লরেন্সের সঙ্গে দেখা

হামিম কামাল
প্রলাপ, মুক্তগদ্য
লরেন্সের সঙ্গে দেখা

তিনতলা লাল ইটের দালান

আমার শৈশব কৈশোরের স্কুলটার একটা বর্ণনা দেওয়া যাক। অবশ্যই প্রাসঙ্গিক। একটা শব্দও অকারণে পড়াব না আপনাদের।

একটা তিনতলা লাল ইটের দালান ওটা, পাচিলের মতো টানা। তার সামনে একসার দেবদারু গাছ পাতায় পাতায় ঝাঁকড়া হয়ে আছে। স্কুল ভবনের পেছনে আম কাঁঠাল আর মেহগণির ঘন বাগান। যত্নপরিত্যক্ত।

একটা পুরনো মেশিনঘরের ধ্বংসাবশেষ ছিল এক কোণে, দেয়াল ফুঁড়ে বেরোনো পুষ্ট একাধিক অশ্বথে ছাওয়া। ওপরের ক্লাসের ছেলেরা ওখানে লুকিয়ে সিগারেট খেতো, কেউ দেখতে পেতো না।

যারা পেত, স্যারের কাছে বলে দেওয়ার সাহস তাদের ছিল না।

স্কুলের সামনে বিরাট মাঠ। এক সেকেন্ড। মাঠ কি তাকে বলা যায়? লাল ইটে ছাওয়া তার মাটি। তবে পূর্বকোণে ইটের বিস্তার শেষ, সেখানে কালো মাটির উঠোন। তার মধ্যখানে এক বয়েসী বটগাছ।

গাছের স্ফীত, কালো ঝুরিগুলো কেটে ফেলা হয়েছিল। নতুন ঝুরি নামতে শুরু করলে সেগুলোও কেটে দেওয়া হতো, নিত্য। লোক ছিল দেখভালের।

গাছের নিচটা ছিল উঁচু করে পাকা করা। তার ধূসর মসৃণ তলের ওপর বটফল পড়ে থাকত। আমি একদিন মুখে দিয়েছিলাম, উদ্ভট। চারপাশের পাখিগুলো মুখে পুরত টপাটপ। লাল রকম সব ফল, ভাঙলে ভেতরের হলুদ শাঁস বেরিয়ে পড়ত।

উঁচু করে পাকা করা জায়গাটায় উঠে আমরা নিচে পা ঝুলিয়ে বসতাম। স্কুলের বার্ষিক সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের মঞ্চটাও হতো ওখানেই।

লাল এই ভবন স্কুলের নিজস্ব ছিল না। দুধ পাস্তুরায়িত করার এক বিখ্যাত কারখানার ভবন ছিল ওটা। ভাড়া নিয়ে বসেছিল আমাদের স্কুল।

অবশ্য স্কুলের মূল অংশ ছিল নিজস্ব ভবনে। আমি পড়তাম শাখায়। ছাত্র ছাত্রী বেড়ে যাওয়ায় মূল থেকে একটা শাখা বেরোনো অনিবার্য হয়ে পড়েছিল।

শাখা স্কুলে পড়তাম এ নিয়ে আমার ভেতর মৃদু হীনমন্যতা কাজ করত। বার্ষিক কোনো অনুষ্ঠানে মূল স্কুলের ছেলেমেয়েদের কেউ খানিকটা ব্রাত্য জ্ঞান করে তাকালে ভেতরে আমি কুঁকড়ে যেতাম।

স্কুলের মাঠ শেষ হতেই কারখানার মূল অংশের সীমানা শুরু।

ওই সীমানাকে ঘিরে উঁচু দেয়াল তুলে দেওয়া ছিল। সাদা রঙ করা দুই মানুষ সমান উঁচু এক দেয়াল। তার এপাশে দাঁড়িয়ে আমি কেমন অসহায় বোধ করতাম।

ওপারে যাওয়ার উপায় একেবারে যে ছিল না, তা না। ছিল, তবে প্রশস্ত নয়, বরং সংকীর্ণ উপায়। একজায়গায় দেয়ালের মধ্যখানে একটা ছোট পকেট গেট মতোন ছিল। তার ওপারে যেন স্বর্গ দেখা যেত; আমাদের চোখে।

প্রহরাবিহীন সেই পকেট গেটটা মাঝে মধ্যেই আমরা খোলা দেখতে পেতাম ঠিকই, কিন্তু ওটা পেরিয়ে ওপারের রহস্যের জগতে ঢুকে পড়ার সাহস ঠিক জমিয়ে উঠতে পারতাম না।

অরণ্যে প্রবেশ

একদিন আমি আর আমার বন্ধু জামি সেই ছোট্ট দরজা পেরিয়ে ওপারে চলে গেলাম।

গিয়ে দেখি ইটবিছানো বিরাট এক রাস্তা পূর্বে পশ্চিমে অনেক দূর পর্যন্ত চলে গেছে। রাস্তার ওপারে সেই ‘অরণ্য’।

রাস্তার ওপর পিঠে বন্দুক নিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে নিরাপত্তারক্ষী। প্রথম দিন ওরা আমাদের কেন যেন গ্রাহ্য করল না। আমরাও যেন স্বরাজ পেলাম।

ফলে যা হলো, দ্বিতীয় দিনই আমাদের তাড়াতে তেড়ে এলো।

‘কেন এসেছ তোমরা! রোল কত, কোন ক্লাস! ’

আমরা তখনও এতোই ছোট যে কারো হুমকিতে দিব্বি কাজ হয়। সীমানা পেরোনো বিপ্লবীরা সুড়সুড় করে আবার স্কুলের দেউড়িতে ঢুকে পড়লাম।

ঢুকলাম ঠিকই, কিন্তু মনটা পড়ে থাকল ওপারেই। কারণ চোখের সামনে ভাসছে তখন ওপারের রহস্যঘন বন।

বনটা কৃত্রিম। কারখানালগ্ন অংশে একটা বড় আকারের কৃত্রিম বন রাখা বাধ্যতামূলক ছিল। সেই নিয়ম হয়তো এখনো আছে। তবে নিয়তি আর নেই। বনের কৃত্রিমতা তো আর বোঝার বয়স হয়নি তখনো। কিন্তু আদিম জীবনের যে ডাক মনের গভীরে একবার উঠেই থেমে গেছে, তার অনুরণন অনুভব করতে পারি।

মনে হতো ওটাই যেন আমাদের প্রাপ্য পৃথিবী। ওখানে তাবৎ বিস্ময় অশাসিত আস্ত এক রাজ্য নিয়ে আমাদের অপেক্ষায় আছে।

আমরা গেলে যে বনটা ভারি খুশি হতো, তা স্পষ্ট বুঝতাম। আমরা ওই ছোট্ট পকেট দরজার এপারে পা রাখামাত্র এক ঠা-া বাতাস উত্তর দক্ষিণ হয়ে ছুটে যেত।

কিন্তু কারখানার নিরাপত্তারক্ষীরা ছিল নীল পোশাক পরা বয়স্ক কঠিন মনের মানুষ। তাদের যে মুখের কথায় কিছু বোঝাব, তার আবেগটুকু থাকলেও বেগটা জড়ো করতে পারতাম না। ভাষাও নয়।

ভাষাহীন আবেগ বুঝকে কে? ওরা তো আমাদের মা নয়, ভবিষ্যতের প্রেয়সীও নয়।

তবু আরো বেশ ক’বার আমরা লুকিয়ে বনের কোলে ঝাঁপ দিয়েছিলাম। ইচ্ছে ছিল একদিন তার শেষ ছোঁব। পারিনি। তবু আশার স্পর্ধা যে আমরা করেছিলাম, সেটিই এখনও মনে শক্তি জোগায়।

কী কী গাছ ছিল ওখানে?

তখন তো পরিচিত নাম কেবল আম আর জামের ভেতর সীমাবদ্ধ। এখন মনের পর্দায় দেখে অসংখ্য কৃষ্ণচূড়া, বানরলাঠি, শাল, সেগুন, ওলটকম্বল যেন চিনে উঠতে পারি।

বনের মাটি ঢাকা ছিল বড় বড় ঘাস আর আদিম ফার্নে। একটা সরু নর্দমা ছিল, যার গায়ে পিঁপড়ের অট্টালিকা মস দেখেছি আমরা। তার স্বচ্ছ ডাঁটার খুব কাছে চোখ নেওয়ার মতো অবসর ছিল না। তাড়াতাড়ি বন ছাড়ার তাড়া ছিল, তাই।

পরবর্তীতে জীববিজ্ঞানের বইয়ে মস, ফার্নের ছবি পেয়ে আমি আর জামি যখন চোখে চোখে তাকিয়ে শিহরিত হচ্ছি, অন্যদের চোখ তখন একেবারেই ভাষাহীন। নির্লিপ্ত মুখে ওরা বইয়ের পাতা উল্টে যাচ্ছে।

হঠাৎ একদিন

স্কুলের এমন রহস্যময় নিষিদ্ধ বন আমার স্বপ্নে দেখা দিতো। একজন কিশোর যে বনে তার অধিকারটি টের পাচ্ছে, কিন্তু পাচ্ছে না প্রবেশাধিকার। স্বাভাবিকভাবেই সেই অসাম্য তার অবচেতনকে অধিকার করবে। আর স্বপ্ন করতে চাইবে তার সমতাবিধান।

স্বপ্নে, সেই বনে, একদিন নিজেকে আমি নগ্ন দেখতে পেলাম।

স্বপ্নে নিজেকে নগ্ন দেখেছেন অনেকেই। আমি অনেকবার দেখেছি। স্বপ্নের ভেতর কখনো সখনো লজ্জিত হয়েছি খুব। কিন্তু বেশির ভাগ সময়ে অস্বাভাবিকতার, অসম্মানের কোনো বোধই জাগেনি ভেতরে। মনে হয়েছে, এ-ই তো দিব্বি স্বাভাবিক।

ওই সব স্বপ্নে আমার কিশোর পেলব দেহ তার বাদামি ত্বকে সূর্যের আলোকে প্রতিফলিত হতে দিয়ে, নির্বিকার চিত্তে অজস্র ছাত্রছাত্রী আর শিক্ষক শিক্ষিকার ভেতর ঘুরে বেড়াত। এসেম্বলিতে শপথ পাঠ করত, বন্ধুর সঙ্গে বনের শেষ খুঁজে বেড়াত! সবচেয়ে বেশি যা হতো, অরণ্যের শেষপ্রান্তে এক ছড়ার পাশ গিয়ে দাঁড়াত।

বাস্তবে সেই ছড়া ছিল কারখানার বর্জ্যবহ নর্দমা। কিন্তু কিশোরের স্বপ্নকল্পনার তার রূপ মন্দাকিনীর চেয়ে কম ছিল না।

তেমনই এক অরণ্যফেরত স্বপ্নে হঠাৎ এক লোকের দেখা পেলাম।

তিনি যে আমার শিক্ষকদের কেউ, স্বপ্নে এ বিষয়ে আমার কোনো সন্দেহ ছিল না। কিন্তু তাকে চিনতে ব্যর্থ হলাম। কেন হবেন না তিনি ডি এইচ লরেন্স?

আমি অরণ্যে। নগ্ন।

নির্বিকার এবং স্বাভাবিক।

আমার ধারণা, তাঁর সঙ্গে দেখা হওয়ার জন্যে ওরকম একটা স্বপ্নের চেয়ে ভালো কোনো মুহূর্ত আর হতে পারে না।

লরেন্সের লেখালেখির সঙ্গে পরিচিত হওয়ার আগেই তার সঙ্গে এক ধরনের নেতিবাচক পূর্বধারণা আমার দাঁড়িয়ে গিয়েছিল। সেই ধারণা আমি তৈরি করেছিলাম পরের কথায়। বাট্রান্ড রাসেলের একটা অভিমত পড়ে।

রাসেল সেখানে লরেন্সকে অসার কল্পনাবিলাসী মানুষ হিসেবে আখ্যা দিয়েছিলেন।

অতিবাস্তববাদী রাসেলের কাছে আমার মনোজাগতিক গঠনের বর্তমান রূপটির জন্যে আমি ঋণী। অপক্ব কৈশোরেই ‘দর্শনের সমস্যাবলীর’ ওই বেয়াড়া টেবিলটা আমাকে খুব ব্যতিব্যস্ত করে তুলেছিল।

সে আছে কি নেই, আছে কি নেই!

অপরদিকে লরেন্সের কাছে কোনো ঋণে আমি তখনও বাঁধা পড়িনি।

এ অবস্থায় অলক্ষে আমি রাসেলে ঝুঁকে পড়েছি। যখন পড়ছি, রাসেলের সঙ্গে লরেন্সের ক্রমেই দূরত্ব তৈরি হচ্ছে; তখন মনে হয়েছে অমন বেহিসেবী জীবনের কোষাগারিকের সঙ্গে রাসেলের দূরত্ব তৈরি হওয়াই উচিৎ।

রাসেলের প্রতি আমার ভালোবাসা আজও অটুট আছে। কিন্তু লরেন্সকে সেদিন ভুল বোঝার জন্যে আজ আমার মন ভীষণ অনুতপ্ত।

আমি আমার ভালোবাসার পাগল স্রোতে সেই অনুতাপকে ধুয়ে মুছে আমার ব্যক্তিগত সাগরের অতলে লুকিয়ে ফেলতে চাই। পারিও না। ওটা ভেসে থাকে। আমাকে কাতর করে কিন্তু।

লরেন্সকে যতোই পড়েছি, তার ভেতর ভীষণভাবে নিজেকে আবিষ্কার করেছি। ভাবনাচিন্তার মাঝে বিদ্রোহের যে কল্পনাসর্বস্ব উপাদান, লেখায় তার ধৃষ্ট আধিক্য; এসবে এতোখানি সান্নিধ্য আমার জীবনজুয়ার যিনি দীক্ষাগুরু সেই মার্কেজের সঙ্গেও বোধ করিনি।

আমার ভেতরের আমিটি তার আপাত শীলিত জীবন যাপনের আড়ালে একজন ভালো পশুই হতে চেয়েছে আদতে। হতে চেয়েছে একজন নগ্ন মানুষ যার নগ্নতা তার অপাপবিদ্ধ মনের কাছে একদম প্রশ্নবিদ্ধ নয়।

জ্ঞানবৃক্ষের ফলটি তার খাওয়া হয়ে ওঠেনি। তাই তথাকথিত বুদ্ধিমত্তার উপজাত এমন আরো যা কিছু আলোচিত প্রপঞ্চ আছে, ওসব কাজ করে না তার ভেতর।

লরেন্সের সঙ্গে দেখা

‘এই খোকা, যাও! ওই দেবদারু গাছের নিচে দাঁড়াও। শপথ পাঠ করাও সবাইকে!’

স্কুল কম্পাউন্ড। কেউ একজন পেছনে এসে দাঁড়িয়েছে। তবু তাকে দেখতে পারছি আমি। অভাবী মানুষের ভাঙা গাল, দাড়িতে আবৃত। বড় ভারি কণ্ঠ, দৃঢ় উচ্চারণ। এর উত্তর না দিয়ে পারা যায় না। আমি তার দিকে তাকিয়ে নেই। কিন্তু তাকে দেখতে পাচ্ছি স্পষ্ট।

বললাম, ‘শপথ? আমি!’

‘হ্যা তুমি। তুমি যা বলবে, তা আমার মনমতো হবে। তুমি যে শপথ করাবে সে শপথটাই আমি তোমার জায়গায় দাঁড়িয়ে করাতাম। পার্থক্য এই, আমরা আলাদা সময়ে, আলাদা দেশে জন্মালাম, আমাদের দেখা হলো না।’

খানিকটা কাছে এগিয়ে এসে তিনি বললেন, ‘ছেলে, তোমার পরিণত বয়েসে তুমি বুঝবে, পৃথিবীটা শুধু স্থানেই নয়, সময়েও বিস্তৃত। স্থান বদলাবে না। সময় বদলে যাবে। পৃথিবীর হাওয়ায় একটা বার্তা আছে। এ বার্তা সব হৃদয়ে সমান দোলা দেয় না। কারণ সবার হৃদয়ের ধরন এক না। জায়মান কালে, কাল যখন জায়মান, নতুন নতুন হৃদয়ের আগমন ঘটবে। কোনোদিন ওই বার্তার সঙ্গে সম্পূর্ণ বোঝাপড়া লোকের হবে না। কিন্তু প্রতিবার একটু একটু করে বোঝাপড়া বাড়তে থাকবে।’

ধূসর রঙিন চারপাশ ধীরে সাদাকালো হয়ে গেল। তার মুখের রেখা গেল মুছে। ঠোঁট নেই তবু ঠোঁট নেড়ে বললেন, ‘আমি তার কিছুটা নিতে এসেছিলাম। নিয়েছি, দিয়েও গেছি। তুমি তার কিছুটা নিতে এসেছ। নিয়ে এবং দিয়ে চলেছ। তুমি কি আমার কথা বুঝতে পারছ খোকা?’

‘না স্যার! আমি আপনার কথা বুঝতে পারছি না। একটুও বুঝতে পারছি না!’

‘বুঝতে যদি আজ নাও পেরে থাকো ক্ষতি নেই। আর সেটাই স্বাভাবিক। আমি তোমাকে এই স্বপ্নবার্তা দিয়ে গেলাম। মস্তিষ্কের গোপন কুঠুরিতে তা জমা থাকল। সময়ে আপনই বেরোবে।’

‘আমি কি তাহলে শপথ পাঠ করাব স্যার?’

কে উত্তর দেবে। চোখের সামনে থেকে সব উধাও।

বিছানায় তখন উঠে বসেছি। জানালায় চেয়ে দেখি ভোরের আলো লাজুক মুখে ঘরে ঢুকছে। পাশে শুয়ে আছে আমার প্রেমিকা। বালিশের বাইরে তার লালচে কালো চুলে সাগরের ঢেউ। আমি স্পর্শ করলাম।

মাঝে মাঝে এমন হয়। পুরনো স্বপ্ন মানুষ নতুন করে দেখে। বার্তা বদলে যায়।

হামিম কামাল। লেখক। জন্ম- ১৯৮৭ সালের ৯ অগাস্ট, ঢাকায়। আহসানুল্লাহ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে তড়িৎ প্রকৌশলে স্নাতক। প্রকাশিত গ্রন্থ- 'জঠর' (২০১৬), 'কারখানার বাঁশি' (২০১৮)।

এই বিভাগের অন্যান্য লেখাসমূহ