লালসালু

মুবিন খান
গল্প
Bengali
লালসালু

দূর থেকেই স্টেশনের নামফলকটা দেখা গেল। কিন্তু নামটা পড়তে পারা গেল না। নামের ওপর বড় একটা নৌকার ছবি। তার পাশে লেখাজোঁকা। তারপর এক লোকের ছবি। এখানকার রাজনৈতিক নেতার পোস্টার। তবে জংশন শব্দটা পড়তে পারা গেল। স্টেশনটির তেমন বিশেষত্ব নেই। বাংলাদেশের আর সব মফস্বল শহরের রেল স্টেশনগুলোর মতো এই রেল স্টেশনটাও বিশেষত্বহীন। পুরনো। ব্রিটিশদের বানানো লাল রঙের বড় একটা ভবন। যেন লাল ওড়নায় জড়ানো মুখটা। সামনে ছড়ানো প্ল্যাটফর্মের ওপর বিশাল টিনের চাল।

ট্রেনটা স্টেশনে পুরোপুরি থামার আগেই লাফ দিয়ে নামল আপন। হুমড়ি খেয়ে যেন পড়ে না যায় সেজন্যে ট্রেনের সঙ্গে তাল মিলিয়ে কয়েক কদম দৌড়াল। তারপর গতি কমিয়ে হাঁটতে লাগল। হাঁটার গতি খুব দ্রুত। সামনে বিরাট টিনের ছাউনি। লাল ইটের স্টেশন ভবনটার কোণে খোলা আকাশের নিচে একটা চায়ের দোকান।

কাঁধের ব্যগটা বাঁ কাঁধ থেকে ঘুরিয়ে ডান কাঁধে নিতে নিতে আপন এগিয়ে গেল চায়ের দোকানের দিকে। একটা টুল পেতে দোকানি বসে স্বচ্ছ সস্তা গ্লাসে চামচ ডুবিয়ে টুংটুং করে চা নাড়ছে। পাশে চুলায় বড় একটা হাড়িতে দুধ জ্বাল হচ্ছে। মফস্বলের চায়ের দোকানগুলোতে কনডেন্সড্ মিল্ক কি এখনও জনপ্রিয়তা পায় নি? নাকি এর পেছনে অর্থনৈতিক কারণ রয়েছে?
দুধের হাড়ির পাশেই আরেক চুলায় দুটা বড় কেটলি। সম্ভবত তাতে চায়ের লিকার। আপন দ্রুত চোখ বোলাল। পাউরুটি, বনরুটি, বাটারবন, কাঁচের বৈয়ামে কয়েকরকম বিস্কুট। একটা বৈয়ামে চকলেটও রয়েছে। ‘উঁহু, চলবে না।’ স্বগতোক্তি করল আপন। দোকানিকে জিজ্ঞেস করল,

‘পরোটা নাই?’

দোকানি চোখ তুলে তাকাল তারপর হাত ইশারা করে বলল, ‘সামনে গিয়া ডাইন দিকে গেট দিয়া বাইর হইলে হোটেল আছে। ওইখানে পারোটা পাইবেন।’

‘আপনার নাম কি?’ জানতে চাইল আপন।

চোখ তুলে তাকাল দোকানি। একটু অবাক হলেও নিজের নাম বলল, ‘মফিজ মিয়া।’

‘আপনাকে ধন্যবাদ মফিজ মিয়া।’

মফিজ মিয়াকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে হাঁটতে শুরু করল আপন। মফিজ মিয়া এখন আপনকে মনে রাখবে। পরেরবার এলে চিনতে পারবে। কুশল জিজ্ঞেস করবে। গরম পানি দিয়ে কাপ ধুয়ে চা দেবে। ভাবতে ভাবতে পনেরো বিশ কদম হাঁটতে পৌঁছে গেল লাল ভবনটার মূল দরজার কাছে। এখান থেকে পাকা রাস্তা দেখা যায়। বেরুবার পথের ডান পাশটায় টিকেট কাউন্টার, বাঁ দিকে দরজায় তালা ঝুলছে। দেখে মনে হয় বহুদিন এই তালা খোলা হয় নি। ঝুলেই আছে। দরজার ওপরে হাতে লেখা ছোট্ট একটা সাইনবোর্ড। তাতে লেখা ‘ওয়েটিং রুম।’ বেরুবার পথ ধরে এগিয়ে গেল আপন। চার পাঁচ ধাপ সিঁড়ি গিয়ে মিশেছে রাস্তায়। রাস্তার দুপাশে সারি বেঁধে অল্পকিছু রিকশা দাঁড়িয়ে। সিঁড়ি বেয়ে নেমে কিছুটা এগুতেই রিকশাগুলোর পেছনে একটা খাবার হোটেল দেখা গেল।

আপন দ্রুত এগিয়ে গেল হোটেলটার দিকে। টিনের তৈরি কয়েকটা ছোট ছোট ঘর। তার প্রথমটাই হোটেল। হোটেলের বাইরে একজন পরোটা বেলে তাওয়ায় ছুঁড়ে দিচ্ছে। আরেকজন উল্টে পাল্টে সেঁকছে। আপনের পেটের ভেতর গুড়মুড়িয়ে উঠল। পেটটা তার ক্ষিধেটা আবার সগর্বে নিজের অস্তিত্ব ঘোষণা করছে। আপন প্রচন্ড ক্ষুধার্ত। কাল সকাল থেকে প্রায় কিছুই খাওয়া হয়ে ওঠে নি। সময় পায় নি। এখন অখন্ড অবসর। কারও কিছু বলার নেই। যেখানেই যাক ইচ্ছেমত সময় খরচ করতে পারে। বস্তুত ক্ষুধার কারণেই আপন ছুটতে ছুটতে এসেছে।

হোটেলের ভেতর ঢুকল। ঢোকার মুখে বাঁ পাশে কাউন্টার। কাউন্টারে বসা লোকটা আপনকে দেখে বহু পরিচিতের মতো খুব আন্তরিক ভঙ্গীতে বলে উঠল, ‘বসেন ভাই। ওই ভাইয়েরে নাস্তা দে।’

মোট চারটা টেবিল। টেবিলের দুপাশে চেয়ার নয়, পিঠওয়ালা লম্বা বেঞ্চ। আপন রাস্তার পাশের টেবিলটাতে বসল। বসতেই দশ বারো বছরের একটা ছেলে দুম করে খুব সশব্দে টেবিলে পানি ভর্তি গ্লাস রাখল। ছেলেটা যেতে না যেতেই আরেকজন এসে দুটা পরোটাসহ একটা প্লেট গড়িয়ে আপনের দিকে ঠেলে দিয়ে বলল, ‘ডাইল ভাজি সবজি গরু মুরগী; কী খাইবেন?’

সবজি দিয়ে কয়েকটা পরোটাই খেয়ে ফেলল আপন। সবজিটা খেতে খুব সুস্বাদু হয়েছে। খাওয়ার পর বেশ একটা প্রশান্তি ছড়িয়ে পড়ল শরীর জুড়ে। বেঞ্চের পিঠটাতে হেলান দিয়ে দুহাত প্রসারিত করে আয়েশের ভঙ্গীতে ছড়িয়ে বসতেই পানির গ্লাস দিয়ে যাওয়া ছেলেটা পিরিচ ছাড়া এক কাপ চা আপনের সামনে রাখল। আপন চা চায় নি। তাকাল ছেলেটার দিকে। ধবধবে সাদা স্যান্ডো গেঞ্জি পরা। কিন্তু পরনের হাফ প্যান্ট কালো হওয়ার পরেও ভয়াবহ ময়লা। জিপারের জায়গাটা হা করে আছে।

আপন বলল, ‘চা তো চাই নাই!…কিরে ব্যাটা! তোর পোস্টাপিস তো খোলা! তোর শরম নাই?’

ছেলেটা ফিক করে হেসে ফেলল। তার কালো মুখটা ঝলমল করে উঠল। কাউন্টারের লোকটা কন্ঠে অহঙ্কার মিশিয়ে বলে উঠল, ‘খান ভাই। গাইয়ের দুধের না, আমি কনডেন মিল্কের চা বেচি। আপনেদের তো কনডেন মিল্কের চায়ের অভ্যাস…ভাই কি চুড়ুলী যাইবেন?’

আপন সুন্দর করে হাসল। কিছু বলল না। চায়ের কাপটা টেনে নিয়ে ছোট্ট করে চুমুক দিল। ভয়াবহ চা। চিনি তো রয়েছেই, তার সঙ্গে কনডেন্সড মিল্ক মিলেমিশে চায়ের স্বাদকে ভাষাহীন করে ফেলেছে। আপন আরও সুন্দর করে হাসল। আপনের হাসিতে ভাষাহীন চায়ের কোনও ছাপ পড়ল না। টেবিলে কাপ নামিয়ে রেখে বলল, ‘অসাধারণ চা! এই চা এক কাপ খেলে পোষাবে না। একসঙ্গে দু কাপ খেতে হবে।’

বলে সুন্দর করে হাসল। হাসিতে মুগ্ধতা ফুটিয়ে তোলার চেষ্টা করল। কাউন্টারের লোকটা তৃপ্তির হাসি হাসল। চা’টা ফেলে দিতে হবে। এদের সামনে ফেলা যাবে না। আড়ালে ফেলতে হবে। এখন আড়াল তৈরী করতে হবে। ভাবল আপন।

কাউন্টারের লোকটা বলল, ‘ভাইয়ের কি সিগ্রেটের অভ্যাস আছে? সিগ্রেট দিব?’

আপনের মুখটা উজ্জ্বল হয়ে উঠল। সুন্দর হাসিটাকে মুখটাতে ফিরিয়ে এনে উঠে দাঁড়িয়ে বলল, ‘আপনি তো চা খাওয়ালেন। আমি সিগারেট খাওয়াই। চা খাইয়ে ঋণী করে রাখবেন এটা কেমন কথা!’

লোকটা ‘আরে আরে’ বলে প্রতিবাদ করতে শুরু করেছিল। আপন কান না দিয়ে চায়ের কাপ হাতেই হোটেল থেকে বেরিয়ে পড়ল। পাশেই একটা সিগারেটের দোকান। সেখানে গিয়ে কাপের চা টুকু ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে কাপটা বিস্কুটের বৈয়ামের ওপর রাখল। তারপর জিন্সের পকেট থেকে সিগারেটের প্যাকেট বের করল। দোকানের সুতায় বাঁধা লাইটার নিয়ে সিগারেট জ্বেলে বুক ভরে ধোঁয়া নিয়ে ছাড়তে ছাড়তে রাস্তার দিকে তাকাল।

এই জায়গার ও কিছু চেনে না। কোথায় যাবে তাও জানে না। এমন কি যে স্টেশনে নেমেছে সে স্টেশনটার নামও জানে না। কাউকে জিজ্ঞেস করে জেনে নেওয়া যায়। জিজ্ঞেস করতে ইচ্ছে করছে না। একটা জায়গার নাম জেনেছে একটু আগে। চুড়ুলী।

একটু সামনে একটা রিকশা দাঁড়িয়ে। কাছে যেতেই দেখা গেল এক লোক চালকের সিটে পা রেখে আরোহীর সিটে উদাস মুখে বসে আছে। বসার এই ভঙ্গীকে রিকশাচালকদের ভাত বিশ্রাম বলা হয়। গরমের অলস দুপুরে খেয়েদেয়ে রিকশাচালকেরা এইরকম অলস ভঙ্গীতে বসে বিড়ি ফোঁকে। কিংবা একটু ঝিমিয়ে নেয়। এই সাত সকালে প্রবল ভাড়া হেঁকে প্রবল বেগে রিকশা চালানোর পরিবর্তে এই লোক এইভাবে এইখানে বসে আছে কেন!

আপন বলে, ‘ওই চুড়ুলী যাব। প্রাইমারি স্কুলের সামনে নামায়ে দিবা। কত নিবা?’

চুড়ুলী জায়গাটা আপন চেনে না। ধারণা করেছে জায়গাটা একটা গ্রাম। সব গ্রামেই একটা প্রাইমার স্কুল থাকে। তাই প্রাইমার স্কুলের কথা বলেছে। আপন যে এখানে আগন্তুক নয় সে ভাব ধরতে হবে ।

লোকটা কথার জবাব দিল না। ওভাবে বসে থেকেই অদ্ভুতভাবে কাঁধ আর শরীর নাড়া দিল। নড়ার এই ভঙ্গীকে বলে শ্রাগ করা। এদেশের লোকেরা শ্রাগ করে না। শ্রাগ করার স্বভাব পশ্চিমাদের। এই লোক এই জিনিস কোত্থেকে শিখল! আপন খুব মজা পেল।

আবার বলল, ‘কথা বল না ক্যান! চুড়ুলী প্রাইমারি স্কুলের সামনে যেতে কত নিবা?

লোকটা চোখ পাকিয়ে তাকাল। চোখ দুটা লাল হয়ে আছে। মুখটা শুকনো। যেন খাওয়া ঘুম কিছুই হয় নি। আপনের নাদের আলীর কথা মনে পড়ল। সুনীল গঙ্গাপাধ্যায়ের মামা বাড়ির নাদের আলীর কথা। নাদের আলী কখনও কাঙ্ক্ষীত গন্তব্যে নিয়ে যায় না।

আপন বলে, ‘নাদের আলী, তুমি আমাকে চুড়ুলী গ্রামে নিয়ে যাও না কেন!

‘যামু না। আপনে অন্য রিকশা দেখেন। আর আমি নাদের আলী না। আমার বাপে নাদের। নাদের মিয়া। আপনে কেডা?’

‘তাই বল, তুমি তাহলে ইবনে নাদের আলী।’

‘কি কন!’

‘ইবনে নাদের মিয়া মানে হলো নাদের মিয়ার ছেলে। আরবি দেশে লোকেদের তার নিজের নামে না ডেকে এভাবে ডাকে।’

‘ডাকনের দরকার নাই। আপনে অন্য রিকশা দেখেন।’

‘কেন নিয়ে যাবা না ইবনে নাদের আলী? তোমার বউ তোমার সঙ্গে ঝগড়া করেছে, আমি তো করি নাই। বউয়ের রাগ তুমি আমার ওপর ঝারছ কেন!

‘বউ ঝগড়া করছে আপনে জানেন ক্যামনে!’

আপন তার সুন্দর হাসিটা হাসল। এই সাত সকালে লোকে ফুরফুরে মেজাজে থাকে। ঝগড়া না হলে মেজাজ খারাপ করে কাজ কর্ম বন্ধ করে না খেয়ে বসে বসে থাকে না। আর এই বয়সি লোকদের ঝগড়া বউয়ের সঙ্গেই হতে হয়। দুই ধরনের লোক রাগ করে না খেয়ে থাকে। আহ্লাদী লোকে এবং দরিদ্র লোকে। দরিদ্র লোকেদের সবচেয়ে বড় বিলাসিতা হচ্ছে খাবার। খাবারের কষ্টটা এদের চাইতে ভালো কেউ জানে না। ফলে প্রচন্ড রাগ কিংবা অভিমানের প্রাথমিক ধাক্কাটা খাবারের ওপর দিয়েই যায়। এই লোক রাগ করে না খেয়ে বাসা থেকে বেরিয়ে এসেছে। এখন ক্ষিধে পেটে মুখ শুকিয়ে রিকশায় বসে বসে অভিমানের জাবর কাটছে। আপন বলল,

‘বউয়ের সঙ্গে রাগ করে না খেয়ে থাকে ইবনে নাদের মিয়া? তুমি না বুদ্ধিমান লোক?’

লোকটা অবিশ্বাস ভরা দৃষ্টি নিয়ে আপনের দিকে তাকিয়ে রইল। রাগ করে না খেয়ে থাকার তথ্য ফাঁস হয়ে যাওয়াটা মেনে নিতে পারছে না। কথা দু কান হয়েছে। চার কান হতে দেওয়া যাবে না। ঘাড় ত্যাড়া কিশোরের মতো ঘাড় বেঁকিয়ে বলে, ‘আপনে কেডা? কি চান?’

আপন এবার হাহা করে হেসে ওঠে। আরোপিত হাসি নয়। সত্যি সত্যি হাসি। বোকা বোকা লোকটাকে তার ভালো লেগে যায়। হাসির গতি থামিয়ে বলো, ‘ইবনে নাদের মিয়া, আমাকে চুড়ুলী গ্রামে নিয়ে যাও। ভাড়া যা হয় তাই দিব।’

‘উঠেন।’

আপনকে ঘাড় থেকে নামাতে অগত্যা লোকটা চুড়ুলী গ্রামে যেতে রাজি হয়। নেমে রিকশার হাতল ধরে দাঁড়ায়।

চুড়ুলী গ্রামটা রিকশায় স্টেশন থেকে মিনিট দশ পনেরোর পথ। স্টেশন থেকে কিছু দূর এগিয়ে বাঁয়ে ঘুরলে স্থানীয় কলেজ। মাঝখানে ঈষৎ পাকা রাস্তা এগিয়ে গেছে। দুপাশে ধান ক্ষেত। কিছু বিক্ষিপ্ত দোকান। আপন রিকশাচালকের নাম জেনে নিয়েছে। ফজল। যদিও সে ফজলকে ইবনে নাদের মিয়া ডাক বহাল রেখেছে। ফজলের বাড়ি চুড়ুলী গ্রামটার এক প্রান্তে। ফজল এখনও ভেবে পাচ্ছে না আপন ফজলের দাম্পত্যকলহ আর উপোস থাকবার খবর জানল কেমন করে। ফজল কি ভয় পাচ্ছে? ভাবে আপন। ফজলকে ভড়কে দিতে ইচ্ছে করে। রিকশায় আপন আন্দাজে ঢিল ছোঁড়ে, ‘তোমার বউটা কত্ত ভালো একটা বউ। বউয়ের জন্যে তুমি কিছু কিনলেই টাকা খরচ করেছ বলে রাগ করে। সারাক্ষণ তোমার কথা চিন্তা করে। সেই বউয়ের সঙ্গে ঝগড়া করে তুমি না খেয়ে থাকলে বউ কি খেতে পারে ইবনে নাদের মিয়া?’

রিকশার প্যাডেল ঘোরাতে ঘোরাতে ফজল একবার ঘুরে তাকাল। কিছু বলল না। এই লোকের সঙ্গে কথা না বলাই নিরাপদ। রিকশার গতি বেড়ে গেল। যেন আপনকে তাড়াতাড়ি গন্তব্যে পৌঁছে দিয়ে পালাতে চাইছে।

 

দুই

চুড়ুলী প্রাইমারি স্কুলটা গ্রামের সড়ক থেকে কয়েক শ’ গজ দূরে। সড়ক থেকে স্কুলের জমিটা অনেকটা নিচে। নেমে যাওয়ার পথটায় মাটি কেটে কেটে সিঁড়ি বানানো হয়েছে। ক্লাস চলছে। কোনও একটা ক্লাস রুমে বাচ্চাদের সমস্বরে কবিতা পড়তে শোনা যাচ্ছে। আপন রিকশা থেকে নেমে আড়মোড়া ভাঙল। তারপর প্যান্টের দু পকেটে হাত ভরে দাঁড়িয়ে ফজলের দিকে তাকিয়ে তার সুন্দর হাসিটা হেসে বলল, ‘ইবনে নাদের মিয়া, আরেকটা উপকার কর।’

‘কিসের উপকার!’ ফজলের কন্ঠে সন্দেহ।

‘এইদিকে কোথাও একটা বাচ্চার কবর আছে। বাচ্চাটা মুক্তিযুদ্ধের সময় মারা পড়েছিল। কবরটা কোথায় দেখিয়ে দাও।’

ফজলের চোখে বিস্ময় ফুটে উঠল। সে ধাঁধায় পড়ে। এই এলাকা সে ভালোই চেনে। কিন্তু এইরকম কোনও কবর কিংবা ঘটনার কথা সে শোনে নাই। আচ্ছা ওই বাঁশঝাড়ে কি কোনও কবর আছে? চকিতে সড়কের অপর পাশে বাঁশঝাড়ে দৃষ্টি বুলিয়ে নেয়। তারপর বলে, ‘এইখানে এইরকম কোনও কব্বর নাই।’

‘আছে ইবনে নাদের মিয়া, তুমি হয়ত জানো না।’ ফজলের চেহারায় ফুটে ওঠা বিভ্রান্তি পড়তে পারে আপন।

ফজল বলে, ‘এত কথা জানি না। ভাড়া দেন, যাই গা।

আপন প্যান্টের পকেট থেকে হাত বের করল। হাতে দোমড়ানো নোট। সেখান থেকে পঞ্চাশ টাকার একটা নোট তুলে নিয়ে ফজলের দিকে বাড়িয়ে ধরল। ফজল কয়েক সেকেন্ড তাকিয়ে রইল আপনের দিকে। তারপর ছোঁ মেরে টাকাটা নিয়ে দ্রুত রিকশা ঘুরিয়ে গতিতে চালাতে শুরু করল। পেছনে থেকে তাকিয়ে থেকে হাসল আপন। তার আগমনের খবর এখন ইবনে নাদের মিয়া ছড়িয়ে দেবে। তার কাজ সহজ হবে। কাজ সহজ হওয়ার দরকার আছে।

ফজলের চকিত দৃষ্টি চোখ এড়ায় নি আপনের। চলে যেতে সড়কের উল্টো দিকে কিছুটা জংলা জায়গা। তারপর বাঁশঝাড়। বাঁশঝাড়ের দিকটায় হাঁটতে লাগল সে। কাছাকাছি পৌঁছে অবাক হতে হলো। বাঁশঝাড়টার পাশেই একটা পুকুর। বোঝাই যাচ্ছে পরিত্যক্ত পুকুর; অথচ কি স্বচ্ছ আর টলটলে পানি। পানিতে বাঁশঝাড়ের প্রতিবিম্ব। মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে রইল আপন।

 

তিন

প্রাইমারি স্কুলটা পেরিয়ে কিছুটা পথ হাঁটলেই মসজিদ। স্কুলের পিওন মসজিদের ঠিকানা দিয়েছে। জোহরের আজান শুরু হতে আপন মসজিদে পৌঁছে গেল। মসজিদটা সদ্য পাকা করা হয়েছে। তবে ছাদ এখনও টিনের। এই ধরনের ছাদকেই কি চৌচালা বলে? আপন জানে না। মসজিদ ঘরটার সামনে লম্বা একটা বারান্দা। বারান্দাটা মাটির। সেটাতেও টিনের ছাদ। আপন বুঝতে পারল না পুরো মসজিদটা পাকা করা গেল, বারান্দাটুকু কেন করা গেল না!

ওজুখানা বলতে সামনের উঠানে একটা চাপকল বসানো। তার নিচে একটা বালতি। কয়েকটা সিলভারের বদনা। নিয়ম হলো, নামাজ পড়তে আসা লোকেদের কল চেপে বালতি ভরতে হয়। তারপর বদনায় বালতি থেকে পানি তুলে ওজু করতে হবে। বদনার অন্য ব্যবহার করতে চাইলে উঠানের কোণে চারপাশ বেড়া দিয়ে ঘেরা একটা জায়গা আছে। সেইখানে গিয়ে করে আসতে হবে। আপন জিন্সের প্যান্ট গুটিয়ে সকল নিয়মই নিষ্ঠার সঙ্গে পালন করল। তারপর জামাতে দাঁড়িয়ে নামাজ পড়ল। নামাজ শেষে পেছনের একটা কোণায় গিয়ে বসে রইল। মুসুল্লিরা বেরিয়ে যেতে যেতে আপনের দিকে কৌতুহলী দৃষ্টি নিক্ষেপ করতে লাগল।

সুন্নত নামাজ শেষ করে ঈমাম সাহেব মসজিদ থেকে বেরুলে আপন পেছন পেছন উঠে এল। ঈমাম সাহেব বারান্দা পেরিয়ে উঠানে নামতেই আপন পাশে চলে এল।

-‘সালামুআলাইকুম হুজুর।’

-‘ওয়ালাইকুম সালাম।’

সালামের প্রত্যুত্তর করে ঈমাম সাহেব আপনের দিকে তাকিয়ে দাঁড়িয়ে পড়লেন। ঈমাম সাহেবের বয়স নিতান্তই কম। গালে পাতলা দাড়ি। সৌখিন করে ছাঁটা। চোখে সুরমা দিয়েছেন। জড়ির নকশা কাটা কুর্তা পরা ঈমাম সাহেবর চেহারায় বেশ পবিত্র একটা ভাব। অপরিচিত শহুরে আপনকে তিনি চিনতে পারলেন না। বললেনও সে কথা।

‘আপনি কে ভাই! মাস্টর বাড়িতে আসছেন?’

মৃদু মাথা ঝাঁকালো আপন। তারপর বলল, ‘আপনার কাছে একটা কাজে আসছি হুজুর।’

‘কি কাজে ভাই, বলেন?’

‘স্কুলের সমানের সড়কটার ওইপাশে বাঁশঝাড় আর পুকুরটার পাশে একটা বাচ্চার কবর আছে না, আজকে বাদ আছর ওই বাচ্চাটার জন্যে একটা মিলাদ পড়ে দোয়া করে দিতে হবে।’

বলে পকেট থেকে দুটা পাঁচশ’ টাকার নোট বের করে এগিয়ে দিতে দিতে আবার বলল, ‘এটা মিষ্টির জন্যে। আমি তো এখানে নতুন। কাউকে চিনি না। আপনি যদি কাউকে দিয়ে মিষ্টি আনিয়ে নেন তো আমার জন্য খুব ভালো হয়।’

‘কারে দিয়ে যে আনাই…আচ্ছা ঠিক আছে, ব্যবস্থা করে ফেলা যাবে। কিন্তু ওইখানে কোনও কবর আছে বলে তো শুনি নাই! কার কবর ভাই?’

আপন এতক্ষণ এই প্রশ্নটার অপেক্ষাতেই ছিল। বলল, ‘একটা বাচ্চা মেয়ের কবর হুজুর। মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তান আর্মি মেয়েটাকে বুট দিয়ে পাড়া দিয়ে পিষে ডলতে ডলতে মেরে ফেলেছিল। মেয়েটাকে পিষে মেরে ফেলে রেখে ওর মাকে ধরে নিয়ে গিয়েছিল। তারপর কয়েকজন প্রতিবেশি বাচ্চা মেয়েটাকে ওই বাঁশঝাড়ে কবর দিয়ে নিজেরা ইন্ডিয়া পালিয়ে যায়।’

ঈমাম সাহেবের মুখটা গম্ভীর হয়ে যায়। আপনের দিকে তাকিয়ে বলে, ‘আপনারে এইসব গল্প কে বলছে?’

‘মেয়েটা নিজেই বলেছে।’

‘যে মেয়ে মারা গেছে সে আপনারে তার মৃত্যুর সবিস্তার ঘটনা বলছে! ভাই, আপনে কি আমার সঙ্গে রসিকতা করার চেষ্টা করতেছেন?’

‘আমি জানতাম আপনি বিশ্বাস করতে চাইবেন না। কেউই করবে না। তাই কাউকে বলি নাই। আপনি জ্ঞানী মানুষ। তাই আপনাকে বললাম।’

ঈমাম সাহেব কিছু বললেন না। চুপ করে রইলেন। একটুক্ষণ ভাবলেন। তারপর বললেন, ‘ওই মেয়ে আপনারে পেল কেমন করে? কোন্ উপায়ে বলছে?’

‘স্বপ্নে বলেছে হুজুর।’

‘ওই মেয়ে আপনের স্বপ্নে এসে এইসব বলে গেছে?’

‘জ্বী হুজুর। খুব কান্নাকাটি করেছে। বলেছে তার জানাজাও হয় নাই।’

‘আপনি কি এখন ওই মেয়ের জানাজাও পড়াবেন?’

‘বুঝতে পারছি না হুজুর। জানাজা তো মৃতদেহ সামনে রেখে পড়তে হয়। এত বছর পরে কি জানাজা পড়া যাবে? আপনি কি মতামত কি হুজুর?’

আপনাকে আমার কাছে কে পাঠিয়েছে ভাই?’

‘কেউ পাঠায় নাই। আমি নিজেই এসেছি। হুজুর, বললেন না তো, এখন জানাজা পড়লে কি হবে? গায়েবি জানাজা বলে একটা ব্যাপার আছে না? সেইটা কি পড়ানো যাবে?’

‘আপনের নাম কি বাবা?’

‘আপন।’

‘ভাই আপন, আপনে সহজ লোক না। আমার কাছে মিলাদ পড়াইতে আসছেন, বাদ আছর মিলাদ পড়ায়ে দিব। লোক দিয়া মিষ্টিও আনাবো। আরও দুইশ’ টাকা দিয়ে যান। মিলাদে শরীক হইতে চইলা আইসেন।’

আপন সুন্দর করে হাসল। কোনও কথা বলল না। ওর কাজের কঠিন একটা অংশ ঝামেলা ছাড়াই এইমাত্র করা হলো। ঈমাম সাহেব মসজিদের পেছন দিকে এগুতে লাগলেন। আপনও হাঁটতে লাগল। ওকে বাজারে যেতে হবে। কিছু কেনাকাটা করা দরকার। দুপুরের খাবারও খেতে হবে। আপন সড়কের হাঁটতে লাগল।

 

চার

থানার পাশেই বাজার। বাজারটা আপনের বেশ ভালো লেগে গেল। ঢোকার মুখে প্রাচীন আর বিশাল একটা বটগাছ। কান্ডটা উঁচু আর প্রশস্ত করে সিমেন্টে বাঁধাই করা। উল্টো পাশেই একটা খাবার হোটেল। কেনাকাটা সেরে আপন হোটেলে খেয়ে নিল। হোটেল থেকে বেরিয়ে সিগারেট জ্বেলে সামনে তাকিয়ে দেখে ফজল বটগাছের ছায়ায় রিকশা দাঁড় করিয়ে সিমেন্টের চাতালে উদাস মুখে বসে বিড়ি টানছে।

আপন সোজা গিয়ে রিকশায় উঠে বসে বলল, ‘ইবনে নাদের মিয়া, চল।’

ফজল তাকাল। আপনকে দেখে ওর মুখটা শুকিয়ে গেল। বিড়িতে একটা টান দিয়ে ধোঁয়া ছেড়ে আড়াল তৈরি করতে চাইল। কিন্তু বাতাস ফজলকে সহযোগিতা করল না। ধোঁয়াদের মুহূর্তেই নেই করে ফেলল। ফজল চোখমুখ কঠিন করে ফেলল। বাতাসের ওপর তার রাগ হয়েছে। বলল, ‘যামু না।’

‘বউয়ের সঙ্গে আবার ঝগড়া করেছ ইবনে নাদের মিয়া? না খেয়ে ভাতের থালার ওপর হাত ধুয়ে চলে এসেছ? তোমার তো অভ্যাস খারাপ হয়ে যাচ্ছে হে ইবনে নাদের মিয়া!’

কাকতালীয়ভাবে মিলে গেল। ফজল সত্যিই আধ খাওয়া ভাতের থালার ওপর হাতে ধুয়ে উঠে চলে এসেছে। এবারের ঝগড়ার কারণ তরকারিতে লবণ না দেওয়া, অতিরিক্ত ঝাল দেওয়া এবং খেতে বসার পরে লবণদানি দিতে ভুলে যাওয়া। নাদেরের দৃঢ় বিশ্বাস তার বউ চায় না সে ভাত খেতে পারুক। ফলে সে যেহেতু বউকে প্রচন্ড ভালোবাসে, তাই বউয়ের চাওয়াকে মর্যাদা দিতেই হাত ধুয়ে চলে এসেছে। ভাত খায় নি। বাড়ি থেকে বেরিয়ে সোজা এই বটগাছটার নিচে এসে বসে বিড়িটা ধরিয়েছে। এর মধ্যেই এই লোক এসে ঘটনার পূর্ণ বিবরণ দিয়ে ফেলছে। এই লোক এসব ঘটনা জানলো কি করে!

ফজল আপনের দিকে তাকায় না। অন্যদিকে তাকিয়ে বলে, ‘যামু না ব্যস যামু না। এত কথা বলেন ক্যান? আর আমার পরিবারের এইসব কথা আপনে জানেন ক্যামনে? কে বলছে আপনেরে?’

আপন হাহা করে হেসে উঠল। আনন্দর হাসি। ফজলকে বিভ্রান্ত হতে দেখে আনন্দ পেয়েছে। ফজলের বিভ্রান্তি মানেই আপনের সফলতা। হাসি থামিয়ে বলে, ‘আরেকটু আগে তোমার সঙ্গে দেখা হলে দুজনে একসঙ্গে ভাত খাওয়া যেত। এখন তুমি আমাকে নিয়ে চল ইবনে নাদের মিয়া।’

ফজল কোনও কথা বলে না। রিকশা টেনে নিয়ে রাস্তায় থামায়। লোকটাকে বিভ্রান্ত করতে আপনের ভালো লাগে। আরেকটু বিভ্রান্ত করতে ইচ্ছে করে। বছরের এই সময়ে ছেলেমেয়েদের পরীক্ষা থাকার কথা। পরীক্ষা বিষয়ে দুয়েকটা সবজান্তা বাক্য ঝাড়া যায়। ফজলের ছেলে না মেয়ে এটা জানা নাই। এটা অবশ্য কোনও সমস্যা না। ব্যবস্থা আছে।

আপন আলাপ জমাবার সুরে বলল, ‘বাচ্চারা লেখাপড়া না করলে খুবই মেজাজ খারাপ হয় না ইবনে নাদের মিয়া? এই যে তুমি এত কষ্ট করে টাকা পয়সা রোজগার করে বাচ্চারে স্কুলে পাঠাও, স্যারেরা যখন বলে বাচ্চা লেখাপড়া করে না তখন ধরে পিট্টি লাগাতে ইচ্ছা করে না?’

মফিজ রিকশার প্যাডেল ঘোরাতে ঘোরাতে একবার পেছন ফিরে তাকাল। কোনও কথা বলল না। তবে রিকশার গতি বেড়ে গেল।

আপন বলতে থাকে, ‘তুমি তো মাথা গরম মানুষ ইবনে নাদের মিয়া, মার শুরু করলে তো আধমরা করে ফেল। কিন্তু বাচ্চাদের এভাবে মারতে হয় না। মারলে বাচ্চা কথা শোনে না। বেয়াদব হয়। বুঝতে পারছ?’

রিকশা ঝড়ের গতি পায়। আপনকে দ্রুত খসাতে হবে। এই লোকের সামনে নিজেকে নগ্ন বোধ করতে থাকে ফজল। পড়ে যাওয়ার ভয়ে আপন শক্ত করে রিকশার হুড ধরে বসে থাকে। তার খুব হাসিও পায়।

গন্তব্যে পৌঁছে আপন বলে, ‘ইবনে নাদের মিয়া একটু সাহায্য কর। ব্যাগটা একটু সামনে এগিয়ে দিয়ে যাও।’

ফজল কোন কথা না বলে পায়ের কাছে রাখা ব্যাগটা তুলে আপনের পেছন পেছন হাঁটতে থাকে। বাঁশঝাড়ের কাছে পৌঁছে একটা ফাঁকা জায়গা দেখিয়ে আপন বলে,

‘ওই যে ওইখানে রাখ।’

‘এইখানে কি!’

ফজলের কন্ঠ আর চোখে বিস্ময়। আপন সুন্দর করে হাসল। কিছু বলল না। ফজল আবার বলে, ‘আপনে এইখানে থাকবেন!’

আপন এবারও কিছু বলল না। হাসল। ব্যাগ থেকে সদ্য কিনে আনা পাটের সুতলি পুঁতে রাখা ডালে পেঁচাতে লাগল। ফজল লক্ষ্য করল চার কোণায় চারটা গাছের ডাল পোঁতা। ডালগুলো আপন সকালে পুঁতে রেখেছে। সুতলি দিয়ে সেটাকে ঘিরে ফেলতে লাগল। এবার যেন এবার ভয় পেল ফজল। ভয় পাওয়া গলায় বলল, ‘এইটা কি!? আপনে কেডা?’

তখনই দুজন লোককে সড়ক পেরিয়ে বাঁশঝাড়ের দিকে আসতে দেখা গেল। কাছাকাছি হতে দেখা গেল মসজিদের ঈমাম সাহেব আর বয়স্ক একজন মানুষ। বয়স্ক মানুষটি লুঙ্গির সঙ্গে সাদা পাঞ্জাবি আর টুপি পরে আছেন। ধবধবে সাদা চুল আর দাড়ি।

দুজনে কাছে আসতেই ফজল সসম্ভ্রমে সালাম দিল। ঈমাম সাহেব পরিচয় করিয়ে দিলেন, ‘ইনি মাস্টর বাড়ির দাদাজান। এই এলাকার বিশিষ্ট ভদ্রলোক। এই জায়গাটাও ইনার।’

এই জায়গাটা মানে হলো, বৃদ্ধ এই বাঁশঝাড়, পুকুরটার মালিক। আপন সঙ্গে সঙ্গে এগিয়ে গিয়ে বৃদ্ধের পা ছুঁয়ে সালাম করল। তারপর মাথাটা নিচু করে এগিয়ে দিয়ে বলল, ‘দাদাজান দোয়া করে দেন।’

বৃদ্ধ স্মিত হাসলেন। তাঁর মুখটা উজ্জ্বল হয়ে উঠল। আদর করার ভঙ্গীতে আপনের চুলে হাত বুলিয়ে প্রসন্ন ভঙ্গীতে বললেন, ‘তুমি কে? কোত্থেইকা আসছ? ঈমামে বাচ্চা মেয়ের কবরের কথা কি কি সব বলল। বিষয়টা কি?’

আপন ঈমামকে বলা গল্পটা সবিস্তারে আবার বলল। উপসংহারে এসে জানাজার প্রসঙ্গও তুলল। বলল, ‘দাদাজান, মৃতদেহ সামনে রেখেই তো জানাজা পড়ার নিয়ম। এখন কি জানাজা পড়া যাবে? গায়েবি জানাজা পড়লে হবে না?’

আপনের কন্ঠে গভীর উদ্বেগ। বৃদ্ধ আপনের উদ্বেগটার প্রতি সহমর্মিতা প্রকাশ করলেন, ‘চোখে না দেখে একটা স্বপ্নের উপর ভরসা করে অচেনা অজানা জায়গায় একটা বাচ্চার আত্মার শান্তির জন্য তোমার মন অশান্ত হইছে। তোমার মন শান্ত করা দরকার। মিলাদ নাকি পড়াইতে চাইছ, মিলাদ হবে। তবে জানাজার বিষয়ে মাসলা নিতে হবে। আছরের আজান হইলে মসজিদে চইলা আইসো। চল ঈমাম আমরা যাই।’

ঈমাম সাহেব এতক্ষণ আপনের দিকে সরু চোখে তাকিয়ে ছিলেন। বৃদ্ধ চলতে শুরু করতে তিনিও বৃদ্ধের পেছন পেছন হাঁটতে লাগলেন।

ফজল এতক্ষণ চুপ করে দাঁড়িয়ে সব শুনছিল। দুজনে চলে যেতেই সামান্য এগিয়ে বলল, ‘ভাইজান, আপনে কি পীর? না ফকির?’

আপন ফজলের দিকে তাকিয়ে তার সুন্দর হাসিটা হাসল। কোনও জবাব দিল না। এইরকম প্রশ্নর জবাব দেওয়ার নিয়ম নেই। তখনই আছরের আজান শুরু হলো।

আপন বলল, ‘ইবনে নাদের মিয়া, চল মসজিদে যাই। মিলাদে শরিক হওয়া দরকার।

‘আপনে যান ভাইজান। নামাজ পড়তে হইলে আমার পাক হওয়া লাগবে। মুইত্তা পানি লই নাই।’

আপন হাহা করে হাসতে লাগল। ফজল বিস্ময় নিয়ে আপনের দিকে তাকিয়ে ভাবতে লাগল, এই লোক এত সুন্দর করে হাসতে কেমনে শিখল!

হাসতে হাসতেই আপন বলে, ‘আচ্ছা, জিনিসপত্র এখানে রেখে গেলে কেউ নিয়ে যাবে না তো?’

‘কিছু হবে না। আপনে যান। আমি জিনিসপত্রের পাহারায় আছি।’

আপন কিছু বলল না। ও জানে, এখন আপনের ক্ষুদ্র সম্পদগুলো ফজল জীবন বাজি রেখে আগলে রাখবে।

 

পাঁচ

মিলাদ শেষে মসজিদ থেকে বেরুতে দেখা গেল উঠানের চাপকল থেকে সামান্য দূরে ফজল আপনের স্থাবর অস্থাবর সম্পত্তি নিয়ে বসে আছে। আপনের হাতে কয়েকটা জিলাপি। জিলাপিগুলো ফজলের দিকে বাড়িয়ে দিল। ফজল খুব ভক্তিতে দুহাত পেতে নিয়ে কাঁধের গামছায় যত্ন করে বেঁধে রাখল। কয়েকজন কৌতুহলী মুসুল্লি বাঁশঝাড়ের কবর নিয়ে আলোচনা করতে করতে নিজেদের পথে চলল।

ফজল বাঁশঝাড়ের জায়গাটায় পৌঁছে দেখে আপন কোত্থেকে অনেকগুলো কলাপাতার ওপর একটা চাদর বিছিয়ে বিছানার মতো করে ফেলেছে। এখন বিছানার এক কোণায় একটা ডাল রেখে মোটা একটা বাঁশ দিয়ে পেটাচ্ছে।

ফজল অবাক হয়ে বলল, ‘ভাইজান কি করেন!’

‘মশারি টানানোর জন্য খুঁটি পুঁতি ইবনে নাদের মিয়া। নইলে তো ঘুমানো যাবে না।’

‘আপনে এইখানে ঘুমাইবেন!’

‘হাহাহা..এখানে ঘরবাড়ি পাব কই! এখানে তো আমার কেউ নাই।’

‘এইখানে সাপখোপ আছে ভাইজান।’

‘সাপখোপ নিয়ে ভয় পাওয়ার কিছু নাই। সাপ আমার কাছে আসবে না।’ বলে স্বভাবসুলভ হাসি হাসতে লাগল আপন। ফজলের চোখে ভয় দেখা গেল। নিতান্তই অজানা অচেনা জায়গায় এসে এইভাবে কেউ বাস করতে পারে এটা সে বিশ্বাস করতে পারছে না।

ঘন্টা দুয়েক পরে দেখা গেল মাস্টর দাদাজানের অনুমতিতে বাঁশঝাড় থেকে বাঁশ কেটে নিয়ে মাটি থেকে ফুট দেড়েক উঁচু একটা খাটিয়ার মত বানিয়ে ফেলেছে ফজল। অনুমতি আনতে গিয়ে একটা হারিকেনও নিয়ে এসেছে। চারকোণায় খুঁটি পুঁতে মশারি টানানোর ব্যবস্থাও করে ফেলেছে। আপন কৃতজ্ঞ বোধ করল। লোকটাকে টাকা দিতে ইচ্ছে করল। কিন্তু যদি কিছু মনে করে।

‘ইবনে নাদের মিয়া, আমার জন্যে তুমি অনেক করেছ। অপরিচিত কারও জন্যে কেউ এত কিছু করে না। এখন বাড়ি যাও।’

ফজল তার গামছাটা নিয়ে একদিকে বাঁধা পুঁটুলিটা খুলল। মিলাদের জিলাপি রয়েছে সেখানে। আজলা ধরার ভঙ্গিতে আপনের সামনে ধরে বলল, ‘ভাইজান, একটা ফুঁ দিয়া দেন।’

এই প্রথম আপন হাসল না। তার হাসি পেল না। তার খুব কষ্ট হলো। আমাদের দেশের এই মানুষগুলো এত বেশি সরল কেন! ভাবতে ভাবতে জিলাপিতে ফুঁ দিয়ে দিল।

একবার মাওলানা ভাসানীর কাছে একলোক গেল পানি নিয়ে। পানির গ্লাস সামনে দিয়ে বলে, ‘হুজুর পইড়া দেন। বিবির খুব জ্বর।’

মাওলানা ভাসানী বললেন, ‘পইড়া দিতে পারি কিন্তু শর্ত আছে। আমার পইড়া দেওয়া পানি ওষুধের সঙ্গে খাইতে হবে। নইলে কিন্তু পানিপড়া কাজ করবে না।’
লোকটা রাজি হয়ে পানি পড়া নিয়ে চলে গেল।

মাওলানা ভাসানী বাঙালিকে চিনতেন। জানতেন মানুষের বিশ্বাসে আঘাত করতে নেই। আঘাত না করে তাকে তৈরি করতে হয়। আমরা মানুষকে তৈরি করতে শিখি নি। আঘাত করতে শিখেছি। ফলে মানুষ তার কুসংস্কার থেকে বের হওয়ার বদলে তাকে আরও আঁকড়ে ধরেছে। ধর্মব্যবসায়ীরা মাথা চাড়া দিয়ে উঠতে পারছে।

ভাবতে ভাবতে আপন নিঃশব্দে জিলাপিতে ফুঁ দিয়ে বলল, ‘এই জিলাপি রাতে ভরপেট খাওয়া দাওয়ার পর তোমার বউ আর বাচ্চাকে খাইয়ে দিবা। বউ খেতে না চাইলে বউকে ধরে পিটানি দিবা। বুঝতে পারছ ইবনে নাদের মিয়া? এখন যাও।’

ফজল দাঁত বের করে হাসল। আপনের কথায় সে আনন্দ পেয়েছে। তারপর সালাম বলে নিজের পথ ধরল।

ফজল চলে যেতে আপন ব্যাগ থেকে কার্বোলিক অ্যাসিডের বোতল বের করে খাটিয়ার চারপাশে ছিটাতে লাগল। ছিটানো হয়ে গেলে মশারি টানিয়ে বিছিয়ে রাখা চাদরটাই গায়ে মুড়িয়ে শুয়ে পড়ল আপন। সারাদিন বিশ্রাম না পাওয়া ক্লান্ত শরীরটা একটু পরে ঘুমিয়েও পড়ল।

 

ছয়

-‘জনাব কি নিদ্রা যাইতেছেন?’

এই সংলাপেই ঘুমটা ভাঙল আপনের। চোখ মেলে দেখে ঝিরঝির বাতাসে বাঁশগাছ নড়ছে। মশারিটা নেই। শীত শীত লাগছে। চাদরটা শরীরে ভালোমত জড়িয়ে উঠে বসল আপন। তারপর স্বগতোক্তির মতো করে বলল, ‘মশারিটা গেল কই!’

‘চৌর্যবৃত্তি হইছে মনে হয় জনাব।’

আপন তাকিয়ে দেখে অপরিচিত একলোক নিরাসক্ত মুখভঙ্গীতে দাড়িয়ে আছে। চপচপে তেল দেওয়া লোকটার চুল কাঁধ ছাড়িয়েছে। পরনে লুঙ্গী। শরীরে লাল রঙের ছাপা ফুলশার্ট। শার্টের হাতা থেকে শুরু করে কলার পর্যন্ত সবকটা বোতামে লাগানো।

আপন লোকটার দিকে তাকিয়ে বলল, ‘আপনি কে?’

লোকটা নিজের পরিচয় দিতে আগ্রহী হলো না। মাথা ঘুরিয়ে চারপাশ দেখতে দেখতে বলল, ‘মাজার নাকি খুলতেছেন। মাজার অবলোকন করতে আসছি। মাজার কই জনাব?’

লোকটার কন্ঠে কি তাচ্ছিল্য? সদ্য ঘুম ভাঙা আপনের মেজাজ খারাপ হলো। মেজাজ খারাপ নিয়েই বলল, ‘মাজার এখনও খোলা হয় নাই। খোলা হবে। আপনি কি মুরিদ হতে এসেছেন? তাহলে পরে আসেন। ফরম কিনে নিয়ে ফিলআপ করে নিয়ে আসবেন। সঙ্গে আবেদন পত্র জমা দিবেন।’

‘কিসের ফরম জনাব!’ লোকটা সরু চোখে প্রশ্ন করল। আপন ফাজলামো করছে কিনা বুঝতে পারছে না।

‘মুরিদ হতে চাওয়ার ফরম। যারা মুরিদ হতে চাইবে তাদেরকে ফরম ফিলআপ করতে হবে। ফি পরিশোধ করতে হবে। ফি কত হবে সেটা এখনও ঠিক হয় নাই। ঠিক হলে পত্রিকায় বিজ্ঞাপন দেওয়া হবে। যার মাজার তার সঙ্গে ফি কত হবে সেটা নিয়ে আলোচনা চলছে।’

লোকটাকে এবার বিভ্রান্ত দেখায়। আপনের কথাগুলো বিশ্বাসও করতে পারছে না আবার অবিশ্বাসও করতে পারছে না। আপন এবার মজা পায়।

লোকটাকে ভড়কে দিতে বলল, ‘আর আপনি তো পাপী মানুষ। ধর্ম বিষয়ক কিছুই জানেন না। আপনাকে মুরিদ বানানো তো বিপদজনক।’

‘আমি পাপী!? কি পাপ করেছি জনাব?’ লোকটার চোখে মুখে কন্ঠে অপার বিস্ময়।

‘অনেক পাপ করেছেন। আপনার করা সর্বশেষ পাপ হলো, একজন নিদ্রান্ত মানুষকে বিরক্ত করেছেন। নিদ্রান্ত মানুষকে তার নিদ্রা ভাঙিয়ে জানতে চেয়েছেন সে নিদ্রা যাইতেছে কিনা। এটা করা হাদিসে নিষেধ আছে। ধর্ম নিয়ে পড়াশুনা থাকলে এটা করতেন না।’

লোকটা এবার সত্যিই ভড়কে গেছে। মিনমিন করে বলল, ‘এইখানে কবর আছে বইলা কেউ জানে না। তাছাড়া এক এলাকায় দুইটা মাজার থাকা ঠিক না, নিষেধও আছে। যেই এলাকায় মাজার নাই আপনে সেই এলাকায় গিয়া মাজার খোলেন জনাব।’

এবার আপনের কাছে ব্যাপারটা পরিষ্কার হয়। এই লোকটা আশপাশের কোনও মাজার থেকে এসেছে। আপন এখানে মাজার করলে এদের পসার কমে যাবে। মানুষকে বোকা বানানোর ব্যবসায় এরা আপনকে তাদের ব্যবসায়িক প্রতিদ্বন্দ্বী ভাবছে।

আপন বলল, ‘কবর আছে। ওই দেখেন কবর। ওইটাই মাজার হবে।’

‘কার মাজার!’

‘বাচ্চা মেয়ের মাজার। মুক্তিযুদ্ধের সময় মেয়েটাকে পাকস্তানি আর্মি আছাড় দিয়ে মাটিতে ফেলে বুট দিয়ে পাড়া দিয়ে দিয়ে পিষে মেরেছিল।’

তখনই শোনা গেল, ‘সালামালাইকুম ভাইজান। আপনে উঠছেন?’

ফজলের ডানহাতে একটা কনডেন্সড মিল্কের কৌটা, তাতে একটা সাদা রঙের কাপ উল্টো করে বসানো। ফজলের বামহাত ধরে পাঁচ ছয় বছরের একটা ছেলে দাঁড়িয়ে আছে। বাচ্চাটার বড় বড় চোখে কৌতুহল ঝিকমিক করছে। ফজল কাছে এগিয়ে এসে কৌটা থেকে কাপে চা ঢেলে এগিয়ে দিল। চা নিয়ে এতটা দূর আসতে আসতে ঠান্ডা আর পানসে হয়ে গেছে। কিন্তু অযাচিত এই প্রাপ্তী আপনের কাছে অমৃতের মতো লাগল।

ফজল বাচ্চাটাকে বলল, ‘ওই হারামজাদা, ভাইজানের পা ধইরা ছালাম কর।’

জবাবে বাচ্চাটা ফজলের পেছনে আড়াল নিল। আপন বাচ্চাটাকে দেখে মুগ্ধ হয়ে গেল। রাজ্যর দুষ্টুমি আর কৌতুহল বাচ্চাটার মুখে বাসা বেঁধেছে।

আপন বলে, ‘ইবনে নাদের মিয়া, তোমার ছেলে নাকি?…কিরে ব্যাটা, সারাদিন তো মা বাপকে প্রশ্ন করতে করতে বিরক্ত করে ফেলিস্। এখন এত লজ্জা পাস্ ক্যান? এদিকে আয়।’

‘ভাইজান তো সবই জানেন। এই পোলায় ত্যক্ত কইরা শ্যাষ কইরা ফেলতেছে। স্কুলে দিছি কিন্তু লেখাপড়া করে না। স্যারেরা বলছে এরে স্কুলে রাখবে না। আপনের কাছে আনছি একটু দেইখা দিবেন।’

‘রাখবে রাখবে, ভেবো না। তোমার ছেলেকে নিয়ে পরে এসো, ফুঁ দিয়ে দিব। এখন যাও। আমি এখন দিগম্বর হয়ে পুকুরে গোসল করব।’

‘কি হইয়া গোসল করবেন!’

‘ন্যাংটা হইয়া গোসল করব। যাও এখন।’

খিকখিক করা হাসি শোনা গেল। লাল শার্টঅলা হাসছে। ফজল এতক্ষণ লক্ষ্য করে নি। হাসির শব্দে তার দিকে তাকিয়ে দেখে লোকটা চলে যাচ্ছে।

‘ওইটা পূব পাড়ার মাজারের খাদেম না? হেয় আসছিল ক্যান ভাইজান?’

‘আমার মুরিদ হতে এসেছিল। মুরিদ করি নাই। তুমি এখন যাও ইবনে নাদের মিয়া।’

বিস্মিত ফজল ভাষা হারিয়ে ফেলে। এলাকার আগুন গরম মাজারের খাদেম এসেছে ভাইজানের মুরিদ হতে! সে আর ভাবতে পারে না। ভাইজানের অবাধ্য হয়ে নিজের মুরিদ হওয়ার সুযোগ সে হারাতে চায় না।

ছেলের দিকে তাকিয়ে তার মাথার পেছনে কষে একটা চড় মারল ফজল, ‘হারামজাদা, তোরে না কইছি ভাইজানরে সালাম দিতে, দেস্‌ না ক্যা?’ তারপর ছেলের হাত ধরে দ্রুত হাঁটতে লাগল।

 

সাত

ফজল খাটিয়াটা বেশ ভালো একটা জায়গা বেছে বানিয়েছে। চারপাশে অনেক রোদ। কিন্তু খাটিয়ায় কোন রোদ পড়ছে না। সরু বাঁশগাছগুলো নিজেদের সরু সরু ডালপাতা মেলে ছায়া দিয়ে আগলে রেখেছে যেন। আপন খাটিয়ার ওপর উপুর হয়ে শুয়ে ডায়রিতে কিছু লিখছিল।

‘আপনি কী কবিতা লেখতেছেন?’

চমকে উঠে ধড়মর করে উঠে বসল আপন। ঠিক সামনে আগুন দাঁড়িয়ে। দাউ দাউ করে জ্বলছে। আরে! এ তো একটা মেয়ে! গাঢ় কমলা রঙের পোশাক আর ওড়না পেঁচানো। রোদ পড়ে উজ্জ্বল হয়ে আগুন হয়ে আছে যেন।

মেয়েটা আবার বলল, ‘আপনি কী কবিতা লেখতেছিলেন?’

অপ্রস্তুত হওয়া আপনের স্বভাবে নেই। যে কোনও পরিবেশ আর পরিস্থিতিতেই আপন অনেক প্রাণবন্ত। কিন্তু কবিতা লেখার সময় মন আর্দ্র থাকে। তখন খেই হারিয়ে ফেলে। আমতা আমতা করতে লাগল, ‘না..মানে ইয়ে… আপনি কে!’

‘আমি পাগলের ওষুধ। আপনি নাকি পাগল? তাই আসছি। আপনারে ওষুধ দিব। দেখান, কবিতা দেখান।’ বলেই মেয়েটা খিলখিল করে হেসে ওঠে।

আপন বিমূঢ় হয়। বিমূঢ় হয়ে তাকিয়ে থাকে। তারপর বিমূঢ়তা কাটাতে আবার বলে, ‘বলেন আপনি কে!’

হাসির তোড়ে মেয়েটার পুরো শরীর ঝাঁকুনি খেতে থাকে। হাসির ভঙ্গিটা বড় সুন্দর। হাসার সময় বাঁ হাত ভাঁজ হয়ে আড়াআড়ি পেটের ওপর চলে আসে আর ডান হাত মুখ চাপা দেয়। আপন কথা বলে না। তাকিয়ে থাকে। তাকিয়ে থাকতে আপনের ভালো লাগে।

হাসি থামিয়ে মেয়েটা বলল, ‘দাদাজান দুপুরে আপনাকে খেতে বলছেন। জোহরের নামাজের পর আমাদের বাড়িতে চইলা আইসেন। দেইখেন, কবিতায় ডুইবা আবার ভুইলা যাইয়েন না। আমাদের বাড়ি চেনেন তো?’

‘মাস্টারবাড়ি?’ জানতে চাইল আপন।

‘হ্যাঁ। না চিনলেও সমস্যা নাই। আপনের চামচায় চিনে। চামচা নিয়ে চইলা আইসেন।’

বলেই মেয়েটা আবার ডান হাতে মুখটা চেপে হাসতে লাগল। আপনের খুবই মেজাজ খারাপ হল। এটা নিমন্ত্রণ নয়, এটা রীতিমত অপমান। বিরাট অপমান। কিন্তু এখন অপমান গায়ে মাখার সময় নেই। সময় বড় কম।

‘অবশ্যই যাব।’ কন্ঠে বিপুল উৎসাহ ফুটিয়ে বলল আপন। মেয়েটা চলে গেল। আপন তাকিয়ে রইল। তাকিয়ে থাকতে আপনের ভালো লাগে।

 

আট

মেয়েটার নাম জানা গেল। মেহরীন। স্থানীয় কলেজে পড়াশুনা করে। দুপুরের খাবার খেতে খেতে দুপুর গড়িয়ে গেল। খাবারের পর আপন আর মেহেরিনকে মেঠোপথ, ক্ষেতের আ’ল ধরে হাঁটতে দেখা গেল। দূর থেকেই মেহরীনের কাঁচ ভাঙা হাসি শোনা যাচ্ছিল।

বিকেলে বাঁশঝাড়ের পুকুরের পাশে আপনের বাঁশের খাটিয়ায় দুজনকে পাশাপাশি বসে গল্প করতে দেখা গেল। মেহরীনকে আপনের হাতের ডায়েরিটা বারবার ছিনতাই করার চেষ্টা করতেও দেখা গেল। অবশেষে আপনকে শর্তসাপেক্ষে তার ডায়েরিটা মেহরীনকে দেখাতে রাজি হতে দেখা গেল। সন্ধ্যা পর্যন্ত তারা দুজনে পড়ল। গল্প করল। হাসল। একটু দূর থেকে আড়ালে দাঁড়িয়ে এই দেখাগুলো চেয়ে চেয়ে মসজিদের ঈমাম সাহেব দেখছিলেন।

ঈমাম সাহেব মাস্টারবাড়িতে আগে জায়গীর থাকতেন। এখন তাদেরই মসজিদে ঈমামতি করেন। মাস্টারবাড়িতে ঘরের ছেলের মতোই যাতায়াত তার। মেহরীনকে ছোটবেলা দেখেছেন, পড়িয়েছেন। বুকের ভেতরে মেহরীনের জন্যে অসম্ভব মমতা যে তৈরি হয়ে গিয়েছে সেটা তিনি বুঝতে পারেন নি। মাস্টারবাড়ির মানুষদের স্নেহ ঈমাম সাহেবকে স্বপ্ন দেখতে প্ররোচনা দেয়।

সন্ধ্যা হয়ে এল। মাগরিবের নামাজ পড়াতে হবে। ঈমাম সাহেব মসজিদের দিকে রওনা হলেন। কিন্তু বুকের ভেতরটা তার অশান্ত। বড় অস্থির তিনি।

 

নয়

মশারি চৌর্যবৃত্তি হওয়ার ফলে সারাটারাত আপন ঘুমাতে পারে নি। মশারা একলা ছিল না। তাদের প্রতিবেশি বিভিন্ন পোকামাকড়েরা মশাদেরকে সহযোগিতার চূড়ান্ত করেছে। আপন সারারাত একটা চাদরে আপাদমস্তক ঢেকে বসেছিল। কিন্তু চাদরকে পোকারা-মশারা থোরাই কেয়ার করেছে। চাদর যেন আপনের চেয়ে বেশি অসহায় হয়ে পড়েছিল। বসে বসে ঝিমুনি এলেই সকল পোকা আর মশারা মিলেমিশে ঝিমুনি ছুটিয়ে দিয়েছে।

ভোরের আলো ফুটতে একটু নিস্তার পাওয়া যেতে লাগল। তখন একটু তন্দ্রামত এল। হাঁটু ভেঙে কুঁজো হয়ে বসে থাকা আপন ওই অবস্থাতেই শুয়ে পড়েছিল।

-‘জনাব কি নিদ্রা যাইতেছেন?’

আপন চোখ মেলল। সকাল হয়ে গেছে। মাথার কাছে কালকের সেই মাজারের খাদেম লোকটা দাঁড়িয়ে আছে। লোকটার পোশাক আজ ভিন্নরকম। সাদা লুঙ্গি, খালি গা। গায়ে একটা লাল কাপড় জড়ানো।

আপন শোয়া থেকে উঠে বসে বসে বলল, ‘আপনি আবার এসেছেন?’ আজও আমার ঘুম নষ্ট করলেন।’

‘জ্বী জনাব। কালকার মতো আপনের ঘুম ভাঙায়া আবারও লঘু পাপ করলাম।’

‘এইটা লঘু পাপ নাকি?’

‘জ্বী জনাব লঘু পাপ। গুরু পাপ হইল হত্যা। মানব হত্যা।’

বলেই লোকটা দাঁত বের করল। হাসছে নাকি! লোকটা কি হুমকি দিচ্ছে? আপন তার দিকে তাকাল। এতক্ষণ লক্ষ্য করে নি। দুজন তরুণ লোকটার পেছনে দাঁড়িয়ে। লোকটা তখন আবার আগের মত ভাবলেশহীন।

‘আপনাকে তো কাল বলেছি এখন মুরিদ হওয়া যাবে না। ফরম ফিলাআপ করা লাগবে। ফরম এখনও আসে নি। ফরম আসুক তখন আসবেন।’

‘জ্বী জনাব বলছেন। ফরমের জন্য আসি নাই। এই দুই বিশিষ্ট লোক আপনের মাজার নিয়া আগ্রহ প্রকাশ করছেন। তারা আপনের সাথে আলোচনা চালাইতে উৎসাহ জানাইছেন। তাই তাহাদেরকে নিয়া আসছি।’

আপন দুজনের দিকে তাকাল। দুজনেই জিন্সের প্যান্ট পরেছে। এই প্যান্ট দেখে বোঝা যায় অত্যন্ত পরিশ্রমী প্যান্ট। পায়ের গোড়ালি থেকে কোমর পর্যন্ত আঠার মতো এঁটে বসেছে। একজন কালো ফুলহাতা শার্ট পরা। শার্টের হাতা কনুইয়ের ওপর পর্যন্ত গোটানো। বুকের অর্ধেক বোতাম খোলা। অপরজন কলারঅলা টিশার্ট পরেছে। দুজনের গলাতেই সোনার চেইন ঝুলছে। টিশার্টঅলার চেইনে বড় গোলাকৃতি একটা লকেট ঝুলছে।

কালো শার্ট বলল, ‘আপনে বলে এইখানে মাজার খুলতেছেন?’

‘এখনও খোলা হয় নি। খোলা হবে। আপনিও কি মুরিদ হতে চান?’

দুজনেই হাহা করে হেসে উঠল। যেন খুব মজা পেয়েছে। তারপর হাসি থামিয়ে বলল, ‘মুরিদ তো আপনেরে আমাদের হওয়া লাগবে। আমাদের পারমিশন ছাড়া মাজার খুলতে আইসা জাগা দখল নিছেন।’

‘জায়গা দখল নিব কেন। এই জায়গা মাস্টারদাদার। মাস্টারদাদা নিষেধ করলে মাজার হবে না। তিনি তো নিষেধ করেন নি।’ আপন যুক্তি দেখায়।

‘অতশত বুঝি না। এই এলাকায় কিছু করতে গেলে আমাদের চান্দা দেওন লাগে। আপনে আমাদের না জিগায়া দখল নিছেন। আপনের ফাইন হইছে। এখন ডবল চান্দা দেওন লাগব।’

চুলে একটা ঝাঁকুনি মেরে টিশার্ট বলে। দুজনের হুমকি আর কথার ভঙ্গীতে আপন খুব মজা পায়। তার হাসি আসে। হাসেও।

হাসতে হাসতে বলে, ‘ডবল চান্দা তো বুঝলাম। কিন্তু চান্দা আর ফাইন করল কারা সেটাই তো বুঝলাম না। আপনারা কারা? আপনাদের পরিচয় কি?’

‘আপনে এই বিশিষ্ট লোকেদের চিনেন না!’ খাদেমের কন্ঠ থেকে বিস্ময় ঝরে ঝরে পড়ে।

তিনজনকে দেখে মনে হল, এই মুহূর্তে আকাশ থেকে আছড়ে পড়লে অথবা ওদের ওপর বজ্রপাত হলেও ওরা এতটা অবাক হতো না যতটা বিশিষ্টজনদের আপন চেনে নি বলে হয়েছে।

খাদেম দুই বিশিষ্টর গুরুত্ব বোঝাতে লাগল, ‘নৌকা বলেন আর ধানের শীষ বলেন, সরকার যেই চালনা করুক, এনাদের ছাড়া চালনা সম্ভব না। এনারাই সরকার। নৌকার পোশটারে এনাদের ফটো দেখেন নাই? সারা গ্রামে পোশটার আছে। ধানের শীষের সময়ও আছিল। আপনে তো এনাদের অপমান করলেন!’

‘আসলেই ভুল হয়ে গেছে। কি করা যায় বলেন তো?’ আপনের চোখেমুখে হাসি মিটমিট করে। কন্ঠে কৌতুহল।

কিন্তু বিশিষ্টজনেরা রেগে ওঠে। তাদের যে অপমান করা হয়েছে সেটা তারা সহ্য করতে রাজি নয়। কালো শার্ট অনেক কষ্টে জিন্সের দু পকেটে দুহাতের চারটা করে আঙুল ভরতে সমর্থ হয়। তারপর শরীরের সবটুকু ভর বাম পায়ের ওপর ছেড়ে দিয়ে বলল, ‘আপনেরে বিকাল পাঁচটা পর্যন্ত টাইম দিলাম। পাঁচটার মধ্যে বাজারে নৌকার কেলাবে পঞ্চাশ হাজার টেকা নিয়া চইলা আসবেন। টেকা আনতে না পারলে সাড়ে পাঁচটার টেরেনে উইঠা পড়বেন। নইলে পরে কি হবে তার লেইগা আমরা দায়ি থাকব না। ওই, চল্।’

বলে তিনজনেই ঘুরে সড়কের দিকে হাঁটতে লাগল। আপন পেছন থেকে ওদের দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইল। তারপর আড়মোড়া ভাঙল। খাদেম লোকটা যে সুবিধার না সেটা সে বুঝতে পেরেছিল। কিন্তু এতটা মগজহীন সেটা বোঝে নি। এখন কি আরেকটু ঘুমিয়ে নেবে নাকি নাশতা করতে যাবে ভাবতে ভাবতে খাটিয়ায় শুয়ে হাত পা টানটান করে দিল।

‘পীর সাহেবের ঘুম কী ভাঙল?’

মেহরীন কখন এসে দাঁড়িয়েছে আপন টের পায় নি। এখন আর ঘুম হবে না। আপন উঠে বসে বলল, ‘ঘুম ভাঙে নি। ভাঙিয়েছে। এখন ইবনে নাদের মিয়ার জন্যে অপেক্ষা করছি।’

‘ওরা আসছিল কেন?’

‘মাজারের খাদেম? আমার মুরিদ হতে চায়, হাহাহা..’

‘শোনেন, এদের কাছ থেকে দূরে থাকবেন। ওই খাদেম হইল নেশা বেচে, খায়ও। আর ওর সঙ্গের দুইজন খুব খারাপ মানুষ। মার্ডার করে জেলও খাটছে। অল্পদিন পরেই বের হয়ে আসছে। কিছু হয় নাই। এমন কোনও বদ কাম নাই যা এরা করে না। এদের থেকে দূরে থাকেন।’

আপন তার সুন্দর হাসিটা হাসে। আজ মেহরীনের কলেজ নেই। মেহরীন কাল বলেছিল তাদের গ্রামটা ঘুরিয়ে দেখাবে। ওরা হাঁটতে বেরুল। কাছেই নদী। নদীর পারে বাজার গড়ে উঠেছে। বাজারে সাপ্তাহিক হাট বসে। যদিও আজ হাটবার নয়, তবু অনেক মনোহারী পসরা সাজিয়ে বসেছে। চায়ের দোকানে লোকেদের অলস আড্ডা। তারপর খেয়াঘাট। ইঞ্জিন নৌকাদের ভীড়ে বিলুপ্তপ্রায় দাঁড়বাওয়া নৌকাও দেখা গেল। গল্পে গল্পে বেড়াতে বেড়াতে সময় গড়িয়ে যায়। যখন ফিরল তখন বিকেল।

ফজল কবরটাকে ঘিরে একটা বেড়া দিয়ে ফেলেছে। মাঝে কিছু মাটি ফেলে উঁচু করে লাল একটা কাপড় দিয়ে ঢেকে দিয়েছে। কাপড়ের ওপর কয়েকটা গাদা ফুল দেখা যাচ্ছে। এখন জায়গাটা ঝাঁট দিচ্ছে। আপনকে দেখে দাঁড়িয়ে পড়ল। হাসল একটু।

আপন বিস্মিত হয়ে জানতে চাইল, ‘ইবনে নাদের মিয়া তুমি করেছ কি!’

‘মাজার খুলবেন তো তাই সাজায়া ফেলছি। পরে সিমেন্ট দিয়া পাক্কা করলেই ফাইনাল।’

আপন হাহা করে হাসতে লাগল। ফজলও লাজুকভাবে হাসিতে যোগ দিল। আপন হাসতে হাসতে বলল, ‘খুব ভালো করেছ। মাজারকে মাজারের মতো হতে হবে। এখন আমার একটা কাজ করে দাও ইবনে নাদের মিয়া।’

‘কি কাম?’ ফজলের কন্ঠে আগ্রহ।

‘একটা মশারি কিনে এনে দাও। মশারি ছাড়া ঘুমাতে পারছি না।’

ফজল আনন্দর সঙ্গে মশারি কিনে আনতে চলে যায়। আপন কলম হাতে তার ডায়েরি খুলে বসে। সময় এসবের কিছুই পাত্তা দেয় না। নিজের গতিতে বয়ে চলে। বিকেল পাঁচটা পেরিয়ে সন্ধ্যা হয়। তারপর গুটি গুটি পায়ে রাতের দিকে হাঁটতে থাকে। হারিকেনের ভৌতিক আলোয় বসে বসে ভাবতে থাকে আপন।

 

দশ

সেদিন মিরপুরে ইকবালের বাসায় বসে আড্ডা চলছিল। কথায় কথায় লালসালুর প্রসঙ্গ চলে এল। ইকবাল বলছিল, ‘বাঙালি এখন আর সৈয়দ ওয়ালিউল্লাহর সময়কার মতো সহজ সরল নাই। এখন ইচ্ছে করলেই বাঙালিকে ওভাবে বোকা বানানো যায় না।’

অত্যন্ত যৌক্তিক কথা। বাঙালির গর্বে গর্বিত হওয়ার মতো কথা। সমর্থন করা উচিত। কিন্তু সোহেল বেঁকে বসল। সোহেল বলল, ‘আমাদের দেশের মানুষ এখন অনেক পড়াশুনা করছে ঠিকই কিন্তু কিছু কুসংস্কার রয়েই গেছে। মাজার কালচারটা হলো সেসবের একটা।’

‘ঠিক বলছস্, মাজার ব্যাপারটা যে ধর্মের কোনও অংশ না, এটা এখনও বেশিরভাগ মানুষ জানে না।’ আপন সোহেলকে সমর্থন করল।

‘তারমানে কি তোরা বলতে চাস্ মজিদের মতো এখন কেউ কোথাও একটা মাজার বানিয়ে মানুষকে বোকা বানাতে পারবে?’ ইকবালকে কিছুটা বিস্মিত দেখায়।

‘সম্ভব।’ সোহেল বলে। তারপর আপনের দিকে তাকিয়ে বলল, ‘কিরে, সম্ভব না?’

‘সম্ভব।’

আপন সোহেলের কথার প্রতিধ্বনি করে। ইকবাল হাহা করে হাসতে শুরু করল। হাসতে হাসতে বলল, ‘তোরা কোন্ যুগে বাস করস্? এই যুগে লালসালুর মতো গল্প ফেঁদে কেউ একজন গ্রামসুদ্ধ মানুষকে বোকা বানিয়ে ফেলতে পারবে, এটা আমাকে বিশ্বাস করতে বলস্?

‘অবশ্যই পারবে। ইচ্ছা থাকলে যে কেউই পারবে।’ আপন উত্তেজিত ভঙ্গীতে বলে।

‘তুই পারবি?’ আপনের দিকে প্রশ্ন ছুঁড়ে দেয় ইকবাল।

‘অবশ্যই পারব।’ আপনের চোখমুখ কঠিন দেখায়।

‘শোন্ আপন, তোর এখন আবেগের বয়স নাই। ফালতু প্যাঁচাল পারিস্ না।’

ইকবালের এই তাচ্ছিল্য আপনের ভেতরে ক্রিয়া করে। তারপর তারা উত্তেজিত হয়ে পড়ে। আপন হঠাৎ করে আড্ডা ছেড়ে বেরিয়ে পড়ে। হাঁটতে থাকে। হাঁটতে হাঁটতে মিরপুর থেকে কমলাপুর রেলস্টেশনে এসে পড়ল। স্টেশনে বসে রাত কাটিয়ে দিল। পরদিন ভোরে কিছু না ভেবেই প্রথম ট্রেনটাতে উঠে পড়ল।

 

এগারো

আকাশে মেঘ করেছে। কতক্ষণ আগেও অর্ধেকটা চাঁদ ঘুরে বেড়াচ্ছিল। এখন নেই। মেঘ এসে চাঁদটাকে ঢেকে দিয়েছে। কিছুক্ষণ আগে ফজল মশারি কিনে এনে টানিয়ে দিয়ে গেছে। এখন ঠান্ডা বাতাস বইছে। কাল রাতে ঘুম হয় নি। ঘুমে আপনের চোখ মুঁদে আসে। কখন ঘুমিয়ে পড়ে জানতেও পারে না।

কতক্ষণ ঘুমিয়েছে আপন জানে না। ঘুমের মধ্যেই মনে হয় কে যেন ওকে চেপে ধরেছে। ঘুম ভেঙে যায়। কিন্তু অন্ধকারে কিছু দেখা যায় না। নড়তেও পারে না। একটা চাপা কন্ঠ বলে, ‘নইড়েন না। নিজেও তকলিফ পাইবেন আমগোরেও তকলিফ দিবেন।’

আরেকটা কন্ঠ বলে, ‘ভাইজান, ইবলিশগিরি করতে আসছেন ইবলিশগিরিই করতেন, মেহরীনের দিকে হাত বাড়ানো আপনার ঠিক হয় নাই। মেহরিন আমার বিবি হবে।… ভাইয়েরা আপনারা কাজ সমাধা করেন।’

কেউ একজন এসে চুল পেছন দিকে টেনে ধরে। আপনের গলাটা উঁচু হয়। গলায় ঠান্ডা কিছুর স্পর্শ লাগে। তারপর ভিজে যেতে থাকে।

 

বারো

ঝাঁশঝাড়ের সামনে অনেক ভীড়। কিন্তু কেউ ভেতরে যাচ্ছে না। স্কুল সড়কের ওপর একটা পুলিশের ভ্যান দাঁড়ানো। দুজন লোক পাটি দিয়ে পেঁচানো কিছু একটা বয়ে নিয়ে বাঁশঝাড় থেকে বেরিয়ে পুলিশ ভ্যানের পেছনে রাখল। রাখার পর পাটিটা ফাঁক হয়ে এক জোড়া পা বেরিয়ে পড়ল।

পুলিশ অফিসার মাস্টার দাদাজানের সঙ্গে কথা বলছেন। সেখানে মসজিদের ঈমাম সাহেবও দাঁড়ানো। কথা শেষ হলে অফিসার এসে গাড়িতে উঠে বসলে গাড়ি চলতে শুরু করল।

মাস্টরবাড়ির দরজাতেও ছোটখাট একটা ভীড়। বাড়ির সবাই কৌতুহলী হয়ে দাঁড়িয়ে। মেহরীনও। ঈমাম সাহেব এগিয়ে গেলেন সেদিকে। মেহরীনের কাছে গিয়ে একটা ডায়েরি বাড়িয়ে ধরলেন। থমথমে মুখে মেহরিন ঈমাম সাহেবের দিকে তাকাল।

ঈমাম সাহেব বললেন, ‘এইটা তোমার না? ওইখানে মাটিতে পইড়া ছিল। আমি উঠায়ে নিয়া আসছি।’

মেহরীন তাকাল ঈমান সাহেবের হাতে। তিনি আপনের ডায়রিটা বাড়িয়ে ধরে আছেন।

‘হ্যাঁ, আমার।’ খুব ধীরে বলল মেহরিন। তারপর হাত বাড়িয়ে ডায়েরিটা নিল।

 

তেরো

ভোর। লোকটা কবরটার চারপাশ ঝাঁট দেওয়া শেষ করে লাল কাপড়টা তুলে কয়েকবার ঝাড়ল। অনেকটা ধূলা বেরুল। তারপর খুব যত্ন করে কাপড়টা আবার কবরের ওপর বিছিয়ে দিল। কয়েকটা গাদা ফুল ছিটিয়ে দিল কাপড়টার ওপর। তারপর হাঁটতে লাগল সড়কের দিকে। সড়কে এসে দাঁড়াতে দেখে কেউ একজন আসছে। এত ভোরে কে আসে! কাছে আসতে দেখা গেল অপরিচিত কেউ। তাকে দেখে অপরিচিত লোকটা হাসল। তারপর জিজ্ঞেস করল,

‘স্লামালেকুম। কেমন আছেন?’

-‘জ্বী ভালো আছি।’

‘আচ্ছা ভাই, মাস্টারবাড়ি কোন্টা বলতে পারেন?’

‘সামনে যান। ওই যে টিনের বেড়া দেওয়া বাড়িটাই।’

‘অনেক ধন্যবাদ আপনাকে। …ভাই, আমার নাম ইকবাল। আপনার নামটা জানতে পারি?’

‘জ্বী, পারেন। আমার নাম ইবনে নাদের মিয়া।’

মুবিন খান। লেখক ও সাংবাদিক। জন্ম ও বাস বাংলাদেশের ঢাকায়।

এই বিভাগের অন্যান্য লেখাসমূহ

বালির বেহালা

বালির বেহালা

বুড়িমাসি বলেন,জীবনটা বালির ঘর গো।ঢেউ এলে ধুয়ে যায় জীবনের মায়া।তবু বড় ভালবাসা ওদের দাম্পত্যে।রোদের চাদরের…..

তদন্ত

তদন্ত

  এক ড্রইং রুমে বসে রয়েছে সদ্য কিশোর উত্তীর্ণ তরুণ গোয়েন্দা সজীব। সামনের টেবিলে ছড়িয়ে…..