লিপস্টিক, সিগারেট ও নেশা

ওয়াহেদ সবুজ
গল্প
লিপস্টিক, সিগারেট ও নেশা

: এ্ই, আপনি মদ-টদ খান?

— কী বলো!

: এট লিস্ট বিয়ার?

— নাহ৷

টাইগার-স্পিড এগুলো তো খান?

— না, আমার আসলে এলকোহল পছন্দ নয়৷

: সিগারেট?

— উমহু!

: সে কি! আপনি সিগারেটও খান না?

— না, কিন্তু এতে এত অবাক হবার কী আছে?

: অবাক হবার অনেক কিছু আছে৷ একটা ইয়াং ছেলে, তার কোনো রকম নেশা থাকবে না? এটা হয় কখনো?

— কে বলেছে আমার কোনো নেশা নেই?

: আছে? কী সেটা?

— পরে বলবো কোনো এক সময়!

: আচ্ছা, ঠিক আছে; সে নাহয় পরে শোনা যাবে৷ আমি এখন একটা সিগারেট ধরাবো; আপনার কোনো আপত্তি নেই তো?

নিশার কথা শুনে রাহাতের চোখ কপালে ওঠার মতো অবস্থা৷ এ মেয়ে বলে কি! এমন অদ্ভুত কথা কোনো মেয়ের মুখে সে জীবনে কখনোই শোনেনি৷ একটা মেয়ে হয়ে সে সিগারেট খাবে; ভাবা যায়!

রিকশায় পাশাপাশি বসে, রাহাত এতক্ষণ রাস্তার দিকে তাকিয়ে ছিল৷ অন্ধকারে তেমন কিছু দেখা যাচ্ছে না; রিকশার ছোট্ট টিমটিম আলোতে যতটুকু দেখা যাচ্ছে, ততটুকুই৷ কথাটা শোনার পর সে কৌতূহলি দৃষ্টিতে নিশার দিকে তাকালো৷ এ ঘনঘোর অন্ধকারেও একটি বেহেশতি মুখ সে স্পষ্ট দেখতে পেল; কেমন যেন ঘোর লাগা এক সৌন্দর্য সেখানে মাখা৷

রাহাত বললো, “ঠিক আছে, ধরাও৷”

কয়েক মুহূর্তের ভেতরে ঘুটঘুটে অন্ধকারে লালরঙা জোনাকি জ্বলে উঠলো সিগারেটের প্রান্তে৷ নিশা সিগারেটে একটা টান দিয়ে আলতো করে ধোঁয়া ছাড়লো৷ সে ধোঁয়া রাহাতের মুগ্ধতা হয়ে ছড়িয়ে গেল বাতাসে৷ লাল টকটকে লিপস্টিক-বৃত্তের কেন্দ্রে ধরা একটা সিগারেট— তার মনে হলো এর চাইতে মুগ্ধকর দৃশ্য আর কিছু হতে পারে না, হতেই পারে না!

প্রতিবার ধোঁয়া ছাড়ার পর এক বিস্ময়কর সুন্দর মৃদুমন্দ হাসিতে আকাশ-বাতাস মেতে উঠতে লাগলো৷ কী সুন্দর! কী সুন্দর! r

নিশা বললো, “আপনার সমস্যা হচ্ছে না তো?”

রাহাত মৃদু হেসে উত্তর করলো, “উমহু৷ একটু আজব লাগছে ব্যাপারটা; এই যা৷”

“আজব কেন লাগছে?”

“এক জোড়া নারী-পুরুষ রিকশায় যাচ্ছে; নারীর পদ্মকোমল ঠোঁটে সিগারেট, পুরুষটি মোহিত হয়ে সেটি দেখছে৷ আজব না ব্যাপারটা?”

“হুম, তা বটে৷”

নিশার মুখের আলোক-আভায় আশপাশের অন্ধকারটা কেমন যেন ম্লান হয়ে গেছে৷ এ ম্লান অন্ধকারে নিশার গাল থেকে ঠিকরে পড়া নরম আলোয় ডান হাতের দু আঙুলে ধরে রাখা সিগারেটের শরীরে তার ঠোঁটের লাল স্পর্শ স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে৷ রাহাতের মন চাইলো কিছু সময়ের জন্য সে নিশার হাতে ধরে রাখা সিগারেট হয়ে যায়; মন চাইলো তাকে শুষে নিক, নিঃশেষ করে দিক, তার ঠোঁটের ধোঁয়া হয়ে সে যেন হাওয়ায় মিলায়!

দুই.

গত দুদিনে রাহাতের চোখের পর্দায় কেবল একটিই ছবি— লাল টকটকে লিপস্টিক আর তার মধ্যে একটি সিগারেট; ঘুটঘুটে অন্ধকারে এমন সৌন্দর্য আবার দেখতে মন চায়, বারবার দেখতে মন চায়! তার মন-মগজ-মস্তিষ্কজুড়ে নিশার সিগারেট খাওয়ার দৃশ্য! এটা কোনো কথা হলো? তার কি মাথাটাথা খারাপ হয়ে গেল?

সকালে ঘুম ভেঙেই মোবাইল ফোনটা হাতে নিয়ে নিশার মোবাইলে মেসেজ পাঠালো— ‘ইউ দেয়ার?’ সে জানে, মেসেজের রিপ্লাইটা সাথে সাথেই আসবে— এতটা সৌভাগ্যবানও সে নয়; মেসেজের রিপ্লাই আসবে অন্তত ৫-৬ ঘণ্টা পর, তারচেয়ে বেশিও লাগতে পারে৷ এই যে মেসেজটা পাঠানোর পর থেকে অপেক্ষা শুরু হলো, একটি অনির্দিষ্টকালীন অপেক্ষা, একটি অনিশ্চিত অপেক্ষা, এই অপেক্ষাটাও বেশ মধুর৷ রাহাত গুনগুন করতে থাকে— ‘বেদনা মধুর হয়ে যায়, তুমি যদি দাও৷”

মেসেজের রিপ্লাই এলো গুণে গুণে ঠিক সাতাশ সেকেন্ড পর— ‘আছি তো৷ কী খবর?” রাহাত কিছুটা অপ্রস্তুত, এত দ্রুত রিপ্লাই সে কোনোভাবেই আশা করেনি; লিখলো— ‘বেরোবে আজ?’

উত্তর এলো,’আজ বিকেলে একটু কাজ আছে৷’

মেসেজটি পাঠিয়েই নিশা মৃদু হাসলো; এ হাসিতে রহস্য আর প্রেমের মিশ্রণ৷ ভালোলাগার মানুষগুলোকে ভোগাতেও ভালো লাগে; মানুষের মন দারুণ এক অদ্ভুতুড়ে ইতিহাস৷

ভালোলাগা মানে কেবল ভালোলাগাই, অন্য কিছু নয়; নিশার অন্তত এমনটাই বিভ্রম!

সারাদিন পর রাহাত বাসায় ফিরল একরাশ বিরক্তি নিয়ে৷ আজ সারাদিনে সে যেখানে যেখানেই গিয়েছে, কোনো না কোনোভাবে সিগারেট টানার দৃশ্যগুলোতেই তার চোখ নিবদ্ধ হয়েছে৷ এত কিছু দেখার আছে— গাছ-পাতা-আকাশ-পাখি; অথচ বারবার তার চোখ গিয়ে পড়ে সিগারেট টানার দৃশ্যে৷ এবং সে অবাক হয়ে লক্ষ করেছে, প্রতিটি দৃশ্যই অত্যন্ত কুৎসিত৷ সিগারেট খাওয়ার দৃশ্য তার খুব পছন্দের না হলেও এতটা কুৎসিতও লাগেনি কখনো; সে ভাবলো— মানুষ এমন জঘণ্যভাবে সিগারেট খায় কেন?

বাসায় ফিরতেই মোবাইলে মেসেজ— ‘কাল ফ্রি আছেন?’

রাহাতের বুকের মধ্যে ধ্বক করে উঠলো, হৃদপিণ্ডটা বুকের খাঁচায় ধড়াশ ধড়াশ করে বাড়ি খেতে লাগলো; উত্তর করলো— ‘তোমার জন্য সব সময়ই ফ্রি৷’

নিশার উত্তর, ‘হুম, সে তো জানিই৷ তাহলে কাল বিকেলে দেখা হচ্ছে৷’

কী মনে হলো কে জানে, রাহাত লিখলো, ‘কাল তোমাকে আমি সিগারেট খাওয়াবো৷ এবং এ কাজটা আমি জীবনে প্রথমবারের মতো করবো৷’

‘না, আমি নিজেই কিনতে পারবো; আপনার ভার্জিনিটি নষ্ট করতে চাই না৷’

‘মানে?’

‘মানেটা দেখা হলে বলবো৷’

‘ঠিক আছে, অপেক্ষায় থাকলাম৷’

‘কিসের?’

‘দু-ঠোঁটের মাঝখানে একটি সিগারেট-দৃশ্যের৷’

‘আপনি খাবেন?’

‘উমহু, আমার কেবল দেখাতেই সুখ৷’

পরদিন বিকেল৷ রিকশায় দুজন৷ পাশাপাশি৷ রাহাত দৃষ্টি লুকিয়ে চোরাদৃষ্টিতে দেখে নিল নিশার ঠোঁট৷ যথারীতি লাল টকটকে লিপস্টিক, শৈল্পিক ঠোঁটে লালরঙা কবিতা৷

রাহাত বললো, “সিগারেট কিনবো?”

নিশা দারুণ সুরে হেসে উঠলো; বললো, “কিনুন৷”

সিগারেট কিনতে ঢুকতেই দোকানের সামনে দেখলো একজন মধ্যবয়স্ক লোক ধোঁয়া ছাড়ছে৷ প্রচণ্ড বিরক্তির সাথে রাহাত তাকে লক্ষ করে বললো, “পাবলিক প্লেসে এভাবে সিগারেট টানছেন আর ধোঁয়া ছেড়ে আশপাশের মানুষগুলোর ক্ষতি করছেন৷ এতটা ইরিসপন্সিবল হলে চলে?”

কথাটা বলেই সে দোকানদারের কাছে সিগারেট চাইলো; ঘটনার আকস্মিকতায় মধ্যবয়স্ক ভদ্রলোক বিভ্রান্ত দৃষ্টিতে রাহাতের দিকে তাকিয়ে, তার হিসাব মিলছে না৷

নিশার দিকে এগিয়ে দিয়ে রাহাত বললো, “এই নাও, এখনই ধরাও৷”

নিশা বললো, “ধরাতে পারি এক শর্তে৷”

“কী শর্ত?”

“আপনাকেও খেতে হবে৷”

“কিন্তু আমি তো….”

“সে তো আমি জানিই; আপনি হচ্ছেন ঊনত্রিশ বছরের শিশু৷ আজ আপনাকে শৈশবের ডেরা থেকে বের করা হবে৷”

“শিশু মানে?”

“শিশুই তো! আচ্ছা বলেন তো, আপনি কোনো মেয়ের সাথে শুয়েছেন কখনো?”

“কী বলো এগুলো?”

“এবার হলো তো প্রমাণ?”

“মানে?”

“মানে, আপনি একটা শিশু, কচি, কচি পোলা; ঊনত্রিশ বছরের কচি পোলা৷”

গুরুত্বপূর্ণ কিছু একটা মনে পড়ার ভঙ্গিতে রাহাত বললো, “আচ্ছা, গতরাতে ভার্জিনিটি বিষয়ক কিছু একটা বলছিলে….”

“হ্যাঁ৷ আপনি তো জলজ্ব্যান্ত একটা ভার্জিন বস্তু! আপনি কোনোদিন সিগারেট স্পর্শ করেননি, বিয়ার পর্যন্ত খাননি; মানে, আপনার হাত-ঠোঁট-গলা সব— সবকিছুই ভার্জিন, এক্কেবারে ইনটেক! আচ্ছা, মেইনটেইন কীভাবে করেন?”

নিশার হিউমার প্রয়োগটা বুঝতে পেরে রাহাত ছোট্ট করে হেসে উঠলো; সে হাসিতে অহংকার স্পষ্ট৷

তাকে অবাক করে দিয়ে নিশা বললো, “এ বুড়ো বয়সেও ভার্জিন থাকাটা যতটা না অহংকারের, তার চাইতে বেশি সন্দেহের৷”
কথাটা শুনে রাহাত খানিকটা অপ্রস্তুত৷

সেসব থোড়াই পরোয়া করে নিশা বললো, “যাকগে, আপনার হাতের ভার্জিনিটি তো গেছে, সিগারেট তো স্পর্শ করেই ফেললেন; আপনার ঠোঁটের অহংকারও আজ শেষ করে দেবো৷”

নিশার ঠোঁটে নিঃশব্দ হাসি; এ হাসিটা কেমন যেন অন্য রকম, অন্য কোনো জগতে এর সৃষ্টি৷ দুটো টানটান ঠোঁটের মাঝখানে শরতের শুভ্রতা; রাহাত লক্ষ করলো ঠোঁটের সীমানা ভেঙে এক কোণে খানিকটা লিপস্টিক লেপ্টে আছে; খুব সামান্য, কেবল সুগভীর দর্শনে চোখে পড়ে৷ সাথে সাথে তার সারা শরীরে এক অসম উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়লো— আঙুলের আলতো ছোঁয়ায় সেটা মুছে দেবে, না কি দেবে না?

তিন.

দ্বিধাগ্রস্ত দৃষ্টিতে রাহাতের চোখ নিশার ঠোঁটের কোণে৷ নিশা বললো, “আপনাকে একটা কথা বলি শুনুন; পৃথিবীর প্রায় সকল পুরুষই মনে করে তারা চোরাদৃষ্টিতে নারীশরীরের কোন দিকে তাকাচ্ছে সেটা সে নারী বুঝতে পারে না৷”

রাহাত একটা ধাক্কা খেল; নিশার ঠোঁটের ওপর থেকে দ্রুত চোখ সরিয়ে নিল৷

নিশা বলতে থাকলো, “কিন্তু পুরুষের ধারণাটা একদম ভুল৷ আসলে একশো হাত দূর থেকেও পুরুষের চোখের দিকে তাকিয়ে একটা মেয়ে বলে দিতে পারে পুরুষটি তার শরীরের ঠিক কোন অংশে তাকিয়েছে৷”

রাহাত বললো, “বেশিরভাগ পুরুষের ট্র্যাজেডি তো এখানেই৷”

“মানে?”

“মানে, পুরুষ কোন দিকে তাকিয়েছে নারী এটুকুই কেবল বোঝে, দৃষ্টির ভাষাটা কখনোই বোঝে না৷”

নিশা উচ্চতানে হেসে উঠলো; সে হাসিতে নিস্তরঙ্গ হাওয়ায় এক দারুণ সুরঝংকার খেলে গেল৷

রাহাত বললো, “হাসলে কেন?”

“কারণ, ছেলেদের এই এক সমস্যা, তারা চোখের ভাষা বোঝাতে চায়৷ শুনুন, চোখের কোনো ভাষা থাকে না; ওসব বুলশিট৷”

“মানুষের চাহনির কোনো অর্থ থাকে না?”

“না৷ কারণ প্রতারক ও প্রেমিকের দৃষ্টি সচরাচর একই রকম হয়৷”

“প্রেমিক আর প্রতারকের মধ্যে কোনো পার্থক্যই দেখতে পেলে না?”

“এই যে ধরুন, আজ আপনি প্রেমিকের অবস্থানে; কে জানে, এই আপনিই হয়তো কাল প্রতারকের বেশে৷ এখন আপনিই বলুন, এই মুহূর্তে আপনার যে দৃষ্টি, তাকে আমি প্রেমিকের চাহনি বলবো, না-কি সম্ভাব্য প্রতারকের?”

নিশার কথাবার্তায় রাহাত কিছুমাত্রও আহত হলো না; কারণ সে জানে, নিশার সৌন্দর্য এখানেই!

নিশা বললো, “ভালো কথা মনে করিয়ে দিয়েছেন; বলুন তো একটা নারীর সৌন্দর্য বলতে আসলে কী বোঝায়?”

রাহাত হকচকিয়ে গেল; সৌন্দর্য বিষয়টা সে মনে মনে ভাবছিল, নিশা সেটা কীভাবে ধরতে পারলো? প্রশ্নসংকুল বিভ্রান্ত চোখে নিশার দিকে তাকালো৷

নিশা বললো, “এতে এত অবাক হবার কী আছে? আমি তো জানিই যে আমার সবকিছুই আপনার সুন্দর লাগে; আমার মুখ থেকে এমন কঠিন একটা কথাও আপনার সুন্দর লেগেছে— এটা খুবই সাধারণ একটা সমীকরণ৷ তাছাড়া সুন্দর মন যাদের, তারা অসুন্দরেও সুন্দর খুঁজে পায়৷”

রাহাত কিছু একটা বলতে যাবে, এমন সময় নিশা তাকে থামিয়ে দিল, “থাক, সৌন্দর্যের সংজ্ঞা আপনার দেয়া লাগবে না; আপনি বরং সিগারেটটা একটু ধরুন৷”

রাহাত হাত বাড়িয়ে সিগারেটটা নিল৷ নিশাকে বেশ খানিকক্ষণ ব্যাগ হাতড়ে দেয়াশলাই বক্সটা বের করতে দেখে রাহাত বললো, “আমার কাছে এ পৃথিবীর সবচাইতে বড় রহস্য কোনটা, জানো? আমার কাছে সবচাইতে বড় রহস্য হলো….”

“মেয়েদের ভ্যানিটি ব্যাগ৷” রাহাতের শুরু করা বাক্যটি শেষ করলো নিশা৷

রাহাত বললো, “হ্যাঁ; কী এত থাকে ব্যাগের ভেতর?”

“একটা সমৃদ্ধ জাদুঘরে যা যা থাকে৷”

নিশার উত্তরে রাহাত চমৎকৃত হলো, “কী বলো!”

“ঠিকই বলি; আমাদের ভ্যানিটি ব্যাগ হচ্ছে রীতিমতো একটা জাদুঘর— নেইল কাটার থেকে আই লাইনার, টুথপিক থেকে লিপস্টিক— সব পাওয়া যায় এ জাদুঘরে৷”

দেয়াশলাই বক্সটা রাহাতের হাতে দিয়ে সিগারেটটা নিয়ে নিল; এরপর সেটা ঠোঁটে ধরে নিশা বললো, “আগুনটা জ্বালান তো একটু৷”
রাহাত আগুন জ্বাললো; মুখটা এগিয়ে সে আগুনে সিগারেট ধরালো নিশা৷ তারপর দলা পাকিয়ে ধোঁয়া ছাড়লো সরাসরি রাহাতের মুখের ওপর৷

সিগারেটে কয়েকটা টান দিয়ে ঠোঁট থেকে বের করে সেটা পুনরায় এগিয়ে দিলো রাহাতের দিকে; বললো, “ধরুন তো একটু৷”
জ্বলন্ত সিগারেটটা রাহাত হাতে নিল৷ নিশা কোনো কথা না বলে চুপচাপ তাকিয়ে থাকলো তার চোখের দিকে, মুখের দিকে; দারুণ একটা খেলা শুরু হয়ে গেছে৷

সিগারেটের দিকে তাকিয়ে রাহাত দ্বিধায় পড়ে গেল— সেখানে লেগে থাকা ঠোঁটে কি সে ঠোঁট ছোঁয়াবে, না-কি মধুমাখা বিষপেয়ালার আকর্ষণ থেকে নিজেকে নিবৃত করে সারাজীবনের আফসোস কিনবে?

চার.

কয়েক মুহূর্তের ভাবনাপর্ব শেষে হাতে ধরা সিগারেটে লিপস্টিকের দাগ লক্ষ করে ঠোঁট এগিয়ে দিল রাহাত; ঠোঁটের সাথে মিলে গেল ঠোঁট! একটা টান দিতেই বুকের মধ্যে একটা ধাক্কার মতো লাগলো৷ প্রচণ্ড কাশিতে রাহাতের গলার শিরাগুলো রীতিমতো ছিঁড়ে যাবার জোগাড়৷

নিশার লাল লিপস্টিকে হাসির দাগ৷ রাহাতের চোখের কোণে রীতিমতো জল জমে গেছে৷

নিশা বললো, “থাক, আর খাওয়া লাগবে না; দিন আমাকে৷”

কোনো উত্তর না দিয়ে রাহাত পুনরায় টান দিলো; তার মাথা খানিকটা ঝিম ধরে এল৷ নিশা কাছে এগিয়ে এসে রাহাতের বাম হাতের উপর তার হাতটা রাখলো; বললো, “কী হলো? মাথা ঘোরাচ্ছে?”

রাহাত মাথা খানিকটা তুলে বললো, “একটু৷”

কথাটুকু বলেই সে খেয়াল করলো তার হাতের উপর নিশার হাত; তারা সমস্ত শরীরে অদ্ভুত এক শিহরণ খেলে গেল! চট করে সিগারেটে আরেকটা টান দিল রাহাত; মাথার মধ্যে একটা চক্কর দিয়ে উঠলো৷ নিশা রাহাতের হাত থেকে সিগারেটটা কেড়ে নিল; রাহাতের হাতটা শক্ত করে ধরে থাকলো, “খুব বেশি খারাপ লাগছে?”

চোখ বন্ধ করে একাগ্রচিত্তে নিশার স্পর্শে মেতে থাকা হৃদয়ে হঠাৎ কেমন যেন বিষণ্নতার সুর বেজে উঠলো; নিশার মলিন কণ্ঠস্বর শুনে রাহাত চোখ মেলে তার দিকে তাকালো; ঠোঁটের কোণে মৃদু হাসি মেখে বললো, “উমহু, ঠিক আছি; খুব ভালো আছি৷”

কথাটা বলেই রাহাত তার বাম হাতের দিকে তাকালো; তার শূন্য হাতে একটি প্রতীক্ষিত হাত৷ রাহাতের মনে হলো— এভাবেই সে অনন্তকাল কাটিয়ে দিতে পারবে, আর কিচ্ছুই লাগবে না; এ হাতের অধিকারটা একবার পেয়ে গেলে পৃথিবীর আর সকল অধিকার সে নির্দ্বিধায় ছেড়ে দিতে পারে৷

কিছুটা সময় নিশার দিকে তাকিয়ে থেকে প্রেমেল কণ্ঠে রাহাত বললো, “থ্যাংক ইউ, নিশা৷”

মহাবিশ্ব কাঁপিয়ে দেয়া চাহনিতে নিশা চোখ রাখলো রাহাতের চোখে, “থ্যাংক্স কেন? সিগারেট খাওয়ার অভিজ্ঞতা দিলাম, সে কারণে?”

রাহাত উচ্চস্বরে হেসে উঠলো; এরপর খানিকটা থেমে বললো, “তোমার সাথে কাটানো সময়গুলোই আমার জীবনের সুন্দরতম সময়৷”

নিশা বললো, “আপনি আগের চাইতে আরো অনেক বেশি পরিণত৷”

“সে সময়গুলোর কথা তোমার মনে পড়ে?”

“আপনার কি মনে হয় না আমি অত্যন্ত স্বার্থপর?”

“সেই যে বৃষ্টিভেজা সন্ধ্যা, বিস্তীর্ণ নদীতীর, শূন্য প্রান্তর, আবছা অন্ধকার, প্রবল ঝড়বাতাস!”

“আমাকে অপরাধী সাব্যস্ত করতে ইচ্ছে হয় না?”

“শীতল ভোর, শুভ্র আলো, কানে হেডফোন, তোমার নরম গালে সবুজ শিরাগুলোর দৃশ্যমান সৌন্দর্য, আমার হৃদয়ে আলোড়ন!”

নিশা আনমনে সিগারেটে একটা টান দিল; বললো, “জীবনের কাছে আপনি কী চান?”

“নীল পোশাকে তোমার কপালে নীল টিপ!”

“স্যরি?”

“মনে পড়ে তোমার?”

“আচ্ছা বাদ দিন, আপনি আমার কাছে কী চান?”

“যা চাই, তা তো পাচ্ছিই!”

“মানে, এভাবে পাশে বসে থাকা, সিগারেটের ধোঁয়া সরাসরি আপনার মুখের দিকে ছুঁড়ে মারা?”

“অনেকটা তেমনই৷”

“বুঝলাম না৷”

“এই যে, তোমার মুখের হাওয়া, ঠোঁটের ছোঁয়া৷”

ব্যাখ্যাতীত দৃষ্টিতে রাহাতের দিকে তাকিয়ে নিশা বললো, “এতটা এক্সপ্রেসিভ! বাব্বাহ!”

“আমার কী মনে হয় জানো….”

রাহাতকে থামিয়ে দিয়ে নিশা বললো, “চলুন, ওঠা যাক৷”

দুজন হাঁটতে শুরু করলো, পাশাপাশি; অসংজ্ঞায়িত এক দূরত্ব বজায় রেখে একসাথে হেঁটে চলা৷ এ পথচলার শুরু আরো অনেক আগে!

পাঁচ.

“তুমি সিগারেট খাও, না?”

রাহাতের প্রশ্ন শুনে নিশা দারুণ রকম অপ্রস্তুত হয়ে উঠলো৷ অসম্ভব সুন্দর কোনো মেয়ের সাথে প্রথম দেখায় প্রথম কথায় কোনো ছেলে এমন একটা প্রশ্ন করতে পারে, সেটা তার কল্পনাতেও ছিল না৷

নিশা উত্তর করলো, “বই পেতে হলে ননস্মোকার হতে হবে— এমন কোনো পয়েন্ট নিয়মাবলিতে দেখেছি বলে তো মনে পড়ে না৷”

“না না, তা কেন?”

“এমনটা আপনার কেন মনে হলো বলুন তো?”

“এ প্রশ্নের উত্তর দেয়া মুশকিল৷ জাস্ট মনে হলো, তাই বলে দিলাম৷”

“একবারের জন্যও মনে হলো না যে প্রথম সাক্ষাতে কোনো মেয়েকে এ ধরনের প্রশ্ন করা যায় না?”

নিশার সরাসরি আক্রমণে রাহাত বিব্রত, বিপর্যস্ত; বললো, “স্যরি৷”

রাহাতের অপরাধী মুখটা দেখে নিশার বড্ড মায়া হলো; সে এমনভাবে হেসে উঠলো যেন রিনিঝিনি নুপূর বেজে উঠলো, “হ্যাঁ, টুকটাক খাই; বেশি না৷”

রাহাত অনুযোগের স্বরে বললো, “এমন সুন্দর একটা মানুষ সিগারেট খায়!”

“কেন, ‘ধূমপান সুন্দর মানুষদের জন্য নিষিদ্ধ’ এমন কোনো কথা তো সিগারেটের প্যাকেটে কখনো লেখা থাকতে দেখিনি৷”

রাহাত তাকিয়ে আছে নিশার হাতের দিকে; এত সুন্দর হাত সে ইতোপূর্বে দেখেনি৷

নিশার ঠোঁটে দুষ্টুমির হাসি; সে বললো, “কী ভাবছেন? এত সুন্দর একটা হাতের আঙুলে সিগারেট ধরা থাকে কীভাবে?”

রাহাত মৃদু হেসে বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘পথের পাঁচালি’টা এগিয়ে দিলো৷

দুদিন পর৷ নিশার মোবাইল ফোনে রাহাতের মেসেজ, “বইপড়া চলছে?”

নিশা উত্তর করলো, “চলছে তো৷”

“কেমন লাগছে?”

“দারুণ৷ ক্লাসিক৷”

“কদ্দূর হলো পড়া?”

“একান্ন পৃষ্ঠা পর্যন্ত পড়েছি৷ ধীরে ধীরে পড়ছি, মজা লাগছে; পড়া শেষ হলেই তো মজা শেষ৷”

“সত্যজিৎ রায়ের ‘পথের পাঁচালি’ দেখেছো?”

“নাহ৷ আসলে সিনেমাটা দেখবো বলেই বইটা পড়া৷”

“মানে?”

“মানে হলো, সিনেমার আগে তো বই; তারপর সিনেমা৷ উপন্যাসে ঘটে যাওয়া ঘটনাগুলোকে আমি সত্যজিতের চোখে দেখতে চাই না৷ আমি নিজের চোখে ঘটনাগুলোকে দেখবো, তারপর সত্যজিৎকে সে দৃষ্টিকোণ থেকে মূল্যায়ন করবো৷”

“বিভূতিভূষণের আর কোনো লেখা পড়েছো আগে?”

“উমহু; এটাই প্রথম৷ তবে এটা পড়ে অন্যগুলোও পড়ার আগ্রহ পাচ্ছি৷ আপনার কাছে আছে না?”

“আছে তো!”

“এটা শেষ করতে আমার আর দুটো দিন লাগবে; তারপর এটা ফেরত দিয়ে আরেকটা নেবো৷ এরপর কোনটা নেবো, সেটা আপনি ঠিক করবেন৷”

“এরপর পড়বে ‘ইছামতি’৷”

“ইছামতি’ নামে একটা নদী আছে না?”

“হুম৷”

নদীতীরে বালুর চরে পাশাপাশি৷ দুদিনের কথা থাকলেও দেখা হলো ঠিক এক সপ্তাহ পর৷ সামনেই নদীর স্বচ্ছতোয়া জলে ডিঙি নৌকার ভাসমান সুখ, দশ-বারো বছরের কয়েকটি ছেলের সাঁতার-উল্লাস৷ নিশার কপালে নীল টিপ, হাতে কারুকার্যখচিত দৃষ্টিনন্দন ব্রেসলেট; রাহাতের চোখে এখন ডেসডিমোনার সৌন্দর্য! সে বললো, “তোমাকে দারুণ দেখাচ্ছে নিশা৷”

নিশা বললো, “কেমন দারুণ?”

“পৃথিবীর সমুদয় সৌন্দর্য আমি দেখতে পাচ্ছি তোমার কপালের নীল টিপে!”

“যে কোনো মেয়েকেই টিপ পরলে সুন্দর লাগে৷”

“তোমার ক্ষেত্রে ব্যতিক্রম৷”

“মানে?”

“মানে, তুমি পরেছো বলেই টিপটা এত সুন্দর লাগছে৷”

মাথাটা আলতো ঝুঁকিয়ে লাজুক হাসি; নিশার সে হাসিতে ঢেউ খেলে গেল নদীজলে, রাহাতের হৃদয়নদীতে৷

কিন্তু নদীজলে সবসময় টলমলে ঢেউ থাকে না; সেখানে স্থবিরতা আসে, জলস্বচ্ছতায় অস্বচ্ছ অসুন্দর আঘাত করে৷ সৌন্দর্যটা উপভোগ করতে হলে অসুন্দরতাকেও মেনে নিতে হয়; গোলাপের সুগন্ধসৌন্দর্যের জন্য প্রস্তুতি থাকতে হয় কাঁটার আঘাত-বেদনার!

এই যে এই নদীতীর-বালুচর! সময়ের ব্যবধানে কখনো দুতীরের ব্যবধান কমে; কখনো বা নদীজলে দুকূল ছাপিয়ে রচিত হয় দূরত্বের ইতিহাস৷

ছয়.

“কী এত ভাবছেন?”

“অতীত সোনালি দিন!”

“অতীত সবসময় ‘সোনালি’ই হয়, না?”

“কী জানি, হয়তো!”

“শুনুন, ওসব অতীতচিন্তা বাদ দিন; বর্তমানটা নিয়ে ভাবুন৷ বর্তমানটাই সত্য, বাকি সব মেকি৷”

“অতীতকে তুমি কীভাবে দেখ?”

“মুছে দিতে চাই৷”

“মুছে দিতে চাও? কী বলো! কেন?”

নিশা হাসিমুখে বললো, “অতীত নিয়ে পড়ে থাকলে এই মুহূর্তের চাঁদ-পূর্ণিমাটা ব্যর্থ হবে যে!”

রাহাত আকাশের দিকে তাকালো; সুবিশাল কালো আকাশে এক টুকরো চাঁদ৷ কত সুন্দর! কত একা!

রাহাত বললো, “চাঁদটা কী সুন্দর, দেখেছো?”

নিশা বললো, “হ্যাঁ, আপনার মতো৷”

“কিন্তু দেখ, সে কত একা!”

“আমাদের মতো৷”

চাঁদের ওপর থেকে চোখ নামিয়ে নিশার দিকে তাকালো রাহাত; বললো, “একসাথে দুটো চাঁদ দেখেছো কখনো, নিশা?”

“দুটো চাঁদ? একসাথে? কী বলেন!”

“আমি দেখেছি৷”

“কীভাবে?”

নিশার চোখের ওপর চোখ রেখে রাহাত হাসলো; সে নিঃশব্দ হাসিতে সকল প্রশ্নের উত্তর প্রকাশিত হয়ে গেল৷

রাহাত বললো, “সিগারেট খাবে না?”

“নাহ, আজ আমি জ্যোৎস্না খাবো৷”

“খাও, আমি তাকিয়ে থাকি৷”

“এত দেখে কী হবে?”

“নেশা!”

“মানে?

“তুমি জানো, তুমি ঠিক এভাবে আমার দিকে মুখ করে বসে থাকবে, আমি তোমার মুখের দিকে তাকিয়ে অনন্তকাল কাটিয়ে দিতে পারবো!”

“কাব্য হচ্ছে?”

“উমহু, নেশা; এ এমন এক নেশা, যা থেকে উত্তরণের একটিই মাত্র পথ— আরো বেশি নেশা করা, নেশাতুর হওয়া, নেশায় নেশায় জীবন ও জগৎটাকে নিঃশেষ করে ফেলা!”

নিশা চোখ বন্ধ করে ফেললো; সে জানে, রাহাত একদৃষ্টে তার দিকে তাকিয়ে আছে৷ রাহাত কি জানে, এ নেশা সংক্রামক?

সাত.

“আপনি আসলে কী চান, বলুন তো!” নিশা জিজ্ঞেস করলো৷

“ভালোলাগার মানুষের সাথে সময়গুলো কাটিয়ে দিতে চাই৷” রাহাতের উত্তর৷

“আর কিছু চান না?”

রাহাত ছোট্ট করে হাসলো৷

নিশা বললো, “কী হলো?”

“উইল ইউ ম্যারি মি, নিশা?”

নিশার দৃষ্টিতে প্রশ্ন; বললো, “কী চান? ভবিষ্যতের অনিশ্চিত পথ, নাকি বর্তমানের এই স্নিগ্ধ চাঁদ-পূর্ণিমা?”

রাহাত নির্দ্বিধায় উত্তর করলো, “ভবিষ্যতের আর নিশ্চয়তা কী? তার চাইতে বরং এই জ্যোৎস্নাশোভিত রাতটাই থাক৷”

নিশা আলতো করে রাহাতের হাতে হাত রাখলো; বললো, “এই মুহূর্তটার চাইতে বড় কোনো সত্য কি আছে?”

নিশার চোখে চোখ নিবদ্ধ করে রাহাত বললো, “না, নেই; থাকতে পারে না!”

আকাশের আলোকিত চাঁদ ঢেকে গেল কালো মেঘে; নদীর জলতরঙ্গ দুধজ্যোৎস্না রং ছেড়ে মেখে নিল অন্ধকার৷

নিশা বললো, “আপনি কি জানেন, এ পৃথিবীতে একটি নেশা আছে— সংক্রামক?”

দুজনের ঠোঁটেই হাসি; একসাথে চাঁদের দিকে তাকালো৷ মেঘের আড়াল থেকে উঁকি দিয়ে বেরিয়ে এলো চাঁদ; মেঘগুলো ভেসে যেতে যেতে জানিয়ে গেল— কোনো মেঘে ঢাকে না চিরদিন, সকল মেঘ কেটে যায়, জেগে থাকে নেশা এক— চিরন্তন! সে নেশা মেখে থাকে চোখে— কখনো রাহাতের, কখনো তার মুগ্ধতা হয়ে প্রকৃতিতে ছড়িয়ে যায় নিশার উড়ন্ত চুলে!

এই বিভাগের অন্যান্য লেখাসমূহ

বালির বেহালা

বালির বেহালা

বুড়িমাসি বলেন,জীবনটা বালির ঘর গো।ঢেউ এলে ধুয়ে যায় জীবনের মায়া।তবু বড় ভালবাসা ওদের দাম্পত্যে।রোদের চাদরের…..

তদন্ত

তদন্ত

  এক ড্রইং রুমে বসে রয়েছে সদ্য কিশোর উত্তীর্ণ তরুণ গোয়েন্দা সজীব। সামনের টেবিলে ছড়িয়ে…..