প্রক্সি
তারপর ইলেকট্রিক বিল জমা দিতে যাবো। আমার দেরি হবে আসতে। স্বামী অমর বলে, ঠিক আছে।…..
গুলশান এক থেকে দুইয়ের দিকে যাওয়ার পথে চৌরাস্তার পঞ্চাশ গজ দক্ষিণে পঁচিশতলা আর্কেডিয়া টাওয়ারের তেরতলায় অবস্থিত কগনেট ইন্ডাস্ট্রিজের সুদৃশ্য এবং শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত কনফারেন্স রুম থেকে প্রায় জমে যাওয়া অবস্থায় – অনেকটা ইগলুর মধ্যে থাকা এক্সিমোদের মতো – বেরিয়ে এসেই করিডোরের ডানদিকে বিস্তৃত জানালার ওপার থেকে ধেয়ে আসা মধ্য এপ্রিলের দুপুরে গনগনে সূর্যের তীব্র আলোয় হঠাৎ ঝলসে যাওয়ার হাত থেকে চোখ দু’টোকে আড়াল করতে হয়; অতঃপর ব্রিফকেসটাকে দুই হাঁটুর ফাঁকে চেপে ধরে পকেটের রুমাল বের করে ঝাপসা হয়ে যাওয়া চশমার কাচ মুছে সেটা আবার নাকের গোড়ায় স্থাপন করে নিয়ে অভ্যাসবশত কোটের বাঁ হাতের আস্তিনটি মৃদু ঝাঁকিতে সামান্য নিচে নামিয়ে গত গ্রীষ্মে সুইজারল্যান্ড থেকে কিনে আনা বাংলাদেশি মুদ্রায় প্রায় ছয় লাখ টাকা দামের রোলেক্স ঘড়িটার কাঁটায় যখন চোখ রাখি, দেখতে পাই বেলা গড়িয়েছে দেড়টায় এই মাত্র দুই মিনিট সাতচল্লিশ সেকেন্ড আগে। আমাকে এখনই আবার ছুটতে হবে উত্তরায়, ওখানে ফ্যালকন গ্রুপের ম্যানেজিং ডিরেক্টরের সাথে মিটিং ঠিক দু’টো পনেরতে বেঁধে দেয়া আছে। কগনেটের সিইও’র সাথে সাপ্লাইয়ের অর্ডারটা ফাইনাল করেছি, এখন ডিটেইলস ছেড়ে দিয়ে এসেছি দৃষ্টিকেতুর কাছে, সে-ই কগনেটের প্রতিনিধি আখতার ফরিদের সাথে বসে ঠিক করুক ডিলিংয়ের বাকি ব্যাপারগুলো।
দৃষ্টিকেতু সরকার! আহ্, ওর কথা ভেবে যুগপৎ পরিতৃপ্তি ও অতৃপ্তির একটা বোধ বুকের ভেতরটা তোলপাড় করে বেরিয়ে আসতে চায়। গুলশান থেকে উত্তরা, এতোটা পথ আমাকে এখন পেরোতে হবে ওর সঙ্গ ছাড়াই। দৃষ্টিকেতু আমার প্রতিষ্ঠানের জন্য একটি অ্যাসেট, আমার ব্যক্তিগত অ্যাসেটেও ওকে পঞ্চাশোর্ধ্ব আমি পরিণত করেছি সময়-সুযোগ বুঝে উপযুক্ত উপঢৌকনের বিনিময়েই। এখন মেয়েটিকে বলে দেয়া লাগে না আর কিছুই, কগনেটের সাথে বসার জন্য যোগ্যরূপে পরিধেয়-সজ্জিত হয়ে এসেছে সে আজকে, পরিবেশ-পরিস্থিতির পরিধি মেনে শরীরের বাঁকগুলোকে যতোটা দৃশ্যমান রেখে শাড়ি-ব্লাউজ পরা যায় সেভাবেই পরেছে আজ। পীনোন্নত বক্ষের মাঝখানটিতে সে দৃশ্যমানভাবেই ঝুলিয়ে রেখেছে আমারই গিফট করা একটি গোল্ডেন ক্রস, যা কিনা একই ধাতুতে নির্মিত চেইনের সাথে তার কণ্ঠের সাথে ঝুলন্ত অবস্থায় রয়েছে। দু’টি উন্নত গম্বুজের মাঝখানের উপত্যকায় যিশুমূর্তির মতো পড়ে ছিল ওটা, যা কিনা কগনেটের সিইও’র চোখে না পড়েই পারে না। আমি ওর হাতে ডিটেইলসের ভার রেখে এই যে বেরিয়ে আসতে পারলাম কেননা আমি জানি গত মাসে প্যারিস থেকে ওর জন্য নিয়ে আসা ডি’এলমার সর্বাঙ্গে মেখে সে এখনই কগনেটের রিপ্রেজেন্টেটিভের আরও কাছ ঘেঁষে বসে ঠিকই ডিলটা ফাইনাল করে নিতে পারবে আমাদের কোম্পানির অনুকূলে। মিটিংয়ের পুরো সময়টা আখতার ফরিদের চোখের দৃষ্টি ভালো লাগে নি আমার, আমি সন্তুষ্টি বোধ করতাম যদি তার নজর থাকত দৃষ্টিকেতুর বুকের উপত্যকায় ক্রসটির ওপর, কিন্তু তাকে বেশির ভাগ সময়ই আমি দেখেছি ঠোঁটের কোলে চোরা হাসি ঝুলিয়ে রেখে আমার দিকে তাকিয়ে থাকতে, মনে হচ্ছিল যেন আমার ভেতরটাতে পড়ে ফেলতে চাইছে সে।
সিইও’র লাঞ্চের অফারটা আমি ফিরিয়ে দিয়েছি এই বলে যে দুপুরে আমি কিছু খাই না, তবে আমার হয়ে দৃষ্টিকেতুই লাঞ্চ করবে আখতার ফরিদের সাথে। আর লাঞ্চের পর? সে কি চড়বে গিয়ে সিইও’র দামি পোরশে কি মার্সিডিজের পেছনের সিটটিতে, তার সাথে যাবে কোনো পাঁচতারকায়? গত কয়েকমাসে বেশ কয়েকবার পাঁচতারকায় গিয়েছে দৃষ্টিকেতু, বেশ কয়েকজন এমডি, সিইও, চেয়ারম্যান কিংবা ডিএমডির সাথে উঠেছে তাদের জন্য রিজার্ভ করে রাখা বিলাসবহুল স্যুটে, এবং এ সময়ে তার ব্যাগে লুকিয়ে রাখা গোপন ক্যামেরায় সে ধারণ করে রেখেছে দু’জনের মধ্যে সংঘটিত গোপন দৃশ্যাবলির যাবতীয়। সেগুলো দৃষ্টিকেতুর সাথে তাড়িয়ে উপভোগ করেছি আমি বনানীর একটি তিনতারকাবিশিষ্ট হোটেলে আমার জন্য রিজার্ভ করে রাখা কক্ষটায় দৃষ্টিকেতুর চাপাকলার মতো রঙের শরীরটির ওপর চড়তে চড়তে, ওর নরম মোলায়েম দু’টি হাত আর দু’পাশ থেকে কোমর জড়িয়ে রাখা চমৎকার সুদৃশ্য দু’টি লম্বা ঠ্যাঙের আদর উপভোগ করতে করতে। সেগুলো সযত্নে রক্ষিত রয়েছে আমার কাছে, এখন পর্যন্ত ব্যবহারের প্রয়োজন হয় নি আমার, কখনো যদি সেটা হয় তাহলে প্ল্যান সি’র অংশ হিসেবে লাগতে পারে- তার আগে নয়।
আমি জানি না আমাদের দৃশ্যগুলোও সে এভাবে ধারণ করে রাখছে কিনা যাতে সময়-সুযোগ বুঝে সে এগুলোকে ব্যবহার করতে পারে আমাকে ব্ল্যাকমেইলিংয়ের কাজে, কিন্তু তাকে সে সুযোগ আমি দেবো না, আমি এমন কিছুই করব না যাতে আমাদের গোপন দৃশ্যগুলো ধারণ করে রাখা সম্ভাব্য ভিডিওগুলো সে কোনো কাজে লাগাতে পারে। সামনের মাসেই প্রায় তিন বছরের প্রণয়ের সফল পরিণতি ঘটিয়ে সে বিয়ে করতে যাচ্ছে তার প্রেমিক একটি প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের মেধাবী প্রভাষক, সুদর্শন অথচ গর্দভমস্তিষ্কের আশফাক রিয়াদকে। ওদের শুভ পরিণয়ের জন্য আমি আমার ব্যক্তিগত অ্যাকাউন্ট থেকে ওকে দেবো দশ লাখ, টাকাটা দিতে আমার একটুও খারাপ লাগবে না কেননা প্রথমত, তার বদৌলতে ইতোমধ্যেই আমার পকেটে জমা হয়েছে এর বেশ কয়েকগুণ, দ্বিতীয়ত বিয়ের পরও দৃষ্টিকেতু আমারই থাকছে, আমি তাকে ব্যবহার করতে পারব যেকোনো সময়ে- কোম্পানির প্রয়োজন কিংবা নিছক ব্যক্তিগত চাহিদা মেটাতে। এই যে এখন তার সঙ্গবিরহিত অবস্থায় দুপুর বেলায় আমি পাড়ি দিতে যাচ্ছি গুলশান থেকে উত্তরা এতোটা পথ সেটাও তো কোম্পানিরই প্রয়োজনে। আর সেই প্রতিষ্ঠানটিও – বাংলাদেশের একটি অন্যতম শীর্ষস্থানীয় বায়িং হাউস এসকেএস এন্টারপ্রাইজ – কিনা আমারই মালিকানাধীন।
লিফটের সামনে দাঁড়িয়ে আমি আরও একবার বিনা প্রয়োজনে ঘড়ির দিকে চোখ রাখি। ছয় লাখ টাকার সুদৃশ্য ধাতু-নির্মিত যন্ত্রটা নির্ভুলভাবে আমাকে জানাচ্ছে একটা পঁয়ত্রিশ বাজতে এখনো এক মিনিট সতের সেকেন্ড বাকি আছে। আমি লিফটের গতিবিধি লক্ষ করতে থাকি, সেটি তিনতলা থেকে ক্রমান্বয়ে ওপরে উঠছে, মনে হচ্ছে এই ক’টা ফ্লোর পাড়ি দিতে সে সময় নিচ্ছে অনন্ত মহাকালসম, প্রতি ফ্লোরেই সে যেন থেমে থাকছে একটি মহাযুগ ধরে। নাকি এই লিফটের গতি এমনই? এ ধরনের একটি আধুনিক বহুতল ভবনে এমন ধীরগতির লিফট থাকবে কেন? এ বিল্ডিংয়ের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে যারা চাকরি করে তাদের কি সময়ের মূল্য নেই? এদিকে পাশের লিফটটা অকেজো হয়ে পড়ে আছে। অথচ গুলশানের মতো ব্যস্ত এলাকার এমন কোলাহলমুখর একটা বিল্ডিংয়ে লিফট থাকা উচিত ছিল মিনিমাম চারটা। এটা কি তাদেরকে বলে দিতে হবে?
এলিভেটর প্যানেল থেকে আমার দৃষ্টি সরছে না, এখন আট … নয় … দশ … আমার পকেটে রাখা সেলফোনটা মৃদু বিটোফেনিক রিংটোনে সরব হয়ে ওঠে অকস্মাৎ। এ সময়ে আবার কে ফোন করল? আমি পকেট থেকে ফোন বের করে স্ক্রিনে তাকিয়ে দেখি নম্বরটা অপরিচিত, কোনো নামে সেভ করা নেই ওটা। ধরব না এখন, লিফটের দরজা বন্ধ হলেই তো নেটওয়ার্ক কেটে যাবে, কী দরকার এখন রিসিভ করে … আমি প্যানেলের দিকে তাকিয়ে দেখতে পাই লাল আলোয় এখনো দশ জ্বলে আছে, মনে হচ্ছে নম্বর-চিহ্নিততলায় বুঝি সেটা অতিবাহিত করছে একটি দ্বাপরযুগ, হঠাৎ কী ভেবে আমি ফোনটি রিসিভ করি। ‘হ্যালো।’
‘সেলামালাইকুম স্যার … মুই আসলাম। কেমুন আছেন বাহে?’
‘কোন আসলাম, সরি, আমি ঠিক চিনতে পারছি না।’
‘গাইবান্ধার আসলাম স্যার, চিনতে পারিছেন স্যার, ঢাকাত তোমার বাড়ি গেছনু হামার বিটি ছাওয়া নিয়া …’
‘সরি চিনতে পারছি না, মনে হয় রং নম্বর।’
‘স্যার হামাক চিনতি পারিচ্ছেন না তুমি, হামার বিটির অনেক অসুখ ছেল, হাঁটত না পারে, মুই কইছিনু চিকিচ্ছে নাগব তাক সুস্থ করিবার, তা হামাক তুমি ক’লেন …’
‘না, এখনো চিনতে পারছি না, আপনি মনে হয় অন্য কাউকে খুঁজছেন’, আমি এবার বিরক্ত মুখে না চেনার ভান করতে থাকি।
‘স্যার, চিনতি তুমি ঠিকই পারিচ্ছেন, স্বীকার যাচ্ছ না ক্যান বাহে?’
আমি ভেবেছিলাম তার মুখের ওপর কলটি কেটে দিই, কিন্তু শেষ মুহূর্তে সে যে আমাকে মিথ্যাবাদী হিসেবে সরাসরি প্রতিপন্ন করে চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দিচ্ছে সেটা মোকাবেলা করার অপ্রতিহত রোখই আমাকে নিবৃত্ত করল কানের সাথে সংযুক্ত ব্লুটুথ ডিভাইসের মাধ্যমে ঐ অসভ্য গ্রাম্য লোকটার সাথে সংযোগ ছিন্ন করতে। আমি এখন দাঁড়িয়ে আছি ঢাকা শহরের অন্যতম কমার্শিয়াল হাব গুলশানের একটি আধুনিক অট্টালিকার তেরতলায় নিজের সুন্দরী আকর্ষণীয় অ্যাসিস্ট্যান্ট ম্যানেজারকে একটি অত্যন্ত সুপরিচিত গার্মেন্ট প্রতিষ্ঠানের প্রতিনিধির সাথে আগামী মাসের প্রথম সপ্তাহে চট্টগ্রাম বন্দর থেকে নিউইয়র্কগামী যে জাহাজটি ছেড়ে যাবে তাতে অর্ডারকৃত মালামাল সাপ্লাইয়ের ডিলটার সর্বশেষ ডিটেইলস ফাইনাল করতে এবং এখনই ছুটব আরেকটি স্বনামধন্য প্রতিষ্ঠানে তাদের সাথে ইউরোপের বাজারে কিছু অ্যাপারেল আইটেম এক্সপোর্টের ডিল শুরু করতে, আর তুমি কিনা সুদূর প্রত্যন্ত গাইবান্ধার বাউসী কি গলনা অথবা মুন্সিপাড়ার কোন অজ্ঞাত অখ্যাত মূর্খ চাষা সাব্যস্ত করে বসে আছো যে আমি মিথ্যা কথা বলছি! বেশ করছি যে তোমাকে আমি চিনতে পারছি না, চিনলেও চিনছি না আসলে, তোমাকে না চিনতে পারার সবরকম রাইট এই মুহূর্তে আমার আছে, কিন্তু তুমি কে সেটা মুখ ফুটে প্রকাশ করার?
‘Look, whoever you are … you’re not in a position to determine whether I’m pretending not to recognize you, understand?’ আমার মুখ থেকে তীরবেগে কথাগুলো বেরিয়ে কানের সাথে যুক্ত ব্লুটুথের মাধ্যমে অদৃশ্য তরঙ্গ পরিবাহিত হয়ে লোকটির অনভ্যস্ত কর্ণকুহর পর্যন্ত পৌঁছানোর জন্য আমি কয়েক সেকেন্ড অতিরিক্ত সময় নিই।
ওপাশে কয়েক মুহূর্তের নীরবতা, ঠিক যেমনটি আমি আশা করেছিলাম। ‘তুমি কী কচ্ছেন বাহে, মুই বুঝবার না পারোঁ …’
‘বলছি যে আমি তোমাকে, whoever the fucking stupid you are, চিনতে পারি আর না-ই পারি, তুমি …’ লিফটের দরজাটা এ সময়ে টিং মতো একটা মৃদু ধ্বনি তুলে হাট করে খুলে গিয়ে আমার মুখের কথাকে মাঝপথে থামিয়ে দ্যায়। আমি লিফটের অভ্যন্তরে তাকাই একবার, ভেতরটা জনশূন্য এবং বেশ সুপরিসর, প্রায় জনা পনের লোক এঁটে যাবে অনায়াসে, তারপর একবার দৃষ্টি বোলাই প্যানেলের ইন্ডিকেটরের দিকে, লিফটটা এবার নির্দেশ করছে নিচের দিকে, অর্থাৎ ওপর থেকেও কল দ্যায় নি কেউ। আমি দুই মুহূর্তের নীরবতাকে গুটিয়ে এনে কথোপকথন চালিয়ে যাওয়ার সাথে সাথে লিফটের নরম লাল গালিচাশোভিত অভ্যন্তরে পদার্পণ করতে থাকি, ‘তোমার কোনো রাইট নেই আমাকে মিথ্যাবাদী বলার, বুঝেছ স্টুপিড আনকুথ কোথাকার?’
‘কামটা তুমি ঠিক করলেন না বাহে, তুমি হামাক চিনিয়াও মিছা ক’লু, খোদা তুমার ভালো করিবেন না …’ আমি লোকটার এই স্পর্ধিত উচ্চারণের অভিঘাতে লিফটের মধ্যে অবস্থান করেও দরজার দিকে ফিরতে ভুলে গেছি, সামনে মিররে দেখতে পাই দুই পাশের দরজা মুহূর্তে বন্ধ হয়ে গেল আমার পেছনে। ঐ বরাহবৎসের কথার কোনো জবাব দেয়ার আগে আমি এবার ঘুরে দাঁড়াই এবং বাটনের দিকে হাত বাড়াতে যাবো ঠিক সেই মুহূর্তে লাইট নিভে গিয়ে পুরো লিফটটা অন্ধকার হয়ে গেল।
হঠাৎ আলোর অন্তর্ধানে আমি একটু কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে লিফটের মধ্যে ১৮০ ডিগ্রি পাক খাই, তবে বেশি সময় অবস্থাটা এ রকম থাকে না, কয়েক সেকেন্ডেই আলো ফিরে আসে কিন্তু তার আগে যেন লিফটের মেঝেটা সামান্য কেঁপে উঠে স্থির হয়। আমি এবার আবারও দরজার দিকে ঘুরে দাঁড়াই এবং টের পাই লিফটের আলো ফিরে এলেও তার ঔজ্জ্বল্যে বেশ কমতি রয়ে গেছে। হয়তো কারেন্ট চলে গেছে, আর এখন লিফট চালু হয়েছে জেনারেটরে সে জন্য এই অবস্থা। আমি লিফটের দরজার পাশে প্যানেলের দিকে আঙুল বাড়াই গ্রাউন্ড ফ্লোরের বাটনে চাপ দেবো বলে, কিন্তু কোথায় বাটন! বাটন কেন, দরজার পাশের গোটা প্যানেলটাই খুঁজে পাচ্ছি না। প্যানেল থাকবে না কেন আশ্চর্য ব্যাপার, মাত্র ঘণ্টা দেড়েক আগেই এই লিফটে আমি উঠে এসেছি তেরতলায় দৃষ্টিকেতু এবং আরও পাঁচ/ছয়জন মানুষ সহযোগে। টের পেলাম লিফটের আলো আরও যেন কিছুটা কমে এলো এবং এখন ভেতরের সব কিছু দেখতে কষ্ট হচ্ছে, আমি দরজার দুই পাশেই প্যানেল খুঁজতে থাকি কিন্তু কোথাও তার চিহ্নমাত্র নেই। আমি আবারও ঘুরে দাঁড়াই এবং লিফটের পেছনের দেয়ালে তাকাতেই ততোধিক বিস্ময়াহত আমার মুখ থেকে কোনো শব্দ বেরোয় না। সুস্পষ্ট মনে আছে মাত্র কয়েক সেকেন্ড আগেই সেখানে ছিল একটি মিরর যাতে আমি দেখছিলাম আমার পেছনে লিফটের দরজা বন্ধ হয়ে যাওয়া কিন্তু সেই মিররটা কোথায় এখন? এটা তো অসম্ভব! লিফটের স্বল্প আলোয় আমি দেখতে পাই আমার সামনে মুখব্যাদান করে আছে নিরেট ধাতব দেয়াল, যার শরীরে প্রতিফলিত আমার অস্পষ্ট সিলুয়েট নড়াচড়া করছে বুঝতে পারি।
আলোটা অতি সন্তর্পণে অথচ একই সাথে খুব দ্রুত তার রঙ পাল্টাতে থাকে। আমার মনে হয় যেন একটি লাল ড্রিম লাইটের মতো আলো ছড়িয়ে আছে পুরো লিফটের ভেতরটা জুড়ে। আমি চারিপাশে হাতড়াতে থাকি এবং উন্মাদের মতো খুঁজতে থাকি এলিভেটর প্যানেল, এর মধ্যে মনে হলো কাছেপিঠে কোথাও, সম্ভবত আমার কর্ণকুহরে কিংবা মস্তিষ্কের ভেতরেই, একটা মৃদু শ্বাস ফেলার শব্দ শুনতে পেলাম। লিফটে তো রয়েছি কেবল আমি একাই, তাহলে কার শ্বাসের শব্দ শুনলাম, নিজেরটাই কি? তখনই মনে পড়ল, আমি আমার কানের সাথে থাকা নীলদন্ত ডিভাইসের মাধ্যমে সংযুক্ত আছি গাইবান্ধার কোন অখ্যাত অজপাড়াগেঁয়ে অর্ধমূর্খ চাষার সাথে, যার কণ্ঠস্বর আমি চিনতে পারছি না, অথবা চিনতে পেরেও চিনছি না, সে-ই শ্বাস ফেলেছে সম্ভবত। এতোক্ষণ, বিশেষত লিফটের দরজা লেগে যাওয়ার পর থেকে সে একটা শব্দও আর উচ্চারণ করে নি। নিশ্চয়ই সে ওপাশ থেকে অপেক্ষায় আছে আমার দিকে ছুঁড়ে দেয়া তার সর্বশেষ অভিসম্পাতের জবাবটা শোনার জন্য। ‘হ্যালো’, আমি তার প্রত্যুত্তর লাভের চেষ্টা করি, শত্রু হলেও একজন মানুষের সঙ্গ যেন এই মুহূর্তে আমার প্রয়োজন এই অদ্ভুত পরিস্থিতি উত্তীর্ণ হতে। ওপারে নিস্তব্ধতা। ‘হ্যালো, হ্যালো, হ্যালো।’
‘লাইনটা কেটে গিয়েছে স্যার, লিফটের ডোর ক্লোজ হওয়ার সাথে সাথে। এখানে নেটওয়ার্ক পাবেন না এখন আর।’
একটা নারীকণ্ঠ, খুব পরিচিত, মনে হলো যেন মাথার মধ্যে বেজে উঠল- ঠিক যেখান থেকে শ্বাসের শব্দটা উৎপন্ন হয়েছিল সেখান থেকেই। কিন্তু নারীকণ্ঠ এলো কোত্থেকে, লিফটের মধ্যে? আমি আবার এদিক-ওদিক তাকাই। মৃদু লাল আলোয় চারদিক থেকে আবদ্ধ কক্ষের দেয়াল ছাড়া কিছু চোখে পড়ে না, আমি ছাড়া দ্বিতীয় কোনো জন নেই ভেতরে। ‘কে, কে কথা বলছেন?’
এক মুহূর্তের নীরবতা। আবার যেন শ্বাস টানার শব্দ পেলাম। এরপরই, ‘আমি লিফট স্যার, আপনারা লিফটে আপডাউন করার সময়ে যার কণ্ঠ শুনে থাকেন, যে আপনাদেরকে জানিয়ে দ্যায় লিফটে ওপরে যাচ্ছে নাকি নিচে, কোন ফ্লোরে থামছে, আমি হচ্ছি সেই লিফট।’
বাজে কথা, সম্পূর্ণ মিথ্যা। লিফটে নারীর প্রোগ্রামড কণ্ঠস্বর শুধু নির্দিষ্ট কয়েকটি একঘেয়ে তথ্য প্রদানের মধ্যে সীমাবদ্ধ, সে এভাবে মানুষের কথার জবাবে এতো লম্বা এবং জটিল বাক্য – যাতে কিনা রয়েছে চার থেকে পাঁচটি বাক্যাংশ – ব্যবহার করতে সক্ষম নয়। কেউ মনে হয় মজা করছে কোথাও থেকে। অদৃশ্য মাইক্রোফোন বসানো আছে কি কোথাও? আমি ওপরের দিকে তাকাই।
‘না স্যার, আপনি যেটা ভাবছেন তা নয়। বরং আমি যা বলছি সেটাই সঠিক’, কণ্ঠস্বরটি আবার বলে এবং এবার যেন আমি চিনতে পারি, হ্যাঁ, ঢাকা শহরের বিভিন্ন লিফটে ওঠা-নামার সময়ে যে কণ্ঠটা ইংরেজিতে অনবরত বকবক করতে থাকে: Lift is going down, lift is going up … second floor … third floor … twenty-nineth floor … ঠিক সেই কণ্ঠটাই কিন্তু এবার কথা বলছে বাংলায় এবং এভাবে প্রোগ্রাম করা তথ্য না, সে কথা বলছে আরেকজন মানুষের মতোই সাবলীল কথোপকথনের ভঙ্গিতে।
‘আপনি কী চান? মজা করছেন আমার সাথে অথবা কোনো সঙ্ঘবদ্ধ চক্রের সদস্য, আমাকে জিম্মি করে কিছু টাকাকড়ি আদায় করবেন?’ আমি গলায় সাহস আনি, বোঝানোর চেষ্টা করি যে আমি মোটেও ঘাবড়াই নি, বরং চট করে ধরে ফেলতে পেরেছি তাদের চক্রান্ত। তা হবেই বা না কেন, আমার মতো প্রত্যুৎপন্নমতিত্ব আর দূরদৃষ্টি না থাকলে কেউ কি পারে প্রায় শূন্য, পথের পাশে বসা অবস্থা থেকে উঠে এসে এতোবড় প্রতিষ্ঠান যৌথ নাম থেকে পরিবর্তন করে নিজের নামে পুনরায় দাঁড় করাতে; মুম্বাই, কুয়ালালামপুর, হংকং, প্যারিস, বার্লিন, মাদ্রিদ, লন্ডন, ডোভার, নিউ ইংল্যান্ড, ওরেগন কিংবা নিউ জার্সিতে এতো এতো ক্লায়েন্ট জোটাতে, পারে কি প্রতিবছর ডালভাত খাওয়ার মতো করে পূর্ব এশিয়া-ইউরোপ-আমেরিকায় ঘুরে বেড়াতে? নিজের স্ত্রী-সন্তানকে যুক্তরাষ্ট্রের স্থায়ী বাসিন্দায় পরিণত করতে? পারে কি দৃষ্টিকেতুর মতো আকর্ষণীয় এক কর্পোরেট সুন্দরীকে নিজের বগলদাবা করে এবং তার মতো আরও আরও শাওলি হৃদিতা সামিরা ববি শামাররুখ সোহেলিয়াকে নিয়ে ঢাকা, ব্যাংকক, সিঙ্গাপুর কিংবা দুবাইয়ের পাঁচতারকায় ছয়মাসে-নয়মাসে এক কি দুইবার করে আনন্দময় সময় উপভোগ করতে? লিফটের প্রোগ্রামড কণ্ঠস্বরকে নির্ভুলভাবে অনুকরণ করতে সক্ষম সঙ্ঘবদ্ধ অপহরণকারী চক্রের কোন এক নারী সদস্য কি পারবে এক মুহূর্তেই আমাকে ভড়কে দিয়ে আমার নার্ভাস সিস্টেম বিধ্বস্ত করে ফেলতে?
‘তেমন কিছু চাই না, স্যার। আমি শুধু আপনার সাথে সামান্য সময় ভ্রমণের সঙ্গী হয়ে থাকতে চাই।’
ভ্রমণ? কোন ভ্রমণের কথা বলছে অপরাধী চক্রের নারী? সে কি দুবাইয়ের হলিডে ইন, সিঙ্গাপুরের ম্যারিনা বে অথবা ব্যাংককের প্রিন্স প্যালেসের প্রেসিডেন্সিয়াল স্যুটে আমার সাথে একটি রাত কাটানোর প্রত্যাশা করছে- যেমনটি কিনা করে থাকে ইশরাত, স্বপ্না, নারগিস, সায়মা, তানিয়া; নাকি আমার সাথে প্রমোদভ্রমণে যেতে আগ্রহী সে ইংল্যান্ড, জার্মানি কিংবা ফ্রান্সে মিসেস শাহরিয়ার, মিসেস জুলকারনাইন অথবা মিসেস শিহাবের মতো? এই নারী উদীয়মান কর্পোরেট প্রস্টিটিউট, নাকি কগনেটের ভাড়া করা মাতাহারি কোনো? তার হাতে কী এমন কারিগরি আছে যে পঁচিশতলা অট্টালিকার সর্বজন ব্যবহার্য আলোকোজ্জ্বল লিফটটিকে সে মুহূর্তেই পরিণত করতে পারে পুলিশের ইন্টারোগেশন সেলের মতো শ্বাসরুদ্ধকারী কক্ষে?
‘আপনি আবারও ভুল করছেন, স্যার’, যেন আমার চিন্তাধারা পড়ে ফেলতে পেরে মস্তিষ্কের মধ্যে কথা কয়ে ওঠে সেই নারী, ‘আপনার সাথে ভ্রমণ করতে চাই ঠিকই তবে এই ভ্রমণে আমিই আপনাকে নিয়ে যাবো, এবং সেটা বাইরের কোনো দেশে নয়, বলা যেতে পারে আপনার সংলগ্ন জগতেই ঘুরিয়ে আনব কয়েক মুহূর্তের জন্য। আশা করি আপনার ভ্রমণ উপভোগ্য হবে।’
আমি টের পাই লিফট নিচে নামতে শুরু করেছে, নিজে থেকেই। কয়েক মুহূর্ত কেটে গেল, আমি প্রশ্ন করতে চাইলাম, কিন্তু কী প্রশ্ন করব সেটা বুঝে উঠতে পারছি না। মনে হলো খুব দ্রুত তেরটি তলা অতিক্রম করে লিফট যেন আরও নিচে নেমে যাচ্ছে ক্রমশ, ভূ-পৃষ্ঠের অনেক গভীরে, একেবারে পাতালে। এই লিফট কোথায় নিয়ে যাবে আমাকে? সে কি টেকটোনিক প্লেটের ওপর স্থাপন করবে নিজেকে? ভাবতেই দেখি লিফটের চলার গতি স্থির হয়, সামান্য একটা কম্পনের সাথে লিফটটি এসে থামে কোথাও, ভূ-পৃষ্ঠ থেকে আন্দাজ দুইশ’ ফিট নিচে। এবার চোখের সামনে দেখতে পাই লিফটের দরজা খুলতে শুরু করেছে। সেই সাথে নারীকণ্ঠ, ‘আপনি শুধু দেখে যাবেন স্যার, কোনো কিছু বলবেন না অথবা নড়াচড়ার চেষ্টাও করবেন না। যা দেখবেন তা নিয়ে আমরা পরে আলাপ করব।’
লিফটের দরজা পুরোটা খুলে গেলে আমি দেখতে পাই আমার সম্মুখে একটা প্রায় অন্ধকারাচ্ছন্ন আয়তাকার কক্ষ। কক্ষের পরিধি বোঝা সম্ভব হতো না যদি না মধ্যস্থিত টেবিলটার ওপর একটি ল্যাম্প থেকে আলোকচ্ছটা পরিপার্শ্বকে কিছুটা আলোকিত করে রাখত। আমি দেখতে পাই টেবিল ছাড়া এর দুই পাশে শুধু দু’টো চেয়ার, দূরবর্তী দেয়াল ঘেঁষে থাকা একটি পুরাতন ভগ্নপ্রায় মিটশেল্ফ, এক পাশে একটি টিনের তোবড়ানো কলসি, তার পাশে একটি দরজার হাঁ মুখ ওপারের অদৃশ্য অন্ধকার পথের ইঙ্গিত দিচ্ছে। দেয়ালগুলো স্যাঁতসেঁতে, ড্যাম্প পড়ে গেছে। ছাদের কড়িবর্গা ভেঙে পড়ে ঝুলছে, একটা ফ্যান রয়েছে বটে, নিশ্চল, ওটার অবস্থা দেখে কোনো কাজে আসে বলে মনে হয় না। ডান দিকের দেয়ালে দেখতে পাই ফ্রেমে আঁটা একটি ম্লান হয়ে আসা আলোকচিত্র, ছবির মানুষটিকে আমি ঠিক চিনতে পারি না তার ঝাপসা মুখাবয়ব এবং কক্ষের আলোকস্বল্পতার কারণে।
টেবিলের দু’পাশের চেয়ারে দুইজন নারী বসে আছে। বামপাশের জন মধ্যবয়স্কা, কিন্তু বয়সের চেয়ে যেন অধিক ঝুলে পড়েছে তার গালের চামড়া, ঘোমটার মধ্যে থেকে বেরিয়ে আসা চুলের অর্ধেকের বেশি পাকধরা। ডান পাশের চেয়ারে বসা মেয়েটি সালোয়ার-কামিজ পরিহিতা, সম্ভবত অপর নারীটির কন্যা, তবে মায়ের মতোই জরাজীর্ণ দশা তার। মেয়েটি হয়তো একসময়ে আকর্ষণীয়া ছিল কিন্তু দারিদ্র্যের কষাঘাতে তার মুখাবয়ব থেকে তারুণ্যের সকল লাবণ্য দূর হওয়ার পথে তা বেশ বোঝা যায়। মধ্যবয়স্কার কপালে হাত, কনুই ছুঁয়ে আছে টেবিলের উপরিভাগ।
‘আর কী করব বল, তোর বাপ তো আর কাড়ি কাড়ি সম্পত্তি রেখে যায় নাই তোর জন্য। এখন যদি সদরুল মেম্বারের সাথে তোর বিয়েটা হয় তো খেয়েপরে বাঁচতে পারি, তুইও বাঁচবি’, নীরবতা ভেঙে মধ্যবয়স্কার বলা কথাগুলো শুনতে পাই।
তরুণীর কণ্ঠ থেকে দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে আসে। ‘আর একটা বছর, একটা বছর যদি কোনোমতে চালাতে পারতাম! বিএটা পাশ হয়ে গেলেই তো স্কুলে একটা চাকরি হয়ে যাইত। আর মনে করো, সাথে সাথে মাস্টার্সটাও করে ফেলতে পারতাম, ঢাকায় আবার ফিরতে পারতাম তোমারে নিয়া। কষ্টমষ্ট করে একটা বছর কাটাইতে পারলেই, তা না এতো তাড়াহুড়া করে কী লাভ, এখন ঐ পঞ্চাশ বছরের বুড়া মেম্বার যার একটা বউ মরছে, আরেকটা বউ থাকতেই আবার আমারে বিয়ে করতে চায়। ঘরে সাত-সাতটা পোলাপান … টাকাটাই কি সব, আম্মা?’
‘একটা বছরের কথা বলতেছিস, এই একটা বছর কীভাবে টিকব সেই চিন্তা আছে? আর এক বছর পরই তোর চাকরি হবে তার কী গ্যারান্টি? সদরুল মেম্বারের মতো আধবুড়ার সাথে কে নিজের মেয়ের বিয়ে দিতে চায়? কিন্তু আর তো উপায় নাই। আমার কথা নাহয় বাদই দিলাম, তুই একবছর চলবি কেমনে? তোর বাপের সামান্য যা সঞ্চয় আমাদের কাছে ছিল তাও তো শেষপ্রায়। আর বাকি সব তো ঐ শয়তান, শুয়োরের বাচ্চা …’
‘গালাগালি করে কী লাভ, আম্মা’, তরুণী বাধা দ্যায়, ‘সবাই তো আর সোনার চামচ মুখে নিয়ে জন্মায় না। ধরো, আমি যদি একটা গরীব ফ্যামিলিতে জন্মাইতাম, তাহলেই কি ঐ বুড়ার সাথে বিয়ে দিয়ে আমাকে পার করে দেয়ার চিন্তা করতা তুমি? তাছাড়া, আমি টিউশনি করতেছি না? আমাদের কি খাওয়াপরা একেবারেই চলতেছে না?’
‘শুধু চলাচলির ব্যাপার তো নারে, শিখু। এক বছর সময়ের কথাও যদি ধরি, সদরুল মেম্বারের কথা না শুনে আমরা কি থাকতে পারব এখানে? আর তোর বাপের এই সামান্য ভিটা ছেড়ে যদি যাওয়াই লাগে, তখন কই যাবো বলতে পারিস? মুন্সিগঞ্জ ছাড়লে ঢাকা ছাড়া যাওয়ার জায়গা আর কই? ঢাকায় যাবো? ঢাকায় কী আছে আমাদের এখন? সব তো শয়তানটার দখলে।’
আমি কিছু একটা বলতে যাচ্ছিলাম কিন্তু আগেই বুঝতে পেরে মস্তিষ্কস্থিত কণ্ঠস্বর বাধা দ্যায় আমায়, ‘উহুঁ স্যার, এখন কোনো কথা না। শুধু শুনে যান।’
আমার মধ্যে জিজ্ঞাসা তৈরি হচ্ছিল এটা জানবার জন্য যে তারা কি আমাকে দেখতে পাচ্ছে না? একটা জ্বলজ্যান্ত মানুষ দাঁড়িয়ে আছে, আর লিফটটা এখানে এসে থামার সময় একটা শব্দ হয়েছিল সেটাও কি তারা শুনতে পায় নি? আর এই লিফট কোথায় নিয়ে এলো আমাকে? এই প্রত্যন্ত গ্রামাঞ্চলের ততোধিক জীর্ণদশার এই বাড়িটার মধ্যে লিফট এলোই বা কীভাবে? কিন্তু আমি কিছু বলতে পারি না, মুখের ভেতর শুষ্ক জিহ্বা আমার কণ্ঠস্বরকে আড়ষ্ট করে রেখেছে বলে মনে হলো।
‘শয়তানকে বিশ্বাস করার পেছনে আব্বার বোকামিটাও দায়ী, আম্মা। নাহয় তার পুরানো বন্ধু, কিন্তু পার্টনারশিপে কারবার শুরু করার সময় তা-ও তো কিছু দলিলপত্র রাখতে হয় সাইন করে, নাহলে আজকের দুনিয়ায় কে কাকে বিশ্বাস করে, এতোগুলো টাকার ব্যাপার যখন’, মেয়ে বলে।
‘ছিল, কাগজপত্র ছিল’, অকস্মাৎ হিংস্র হয়ে ওঠে প্রৌঢ়া রমণীর কণ্ঠ, চোখ দুটো যেন ঠিকরে বেরিয়ে আসবে। ‘মরার আগে তোর বাপ বলে গেছে, কিন্তু ঐ হারামজাদা লোক লাগায়ে সব দলিল চুরি করে নষ্ট করাইছে। ভল্টের ডবল চাবি ছিল একটা তোর বাপ, আরেকটা বদমাইশটার কাছে। তোর আব্বারে মদ খাওয়ায়ে বেহুঁশ করে চাবিটা সে চুরি করে, তারপর দুইটা চাবি দিয়ে ভল্ট খুলে সে কাগজপত্রগুলা সব সরায়। তোর বাপ যে মদ খাইছে এইটা স্বীকার করতে যাতে না হয় সেই জন্য প্রথমে আমারে কিছু বলে নাই। এক ভোরে ফজরের সময়ে ঘুম ভেঙে উঠে দেখি সে জানালার সামনে বসে কানতেছে। আমি তো বুঝলাম যে তার বন্ধুর বেইমানির জন্যই তার চোখে ঘুম নাই। আমি উঠে গিয়ে তার কাঁধে হাত রাখলাম। সে তখন বলে রাহেলা, অনেক বড় ভুল করে ফেলছি, তোমারে কথা দিছিলাম আর কোনোদিন মদ ছোঁব না, কিন্তু ফেকু বলল এতোবড় একটা সাক্সেস সেলিব্রেট করার জন্য একদিন গলা ভিজালে কিছু হবে না। সে আমারে বারে না নিয়ে হোটেলে তার ভাড়া করা রুমে নিয়ে যায়, আমার তখনই সন্দেহ করা উচিত ছিল কিন্তু আমি বুঝি নাই আমার এতো দিনের পুরানা বন্ধু আমার সাথে এই কাজ করবে, সে মদের মধ্যে কিছু একটা মিশায়ে দিছিল, আমি কয়েক ঘণ্টা অজ্ঞান ছিলাম, এই সময়ের মধ্যে সে কাজ সেরে ফেলে আবার চাবিটা আমার পকেটে ফিরায়ে দিয়েছে। আমি তখনো বুঝতে পারি নাই, জ্ঞান ফেরার পরে অনেকক্ষণ হ্যাংওভার ছিল, তোমাকে ফোন করে বলছিলাম একটা জরুরি কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়ছি, আসলে আমি তখনো হোটেল স্যুটে আর রাত প্রায় এগারটা। আট-দশ দিন পরে যখন একদিন ভল্ট খুলতে চাইলাম ও রাজি হইল না প্রথমে, পরে যখন জোরাজুরি করে খুললাম আর দেখি কাগজপত্র কিছু নাই তখন …’
আমি মন্ত্রমুগ্ধের মতো শুনে যাচ্ছিলাম কিন্তু এর মধ্যেই রাহেলা নামটা আমার ভেতরটাকে আঘাত করে আমূল কাঁপিয়ে দিতে চায়। ভদ্রমহিলার চেহারা দেখেই চেনা মনে হয়েছিল, নামটা শোনার সাথে সাথে এক লহমায় আগের অনেক স্মৃতি হুড়মুড়িয়ে এসে তোলপাড় করে দিতে থাকে আমার অভ্যন্তর। রাহেলা, একসময়ের সুন্দরী আর গ্ল্যামারাস রাহেলা, আমার বন্ধু ইফতেখারের স্ত্রী, যাকে একটা সময়ে ফ্যান্টাসাইজ করতাম আমিও, যে কিনা আমার সাথে সহজভাবে মিশলেও কখনো অন্যায় সুযোগ দ্যায় নি আমাকে- সেই রাহেলার আজ এই হাল হয়েছে! গলার স্বরও বদলে গিয়েছে পুরোপুরি, চেনা যায় না এখন। আর … আর যে একটা নাম সে উচ্চারণ করল এইমাত্র …
লিফটের দরজাটা আমার মুখের সামনে বন্ধ হয়ে যায় তখনই এবং মাথার মধ্যে সেই কণ্ঠস্বর আমাকে জানায়, ‘আর দরকার নেই স্যার, আপনার যা দেখার ইতোমধ্যে দেখে ফেলেছেন।’
লিফট আবার ওপরের দিকে উঠতে শুরু করে, তবে এবার গতি বেশ ধীর। ভেতরের আলোয় মনে হচ্ছে লালের মধ্যে একটু বেগুনির স্পর্শ লেগেছে। আমি এবার কথা বলতে যাবো এর মধ্যেই সে বলে ওঠে, ‘ভদ্রমহিলাকে চিনতে কষ্ট হয় নি তো আপনার?’
‘ন্নাহ্’, আমি বলি, টের পাই শুষ্ক জিহ্বার কারণে উচ্চারণে সমস্যা হচ্ছে।
‘ফেকু যে আপনার ডাকনাম সেটা কিন্তু আমি জানি, স্যার। যদিও কর্পোরেট ওয়ার্ল্ডে আপনার এই নাম কারও জানা নেই, সবাই চেনে বিশিষ্ট বিজনেস ম্যাগনেট মিস্টার শাফকাত কবির সায়মন নামে- সংক্ষেপে এসকেএস। শুধু আপনার ফ্যামিলি মেম্বার, আর ঐ রাহেলা ম্যাডামের হাসব্যান্ড ইফতেখার সাহেবের মতো আপনার ঘনিষ্ঠ বন্ধুরাই কেবল এটা ব্যবহার করত, তাই না? ইফতেখার সাহেব মারা গিয়েছেন দশ বছর হয়ে গেল’, শেষ বাক্যটা স্বগতোক্তির মতো মনে হয় আমার কাছে কিন্তু তারপরই, ‘আচ্ছা স্যার, তিনি মারা গেলেন কীভাবে?’
আমি চমকে উঠি কিন্তু কোন দিকে, কার মুখের দিকে তাকাব বুঝতে পারি না। উত্তরে কী বলব আমি? ‘অ্যা-অ্যাক্সিডেন্ট।’
‘কীসের অ্যাক্সিডেন্ট স্যার?’
আমি কী জবাব দেবো বুঝতে পারি না, এর মধ্যে টের পেলাম লিফটের গতি বেশ বেড়ে গেছে, এখন এটা দ্রুত ওপরের দিকে উঠছে তো উঠছেই, মনে হলো পাতাল ফুঁড়ে বেরিয়ে দশ, বার, বিশ, পঁচিশ, ত্রিশতলা ছাড়িয়ে আরও ঊর্ধ্বে উঠে গেছে। এই বিল্ডিং তো পঁচিশ তলা, এতো ওপরে কীভাবে উঠছে লিফট? আমি প্রশ্নটা করতে যাবো বোধহয় সেটা টের পেয়েই মস্তিষ্কস্থিত কন্ঠ আমাকে বাধা দিয়ে বলে ওঠে, ‘একটা তো শেষ হলো, এবার আমাদের দ্বিতীয় ভ্রমণ, স্যার।’
আমার আন্দাজ মতো প্রায় পঞ্চাশ তলা উঠে এসে লিফটটি আবার থেমে যায় বেশ একটু শব্দ করে। দরজাটা খুলে যেতেই বাইরের তীব্র আলো আমার চক্ষুস্থিত কর্নিয়ার ওপর রীতিমতো আক্রমণ করে বসে। আমি প্রথমটায় হাত তুলে আলোর অনুপ্রবেশ ঠেকাতে চেষ্টা করি, তারপর ধীরে ধীরে হাত সরিয়ে নিতেই প্রথম ধাক্কাটা অপসারিত হয়ে একটা কক্ষ দৃশ্যপটে ফুটে উঠতে থাকে। আমার পরিচিত একটা স্থান। আগের রুমের সাথে কোনো মিল নেই, কিন্তু কী আশ্চর্য, রুমের ঠিক মাঝেই একটা টেবিল স্থাপিত সেই আগের রুমটার মতোই এবং তেমনই যেন দু’পাশে দু’টো চেয়ার রাখা। মাথার ওপর স্কাইলাইট দিয়ে স্বচ্ছ নীলাকাশ এবং দূরবর্তী ফ্রেঞ্চ ধাঁচের জানালার ওপারে ম্যানহাটনের স্কাইস্ক্র্যাপারবহুল ল্যান্ডস্কেপ সহজেই দৃষ্টিগোচর হয়। রুমের মেঝেতে দামি পার্শিয়ান কার্পেট, এক পাশে মেহগিনি কাঠের কাবার্ড, তার পাশে একটা সিংক। আরেক দিকের দেয়াল ঘেঁষে একটা কাঠের মিটশেল্ফ তবে আগেরটার মতো জরাজীর্ণ নয় অবশ্যই, বেশ ঝকঝকে পার্পল রঙের। তার ওপর অফহোয়াইট দেয়ালে ঝুলছে একটি বাঁধাই পারিবারিক ছবি এবং সেই ছবিতে থাকা মানুষগুলোকে আমি চিনে নিতে পারি অতি সহজেই। বছরে বার কয়েক আমার যাতায়াত আছে এখানে।
টেবিলের দুই পাশে যারা বসে আছে তাদের কাউকে চিনতে আমার অসুবিধা হয় না। ঠিক আগের রুমের মতোই একইভাবে বামপাশের চেয়ারে কপালে হাত ঠেকিয়ে বসে আছে যে সে আমার স্ত্রী সামায়রা, বয়স রাহেলার মতোই পঞ্চাশ ছুঁই ছুঁই, কিন্তু তার বেশভূষা, শরীরের ত্বক ঠিকরে বেরোচ্ছে দুধ, মাখন, পনির এবং আরও সব পুষ্টিকর খাদ্যবস্তু উদরস্থ করার অভ্যস্ততাজনিত লালিমা। ডানদিকে চেয়ারে আমারই নয়নমণি, মেয়ে সানজিদা, সে বসে আছে চেয়ারে দুই পা তুলে ঠিক কী যেন নাম ঐ মেয়েটার, প্রয়াত বন্ধু ইফতেখারের মেয়ে, শিখা, হ্যাঁ শিখাই তো, ঠিক তার মতো করে। তবে পরনে তার সালোয়ার-কামিজ নেই, একটা ঘিয়ে রঙের শেমিজের সাথে বর্ণালি ফুটকি দেয়া কালো স্কার্ট।
‘রিক, উফ্ রিক, তোর ড্যাডির মতোই হয়েছে স্টাবোর্ন আর অ্যারোগেন্ট। টু নাইটস এগো ইস্টারের পার্টি থেকে ফিরতে বেশি রাত করে ফেলেছিল দেখে ওকে সামান্য ধমকেছি। এ জন্য পুরো একটা দিন সে বাসা থেকে হাওয়া হয়ে থাকবে? Just vanished into thin air? আমার তো মনে হচ্ছে, something’s happening.’
‘কামঅন মা’, সানজিদা, ওর এখন বয়স বাইশ, অর্থনীতির ওপর পড়াশোনা করছে বার্নার্ড কলেজে, অনেকটা সান্ত্বনার স্বরে বলতে থাকে, ‘Rick’s adult now. He knows very well what he’s doing.’
এরিক, আমার ছেলে এরিক, বাসায় ফেরেনি পুরো একটি দিন, একটি রাত! কোথায় আছে সে? আমার তো পষ্টাপষ্টি সামায়রাকে বলা ছিল এরিককে কখনো দৃষ্টির আড়াল না করে, আমেরিকার লাইফস্টাইলে অভ্যস্ত হতে সময় লাগবে, যদি প্রাপ্তমনস্কতা আসার আগেই একবার সেই লাইফস্টাইলের মধ্যে ঢুকে যায় তাহলে সামলানো মুশকিল। আমাকে এখনই কথা বলতে হবে সামায়রা আর সানজিদার সাথে, আমি সামনের দিকে এগিয়ে যাই কোথায় আছি সে কথা ভুলে গিয়ে, আমার মাথার মধ্যে কণ্ঠধ্বনি আমাকে অবিরত বারণ করতে থাকে, ‘উহুঁ স্যার, একটুও আগাবেন না। আপনি যা দেখতে পাচ্ছেন সেটার অবস্থান বস্তুগতভাবে এক অন্য জগতে, আপনার চারপাশের পৃথিবীতে নয়’ তবু আমি এগিয়ে যাই- আমার একটা হাত সামনের দিকে বাড়িয়ে ধরা কিন্তু লিফটের দরজা পর্যন্তই পৌঁছতে পারি কেবল, এরপরেই বিদ্যুতের প্রচণ্ড শক খাওয়ার মতো হয়ে পিছিয়ে আসি। নারীর কন্ঠধ্বনি আমাকে শোনায়, ‘আপনি শুধু দেখে যান স্যার, এখন তাদের কাছে যেতে পারবেন না কারণ আপনি বাস্তবে ওখানে উপস্থিত নেই, যা দেখতে পাচ্ছেন এসবই আসলে বাস্তব ঘটনার একটা প্রতিফলন আপনার সামনের পর্দায়।’
‘কিন্তু এরিক, আমার এরিক- তার কী হয়েছে?’
‘ধৈর্য ধরুন স্যার, সবই জানতে পারবেন।’
আমি পুনরায় মনোসংযোগ করি সম্মুখবর্তী দুই নারীচরিত্রের মধ্যে কথোপকথনে। সামায়রা তখন বলছে, ‘এরিকের মাথা নষ্ট করেছে গতবার যখন বাংলাদেশে গেল তখনই ঐ হারামজাদী মাগিটা, দ্যাট হোর।’
‘কার কথা বলছ, মা?’
‘ঐ যে তোর ড্যাডির সেক্রেটারি, সব সময় সাথে সাথে থাকে।’
‘দৃষ্টিকেতু? সে তো সেক্রেটারি না মা, অ্যাসিস্ট্যান্ট ম্যানেজার।’
‘ঐ হলো। তাকে তোর ড্যাড সেক্রেটারির মতোই ট্রিট করে। না জানি দুইজনের মধ্যে কী আছে! আমার তো সব সময় সন্দেহ হয় ঐ মেয়েটার ভাবভঙ্গি দেখে।’
‘কী বলছ মা! একবার বলছ এরিকের মাথা খেয়েছে, এখন আবার বলছ ড্যাডির সাথে। আমার ধারণা ইউ আর থিংকিং টু মাচ মা, এইজন্য উইয়ার্ড থটগুলো তোমাকে হন্ট করছে।’
‘কী জানি বাপু, গতবার দেশে যখন গিয়েছিলাম মনে আছে, অফিসে ঐ মেয়েটা কীভাবে হেসে হেসে রিকের সাথে কথা বলছিল? আর কিছুতেই যেন পিছু ছাড়তে চায় না, একেবারে যেন আঠার মতো সাথে লেগেছিল। শুধু তাই তা, এরিককে আমি পরে কয়েকবার ফোনে কথাও বলতে শুনেছি এবং মনে হচ্ছিল he was talking with that bitch. তারা সম্ভবত ডেটও করেছে, আমার যেটা মনে হয়।’
‘হা হা মা, তুমি ভুলে যাচ্ছ কেন, Rick’s just twenty now, আর ঐ মেয়েটা? She belongs to the thirties, I predict.’
‘এইসব বয়সের ব্যাপার আমাকে বুঝাতে আসিস না। এগুলো এখন তোদের ভাষায় নাম্বার ছাড়া আর কিছু না। যখনই থার্টি ক্রস করে মাগিগুলো বলতে থাকে age is just a number …’
আমার সামনে কোনোরকম পূর্বসঙ্কেত ছাড়াই লিফটের দরজা বন্ধ হয়ে যায়, আর আমিও হারিয়ে গেলাম লিফটের ভেতর নিউইয়র্কের সকালবেলাকার রৌদ্রালোকের কিয়দংশকে সঙ্গে নিয়ে কেমন একটা কমলাটে লাল অন্ধকারে। মাথার ভেতর সেই নারীকণ্ঠ বাণী ঢালতে থাকে, ‘আপনি যথেষ্ট দেখে ফেলেছেন স্যার। আপনার দ্বিতীয় ভ্রমণ এইমাত্র শেষ হলো। আশা করি পর্যাপ্ত আনন্দ পেয়েছেন।’
‘কী, কী হচ্ছে এসব!’ আমি জিভের জড়তাকে অতিক্রম করে প্রায় চেঁচিয়ে উঠি লিফটের মধ্যে, জানি না কার উদ্দেশ্যে, ‘এসবের মানে কী?’
লিফট ততোক্ষণে আবার নিচে নামতে শুরু করেছে। এভাবে কোথায় নিয়ে কোন নরকের সোপানদ্বারে ঠেকাবে আমাকে? তবে গতি খুবই ধীর। সামান্য নীরবতা, এরপরই নারীকণ্ঠ বলতে থাকে, ‘যখনকার এই দৃশ্য দেখছেন সেই মুহূর্তে আপনার ছেলে এরিক জেএফকেতে অপেক্ষায় আছে লন্ডনগামী ফ্লাইটের জন্য। লন্ডন থেকে সে পৌঁছাবে ঢাকায় কয়েকদিনের মধ্যে, কেননা তার কাছে খবর গিয়েছে তার প্রেমিকা আরেকজনের সাথে অতি সম্প্রতি বাগদান সম্পন্ন করে খুব শিগগিরই বিয়ের পিঁড়িতে বসতে যাচ্ছে। ঐ বিয়েটা তাকে ঠেকাতে হবে।’
‘এরিকের প্রেমিকা?’ আমার বিস্ময়াহত কণ্ঠ চিরে বেরিয়ে আসে, ‘বাংলাদেশে? কিন্তু এ তো অসম্ভব! এখানে এমন কেউ নেই ওর, থাকার কথা নয়।’
‘অবশ্যই আছে, স্যার। এবং সে আপনার খুব কাছের মানুষ।’
‘মানে?’
‘মানেটা খুব সহজ, স্যার। আপনার অ্যাসিস্টেন্ট ম্যানেজার মিজ দৃষ্টিকেতু তাকে কমিট করে এখন পুরোনো প্রেমিক আশফাক রিয়াদের গলায় মালা পরাতে যাচ্ছে কিছুদিনের মধ্যেই, আপনি জানেন সেটা। নিজেও তো খুব বড় কোনো ওয়েডিং গিফটের কথা চিন্তা করছেন আপনি, তাই না স্যার?’
‘দৃষ্টিকেতুর সাথে এরিক! তা কীভাবে সম্ভব? ওদের পরিচয়ই বা ক’দিনের? আর দু’জনের এজ গ্যাপ, দৃষ্টিকেতুর আগের রিলেশন এসব কনসিডার করলে এটা তো নেক্সট টু ইম্পসিবল!’
‘There are more things on heaven and earth sir, than meets the eye. বয়সের গ্যাপ কিছুই না। আপনার সাথেও তো মিজ দৃষ্টিকেতুর গ্যাপ অনেকদিনের। তাই বলে তাকে বিছানায় নিতে আপনার সমস্যা হয় নি। মিজ দৃষ্টিকেতুর তো সমস্যা হয় নি তার প্রেমিক থাকা সত্ত্বেও আপনার মতো সুগারড্যাডির সাথে প্রেসিডেন্সিয়াল স্যুটে বেড শেয়ার করতে। তেমনি আপনার ছেলের সাথে সম্পর্ক গড়ে আপনার প্রতিষ্ঠান থেকে গুরুত্বপূর্ণ কিছু তথ্য হাতিয়ে নিয়ে আপনাকে পথে বসানোও তার জন্য কোনো ব্যাপার না। এমনটাই তো ঘটে স্যার, যার ওপর সবচেয়ে বেশি বিশ্বাস রাখা হয় সেই দেখা যায় নিঃস্ব করে দিয়ে পথে বসায়। এমন হয় না স্যার, বলেন? এটা তো আমার চেয়ে আপনিই ভালো জানেন।’ আমি জবাব না দিয়ে চুপ করে থাকি। ‘চলুন স্যার, এবার আপনাকে নিয়ে যাবো তৃতীয় ও সর্বশেষ দৃশ্যপটে। মনে হচ্ছে এই ভ্রমণে আপনি আশাতীত আনন্দ লাভ করবেন।’
আমি টের পাই লিফটের গতিবেগ বাড়ছে। এখন কতো তলায় আছি আমরা চল্লিশ, ত্রিশ অথবা বিশ? আনুমানিক পনের তলা হবে, কোথায় কোনো নির্দেশক চিহ্ন নেই যা দেখে বুঝতে পারি আমার অবস্থান। লিফট একটা মৃদু নাড়া খেয়ে থেমে যায়, এবং চোখের সামনে নতুন দৃশ্য উন্মোচিত হতে থাকে। আরামদায়ক নীলাভ হালকা আলো ভেসে ওঠে সম্মুখপটে।
একটা বিলাসবহুল শয়নকক্ষ। এক নজরেই বুঝতে অসুবিধা হয় না কোনো পাঁচতারকা হোটেলের নিভৃত রুম এটা। রুমের মাঝখান জুড়ে একটা ডবল বেড, একপাশে সাইড কেবিনেট, দেয়ালজুড়ে বিচিত্র সব আলোকচিত্র বাঁধাই হয়ে ঝুলছে বিশাল সাইজের এলইডি টিভিটার চারপাশ ঘিরে। এসির একটানা গুঞ্জন রুমটিকে আরামদায়ক নাতিশীতোষ্ণতায় ডুবিয়ে রেখেছে বলে মনে হয়। আমি দেখতে পাই বেডের ওপর একটি নারী, সম্পূর্ণ নগ্ন, উপুড় হয়ে শুয়ে আছে আর ওপাশ থেকে একটি পুরুষালি হাত এগিয়ে এসে আদর করছে তাকে, নিতম্বে আঙুল বোলাচ্ছে, হালকা চাঁটি মারছে, কখনো চুমু খাচ্ছে সুগোল অঙ্গটিতে। মেয়েটার মুখ প্রথমে দেখতে পেলাম না, কিন্তু কয়েক সেকেন্ড বাদে সে কাত হলো ঠিক আমার দিক ফিরে যদিও আমাকে সে দেখতে পাচ্ছে না, অথচ হালকা নীলাভ আলোয় তার মুখ ভালো করে দেখতে না পেলেও মুখের গড়ন, চুল, কোমরের বাঁক এসবে মোটামুটি এইটুকু সময়ের মধ্যেই চিনতে পেরে যাই ওকে। বুকের সুন্দর, সুদৃঢ়, সুগোল দুই গম্বুজের মাঝে সোনার চেইনের সাথে লটকে আছে সোনালি ক্রস, ওটা আমিই গিফট করেছিলাম ওর বার্থডেতে, বলেছিলাম দৃশ্যমানভাবে যেন সবসময় পরিধান করে থাকে ওটা। পেছনের হাতটি এবার সামনে এগিয়ে এসে চেপে ধরেছে তার সুন্দর পাকা বাতাবিলেবুর মতো নিখুঁত গোলাকার স্তন, পেষণ করছে ক্রমশ, উত্থিত গোলাপি স্তনবৃন্তদ্বয় ক্রমাগত নিষ্পেষিত হচ্ছে তার আঙুলের দ্রুত নাড়াচাড়ার ভেতর। এবার মেয়েটি পার্শ্বস্থ লোকটার ঠোঁট থেকে সিগারেট নিয়ে নিজের ঠোঁটে ছোঁয়ায়, একটানে অনেকগুলো ধোঁয়া ভেতরে নিয়ে নাক-মুখ দিয়ে একসাথে ছাড়তে থাকে। আমি দৃষ্টিকেতুকে কখনো ধূমপান করতে দেখি নি, কিন্তু তাকে এ মুহূর্তে দেখে মনে হচ্ছে না এ বিষয়ে অভ্যস্ততার ঘাটতি আছে কোনো। লোকটির হাত এবার দৃষ্টিকেতুর স্তন ছাড়িয়ে চলে যাচ্ছে তার দুই উরুর সন্ধিস্থলের দিকে এবং অতিদ্রুত সক্রিয় হয়ে ওঠে সেখানে। প্রথমটায় দৃষ্টিকেতুর মধ্যে কোনো ভাবান্তর লক্ষ করা যায় না, কিন্তু আঙুলের গতিবেগ বাড়ার সাথে সাথে তার বুকের ওঠানামা দ্রুততর হয়। উত্তেজনার পারদ ক্রমশ ঊর্ধ্বগামী হতে থাকে এবং চূড়ান্ত মুহূর্ত আসার পূর্বেই দৃষ্টিকেতু কনুইয়ের গুঁতোয় হাতটিকে সরিয়ে দ্যায়। এখনো তার শরীরের ভাঁজে ভাঁজে খেলা করছে খাঁড়ির উচ্ছ্বসিত জল, এর মধ্যেই তার হাতে উঠে আসে একটি সেলফোন। ফোনের স্ক্রিনে কিছুক্ষণ তার আঙুলের নড়াচড়া, আমি এবার স্ক্রিনের আলোয় দৃষ্টিকেতুর মুখমণ্ডলটাকে স্পষ্ট দেখতে পাই- প্রবল উত্তেজনা সেখানে স্থিরচিত্রের মতো জমাট বেঁধে আছে যেন কিছুক্ষণের মধ্যে পুনরায় সপ্রাণ হবে বলেই। সে এবার ফোনটা হস্তান্তরিত করে পার্শ্ববর্তী পুরুষসঙ্গীটিকে। এবার তার মুখাবয়ব আলোয় উদ্ভাসিত হলে আমি তা দেখে চমকিত না হয়ে পারি না। এ তো সেই আখতার ফরিদ, কগনেটের রিপ্রেজেন্টেটিভ, যার কাছে দৃষ্টিকেতুকে ছেড়ে আমি উত্তরায় যাবো বলে উঠে এসেছি কনফারেন্স রুম ছেড়ে। ওরা দু’জন এই পাঁচতারকার হোটেল স্যুটে কী করছে? আর এখানে এতো দ্রুত এলোই বা কীভাবে? ওরা কি সিঁড়ি বেয়ে অতিক্রম করেছে এতোগুলো তলা? লিফটের মধ্যে তো আমি ঢুকে বসে আছি, করে চলেছি একটার পর একটা আশ্চর্যভ্রমণ। ওরা এতো শিগগিরই হোটেলে গেল কী করে জানাটা প্রয়োজন আমার জন্য। কিছু বলতে যাবো এর মধ্যে নারীকণ্ঠ আগের মতো আবার বাধা দ্যায়, ‘যা দেখছেন দেখতে থাকুন, স্যার। একটু পরে সবই বুঝে যাবেন।’
এবার দেখতে পাই ঐ আখতার ফরিদ সেলফোনের স্ক্রিনে কী যেন দেখে হাসতে হাসতে গড়িয়ে পড়ছে বিছানার ওপর, দৃষ্টিকেতু লাফিয়ে পড়ছে তার বুকে- উত্তেজনা ছাড়া পেয়েছে হঠাৎ স্লুইস গেট খুলে দেয়া গর্জনরত জলের তীব্রতায় এবং অল্পক্ষণের মধ্যেই সে অশ্বারোহীর নিপুণ দক্ষতায় চড়ে বসছে আখতার ফরিদের নগ্ন শরীরটির ওপর, তার কোমরের ভাঁজে ঊর্ধ্বনিম্নগামী তরঙ্গের তৎপরতা শুরু হয়ে গেছে যেন বিদ্যুৎ খেলা করছে সর্বাঙ্গে, খানিকক্ষণ আগের খিলখিল হাসি পরিণত হয়েছে পুলকিত গোঙানিতে। আখতার ফরিদের হাত দু’টো চেপে বসেছে দৃষ্টিকেতুর দুই স্তনে, দৃষ্টিকেতু হয়ে আছে ঊর্ধ্বগ্রীবা, তার কণ্ঠ থেকে নিঃসৃত হচ্ছে অবিরাম ‘Oh God! Oh God! Kill me, harder, please!’ কাতর কামোচ্ছ্বসিত ধ্বনি।
কতোক্ষণ ধরে এই অনুপভোগ্য নীলছবি আমার চোখের সামনে চলতে থাকত জানি না, তবে লিফটের দরজা বন্ধ হয়ে গেল এর মধ্যে হঠাৎ করেই। লিফটের অভ্যন্তর যেন ঐ হোটেল কক্ষ থেকে কিছুটা আলো শুষে নিয়ে নিজেও ধারণ করেছে একটি নীলচে লাল ব্যাখ্যাতীত বর্ণ। চোখের সামনে দেখা দৃশ্যাবলি হজম করতে কিছুটা সময় লাগে, আমি নিজেকে সেই সময়টুকু দিই। এবং তারপরই প্রশ্ন ছুঁড়ে দিই অদৃশ্য নারীর প্রতি, ‘এটা কীভাবে সম্ভব? আমি দৃষ্টিকেতুকে এইমাত্র রেখে এসেছি কগনেট অফিসের কনফারেন্স রুমে ঐ আখতার ফরিদের সাথে, সে এর মধ্যে কীভাবে পৌঁছে গেল হোটেলকক্ষে? তারা নামল কোন পথে? এই বিল্ডিংয়ের কী আর কোনো লিফট আছে? পাশের লিফটটা তো দেখলাম অচল হয়ে পড়ে আছে।’
‘আপনার একটু ভুল হয়েছে, স্যার। আপনি চোখের সামনে যা দেখেছেন এগুলোকে সবই বর্তমানে চলমান ঘটনাবলি ধরে নিয়েছেন। আসলে এসবই ঘটেছে বাংলাদেশ সময় গতকাল রাত সাড়ে এগারটা থেকে বারটার মধ্যে ঢাকা, মুন্সিগঞ্জ এবং নিউইয়র্কের তিনটি স্থানে। এখন আপনাকে বলছি যা দেখেছেন তার ব্যাখ্যা। আপনার প্রিয় অ্যাসিস্টেন্ট ম্যানেজার মিজ দৃষ্টিকেতু, যে একই সাথে আপনার এবং আপনার প্রিয় পুত্রের প্রেমিকা, সে প্রেমিকা ঐ আশফাক রিয়াদের যাকে সে বিয়ে করতে যাচ্ছে আগামি মাসে আর এই আখতার ফরিদেরও, এবং এমন আরও অনেক ফয়সাল শিবলী রবিন নাসের রানা জামাল কামালের, আসলে যে একজন কপোরেট প্রস্টিটিউট ছাড়া আর কিছুই নয়, যাকে ঐ প্রস্টিটিউটে পরিণত করেছেন আপনি নিজেই; দেখতে পেলেন তো সে মোবাইল ফোনে শেয়ার করছে তার শয্যাসঙ্গীর সাথে কিছু একটা, সেটা অন্য কিছু না, আপনার সাথে হোটেলের বিছানায় কিছু অন্তরঙ্গ মুহূর্তের ভিডিও দৃশ্য- যা সে কৌশলে তার ফোনে ধারণ করে রেখেছিল। গতরাতেই তা ব্লুটুথের মাধ্যমে পাচার হয়ে গেছে আখতার ফরিদের মোবাইল ফোনে। এটা এখন কাজে লাগবে কগনেটের। আপনি যে দৃষ্টিকেতুকে বসিয়ে রেখে এসেছেন তার প্রেমিক কাম শয্যাসঙ্গী আখতার ফরিদের সাথে ডিলটা যাতে আপনার প্রতিষ্ঠানের ফেভারে হয় সেই উদ্দেশ্যে, সেই ডিল এখন চূড়ান্তরকমভাবে হতে যাচ্ছে কগনেটের অনুকূলে। তবে এটা এখনই প্রকাশ পাবে না আপনার কাছে, আপনি জানতে পারবেন দৃষ্টিকেতুর বিয়ের অনেক পর, যখন কিনা আপনার কাছ থেকে বহুমূল্য ওয়েডিং গিফট-টিফট সহ আরও বহু কিছু নিয়ে সে নিজেই জয়েন করতে যাচ্ছে কগনেটে।’
আমার বুকের মধ্যে নীরবতার জগদ্দল পাথর চেপে বসে পাঁজরগুলোকে গুঁড়ো গুঁড়ো করে ফেলবে বলে মনে হতে থাকে। যেই দৃষ্টিকেতুকে প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ে এমবিএ পাশ করে আকর্ষণীয় চাকরির স্বপ্ন নিয়ে আসা সাধারণ একজন তরুণী থেকে আমি তিলে তিলে গড়ে তুলেছি একজন সুচারু বারগেইনাররূপে, যাকে শিখিয়েছি কর্পোরেট ডিলিংয়ের যাবতীয় কৌশলের চোরাগলি, যাকে তুলে এনে রেখেছি নেগোসিয়েশন-ট্রানজ্যাকশন-এন্টারটেইনমেন্ট জগতের আলোকোজ্জ্বল একই সাথে অন্ধকারাচ্ছন্ন চৌরাস্তায়, সে-ই কিনা এখন বিশ্বাসঘাতকতার শাণিত চাকু বসাতে যাচ্ছে আমার বুকের গভীরে!
অদৃশ্য নারীকণ্ঠ যেন বুঝতে পারে আমার মনের অবস্থা। ‘এটাই জগতের নিয়ম, স্যার। যাকে বিশ্বাস করা যায় সেই কিন্তু পিঠে ছুরি মারে অথবা নিঃস্ব করে পথে বসায়।’ কিন্তু তার কণ্ঠ সহানুভূতির পরিবর্তে হঠাৎ যেন একটু তীক্ষ্ণ হয়ে বেজে ওঠে আমার কানে, ‘আসলামের কথা মনে আছে তো স্যার আপনার?’
‘আসলাম, কোন আসলাম?’
‘ঐ যে স্যার, আপনার গ্রামের বাড়ির মানুষ, গাইবান্ধার। আপনার বাবা বেঁচে থাকতে প্রায়ই আসত ঢাকায় দেখা করতে তার সাথে। পরে একবার এসেছিল, তার বছর পনের বয়সী মেয়েটাকে নিয়ে, মেয়েটার হাঁটাচলায় সমস্যা- ভেইন থ্রম্বোসিস। আপনি বলেছিলেন তার চিকিৎসা করাবেন ঢাকায় রেখে, আসলাম মূর্খ গ্রাম্য চাষাভূষা মানুষ, আপনাকে বিশ্বাস করে তার মেয়েকে রেখে গিয়েছিল আপনার কাছে, আপনি বলেছিলেন তার চিকিৎসার পর ঢাকায়ই তাকে কোনো একটা গার্মেন্টসে – আপনার পরিচিত গার্মেন্টস আছে অনেক – কাজে ঢুকিয়ে দেবেন, এমনকি পরে বিয়ে দেবেন নিজের তত্ত্বাবধানে। সেই আসলাম, যে আপনাকে বিশ্বাস করে তার মেয়েকে রেখে গিয়েছিল, আপনি তার চিকিৎসা করিয়েছিলেন ঠিকই, কিন্তু পরে গার্মেন্টসে চাকরির বদলে তাকে পাচার করে দিয়েছিলেন হংকংয়ের অরগ্যান ট্রাফিকারদের কাছে। তার কিডনি, লিভার, ফুসফুস, চোখ, বৃহদান্ত্র এসব কেড়ে নিয়ে তার লাশটাকে ট্রাফিকাররা ছুঁড়ে ফেলে দিয়েছিল দক্ষিণ চীন সাগরের চোরাস্রোতে, চেহারা-শরীর পুড়িয়ে এমন বিকৃত করে দিয়েছিল যে হংকংয়ের পুলিশের সাধ্য হয় নি তাকে শনাক্ত করার। আর বাংলাদেশি একটা অসহায় মেয়ে, যার মূর্খ চাষা পিতা কোনোদিন বিদেশ চোখে দ্যাখে নি, যাকে হংকংয়ে পাচার করা হয়েছিল সমুদ্রপথে অবৈধভাবে কন্টেইনারে করে, তার ঠিকুজি কীভাবে বের করবে সে দেশের পুলিশ? হংকংয়ে তো এ-ই হয় স্যার, বাংলাদেশের মতো দেশগুলো থেকে অসংখ্য মেয়ে, যাদের ভাগ্য সামান্য ভালো তাদেরকে বেশ্যাবৃত্তিতে নিযুক্ত করা হয় বিভিন্ন ব্রোথেল কিংবা স্ট্রিপক্লাবে, আর যাদের কিনা ভাগ্যটা পুরোই খারাপ তারা অরগ্যান ট্রাফিকারদের কবলে পড়ে বিভিন্ন অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ হারিয়ে নিষ্প্রাণ ভাসতে থাকে সমুদ্রের পানিতে। এদের সাথে আপনার যোগাযোগ আছে স্যার, আপনি এর আগেও অনেক মেয়ে পাচার করেছেন ব্যাংকক, হংকং, সাংহাই সহ পূর্ব এশিয়ার বিভিন্ন শহরের ব্রোথেলগুলোতে ভাড়াখাটা মেয়ে হিসেবে ব্যবহৃত অথবা অঙ্গচ্ছেদের নিরুপায় শিকার হওয়ার জন্য। আপনার বায়িং হাউস তো একটা ভড়ং স্যার, এর বাইরে নারী পাচার, আদম পাচার, মাদক পাচারের সাথে আপনি জড়িত, ঐগুলোই তো আপনার আসল ব্যবসা। তা নাহলে দেশে জাতীয় নির্বাচন হলে কীভাবে পছন্দের প্রার্থীর পেছনে এতো কাঁড়ি কাঁড়ি টাকা খরচ করেন আপনি, এমপিদের দামি দামি গিফট পাঠান, সম্ভব হয় কীভাবে আপনার পক্ষে দুবাই, ব্যাংকক, কেম্যান আইল্যান্ডে সঙ্গিনী নিয়ে বিলাসবহুল হোটেলে দেহজ ফূর্তি করা, কী করে নিউইয়র্ক, টরন্টো, সিঙ্গাপুর, কুয়ালালামপুরে এতো স্থাবর সম্পত্তি গড়ে তুলেছেন নিজের ও স্ত্রী-সন্তানের নামে এমনকি বেনামেও, স্যার?
‘যাই হোক, ঐ আসলামকে তো প্রথমে বুঝ দিয়েছিলেন যে তার মেয়েকে গার্মেন্টসে কাজ দিয়েছেন আপনি। সে প্রথমে অনেক চেষ্টার পর যখন মেয়েটার সাথে যোগাযোগের জন্য ধরে বসল আপনাকে তখন আপনি তার কল রিসিভ করা বন্ধ করে দিলেন। এরপর ব্লক করে দিলেন তার নম্বর। আপনার বাসায় দেখা করার জন্য যাতে ঢুকতে না পারে সেই ব্যবস্থাও করলেন। এ কারণে সে তো আর আপনাকে পায় না। আসলাম মূর্খ চাষা হতে পারে স্যার, কিন্তু তার মাথায় সামান্য হলেও বুদ্ধি আছে। আজকে এই তো কিছুক্ষণ আগে সে অন্য একটা অপরিচিত নম্বর থেকে আপনাকে ফোন দিয়েছিল। কিন্তু আপনি ভান করেছেন যে আসলামকে চেনেনই না, খুব নিখুঁত অভিনয় চালিয়ে গেছেন লিফটে ওঠার আগ পর্যন্ত, তাই না? আপনি একটা জঘন্য অমানুষ, স্যার!’
শেষের বাক্যটা উচ্চারণ করার সময়ে তার কন্ঠ এতোটাই তীক্ষ্ণ হয়ে পড়ে আর সেটা এতো উচ্চগ্রামে ওঠে যে আমার পিলে চমকে যায় আর তার বাক্যটা শেষ হওয়ার পরও লিফটের অভ্যন্তরে আমি যেন কেবলই তার প্রতিধ্বনি শুনতে থাকি। আমাকে আমুল কাঁপিয়ে দ্যায় তার ছুঁড়ে দেয়া ভর্ৎসনার মধ্যে তীব্র ঘৃণার উপস্থিতি। টের পাই কপাল বেয়ে নেমে আসছে ঘামের ছোট ছোট ধারা, শরীরের বিভিন্ন স্থানেও শুরু হয়ে গেছে তাদের নিঃশব্দ সঞ্চলন। আমার নিজেকে ফিরে পেতে বেশ কিছুটা সময় লাগে। অবশেষে আমি তাকে জিজ্ঞেস করার মতো করে নিজেকে সামলে নিতে পারি, ‘আ-আপনি আমার কাছে কী চান সে আলাপ পরে। আসলে আপনি কে, সেটা আগে বলুন তো?’
‘আগেও বলেছি যে আমি লিফট, স্যার। প্রতিদিন যে লিফটে করে আপনি ওপরে ওঠেন আবার নিচে নেমে আসেন, সেই লিফট। সমাজের লিফটে চড়ে যেভাবে আপনি ওপরে উঠে আসছেন, ঠিক একইসাথে আপনি ক্রমশ সর্বনিম্ন স্তরে নেমে যাচ্ছেন একজন মানুষ হিসেবে প্রতিনিয়ত। অথচ নিচে নামারও কিন্তু একটা শেষ আছে, স্যার। আপনি হয়তো এখন আত্মীয়-স্বজন, আপনার সন্তান, প্রেমিকা অথবা শয্যাসঙ্গিনী- এদের মাধ্যমেও ঝামেলায় পড়তে চলেছেন। ভাবুন তো যদি এমন হয় যে, খুব শিগগিরই দৃষ্টিকেতু সহ বাংলাদেশের অনেক প্রতিষ্ঠিত ব্যবসায়ীর অসুখী স্ত্রীদের সাথে আপনার সেক্স স্ক্যান্ডাল ছড়িয়ে পড়ল ঢাকার আকাশে-বাতাসে, তাহলে বিষয়টা কিন্তু আর আপনার নিয়ন্ত্রণে থাকছে না। আগেই বলেছি এমনই হয়, স্যার। এটা আপনি তো ভালো করেই জানেন।
‘আপনার এই যে পূর্ব এশিয়ায় নারী পাচার, মাদক ব্যবসার আকাঙ্ক্ষা- এগুলোর সাথে তো আপনার বন্ধু ইফতেখার একমত ছিলেন না। তিনি চেয়েছিলেন সৎভাবে থেকে যতোটা সচ্ছলতা অর্জন করা যায় তার মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকতে। কিন্তু তার সাথে আপনার অদম্য উচ্চাশাকে খাপ খাওয়াতে পারলেন না। অথচ ব্যবসা শুরু করেছিলেন আপনারা দু’জন পার্টনারশিপে, ইনভেস্টমেন্ট তার সত্তর পার্সেন্ট আর আপনার ত্রিশ। সুতরাং মেজর পার্টনার তো সে-ই ছিল স্যার, তার কথা না শুনে আপনি যাবেন কই? কিন্তু তাকে রাখলে তো আপনার উন্নতি হচ্ছে না। ফলে পার্টনারশিপের সব কাগজ আপনি সরিয়ে ফেললেন, নষ্ট করে ফেললেন আর নিজের নামে মালিকানার ভুয়া কাগজপত্র তৈরি করলেন। ইফতেখার সাহেব টের পেয়ে আপনার নামে মামলা করার হুমকি দিলেন। এরপর কী হলো, স্যার? ব্যাপারটা জানার আমার আগ্রহ হচ্ছে।’
‘আর কী হবে, সে একটা ট্র্যাজিক ঘটনার মধ্যে পড়ে গেল’, বলেই আমি সচকিত হই, ‘কিন্তু আপনি এসব কী বলছেন আমাকে? আমি কেন তার সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করতে যাবো?’
‘আপনার মতো অন্যরা যে কারণে করে। যে কারণে এখন আপনার প্রিয় শয্যাসঙ্গিনী আপনার সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করে যাচ্ছে। এরা সবাই আসলে ওপরে ওঠার লিফটটাকে ধরতে চায়। কিন্তু তারা এটা মনে রাখে না যে লিফট শুধু ওপরেই ওঠায় না, মানুষকে নিচেও নামিয়ে আনে। যে পথ বেয়ে একদিন ওপরে ওঠা, ঠিক সেই পথেই নেমে আসা। এখন আমাকে বলেন স্যার, ইফতেখার সাহেবের কী হয়েছিল?’
‘আগেই তো বলেছি, অ্যাক্সিডেন্ট।’
‘আর আপনাদের যৌথ প্রতিষ্ঠান এসঅ্যান্ডআই এন্টারপ্রাইজ যে অচিরেই এসকেএস নামে আবির্ভূত হলো, সেটাও নিশ্চয়ই অ্যাক্সিডেন্ট, তাই না? যাই হোক, আমি তো আপনার প্রায় সব প্রশ্নেরই জবাব দিয়েছি, কিন্তু স্যার আপনি আমার করা একটা মাত্র প্রশ্নের উত্তর ঠিকঠাকমতো এখনো দেন নি।’
‘কোন প্রশ্ন?’
‘কী ধরনের অ্যাক্সিডেন্ট হয়েছিল, স্যার- যাতে ইফতেখার সাহেব মারা গেলেন?’
‘লি-লিফট অ্যাক্সিডেন্ট’, আমি কোনোমতে উচ্চারণ করতে পারি।
‘সত্যি সত্যি অ্যাক্সিডেন্ট ছিল ওটা, স্যার? আপনাদের পুরানো অফিস বিল্ডিংয়ে না? ওটা তো ইনশিউরেন্স করা ছিল। লিফটটা হঠাৎ কীভাবে ঝুপ্ করে পড়ে গেল?’
‘সেটা আমি কীভাবে জানব? লিফটের দড়ি ছিঁড়ে পড়ে … ইনশিউরেন্সের লোক তো তদন্ত করেছিল। তারা কিছু পায় নি। তার মানে এটা সাধারণ দুর্ঘটনামাত্র।’
‘ইনশিউরেন্সের যারা এসেছিল তাদের একজন তো চাকরি ছেড়ে দিয়ে পরবর্তীতে আপনার কান্ট্রি রিপ্রেজেন্টেটিভ হয়েছে হংকংয়ে, তাই না স্যার? আর যারা লিফটটার মেশিনারিজ ট্যাম্পারিং করেছিল এদেরকেও তো খুব সাবধানে বাছাই করা হয়েছিল, খুব দক্ষ আর বিশ্বস্ত। কাজগুলো কিন্তু খুব নিখুঁত, স্যার। শয়তানকে আসলেই দক্ষ আর নিখুঁত হতে হয়, বোকা অদক্ষ লোক শয়তান হিসেবে খুব উঁচুমানের না।’
‘এসব আপনি কী বলছেন! আমি কেন এ কাজ করতে যাবো?’ কয়েক মুহূর্ত থমকে থাকার পর আমি চিৎকার দিয়ে উঠি। কোনো জবাব পাওয়া যায় না শুধু নিজের উচ্চারিত বাক্যের প্রতিধ্বনি নিজের কাছে ফিরে আসা ছাড়া, কিন্তু মনে হতে থাকে অদৃশ্য নারীকণ্ঠ বুঝি নিঃশব্দ হাসিতে ফেটে পড়ছে আমার অবস্থা দেখে। ‘আমার মতো একজন বিখ্যাত বিজনেস ম্যাগনেটকে ধ্বংস করার জন্য আপনাকে কে লেলিয়ে দিয়েছে আমার পেছনে? কগনেটের হারুন, ফিউচার ড্রিমসের জুলকারনাইন, খান সন্সের মোসাদ্দেক, এভারগ্রীনের তপন চক্রবর্তী- বলুন বলুন, কে? কী চান আপনি? কতো প্রয়োজন আপনার ব্যাংক অ্যাকাউন্টে? কতো কোটি আপনার মুখের ওপর ছুঁড়ে দিলে সরে যাবেন আমার পথ থেকে?’ আমি নিজের ওপর নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে চিৎকার করতে থাকি নিরুত্তর অদৃশ্য নারীর উদ্দেশ্যে। অক্ষম আক্রোশে পাগলের মতো দু’হাতে চুল ধরে টানতে থাকি, রাগের চোটে মুষ্ঠিবদ্ধ হাতে আঘাত করে চলি লিফটের দেয়ালে, ‘Tell me you irresistible whore, what do you want from me? Money, power or what?’
ঠিক তখনই আলো নিভে গিয়ে লিফটের ভেতরটা আবারও পুরো অন্ধকারে ছেয়ে গেল।
অন্ধকারের মধ্যে আমি হাতড়াচ্ছি, মনে হচ্ছে লিফটের চারপাশ সঙ্কীর্ণ হয়ে এসে চেপে ধরছে আমাকে, অক্সিজেনের অভাব অনুভূত হচ্ছে ফুসফুসের মধ্যে, আমি প্রাণপণে চিৎকার দিয়ে উঠতে চেয়েও পারছি না, এভাবে কয়েক সেকেন্ড কেটে যাওয়ার পরই লিফটের আলো ফিরে এলো। কোনো ম্লান ভূতুড়ে লাল, কমলা, বেগুনি অথবা নীলচে আলো নয়, একেবারে স্বাভাবিক সিলিং লাইট যেমনটা থাকার কথা ঠিক সেভাবেই এবং আমি খুব স্পষ্ট করে আবার দেখতে পাই লিফটের ভেতরটাকে। আমার পেছনে লিফটের মিরর ঠিক তেমনি যথাস্থানে আছে, লিফট ডোরের ঠিক ডান পাশে এলিভেটর প্যানেল দৃশ্যমান যেমনটি কিনা আগেই ছিল, আর তার মনিটরে তের স্পষ্ট জ্বলজ্বলে সংখ্যায় স্থির হয়ে আছে। আশপাশে কোথাও কোনো কণ্ঠস্বর নেই। সম্ভবত ইলেকট্রিসিটি চলে গিয়েছিল বিল্ডিংয়ের এবং জেনারেটরের মাধ্যমে সচল করা হয়েছে লিফট। তাহলে এতোক্ষণ ধরে যা দেখে কিংবা শুনে আসছিলাম: সেই পাতাল গহ্বরে রাহেলা আর তার মেয়ে শিখা, ঊর্ধ্বাকাশে নিউইয়র্কের পেন্থাউজে আমার স্ত্রী সামায়রা আর মেয়ে সানজিদা, হোটেলের স্যুটে দৃষ্টিকেতুর সাথে আখতার ফরিদের নগ্ন কামকেলি, পাসপোর্ট হাতে আমার ছেলের জেএফকেতে লন্ডন ফ্লাইটের অপেক্ষায় বসে থাকা, সর্বোপরি লিফটের ঐ অদ্ভূতুড়ে কণ্ঠস্বর- এসব তাহলে কী ছিল? এগুলো কি মাত্র কয়েক সেকেন্ডের বিদ্যুৎহীনতায় দুঃস্বপ্নের মতো হানা দিয়েছিল আমার মনের মধ্যে? আমি কি জাগ্রত অবস্থায় মাত্র কয়েক সেকেন্ড কল্পনার ভেতর সম্পন্ন করে এলাম এই নরক পরিভ্রমণ? সব কিছু তো এখন স্বাভাবিক, লিফটের দরজা আমার পেছনে বন্ধ হতে দেখার সময়ে যেমন ছিল ঠিক তেমনি। তার মানে এসবই আমার কয়েক মুহূর্তের দুঃস্বপ্ন ছাড়া আর কিছু ন্য়। বিষয়টা আমার বিশ্বাস হয় আবার হয়ও না, আমার মনে আছে তৃতীয় ভ্রমণের শেষভাগে আমার সর্বাঙ্গ ভরে উঠেছিল স্বেদবিন্দুতে, সর্বশরীর হয়ে পড়েছিল ঘর্মাক্ত। এখনো আমি এই সুটেড-বুটেড অবস্থায় পিঠের ওপর দিয়ে ঘামের ধারা নিঃশব্দে নিচে নেমে যাওয়ার শীতল অনুভূতি টের পাচ্ছি, আমার শার্ট, তার নিচে স্যান্ডো গেঞ্চি, আমার অন্তর্বাস- সব ঘামে ভিজে একাকার হয়ে উঠেছে সেটা স্পষ্ট অনুভব করছি। মাত্র কয়েক সেকেন্ডের দুঃস্বপ্নে এমনটা হবে কেন?
কী হয়েছে না হয়েছে এখনই প্রমাণ করা যায়। আমার স্পষ্ট মনে আছে যখন লিফটে উঠছিলাম তখন ঘড়িতে একটা পঁয়ত্রিশ বাজে। এখনই দেখে নেয়া যায় একবার ঘড়িটা, কয়টা বেজেছে দেখলেই বুঝতে পারব এতোক্ষণ যা ঘটল আমার চারপাশে সেটা বাস্তব নাকি কল্পনা অথবা দুঃস্বপ্ন? কল্পনা হওয়ার সম্ভাবনা যদিও বেশি, কিন্তু মাত্র কয়েক সেকেন্ডের ভেতর এতোগুলো দৃশ্য চোখের সামনে সিনেমার মতো করে দেখতে পারার এই যে অসম্ভব কল্পনাশক্তি তার কথা চিন্তা করে আমি নিজেই হতবাক না হয়ে পারি না।
আমার ডান হাতের তর্জনি এগিয়ে যায় লিফটের গ্রাউন্ড ফ্লোরের বাটনে চাপ দিতে, ঠিক একই সময় বাঁ হাতে ঝাঁকি দিয়ে আস্তিন গুটিয়ে আনতে থাকি কবজিতে ঝোলানো রোলেক্সে সময়টাকে দেখব বলে, ঠিক এমনি সময়ে মাথার কাছে একটা খুট্ শব্দ হলো। শব্দটাকে হয়তো পাত্তা দিতাম না, যদি শব্দের সাথে সাথে লিফটটাও মোটামুটি জোরে ঝাঁকি দিয়ে না উঠত। আমি মাথার ওপরে তাকাই, দেখি সিলিং লাইট বেশ সময় নিয়ে মিটমিট করে উঠল একবার, সেই সাথে ঠাস্ ঠাস্ শব্দ কোথাও, ক্ষণিকের জন্য মনে হলো যেন শক্ত ধাতব রশি কাটছে মাথার ওপর কেউ ধারালো বৈদ্যুতিক করাত দিয়ে এমন একটা শব্দ শুনতে পেলাম এবং এরই সাথে ভীষণ বেগে দুলে উঠল লিফট। সেই সাথে এতো জোরে একদিকে কাত হলো সেটা যে আমি নিক্ষিপ্ত হলাম লিফটের মেঝেয় এবং হ্যান্ডেলের সাথে প্রচণ্ড জোরে ঠুকে গেল কপাল। সাহায্যের জন্য ডেকে উঠতে চাইলাম প্রাণপণে কিন্তু কোনো শব্দ বেরোলো না বিশ্বাসঘাতক কণ্ঠ থেকে। লিফটটা আটকে আছে শ্যাফটের ভেতর পেছনের ডান পাশ কিছুটা ঢালু অবস্থায়, আমি খুব বেকায়দাভাবে হাত-পা ছড়িয়ে পড়ে আছি মেঝের ওপর, টের পাচ্ছি কপাল ফেটে গিয়ে চোখের ওপর নেমে আসছে রক্তধারা, হাত-পা নাড়িয়ে চেষ্টা করছি উঠে দাঁড়ানোর জন্য। এমন সময় আবার একটা প্রচণ্ড শব্দ এবং আরও একবার প্রচণ্ডভাবে লিফটের দুলে ওঠা।
মাত্র কয়েকটা সেকেন্ড। এরপরই ভয়ঙ্কর শব্দে চারিদিক প্রকম্পিত করে তুমুল বেগে হুড়মুড় করে লিফটটা আমাকে সমেত পড়তে শুরু করল নিচের দিকে।
তারপর ইলেকট্রিক বিল জমা দিতে যাবো। আমার দেরি হবে আসতে। স্বামী অমর বলে, ঠিক আছে।…..
নভেম্বর চলছে। অনির সাথে আজ দেখা হবে তা জানাই ছিল। এই তো ক’দিন আগেই দেখা…..
বুড়িমাসি বলেন,জীবনটা বালির ঘর গো।ঢেউ এলে ধুয়ে যায় জীবনের মায়া।তবু বড় ভালবাসা ওদের দাম্পত্যে।রোদের চাদরের…..
এক ড্রইং রুমে বসে রয়েছে সদ্য কিশোর উত্তীর্ণ তরুণ গোয়েন্দা সজীব। সামনের টেবিলে ছড়িয়ে…..