লুই বুনুয়েল: চলচ্চিত্রের মহত্তম শিল্পী

ফারহানা রহমান
চিত্রকলা, সৌরভ মিত্র-এর প্রবন্ধ
Bengali
লুই বুনুয়েল: চলচ্চিত্রের মহত্তম শিল্পী

“God and Country are an unbeatable team; they break all records for oppression and bloodshed.”

–  Luis Bunuel

লুই বুনুয়েল

নৈতিক সত্যের গভীরতা অন্বেষণই যদি একজন প্রকৃত শিল্পীর মানদণ্ড হয়ে থাকে তাহলে চলচ্চিত্রকার লুই বুনুয়েলকে অবশ্যই একজন মহত্তম শিল্পী বলা যায়। চলচ্চিত্র নির্মাতা হিসেবে তিনি সারাজীবনব্যাপী অসাধারণ সব চিত্রকল্প সৃষ্টি করার অলৌকিক ক্ষমতা দেখিয়েছেন। তাঁর চিত্রকল্পগুলো তাঁর সময়কার স্পেনের সমষ্টিগত মানসিকতার সঙ্গে এবং মানবজাতির আত্মপ্রতারণার রহস্যজনক ইতিহাসের সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত। ১৯০০ খ্রিস্টাব্দের ২২ ফেব্রুয়ারি স্পেনের তেরুয়েল রাজ্যের তৎকালীন ক্ষুদ্র শহর কালান্দার একটি উদার সংস্কারমুক্ত ভূম্যধিকারী বুর্জোয়া পরিবারে লুই বুনুয়েল পোর্টোলেস জন্মগ্রহণ করেন। বিংশ শতাব্দীর প্রারম্ভিক পর্যায় পর্যন্ত একদিকে শিল্পে যৌন উদ্দীপনা-উদ্দিপক সমৃদ্ধির ধারনায় এবং অন্যদিকে সুগভীর মৃত্যুকেন্দ্রিক নিবিষ্টতার ধারণায় যতদিন স্পেন নিবিড়ভাবে আবিষ্ট হয়ে ছিল, বুনুয়েলের জীবদ্দশায় তিনি ততদিন এদুটো ব্যাপারকেই প্রতিধ্বনিত করে গেছেন। যদিও তিনি বেড়ে উঠেছিলেন একটি কঠোর ধর্মীয়  পরিমণ্ডলে, তথাপি কোন এক বিচিত্র কারণে খুব ছোটবেলা থেকেই ধর্মের গোঁড়ামির প্রতি তাঁর বিরূপ ধারণা জন্মায়। তবে ১৯০৬ থেকে ১৯১৫ পর্যন্ত সারাগোসায় জেসুইটদের পরিচালিত স্কুলে পড়ালেখা করাকালীন সময়ে তাঁর মধ্যে ধর্মীয় বিশ্বাস, রীতিনীতি সম্পর্কে এক ধরণের ভয়ানক বিরূপ প্রতিক্রিয়া জন্মায়। ফলে প্রাতিষ্ঠানিক ধর্মের নানা কাজে তিনি বিরক্ত হয়ে ওঠেন। ধর্মের  অর্থনৈতিক ও সামাজিক ক্ষমতাও তাকে অস্বস্তিতে ফেলে দেয়। তাই বাকি জীবন তিনি গির্জা, রাষ্ট্র ও তার মধ্যে প্রোথিত সামাজিক কাঠামোকে আক্রমণ করে গেছেন। তার মতে, তথাকথিত ভদ্রসমাজ মানুষের স্বাভাবিক আকাঙ্ক্ষাকে দমন করে রাখে, যার ফলে সমাজে  নানা বিশৃঙ্খলা দেখা দেয়।

সিনেমাটিক স্যরিয়েলিজমের জনক এ স্প্যানিশ পরিচালক তার সারাজীবন ধরে তাঁর ক্যারিয়ার বা কাজের মাধ্যমে বিদ্রোহ করে গেছেন। বুনুয়েলের কথায়,

আমাদের এ  দুনিয়া এতটাই বাজে যে, এখানে শুধু সামনে একটা পথই খোলা আছে বিদ্রোহ।

উক্তিটির মধ্যেই এ কিংবদন্তি পরিচালকের জীবন ও কর্মকাণ্ডের সারসংক্ষেপ পাওয়া যায়।

একজন বলিষ্ঠ শিল্পীর মতোই লুই বুনুয়েল আধুনিক বিশ্বের বুর্জোয়া শ্রেণীর সমস্ত রকমের কৃত্রিম নৈতিকতা আর পতনের মুখোশটা  বারবার টেনে হিঁচড়ে খুলে দিয়েছেন। বাইরে থেকে আমরা যে সভ্যসমাজকে দেখি, বুনুয়েলের মতে সেটা হচ্ছে আপাত পরিচ্ছন্ন পোশাকে আবৃত একদল কুৎসিত মানুষের আবাস। অথচ এর অন্তরালে রয়েছে অত্যাচার, দুর্দশা, নিরাশা, নাস্তকতাসুলভ অসারতা এবং উচ্চবিত্ত মানুষের অমার্জিত আচরণ। আর তারই তলায় রয়েছে অবহেলিত দরিদ্র মানুষের ক্ষুধার তাড়না, দুর্ভোগ আর ফেটে পড়ার বাসনা। তিনি আমাদেরকে দেখিয়েছেন সভ্যতার এই অদ্ভুত বৈষম্য আর কদর্যতার প্রকৃতরূপ এবং আধুনিক বস্তুবিশ্বের এই সর্বাত্মক বিনাশ আর ক্ষয়কে। স্পেনের চরম আবহাওয়া আর সংস্কৃতি, সমুদ্রে ঘেরা পরিবেশের এক উত্তাল জীবনে বুনুয়েল জন্মেছিলেন। এই পরিবেশের পাশবিক নৃশংসতা আর সৌজন্যমূলক মর্যাদার অদ্ভুত মিশ্রণ একধরণের বৈপরীত্যের জন্ম দিয়েছিল। অন্যান্য সব স্যরিয়ালিস্টিক শিল্পীদের মতোই বুনুয়েলের কাজগুলোতেও আমরা দেখতে পাই নম্র-শোভন, সুকুমার প্রতিচ্ছবির পাশাপাশি প্রচণ্ড এক  তীব্রতার অদ্ভুত প্রতিভাস।

তিনি ১৯১৭-২০ সাল পর্যন্ত মাদ্রিদের রেসিদেন্সিয়া দে এস্তদিয়ান্তেস এ পড়াশোনা করেন। ১৯২২ সালের শুরু থেকেই তিনি নিজেকে সাহিত্যের সাথে পুরোপুরি জড়িয়ে ফেলেন এবং নানা পত্র পত্রিকায় নিয়মিত লিখতে শুরু করেন।  ১৯২৪ সালে মাদ্রিদ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতক ডিগ্রী লাভ করেন। পিতার মৃত্যুর ১৯২৫ এ তিনি জ্যাঁ এপস্তারের আমন্ত্রণে তাঁর ছবির সহকারী হিসেবে কাজ করার জন্য পারিতে যান। এ সময় তিনি জড়িত হন সে- সময়কার স্প্যানিশ কবিদের দল ‘লা জেনারেশন ডেল ২৭’ (১৯২৩-১৯২৭) এর সঙ্গে। এই দলেই পরিচিত হন কবি ফেডিরিকো গারসিয়া লোরকা, র‍্যামন গমেজ ভিলাসেরনসে, আলবেরতি ও সালভাদর দালিসহ সে-সময়ের স্পেনের তরুণ সৃজনশীল শিল্পীদের সঙ্গে। এখানেই মূলত আঁভগার্দ আন্দোলনের অন্যান্য শিল্পতত্ত্বের সঙ্গে পরাবাস্তববাদের ব্যাপারেও বুনুয়েলের জানাশোনা শুরু হয়। সেসময় লোরকা ও দালির সঙ্গে বন্ধুত্ব বুনুয়েলের জীবন ও ক্যারিয়ারকে গভীরভাবে প্রভাবিত করেছিল বলে মনে করা হয়।

স্যরিয়ালিজম হলো আঁভগার্দ এর একেবারে প্রথম দিককার ধারা। বিশের দশকে ফ্রান্সের আঁদ্রে ব্রেতো মূলত এই ধারার সূচনা করেন । অযৌক্তিক মনের স্বপ্ন, সত্য, গোপন কল্পনা, ইমেজের আবেগ, ব্যক্তিগত কামনা বা যৌনতা প্রভৃতিই পরাবাস্তববাদের স্বাভাবিক লক্ষণ বলে  ধরে নেওয়া হয়। পরাবাস্তববাদ আধুনিক শিল্প আন্দোলনের এক অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ পর্যায়। এরই আলোকে বাস্তবতাকে দেখার জন্য যেসব শিল্প আন্দোলন শুরু হয় তা হচ্ছে কিউবিজম, ফিউচারিজম, দাদাবাদ, পরাবাস্তববাদ। এছাড়াও অভিব্যক্তিবাদসহ আরও নানা বিষয়কে  শিল্পে, সাহিত্যে, চলচ্চিত্রে, চিত্রকলায় প্রয়োগ ও বিকশিত করার যে প্রক্রিয়া তাকেই আঁভগার্দ হিসেবে বর্ণনা করা যায়।

১৯২৮ সালে মা’র কাছ থেকে টাকা জোগাড় করে তিনি এবং সালভাদর দালি ‘অ্যান আন্দালুসিয়ান ডগ’ নামে একটি  নির্বাক সিনেমা তৈরি করেন। এটিকে বলা হয় চেতনা –অবচেতনার যুক্তিনিষ্ঠ বুদ্ধিদীপ্ত একটি ছবি। সিনেমাটিতে ব্লেড দিয়ে চোখ কাটার একটা দৃশ্য ছিল। সেই সম্পর্কে বলতে গিয়ে বুনুয়েল জানান যে তিনি  একদিন রেস্টুরেন্টে খেতে বসে বন্ধু দালিকে এক অদ্ভুত স্বপ্নের কথা জানালেন সেটি হচ্ছে, তিনি দেখলেন ‘চাঁদকে নাকি এক ফালি মেঘ এসে চিড়ে দিয়েছিল এমনভাবে, ঠিক যেন ক্ষুরের ব্লেড চিড়ে দিচ্ছে কারও চোখ।’ জবাবে দালি জানালেন, তিনিও আজব এক স্বপ্ন দেখেছেন, অগুনতি পিঁপড়ার ভেতর হামাগুড়ি দিয়ে যাচ্ছে একটি হাত। দালির স্বপ্নের কথা শোনা মাত্রই বুনুয়েল বলে উঠলেন, ‘এটাই তো সিনেমা; চলো, বানিয়ে ফেলি!’ বুনুয়েল মূলত এ সিনেমা দিয়ে বুর্জোয়া মনোভাবাপন্ন মধ্যবিত্ত তরুণদের অপমান করতে চেয়েছিলেন। এছবি প্রসঙ্গে বলতে গিয়ে আঁদ্রে ব্রেতো বলেছিলেন,

ভালোবাসার এই ভয়ঙ্কর, নিষেধহীন মুখকে নির্মোক থেকে নগ্ন করার জন্য আধুনিক শিল্পের প্রাণপণ প্রয়াস এটি

এরপর ১৯৩০ সালে তিনি ‘লাজ দ্য’ বা ‘দ্য গোল্ডেন এজ’ ছবিতি তৈরির পর এম যে এম থেকে ছবি করার আমন্ত্রণ আসে ফলে তিনি হলিউডে চলে যান। ‘ দ্য গোল্ডেন এজ’  ছবিটি আধুনিক জীবনের উন্মত্ততা, বুর্জোয়া সমাজের যৌনবিকৃতি ও ধর্মীয় প্রাতিষ্ঠানিকতার মূল্যবোধের এক তীর্যক চিত্র, এক অন্যতর প্রতিবাদনামা। এ ছবিতে তিনি দেখাতে চেয়েছেন সমাজের প্রকৃত ইতিহাস। যেখানে  অপ্রাসঙ্গিক কারণে মানুষের অচেতন আকাংখ্যাগুলো চিরন্তন হয়ে থাকে। যৌন কামনাকেই ‘ দ্য গোল্ডেন এজ ’ এ মানুষের একমাত্র গতিশীল শক্তি হিসেবে দেখানো হয়,  যেখানে সে সভ্যতাকে অস্বীকার করে। সভ্যতার নিজের কোন ইতিহাস বা শক্তি নেই। ইতিহাস  কতগুলো নিপীড়ক শক্তির সমাহার যাকে সামগ্রিক অভ্যুত্থান নাড়াতে পারেনা।  এ সিনেমায় দেখা গেল পরিবার, গির্জা ও সমাজের নানা  ভণ্ডামিকে মোকাবেলা করে একটি যুগল তাদের সম্পর্ককে চালিয়ে যেতে চেষ্টা করছে। সিনেমার প্রিমিয়ারে হামলা করেছিল ফ্যাসিস্টরা। তারা সিনেমা হলের পর্দায় কালি লেপে দেয়, আসন ছিঁড়ে ফেলে এবং অনেক থিয়েটারে বোমা হামলা পর্যন্ত করে। ভ্যাটিকান সিটি থেকে  বুনুয়েলকে খ্রিস্টান সমাজ থেকে বহিষ্কার করার হুমকিও দেওয়া হয়। সিনেমাটির প্রদর্শনী বন্ধ করে দেয়া হয়। বহুবছর পর ১৯৭৯ সালে সিনেমাটির প্রদর্শনী আবার শুরু হয়। ১৯৩১ সালে তিনি আবারো হলিউড থেকে পারিতে ফিরে আসেন।

বুনুয়েলের পরবর্তী কাজ ছিল সুররিয়েলিস্ট প্রামাণ্যচিত্র ‘লা হার্দেস’ ১৯৩৩ সালে তিনি পারিতে প্যারামাউন্ট প্রযোজক সংস্থার হয়ে কাজ করেন। ‘লা হার্দেস’ সিনামাটিতে দেখানো হয় স্পেনের উত্তরাঞ্চলের সমাজবিচ্ছিন্ন একটি হতদরিদ্র অঞ্চলকে। এই অঞ্চলটিকে  বুনুয়েলের রাজনৈতিক ও ঐতিহাসিক পালাবদল থেকে বিচ্ছিন্ন মনে হয়। এই অঞ্চলের কৃষকদের শ্রম হচ্ছে প্রথমবারের জন্যে এক বিরোধী প্রকৃতিকে বস করার চেষ্টা, যে প্রচেষ্টা অনিবার্যভাবে ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয় এবং তাদের অসম্পূর্ণ সমাজ আবার শূন্যাবস্তায় ফিরে যায়। কৃষকদের জীবন যেন ক্ষুধা ব্যাধি থেকে পঙ্গুতা ও মৃত্যু পর্যন্ত এক ভয়ঙ্কর ক্রমপরিণতি। এখানে সময় কোন সমৃদ্ধি আনেনা, আনেনা মৃত্যু ব্যতীত কোন সংবাদ।

এরপর অর্থাৎ ১৯৩২ থেকে ১৯৫০ পর্যন্ত প্রায় আঠারো বছর বুনুয়েল নিজেকে নানারকম কাজের সাথে জড়িয়ে রাখেন। ১৯৩৫ সালে মাদ্রিদের ফিল্মোফোনো সংস্থার কার্যনির্বাহী প্রযোজক হিসেবে মিউজিক্যাল ও কমেডি ছবির তত্ত্বাবধায়ক হিসেবে কাজ করেন। ১৯৩৬- ৩৯ পর্যন্ত স্পেনের গৃহযুদ্ধের সময় রিপাবলিকান সরকারের হয়ে কাজ করেন। হলিউডে যান যুদ্ধ বিষয়ে তথ্যচিত্রের কাজে তত্ত্বাবধানের জন্য। সে সময়কার ছবিগুলো অসম্পূর্ণ রয়ে যায়। নিউ ইয়র্কের মিউজিয়াম অফ মডার্ন আর্টের হয়ে ১৯৩৯-৪২ সাল পর্যন্ত লাতিন আমেরিকায় দেখানোর জন্য ছবির পুনরসম্পাদনা, শব্দ পুনরযোজনা ও পরিচালনার কাজ করেন। মাঝেমধ্যে ছবির ডাবিং করেন। ১৯৪২ সালে কমিউনিস্টদের সাথে যোগাযোগ আছে সন্দেহে নিউ ইয়র্কের মিউজিয়াম অফ মডার্ন আর্ট থেকে বরখাস্ত হন। ৪৪ সালে হলিউডে এসে ওয়ারনার ব্রাদার্সের হয়ে স্পেনে থাকাকালীন সময় চারটি ছবি পরিচালনা করেন। ১৯৪৬ সালে মেক্সিকো ফিরে যান। ৪৭-৬০ সাল পর্যন্ত মেক্সিকোতে ‘লা হাইজা দেল এঞ্জানো’ ‘ সুসানা’ দুটি ব্যবসাসফল ছবি করেন। পরবর্তীতে নির্মাণ করেন ‘সুবিদা আল সিয়েলো’।  ৫২ তে  সিনামাটি কান উৎসবে সেরা আঁভগার্দ পুরষ্কার পান। ৫১ সালে ‘লস অলভিদাদোসে’ র জন্য কান চলচিত্র উৎসবে সেরা পরিচালকের পুরষ্কার এবং আন্তর্জাতিক সমালোচক সংস্থার পুরষ্কার পান। ১৯৫২ তে এসে তৈরি করেন ‘দ্য এডভেঞ্চার অব রবিনসন ক্রুসো’ এবং  ১৯৬০ এ ‘দি ইয়াং ওয়ান’। এরপর ‘এল’। এটি একটি সম্পূর্ণ অন্য মেজাজের ছবি।

গৃহযুদ্ধ শেষে দীর্ঘদিন নির্বাসনে থাকার পর বুনুয়েল এবার হলিউডে এসে স্থায়ীভাবে বসবাস শুরু করেন। এখানে তিনি বাণিজ্যিক ধারার হলিউডি সিনেমায় বিভিন্ন ভাষায় সাব-টাইটেলের কাজ করতেন। এরপর হঠাৎই চাকরি পেয়ে যান মিউজিয়াম অব মডার্ন আর্ট নামের একটি প্রতিষ্ঠানে, ফলে তাকে হলিউড ছেড়ে নিউইয়র্কে চলে আসতে হয়। সেখানে কিছু সমস্যা হওয়ায় তিনি আবার হলিউডে ফিরে আসেন। এখানেই তিনি ওয়ার্নার ব্রাদার্সের ডাবিং বিভাগে ১৯৪২ থেকে ১৯৪৬ সাল পর্যন্ত কাজ করেছেন। এরপর ওয়ার্নার ব্রাদার্সের চাকরি ছেড়ে দিয়ে সে-বছরই বুনুয়েল পাড়ি জমান মেক্সিকোতে। বাকি জীবন মেক্সিকোতেই ছিলেন বুনুয়েল। তবে সিনেমা নির্মাণ করেছেন ফ্রান্স ও স্পেনেও।

১৯৫৩ সালে ‘দ্য ক্রিমিনাল লাইফ অব আরচিবল্ডো দিলা ক্রুজ’ এর পর উল্লেখযোগ্য ছবি হিসেবে বলা যায় ‘নাজারিন’ কে এই ছবি দেখে সিনামার দর্শকরা আবারো ভীষণভাবে ধাক্কা খেলো। এটি তাঁর শিল্পকরমের মধ্যে সবচেয়ে বিতর্কিত ছবি। এ ছবিতি সম্পর্কে  বলতে গিয়ে ঋত্বিক ঘটক মন্তব্য করেছিলেন, ‘বুনুয়েলের এই ছবিতি একটি সভ্যতার মিথ্যাচরণের চরম দলিল’। বুনিতো পেরেজ গালদোসের বিখ্যাত উপন্যাস নাজারিনকে উপলক্ষ করে লুই বুনুয়েল এবং জুলিও আলেজান্দ্রোর যৌথ উদ্যোগে নাজারিন চিত্রনাট্যটি লিখেন। লুই বুনুয়েল এটিকে ১৯৫৯ সালে ম্যাক্সিকান চলচ্চিত্রে রূপান্তরিত করেন যা ১৯৫৯ সালের কান ফিল্ম ফেস্টিভ্যালের ৩২তম একাডেমি এওয়ার্ডসে শ্রেষ্ঠ বৈদেশিক ভাষা চলচ্চিত্রের জন্য মেক্সিকান এন্ট্রি হিসেবে নির্বাচিত হয়  এবং আন্তর্জাতিক পুরস্কার জিতে নেয়। যদিও নাজারিন বুনুয়েলের সবচেয়ে বিখ্যাত চলচ্চিত্রগুলির মধ্যে অন্যতম নয় তথাপি এটি অত্যন্ত বিখ্যাত একটি সিনামা। প্রখ্যাত চলচ্চিত্র পরিচালক আন্দ্রেই তারকোভস্কি নাজারিনকে তার প্রিয় ১০টি সিনামার একটি হিসেবে বিবেচনা করেন।

‘নাজারিন’ এ আমরা দেখতে পাই পাদ্রী নাজারিও স্প্যানিস ঐতিহ্যের একজন রোমান ক্যাথলিক পুরোহিত যিনি শহরের দরিদ্রতম  এলাকার একটি হোটেলে থাকেন। ঈশ্বরের প্রতি গভীর ভরসা ও বিশ্বাস নিয়ে তিনি সকলের সাহায্যে এগিয়ে যান এবং ধৈর্য সহকারে অন্যায়কারীকে নানা উপদেশ দিতে থাকেন। নানা ঘটনার পরিপেক্ষিতে তিনি একসময় শহরের জেলহাজতে আটক হন। বিনা কারণে পাদ্রী নাজারিওকে চোররা মারতে থাকলে একজন বড় চোর এসে তাঁকে উদ্ধার করে। রাতে শুয়ে শুয়ে নাজারিও ভাবে যে বড় চোরটা যত খারাপ কাজই করুক না কেন আসলে সে একজন ভালো মানুষ। জেল থেকে ছাড়া পেয়ে হাঁটতে থাকলে একজন ফলওয়ালির তাঁকে দেখে মায়া হয় এবং তাঁকে একটি আনারস খেতে দেয়। প্রথমে নিতে না চাইলেও ক্ষুধার্ত নাজারিও অশ্রুসজল চোখে ফলটি নিয়ে সেদিকে তাকিয়ে থাকে। জীবনের এ পর্যায়ে এসে ঈশ্বর বিশ্বাসে ভরপুর নাজারিওর ভিতর থেকে যিশুখ্রিস্ট সুলভ ইমেজটা ভেঙে চুরমার হয়ে যায় এবং তাঁর প্রকৃত মনুষ্যোচিত চেহারাটা বেরিয়ে আসে। এ ছবিতে বুনুয়েন ধর্মান্ধতা, মূর্খতা, আর প্রকৃত মনুষ্যত্ববোধের অন্তর্নিহিত সত্যটাকে অসাধারণ দক্ষতায় প্রকাশ করেছেন।

এরপর ১৯৫৮ থেকে ১৯৭৭ পর্যন্ত এই উনিশ বছরে আরও এগারোটি ছবি নির্মাণ করেন। ১৯৬১ তে স্পেনের সরকারের আমন্ত্রণে স্পেনে গিয়ে তৈরি করেন ‘ভিরিদিয়ানা’ কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত স্পেনে ছবিতি প্রদর্শিত করতে দেওয়া হয়না। তবে একইবছর ছবিটির জন্য যুগ্মভাবে কান চলচ্চিত্র উৎসবে সেরা পুরস্কারটি পান। ৬৫তে ‘সাইমন অফ দ্য ডেজারট’ এর জন্য ভেনিস উৎসবে রৌপ্য সিংহ পান। ১৯৬৭ ‘বেল দ্য জ্যু’ এর জন্য ভেনিস উৎসবে স্বর্ণ সিংহ পান। ১৯৬০ থেকে ৭০ এ সময়টিতে বুনুয়েল মূলত ফ্রান্স ও ইতালিতে ছবি করেন। যদিওবা তিনি বাস করেন ম্যাক্সিকোয়।  ১৯৭২ সালে নির্মাণ করেন তার আলোচিত ফরাসি সিনেমা ‘ডিসক্রিট চার্ম অব দ্য বুর্জোয়া’। একদল ধনী একসঙ্গে খেতে গিয়ে নানা ঝামেলা করছেন- তাদের চরিত্রকে নানাভাবে দেখানোই ছিল বুনুয়েলের এ সিনেমার গল্প। এ সিনেমা সেরা বিদেশী সিনেমার ক্যাটাগরিতে অস্কার পেয়েছিল। ১৯৭৭ সালে ৭৭ বছর বয়সে তিনি তাঁর শেষ ছবি ‘দ্যাট অবসকিওর অবজেক্ট অব ডিজায়ার’ নামক এক অসাধারণ ছবি তৈরি করেন। চরম নৈপুণ্যতা এবং দক্ষতার সাথে তিনি তাঁর শেষ ছবিতি পরিচালনা করেন। ছবিতি দর্শকে প্রথম থেকে একেবারে শেষ পর্যন্ত মন্ত্রমুগ্ধের মতো আকৃষ্ট করে রাখে। এটিকে তাঁর চলচ্চিরের সবচেয়ে বিস্ময়কর অগ্রগতির অন্যতম চূড়ান্ত মনোমুগ্ধকর ছবি হিসেবে ধরা হয়। এটি হল যৌনতার রাজনীতি ও বুর্জোয়া নৈতিকতার কাঙ্ক্ষিত কাহিনীকে নাগালের বাইরে রেখে কষ্ট পাওয়ার এক বিশেষ অনুভূতিসম্পন্ন ছবি।

মহান এই বিচিত্রমনা চলচ্চিত্রনির্মাতা ১৯৮৩ সালের ২৯ জুলাই মেক্সিকোতে মৃত্যুবরণ করেন। ৫৩ বছর ধরে চলচ্চিত্রের পর্দায় রূপ-অরূপের দ্বন্দ্বে মানবসভ্যতা আর মানুষের জীবনের সত্যটাকে খুঁজে ফিরেছেন নানা আঙ্গিকে। আশ্চর্যের বিষয় হলো, আজীবন সাধারণভাবে চলা বিশ্ববরেণ্য এই মানুষটির সৎকারের সময়টিতেও ছিলোনা কোন আড়ম্বর। এই অনুষ্ঠানে স্ত্রী, পুত্রসহ কাছের মাত্র ৫০ জন লোক অংশ নিয়েছিলো। জীবনের শেষ সপ্তাহগুলো তিনি মেক্সিকোয় কাটিয়েছিলেন। এ সময়টা এক ক্যাথলিক পাদ্রির সঙ্গে ধর্মতত্ত্ব নিয়ে নানাধরনের আলোচনায় মত্ত হয়েছিলেন তিনি ।

নিজের আত্মজীবনী ‘মাই লাস্ট ব্রিদ’ এ নিজের জীবন দর্শন সম্পর্কে বর্ণনা করতে গিয়ে চিরবিদ্রোহী লুই বুনুয়েল বলেন,

‘সুযোগ আর রহস্যের মাঝেই কোথাও কল্পনা লুকিয়ে থাকে। এ কল্পনাই আমাদের স্বাধীনতাকে রক্ষা করে, যদিও মানুষ তাদের কল্পনাকে ঝেড়ে ফেলতে চায় আবার অনেকে কল্পনাকে একেবারে কবর দিতে চায়।’

 

ঋণস্বীকার:
1. My Last Breath
2. The Criterion Collection -1977
3. The World of Luis Bunuel -1978
4. Wikipedia,
5. ধীমান দাশগুপ্তের চলচ্চিত্রের অভিধান।

ফারহানা রহমান। কবি ও গল্পকার। জন্ম ঢাকায়।  পিতা- মরহুম শেখ রহমত উল্লাহ ও মাতা- সালমা বেগম। লেখাপড়া করেছেন পল্লবী মডেল হাই স্কুল, লালমাটিয়া মহিলা কলেজ ও ইডেন মহিলা কলেজ। ইংরেজি সাহিত্যে পোস্ট গ্র্যাজুয়েট। কৈশোরে সাহিত্যের প্রতি আকর্ষণ থেকেই কবিতা লেখালেখির শুরু। সেই...

এই বিভাগের অন্যান্য লেখাসমূহ