাবো।হা খুদা!তোর কোনো দিল নাই!তোর কোনো দিল নাই…।
আমি ইমলির পাপাকে বললাম,আমি পারবো না।ইমলির বাপের চোখ চকচক করে উঠল।ফিসফিস করে কানের সামনে এসে বলল,এ বাত ঠিক আছে।ঝপ করে পোটলা দিয়ে দুঠো শাড়ি আর একটা মাফলার বার করলো।আমি আর কোনো দিক দিকে তাকালাম না।একটা শাড়ি ওর বাপের হাত থেকে টেনে পাশের গাছটায় লটকে দিলাম।
—আর ইমলি?ইমলির পাপা…?
আমি রুদ্ধশ্বাসে বলে উঠি।
—ও তো ঘরমে।আভিভি খেলছে ওর বাবার সাথে।এসো… ভিতরে এসো…
বলতে বলতে ইমলির মা মুহূর্তে ঘরে ঢুকে গেল।আমিও দিকভ্রান্তের মত ইমলির মার পেছন পেছন ঐ চিটে বস্তার ঘরে।
দেখি,কেউ কোত্থাও নেই…কেবল একটি চিৎকার ভেসে আসছে।
—পাপা …মুঝে মত মারো, পাপা… মুঝে ছোড় দো…ছোড় দো পাপা…
আমি কোথায় ছিলাম!পলকে আমার হুঁশ এলো।আমি এখনো সেই লাইনের ধারে দাঁড়িয়ে।মাথার ওপর অনন্ত আকাশ।কোথায় সেই ঘর!কোথায় ইমলির মা!কোথায় সব…কোথায়…
এক মেয়েটা মুঠো মুঠো জ্যোৎস্না কুড়িয়ে অপরের মুখমন্ডলে চাঁদ দেখত। মানুষের উপকার করার ক্ষেত্রে,…..
শেষ থেকে শুরু। আমি রজকিনী রামী,ধোপার বংশে জন্ম আমার।ঘাটে সখিদের সঙ্গে কাপড় কাচি। একাজটা আমি…..
মালঞ্চার পথে ভোরবেলা। সূর্য সবে উঠছিল। বৈশালী দূর থেকে দেখতে পেল,বুনিয়াদপুর বাসস্ট্যান্ডে বালুরঘাটের দিকে মুখ…..
আমার বাবা ছিলেন অত্যন্ত সাহসী একজন লড়াকু মনের মানুষ।শত অভাব অভিযোগেও তাকে কোনোদিন ভেঙ্গে…..