প্রক্সি
তারপর ইলেকট্রিক বিল জমা দিতে যাবো। আমার দেরি হবে আসতে। স্বামী অমর বলে, ঠিক আছে।…..
রেললাইনের ধারে একটা লাল রক্তপিণ্ডের মতো মৃতদেহ পড়ে আছে সবুজ ঘাসের মাঝে। সুমন নামের মৃতদেহটিকে ঘিরে মানুষের ভীড়। এই সুমন খুব সাদাসিধে মানুষ ছিলো। সুমনের রক্তে সবুজ ঘাসের ওপর একটি বেদনার্ত পতাকা আঁকা হয়ে আছে। প্রত্যেক বছর ১৪ ডিসেম্বর রায়ের বাজার বধ্যভূমিতে সুমন লাল-সবুজ পতাকার পোশাক পরে শহীদ বুদ্ধিজীবীদের সম্মান জানাতে যেতো। সুমনের মা সাংবাদিক ছিলেন। একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তানি খুনে বাহিনীর ঘাতক কোলাবরেটরেরা সুমনের মা’কে তার চোখের সামনে ধরে নিয়ে গিয়ে হত্যা করেছিলো। তাই রায়ের বাজার বধ্যভূমিতে গেলেই সুমন তার মায়ের স্পর্শ পেতো।
পুলিশ প্রাথমিক তদন্তে বলছে সুমন আত্মহত্যা করেছে। রেললাইনের ধারের একটি দোকানে সুমন কিছুক্ষণ বসেছিলো; এমন জানাচ্ছে প্রত্যক্ষদর্শীরা। একটি শিশু বলছে, সুমন ওর সঙ্গে কিছুক্ষণ গল্প করেছিলো।
কিন্তু সুমনের সঙ্গে আশৈশব মুক্তিযুদ্ধে পিতা হারানোর বেদনা নিয়ে বেড়ে উঠেছে যারা; তারা তো জানে সুমন এতো সহজে হেরে যাবার মানুষ নয়। যে শিশু তার মাকে হারানোর পর একা একাই এই নির্দয় শহরে বেড়ে উঠেছে; বেঁচে থাকার জন্য বেবিট্যাক্সি চালিয়েছে; তারপর ঠিকই তার মায়ের স্বপ্নের পথ অনুসরণ করে মিডিয়ায় কাজ করেছে। একাত্তরে সুমনের মাকে যে ঘাতকেরা হত্যা করেছিলো; তাদের বিরুদ্ধে মানবতাবিরোধী অপরাধ আদালতে সাক্ষ্য দিয়েছে। সেই সুমন আত্মহত্যা করেছে এটা অবিশ্বাস্য।
সুমনের স্ত্রী বলেন, একাত্তরের ঘাতকদের বিরুদ্ধে সাক্ষ্য দিতে যাওয়ায় সুমনের ওপর দিয়ে অনেক হুমকি-ধামকির ঝড় গেছে। প্রায়ই ফোন করে তাকে হত্যার হুমকি দিতো একাত্তরের খুনিদের দোসরেরা। সুমনকে ওরা নিশ্চয়ই হত্যা করেছে।
সুমন তার নিরাপত্তাহীনতার কথা পুলিশকে জানিয়েছিলো। কিন্তু পুলিশ তাকে কেবল একটি পিস্তল রাখার পরামর্শ দিয়ে দায় সারে। সুমন সাদাসিধে মানুষ। সে হয়তো বলতে পারেনি, আমার মা মুক্তিযুদ্ধে জীবন দিয়েছিলেন বলেই এই আপনারা আজ খুব পুলিশ হয়ে উপদেশ দিয়ে ছেড়ে দিচ্ছেন হত্যার হুমকি পাওয়া একজন মানুষকে। নইলে পাকিস্তানি শাসকের বুট পালিশ করতে হতো এতোকাল।
সুমন যুদ্ধাপরাধীর বিরুদ্ধে সাক্ষ্য দিয়েছে। তার নিরাপত্তা নিশ্চিত করার দায়িত্ব রাষ্ট্রের-পুলিশের। সুমনের এ মৃত্যুর দায় রাষ্ট্রের। একথা বলে বেদনা প্রকাশ করে দৈনন্দিন জীবনের ব্যস্ততায় সুমনকে ধীরে ধীরে ভুলে যেতে থাকে সাধারণ মানুষ।
সুমন মিডিয়া ছেড়ে মুক্তিযুদ্ধের স্বপক্ষের শক্তির ফার্মার্স ব্যাংকে চাকরি নিয়েছিলো। ব্যাংকের মালিক বাঘা লোক। একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তান সরকারের দায়িত্ব পালন করেছেন, বাংলাদেশ আমলে সরকারি চাকুরেদের নিয়ে জনতার মঞ্চে যোগ দিয়ে আওয়ামী লীগের দায়িত্ব পালন করেছেন। সরকারি চাকরি থেকে অবসরের পর আওয়ামী লীগের এমপি-মন্ত্রী হয়েছেন; এরপর গড়েছেন ফার্মার্স ব্যাংক। কৃষক কল্যাণে গড়ে ওঠা ব্যাংকের সঙ্গে সম্পৃক্ত রয়েছেন মালিকের আত্মীয় স্বনামধন্য এক ইতিহাসবিদ। তিনি মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিতে না পারলেও কৃতি ইতিহাসবিদ হিসেবে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস রচনা করেছেন। ‘স্বাধীনতার পক্ষ শক্তি ও বিপক্ষ শক্তি‘ এই পরিচ্ছন্ন বিভাজনসূত্রের রচয়িতা তিনি। তার কাছে জাতির ঋণ অবিশ্বাস্য। আওয়ামী লীগ মানে স্বাধীনতার স্বপক্ষের শক্তি; বাকি সবাই স্বাধীনতার বিপক্ষের শক্তি; এই যুগান্তকারী ডিভাইড এন্ড রুলের পলিটিক্যাল থিওরি দেয়ার পর জাতির জন্য আর কোন উপহার দেয়া বাকি থাকে! তবু স্বাধীনতার স্বপক্ষের শক্তি যেহেতু কৃষকদের ঋণ দিতে চাইছে; কৃষক সমাজকে ঋণী করতে ইতিহাসবিদকেও ‘গরিবের ব্যাংকার‘ হতে হয়।
আর মুক্তিযুদ্ধের স্বপক্ষের শক্তির স্বপ্নের ফার্মার্স ব্যাংকে সুমনকে কাজের সুযোগ দেয়া হলে; সে মিডিয়ার জীবন ছেড়ে ফার্মার্স ব্যাংকের শান্তিনগর শাখায় যোগ দেয়। খুব আনন্দের সঙ্গে কাজ করে সে। ব্যাংক মালিক ও স্বাধীনতার স্বপক্ষের ইতিহাসবিদের প্রতি কৃতজ্ঞতা অনুভব করে। সুমন তার বন্ধু-বান্ধব, আত্মীয়-স্বজনকে সে ব্যাংকে সঞ্চয়ী একাউন্ট খোলায়। অনেকদিন পর মনে হয় জীবনে একটু থিতু হওয়া গেলো। তাছাড়া কৃষক কল্যাণে কাজ করা খুবই আনন্দের কথা।
কিন্তু একদিন সকালে চাকরি চলে যাবার চিঠি পেয়ে বিস্মিত হয় সুমন। ফার্মার্স ব্যাংকের টাকা-পয়সা লোপাট হয়ে গেছে। সরকারের কাছে ব্যাংক বাঁচাতে আবার ঋণ চেয়েছে ব্যাংক মালিক। তাই কর্মচারীদের ডাউন সাইজিং করতে হয়েছে। সুমন বুঝতেও পারেনি মুক্তিযুদ্ধের চেতনার মন্ত্র শুনিয়ে এগিয়ে আসা আরেক শান্তিবাহিনীর পাল্লায় পড়েছে সে। ব্যাংকের মালিক বলেন, সুমন স্বাধীনতার বিপক্ষের শক্তি নিশ্চয়ই ব্যাংকের স্তম্ভ নিয়ে নাড়ানাড়ি করেছে। একটু ব্যাংকটা মেরামত করেই আবার তোমাকে কাজে ডাকবো।
কাজের শখ সুমনের প্রায় মিটেই গেছে। একজীবনে কতরকম দানবের বিরুদ্ধে লড়াই করবে সে! সে বুঝে পায়না কোথায় কার কাছে যাবে! একদিকে স্বাধীনতার বিপক্ষের শক্তির হুমকি-অন্যদিকে স্বাধীনতার পক্ষের শক্তির ছলনায় পথে বসে গেছে সে। যেসব আত্মীয়কে ব্যাংকে টাকা জমা রাখিয়েছিলো সে; তাদের সামনে কীকরে মুখ দেখাবে!
পুলিশ তদন্তে জানাচ্ছে, সুমন আত্মহত্যা করেছে।
সুমনের স্ত্রী দাবী করছেন, সুমনকে একাত্তরের ঘাতকদের দোসরেরা হত্যা করেছে।
সুমনের সন্তানেরা স্বাধীনতার স্বপক্ষের শক্তির যুগে পিতৃহারা ঠিক সুমনের মতোই; যে সুমন স্বাধীনতার বিপক্ষের শক্তির যুগে তার মাকে হারিয়েছিলো। কোথাও কোন লালসবুজ পতাকা পতপত করে উড়তে দেখলেই সুমনের বন্ধুদের মনে হয়, ঐ তো সুমন, খুব পরিচিত প্রশান্ত হাসিটি তার মুখে লেগে রয়েছে।
তারপর ইলেকট্রিক বিল জমা দিতে যাবো। আমার দেরি হবে আসতে। স্বামী অমর বলে, ঠিক আছে।…..
নভেম্বর চলছে। অনির সাথে আজ দেখা হবে তা জানাই ছিল। এই তো ক’দিন আগেই দেখা…..
বুড়িমাসি বলেন,জীবনটা বালির ঘর গো।ঢেউ এলে ধুয়ে যায় জীবনের মায়া।তবু বড় ভালবাসা ওদের দাম্পত্যে।রোদের চাদরের…..
এক ড্রইং রুমে বসে রয়েছে সদ্য কিশোর উত্তীর্ণ তরুণ গোয়েন্দা সজীব। সামনের টেবিলে ছড়িয়ে…..