প্রক্সি
তারপর ইলেকট্রিক বিল জমা দিতে যাবো। আমার দেরি হবে আসতে। স্বামী অমর বলে, ঠিক আছে।…..
ছোটকাল থেকে পুতুল নিয়ে খেলতে খুব পছন্দ করতাম বলে বাবা আমার জন্য অনেক পুতুল কিনে আনতেন। সারাদিনের ক্লান্তি শেষে সন্ধায় বাবা যখন ঘরে ফিরতেন তখন কলিং বেলের শব্দ পেয়ে দৌড়ে আমি দরজার কাছে হুমড়ি খেয়ে পড়তাম; দরজার সিটকানি নাগাল পেতাম না বলে মা-ই এগিয়ে আসতেন দরজা খুলতে। পুতুল কি আর সব দিন আনা সম্ভব? তাই, বাবা প্রায়ই বানিয়ে বানিয়ে পুতুল বাজার থেকে হঠাৎ উধাও হয়ে গেছে বলে শান্তনা দেওয়ার চেষ্টা করতেন। কোলে নিয়ে আদর করে আলতো করে কপালে চুমু দিয়ে একটি টফি মুখে গুঁজে দিতেন। হরেক রকম বর-কনের জোড়া পুতুলই আমার সবচেয়ে প্রিয় ছিল।
বাবা-মেয়ের অতি ভাব-ভালবাসা দেখে মায়ের কিছুটা হিংসা হতো! তবে মায়ের সাথেও খুব টান থাকলেও বাবা-ই ছিলেন আমার সবচেয়ে আপনজন। গল্প করা থেকে শুরু করে ঘুরে বেড়ানো, স্কুলে যাওয়া, খেলাধুলায় সঙ্গ দেওয়া, সাঁতার শেখানো, পড়া দেখিয়ে দেওয়া সবকিছুতেই বাবা আমার ছায়াসঙ্গী হতেন। কখনো মন খারাপ দেখলে বাবা ভীষণ কষ্ট পেতেন, এজন্য অযথা মাকে বকাঝঁকা করতেন। যদিও মা কোনদিন আমাকে কড়া শাসন করেন নাই।
স্কুল থেকে ফিরে আম্মুকে জড়িয়ে ধরতাম। ঘরে বাবা থাকলে দু’জনকে। স্কুল ছিল বাড়ি থেকে বিশ মিনিটের হাঁটা দূরত্বে। প্রতিবেশী বান্ধবী সায়রা ও গুলবারের সাথে হেঁসে-খেলে প্রতিদিন স্কুলে আসা-যাওয়া করতাম। স্কুলটি ছিল মেয়েদের। আর কোন ভাইবোন না থাকায় বাবা-মায়ের সবটুকু ভালবাসা ছিল শুধুমাত্র আমার জন্য বরাদ্দ।
আমি রাওয়ান। পুরো নাম রাওয়ান মিলাদ। শৈশব ও বেড়ে উঠা সিরিয়ার আলেপ্পো শহর থেকে ত্রিশ কিলোমিটার দূরে সামারা গ্রামে। দুই হাজার সালের ২৫শে জানুয়ারি আমার জন্ম। এজন্য বাবা প্রায়ই আমাকে ‘মিলেনিয়াম গার্ল’ বলে খেপাতেন। মা ছিলেন হিস্ট্রির ছাত্রী। প্রায় সময় আমাকে সিরিয়ার ইতিহাস, ঐতিহ্য আর শাসন ব্যবস্থা নিয়ে গল্প বলতেন। বিশেষ করে অটোমানদের শাসন, আরব-ইসরাঈল বিরোধ, সিরিয়ানদের সমৃদ্ধ সাহিত্য আর শিল্প-সংস্কৃতির ভান্ডার তুলে ধরতেন। মায়ের গল্প শুনতে শুনতে কখন যে হিস্ট্রির প্রেমে পড়েছি খেয়াল নেই।
সবে ক্লাস সেভেন থেকে এইটে প্রমোশন পেয়েছি। ইচ্ছা ভবিষ্যতে হিস্ট্র নিয়ে পড়ার।
এইতো কিছুদিন আগে বাবা-মায়ের সাথে আলেপ্পো ঘুরে আসলাম। আলেপ্পো শহরের বাসিন্দা ছোট খালামনিকে সাথে নিয়ে হাজার হাজার বছর পুরোনা “এনসিয়েন্ট সিটি অফ আলেপ্পো” ঘুরে ঘুরে দেখলাম। উল্লেখ্য যে, এটি ইউনেস্কোর ওয়ার্লড হ্যারিটেজ সাইট। ঐতিহাসিক আলেপ্পো সিতাদেল, চার্চ অব সেইন্ট সিমিয়ের স্ট্যাইলিতস দেখে খুব ভাল লাগল। খৃষ্টপূর্ব প্রায় তিনশত বছর পূর্বে “সেলুসিড এম্পায়ার”-এর সময়ে এগুলো নির্মিত।
পরদিন বিখ্যাত আব্রাহাম মসজিদ, কুইনাছরিন গেইট, সোক আজ-জিরক, আল-অতরোস মসজিদ দেখা হলো। ভাল লাগলো আলেপ্পো শহরের প্রাণকেন্দ্রে অবস্থিত “বাব আল-ফারাজ ক্লক টাওয়ার” দেখে। অটোমান আমলের বিখ্যাত খুছরুইয়া মসজিদেও গেলাম। সবশেষে গেলাম ন্যাশনাল মিউজিয়াম অফ আলপ্পো এবং ইউনিভার্সিটি অফ আলেপ্পোতে। আসার সময় আলেপ্পোর বিখ্যাত মারুশ কুজিনে ডিনার করলাম। যে দুই দিন ছিলাম, শুধু ঘোরাঘুরি………. খাওয়া-দাওয়া………. আড্ডাবাজি………. মুভি দেখা………. শপিং……….. ।
এবার আসল কথায় আসা যাক।
২০১১ সালে সিরিয়ায় গৃহযুদ্ধ শুরু হওয়ার পর থেকে আমি সব সময় খুব আতঙ্কে কাটাতাম। ভীষণ ভয় পেতাম। টেলিভিশনে বিভিন্ন দেশে সংঘটিত যুদ্ধের ভয়াবহতা দেখেছি। তাই মনে প্রাণে চাইতাম যুদ্ধটা যাতে থেমে যায়। আমি ধ্বংসযজ্ঞ আর খুনাখুনি সহ্য করতে পারি না। তবে বাবা-মা উভয়ই যুদ্ধের পক্ষে ছিলেন। সরকার বিরোধী পক্ষের সাথে তাদের একাত্মতা ছিল। বাবা প্রায়ই দুই-তিনদিনের জন্য উধাও হয়ে যেতেন আবার ফিরেও আসতেন। বাবা-মায়ের সাথে যুদ্ধ সংক্রান্ত বিষয় নিয়ে মাঝে মাঝে বাকবিতণ্ডা হতো।
যুদ্ধের তীব্রতায় হঠাৎ একদিন স্কুলে যাওয়া বন্ধ হয়ে গেল। শুনেছি সরকার বিরোধীরা আমাদের স্কুলে ক্যাম্প করেছে। সারাদিন বাড়িতে জড়সড় হয়ে চুপচাপ বসে থাকতাম। বোমার শব্দে আর মানুষের চিৎকার-চেঁচামেচি- আর্তনাদ শুনে দু’চোখ বেয়ে অশ্রু গড়িয়ে পড়তো। পিচ্চি হার্টখানি চকলেট আইসক্রিমের মত মেল্ট হয়ে যেত।
দেখতাম বাবা প্রতিদিন তিন-চারজন অস্ত্রবাজ যুদ্ধাকে আমাদের বাড়িতে নিয়ে আসতেন। তারা রাত্রীযাপন করে ভোরের দিকে চলে যেত। তবে তারা কখনো আমাকে দেখে নাই। এর কিছুদিন পর বাবা একটানা পনেরো দিন আমাকে ঘরে তালাবন্ধ করে রেখেছিলেন। শুধু সময়মতো খাবার এনে দিতেন। বাবা কেন এমনটা করতেন, আমার জানা ছিল না। জিজ্ঞেস করলে কোন সদোত্তর মিলত না। চুপচাপ থাকতেন।
এই পনেরো দিনের মধ্যে একদিনও মাকে দেখিনি। সময়টা তখন ২০১৩ সালের সেপ্টেম্বর মাস। বাবাকে মায়ের কথা জিজ্ঞেস করলে বলতেন ব্যস্ত আছেন। কি যেন একটা কাজে কিছুদিন বাড়ির বাইরে থাকবেন। দিনগুলো খুবই কষ্টের ছিল। ভয় লাগত। রুমে কোন টিভি, রেডিও, ফোন কিছুই ছিল না। একদিন বাবা এসে বললেন-
— মা, রাওয়ান। শাওয়ার করে ভাল কাপড়-চোপড় পরো।
— কেন, বাবা! মায়ের কাছে যাব?
— কোন কথা নয়, যা বলছি তাড়াতাড়ি কর।
— ঠিক আছে, বাবা।
মনে মনে ভীষণ খুশি হলাম। ভাবলাম হয়তো আমার বন্ধী জীবনের অবসান হতে চলছে। বাবা নিশ্চয় আমাকে মায়ের কাছে নিয়ে যাবেন। অনেক দিন পর মাকে দেখতে পাব।
মনের আনন্দে যখন শাওয়ার করছি হঠাৎ খেয়াল হলো আনুমানিক পঞ্চাশ-বায়ান্ন বছরের একজন অপরিচিত লোক ধীরে ধীরে আমার দিকে এগিয়ে আসছে। আমি ভয়ে কুঁকড়ে গেলাম। ভেঁজা কাপড়ের উপর শুকনো একটা ওড়না পেঁচিয়ে লোকটিকে কাছে আসতে নিষেধ করলাম। না লোকটি আমার নিষেধ আর চেঁচামেচি থোড়াই কেয়ার করছে। গলার সর্বোচ্ছ আওয়াজ দিয়ে বাবাকে ডাকলাম। কোন সাড়াশব্দ পেলাম না। আরো ঘনিষ্ট হতেই সজোরে লোকটার গালে …..টু….শ….. করে একটা ঘুষি বসালাম। লোকটি আমার চুলের মুষ্টিতে জাপটে ধরলো-
— খানকি মাগী। তোর এতো সাহস আমাকে…….?
— প্লীজ……. আমাকে ছেড়ে দেন, আঙ্কেল। ……. প্লীজ। আমি আপনার মেয়ের মতো। প্লীজ………. প্লীজ……… প্লীজ!!!
— মেয়ের মতো?……… হা-হ-হা।……….. মেয়ে তো নয়!
আমার এতো চিৎকার, চেঁচামেচি শুনেও বাবা পাশের ঘর থেকে এগিয়ে আসেনি। পৃথিবীর কোন বাবা এভাবে তার চোখের সামনে মেয়েকে পাশবিকভাবে অত্যাচারিত হতে দেখেও এগিয়ে আসে না? বিশ্বাস হচ্ছিল না!……….. মনে হচ্ছিল স্বপ্ন দেখছি। এতদিন জানতাম, বাবারা হলেন মেয়েদের জন্য পৃথিবীর সবচেয়ে নিরাপদ আশ্রয়। ………….. কিন্তু না আমার ধারণাটি ভুল ছিল।…………. একদম ভুল…….!
এভাবে একের পর এক……..চলছে……..তো……..চলছেই…….। পর্যায়ক্রমে তিনজন আসার পর কখন যে জ্ঞান হারিয়ে ফেলেছি খেয়াল নেই। খেয়াল হলো পঞ্চম জনের সময়ে।
………. অনেক অনুনয় বিনয় করলাম, হাত-পায়ে পড়লাম। জীবন ভিক্ষা চাইলাম কোন লাভ হল না। কিছুক্ষণ পর আবার জ্ঞান হারালাম।
যখন জ্ঞান ফিরে পাই তখন শরীরের ব্যথা এতো তীব্র ছিল যে, মুখ দিয়ে কথা বের হচ্ছিল না। নাকের জল, চোখের জল সব একাকার হয়ে গেছে। যুদ্ধে পরাজিত এ দেহে কোন শক্তি অবশিষ্ট ছিল না। শরীরের শেষ শক্তিটুকু নিংড়ে প্রতিপক্ষকে পরাজিত করতে ব্যর্থ হয়ে বিছানায় পড়ে আছি।
হঠাৎ বাবা নামক নরপীশাচটি ঘুটি ঘুটি পায়ে আমার ঘরে ঢুঁকলো। আমি চিৎকার দিয়ে বলার চেষ্টা করলাম…………. ওরে বাবা নামের পিশাচ, আমাকে কেন রক্ষা করতে এলে না? আমার এতো বড় ক্ষতি করলে কেন?……….. কেমনে?…………
কিন্তু মুখ দিয়ে কোন আওয়াজ বের করতে পারলাম না। সে বলটুকু অবশিষ্ট ছিল না বলে।
একটু সুস্থ হওয়ার পর বাবা বল্লেন-
— মারে, মনে কষ্ট নিছ না। এটা এমন কিছু না। দেখিস তাড়াতাড়ি সুস্থ হয়ে উঠবে। তোর সাথে যা হয়েছে তা শরীয়ত সম্মত। এটা এক প্রকার ‘জিহাদ’। তুই তো যুদ্ধে যেতে পারবে না এজন্য মুজাহিদের যদি একটু আনন্দ-ফুঁর্তিতে রাখতে পারিস তাহলে যুদ্ধে অংশ গ্রহণের সমান পূণ্য পাবে! তোর অতীতের সব গোনাহ মাফ হবে!! তুই যখন মৃত্যুবরণ করবে তখন শহীদি দরজা পাবে!!! তোর স্থান হবে সোজা জান্নাত!!!!
তেইশ দিন অসুস্থ ছিলাম। বিছানা থেকে উঠতে পারতাম না। একটু জোরে কথা বল্লে কষ্ট হতো।
— বাবা, আমার শরীরে খুব ব্যথা?
— ধৈর্য ধর, মা।
— বাবা, আমার খুব কষ্ট হচ্ছে। অনেক কষ্ট।
মাকে খুব মনে পড়ছে। মাকে বলো একদিন
আসতে, একবার শুধু দেখেই চলে যাবে।
— এখন আসতে পারবে না।
— আমাকে ডাক্তারের কাছে নিয়ে চল?
ঔষধ কিনে দাও?
প্লীজ, বাবা।
নাহ্। বাবা আমাকে ডাক্তারেও নিয়ে যাননি,ঔষধও কিনে দেননি। যখন মোটামুটি সুস্থ হলাম তখন বাবা আবার মুজাহিদদের জিহাদের অনুমতি দিলেন।
শুরু হলো আমার দ্বিতীয় দফা জিহাদের মেঘা সিরিয়াল……………!
আগের মতো…….. জ্ঞান আসে………..জ্ঞান যায়।…….বাবা আসে……বাবা যায়……..।
চলে সান্তনা পর্ব। পাশাপাশি আমার ‘জিহাদ’ গাড়ি………..!
দিন গড়িয়ে রাত আসে…….. সপ্তাহ পেরিয়ে মাস…….. ধীরে ধীরে আমার অনুভূতিগুলোতে জং ধরে। পাশাপাশি মনের গহীনে লুকিয়ে থাকা স্বপ্নগলোর একে একে সমাধি হতে থাকে। এখন আর কোন মুজাহিদকে নিষেধ করি না। শুধু স্বপ্নহীন চোখ দু’টি বড় বড় করে তাদের জিহাদকে সমর্থন দিয়ে যাই। এখন চোখ দিয়ে পানিও আসে না। হয়তো মানুষের স্বপ্নগুলো মরে গেলে চোখের পানিও নিঃশেষ হয়ে যায়!
বেশ কয়েক দিন নরক যন্ত্রণা থেকে মুক্তির চেষ্টা করেছি, লাভ হয়নি। জিহাদ পর্ব শেষ হলেই তারা আমাকে তালা দিয়ে রাখতো। জানালার ফাঁক দিয়ে দেখতাম বাড়ির সদর দরজায় ভারী অস্ত্র নিয়ে মোজাহিদরা কড়া পাহারায় টহল দিচ্ছে। একটা সময় মুক্ত হওয়ার আশা ছেড়েই দিলাম। আর মুক্ত হয়েই বা কী লাভ?
তখন প্রায়ই স্বপ্নে দেখতাম বাবা আমার সাথে জিহাদ করছেন। ভয়ঙ্কর, ভয়াবহ জিহাদ। ভয়ে ঘুম ভেঙ্গে যেত। যদিও বাস্তবে বাবা কখনো এমনটি করেননি। যাতে এই দুঃস্বপ্ন আর না দেখি সেজন্য রাতের পর রাত না ঘুমিয়ে কাটিয়ে দিয়েছি। ঘুম আসলেই চোখে পানি ঢালতাম, বিছানা থেকে উঠে হাঁটাহাটি করতাম। বাবাও কী আমার বয়সী অন্য কারো সাথে………..!!!
একদিন শুনলাম আমাদের পাশের ‘নাওয়া’ গ্রামে আর্মি ক্যাম্প করেছে। সংবাদ পেয়ে বাবা সহ সকল জিহাদি প্রতিবেশী আরেকটি গ্রাম ‘তিসিলে’ আশ্রয় নিল। এসময় মা কোথা থেকে এসে হাজির হলেন-
— মা, মাগো। তুমি আমাকে রেখে কোথায় গিয়েছিলে?
— তিসিল।
— মা মুজাহিদরা আমার সাথে……..!!
জানো, মা………. বাবা কোন প্রতিবাদ করেনি।……….আমার কান্নাকাটি শুনে এগিয়ে আসেনি। উল্টো ওদেরকে সহযোগিতা করেছে। মাগো, তখন তোমার কথা খুব মনে পড়তো। খুব…….। ওরা যখন অত্যাচার করতো তোমার মুখটি চোখের সামনে ভেসে উঠতো। মাগো, এতদিন আমাকে একা ফেলে কোথায় ছিলে তুমি? কেমনে আমাকে ছাড়া থাকলে? কেমনে!
আমার আর বাঁচতে ইচ্ছা করছে না মা। এ জীবন রেখে কী করবো?
— চুপ কর, হারামজাদী। যা হয়েছে তা সহজভাবে নে। এ কথা আমাকে বলেছিস ঠিক আছে। যদি কোনদিন শুনি আর কারো কাছে প্রকাশ করেছিস, তাহলে তোর একদিন কী আমার একদিন। এক্কেবারে খুণ করে ফেলবো। এক্কেবারে………
মায়ের যুদ্ধের মেজাজ দেখে স্তম্ভিত হয়ে গিয়েছিলাম। পাশাপাশি নিষ্টুর এ জিহাদে মায়ের সমর্থন দেখে শকড হলাম। কষ্টে হৃদয়টা চুরমার হয়ে গেল।
মা প্রতিদিন ভোরে ঘুম থেকে উঠে শাওয়ার করে ভাল কাপড়চোপড় পরে, সুগন্ধি মেখে বেরিয়ে যেতেন। উপরে পরতেন একটি পুরাতন বোরকা ও হিজাব। সন্ধায় ফিরে এসে আবার শাওয়ার নিতেন। মায়ের এভাবে সাজুগুজু করতে দেখে দৃষ্টিটা সরিয়ে নিতাম। তবে ঘর থেকে বের হয়ে হেঁটে হেঁটে দূরের বড় রাস্তায় মিলিয়ে যাওয়ার আগ পর্যন্ত অপলক দৃষ্টিতে ঘরের জানালার গ্রিল ধরে চেয়ে থাকতাম।
একদিন ভোরে মা বল্লেন-
— তাড়াতাড়ি শাওয়ার করে
রেডি হও?
— কই যাব, মা?
— কই যাবে মানে? জলদি।
বাড়ি থেকে বের হয়ে গ্রামের মূল সদর রাস্তায় কিছুদূর যেতেই দেখলাম রাস্তার পাশে দুইজন জিহাদীর লাশ পড়ে আছে। এদের মধ্যে একজন আমার খুব পরিচিত। অতি আপনজন……….!!! আমার রেগুলার জিহাদের পার্টনার। বাহ্ শান্তি পেলাম। এই প্রথম মৃত মানুষের লাশ দেখে ভয়ের পরিবর্তে পুলকিত হলাম। আরেকটু সামনে এগিয়ে যেতই দেখলাম সরকারি মিলিটারী রাস্তায় ব্যারিকেড দিয়ে টহল দিচ্ছে। কাছাকাছি আসতেই চিৎকার দিয়ে বলে উঠলাম-
— বাঁচাও বাঁচাও। আমাকে রক্ষা করো, প্লীজ। প্লীজ বাঁচাও। মা আমাকে লাভ জিহাদের জন্য মুজাহিদদের কাছে নিয়ে যাচ্ছে।
আমার চেঁচামেচি শুনে দুজন মিলিটারী মাকে জাপটে ধরে আটকে রাখলো। আমাদের শরীর ভালভাবে চেকআপ করলো। আমাকে আলাদা একটি গাড়িতে তুলে অল্প কিছু দূরে একটি মিলিটারী ক্যাম্পে নিয়ে গেল। তিন দিন পর সেখান থেকে সোজা লেবানন।
গত সাড়ে চার বছর থেকে আমি লেবাননের “যাতারি রিফিউজি ক্যাম্প”-এ আছি। এখানে সিরিয়ানদের পাশাপাশি ইরাকি, ইয়াজিদি ও ফিলিস্তিনের রিফিউজিরাও আছেন। আমি জানি না আমার সাথে যা হয়েছে তা ইসলামী শরীয়ত সম্মত কিনা!! সত্যি সত্যি কী ইসলাম এই বর্বরতাকে সমর্থন করে? মুজাহিদরা সবাই ইসলামের কথা বলে আমার মতো হাজার হাজার মেয়ের জীবন নষ্ট করেছে। এরা মুজাহিদ নয়, এরা ছিল ভয়ঙ্কর হিংস্র সন্ত্রাসী। বাবা নামক পিশাচটাও। জানি না, বাবা-মা বেঁচে আছে কি না। তারা বেঁচে থাকা অথবা মরে যাওয়া আমার কছে কোন গুরুত্ব বহন করে না। পাঁচ বছর আগেই হৃদয়ের গহীনে তাদেরকে মাটি চাপা দিয়েছি। চিরতরে।
একদিন যাতারি ক্যাম্পের ইয়াজিদি বান্ধবী সুফিয়া আমাকে প্রশ্ন করেছিল-
— আচ্ছা, কারাগার জীবন আর রিফিউজি ক্যাম্পের মধ্যে পার্থক্য কী?
— জানি না। আমি তো কারাগার দেখিনি।
উত্তর দিয়েছিলাম আমি।
— শোন, পার্থক্য সামান্যই। কারাগারে থাকে বিভিন্ন অপরাধে সাজাপ্রাপ্ত কয়েদীরা। আর এসব রিফিউজি ক্যাম্পে থাকে যুদ্ধোপরাধীদের দ্বারা আঘাতপ্রাপ্তরা, পরাজিতরা।
— তবে একটা কমন বিষয় আছে?
— কমন?
— হুম। কয়েদী আর রিফিউজিরা স্বপ্নবাজ
হয় না। স্মৃতি কাতর হয়।
— হয়তোবা।
যে আমি প্রতিনিয়ত ইতিহাস নিয়ে পড়ার স্বপ্ন দেখতাম, সে কিনা আজ নিজেই ইতিহাসের অংশ হয়ে গেলাম। এ ইতিহাস নিয়ে আমার কোন আগ্রহ নেই। এটা হিংস্র। হয়তো আরো কয়েক বছর পর আমার মতো কোন ইতিহাস প্রেমী “সিরিয়ার গৃহযুদ্ধ” নিয়ে আগ্রহ সহকারে গবেষণা করবে। সে কী জানবে আমার ইতিহাস? শুনেছি ইতিহাস নাকি পুরোটা সত্য নয়। কারণ ইতিহাস তো লেখে বিজয়ীরা। থাকে শুধু বীরত্বের জয়গান। আমার মতো পরাজিত সৈন্যের আবার ইতিহাস!!!
আমি তো সৈন্য নয়, একদম শুণ্য। পঁচে-গলে দুর্গন্ধ ছড়ানো ইতিহাসের একটা জীবাষ্ম মাত্র।
ওহ! আরেকটি তথ্য দিতে বিলকুল ভুলে গেছি; আমার জন্মের কথা বলা হয়নি। জন্ম সিরিয়ার উত্তর-পূর্ব সীমান্তে “বানু আল-খোয়ান” নামক একটি উপজাতি সম্প্রদায়ে। শুনেছি জন্মের সময় মা মারা যান, আর বাবা বছরখানেক পর নাকি হারিয়ে গিয়েছিলেন। তবে সত্য-মিথ্যা জানা নেই। এক বছর দুই মাস সতরো দিন বয়স থেকে আমি নতুন ঠিকানায়, নতুন বাবা-মায়ের সাথে ছিলাম।।
তারপর ইলেকট্রিক বিল জমা দিতে যাবো। আমার দেরি হবে আসতে। স্বামী অমর বলে, ঠিক আছে।…..
নভেম্বর চলছে। অনির সাথে আজ দেখা হবে তা জানাই ছিল। এই তো ক’দিন আগেই দেখা…..
বুড়িমাসি বলেন,জীবনটা বালির ঘর গো।ঢেউ এলে ধুয়ে যায় জীবনের মায়া।তবু বড় ভালবাসা ওদের দাম্পত্যে।রোদের চাদরের…..
এক ড্রইং রুমে বসে রয়েছে সদ্য কিশোর উত্তীর্ণ তরুণ গোয়েন্দা সজীব। সামনের টেবিলে ছড়িয়ে…..